নাম: মো: ইসমাইল হোসেন সিরাজী
সাংগঠনিক মান: সাথী
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১২ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫।
পিতার নাম: মো: ছবেত আলী মুন্সী
সর্বশেষ পড়াশুনা: ১ম বর্ষ সম্মান, বাংলা বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: সরকারী চাকুরী।
শহীদ হওয়ার স্থান: হবিবুর রহমান হলের সামনের মাঠ।
আঘাতের ধরন: স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে বুক ঝাঁঝরা।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রদল।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: চালা, ডাক: বেলকুচি, থানা: বেলকুচি, জেলা: সিরাজগঞ্জ।
ভাইবোন : ৭ জন।
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান: ছোট।
পরিবারের মোট সদস্য: ৯ জন।
পিতা: জীবিত, পেশা: ব্যবসা।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: শহীদ ইসমাইল তার শাহাদাতের পূর্ব দিন ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ বলেছিলেন, “যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাতিলের সঙ্গে আগামী কাল লড়াই হয় তাহলে আমি শাহাদত বরণ করবো।”
শাহাদতের পর শহীদের পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া: শহীদের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার সাথে সাথে শহীদের মাতা বেঁহুশ হয়ে পড়ে যান। পিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলতে থাকেন, “আমার ইসমাইল মরেনি। মরতে পারে না।”
শহীদ ইসমাইলের আম্মা যা বললেন...
শৈশব ও কৈশোর জীবন কেটেছে বেলকুচি থানার আলো বাতাসে। আসে- আসে- গড়ে উঠেছে প্রকৃতির মত। নম্র, ভদ্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী এক জান্নাতী যুবক নাম তার ইসমাইল হোসেন সিরাজী। চার ভাই তিন বোনের সবার মাঝে ছোট। পিতা তাঁত ব্যবসায়ী, মাতা গৃহিনী। বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের এক নৈসর্গিক দৃশ্য বেলকুচির তাঁত। রাস-ার দুইধারে কিংবা বসত বাড়ির সুবিধা মত জায়গায় তাঁত আর তাঁত। পথ চলছি দুটো মটর সাইকেল যোগে। শহীদের বাড়ি পৌঁছার পূর্বে দেখতে পাওয়া যায় দেলুয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসা থেকেই শহীদ ইসমাইল দাখিল পাশ করেছিলেন। তাই মাদ্রাসায় নামলাম। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে ইসমাইল ভাই সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, “শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ছিল খুব নম্র, ভদ্র। তার ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম ছিল আব্দুল হালিম। ইসমাইল এবং হালিম আমার কাছে আরবী ব্যাকরণ পড়ত। পড়াশুনায় ইসমাইলের তুলনায় হালিম কিছুটা ভাল ছিল। হালিমের দেখাদেখি ইসমাইলও পড়াশুনায় জোর দিল। আমি তাদের দু’জনকেই ভালভাবে পড়াশুনার জন্য উৎসাহ দিতাম। ফলে দুইজনই পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিয়েছিল। বাড়ি আসলেই সে আমার সঙ্গে দেখা করত ও খোঁজ খবর নিত। আমিও তার কাছে তার পড়াশুনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক অবস'ার খোঁজ খবর নিতাম। শাহাদাত বরণের কয়েক দিন পূর্বেও তার সাথে আমার কথা হয়েছিল।” অধ্যক্ষ সাহেবের কথাগুলো সহজ সরল হলেও তা ছিল হৃদয়গ্রাহী ও খুবই বেদনাবহ। এই মাদ্রাসা থেকেই তিনি ১৯৯০ সালে মানবিক শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে দাখিল পাশ করেছিলেন। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বেলকুচি গোরস'ানে শহীদ ইসমাইল চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
বাড়ি যাবার পথেই গোরস'ান। সুতরাং কবর জিয়ারত করে যাওয়াকে সবাই ভাল মনে করল। পৃথিবীর আর কিছু দেখলে ভয় হোক আর না হোক গোরস'ানের দিকে তাকালে সবার কম বেশি ভয় হয়। কত পুরুষ, নারী ও শিশু প্রতিবেশির মত বসবাস করছে গোরস'ানে।
তাদের দিন হয়না শুধু রাত আর রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, ঘর-সংসার, হাট-বাজার নেই ওদের। অনেকেই হয়ত শানি-র পরশে ঘুমাচ্ছে। কিয়ামাতের পূর্বে ডাকলেও আলস্যে বলবে, “উহ্! এই মাত্র ঘুমালাম, দিলেত আমার ঘুমটা নষ্ট করে।” আবার অনেকেই দুনিয়ার অর্থ, যৌবন আর প্রবৃত্তির হেয়ালিপনার খেসারত দিতে শশব্যস-। কবর জিয়ারতের সময় এক আশ্চর্য ও সৌভাগ্যজনক ভাবে শহীদের পিতা আমাদের সাথে শরীক হলেন। তখন ভীষণ আনন্দে আমাদের হৃদয় পুলকিত হচ্ছিল। কিন' শহীদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ পিতা হাত তুলেছেন আমাদের সাথে। কি যে বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কথার চেয়ে সবাই মিলে হাউমাউ করে অবুঝ শিশুর মত কাঁদছিলাম।
জিয়ারত শেষে পৌঁছালাম শহীদের বাড়ি। আমাদের দেখে শহীদের আম্মা যে কান্না শুরু করল তা আমাদের সবাইকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করে তুলল। শহীদের আম্মা কিছুতেই আমাদের কোন অনুরোধ, উপরোধ, সান-্বনা মানছেন না। সে যে কি মর্মস্পর্শী অবস'া, যা বর্ণনা করতে গেলে কলম থমকে দাঁড়ায়। কেঁদেই চলেছেন। শহীদের পিতাও কান্না শুরু করলেন। বৃদ্ধ পিতার কান্না দেখে আমাদের সবার চোখ ছলছল করছে। সাত খুনের আসামীর মত জঘন্য অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে। কান্নার শব্দে বাড়ির ছেলে-মেয়ে যে যেখানে ছিল ছুটে এল, না জানি নতুন কোন দুর্ঘটনা ঘটল! কিন' আশ্চর্যের ব্যাপার বাড়িতে এত লোক তবুও পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতার সাথে একা্ততা ঘোষণা করছে বাড়ি ঘেরা গাছগাছালিরা। শহীদের আম্মার কান্নারোধে আমরা সবাই ব্যর্থ ও ভাষাহীন। বেশ কিছুক্ষণ পর আম্মা শান- হলেন। শুরু করলেন তার প্রিয় ইসমাইলের স্মৃতিচারণ-
“কি কথা বলব বাবা! আমার ইসমাইল আর নেই। বাড়ির সবার ছোট হওয়ার কারণে সবাই তাকে খুব ্লেহ করত, আদর করত, ভালবাসত। বাড়ির কোন কাজকর্ম তাকে কোন দিনও করতে দেইনি। কোনদিন শখ করে মাঠে বেড়াতে গেলেও ওর বাবা ওকে নিষেধ করত। ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, আ্তীয়-স্বজন সবাই তাকে ভালবাসত। বন্ধু-বান্ধব সবাই একসাথে বেড়াত, ঘুরত। একা একা কোন জিনিস খেত না, যা খেত সবাই মিলে মিশে খেত। বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন সংগঠনের কাজ করে রাত্রে বাড়ি ফিরত। আর আমি তার ঘরে শুধু তারই খাবার রাখতাম। তখন সবাই ভাগ করে খেত। আমি বলতাম, ও বাজান! তুই আমারে ডাকলিনা খাবার তো ঘরেই ছিল। একজনের খাবার দুই তিন জন কি করে খাস? বাজান বলত, খাবারের বরকত আছে মা।”
কালজয়ী পুরুষ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইবাদত, বন্দেগী, আমল আখলাক ছিল সবার জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও শিক্ষনীয়। এ প্রসঙ্গে শহীদের আম্মার আরো স্মৃতিচারণঃ
“ইসমাইল ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই নামাজ পড়ত, রোজা রাখত। এর পর আমার জানা মতে সে কখনও নামাজ ক্বাজা করেনি। ছোট বেলায় একবার মাদ্রাসা থেকে এসে বলল, “ওমা হুজুর আমাকে মুসলমানি দিতে বলেছে, মুসলমানি না দিলে নাকি এবাদত বন্দেগী হয় না।” ওতো সবার ছোট ছিল তাই ওর কোন আব্দার আমি কেন, বাড়ির কেউ ফেলতে পারত না। তাই ছোট হলেও ওর বড় ভাইয়ের সাথে মুসলমানি দিয়েছিলাম শুধু আব্দারের কারণে। নামাজের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিল। মসজিদ ছাড়া কখনও বাড়িতে নামাজ পড়ত না। শীত, গ্রীষ্ম, ঝড় বাদল সব সময় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত। বাড়ির কেউ নামাজ না পড়লে তাকে বুঝাত, পাড়াপড়শিকে নামাজের জন্য ডাকত। জুম্মার দিন হলে পাড়ার মধ্য দিয়ে মসজিদে যেত আর মানুষদের মসজিদে আসার জন্য বলত।” অসুখ বিসুখেও নামাজ ক্বাজা করেনি। এ প্রসঙ্গে শহীদের আম্মা একটি ঘটনা বললেন-
“যখন ইসমাইল সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। সেই সময় একবার ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। ওর প্রেসারের সমস্যা ছিল, খেলতে খেলতে হঠাৎ তার প্রেসার বেড়ে যায়। সবাই মিলে তাকে বাড়ি নিয়ে এলো। আমি তার মাথায় পানি ঢালা শুরু করলাম। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এসে তাকে আমাদের অভয় দিয়ে গেলেন। তখন মাগরিবের সময় আসন্ন। ইতোমধ্যে আযান শেষ হয়ে গেল। আযান শুনে আমার ইসমাইল বলল, “ওমা আযান হয়ে গেল আমার মাথা মুছে দাও নামাজ পড়ব।” আমি মাথা মুছে দিলে শায়িত অবস'ায় ইশারায় নামাজ পড়ল। দিনে ৪/৫ বার মেছওয়াক করত। আমি যদি বলতাম, ও বাজান তোর দাঁত ক্ষয় হয়ে যাবে, এত মেছওয়াক করিস না। কথা শুনে বাজান আমার হাসত। রোজাকে নামাজের মতই গুরুত্ব দিত। ছোট থেকেই রোজা রাখত। আমি রোজা না থাকার জন্য বললে, বলত-“ওমা ওসব কথা বলবে না, গুনাহগার হবে।” রোজা থেকেই স্কুলে যেত। কোন কোন দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে না খেয়েই রোজা রাখত। সামান্য চাল পানি খেতে বললেও কিছুতেই খেতে চাইত না। ইফতার করত বন্ধু বান্ধব সহ এক সাথে। ফরজ রোজা ছাড়াও সবে বরাত, সবে মেরাজ সহ প্রায় মাসে দু’একটি করে রোজা রাখত।”
আম্মা যখন শহীদ ইসমাইলের মেছওয়াক করার কথা বলছিলেন তখন আমার একটি হাদীস মনে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মাতের যদি কষ্ট না হতো তাহলে আমি তাদেরকে মেছওয়াক করা ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে বলতাম।” শহীদ ইসমাইল এই হাদীস বিশ্বাসের পাশাপাশি আমলের প্রতিও মনোযোগ দিয়েছিল। সেহেরীর পূর্বে শহীদ ইসমাইল হোসেন তার মহান প্রভুর সামনে পবিত্র হয়ে জায়নামাজে দাঁড়াতেন। এই তাহাজ্জুদের নামাজকে এ অঞ্চলের মানুষ সবাই বলতো কি না জানি না। তবে শহীদ ইসমাইলের আম্মার কাছে এ নামাজ বিশ্বাসের নামাজ বলে পরিচিত ছিল। আর এই বিশ্বাসের নামাজ বেশি বেশি করে পড়তো শহীদ ইসমাইল শাহাদাতের পূর্বে। শাহাদাত বরণের আগের দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ রাত্রেও তার সাথীরা তাকে সেই বিশ্বাসের নামাজ পড়তে দেখেছে।
জীবন যাপন ছিল স্বাভাবিক। লুঙ্গি, পাজামা, পাঞ্জাবী বেশি ব্যবহার করতেন। ্লেহের ভাতিজাদের আদর করতেন। সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসাতেন। আর বলতেন, “কাউকে অশিক্ষিত রাখবো না, সবাইকে মানুষ করব।” পড়াশুনার জন্য সবাইকে শাসন করতেন। বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালবাসা শহীদ ইসমাইলের থাকার ঘরটি ছিল অন্যান্য ঘরের দক্ষিণ পূর্বে। ঘরে ভাল বাতাস লাগত বলে বাড়ি হতে রাজশাহী আসার সময় তার শ্রদ্ধেয় পিতাকে তার ঘরে ঘুমানোর কথা বলে আসত।
শহীদের প্রিয় খাবার ছিল পোলাও ও গোশ্ত। বাড়িতে ভালমন্দ রান্না হলে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী পিতার মুখে খাবার তুলে দিত। পিতা আপত্তি জানালে শহীদ ইসমাইল বলত, “খাও বাজান আমিতো প্রায় খেয়েই থাকি তুমিই খাও।” ভাই ও ভাবীদের নামাজের কথা বলার পাশাপাশি ভাবীদের পর্দার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলত। তাদের বাড়ির বাইরে যেতে এবং বেশি কথা বলতে নিষেধ করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়-য়া আদরের ছোট ভাই সবার ছিল মাথার মণি। বাড়ির চার ভাই যার জন্যই নতুন শার্ট, লুঙ্গি কেনা হতো না কেন, শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী আগে পরতেন। কিছু দিন পরার পর যার জিনিস সে পরত। বড় দুই ভাই শশুর বাড়ি থেকে নতুন পোশাক উপহার পেলেও ইসমাইল আগে কিছুদিন পরতেন এরপর তার ভায়েরা পরত।
শহীদ ইসমাইল টাঙ্গাইল জেলা থেকে ১৯৯২ সালে আলিম মানবিক দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। বহু আশা, আকাঙ্ক্ষা আর উদ্দীপনা নিয়ে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার জন্য। চান্স হল বাংলায় আর সংযুক্ত হল নবাব আব্দুল লতিফ হলে। সঙ্গত কারণেই সে চলে গেল লতিফ হলে। আজ তার স্নেহ মাখা মুখের নম্রতা আর ঝক ঝকে দাঁতের কথা ঢের মনে পড়ে। তার ্লেহ ভরা মুখের কথা স্মরণ হলেই মন চলে যায় ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ এর এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে। যেই সকাল কেড়ে নিয়েছিল আমাদের মাঝ থেকে এক বৃনে-র দু’টি ফুলকে।
শাহাদাত বরণের পর রাজশাহী থেকে আনা ইসমাইল ভাইয়ের ট্রাঙ্কটি দেখতে লাগলাম। ট্রাংক ভর্তি কাপড়, গেঞ্জি, টুপি, জেট, শার্ট, কিছু বই পুস-ক, ব্যক্তিগত দুটি ডায়রীসহ অনেক কিছু দেখলাম। ট্রাংকের জিনিসপত্র দেখে শহীদের পিতামাতার বুকফাটা কান্না আবার শুরু হল। শহীদের মাকে বাঁধাদান সত্তেও কাপড় চোপড় নাড়ছে আর বুকে জড়িয়ে ধরছে। এভাবে কাঁদলে পরে অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। এ ভয়ে ওগুলো আম্মার কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা অনেকেই করছে কিন' আম্মার আবেগের কাছে আমরা বার বার পরাজিত হচ্ছিলাম।
শহীদের বৃদ্ধ পিতা টুপি হাতে নিয়ে কাঁদছেন। টুপির গন্ধ নিচ্ছেন, চুমু খাচ্ছেন আর তার চোখ থেকে বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায়। আমার মনে হচ্ছিল ওরা কাঁদুক। যত ইচ্ছা কাঁদুক। ওদের প্রাণ ভরে কাঁদতে দেওয়া উচিত। আমার হৃদয়ে তখন মরুভূমির ঝড় প্রবাহিত হচ্ছিল। মা-বাবার ছোট ছেলে ইসমাইল যাকে কেউ কোনদিন কষ্ট দেয়নি, দেয়নি দুঃখ, করেনি কাজের নির্দেশ। বিষয় একটিই তা হলো ইসমাইল পড়াশুনা করছে, মানুষের মত মানুষ হবে, বড় হয়ে চাকুরি করবে, সবার মুখ উজ্জ্বল করবে, শানি-র বাকবাকুম ঘরের চালে উড়বে। হায়রে শানি-! রঙিন ফানুস হয়ে গেল। রক্ত পিপাসু হায়েনারা থামিয়ে যাও শহীদের পিতামাতার বুক ভাঙ্গা কান্না। তোমরা কিভাবে পারলে শহীদ ইসমাইলের খুন ঝরাতে?
তার ব্যক্তিগত ডাইরী খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ২৬ জানুয়ারী ’৯২ ইং তার সাথী শপথ হয়েছিল টাঙ্গাইলের আশ-শিফায়। শপথ দিয়েছিলেন তৎকালীন অফিস সম্পাদক জনাব মোঃ আবুল কালাম আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমি তার সাংগঠনিক সক্রিয়তা লক্ষ্য করেছি। শহীদ ইসমাইলের শহীদ হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। শহীদি মৃত্যুই বেহেসে-র নিশ্চিত পথ জেনেই মনে প্রাণে তিনি শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতেন। তার বিভিন্ন কথা বার্তায় তা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। অশান- বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস'ায় মা থাকত সদা শংকিত। তাই শহীদের মাতা প্রায়ই বলতেন, “বাজান একটু দেখেশুনে থাকিস।” উত্তরে শহীদ ইসমাইল বলেছিল, “ছাত্র কালে মারা গেলে কত সুখ, হিসাব কম দিতে হবে। কবরে থাকব ছাত্র হয়ে, তুমি আফসোস করো না, তুমি কেঁদোনা মা শহীদ হয়ে মরলে কোন কষ্ট হয় না।”
এমন কিছু অস্বাভাবিক কথা বার্তা বলে শহীদ ইসমাইল বাড়ি থেকে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন। কয়েক দিন পর শহীদ ইসমাইলের আম্মা স্বপ্ন দেখলেনঃ বাড়ির চারিদিকে থৈ থৈ পানি। দক্ষিণ দিক থেকে দু’টি লাশ পানিতে ভেসে আসছে। একটি লাশ লুঙ্গি পরা, দেখতে অবিকল শহীদ ইসমাইলের মতো। অপরটি তিনি চিনতে পারছেন না। পরিচিত লাশটিকে তার এলাকার মানুষ ধরে দাফনের ব্যবস'া করলেন। অন্যটি পানিতে ভেসে চলে গেল।
কি অদ্ভুত শহীদের জননীর স্বপ্ন! স্বপ্ন সত্যিতে পরিণত হলো। ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ ছাত্রদলের খুনীরা সুন্দর কুয়াশাচ্ছন্ন রমজানের সকালকে করেছিল দূষিত, মতিহার চত্বর করেছিল রক্তাক্ত। বীরশ্রেষ্ঠ দু’জন তরুণ আদর্শের সম্রাটকে খুন করে। লাশ পানিতে ভেসে নয় বরং শহীদ ইসমাইলের হাজার হাজার সাথীরা ট্রাক যোগে পবিত্র আত্মা নিয়ে হাজির হয়েছিল বেলকুচির চালা গ্রামে। শহীদ ইসমাইলের আম্মার আল্লাহ প্রদত্ত স্বপ্নের এলহাম আর বাস-বতার ঐক্য নিয়ে হাজির হলো একটি লাশ নাম তার শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
(লেখক: ইবনে হক, ইসলামের ইতিহাস শেষ বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
স্মৃতির অন্তরালে
পড়ন্ত বিকেল। বসনে-র কোমল হাওয়া বইছে। এমনই এক মনমুগ্ধকর স্মৃতিমধুর প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্যাম্পাসে হাঁটছি। সাথে ইসমাইল হোসেন সিরাজী। চারদিকে গাছগুলোর সবুজ পাতা দুলছে বসনে-র ঝিরঝিরে কোমল বাতাসে। মনে হচ্ছে যেন কল্পণার স্বপ্নাকাশে মতিহার চত্বরের শহীদ ভাইদের অপূর্ণ সাধ পূরনের উদাত্ত আহ্বান ব্যক্ত করছে প্রকৃতির এই বাকহীন সত্তাগুলো।
ইসমাইল ভাই ক্যাম্পাসে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সব কিছুই নতুন। তাই ক্যাম্পাসে শহীদ ভাইদের অতীত ইতিহাসের অজানা-অচেনা ঘটনাগুলো জানার অদম্য স্পৃহা তার জিজ্ঞাসু হৃদয়ে বার বার প্রশ্ন করছেন-“কোনখানে আমাদের প্রিয় ভাই শফিকুল ইসলাম শাহাদাত বরণ করেছিলেন? কোন স'ানে জব্বার, হামিদ, আইয়ূব, রবিউল, মুস-াফিজ ভাই তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের ভিত রচনা করেছিলেন? আমি সে মিছিলে শরীক হয়ে নিজেকে ধন্য করতে পারব তো?”
মহান আল্ল্লাহ পাক তার এই সাধ পূরণ করেছেন। সত্যিই তিনি সাব্বির, হামিদ, আইয়ূব, জব্বার, আসলাম, আসগর, শফিক ভাইসহ অসংখ্য ভাইদের সাথে শহীদি মিছিলে অংশ নিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। সেদিন ছিল ১৯৯৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী। পবিত্র রমজান মাস। আগের রাতে সন্ত্রাসীরা সোহরাওয়ার্দী ও হবিবুর রহমান হলে হামলা চালিয়ে বেশ কিছু রুম ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করেছিল। তাই পরবর্তী দিন বাদ ফজর আমরা ঘটনা পর্যালোচনার জন্য বিনোদপুরে সদস্য বৈঠকে মিলিত হয়েছিলাম। এদিকে হলগুলোতে ছাত্ররা রমজানের সেহরী খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সকাল বেলা ছিল প্রচন্ড কুয়াশাচ্ছন্ন। খুব কাছ থেকেও কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। হঠাৎ আমাদের কাছে খবর
এলো সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা প্রচুর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রচন্ড হামলা চালিয়েছে। আমরা দ্রুত ক্যাম্পাসে চলে এলাম। এসে দেখি সন্ত্রাসীরা ভোরের নীরবতা নিস-ব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে তান্ডবতায় মেতে উঠেছে। প্রচন্ড গুলি আর বোমার বিকট শব্দে মতিহারের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ দেখতে পেলাম শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দু’জন ভাই। তখনও তাঁর দেহ থেকে পুণ্যাত্ম বের হয়ে যায়নি। দেখে আৎকে উঠলাম আমি। এক ঘণ্টা পর ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা পালিয়েছে শুনলাম আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে আমাদের প্রাণ প্রিয় ভাই ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজুর রহমান। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারছিলাম না। হৃদয়ের মনি কোঠায় বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল-এতক্ষণে ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাইয়ের আব্বা আম্মা কী করছে। শাহাদাতের খবর শুনলে তারা কিভাবে নিজেদের সংযত করবেন। কোন অপরাধে তাদের বুক খালি হল। যে ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাই পিতা-মাতার একরাশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বুকে বেধে নিয়ে মতিহারের এ পবিত্র শহীদি আঙ্গিনায় পদার্পন করেছিলেন, সন্ত্রাসীদের হিংস্র ও কাল থাবা তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। ৪ বছরের কোর্স যেখানে ৮বছরেও শেষ হয়না, অথচ মাত্র কয়েক মাসে তারা কোর্স শেষ করে আল্ল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন স্রষ্টার পানে। তারা পৌঁছে গেছে তাদের চূড়ান- মঞ্জিলে।
শহীদ ইসমাইল ভাইকে খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি ছিলাম তখন নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখার সেক্রেটারী আর ইসমাইল ভাই ছিলেন হল শাখার অফিস সম্পাদক। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও মার্জিত ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করত। তাইতো সেই প্রাণ কাড়া মার্জিত ব্যবহার আর হাস্যোজ্জ্বল বদনখানি হৃদয়ের মনি কোঠাতে নাড়া দেয়। এখনও সে সকল স্মৃতিগুলো হৃদয়ের অন-রালে লুকোচুরি খেলছে আলো আঁধারের মত।
আজও সেই ক্যাম্পাস আছে। আছে ক্যাম্পাসে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণা। আছে ক্যাম্পাসের সবুজ মনোরম প্রকৃতির হাতছানি, আছে বিস-র সবুজের গালিচা। তারা শুধু কালের আবর্তে সাক্ষী হয়ে আছে। নেই শুধু ইসমাইল হোসেন সিরাজী। নেই রবিউল, মুস-াফিজ, আসলাম, আসগর, হামিদ, জব্বার, আইয়ূবসহ অগনিত ভাই। নেই তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর পদচারণা। কিন' তারা দিয়ে গেছেন আমাদের চলার পথের প্রেরণা। সেই প্রেরণার রশি ধরে এগিয়ে চলেছি অজানা ভবিষ্যতের পানে। তবুও স্মৃতির রাডারে বার বার ভেসে আসে ইসমাইল ভাইয়ের সেই হৃদয়গ্রাহী উক্তি-“আমিও সেই মিছিলে শরীক হয়ে নিজেকে ধন্য করতে পারব তো?”
(লেখকঃ মো: সুজা উদ্দিন জোয়াদ্দার, সভাপতি, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
অম্লান স্মৃতিঃ শহীদ ইসমাইল
বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তা’লার ডাকে মানুষ একদিন তার সমস- সত্তাকে বিলিয়ে দিয়ে আপন প্রভুর কাছে একান-ভাবে চলে যায়, নিজের অসি-ত্বকে কুরবানী দিয়ে। আশার সোনালী প্রদীপ নিভিয়ে সাদা শুভ্র কফিনে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক, বিধাতার চিরাচরিত নিয়ম। কিন' কখনও যদি আশার প্রদীপ অপ্রত্যাশিত ভাবে দক্ষিণা সমিরণে দপ করে নিভে যায়, তখন স্রষ্টার সুন্দর ধরনীর মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই অন্ধকারের ঘোর অমানিশা নেমে আসে।
এমনি অপ্রত্যাশিতভাবে অন্ধকারের ঘোর অমানিশা টেনে নিভে গেছে একটি প্রজ্জ্বলিত আশার প্রদীপ। ঝরে গেছে সুন্দর একটি লাল গোলাপ, কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত হবার আগে। হাজারো নক্ষত্র হতে ছুটে গেছে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে একটি মিষ্টি সুবোধ ছেলে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মায়ের দামাল সন-ান। শহীদি কাফেলার মিছিলে সংযোজিত হয়েছে আর একটি নতুন অধ্যায়; একটি ইতিহাসঃ একটি নাম শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
যেন অনল প্রবাহের কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বিপ্লবের উত্তরাধিকারী। সেদিন কি বার ছিল মনে নেই। তবে সময় টি ছিল ১৯৮৯ সনের প্রথম দিক। রৌদ্র ঝলমল ছিল আকাশ। স্নিগ্ধ হাসি হেসে সোনাঝরা সূর্য উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। ২/৩টি বাইসাইকেলে চড়ে বেলকুচি থানার সাথী শাখার সাবেক সভাপতি মীর মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা রওয়ানা হলাম দেলুয়া আলিম মাদ্রাসায় শিবিরের সাধারণ সভায়। অনেক ছাত্রের উপসি'তি। সামনে বসে আছে মিষ্টি শান- একটি ছেলে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এবং তার প্রিয় বন্ধু আঃ হালিম সহ অনেকেই।
তন্ময় হয়ে শুনল আমাদের আলোচনা। সকলেই সমর্থক ফরম পূরণ করল, সাথে সাথে ইসমাইল ভাইও। তখন ইসমাইল ভাই নবম
শ্রেণীর ছাত্র। আমি সবেমাত্র সাথী হয়েছি। খুব ছোট ছিলাম বলেই মুহাম্মদ ভাই অত্যন- স্নেহ করতেন। তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন, অম্ল্লান প্রাণ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের সাথে। সেই থেকে শহীদ ইসমাইল ভাইকে একান-ভাবে কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এরপর থেকে বেলকুচির অনেক প্রোগ্রামেই কখনও কলেজ ক্যাম্পাসে, রাজপথের মিছিলে শহীদ ইসমাইল ভাইকে কম বেশি পেয়েছি।
তবে সাথী হিসাবে শপথ গ্রহণের পর থেকে সাংগঠনিক জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের করটিয়া কলেজে। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনশক্তি হিসাবে। মূলতঃ শহীদ ইসমাইল ভাই হাজারো স্বপ্নের ইমারত গড়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রকৃতির লীলাভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন' সব স্বপ্নের ইমারত চোরাবালির বাঁধের ন্যায় ভেঙ্গে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে যান একান-ভাবে আপন প্রভুর কাছে। শাহাদাত এর সময় তিনি সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ সাথী ছিলেন।
মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাড়ি আসতেন। খোঁজ খবর জানতে চাইতেন বেলকুচির কাজের অবস'ার। শুধু খোঁজ খবর নিয়েই বসে থাকেন না বরং বুদ্ধি, পরামর্শ ও শারীরিক শ্রম দিয়ে বেলকুচি থানায় ইসলামী আন্দোলনের কাজে সহযোগিতা করেছেন। আমি ইসমাইল ভাইয়ের কাজের আন-রিকতা দেখে এক এক সময় অবিভূত হয়ে যেতাম। ১৯৯২ সালের কথা। বেলকুচি কলেজে প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠান। বাকি একটি রাত। অনেক চেষ্টা করে টেলিফোনে টাঙ্গাইল শহরের সাবেক সভাপতি, পরিষদ সদস্য আহসান হাবিব ইমরোজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হলো না। সুতরাং প্রধান অতিথি ইমরোজ ভাই এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা বা নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো ছাড়া গত্যন-র নেই। কে যাবে এত রাতে? ইসমাইল ভাইকে যাবার প্রস-াব করলে অধীর আগ্রহ উদ্দীপনায় রাজি হয়ে গেলেন। বললাম, ভাই আপনারতো খুব কষ্ট হবে যেতে। স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললেন, সোহেল ভাই, আপনি জি.এস হলে এ কষ্ট থাকবে না।
তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ইসমাইল ভাই শ্যালো নৌকায় ভূয়াপুর দিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং ভোরে রওনা হয়ে ১০টার পূর্বেই প্রোগ্রামে উপসি'ত হলেন। এছাড়া ইসমাইল ভাইকে একান- ভাবে পেয়েছি আমার কলেজ ক্যাম্পাসে। স্বাভাবিক ভাবে বেলকুচি কলেজে আমাদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক তেমন ভাল ছিল না। দেখেছি ইসমাইল ভাই বাড়ি এলে কলেজ ক্যাম্পাসে আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। কর্মীদের সাথে কথা বলতেন। কলেজে মিছিল করার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রাখতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন- সাদা সিধে মানুষ ছিলেন শহীদ ইসমাইল ভাই। রাগ কাকে বলে আমি তার মাঝে কখনও দেখিনি। ব্যবহারে ছিলেন অত্যন- অমায়িক। মিশতেন প্রশস- হৃদয়ের সমস- মাধুরী দিয়ে। মুক্তাঝরা ্লিগ্ধ হাসি, চেহারায় উজ্জ্বল লাবণ্য সব মিলেই শহীদ ইসমাইল ভাই ছিলেন অপরূপ সুদর্শন পুরুষ।
মেধাবী এই কর্ম চঞ্চল তরুণ শহীদ হবার ক’দিন পূর্বে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। বাসে চড়ার পূর্বেই পথে হঠাৎ করে আমার সাথে সাক্ষাৎ হলো। আমার সাথে ছিলেন লুৎফর ভাই সাবেক বেলকুচি থানা সভাপতি। দু’জনকে পেয়ে পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। এমনভাবে আন-রিকতা সহকারে কোলাকুলি করে কথা বললেন, যেন হাজার বছর পর হঠাৎ হারানো বন্ধুর সাথে দেখা হল। আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন “সোহেল ভাই, চলেন রাজশাহী যাই। আপনি গেলে সবাই খুব খুশি হবে। আমার বন্ধু বান্ধব ও দ্বীনি ভাইসহ সকলকে আপনার কথা বলেছি।” অনেক পিড়াপিড়ি করলেন ইসমাইল ভাই। হাসার ছলে অনেক কথাও ইসমাইল ভাইকে বলেছিলাম। কথা দিয়েছিলাম, এবার নয়, আগামীতে আপনি এলে যাব ইনশাল্ল্লাহ। আমার কথায় খুশি হয়ে ইসমাইল ভাই বললেন, “আমি ২৮/২৯ রোযার ভিতর ঈদের পূর্বেই আবার বাড়ি আসব। ঈদ করে ২দিন পর রাজশাহী যাব। তখন আমার সাথে যাবেন কিনা বলুন।” ইসমাইল ভাইয়ের কথায় রাজী হয়েছিলাম যাবার জন্য তার সাথে রাজশাহীতে। কিন' ভাগ্যের বড় নির্মম পরিহাস। ২৮/২৯ রোজা ও ঈদের অনেক পূর্বেই তিনি তার বাড়িতে অপ্রত্যাশিতভাবে এলেন। তবে স্বাভাবিক সুস' মানুষের বেসে কিংবা আমায় রাজশাহী নিয়ে যাবার কোন পরিবেশে নয় বরং শহীদি মিছিলের যাত্রী বেসে সাদা কফিনে সজ্জিত হয়ে।
যখন মুহতারাম শহীদুল ভাই, সিরাজগঞ্জ জেলার সাবেক সভাপতি, সংবাদ জানালেন, ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাই গত ভোর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন তখন নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না। যেন বিনা বজ্রপাতে সুবিশাল আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমার দু’টি চোখে যেন অন্ধকার নেমে এল। অশ্রু ঝরল দু’টি চোখে। নিজের কান্নাকে চেপে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। কিন' পারিনি। শহীদুল ভাই সান-না দিলেন, আপনি যদি দায়িত্বশীল হয়ে ভেঙ্গে পড়েন বাকী কাজ কে সামলাবে? কে দিবে কর্মীদের সান-না? শহীদুল ভাইয়ের কথায় তখন স্বাভাবিক হলেও পরবর্তীতে সে স্বাভাবিকতা আমি ধরে রাখতে পারিনি। অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসমাইল ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছে গেল বেলকুচির প্রত্যন- অঞ্চলে। থানা জামায়াত কার্যালয়ে উপসি'ত হল ছাত্র-জনতা। বোবা কান্নায় ভেঙ্গে শহীদের সাথীরা। দায়িত্বশীল হিসাবে সান-না দিতে চাইলেও আমি পারিনি কাউকে সান-না দিতে। শহীদের কফিনের পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে চাতকের ন্যায় জামায়াত কার্যালয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। রাত্রি ৩-১৬ মিনিট। শহীদের কফিন নিয়ে একটি ট্রাক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এসে থমকে দাঁড়াল। শহীদ ইসমাইলের সাদা শুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত কফিনটি ট্রাক থেকে নামানো হল। কাঠের বাক্স খোলা হল। দেখলাম, পরম নিদ্রায় যেন ঘুমিয়ে আছে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
ইসলাম বিরোধী শক্তির ব্রাশ ফায়ারে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছে বুক। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পেছনের পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ দৃশ্য যেন কোন অসভ্য পৃথিবীর। কোন সভ্য পৃথিবীর সৃষ্টির সেরা মানুষ এমনি নির্লজ্জভাবে অপর মানুষের বুকে ব্রাশ ফায়ার করতে পারে? পারে খুন করে রক্ত কণিকা ঝরিয়ে দিতে? স্ব-চোখে শুধু অনুভূতিতে এসব বর্বরতার বীভৎস দৃশ্য উপলব্ধি করা যায় না। এমন করুন অস্বাভাবিক মৃত্যু আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সমাজকেও হার মানায়। ঐ সব নরপশুর কাছে শহীদ ইসমাইল যেন নীড়হারা শরাহত পাখি। যার ফলশ্রুতিতেই ওরা কেড়ে নিয়েছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন-ান; একটি সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন। হায়বে পৃথিবী! এই কি তোমার সভ্যতা!
ট্রাক থেকে নামিয়ে সেহরীর পূর্বলগ্নে রাত্রি ৪টায় শহীদের পবিত্র কফিন তার বাড়ি নেওয়া হল। থমকে দাঁড়াল পৃথিবী। কেঁপে উঠল মায়ের কান্নায় খোদার আরশ। থেমে গেল ভোরের পাখির মিষ্টি গান। পরিবেশ হয়ে উঠল ভারী। চারিদিকে নেমে এল শোকের ছায়া। শহীদের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও শহীদের প্রিয় সাথীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কে কাকে দেবে সান-না? রাতের আধার টুটে বেরিয়ে এল ভোরের আলো। শহীদের সাথীরা শোক কে শক্তিতে পরিণত করল। বেলকুচির রাজপথ হল শহীদের লাশ নিয়ে শ্ল্লোগানে মুখরিত। বিশাল সে মিছিল। বিশ্ব মানবতাসহ সাধারণ জনতা অবাক দৃষ্টিতে রাস-ার পাশে দাঁড়িয়ে অবলোকন করল শহীদের মিছিল। নেতৃত্ব দিলেন জেলা আমীর জননেতা আলী আলম, ছাত্রনেতা শহীদুল ইসলাম, জোবায়ের হোসেন, অধ্যাপক নূর-উন-নবী সরকার, আলহাজ্ব আঃ মান্নান ভাইসহ অনেকেই। শহীদি প্রেরণায় দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নব দীক্ষায় দীক্ষিত হল শহীদের সাথীরা। বজ্র সাহসে শপথ খোদার রাজ প্রতিষ্ঠার। সত্যি শহীদ ইসমাইল ভাই চলে গেছেন। রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত কাজ। আমরা সবাই শহীদ ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাইয়ের পথ ধরে কুরআন সুন্নার পথে চলে প্রয়োজনে শহীদ হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে হেরার পথে এগিয়ে যাব। প্রতিষ্ঠিত করবো শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজ ভাইয়ের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। শাশ্বত আল কুরআনের রাজ।
(লেখকঃ আরিফুল ইসলাম সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, সিরাজগঞ্জ জেলা)
শহীদ ইসমাইলঃ কুয়াশা ভাঙ্গা রোদ্দুর
শীতকাল তখন পুরোপুরি। সকালে চারদিকে কিছুই দেখা যায় না কুয়াশার শব্দহীন বৃষ্টিতে। তবু অবিনাশী রোদ্রের পাখিরা কুয়াশার ব্যুহ ছিন্নভিন্ন করে স্বপ্নময় পৃথিবীর এই ছোট্ট আঙ্গিনায় পৌঁছে যায়, অতপর ঘাসে ঘাসে বিজয়ের আশ্চর্য প্রদীপ জ্বলে নক্ষত্রের মত; ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের মত। এই সিরাজী ভাইয়ের সাথে শীতের এক রাত্রিতে সৌভাগ্যক্রমে পরিচিত হই আমি। লতিফ হলের ২৫০ নং কক্ষে বসে আছি। রাত তখন ৮টা। পাশের টেবিলে বই ও ব্যাগ রাখার শব্দ হল। চোখ ফিরিয়ে দেখি সুন্দর চেহারার ছিপছিপে গড়নের হাস্যোজ্জ্বল একটি মানুষ। দেখলেই প্রাণ খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে তার সাথে। তাই দেরি না করেই সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হলাম। সেদিন আর তেমন কোন কথা হলো না। কিন' আমার হৃদয়ের বুভূক্ষ নদীটি শুধু তার বিস-ীর্ণ হৃদয়ের অথৈ সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে অবিরাম, আর সে জন্যই অতি অল্প সময়ের মধ্যে নদী ও সমুদ্র মিলে সৃষ্টি হল ঘনিষ্ঠতার উত্তাল তরঙ্গের।
দু’টি আত্মার এই সুমধুর সম্পর্কের মাঝে ছিট বদল নামের একটি নিষ্ঠুর চর জাগল। কিন' সেই চর আমাদের ভালবাসার সাইক্লোনে কোথায় জানি হারিয়ে গেল মনের অজানে-ই। আমরা দু’জনই যে কোন ব্যাপারে নিজেদের ভিতর পরামর্শ করতাম, আলোচনা করতাম আর কোন সমস্যা উদ্ভব হলে তো তার সমাধান না হওয়া ছাড়া কোনই নিস-ার নেই কারোর।
একদিন (জানুয়ারী ’৯৫) আমি রুমে বসে সূরা বাকারার ১৫৩-১৫৭ নম্বর আয়াত সমূহের একটি দারস প্রস'ত করছিলাম, এই সময় ইসমাইল ভাই কক্ষে ঢুকে সালাম দিয়ে বললেন, কী করছেন? বললাম, কুরআনের দারস প্রস'ত করছি। শুনে তিনি বললেন, দেন আমি লিখে দেই বলেই তিনি আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে লিখতে বসলেন।
“ওয়ালা তাকুলু লিমাই ইউক্তালু ফি সাবিলিল্লাহ্ আমওয়াতান্ বাল্ আহ্ইয়ায়ু-ওয়ালা কিল্ল্লা তাশউরুন।” অর্থাৎ-যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলোনা বরং তারা জীবিত। এইটুকু সুন্দর করে লেখার পর আমি তাকে বললাম, কি কাজে এসেছেন? তিনি লেখার গতি থামিয়ে বললেন, সিটের টাকা নিতে, আপনি কি এখন দিতে পারবেন? বললাম, নিয়ে যান। তিনি টাকাগুলো হাসি মুখে গ্রহণ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে আন-রিকতার সুগন্ধি ছড়ানো সালাম জানিয়ে চলে গেলেন। কিন' যা লিখে গেলেন নিজ হাতে তার বাস-ব সাক্ষ্য যে তাকেই হতে হবে তা হয়ত সেদিন তিনি নিজেই জানতেন না।
’৯৫ এর ১১ ফেব্রুয়ারী। হল মসজিদে যোহরের নামাজ শেষে দরজায় দাঁড়িয়ে সাথী ভাইদেরকে একটি বৈঠকের সংবাদ দিচ্ছিলাম তখন প্রিয় সিরাজী ভাই মসজিদ থেকে বের হলেন, আমি সালাম দিয়ে বৈঠকের কথা জানালাম। তিনি তা শুনার পর আমার হাত ধরে মসজিদের সামনে ঘাস বিছানো কার্পেটের সবুজ আঙ্গিনায় বসে পড়লেন। মুখের সেই হাসির উজ্জ্বল আভা নেই, নেই আনন্দের উচ্ছ্বাস। কোন সুদূরের টানে তিনি যেন এক উদাসীন পথিক। তবু সব কিছু হৃদয়ে বহু কষ্টে চাপা রেখে শিক্ষাশিবির সংক্রান- আলাপ করলাম তাঁর সাথে। বিকালে মতিউর রহমান আকন্দ ভাইয়ের মুক্তি উপলক্ষ্যে শহরে একসাথে নারায়ে তাকবীর শ্ল্লোগান বুকে করে দীপ্ত পদক্ষেপে বর্ণাঢ্য ভঙ্গিমায় মিছিল করলাম। শহর থেকে ফিরে এসে ইফতার করেই শুনলাম সোহরাওয়ার্দী হলের (আমাদের) তিনটি সিট অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী। দু’জনে সোহরাওয়ার্দী হলে গেলাম। সেখান থেকে রাত আটটায় ফিরে এলাম লতিফ হলে। তখন আকাশ থেকে বর্ষার বৃষ্টির মত ঝর ঝর করে ঝড়ছিল ঘন কুয়াশা আর গগনের চলমান নক্ষত্ররা জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে এবং বলছিল, দেখ আমরা কেমন উজ্জ্বল নিদর্শন। ভয়াবহ অন্ধকারের অমানিশা ভেদ করে নির্ভয়ে ফুটে আছি। তোমরাও পৃথিবীর সহস্র রাতের জমিন ছিন্নভিন্ন করে আলোর মহিরুহ ফলাও। মহাকাশ নক্ষত্রের একেবারে আসীন হয়ে যাও। রাত ৯টার সময় আর একটা দুঃসংবাদ শুনলাম, হবিবুর রহমান হলে আমাদের তেতাল্ল্লিশটি রুম পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে বাতিলের দোসররা। আমাদের অপরাধ আমরা নতুন পবিত্র পৃথিবী গড়তে চাই, মানবতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনে দৃঢ় প্রত্যয়ী, শাশ্বত সত্তার অসি-ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসী। সেই অসি'র অশান- পরিসি'তিতে আমি আর ইসমাইল ভাই রাত দু’টা পর্যন- হল গেটে অবস'ান করার পর ঘুমাতে যাই।
অতঃপর জেগে উঠে সিরাজী ভাইকে ডাকলাম আসে- করে নরম গলায় সেহরী খাওয়ার জন্য। সেহরীর পর ফজরের আজানের সুললিত কণ্ঠ ভেসে এল। মেদিনীর খদ্দর ভেদ করে আমাদের কর্ণকুহুরে। ঘোষিত হল নতুন ভোর, একটি সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি দিনের শুরু হবে। দিনটি হলো ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫। আমাদের দু’জনের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। ফজর নামাজ পড়ে সবেমাত্র গাটা এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়। সারাদিন সিয়াম সাধনার জন্যই মূলত এ প্রশানি-র নিদ্রা। কিন' পাখিরা তাদের কিচির-মিচির গীতিময় ঝড় তুলতে ভুলল না। কুয়াশা কাঁদানির গ্যাসের মত ভয়াবহ রূপ ধারন করতেও পিছপা হলো না। হঠাৎ কে যেন ডাক দিল। সেই ডাক উৎকন্ঠা ও অসি'রতা মিশানো। জেগেই শুনতে পেলাম প্রচন্ড গুলির শব্দ। সিরাজী ভাইও তখন জেগে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি প্যান্ট, শার্ট, জুতা পরে দ্রুত হল গেটে চলে গেলাম দু’জনেই।
গেটে এসে দেখি আমাদের হলের ভাইদের একজন অপরজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ। একজন বলল-সোহরাওয়ার্দী হলে বাতিল শক্তি আমাদের ভাইদের ওপর আক্রমণ করেছে। তখনই ছুটে গেলাম সোহরাওয়ার্দী হলের দিকে। কিন' বেশিদূর এগোতে হলো না কারণ সামনেই দেখলাম বদরুল ভাইয়ের শরীর রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, শকুনগুলোর বুলেটে। চার-পাঁচজন ভাই তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে একটু বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে। আর একটু এগোতেই শুনলাম মর্মানি-ক হৃদয় বিদারক কথা। বাতিল শক্তি সোহরাওয়ার্দী হলের ডাইনিং রুমের ছাদের ওপর পৈশাচিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন-ান মুস-াফিজুর রহমান ভাইকে শহীদ করেছে। সিরাজী ভাই সবসময় আমার পাশেই ছিল। তিনি সামনে যাবার জন্য ছটফট করছিলেন। কিন' প্রচন্ড গুলির শব্দে এই সবুজ মতিহার শুধু নয় সমস- পৃথিবী, গগন-পবন পর্যন-ও কম্পিত হয়েছিল সে সময়। তবু সাহসের দীপ জ্বলতেই থাকল। সামনে এগিয়ে গেলাম আমরা। হঠাৎ দেখি সিরাজী ভাই আমাদের ছেড়ে সামনের দিকে এগুচ্ছেন দুঃসাহসী যোদ্ধার মত। বাতিল শক্তিকে পরাজিত করার চেষ্টায় বীর সৈনিকের মত তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন জিহাদের ময়দানে। বেশিক্ষণ আর দেখতে হলো না। একজন সীমারের গুলি তার দুঃসাহসী বুকের জমিন বিধ্বস- করে দিল। তিনি তবু সামনের দিকে আরো সামনের দিকে চেষ্টা করলেন। কিন' সক্ষম হলেন না। সবুজ ঘাসে এলিয়ে পড়লেন কালেমার আওয়াজ কণ্ঠবীণায় শেষবারের মত বাজিয়ে।
কয়েকজন ভাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমরা তাকবীর দিয়ে সামনে বাতিলের মুকাবিলায় এগিয়ে গেলাম। পরাজিত হল নরখাদকের দল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরে কালেমার পতাকা উড্ডীন হল। কিন' সিরাজী ভাইকে আর পেলাম না আমাদের মাঝে। তিনি এ বিজয়ের পতাকা দেখে যেতে পারলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় প্রভুর কাছে চলে গেলেন জান্নাতের বাগিচায় অননে-র ঠিকানায়। মহান রাব্বুল আলামীন নিজের কাছে তাঁর এই শ্রেষ্ঠ গোলামটিকে রাখবার ইচ্ছা করেছেন তাই তাকে নিয়ে গেলেন দুনিয়ার এ মাটি থেকে। আমরা কি করে তাকে ধরে রাখবো? শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী চলে গেছেন কিন' রেখে গেছেন অজস্র স্মৃতি। আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসমাপ্ত কিছু কাজ। আর এ অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই হবে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
(লেখকঃ মোঃ মুখলেছুর রহমান লিটন, সভাপতি, শহীদ আসগর আলী উপশাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
সিরাজীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি
মানুষ মরণশীল। কথাটি চিরন-ন সত্য। মানুষ এ পৃথিবী হতে চিরবিদায় নেয়। কিন' পৃথিবীতে এমন কিছ মানুষ আছে যা মরার পরও অমর হয়ে থাকে। রেখে যাওয়া কীর্তিগুলো সমাজে তাদেরকে চির অম্ল্লান করে রাখে। তাঁদেরকে ঘিরে রচিত হয় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি।
প্রত্যেকের জীবন একটি করে স্মরণীয় ঘটনা থাকে, হতে পারে তা আনন্দের অথবা দুঃখের দাবানলে ভরা। সে রকম আমার জীব েন ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজুর রহমানের শাহাদাতের ঘটনা। আমার স্মৃতির এ্যালবামে প্রতিক্ষণে শহীদ সিরাজীর স্মৃতিগুলো দোলা দেয়। সিরাজীকে ভাবতে গেলে নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। স্বপ্নের মত নিজেকে সান-্বনা দেই। সিরাজী শহীদ হয়নি, ধূমকেতুর ন্যায় আবার আসবে, কিন' বাস-ব বড় নির্মম এবং সত্য, যে যায় সে আর ফিরে আসে না কখনো। শহীদ সিরাজী আমার অতি কাছের বন্ধু ছিল। যার কারণে সিরাজীকে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। সিরাজীর পাশেই থেকেছি প্রাইমারীর প্রথম শ্রেণী হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পর্যন-। তার আচার-আচরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যের চেয়ে ব্যতিক্রম। প্রত্যেকটা কাজে সে ছিল অগ্রগামী। আমার আজও মনে আছে আমরা যখন দেলুয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় পড়ি, তখন আমাদের ক্লাসে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ছিল। দেখতাম সিরাজী আমাদের চেয়ে আগে ক্লাসে এসে প্রথম বেঞ্চে বসত এবং সে পার্শ্বে আমার জন্য একটা সিট রেখে দিত। লেখাপড়ার প্রতি সিরাজীর ছিল প্রবল আগ্রহ। যার কারণে দশম শ্রেণী পর্যন- সিরাজীর রোল ছিল এক অথবা দু’
য়ের মধ্যেই। শৈশব আমাদের আড্ডাখানা ছিল খেলার মাঠ ও আমাদের রক্তে যে নদীর স্মৃতি মিশে আছে সেই যমুনা নদীর তীর। বিকেল বেলা সিরাজী, ফরিদ ও আমি সহ আরও অনেক বন্ধু মিলে যমুনা নদীর তীরে বসতাম। যমুনার সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। যমুনার চরের ভিতর হতে কাশফুল নিয়ে আসতাম। আমাদের বন্ধু ফরিদের সুমিষ্ট কন্ঠে গান ভেসে আসত, ‘নদীর একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা’ ...
শহীদ সিরাজী বাংলাদেশের প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠেছিল যার কারণে সে প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসত এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নিয়ে কবিতা রচনা করত।
শৈশব থেকেই সিরাজীর মধ্যে ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ লক্ষ্য করেছি। সমাজের প্রত্যেকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার অগ্রণী ভূমিকাও দেখেছি। যখন আমরা ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম, তখন একদিন আমাদের ক্লাসে ছাত্রশিবিরের মীর মুহাম্মদ ভাইসহ আরও কয়েকজন ভাই আসলেন তাঁরা সুমিষ্ট ভাষায় ইসলাম ও শিবির সম্পর্কে আমাদেরকে প্রাথমিক ধারণা দিলেন। সিরাজী ও আমিসহ আরও কয়েকজন বন্ধু শিবিরের সমর্থক ফরম পূরণ করি। শুরু হয় সিরাজীর জীবনে আমুল পরিবর্তন। তাঁর আচার আচরণে শিক্ষা চরিত্রে এমনকি সামগ্রিক ক্ষেত্রে আকস্মিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে লাগল। তার প্রত্যেকটি কাজে কর্মে ইসলামের ছোঁয়া দেখতে পেতাম। ১৯৯১ সালের প্রথম দিক সিরাজী টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী কলেজে ভর্তি হন এবং সিরাজী ইসলামী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। শিবিরের আদর্শের সাথে সিরাজীর আদর্শ একত্রীভূত হয়ে যেতে লাগল।
১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাস। ফরিদ, সাইদুল ভাই, সোহেল ভাই ও আমি সহ আরও অনেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় সাথী সম্মেলনে যাওয়ার জন্য প্রস'তি নিচ্ছিলাম। এমন সময় একদিন বিকেলে যমুনার তীরে বসে জেলেদের মাছ ধরা দেখছিলাম। তখন ডাকপিয়ন আমাকে একটা চিঠি দিলেন। আনন্দ সহকারে চিঠি খুললাম। সিরাজী টাঙ্গাইল হতে লিখেছে। ঐ দিনের সিরাজীর চিঠির ভাষা ছিল খুবই আবেগময়ী। চিঠির ভাষা পড়ে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। ২০ জানুয়ারীর রাত ১টার সময় সিরাজী ছাত্র শিবিরের এক শিক্ষা শিবিরে সাথী শপথ গ্রহণ করেছে, চিঠি পড়ে তা জানতে পারলাম। সাথী শপথের পরেই আমার নিকটে পত্র লেখে। তখন টাঙ্গাইলের জেলা সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন আহসান হাবিব ইমরোজ ভাই। চিঠির শেষের ভাষা ছিল খুবই বিস্ময়কর। তা ছিল এরূপ-“বন্ধু, আল্ল্লাহর কাছে দোয়া করিস আমি যেন ইসলামী আন্দোলনের আলোকে নিজেকে গঠন করে শাহাদাতের পিয়ালা পান করতে পারি।” তখন থেকেই আমি সিরাজীর স্পৃহা দেখে ভাবছিলাম সিরাজীকে আল্ল্লাহ পাক শহীদ হিসেবে কবুল করতে পারেন।
সিরাজীর হৃদয়ে উচ্চ শিক্ষার বাসনা ছিল। যার কারণে আমরা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সবুজ কাননে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মন ভুলানো ক্যাম্পাসের হাতছানিতে আমরা ধরা দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বিভাগে আমি ও সিরাজী ভর্তি হলাম। সিরাজীর আশা ছিল জীবনে অনেক বড় হবে। চাচা-চাচী সিরাজীকে খুব ভালোবাসতেন। সিরাজীর লেখাপড়ার অর্থ ওর বাবা-মা বড় কষ্টে যোগান দিতেন। এই কষ্টের কথা মনে হলে এখনও আমার কান্না আসে। চোখ দুটো ভিজে যায় বেদনায়। সিরাজীর বাবা-মা গ্রামের লোকদেরকে বলত, “বড় কষ্ট করে ইসমাইলকে ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি একদিন আমাদের দুঃখ দূর হবে।” কিন' ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সন্ত্রাসীদের মরণ ছোবলে তাদের দুঃখ অগ্নি শিখার মত প্রজ্জ্বলিত হল।
যারা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়ে তারা অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারেন যে অর্থ কষ্টে লেখাপড়া করলে নিজের হৃদয়ে উচ্চাশার কল্পরাজ্য গড়ে ওঠে। যেমন বড় হয়ে বাবা-মার মুখে হাসি ফুটাব, আত্মীয় স্বজনদের দেখা-শোনা করব, বাড়ি-গাড়ি প্রভৃতি। সিরাজীর মনেও এরূপ আশা ছিল।
মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারী সিরাজী ও আমি রাজশাহী শহরে গিয়েছিলাম। শহর হতে ফেরার পথে সিরাজী বারবার আমাকে একটি কথা বলছিল, “আচ্ছা হালিম, আমাদের কি অর্থাভাব কোনদিন শেষ হবে না? দেখবি আমার একদিন বড় চাকুরী হবে। আমার বেতনের প্রথম টাকা দিয়ে মার জন্য শাড়ী ও বাবার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবী ক্রয় করব।” আমি তখন বলেছিলাম, তোর অবশ্যই বড় চাকুরী হবে। আসলে মানুষ যা চায় তা পায় না। সিরাজীর কবরে মাটি দেয়া শেষ হলে কবরের পার্শ্বে বসে কেঁদে-কেঁদে বলেছিলাম সিরাজী তুই চাকুরী করবি না? কথা বল সিরাজী, না কি এটাই তোর বড় চাকুরী?
সিরাজী গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে সমব্যবহার করত, গ্রামের প্রতিটি অনুষ্ঠানে সিরাজীকে প্রথম কাতারে দেখা যেত। গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ সমভাবে ভাগ করে নিত। বৃদ্ধ যুবক কিংবা শিশু সকলের প্রিয় পাত্র ছিল সিরাজী। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল, সিরাজীদের বাড়িতে আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তি কাজ করত। তার সংসারে খুব অভাব ছিল। সিরাজী ও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসব। ইতিমধ্যে আব্দুল কুদ্দুস ভাই সিরাজীকে তার অভাবের কথা জানাল। বাড়ি থেকে সিরাজী যে টাকা পেয়েছিল তা হতে আব্দুল কুদ্দুস ভাইকে টাকা দিয়ে দিল। আমি তখন অবাক হয়ে দেখলাম।
সিরাজী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শকে বাস-বায়ন করেছিল। যার কারণে কোন দিন নামাজ জামাত ক্বাজা পর্যন-ও করতে দেখিনি। আমরা যখন শীতের ভিতরে একই রুমে থাকতাম মুয়াজ্জিন যখন সুমিষ্ট কন্ঠে ফজরের আযান দিত সাথে সাথে সিরাজী বেড থেকে উঠে পড়ত। আমাদের উঠতে বিলম্ব হলে সিরাজী আমাদের উপর হতে লেপ উঠিয়ে নিত এবং ঠান্ডা পানি ঢেলে দিত।
১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ আমাদের গ্রাম হতে ছোট ভাই আব্দুল আলীম মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফরম উঠানোর জন্য রাজশাহীতে আসে। সেদিন রাত্রে আব্দুল আলীম সিরাজীর বেডেই শুয়ে ছিল। আব্দুল আলীমের নিকট হতে শুনেছি সে রাতে সিরাজী সেহরী খাওয়ার পর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছে। তারপর কুরআন তিলাওয়াত করছে। আব্দুল আলীম সিরাজী কে প্রশ্ন করেছে সিরাজী ভাইয়া দীর্ঘ সময় ধরে কিসের নামাজ আদায় করেন? উত্তরে সিরাজী বলেছিল শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে হয়।
১৯৯৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী প্রকৃতির ঘন কুয়াশা ক্যাম্পাসকে ঘিরে নিয়েছিল। কে জেনেছিল এই দিনটা হবে কালো অন্ধকারে ঘেরা। সেহরী খাওয়ার পর সকলে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিল। সন্ত্রাসীদের বুলেটের শব্দে ছাত্র-ছাত্রীদের সে রাতের ঘুম হয়নি। সৈয়দ আমীর আলী হলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রথমে শহীদ মুস-াফিজুর রহমান ভাইয়ের শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলাম। তারপর বন্ধুরা আমাকে সিরাজীর শাহাদাতের সংবাদ দেয়। তখন আমি সকলের মুখের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো এটা স্বপ্ন দেখছি। সে দিন চিৎকার করে বলেছিলাম সিরাজী মরতে পারে না। কিন' পরে দেখতে পেলাম সন্ত্রাসীদের স্টেনগানের গুলিতে সিরাজীর বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সেদিন নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছিলাম, একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রকে কেমন করে হত্যা করতে পারে? তাও আবার ইসমাইলের মত হাস্যোজ্জ্বল ছেলেকে। আসলে ওরা ছাত্র নামের কলঙ্ক!
সকলেই সেদিন সিরাজীর জন্য কেঁদেছিল। বন্ধুদের চোখে ছিল অশ্রু আর মুখ ছিল নির্বাক। আমরা যখন সিরাজীর লাশের কফিন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসযোগে গ্রামের বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম তখন সকলে নিস-ব্ধ ছিলাম। সকলের চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা টপ টপ করে ঝরছিল। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছিলাম সিরাজীর বাবা-মাকে কি বলে সান-্বনা দিব। এলাকার বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলব? গ্রামবাসী যখন প্রশ্ন করবে হালিম, এই হত্যাকান্ড কেমন করে হলো? তখন আমি তাদের কি বলে উত্তর দিব?
শেষ রাত্রের দিকে আমরা সিরাজীর কফিন নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী বেলকুচি থানাতে পৌঁছলাম এবং ভোরে সিরাজীর প্রাণের গ্রাম চালা উত্তর পাড়ায় শানিত নীড়ে গেলাম। আশা ছিল সিরাজী এম. এ পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়িতে যাবে, সকলের মুখে মিষ্টি উঠিয়ে দেবে। কিন' না, সিরাজী সেদিন বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকে মিষ্টির পরিবর্তে কান্নার রোল উপহার দিয়েছিল। কফিন পৌঁছার সাথে সাথে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এলো। বেলকুচির লোকের মুখে সেদিন কোন কথা ছিল না। সেদিন সকলের চোখে ছিল পানি আর পানি। বাড়ির এক পাশে আমি আধো অবচেতন হয়ে অবস'ান করছিলাম। সিরাজীর মা অজ্ঞান অবস'ায় আমাকে ডেকে পাঠালেন, আমি কান্নায় কাঁপতে কাঁপতে তার নিকটে গেলাম। সেদিন সিরাজীর মা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “বাবা আমার ইসমাইলকে এনে দাও, আমি ইসমাইলের লাশ চাই না, তুমি তো মারা যাওনি? কিন- ইসমাইল মারা গেল কেন? সেদিন সিরাজীর মার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সিরাজী মারা গেছে কিন' তাঁকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে সে সব সন্ত্রাসীর কি আজও বিচার হয়েছে? না, তাদেরকে বাংলাদেশের সরকার গ্রেফতারও করেনি। এই গ্রেফতার না করার কারণ কি? শিক্ষাঙ্গনে নিয়মিত সন্ত্রাস হচ্ছে। ইসমাইলের মার মত কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এর কোন প্রতিরোধ মূলক ব্যবস'া সরকার করছেনা। যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস'া হতো তবে আর কোন সন্ত্রাস শিক্ষাঙ্গনে কি হতো?
সিরাজীকে আল্ল্লাহ পাক জান্নাতবাসী করুক, এটাই সকল সময় কামনা করি। আর সিরাজীর কথা যখনি মনে পড়ে তখনি এই গানটা শুনি, ‘ওরা চলে গেছে ওপারে সুন্দর ভুবনে’।
যখন রাজশাহী থেকে বাড়ী যাই তখনি সিরাজীর কবরের পাশে যাই। সিরাজীর কবর দেখে মনে হয় সিরাজী এখনও হাসছে। সিরাজীর কবরের পাশ থেকে আসতে মন চায় না। এই বলে মনকে সান-্বনা দেই-“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত।”
(লেখকঃ মো: আ: হালিম, শহীদ ইসমাইলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বাংলা শেষ বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
শহীদ ইসমাইল একটি ফুটন্ত গোলাপ
স্মৃতির পাতা খুললে যার কথা হৃদয়ে দাউ দাউ করে যন্ত্রণার আগুন প্রজ্জ্বলিত করে তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার অতি প্রিয়, স্নেহভাজন ভাই শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মাঝ থেকে বাছাই করা কুড়িয়ে পাওয়া মনি মুক্তার সাথে তুলনা করলে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। যার হৃদয় জুড়ানো ভালবাসায় প্রথমেই তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছিলাম। যার হৃদয় নাড়ানো হাসিতে মনটা জুড়িয়ে যেত। যাকে দিনে একবার না দেখলে মনে হত হৃদয়ের মাঝে শূন্যতা বিরাজ করছে। যার কণ্ঠ শুনলে কান খাড়া করে পরবর্তী কথা শুনার অপেক্ষায় থাকতাম। তাকে হারিয়ে পিতা হারানোর বিলাপের ন্যায় চক্ষু ভিজিয়ে ছিলাম। অথচ আমার পিতাকে ছোটবেলায় হারিয়েও একটু চোখের পানি ফেলিনি। ধৈর্য্যের মাধ্যমে পরিসি'তির মোকাবিলা করেছি। কিন' আন্দোলনের এ প্রিয় সাথীকে হারিয়ে বিলাপ না করে ধৈর্য ধরতে পারিনি। ধৈর্যের বাঁধকে ভাঙ্গতে হয়েছিল। শহীদ ইসমাইলের শাহাদাতের খবর প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। মনে হয়েছে সে হয়তো বেঁচে আছে। ভেবেছিলাম একজন জীবন- চরিত্রের ছাত্র এভাবে অকালে ঝরতে পারে না।
শহীদ ইসমাইল নবাব আব্দুল লতিফ হলের ছাত্র ছিলেন। সদা বিনয়ী এ ছাত্রটি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে সকল ছাত্রদের আপন করে নেন। তার ব্যক্তিগত কাজ কর্মের ক্ষেত্রে সহযোগিতার অভাব হত না। সবাই তার কাজ করে দিতে লোভাতুর ছিল। তিনি ১৯৯৩-৯৪ সেশনে রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমান শিবিরের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের ক্লাসমেট ছিলেন। বাংলা বিভাগের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে সংক্ষিপ্ত সময়ে আপন করে নেন। শহীদ ইসমাইলের আগমনের জন্য ক্লাসের সবাই প্রতিক্ষায় থাকত। সিরাজগঞ্জের কৃতি সন-ান বেলকুচিতে বড় হয়ে ওঠেন। সেখান থেকে স্কুল ও কলেজের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে পা বাড়ালের শহীদ ইসমাইল।
শহীদকে নিয়ে মা-বাবার খুবই আশা ছিল। বাবা চিন-া করতেন ইসমাইল পরিবারের দুঃখ ঘোচাবেন। ছোট্ট খোকা থেকে ইসমাইলকে তাই আদরে সোহাগে বড় করে তুলে ছিলেন। বাড়িতে গেলে মা শহীদ ইসমাইলকে বের হতে দিতেন না বাড়ি থেকে। মা কাছে বসিয়ে রাখতেন। গল্প শোনাতে বলতেন ভার্সিটির। আর শহীদ ইসমাইল ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় কর্মী হবার সাথে সাথে ইসলামী আন্দোলনের জন্য পাগল পারা এ ভাইটি সকল সময় ব্যস- থাকতেন। ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। দ্বীনের মূর্ত প্রতীক ইসমাইল ভাই বিশ্রামের সুযোগ পেতেন না। শহীদ ইসমাইলের চেহারা সুন্দর ছিল। হালকা পাতলা গড়নের ভাইটি আকর্ষণীয় চেহারায় আবির্ভূত হয়ে অতি সহজেই কাছে টেনে আনতেন তার চুম্বকীয় শক্তি দিয়ে। চুম্বক যেমন লোহা বা লোহা জাতীয় দ্রব্যকে আকর্ষণ করে তেমনি ইসমাইল অতি সহজে ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম ছিলেন। শহীদ ইসমাইল মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল।
তিনি শত ব্যস-তার মাঝেও সময় সচেতন ছিলেন। প্রয়োজনীয় সময়ের পাঁচ দশ মিনিট পূর্বে আসতেন। নির্দিষ্ট সময়ের পরে আসতেন না। যে কোন কাজ সুনিপুনভাবে করতেন। কাজে তাড়াহুড়ো করতেন না। কোন কাজ দিলে খুব ধীরগতিতে সুনিপুন হাতের পরশে সুন্দর করে তুলতেন।
কর্তব্যে অবহেলা ছিল শহীদ ইসমাইলের চরিত্র বিরোধী। তার কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে তিনি ছিলেন সদা সচেতন। একাগ্রচিত্তে কার্য পালনে সব সময় থাকতেন ব্যতিব্যস-। কোন কাজ দিলে অপূর্ণ ভাবে রাখতেন না। অতি সত্তর কাজের পূর্ণতা এনে দিতে পারতেন।
আল্লাহর আদেশ পালনে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। ইবাদতে কখনও অবহেলা প্রদর্শন করেননি। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। আর সর্বদা গভীর জিকিরে মশগুল থাকতেন আল্লাহর জিকির থেকে ক্ষনিকের জন্যও বিরত থাকতেন না। একদিন তার এ আমলের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আল্লাহর কথা স্মরণ করলে আমার মন প্রশানি-তে ভরে যায়। জিকির না করলে শরীরের সি'রতা থাকে না। সব সময় ছটফট করতে থাকি।”
ফুলের বাগানে সকল ফুলই শোভা বর্ধন করে। তবে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে হাতে গোনা কয়েকটি ফুল দর্শকদের হৃদয় কাড়ে। শিবির নামক বাগানে অনেক ফুলের সমাবেশ ঘটেছে। তবে হৃদয় তন্ত্রীতে সকল ফুল অবস'ান করতে পারেনি। হৃদয়ের মাঝখানে সর্বোচ্চ আসনে স'ান করলেন শহীদ ইসমাইল। তিনি বাগানের ফুটন- গোলাপের মত সুবাস ছড়ালেন, সে সুবাস পেয়ে অনেকেই মাতোয়ারা হলো। ক্ষণিকের এ সুবাস পাগল পারা ভ্রমররা ভুলতে পারল না। আল্ল্লাহ ফুলের বাগানের সৌন্দর্যকে ম্লান করে সে ফুলকে তুলে নিলেন তারই নিকটে।
১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ সালের সে দৃশ্য হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। জানিনা এ সকল দুনিয়াবী জুলুমের শেষ কোথায়? জুলুমবাজরা মহাদাপটে ঘুরছে এ নশ্বর পৃথিবীতে। তাদের পায়ের আঘাতে জমিনও চিৎকার করে বলছে, প্রভু গো! তুমি আমাদের জালিমের জুলুম থেকে রক্ষা কর। মহান পালনকর্তা মাটিকে আশ্বাস দিয়ে বলছে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর। এ সুযোগ তুমিও একদিন পাবে। তোমার পেটে আমি তাদের কিছুকাল আটকে রাখব। তোমাদের পাওনা ও প্রতিশোধ তখন পুরোপুরি আদায় করে নেবে।
মোকাম্মেল বাহিনীকে তাড়া করে শিবির কর্মীরা যখন জিয়া হলের সামনে দন্ডায়মান, সে সময় হায়েনাদের স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল শহীদ ইসমাইলের বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। কালেমা পড়লেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলু্ল্লাহ”। সারা দেহ রক্তে রঞ্জিত। শহীদদের সাথীরা ধরাধরি করে ঘাড়ে তুললেন। কিন' তখন শহীদ ইসমাইল তার প্রভুর নিকট হাজির ------ ইন্না লিল্লাহে ---।
লাশের নিকট ক্ষণিক দাড়িয়ে থেকেছি হঠাৎ আনমনা হয়ে গেছি মনে হলো আমি যেন এ নশ্বর দুনিয়াতে নেই। আমিও যেন তার সঙ্গে আল্ল্লাহর দরবারে হাজির হয়েছি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হলাম। মনে হলো মারা যাবার পরও তিনি যেন হাসি মুখে সবাইকে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হবার আহ্বান জানাচ্ছেন। চেহারায় কোন মলিনতা নেই, মনে হচ্ছে যেন একজন মানুষ সাধারণভাবে ঘুমিয়ে আছে। আল্লাহর বাণীতে আমরা বুঝতে পারি, যারা শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন তাদের মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় না। একটা পিঁপড়ার কামড়ের ব্যথা শুধু অনুভূত হয়। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমরা ঘোষণা করছি-‘ঘুমাও ইসমাইল শানি-তে, তোমার প্রভুর সংস্পর্শে। আমরাও আসছি, আমাদের জন্য তোমার পাশে একটু জায়গা করে দিও ভাই!
(লেখক: মোঃ শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মোহতারাম সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি)
সাংগঠনিক মান: সাথী
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১২ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫।
পিতার নাম: মো: ছবেত আলী মুন্সী
সর্বশেষ পড়াশুনা: ১ম বর্ষ সম্মান, বাংলা বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: সরকারী চাকুরী।
শহীদ হওয়ার স্থান: হবিবুর রহমান হলের সামনের মাঠ।
আঘাতের ধরন: স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে বুক ঝাঁঝরা।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রদল।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: চালা, ডাক: বেলকুচি, থানা: বেলকুচি, জেলা: সিরাজগঞ্জ।
ভাইবোন : ৭ জন।
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান: ছোট।
পরিবারের মোট সদস্য: ৯ জন।
পিতা: জীবিত, পেশা: ব্যবসা।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: শহীদ ইসমাইল তার শাহাদাতের পূর্ব দিন ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ বলেছিলেন, “যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাতিলের সঙ্গে আগামী কাল লড়াই হয় তাহলে আমি শাহাদত বরণ করবো।”
শাহাদতের পর শহীদের পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া: শহীদের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার সাথে সাথে শহীদের মাতা বেঁহুশ হয়ে পড়ে যান। পিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলতে থাকেন, “আমার ইসমাইল মরেনি। মরতে পারে না।”
শহীদ ইসমাইলের আম্মা যা বললেন...
শৈশব ও কৈশোর জীবন কেটেছে বেলকুচি থানার আলো বাতাসে। আসে- আসে- গড়ে উঠেছে প্রকৃতির মত। নম্র, ভদ্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী এক জান্নাতী যুবক নাম তার ইসমাইল হোসেন সিরাজী। চার ভাই তিন বোনের সবার মাঝে ছোট। পিতা তাঁত ব্যবসায়ী, মাতা গৃহিনী। বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের এক নৈসর্গিক দৃশ্য বেলকুচির তাঁত। রাস-ার দুইধারে কিংবা বসত বাড়ির সুবিধা মত জায়গায় তাঁত আর তাঁত। পথ চলছি দুটো মটর সাইকেল যোগে। শহীদের বাড়ি পৌঁছার পূর্বে দেখতে পাওয়া যায় দেলুয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসা থেকেই শহীদ ইসমাইল দাখিল পাশ করেছিলেন। তাই মাদ্রাসায় নামলাম। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে ইসমাইল ভাই সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, “শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ছিল খুব নম্র, ভদ্র। তার ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম ছিল আব্দুল হালিম। ইসমাইল এবং হালিম আমার কাছে আরবী ব্যাকরণ পড়ত। পড়াশুনায় ইসমাইলের তুলনায় হালিম কিছুটা ভাল ছিল। হালিমের দেখাদেখি ইসমাইলও পড়াশুনায় জোর দিল। আমি তাদের দু’জনকেই ভালভাবে পড়াশুনার জন্য উৎসাহ দিতাম। ফলে দুইজনই পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিয়েছিল। বাড়ি আসলেই সে আমার সঙ্গে দেখা করত ও খোঁজ খবর নিত। আমিও তার কাছে তার পড়াশুনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক অবস'ার খোঁজ খবর নিতাম। শাহাদাত বরণের কয়েক দিন পূর্বেও তার সাথে আমার কথা হয়েছিল।” অধ্যক্ষ সাহেবের কথাগুলো সহজ সরল হলেও তা ছিল হৃদয়গ্রাহী ও খুবই বেদনাবহ। এই মাদ্রাসা থেকেই তিনি ১৯৯০ সালে মানবিক শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে দাখিল পাশ করেছিলেন। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বেলকুচি গোরস'ানে শহীদ ইসমাইল চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
বাড়ি যাবার পথেই গোরস'ান। সুতরাং কবর জিয়ারত করে যাওয়াকে সবাই ভাল মনে করল। পৃথিবীর আর কিছু দেখলে ভয় হোক আর না হোক গোরস'ানের দিকে তাকালে সবার কম বেশি ভয় হয়। কত পুরুষ, নারী ও শিশু প্রতিবেশির মত বসবাস করছে গোরস'ানে।
তাদের দিন হয়না শুধু রাত আর রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, ঘর-সংসার, হাট-বাজার নেই ওদের। অনেকেই হয়ত শানি-র পরশে ঘুমাচ্ছে। কিয়ামাতের পূর্বে ডাকলেও আলস্যে বলবে, “উহ্! এই মাত্র ঘুমালাম, দিলেত আমার ঘুমটা নষ্ট করে।” আবার অনেকেই দুনিয়ার অর্থ, যৌবন আর প্রবৃত্তির হেয়ালিপনার খেসারত দিতে শশব্যস-। কবর জিয়ারতের সময় এক আশ্চর্য ও সৌভাগ্যজনক ভাবে শহীদের পিতা আমাদের সাথে শরীক হলেন। তখন ভীষণ আনন্দে আমাদের হৃদয় পুলকিত হচ্ছিল। কিন' শহীদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ পিতা হাত তুলেছেন আমাদের সাথে। কি যে বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কথার চেয়ে সবাই মিলে হাউমাউ করে অবুঝ শিশুর মত কাঁদছিলাম।
জিয়ারত শেষে পৌঁছালাম শহীদের বাড়ি। আমাদের দেখে শহীদের আম্মা যে কান্না শুরু করল তা আমাদের সবাইকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করে তুলল। শহীদের আম্মা কিছুতেই আমাদের কোন অনুরোধ, উপরোধ, সান-্বনা মানছেন না। সে যে কি মর্মস্পর্শী অবস'া, যা বর্ণনা করতে গেলে কলম থমকে দাঁড়ায়। কেঁদেই চলেছেন। শহীদের পিতাও কান্না শুরু করলেন। বৃদ্ধ পিতার কান্না দেখে আমাদের সবার চোখ ছলছল করছে। সাত খুনের আসামীর মত জঘন্য অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে। কান্নার শব্দে বাড়ির ছেলে-মেয়ে যে যেখানে ছিল ছুটে এল, না জানি নতুন কোন দুর্ঘটনা ঘটল! কিন' আশ্চর্যের ব্যাপার বাড়িতে এত লোক তবুও পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতার সাথে একা্ততা ঘোষণা করছে বাড়ি ঘেরা গাছগাছালিরা। শহীদের আম্মার কান্নারোধে আমরা সবাই ব্যর্থ ও ভাষাহীন। বেশ কিছুক্ষণ পর আম্মা শান- হলেন। শুরু করলেন তার প্রিয় ইসমাইলের স্মৃতিচারণ-
“কি কথা বলব বাবা! আমার ইসমাইল আর নেই। বাড়ির সবার ছোট হওয়ার কারণে সবাই তাকে খুব ্লেহ করত, আদর করত, ভালবাসত। বাড়ির কোন কাজকর্ম তাকে কোন দিনও করতে দেইনি। কোনদিন শখ করে মাঠে বেড়াতে গেলেও ওর বাবা ওকে নিষেধ করত। ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, আ্তীয়-স্বজন সবাই তাকে ভালবাসত। বন্ধু-বান্ধব সবাই একসাথে বেড়াত, ঘুরত। একা একা কোন জিনিস খেত না, যা খেত সবাই মিলে মিশে খেত। বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন সংগঠনের কাজ করে রাত্রে বাড়ি ফিরত। আর আমি তার ঘরে শুধু তারই খাবার রাখতাম। তখন সবাই ভাগ করে খেত। আমি বলতাম, ও বাজান! তুই আমারে ডাকলিনা খাবার তো ঘরেই ছিল। একজনের খাবার দুই তিন জন কি করে খাস? বাজান বলত, খাবারের বরকত আছে মা।”
কালজয়ী পুরুষ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইবাদত, বন্দেগী, আমল আখলাক ছিল সবার জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও শিক্ষনীয়। এ প্রসঙ্গে শহীদের আম্মার আরো স্মৃতিচারণঃ
“ইসমাইল ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই নামাজ পড়ত, রোজা রাখত। এর পর আমার জানা মতে সে কখনও নামাজ ক্বাজা করেনি। ছোট বেলায় একবার মাদ্রাসা থেকে এসে বলল, “ওমা হুজুর আমাকে মুসলমানি দিতে বলেছে, মুসলমানি না দিলে নাকি এবাদত বন্দেগী হয় না।” ওতো সবার ছোট ছিল তাই ওর কোন আব্দার আমি কেন, বাড়ির কেউ ফেলতে পারত না। তাই ছোট হলেও ওর বড় ভাইয়ের সাথে মুসলমানি দিয়েছিলাম শুধু আব্দারের কারণে। নামাজের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিল। মসজিদ ছাড়া কখনও বাড়িতে নামাজ পড়ত না। শীত, গ্রীষ্ম, ঝড় বাদল সব সময় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত। বাড়ির কেউ নামাজ না পড়লে তাকে বুঝাত, পাড়াপড়শিকে নামাজের জন্য ডাকত। জুম্মার দিন হলে পাড়ার মধ্য দিয়ে মসজিদে যেত আর মানুষদের মসজিদে আসার জন্য বলত।” অসুখ বিসুখেও নামাজ ক্বাজা করেনি। এ প্রসঙ্গে শহীদের আম্মা একটি ঘটনা বললেন-
“যখন ইসমাইল সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। সেই সময় একবার ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। ওর প্রেসারের সমস্যা ছিল, খেলতে খেলতে হঠাৎ তার প্রেসার বেড়ে যায়। সবাই মিলে তাকে বাড়ি নিয়ে এলো। আমি তার মাথায় পানি ঢালা শুরু করলাম। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এসে তাকে আমাদের অভয় দিয়ে গেলেন। তখন মাগরিবের সময় আসন্ন। ইতোমধ্যে আযান শেষ হয়ে গেল। আযান শুনে আমার ইসমাইল বলল, “ওমা আযান হয়ে গেল আমার মাথা মুছে দাও নামাজ পড়ব।” আমি মাথা মুছে দিলে শায়িত অবস'ায় ইশারায় নামাজ পড়ল। দিনে ৪/৫ বার মেছওয়াক করত। আমি যদি বলতাম, ও বাজান তোর দাঁত ক্ষয় হয়ে যাবে, এত মেছওয়াক করিস না। কথা শুনে বাজান আমার হাসত। রোজাকে নামাজের মতই গুরুত্ব দিত। ছোট থেকেই রোজা রাখত। আমি রোজা না থাকার জন্য বললে, বলত-“ওমা ওসব কথা বলবে না, গুনাহগার হবে।” রোজা থেকেই স্কুলে যেত। কোন কোন দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে না খেয়েই রোজা রাখত। সামান্য চাল পানি খেতে বললেও কিছুতেই খেতে চাইত না। ইফতার করত বন্ধু বান্ধব সহ এক সাথে। ফরজ রোজা ছাড়াও সবে বরাত, সবে মেরাজ সহ প্রায় মাসে দু’একটি করে রোজা রাখত।”
আম্মা যখন শহীদ ইসমাইলের মেছওয়াক করার কথা বলছিলেন তখন আমার একটি হাদীস মনে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মাতের যদি কষ্ট না হতো তাহলে আমি তাদেরকে মেছওয়াক করা ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে বলতাম।” শহীদ ইসমাইল এই হাদীস বিশ্বাসের পাশাপাশি আমলের প্রতিও মনোযোগ দিয়েছিল। সেহেরীর পূর্বে শহীদ ইসমাইল হোসেন তার মহান প্রভুর সামনে পবিত্র হয়ে জায়নামাজে দাঁড়াতেন। এই তাহাজ্জুদের নামাজকে এ অঞ্চলের মানুষ সবাই বলতো কি না জানি না। তবে শহীদ ইসমাইলের আম্মার কাছে এ নামাজ বিশ্বাসের নামাজ বলে পরিচিত ছিল। আর এই বিশ্বাসের নামাজ বেশি বেশি করে পড়তো শহীদ ইসমাইল শাহাদাতের পূর্বে। শাহাদাত বরণের আগের দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ রাত্রেও তার সাথীরা তাকে সেই বিশ্বাসের নামাজ পড়তে দেখেছে।
জীবন যাপন ছিল স্বাভাবিক। লুঙ্গি, পাজামা, পাঞ্জাবী বেশি ব্যবহার করতেন। ্লেহের ভাতিজাদের আদর করতেন। সকাল সন্ধ্যা পড়তে বসাতেন। আর বলতেন, “কাউকে অশিক্ষিত রাখবো না, সবাইকে মানুষ করব।” পড়াশুনার জন্য সবাইকে শাসন করতেন। বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালবাসা শহীদ ইসমাইলের থাকার ঘরটি ছিল অন্যান্য ঘরের দক্ষিণ পূর্বে। ঘরে ভাল বাতাস লাগত বলে বাড়ি হতে রাজশাহী আসার সময় তার শ্রদ্ধেয় পিতাকে তার ঘরে ঘুমানোর কথা বলে আসত।
শহীদের প্রিয় খাবার ছিল পোলাও ও গোশ্ত। বাড়িতে ভালমন্দ রান্না হলে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী পিতার মুখে খাবার তুলে দিত। পিতা আপত্তি জানালে শহীদ ইসমাইল বলত, “খাও বাজান আমিতো প্রায় খেয়েই থাকি তুমিই খাও।” ভাই ও ভাবীদের নামাজের কথা বলার পাশাপাশি ভাবীদের পর্দার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলত। তাদের বাড়ির বাইরে যেতে এবং বেশি কথা বলতে নিষেধ করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়-য়া আদরের ছোট ভাই সবার ছিল মাথার মণি। বাড়ির চার ভাই যার জন্যই নতুন শার্ট, লুঙ্গি কেনা হতো না কেন, শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী আগে পরতেন। কিছু দিন পরার পর যার জিনিস সে পরত। বড় দুই ভাই শশুর বাড়ি থেকে নতুন পোশাক উপহার পেলেও ইসমাইল আগে কিছুদিন পরতেন এরপর তার ভায়েরা পরত।
শহীদ ইসমাইল টাঙ্গাইল জেলা থেকে ১৯৯২ সালে আলিম মানবিক দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। বহু আশা, আকাঙ্ক্ষা আর উদ্দীপনা নিয়ে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার জন্য। চান্স হল বাংলায় আর সংযুক্ত হল নবাব আব্দুল লতিফ হলে। সঙ্গত কারণেই সে চলে গেল লতিফ হলে। আজ তার স্নেহ মাখা মুখের নম্রতা আর ঝক ঝকে দাঁতের কথা ঢের মনে পড়ে। তার ্লেহ ভরা মুখের কথা স্মরণ হলেই মন চলে যায় ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ এর এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে। যেই সকাল কেড়ে নিয়েছিল আমাদের মাঝ থেকে এক বৃনে-র দু’টি ফুলকে।
শাহাদাত বরণের পর রাজশাহী থেকে আনা ইসমাইল ভাইয়ের ট্রাঙ্কটি দেখতে লাগলাম। ট্রাংক ভর্তি কাপড়, গেঞ্জি, টুপি, জেট, শার্ট, কিছু বই পুস-ক, ব্যক্তিগত দুটি ডায়রীসহ অনেক কিছু দেখলাম। ট্রাংকের জিনিসপত্র দেখে শহীদের পিতামাতার বুকফাটা কান্না আবার শুরু হল। শহীদের মাকে বাঁধাদান সত্তেও কাপড় চোপড় নাড়ছে আর বুকে জড়িয়ে ধরছে। এভাবে কাঁদলে পরে অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। এ ভয়ে ওগুলো আম্মার কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা অনেকেই করছে কিন' আম্মার আবেগের কাছে আমরা বার বার পরাজিত হচ্ছিলাম।
শহীদের বৃদ্ধ পিতা টুপি হাতে নিয়ে কাঁদছেন। টুপির গন্ধ নিচ্ছেন, চুমু খাচ্ছেন আর তার চোখ থেকে বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায়। আমার মনে হচ্ছিল ওরা কাঁদুক। যত ইচ্ছা কাঁদুক। ওদের প্রাণ ভরে কাঁদতে দেওয়া উচিত। আমার হৃদয়ে তখন মরুভূমির ঝড় প্রবাহিত হচ্ছিল। মা-বাবার ছোট ছেলে ইসমাইল যাকে কেউ কোনদিন কষ্ট দেয়নি, দেয়নি দুঃখ, করেনি কাজের নির্দেশ। বিষয় একটিই তা হলো ইসমাইল পড়াশুনা করছে, মানুষের মত মানুষ হবে, বড় হয়ে চাকুরি করবে, সবার মুখ উজ্জ্বল করবে, শানি-র বাকবাকুম ঘরের চালে উড়বে। হায়রে শানি-! রঙিন ফানুস হয়ে গেল। রক্ত পিপাসু হায়েনারা থামিয়ে যাও শহীদের পিতামাতার বুক ভাঙ্গা কান্না। তোমরা কিভাবে পারলে শহীদ ইসমাইলের খুন ঝরাতে?
তার ব্যক্তিগত ডাইরী খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ২৬ জানুয়ারী ’৯২ ইং তার সাথী শপথ হয়েছিল টাঙ্গাইলের আশ-শিফায়। শপথ দিয়েছিলেন তৎকালীন অফিস সম্পাদক জনাব মোঃ আবুল কালাম আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমি তার সাংগঠনিক সক্রিয়তা লক্ষ্য করেছি। শহীদ ইসমাইলের শহীদ হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। শহীদি মৃত্যুই বেহেসে-র নিশ্চিত পথ জেনেই মনে প্রাণে তিনি শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতেন। তার বিভিন্ন কথা বার্তায় তা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। অশান- বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস'ায় মা থাকত সদা শংকিত। তাই শহীদের মাতা প্রায়ই বলতেন, “বাজান একটু দেখেশুনে থাকিস।” উত্তরে শহীদ ইসমাইল বলেছিল, “ছাত্র কালে মারা গেলে কত সুখ, হিসাব কম দিতে হবে। কবরে থাকব ছাত্র হয়ে, তুমি আফসোস করো না, তুমি কেঁদোনা মা শহীদ হয়ে মরলে কোন কষ্ট হয় না।”
এমন কিছু অস্বাভাবিক কথা বার্তা বলে শহীদ ইসমাইল বাড়ি থেকে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন। কয়েক দিন পর শহীদ ইসমাইলের আম্মা স্বপ্ন দেখলেনঃ বাড়ির চারিদিকে থৈ থৈ পানি। দক্ষিণ দিক থেকে দু’টি লাশ পানিতে ভেসে আসছে। একটি লাশ লুঙ্গি পরা, দেখতে অবিকল শহীদ ইসমাইলের মতো। অপরটি তিনি চিনতে পারছেন না। পরিচিত লাশটিকে তার এলাকার মানুষ ধরে দাফনের ব্যবস'া করলেন। অন্যটি পানিতে ভেসে চলে গেল।
কি অদ্ভুত শহীদের জননীর স্বপ্ন! স্বপ্ন সত্যিতে পরিণত হলো। ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ ছাত্রদলের খুনীরা সুন্দর কুয়াশাচ্ছন্ন রমজানের সকালকে করেছিল দূষিত, মতিহার চত্বর করেছিল রক্তাক্ত। বীরশ্রেষ্ঠ দু’জন তরুণ আদর্শের সম্রাটকে খুন করে। লাশ পানিতে ভেসে নয় বরং শহীদ ইসমাইলের হাজার হাজার সাথীরা ট্রাক যোগে পবিত্র আত্মা নিয়ে হাজির হয়েছিল বেলকুচির চালা গ্রামে। শহীদ ইসমাইলের আম্মার আল্লাহ প্রদত্ত স্বপ্নের এলহাম আর বাস-বতার ঐক্য নিয়ে হাজির হলো একটি লাশ নাম তার শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
(লেখক: ইবনে হক, ইসলামের ইতিহাস শেষ বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
স্মৃতির অন্তরালে
পড়ন্ত বিকেল। বসনে-র কোমল হাওয়া বইছে। এমনই এক মনমুগ্ধকর স্মৃতিমধুর প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্যাম্পাসে হাঁটছি। সাথে ইসমাইল হোসেন সিরাজী। চারদিকে গাছগুলোর সবুজ পাতা দুলছে বসনে-র ঝিরঝিরে কোমল বাতাসে। মনে হচ্ছে যেন কল্পণার স্বপ্নাকাশে মতিহার চত্বরের শহীদ ভাইদের অপূর্ণ সাধ পূরনের উদাত্ত আহ্বান ব্যক্ত করছে প্রকৃতির এই বাকহীন সত্তাগুলো।
ইসমাইল ভাই ক্যাম্পাসে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সব কিছুই নতুন। তাই ক্যাম্পাসে শহীদ ভাইদের অতীত ইতিহাসের অজানা-অচেনা ঘটনাগুলো জানার অদম্য স্পৃহা তার জিজ্ঞাসু হৃদয়ে বার বার প্রশ্ন করছেন-“কোনখানে আমাদের প্রিয় ভাই শফিকুল ইসলাম শাহাদাত বরণ করেছিলেন? কোন স'ানে জব্বার, হামিদ, আইয়ূব, রবিউল, মুস-াফিজ ভাই তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের ভিত রচনা করেছিলেন? আমি সে মিছিলে শরীক হয়ে নিজেকে ধন্য করতে পারব তো?”
মহান আল্ল্লাহ পাক তার এই সাধ পূরণ করেছেন। সত্যিই তিনি সাব্বির, হামিদ, আইয়ূব, জব্বার, আসলাম, আসগর, শফিক ভাইসহ অসংখ্য ভাইদের সাথে শহীদি মিছিলে অংশ নিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। সেদিন ছিল ১৯৯৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী। পবিত্র রমজান মাস। আগের রাতে সন্ত্রাসীরা সোহরাওয়ার্দী ও হবিবুর রহমান হলে হামলা চালিয়ে বেশ কিছু রুম ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করেছিল। তাই পরবর্তী দিন বাদ ফজর আমরা ঘটনা পর্যালোচনার জন্য বিনোদপুরে সদস্য বৈঠকে মিলিত হয়েছিলাম। এদিকে হলগুলোতে ছাত্ররা রমজানের সেহরী খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সকাল বেলা ছিল প্রচন্ড কুয়াশাচ্ছন্ন। খুব কাছ থেকেও কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। হঠাৎ আমাদের কাছে খবর
এলো সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা প্রচুর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রচন্ড হামলা চালিয়েছে। আমরা দ্রুত ক্যাম্পাসে চলে এলাম। এসে দেখি সন্ত্রাসীরা ভোরের নীরবতা নিস-ব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে তান্ডবতায় মেতে উঠেছে। প্রচন্ড গুলি আর বোমার বিকট শব্দে মতিহারের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ দেখতে পেলাম শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দু’জন ভাই। তখনও তাঁর দেহ থেকে পুণ্যাত্ম বের হয়ে যায়নি। দেখে আৎকে উঠলাম আমি। এক ঘণ্টা পর ততক্ষণে সন্ত্রাসীরা পালিয়েছে শুনলাম আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে আমাদের প্রাণ প্রিয় ভাই ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজুর রহমান। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারছিলাম না। হৃদয়ের মনি কোঠায় বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল-এতক্ষণে ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাইয়ের আব্বা আম্মা কী করছে। শাহাদাতের খবর শুনলে তারা কিভাবে নিজেদের সংযত করবেন। কোন অপরাধে তাদের বুক খালি হল। যে ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাই পিতা-মাতার একরাশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বুকে বেধে নিয়ে মতিহারের এ পবিত্র শহীদি আঙ্গিনায় পদার্পন করেছিলেন, সন্ত্রাসীদের হিংস্র ও কাল থাবা তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। ৪ বছরের কোর্স যেখানে ৮বছরেও শেষ হয়না, অথচ মাত্র কয়েক মাসে তারা কোর্স শেষ করে আল্ল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন স্রষ্টার পানে। তারা পৌঁছে গেছে তাদের চূড়ান- মঞ্জিলে।
শহীদ ইসমাইল ভাইকে খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি ছিলাম তখন নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখার সেক্রেটারী আর ইসমাইল ভাই ছিলেন হল শাখার অফিস সম্পাদক। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও মার্জিত ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করত। তাইতো সেই প্রাণ কাড়া মার্জিত ব্যবহার আর হাস্যোজ্জ্বল বদনখানি হৃদয়ের মনি কোঠাতে নাড়া দেয়। এখনও সে সকল স্মৃতিগুলো হৃদয়ের অন-রালে লুকোচুরি খেলছে আলো আঁধারের মত।
আজও সেই ক্যাম্পাস আছে। আছে ক্যাম্পাসে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণা। আছে ক্যাম্পাসের সবুজ মনোরম প্রকৃতির হাতছানি, আছে বিস-র সবুজের গালিচা। তারা শুধু কালের আবর্তে সাক্ষী হয়ে আছে। নেই শুধু ইসমাইল হোসেন সিরাজী। নেই রবিউল, মুস-াফিজ, আসলাম, আসগর, হামিদ, জব্বার, আইয়ূবসহ অগনিত ভাই। নেই তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর পদচারণা। কিন' তারা দিয়ে গেছেন আমাদের চলার পথের প্রেরণা। সেই প্রেরণার রশি ধরে এগিয়ে চলেছি অজানা ভবিষ্যতের পানে। তবুও স্মৃতির রাডারে বার বার ভেসে আসে ইসমাইল ভাইয়ের সেই হৃদয়গ্রাহী উক্তি-“আমিও সেই মিছিলে শরীক হয়ে নিজেকে ধন্য করতে পারব তো?”
(লেখকঃ মো: সুজা উদ্দিন জোয়াদ্দার, সভাপতি, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
অম্লান স্মৃতিঃ শহীদ ইসমাইল
বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তা’লার ডাকে মানুষ একদিন তার সমস- সত্তাকে বিলিয়ে দিয়ে আপন প্রভুর কাছে একান-ভাবে চলে যায়, নিজের অসি-ত্বকে কুরবানী দিয়ে। আশার সোনালী প্রদীপ নিভিয়ে সাদা শুভ্র কফিনে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক, বিধাতার চিরাচরিত নিয়ম। কিন' কখনও যদি আশার প্রদীপ অপ্রত্যাশিত ভাবে দক্ষিণা সমিরণে দপ করে নিভে যায়, তখন স্রষ্টার সুন্দর ধরনীর মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই অন্ধকারের ঘোর অমানিশা নেমে আসে।
এমনি অপ্রত্যাশিতভাবে অন্ধকারের ঘোর অমানিশা টেনে নিভে গেছে একটি প্রজ্জ্বলিত আশার প্রদীপ। ঝরে গেছে সুন্দর একটি লাল গোলাপ, কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত হবার আগে। হাজারো নক্ষত্র হতে ছুটে গেছে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে একটি মিষ্টি সুবোধ ছেলে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মায়ের দামাল সন-ান। শহীদি কাফেলার মিছিলে সংযোজিত হয়েছে আর একটি নতুন অধ্যায়; একটি ইতিহাসঃ একটি নাম শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
যেন অনল প্রবাহের কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বিপ্লবের উত্তরাধিকারী। সেদিন কি বার ছিল মনে নেই। তবে সময় টি ছিল ১৯৮৯ সনের প্রথম দিক। রৌদ্র ঝলমল ছিল আকাশ। স্নিগ্ধ হাসি হেসে সোনাঝরা সূর্য উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। ২/৩টি বাইসাইকেলে চড়ে বেলকুচি থানার সাথী শাখার সাবেক সভাপতি মীর মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা রওয়ানা হলাম দেলুয়া আলিম মাদ্রাসায় শিবিরের সাধারণ সভায়। অনেক ছাত্রের উপসি'তি। সামনে বসে আছে মিষ্টি শান- একটি ছেলে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এবং তার প্রিয় বন্ধু আঃ হালিম সহ অনেকেই।
তন্ময় হয়ে শুনল আমাদের আলোচনা। সকলেই সমর্থক ফরম পূরণ করল, সাথে সাথে ইসমাইল ভাইও। তখন ইসমাইল ভাই নবম
শ্রেণীর ছাত্র। আমি সবেমাত্র সাথী হয়েছি। খুব ছোট ছিলাম বলেই মুহাম্মদ ভাই অত্যন- স্নেহ করতেন। তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন, অম্ল্লান প্রাণ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের সাথে। সেই থেকে শহীদ ইসমাইল ভাইকে একান-ভাবে কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এরপর থেকে বেলকুচির অনেক প্রোগ্রামেই কখনও কলেজ ক্যাম্পাসে, রাজপথের মিছিলে শহীদ ইসমাইল ভাইকে কম বেশি পেয়েছি।
তবে সাথী হিসাবে শপথ গ্রহণের পর থেকে সাংগঠনিক জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের করটিয়া কলেজে। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনশক্তি হিসাবে। মূলতঃ শহীদ ইসমাইল ভাই হাজারো স্বপ্নের ইমারত গড়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রকৃতির লীলাভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন' সব স্বপ্নের ইমারত চোরাবালির বাঁধের ন্যায় ভেঙ্গে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে যান একান-ভাবে আপন প্রভুর কাছে। শাহাদাত এর সময় তিনি সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ সাথী ছিলেন।
মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাড়ি আসতেন। খোঁজ খবর জানতে চাইতেন বেলকুচির কাজের অবস'ার। শুধু খোঁজ খবর নিয়েই বসে থাকেন না বরং বুদ্ধি, পরামর্শ ও শারীরিক শ্রম দিয়ে বেলকুচি থানায় ইসলামী আন্দোলনের কাজে সহযোগিতা করেছেন। আমি ইসমাইল ভাইয়ের কাজের আন-রিকতা দেখে এক এক সময় অবিভূত হয়ে যেতাম। ১৯৯২ সালের কথা। বেলকুচি কলেজে প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠান। বাকি একটি রাত। অনেক চেষ্টা করে টেলিফোনে টাঙ্গাইল শহরের সাবেক সভাপতি, পরিষদ সদস্য আহসান হাবিব ইমরোজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হলো না। সুতরাং প্রধান অতিথি ইমরোজ ভাই এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা বা নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো ছাড়া গত্যন-র নেই। কে যাবে এত রাতে? ইসমাইল ভাইকে যাবার প্রস-াব করলে অধীর আগ্রহ উদ্দীপনায় রাজি হয়ে গেলেন। বললাম, ভাই আপনারতো খুব কষ্ট হবে যেতে। স্নিগ্ধ হাসি হেসে বললেন, সোহেল ভাই, আপনি জি.এস হলে এ কষ্ট থাকবে না।
তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ইসমাইল ভাই শ্যালো নৌকায় ভূয়াপুর দিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং ভোরে রওনা হয়ে ১০টার পূর্বেই প্রোগ্রামে উপসি'ত হলেন। এছাড়া ইসমাইল ভাইকে একান- ভাবে পেয়েছি আমার কলেজ ক্যাম্পাসে। স্বাভাবিক ভাবে বেলকুচি কলেজে আমাদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক তেমন ভাল ছিল না। দেখেছি ইসমাইল ভাই বাড়ি এলে কলেজ ক্যাম্পাসে আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। কর্মীদের সাথে কথা বলতেন। কলেজে মিছিল করার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রাখতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন- সাদা সিধে মানুষ ছিলেন শহীদ ইসমাইল ভাই। রাগ কাকে বলে আমি তার মাঝে কখনও দেখিনি। ব্যবহারে ছিলেন অত্যন- অমায়িক। মিশতেন প্রশস- হৃদয়ের সমস- মাধুরী দিয়ে। মুক্তাঝরা ্লিগ্ধ হাসি, চেহারায় উজ্জ্বল লাবণ্য সব মিলেই শহীদ ইসমাইল ভাই ছিলেন অপরূপ সুদর্শন পুরুষ।
মেধাবী এই কর্ম চঞ্চল তরুণ শহীদ হবার ক’দিন পূর্বে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। বাসে চড়ার পূর্বেই পথে হঠাৎ করে আমার সাথে সাক্ষাৎ হলো। আমার সাথে ছিলেন লুৎফর ভাই সাবেক বেলকুচি থানা সভাপতি। দু’জনকে পেয়ে পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। এমনভাবে আন-রিকতা সহকারে কোলাকুলি করে কথা বললেন, যেন হাজার বছর পর হঠাৎ হারানো বন্ধুর সাথে দেখা হল। আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন “সোহেল ভাই, চলেন রাজশাহী যাই। আপনি গেলে সবাই খুব খুশি হবে। আমার বন্ধু বান্ধব ও দ্বীনি ভাইসহ সকলকে আপনার কথা বলেছি।” অনেক পিড়াপিড়ি করলেন ইসমাইল ভাই। হাসার ছলে অনেক কথাও ইসমাইল ভাইকে বলেছিলাম। কথা দিয়েছিলাম, এবার নয়, আগামীতে আপনি এলে যাব ইনশাল্ল্লাহ। আমার কথায় খুশি হয়ে ইসমাইল ভাই বললেন, “আমি ২৮/২৯ রোযার ভিতর ঈদের পূর্বেই আবার বাড়ি আসব। ঈদ করে ২দিন পর রাজশাহী যাব। তখন আমার সাথে যাবেন কিনা বলুন।” ইসমাইল ভাইয়ের কথায় রাজী হয়েছিলাম যাবার জন্য তার সাথে রাজশাহীতে। কিন' ভাগ্যের বড় নির্মম পরিহাস। ২৮/২৯ রোজা ও ঈদের অনেক পূর্বেই তিনি তার বাড়িতে অপ্রত্যাশিতভাবে এলেন। তবে স্বাভাবিক সুস' মানুষের বেসে কিংবা আমায় রাজশাহী নিয়ে যাবার কোন পরিবেশে নয় বরং শহীদি মিছিলের যাত্রী বেসে সাদা কফিনে সজ্জিত হয়ে।
যখন মুহতারাম শহীদুল ভাই, সিরাজগঞ্জ জেলার সাবেক সভাপতি, সংবাদ জানালেন, ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাই গত ভোর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন তখন নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না। যেন বিনা বজ্রপাতে সুবিশাল আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমার দু’টি চোখে যেন অন্ধকার নেমে এল। অশ্রু ঝরল দু’টি চোখে। নিজের কান্নাকে চেপে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। কিন' পারিনি। শহীদুল ভাই সান-না দিলেন, আপনি যদি দায়িত্বশীল হয়ে ভেঙ্গে পড়েন বাকী কাজ কে সামলাবে? কে দিবে কর্মীদের সান-না? শহীদুল ভাইয়ের কথায় তখন স্বাভাবিক হলেও পরবর্তীতে সে স্বাভাবিকতা আমি ধরে রাখতে পারিনি। অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসমাইল ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছে গেল বেলকুচির প্রত্যন- অঞ্চলে। থানা জামায়াত কার্যালয়ে উপসি'ত হল ছাত্র-জনতা। বোবা কান্নায় ভেঙ্গে শহীদের সাথীরা। দায়িত্বশীল হিসাবে সান-না দিতে চাইলেও আমি পারিনি কাউকে সান-না দিতে। শহীদের কফিনের পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে চাতকের ন্যায় জামায়াত কার্যালয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। রাত্রি ৩-১৬ মিনিট। শহীদের কফিন নিয়ে একটি ট্রাক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এসে থমকে দাঁড়াল। শহীদ ইসমাইলের সাদা শুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত কফিনটি ট্রাক থেকে নামানো হল। কাঠের বাক্স খোলা হল। দেখলাম, পরম নিদ্রায় যেন ঘুমিয়ে আছে শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী।
ইসলাম বিরোধী শক্তির ব্রাশ ফায়ারে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছে বুক। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পেছনের পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ দৃশ্য যেন কোন অসভ্য পৃথিবীর। কোন সভ্য পৃথিবীর সৃষ্টির সেরা মানুষ এমনি নির্লজ্জভাবে অপর মানুষের বুকে ব্রাশ ফায়ার করতে পারে? পারে খুন করে রক্ত কণিকা ঝরিয়ে দিতে? স্ব-চোখে শুধু অনুভূতিতে এসব বর্বরতার বীভৎস দৃশ্য উপলব্ধি করা যায় না। এমন করুন অস্বাভাবিক মৃত্যু আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সমাজকেও হার মানায়। ঐ সব নরপশুর কাছে শহীদ ইসমাইল যেন নীড়হারা শরাহত পাখি। যার ফলশ্রুতিতেই ওরা কেড়ে নিয়েছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন-ান; একটি সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন। হায়বে পৃথিবী! এই কি তোমার সভ্যতা!
ট্রাক থেকে নামিয়ে সেহরীর পূর্বলগ্নে রাত্রি ৪টায় শহীদের পবিত্র কফিন তার বাড়ি নেওয়া হল। থমকে দাঁড়াল পৃথিবী। কেঁপে উঠল মায়ের কান্নায় খোদার আরশ। থেমে গেল ভোরের পাখির মিষ্টি গান। পরিবেশ হয়ে উঠল ভারী। চারিদিকে নেমে এল শোকের ছায়া। শহীদের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও শহীদের প্রিয় সাথীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কে কাকে দেবে সান-না? রাতের আধার টুটে বেরিয়ে এল ভোরের আলো। শহীদের সাথীরা শোক কে শক্তিতে পরিণত করল। বেলকুচির রাজপথ হল শহীদের লাশ নিয়ে শ্ল্লোগানে মুখরিত। বিশাল সে মিছিল। বিশ্ব মানবতাসহ সাধারণ জনতা অবাক দৃষ্টিতে রাস-ার পাশে দাঁড়িয়ে অবলোকন করল শহীদের মিছিল। নেতৃত্ব দিলেন জেলা আমীর জননেতা আলী আলম, ছাত্রনেতা শহীদুল ইসলাম, জোবায়ের হোসেন, অধ্যাপক নূর-উন-নবী সরকার, আলহাজ্ব আঃ মান্নান ভাইসহ অনেকেই। শহীদি প্রেরণায় দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নব দীক্ষায় দীক্ষিত হল শহীদের সাথীরা। বজ্র সাহসে শপথ খোদার রাজ প্রতিষ্ঠার। সত্যি শহীদ ইসমাইল ভাই চলে গেছেন। রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত কাজ। আমরা সবাই শহীদ ইসমাইল ও মুস-াফিজ ভাইয়ের পথ ধরে কুরআন সুন্নার পথে চলে প্রয়োজনে শহীদ হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে হেরার পথে এগিয়ে যাব। প্রতিষ্ঠিত করবো শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজ ভাইয়ের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। শাশ্বত আল কুরআনের রাজ।
(লেখকঃ আরিফুল ইসলাম সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, সিরাজগঞ্জ জেলা)
শহীদ ইসমাইলঃ কুয়াশা ভাঙ্গা রোদ্দুর
শীতকাল তখন পুরোপুরি। সকালে চারদিকে কিছুই দেখা যায় না কুয়াশার শব্দহীন বৃষ্টিতে। তবু অবিনাশী রোদ্রের পাখিরা কুয়াশার ব্যুহ ছিন্নভিন্ন করে স্বপ্নময় পৃথিবীর এই ছোট্ট আঙ্গিনায় পৌঁছে যায়, অতপর ঘাসে ঘাসে বিজয়ের আশ্চর্য প্রদীপ জ্বলে নক্ষত্রের মত; ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভাইয়ের মত। এই সিরাজী ভাইয়ের সাথে শীতের এক রাত্রিতে সৌভাগ্যক্রমে পরিচিত হই আমি। লতিফ হলের ২৫০ নং কক্ষে বসে আছি। রাত তখন ৮টা। পাশের টেবিলে বই ও ব্যাগ রাখার শব্দ হল। চোখ ফিরিয়ে দেখি সুন্দর চেহারার ছিপছিপে গড়নের হাস্যোজ্জ্বল একটি মানুষ। দেখলেই প্রাণ খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে তার সাথে। তাই দেরি না করেই সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হলাম। সেদিন আর তেমন কোন কথা হলো না। কিন' আমার হৃদয়ের বুভূক্ষ নদীটি শুধু তার বিস-ীর্ণ হৃদয়ের অথৈ সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে অবিরাম, আর সে জন্যই অতি অল্প সময়ের মধ্যে নদী ও সমুদ্র মিলে সৃষ্টি হল ঘনিষ্ঠতার উত্তাল তরঙ্গের।
দু’টি আত্মার এই সুমধুর সম্পর্কের মাঝে ছিট বদল নামের একটি নিষ্ঠুর চর জাগল। কিন' সেই চর আমাদের ভালবাসার সাইক্লোনে কোথায় জানি হারিয়ে গেল মনের অজানে-ই। আমরা দু’জনই যে কোন ব্যাপারে নিজেদের ভিতর পরামর্শ করতাম, আলোচনা করতাম আর কোন সমস্যা উদ্ভব হলে তো তার সমাধান না হওয়া ছাড়া কোনই নিস-ার নেই কারোর।
একদিন (জানুয়ারী ’৯৫) আমি রুমে বসে সূরা বাকারার ১৫৩-১৫৭ নম্বর আয়াত সমূহের একটি দারস প্রস'ত করছিলাম, এই সময় ইসমাইল ভাই কক্ষে ঢুকে সালাম দিয়ে বললেন, কী করছেন? বললাম, কুরআনের দারস প্রস'ত করছি। শুনে তিনি বললেন, দেন আমি লিখে দেই বলেই তিনি আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে লিখতে বসলেন।
“ওয়ালা তাকুলু লিমাই ইউক্তালু ফি সাবিলিল্লাহ্ আমওয়াতান্ বাল্ আহ্ইয়ায়ু-ওয়ালা কিল্ল্লা তাশউরুন।” অর্থাৎ-যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলোনা বরং তারা জীবিত। এইটুকু সুন্দর করে লেখার পর আমি তাকে বললাম, কি কাজে এসেছেন? তিনি লেখার গতি থামিয়ে বললেন, সিটের টাকা নিতে, আপনি কি এখন দিতে পারবেন? বললাম, নিয়ে যান। তিনি টাকাগুলো হাসি মুখে গ্রহণ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে আন-রিকতার সুগন্ধি ছড়ানো সালাম জানিয়ে চলে গেলেন। কিন' যা লিখে গেলেন নিজ হাতে তার বাস-ব সাক্ষ্য যে তাকেই হতে হবে তা হয়ত সেদিন তিনি নিজেই জানতেন না।
’৯৫ এর ১১ ফেব্রুয়ারী। হল মসজিদে যোহরের নামাজ শেষে দরজায় দাঁড়িয়ে সাথী ভাইদেরকে একটি বৈঠকের সংবাদ দিচ্ছিলাম তখন প্রিয় সিরাজী ভাই মসজিদ থেকে বের হলেন, আমি সালাম দিয়ে বৈঠকের কথা জানালাম। তিনি তা শুনার পর আমার হাত ধরে মসজিদের সামনে ঘাস বিছানো কার্পেটের সবুজ আঙ্গিনায় বসে পড়লেন। মুখের সেই হাসির উজ্জ্বল আভা নেই, নেই আনন্দের উচ্ছ্বাস। কোন সুদূরের টানে তিনি যেন এক উদাসীন পথিক। তবু সব কিছু হৃদয়ে বহু কষ্টে চাপা রেখে শিক্ষাশিবির সংক্রান- আলাপ করলাম তাঁর সাথে। বিকালে মতিউর রহমান আকন্দ ভাইয়ের মুক্তি উপলক্ষ্যে শহরে একসাথে নারায়ে তাকবীর শ্ল্লোগান বুকে করে দীপ্ত পদক্ষেপে বর্ণাঢ্য ভঙ্গিমায় মিছিল করলাম। শহর থেকে ফিরে এসে ইফতার করেই শুনলাম সোহরাওয়ার্দী হলের (আমাদের) তিনটি সিট অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী। দু’জনে সোহরাওয়ার্দী হলে গেলাম। সেখান থেকে রাত আটটায় ফিরে এলাম লতিফ হলে। তখন আকাশ থেকে বর্ষার বৃষ্টির মত ঝর ঝর করে ঝড়ছিল ঘন কুয়াশা আর গগনের চলমান নক্ষত্ররা জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে এবং বলছিল, দেখ আমরা কেমন উজ্জ্বল নিদর্শন। ভয়াবহ অন্ধকারের অমানিশা ভেদ করে নির্ভয়ে ফুটে আছি। তোমরাও পৃথিবীর সহস্র রাতের জমিন ছিন্নভিন্ন করে আলোর মহিরুহ ফলাও। মহাকাশ নক্ষত্রের একেবারে আসীন হয়ে যাও। রাত ৯টার সময় আর একটা দুঃসংবাদ শুনলাম, হবিবুর রহমান হলে আমাদের তেতাল্ল্লিশটি রুম পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে বাতিলের দোসররা। আমাদের অপরাধ আমরা নতুন পবিত্র পৃথিবী গড়তে চাই, মানবতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনে দৃঢ় প্রত্যয়ী, শাশ্বত সত্তার অসি-ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসী। সেই অসি'র অশান- পরিসি'তিতে আমি আর ইসমাইল ভাই রাত দু’টা পর্যন- হল গেটে অবস'ান করার পর ঘুমাতে যাই।
অতঃপর জেগে উঠে সিরাজী ভাইকে ডাকলাম আসে- করে নরম গলায় সেহরী খাওয়ার জন্য। সেহরীর পর ফজরের আজানের সুললিত কণ্ঠ ভেসে এল। মেদিনীর খদ্দর ভেদ করে আমাদের কর্ণকুহুরে। ঘোষিত হল নতুন ভোর, একটি সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি দিনের শুরু হবে। দিনটি হলো ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫। আমাদের দু’জনের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। ফজর নামাজ পড়ে সবেমাত্র গাটা এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়। সারাদিন সিয়াম সাধনার জন্যই মূলত এ প্রশানি-র নিদ্রা। কিন' পাখিরা তাদের কিচির-মিচির গীতিময় ঝড় তুলতে ভুলল না। কুয়াশা কাঁদানির গ্যাসের মত ভয়াবহ রূপ ধারন করতেও পিছপা হলো না। হঠাৎ কে যেন ডাক দিল। সেই ডাক উৎকন্ঠা ও অসি'রতা মিশানো। জেগেই শুনতে পেলাম প্রচন্ড গুলির শব্দ। সিরাজী ভাইও তখন জেগে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি প্যান্ট, শার্ট, জুতা পরে দ্রুত হল গেটে চলে গেলাম দু’জনেই।
গেটে এসে দেখি আমাদের হলের ভাইদের একজন অপরজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ। একজন বলল-সোহরাওয়ার্দী হলে বাতিল শক্তি আমাদের ভাইদের ওপর আক্রমণ করেছে। তখনই ছুটে গেলাম সোহরাওয়ার্দী হলের দিকে। কিন' বেশিদূর এগোতে হলো না কারণ সামনেই দেখলাম বদরুল ভাইয়ের শরীর রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, শকুনগুলোর বুলেটে। চার-পাঁচজন ভাই তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে একটু বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে। আর একটু এগোতেই শুনলাম মর্মানি-ক হৃদয় বিদারক কথা। বাতিল শক্তি সোহরাওয়ার্দী হলের ডাইনিং রুমের ছাদের ওপর পৈশাচিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন-ান মুস-াফিজুর রহমান ভাইকে শহীদ করেছে। সিরাজী ভাই সবসময় আমার পাশেই ছিল। তিনি সামনে যাবার জন্য ছটফট করছিলেন। কিন' প্রচন্ড গুলির শব্দে এই সবুজ মতিহার শুধু নয় সমস- পৃথিবী, গগন-পবন পর্যন-ও কম্পিত হয়েছিল সে সময়। তবু সাহসের দীপ জ্বলতেই থাকল। সামনে এগিয়ে গেলাম আমরা। হঠাৎ দেখি সিরাজী ভাই আমাদের ছেড়ে সামনের দিকে এগুচ্ছেন দুঃসাহসী যোদ্ধার মত। বাতিল শক্তিকে পরাজিত করার চেষ্টায় বীর সৈনিকের মত তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন জিহাদের ময়দানে। বেশিক্ষণ আর দেখতে হলো না। একজন সীমারের গুলি তার দুঃসাহসী বুকের জমিন বিধ্বস- করে দিল। তিনি তবু সামনের দিকে আরো সামনের দিকে চেষ্টা করলেন। কিন' সক্ষম হলেন না। সবুজ ঘাসে এলিয়ে পড়লেন কালেমার আওয়াজ কণ্ঠবীণায় শেষবারের মত বাজিয়ে।
কয়েকজন ভাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমরা তাকবীর দিয়ে সামনে বাতিলের মুকাবিলায় এগিয়ে গেলাম। পরাজিত হল নরখাদকের দল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরে কালেমার পতাকা উড্ডীন হল। কিন' সিরাজী ভাইকে আর পেলাম না আমাদের মাঝে। তিনি এ বিজয়ের পতাকা দেখে যেতে পারলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় প্রভুর কাছে চলে গেলেন জান্নাতের বাগিচায় অননে-র ঠিকানায়। মহান রাব্বুল আলামীন নিজের কাছে তাঁর এই শ্রেষ্ঠ গোলামটিকে রাখবার ইচ্ছা করেছেন তাই তাকে নিয়ে গেলেন দুনিয়ার এ মাটি থেকে। আমরা কি করে তাকে ধরে রাখবো? শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী চলে গেছেন কিন' রেখে গেছেন অজস্র স্মৃতি। আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসমাপ্ত কিছু কাজ। আর এ অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই হবে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
(লেখকঃ মোঃ মুখলেছুর রহমান লিটন, সভাপতি, শহীদ আসগর আলী উপশাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
সিরাজীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি
মানুষ মরণশীল। কথাটি চিরন-ন সত্য। মানুষ এ পৃথিবী হতে চিরবিদায় নেয়। কিন' পৃথিবীতে এমন কিছ মানুষ আছে যা মরার পরও অমর হয়ে থাকে। রেখে যাওয়া কীর্তিগুলো সমাজে তাদেরকে চির অম্ল্লান করে রাখে। তাঁদেরকে ঘিরে রচিত হয় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি।
প্রত্যেকের জীবন একটি করে স্মরণীয় ঘটনা থাকে, হতে পারে তা আনন্দের অথবা দুঃখের দাবানলে ভরা। সে রকম আমার জীব েন ১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ও মুস-াফিজুর রহমানের শাহাদাতের ঘটনা। আমার স্মৃতির এ্যালবামে প্রতিক্ষণে শহীদ সিরাজীর স্মৃতিগুলো দোলা দেয়। সিরাজীকে ভাবতে গেলে নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। স্বপ্নের মত নিজেকে সান-্বনা দেই। সিরাজী শহীদ হয়নি, ধূমকেতুর ন্যায় আবার আসবে, কিন' বাস-ব বড় নির্মম এবং সত্য, যে যায় সে আর ফিরে আসে না কখনো। শহীদ সিরাজী আমার অতি কাছের বন্ধু ছিল। যার কারণে সিরাজীকে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। সিরাজীর পাশেই থেকেছি প্রাইমারীর প্রথম শ্রেণী হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পর্যন-। তার আচার-আচরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যের চেয়ে ব্যতিক্রম। প্রত্যেকটা কাজে সে ছিল অগ্রগামী। আমার আজও মনে আছে আমরা যখন দেলুয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় পড়ি, তখন আমাদের ক্লাসে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ছিল। দেখতাম সিরাজী আমাদের চেয়ে আগে ক্লাসে এসে প্রথম বেঞ্চে বসত এবং সে পার্শ্বে আমার জন্য একটা সিট রেখে দিত। লেখাপড়ার প্রতি সিরাজীর ছিল প্রবল আগ্রহ। যার কারণে দশম শ্রেণী পর্যন- সিরাজীর রোল ছিল এক অথবা দু’
য়ের মধ্যেই। শৈশব আমাদের আড্ডাখানা ছিল খেলার মাঠ ও আমাদের রক্তে যে নদীর স্মৃতি মিশে আছে সেই যমুনা নদীর তীর। বিকেল বেলা সিরাজী, ফরিদ ও আমি সহ আরও অনেক বন্ধু মিলে যমুনা নদীর তীরে বসতাম। যমুনার সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। যমুনার চরের ভিতর হতে কাশফুল নিয়ে আসতাম। আমাদের বন্ধু ফরিদের সুমিষ্ট কন্ঠে গান ভেসে আসত, ‘নদীর একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা’ ...
শহীদ সিরাজী বাংলাদেশের প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠেছিল যার কারণে সে প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসত এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নিয়ে কবিতা রচনা করত।
শৈশব থেকেই সিরাজীর মধ্যে ইসলামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ লক্ষ্য করেছি। সমাজের প্রত্যেকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার অগ্রণী ভূমিকাও দেখেছি। যখন আমরা ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম, তখন একদিন আমাদের ক্লাসে ছাত্রশিবিরের মীর মুহাম্মদ ভাইসহ আরও কয়েকজন ভাই আসলেন তাঁরা সুমিষ্ট ভাষায় ইসলাম ও শিবির সম্পর্কে আমাদেরকে প্রাথমিক ধারণা দিলেন। সিরাজী ও আমিসহ আরও কয়েকজন বন্ধু শিবিরের সমর্থক ফরম পূরণ করি। শুরু হয় সিরাজীর জীবনে আমুল পরিবর্তন। তাঁর আচার আচরণে শিক্ষা চরিত্রে এমনকি সামগ্রিক ক্ষেত্রে আকস্মিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে লাগল। তার প্রত্যেকটি কাজে কর্মে ইসলামের ছোঁয়া দেখতে পেতাম। ১৯৯১ সালের প্রথম দিক সিরাজী টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী কলেজে ভর্তি হন এবং সিরাজী ইসলামী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। শিবিরের আদর্শের সাথে সিরাজীর আদর্শ একত্রীভূত হয়ে যেতে লাগল।
১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাস। ফরিদ, সাইদুল ভাই, সোহেল ভাই ও আমি সহ আরও অনেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় সাথী সম্মেলনে যাওয়ার জন্য প্রস'তি নিচ্ছিলাম। এমন সময় একদিন বিকেলে যমুনার তীরে বসে জেলেদের মাছ ধরা দেখছিলাম। তখন ডাকপিয়ন আমাকে একটা চিঠি দিলেন। আনন্দ সহকারে চিঠি খুললাম। সিরাজী টাঙ্গাইল হতে লিখেছে। ঐ দিনের সিরাজীর চিঠির ভাষা ছিল খুবই আবেগময়ী। চিঠির ভাষা পড়ে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। ২০ জানুয়ারীর রাত ১টার সময় সিরাজী ছাত্র শিবিরের এক শিক্ষা শিবিরে সাথী শপথ গ্রহণ করেছে, চিঠি পড়ে তা জানতে পারলাম। সাথী শপথের পরেই আমার নিকটে পত্র লেখে। তখন টাঙ্গাইলের জেলা সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন আহসান হাবিব ইমরোজ ভাই। চিঠির শেষের ভাষা ছিল খুবই বিস্ময়কর। তা ছিল এরূপ-“বন্ধু, আল্ল্লাহর কাছে দোয়া করিস আমি যেন ইসলামী আন্দোলনের আলোকে নিজেকে গঠন করে শাহাদাতের পিয়ালা পান করতে পারি।” তখন থেকেই আমি সিরাজীর স্পৃহা দেখে ভাবছিলাম সিরাজীকে আল্ল্লাহ পাক শহীদ হিসেবে কবুল করতে পারেন।
সিরাজীর হৃদয়ে উচ্চ শিক্ষার বাসনা ছিল। যার কারণে আমরা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সবুজ কাননে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মন ভুলানো ক্যাম্পাসের হাতছানিতে আমরা ধরা দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বিভাগে আমি ও সিরাজী ভর্তি হলাম। সিরাজীর আশা ছিল জীবনে অনেক বড় হবে। চাচা-চাচী সিরাজীকে খুব ভালোবাসতেন। সিরাজীর লেখাপড়ার অর্থ ওর বাবা-মা বড় কষ্টে যোগান দিতেন। এই কষ্টের কথা মনে হলে এখনও আমার কান্না আসে। চোখ দুটো ভিজে যায় বেদনায়। সিরাজীর বাবা-মা গ্রামের লোকদেরকে বলত, “বড় কষ্ট করে ইসমাইলকে ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি একদিন আমাদের দুঃখ দূর হবে।” কিন' ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সন্ত্রাসীদের মরণ ছোবলে তাদের দুঃখ অগ্নি শিখার মত প্রজ্জ্বলিত হল।
যারা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়ে তারা অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারেন যে অর্থ কষ্টে লেখাপড়া করলে নিজের হৃদয়ে উচ্চাশার কল্পরাজ্য গড়ে ওঠে। যেমন বড় হয়ে বাবা-মার মুখে হাসি ফুটাব, আত্মীয় স্বজনদের দেখা-শোনা করব, বাড়ি-গাড়ি প্রভৃতি। সিরাজীর মনেও এরূপ আশা ছিল।
মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারী সিরাজী ও আমি রাজশাহী শহরে গিয়েছিলাম। শহর হতে ফেরার পথে সিরাজী বারবার আমাকে একটি কথা বলছিল, “আচ্ছা হালিম, আমাদের কি অর্থাভাব কোনদিন শেষ হবে না? দেখবি আমার একদিন বড় চাকুরী হবে। আমার বেতনের প্রথম টাকা দিয়ে মার জন্য শাড়ী ও বাবার জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবী ক্রয় করব।” আমি তখন বলেছিলাম, তোর অবশ্যই বড় চাকুরী হবে। আসলে মানুষ যা চায় তা পায় না। সিরাজীর কবরে মাটি দেয়া শেষ হলে কবরের পার্শ্বে বসে কেঁদে-কেঁদে বলেছিলাম সিরাজী তুই চাকুরী করবি না? কথা বল সিরাজী, না কি এটাই তোর বড় চাকুরী?
সিরাজী গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে সমব্যবহার করত, গ্রামের প্রতিটি অনুষ্ঠানে সিরাজীকে প্রথম কাতারে দেখা যেত। গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ সমভাবে ভাগ করে নিত। বৃদ্ধ যুবক কিংবা শিশু সকলের প্রিয় পাত্র ছিল সিরাজী। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল, সিরাজীদের বাড়িতে আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তি কাজ করত। তার সংসারে খুব অভাব ছিল। সিরাজী ও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসব। ইতিমধ্যে আব্দুল কুদ্দুস ভাই সিরাজীকে তার অভাবের কথা জানাল। বাড়ি থেকে সিরাজী যে টাকা পেয়েছিল তা হতে আব্দুল কুদ্দুস ভাইকে টাকা দিয়ে দিল। আমি তখন অবাক হয়ে দেখলাম।
সিরাজী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শকে বাস-বায়ন করেছিল। যার কারণে কোন দিন নামাজ জামাত ক্বাজা পর্যন-ও করতে দেখিনি। আমরা যখন শীতের ভিতরে একই রুমে থাকতাম মুয়াজ্জিন যখন সুমিষ্ট কন্ঠে ফজরের আযান দিত সাথে সাথে সিরাজী বেড থেকে উঠে পড়ত। আমাদের উঠতে বিলম্ব হলে সিরাজী আমাদের উপর হতে লেপ উঠিয়ে নিত এবং ঠান্ডা পানি ঢেলে দিত।
১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ আমাদের গ্রাম হতে ছোট ভাই আব্দুল আলীম মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফরম উঠানোর জন্য রাজশাহীতে আসে। সেদিন রাত্রে আব্দুল আলীম সিরাজীর বেডেই শুয়ে ছিল। আব্দুল আলীমের নিকট হতে শুনেছি সে রাতে সিরাজী সেহরী খাওয়ার পর তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছে। তারপর কুরআন তিলাওয়াত করছে। আব্দুল আলীম সিরাজী কে প্রশ্ন করেছে সিরাজী ভাইয়া দীর্ঘ সময় ধরে কিসের নামাজ আদায় করেন? উত্তরে সিরাজী বলেছিল শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে হয়।
১৯৯৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী প্রকৃতির ঘন কুয়াশা ক্যাম্পাসকে ঘিরে নিয়েছিল। কে জেনেছিল এই দিনটা হবে কালো অন্ধকারে ঘেরা। সেহরী খাওয়ার পর সকলে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিল। সন্ত্রাসীদের বুলেটের শব্দে ছাত্র-ছাত্রীদের সে রাতের ঘুম হয়নি। সৈয়দ আমীর আলী হলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রথমে শহীদ মুস-াফিজুর রহমান ভাইয়ের শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলাম। তারপর বন্ধুরা আমাকে সিরাজীর শাহাদাতের সংবাদ দেয়। তখন আমি সকলের মুখের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো এটা স্বপ্ন দেখছি। সে দিন চিৎকার করে বলেছিলাম সিরাজী মরতে পারে না। কিন' পরে দেখতে পেলাম সন্ত্রাসীদের স্টেনগানের গুলিতে সিরাজীর বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সেদিন নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছিলাম, একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রকে কেমন করে হত্যা করতে পারে? তাও আবার ইসমাইলের মত হাস্যোজ্জ্বল ছেলেকে। আসলে ওরা ছাত্র নামের কলঙ্ক!
সকলেই সেদিন সিরাজীর জন্য কেঁদেছিল। বন্ধুদের চোখে ছিল অশ্রু আর মুখ ছিল নির্বাক। আমরা যখন সিরাজীর লাশের কফিন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসযোগে গ্রামের বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম তখন সকলে নিস-ব্ধ ছিলাম। সকলের চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা টপ টপ করে ঝরছিল। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছিলাম সিরাজীর বাবা-মাকে কি বলে সান-্বনা দিব। এলাকার বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলব? গ্রামবাসী যখন প্রশ্ন করবে হালিম, এই হত্যাকান্ড কেমন করে হলো? তখন আমি তাদের কি বলে উত্তর দিব?
শেষ রাত্রের দিকে আমরা সিরাজীর কফিন নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী বেলকুচি থানাতে পৌঁছলাম এবং ভোরে সিরাজীর প্রাণের গ্রাম চালা উত্তর পাড়ায় শানিত নীড়ে গেলাম। আশা ছিল সিরাজী এম. এ পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়িতে যাবে, সকলের মুখে মিষ্টি উঠিয়ে দেবে। কিন' না, সিরাজী সেদিন বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকে মিষ্টির পরিবর্তে কান্নার রোল উপহার দিয়েছিল। কফিন পৌঁছার সাথে সাথে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এলো। বেলকুচির লোকের মুখে সেদিন কোন কথা ছিল না। সেদিন সকলের চোখে ছিল পানি আর পানি। বাড়ির এক পাশে আমি আধো অবচেতন হয়ে অবস'ান করছিলাম। সিরাজীর মা অজ্ঞান অবস'ায় আমাকে ডেকে পাঠালেন, আমি কান্নায় কাঁপতে কাঁপতে তার নিকটে গেলাম। সেদিন সিরাজীর মা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “বাবা আমার ইসমাইলকে এনে দাও, আমি ইসমাইলের লাশ চাই না, তুমি তো মারা যাওনি? কিন- ইসমাইল মারা গেল কেন? সেদিন সিরাজীর মার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সিরাজী মারা গেছে কিন' তাঁকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে সে সব সন্ত্রাসীর কি আজও বিচার হয়েছে? না, তাদেরকে বাংলাদেশের সরকার গ্রেফতারও করেনি। এই গ্রেফতার না করার কারণ কি? শিক্ষাঙ্গনে নিয়মিত সন্ত্রাস হচ্ছে। ইসমাইলের মার মত কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এর কোন প্রতিরোধ মূলক ব্যবস'া সরকার করছেনা। যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস'া হতো তবে আর কোন সন্ত্রাস শিক্ষাঙ্গনে কি হতো?
সিরাজীকে আল্ল্লাহ পাক জান্নাতবাসী করুক, এটাই সকল সময় কামনা করি। আর সিরাজীর কথা যখনি মনে পড়ে তখনি এই গানটা শুনি, ‘ওরা চলে গেছে ওপারে সুন্দর ভুবনে’।
যখন রাজশাহী থেকে বাড়ী যাই তখনি সিরাজীর কবরের পাশে যাই। সিরাজীর কবর দেখে মনে হয় সিরাজী এখনও হাসছে। সিরাজীর কবরের পাশ থেকে আসতে মন চায় না। এই বলে মনকে সান-্বনা দেই-“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত।”
(লেখকঃ মো: আ: হালিম, শহীদ ইসমাইলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বাংলা শেষ বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
শহীদ ইসমাইল একটি ফুটন্ত গোলাপ
স্মৃতির পাতা খুললে যার কথা হৃদয়ে দাউ দাউ করে যন্ত্রণার আগুন প্রজ্জ্বলিত করে তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার অতি প্রিয়, স্নেহভাজন ভাই শহীদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মাঝ থেকে বাছাই করা কুড়িয়ে পাওয়া মনি মুক্তার সাথে তুলনা করলে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। যার হৃদয় জুড়ানো ভালবাসায় প্রথমেই তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছিলাম। যার হৃদয় নাড়ানো হাসিতে মনটা জুড়িয়ে যেত। যাকে দিনে একবার না দেখলে মনে হত হৃদয়ের মাঝে শূন্যতা বিরাজ করছে। যার কণ্ঠ শুনলে কান খাড়া করে পরবর্তী কথা শুনার অপেক্ষায় থাকতাম। তাকে হারিয়ে পিতা হারানোর বিলাপের ন্যায় চক্ষু ভিজিয়ে ছিলাম। অথচ আমার পিতাকে ছোটবেলায় হারিয়েও একটু চোখের পানি ফেলিনি। ধৈর্য্যের মাধ্যমে পরিসি'তির মোকাবিলা করেছি। কিন' আন্দোলনের এ প্রিয় সাথীকে হারিয়ে বিলাপ না করে ধৈর্য ধরতে পারিনি। ধৈর্যের বাঁধকে ভাঙ্গতে হয়েছিল। শহীদ ইসমাইলের শাহাদাতের খবর প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। মনে হয়েছে সে হয়তো বেঁচে আছে। ভেবেছিলাম একজন জীবন- চরিত্রের ছাত্র এভাবে অকালে ঝরতে পারে না।
শহীদ ইসমাইল নবাব আব্দুল লতিফ হলের ছাত্র ছিলেন। সদা বিনয়ী এ ছাত্রটি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে সকল ছাত্রদের আপন করে নেন। তার ব্যক্তিগত কাজ কর্মের ক্ষেত্রে সহযোগিতার অভাব হত না। সবাই তার কাজ করে দিতে লোভাতুর ছিল। তিনি ১৯৯৩-৯৪ সেশনে রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমান শিবিরের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের ক্লাসমেট ছিলেন। বাংলা বিভাগের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে সংক্ষিপ্ত সময়ে আপন করে নেন। শহীদ ইসমাইলের আগমনের জন্য ক্লাসের সবাই প্রতিক্ষায় থাকত। সিরাজগঞ্জের কৃতি সন-ান বেলকুচিতে বড় হয়ে ওঠেন। সেখান থেকে স্কুল ও কলেজের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে পা বাড়ালের শহীদ ইসমাইল।
শহীদকে নিয়ে মা-বাবার খুবই আশা ছিল। বাবা চিন-া করতেন ইসমাইল পরিবারের দুঃখ ঘোচাবেন। ছোট্ট খোকা থেকে ইসমাইলকে তাই আদরে সোহাগে বড় করে তুলে ছিলেন। বাড়িতে গেলে মা শহীদ ইসমাইলকে বের হতে দিতেন না বাড়ি থেকে। মা কাছে বসিয়ে রাখতেন। গল্প শোনাতে বলতেন ভার্সিটির। আর শহীদ ইসমাইল ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় কর্মী হবার সাথে সাথে ইসলামী আন্দোলনের জন্য পাগল পারা এ ভাইটি সকল সময় ব্যস- থাকতেন। ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। দ্বীনের মূর্ত প্রতীক ইসমাইল ভাই বিশ্রামের সুযোগ পেতেন না। শহীদ ইসমাইলের চেহারা সুন্দর ছিল। হালকা পাতলা গড়নের ভাইটি আকর্ষণীয় চেহারায় আবির্ভূত হয়ে অতি সহজেই কাছে টেনে আনতেন তার চুম্বকীয় শক্তি দিয়ে। চুম্বক যেমন লোহা বা লোহা জাতীয় দ্রব্যকে আকর্ষণ করে তেমনি ইসমাইল অতি সহজে ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম ছিলেন। শহীদ ইসমাইল মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল।
তিনি শত ব্যস-তার মাঝেও সময় সচেতন ছিলেন। প্রয়োজনীয় সময়ের পাঁচ দশ মিনিট পূর্বে আসতেন। নির্দিষ্ট সময়ের পরে আসতেন না। যে কোন কাজ সুনিপুনভাবে করতেন। কাজে তাড়াহুড়ো করতেন না। কোন কাজ দিলে খুব ধীরগতিতে সুনিপুন হাতের পরশে সুন্দর করে তুলতেন।
কর্তব্যে অবহেলা ছিল শহীদ ইসমাইলের চরিত্র বিরোধী। তার কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে তিনি ছিলেন সদা সচেতন। একাগ্রচিত্তে কার্য পালনে সব সময় থাকতেন ব্যতিব্যস-। কোন কাজ দিলে অপূর্ণ ভাবে রাখতেন না। অতি সত্তর কাজের পূর্ণতা এনে দিতে পারতেন।
আল্লাহর আদেশ পালনে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। ইবাদতে কখনও অবহেলা প্রদর্শন করেননি। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। আর সর্বদা গভীর জিকিরে মশগুল থাকতেন আল্লাহর জিকির থেকে ক্ষনিকের জন্যও বিরত থাকতেন না। একদিন তার এ আমলের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আল্লাহর কথা স্মরণ করলে আমার মন প্রশানি-তে ভরে যায়। জিকির না করলে শরীরের সি'রতা থাকে না। সব সময় ছটফট করতে থাকি।”
ফুলের বাগানে সকল ফুলই শোভা বর্ধন করে। তবে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে হাতে গোনা কয়েকটি ফুল দর্শকদের হৃদয় কাড়ে। শিবির নামক বাগানে অনেক ফুলের সমাবেশ ঘটেছে। তবে হৃদয় তন্ত্রীতে সকল ফুল অবস'ান করতে পারেনি। হৃদয়ের মাঝখানে সর্বোচ্চ আসনে স'ান করলেন শহীদ ইসমাইল। তিনি বাগানের ফুটন- গোলাপের মত সুবাস ছড়ালেন, সে সুবাস পেয়ে অনেকেই মাতোয়ারা হলো। ক্ষণিকের এ সুবাস পাগল পারা ভ্রমররা ভুলতে পারল না। আল্ল্লাহ ফুলের বাগানের সৌন্দর্যকে ম্লান করে সে ফুলকে তুলে নিলেন তারই নিকটে।
১২ ফেব্রুয়ারী ’৯৫ সালের সে দৃশ্য হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। জানিনা এ সকল দুনিয়াবী জুলুমের শেষ কোথায়? জুলুমবাজরা মহাদাপটে ঘুরছে এ নশ্বর পৃথিবীতে। তাদের পায়ের আঘাতে জমিনও চিৎকার করে বলছে, প্রভু গো! তুমি আমাদের জালিমের জুলুম থেকে রক্ষা কর। মহান পালনকর্তা মাটিকে আশ্বাস দিয়ে বলছে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর। এ সুযোগ তুমিও একদিন পাবে। তোমার পেটে আমি তাদের কিছুকাল আটকে রাখব। তোমাদের পাওনা ও প্রতিশোধ তখন পুরোপুরি আদায় করে নেবে।
মোকাম্মেল বাহিনীকে তাড়া করে শিবির কর্মীরা যখন জিয়া হলের সামনে দন্ডায়মান, সে সময় হায়েনাদের স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল শহীদ ইসমাইলের বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। কালেমা পড়লেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলু্ল্লাহ”। সারা দেহ রক্তে রঞ্জিত। শহীদদের সাথীরা ধরাধরি করে ঘাড়ে তুললেন। কিন' তখন শহীদ ইসমাইল তার প্রভুর নিকট হাজির ------ ইন্না লিল্লাহে ---।
লাশের নিকট ক্ষণিক দাড়িয়ে থেকেছি হঠাৎ আনমনা হয়ে গেছি মনে হলো আমি যেন এ নশ্বর দুনিয়াতে নেই। আমিও যেন তার সঙ্গে আল্ল্লাহর দরবারে হাজির হয়েছি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হতবাক হলাম। মনে হলো মারা যাবার পরও তিনি যেন হাসি মুখে সবাইকে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হবার আহ্বান জানাচ্ছেন। চেহারায় কোন মলিনতা নেই, মনে হচ্ছে যেন একজন মানুষ সাধারণভাবে ঘুমিয়ে আছে। আল্লাহর বাণীতে আমরা বুঝতে পারি, যারা শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন তাদের মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় না। একটা পিঁপড়ার কামড়ের ব্যথা শুধু অনুভূত হয়। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমরা ঘোষণা করছি-‘ঘুমাও ইসমাইল শানি-তে, তোমার প্রভুর সংস্পর্শে। আমরাও আসছি, আমাদের জন্য তোমার পাশে একটু জায়গা করে দিও ভাই!
(লেখক: মোঃ শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মোহতারাম সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি)
0 comments: