যে মহাবিপদ সেক্যিউলারিজমে

http://media.somewhereinblog.net/images/ladenvai_1291105771_1-Lp_islamic-foundatione-bala.jpg


বাংলাদেশসহ প্রতিটি মুসলিম দেশে মুসলমানদের বড় বিপদ এ নয় যে মানুষ দলে দলে হিন্দু, খৃষ্টান বা বৌদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বরং বিপদের মূল কারণ, সেক্যিউলারিজম ও অসংখ্য সেক্যিউলার প্রতিষ্ঠান। এগুলির মুল লক্ষ্য হলো জনগণের চেতনা থেকে পরকালের স্মরণকে দূর করা। এবং জীবনকে পার্থিব বা ইহকালমুখি করা। অথচ যারা মুসলমান তাদের সমগ্র জীবনই হলো পরকালমুখি। তাদের ধর্মকর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহসহ সকল কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় পরকালে জবাব দিতে হবে সে ভীতি থেকে। পার্থিব জীবনকে ভাবে পরকালীন কল্যাণ লাভে বিণিয়োগের ক্ষেত্ররূপে। ফলে পরকালের চেতনা লোপ পেলে তখন সে ধর্মে অঙ্গিকারশূন্য হতে বাধ্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনের অন্যান্য অঙ্গনে তখন প্রকাশ পায় ইহজাগতিকতা। ফলে ধর্মে অঙ্গিকারহীন হয় রাজনীতি। এজন্যই কোন মুসলিম দেশে সেক্যিউলারিজম প্রতিষ্ঠা পেলে ইসলামের চেতনা-বিনাশ অনিবার্য। তখন মানুষ পরিণত হয় নিছক ভোগবাদী জীবে।



বাংলাদেশের ন্যায় প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে এভাবে ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য করার কাজ হচ্ছে অতি পরিকল্পিতভাবে। একাজে তারা সফলতাও পাচ্ছে প্রচৃুর। ফলে লোপ পাচ্ছে প্যানইসলামি চেতনা এবং ইসলামের বিশ্বভাতৃত্ব ও উম্মাহর ধারণা। বিলুপ্ত হচ্ছে ইসলামি মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি। ফলে সূদ, ঘুষ, ব্যভিচার ও দূর্নীতির ন্যায় জঘন্য অপরাধও এখন আর গণ্য হচ্ছে না দন্ডনীয় বা নিন্দনীয় অপরাধ রূপে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত  দেশ হলে কি হবে তা নিয়ে তেমন লজ্জাশরম নেই। কারণ পাপাচারে বেশী অভ্যস্ত হলে সেটি থাকে না। এমন এক লজ্জাহীনতার কারণেই যারা নিয়মিত ঘুষ খায়, সূদ খায়, চুরিডাকাতি বা ব্যাভিচারি করে তারাও সমাজে বুক ফুলিয়ে চলা ফেরা করে। এমন দুর্বৃত্তরাও তখন নেতা হওয়ার প্রশ্রয় পায়। দেশে এমন পাপাচারীরা হর্তাকর্তা হলে তারা যে পাপাচারকে প্রশ্রয় দিবে সেটিই স্বাভাবিক। ফলে তখন পাপকর্ম হয় প্রকাশ্যে। বাংলাদেশের মত দেশে একারণেই দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ হয়, শতনারী ধর্ষণের  উৎসবও হয়। (যেমনটি নব্বইয়ের দশকে জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছিল জনৈক ছাত্রনেতার দ্বারা)। এমন দুর্বৃত্তি ও পাপাচার এতই গা’ সওয়া হয়ে গেছে যে এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ নেই। কোন আন্দোলনও নেই। দেশের আদালতে বিচার বা শাস্তিও নেই। দূর্নীতির কারণ এ নয় যে, দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। বরং মূল কারণ, নৈতিক দুর্ভীক্ষ। দেশবাসী নীতিশূণ্য ও চরিত্রশূণ্য হয়েছে ভয়ানক ভাবে। দুর্বত্তদের প্রাধান্য শুধু অফিসআদালতে নয়, বরং রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বস্তরে। অপর দিকে দারুন ভাবে বিভক্ত হয়েছে সমাজ। এ বিভক্তি যেমন ধনি-দরিদ্যের, তেমনি দলভিত্তিক, জেলাভিত্তিক এবং আদর্শভিত্তিক। ইসলামে অনৈক্য সৃষ্টি বড় রকমের গোনাহ, এবং একতার কাজ হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পবিত্র কোরআনে শুধু ‘আকিমুস্সালাত’ অর্থঃ ‘নামায কায়েম করো’ই শুধু বলা হয়নি, ‘লা তার্ফাÍাকু’ অর্থাৎ ‘ক্ষিভক্ত হয়ো না’ সে কথাও বলা হয়েছে। মুসলমানের কাজ এ নয় যে, কোরআনে ঘোষিত শুধু নামায-রোযার হুকুমগুলোই সে পালন করবে এবং অমান্য করবে একতাবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ। মুসলমানের উপর আল্লাহর প্রতিটি হুকুম মেনে চলাই ফরয। কারণ, ইবলিসের ন্যায় আল্লাহর অবাধ্য ও অভিশপ্ত হওয়ার জন্য তাঁর একটি মাত্র হুকুম অমান্যই যথেষ্ট। তাই ঐক্যের প্রতিষ্ঠায় আল্লাহপাকের যে হুকুম সেটি সর্বাত্মক ভাবে পালন করেছিলেন প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ। ফলে নানা ভাষাভাষি ও নানা বর্ণের হয়েও তারা জন্ম দিয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর। মুসলমানগণ পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বশক্তিতে।

ভাষাভিত্তিক নেশন স্টেটের যে ধারণা সেটি নিতান্তই ইউরোপীয়। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ মুসলমানদের সম্পদই শুধু লুট করেনি, বিনষ্ট করেছে তাদের প্যানইসলামিক চেতনাও। সংক্রামক ব্যধি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির দেহেই সীমাবদ্ধ থাকে না, যেখানে যায় সেখানেই সে রোগ ছড়্য়া। ফলে যে রোগের শুরু ইউরোপে সেটিই ব্যাপক ভাবে প্রসার পেয়েছে মুসলিম দেশগুলিতে। মুসলিম উম্মাহর জীবনে এটি কাজ করেছে অতি ঘাতক ব্যাধিরূপে। অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি বা যুদ্ধবিগ্রহে মুসলমানদের এত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সেক্যিউলারিজমের প্রসারে অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষের সাথে একতা গড়া যে ইবাদত সে প্রেরণাই বিনষ্ট হয়েছে। বরং গুরুত্ব পেয়েছে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলভিত্তিক অহংকার নিয়ে পারস্পারিক ঘৃনা। ফলে নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে মুসলিম দেশে আচার বা সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভিন্ ভাষার মুসলমানদের গালি দেওয়া। তাই আরবভূমিতে তুর্কি বা ইরানীদের বিরুদ্ধে গালি না দিলে রাজনীতিতে টিকে থাকাই অসম্ভব। একই রূপ অবস্থা ইরানে এবং তুরস্কে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। অবাঙ্গালীদের ঘৃনা করা, তাদের ঘরবাড়ি দখল করে তাদের পরিবার পরিজনকে বস্তিতে পাঠানোই এখন বাঙ্গালী সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির খেসারত দিচ্ছে কয়েক লক্ষ অবাঙ্গালী পরিবার। একমাত্র শয়তানই এরূপ সংস্কৃতিতে খুশী হতে পারে। এবং এর মূল কারণ সেক্যিউলারিজম। ভোগবাদী স্বার্থে অন্যভাষা বা অন্যদেশের মানুষ দূরে থাক নিজ ভাইকেও মানুষ খুণ করে। এরূপ স্বার্থের তাড়নায় আরবের কাফেরগণ নিজ কন্যাকেও জীবন্ত দাফন দিত। সেক্যিউলারিজম তথা ইহজাগতিকতা এভাবে জন্ম দেয় মানববিধ্বংসী এক ঘাতক চেতনার। বাড়ে অনৈক্য ও বিবাদ। কোন জাতি কি এমন বিভক্তি নিয়ে বিজয়ী হতে পারে? তেলের খনি, গ্যাসের খনি বা লোকবল দিয়ে কি এ ক্ষতি দূর করা যায়? ঐক্যের বিকল্প একমাত্র ঐক্যই। সেটি সৃষ্টি হতে পারে একমাত্র পরকালমুখি চেতনায়। আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতাই যার মূল কথা। কয়েক লক্ষ নবী-রাসূল একত্রে জন্ম নিলেও এমন এক চেতনার কারণে তারা একতাবদ্ধ ভাবে কাজ করতেন। তেমনি পারে সত্যিকার মুসলমানগণও। প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ সেটি দেখিয়েও গেছেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে সে চেতনাটিকে সমূলে বিনষ্ট করছে সেক্যিউলারিজম। এ মতবাদটির কারণে মুসলমানগণ আজ ভাতৃঘাতি লড়ায়ে লিপ্ত। ইসলামিক চেতনা যেখানে নানা বর্ণ ও নানা ভাষার মুসলমানের মাঝে সিমেন্ট লাগায় এবং গড়ে তোলে সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ, সেক্যিউলারিজম সে সিমেন্ট সরিয়ে দেয় অতি ক্ষিপ্রতার সাথে। তখন বিল্প্তু হয় উম্মাহর স্বার্থচিন্তা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় তখন পার্থিব স্বার্থচিন্তায়। বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে অতি প্রবল ভাবে। ফলে ইসলামি শিক্ষা ও ইসলামি শরিয়ত প্রতিষ্ঠা বা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে ভূমিকা রাখা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ আর কোন প্রসঙ্গই নয়।

ইসলামি চেতনার বিনাশে বাংলাদেশের ন্যায় প্রায় প্রতিটি দরিদ্র মুসলিম দেশে কাজ করছে বহু হাজার প্রতিষ্ঠান। বিণিয়োগ হ্েচছ শত শত কোটি টাকার দেশী-বিদেশী পুঁজি। এ অর্থে গড়ে উঠেছে বহু হাজার এনজিও। বাংলাদেশে এনজিও প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ১৯৪৭য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। তখন এগুলোর মূল কাজ ছিল খৃষ্টান বানানো। কিন্তু বহু বছরে বহু কোটি টাকা ব্যয়েও সে এনজিওগুলি বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে তেমন সফলতা পায়নি। নিম্ন বর্ণের হিন্দু, গারো, সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতীয়দের মাঝে খৃষ্টান ধর্মের প্রচারে সফলতা পেলেও মুসলমানদের মাঝে সে কৌশল কাজ দেয়নি। ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্টার পর তাদের কৌশলে আনে আমূল পরিবর্তন। এবং সেটি মুসলমানদের খৃষ্টান বানানো নয়, বরং ইসলাম থেকে দূরে হটানো বা ডিইসলামাইজেশন। এ লক্ষ্যে বহু এনজির কাজই হচ্ছে গ্রামে গঞ্জে নেমে ছেলেমেয়েদের নাচগাণ শেখানো। নাচগানের প্রসারে তাদের অর্থে ও নেতৃত্বে গড়ে তুলেছে অসংখ্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। লেখা হ্েচছ বহু বই, প্রচার পাচ্ছে বহু পত্র-পত্রিকা। গড়া হচ্ছে মকতবের পাশে এনজিও স্কুল। ফলে যে কিশোর একদিন মকতবে গিয়ে কোরআন তেলওয়াত শিখতো এখন শিখছে নাচ-গান। দারিদ্র্যতাকে পূঁজি করে ব্যাপক ভাবে চলছে সূদের ব্যবসা। গ্রামের যে ধর্মভীরু মানুষটি আগে সূদকে জ্বিনার চেয়েও ভয়ংকর পাপ জেনে সূদ খেতে ও দিতে ভয় পেত এখন সে  নির্ভয়ে সূদ খাচ্ছে ও দিচ্ছে। গ্রামের যে মহিলাটি একাকী রাস্তায় নামাকে গর্হিত কাজ মনে করতো সে এখন রাস্তায় রাস্তায় এনজিওর গাছ পাহারা দিচ্ছে। মাটি কাটছে বা সাইকেলে চড়ে একাকী গ্রাম-গঞ্জ, নদী-নালা বা মেঠো পথ অতিক্রম করছে। সমিতি করে শেখানো হচ্ছে মহান আল্লাহর নানা বিধানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবাধ্যতা।

প্রশ্ন হলো, ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে এত প্রতিষ্ঠান ও এত বিণিয়োগের কারণ কি? এর কারণ, মুসলমানদের সম্পদ যারা লুটতে চায় বা তাদেরকে যারা পদানত রাখতে চায় তারা সে লক্ষ্যে মুসলমানদেরকে দুর্বলও রাখতে চায়। মুসলমানগণ শক্তিশালী হলে সেটি সম্ভব নয়। তারা জানে, মুসলমানদের শক্তির মূল উৎস্য হলো ইসলাম। তাই শক্তির সে উৎস্য থেকেই তাদেরকে সরাতে চায়। ইসলামের মূল কথা, মহান আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় লেগে থাকাই তার জীবন-সাধনা। এমন চেতনা থেকে সে পায় আমৃত্যু লড়াই ও আত্মত্যাগের প্রেরণা। এ প্রেরণায় আফগানিস্তানে তারা পরাজিত করেছে সোভিযেত রাশিয়াকে। আলজারিয়ায় পরাজিত করেছে ফ্রান্সকে। গাজায় ও দক্ষিণ লেবাননে পরাজিত করেছে ইসরাইলকে। ফলে ইসলাম বিরোধী শক্তি বুঝতে পেরেছে নিছক উন্নত প্রযু্িক্তর যুদ্ধাস্ত্রে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত নয়। ফলে ময়দানে নেমেছে মুসলমানদেরকে তাদের শক্তির মূল উৎস্য ইসলাম থেকে সরাতে। একারণে মুসলমানদের যেখানে যত অধিক জনশক্তি সেখানেই তাদের অধিক বিণিয়োগ। বাংলাদেশে সেক্যিউলার ও ইসলামি বিরোধী এনজিওদের অর্থভারি হওয়ার মূল কারণও এখানে। তাদের মূল টার্গেট এখন ইসলাম এবং মুসলমানের প্যান-ইসলামি চেতনা। কারণ, এ চেতনার কারণেই নানা দেশের নানা ভাষি মুসলমান ছুটে যায় মজলুম মুসলমান ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে। গিয়েছিল আফগানিস্তানে ও চেচনিয়ায়। ইসলামের শত্রু পক্ষ চায় না, আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ায়ে বিশ্বের মুসলমানেরা আবার একতাবদ্ধ হোক। ভাষা, ভূগোল বা বর্ণভিত্তিক চেতনায় সেরূপ একতা অচিন্তনীয়। এজন্যই ইসলামের বিপক্ষ শক্তি চায়, নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলভিত্তিক মুসলিম বিশ্বের বিভক্তি। চায় ভাতৃঘাতি লড়াই। চায় স্থায়ী ঘৃণাসৃষ্ঠি।

একাত্তরে যে ভ্রাতৃঘাতি লড়াই হলো সেটিকে এরাই উপমহাদেশের বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী মুসলমানের মাঝে চিরস্থায়ী ঘৃণায় পরিণত করেছে। এ ঘৃণাকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে সেক্যিউলার পাক্ষটি সর্বপ্রকার আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা পাচ্ছে অমুসলিম দেশ থেকে। যেখানেই ইসলামের বিপক্ষ শক্তির পদচারণা সেখানেই বিভক্ত হয়েছে মুসলিম ভূমি। রক্ত ঝরেছে মুসলমানের। অখন্ড আরব ভুমি বহু খন্ডে বিভক্ত হয়েছে এদের কারণেই। আজ বিভক্ত হতে চলেছে ইরাক। অথচ ইসলামে এমন বিভক্তি হারাম। ইসলামে আছে উম্মাহর চেতনা। বর্নবাদ ও জাতিয়তাবাদ এখানে হারাম। উম্মাহ বলতে বোঝায়, নানা ভাষা, নানা বর্ণ এবং নানা দেশের মানুষের মাঝে মহান আল্লাহকে খুশি করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা। আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় অর্থদান, শ্রমদান এমন কি প্রাণদানেও তারা অগ্রণী হয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন সাহাবী পাওয়া যাবে না যিনি এমন লড়ায়ে অংশ নেননি। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ইসলামে নিষিদ্ধ। তবে যেটি সিদ্ধ ও অতিশয় কাঙ্খিত তা হলো, বান্দাহর অর্থ ও রক্তসহ সমুদয় সামর্থ ব্যবহৃত হবে ইসলামের বিজয়ে। একটি পয়সা বা এক ফোটা রক্তও ব্যয় হবে না ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে তথা সেক্যিউলার রাজনীতিতে। কারণ, এমন অর্থ ও আত্মবিণিয়োগে আর যাই হোক মুসলমানের ঈমান বাঁচে না। ঈমানদারের কাছে তাই সেটি অভাবনীয়। বরং প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয, ইসলামের বিজয়ে সমগ্র সামর্থকে সে নিয়োজিত করবে। এটিই তার বাঁচবার মিশন। অথচ সেক্যিউলার শক্তি মুসলমানের সে আত্মনিয়োগকেই নিষিদ্ধ করতে চায়। নিষিদ্ধ করতে চায় জিহাদকে। মুসলমানের রাজনীতিই হলো জিহাদ। এ রাজনীতিতে সে শুধু ভোট দেয় না, অর্থ ও রক্তও দেয়। এমন রাজনীতিতে সে ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে না, বরং সর্বভাবে নিজে ব্যবহৃত হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠায়। এমন কি প্রাণও দেয়। নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম তো এমন রাজনীতিই শিখিয়ে গেছেন। অপর দিকে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি যেখানেই ক্ষমতায় গেছে সেখানে নিষিদ্ধ করেছে ধর্মপ্রাণ মানুষের রাজনীতি তথা জানমালের এ আত্মত্যাগী বিণিয়োগ। এমনটি হয়েছে তুরস্ক, মিশর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়াসহ বহু মুসলিম দেশে। সত্তরের দশকে বাংলাদেশেও একাজ করেছিল সেক্যিউলার পক্ষটি। সেক্যিউলারিজমকে তারা রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছিল। এতে তারা নিজেরা যেমন খুশি হয়েছিল তেমনি খুশি করেছিল ভারতকে। এদের কারণেই মুসলিম দেশে পরাজিত হচ্ছে ইসলাম। অসম্ভব হয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের এত পরাজয়, এত অসম্মান ও এত রক্তক্ষয়ের কারণতো এটিই। কারণ আল্লাহপাক তাঁর দ্বীনের প্রতি এমন অঙ্গিকারহীনদের বিজয়ী করেন না, সম্মানও দেন না। অথচ মুসলমানেরা যখনই এক অভিন্ন উম্মাহর ধারণা নিয়ে একমাত্র আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে ময়দানে নেমেছে তখন তাঁর সাহায্য পেয়েছে। বিজয়ও অর্জিত হয়েছে।

অথচ আজ থেকে শত বছর আগে বাংলার মানুষ আজকের ন্যায় ধর্মে এতটা অঙ্গিকার শূণ্য ছিল না। অন্য যে কোন মুসলমানের ন্যায় বাংলার মুসলমানও কাজ-কর্ম ও সংস্কৃতিতে ধর্ম থেকে অনুপ্রেরণা পেত। অনুপ্রেরণা পেত নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষের সাথে ইসলাম ও মুসলমানের কল্যাণে কিছু করার। ধর্মে এমন অঙ্গিকারবদ্ধতার কারণেই বাংলার মানুষ আজ থেকে শত বছর আগে ঢাকাতে ঘটিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার বুকে অতিশয় যুগান্তকারি ঘটনা। সে ঘটনাটিই পাল্টে দিয়েছিল উপমহাদেশের মানচিত্র। সেটি ছিল ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা যা জন্ম দেয় বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্্র পাকিস্তানের। ইসলামি চেতনাশূন্য একজন সেক্যিউলারের কাছে এ ঘটনার মূল্য যাই হোক, ১৭৫৭ যে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বরং বলা যায়, মুসলমানদের হাতে ভারত বিজয়ের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বিজয়। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের ইতিহাসেই নয়, বহু শত বছরের বিশ্ব-মুসলিম ইতিহাসেও এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোন এক বিশেষ ভাষার মুসলমানের পক্ষে যখন অন্য ভাষার মুসলমানদের সাথে এক ভূগোলে বসবাসই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম দেশগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভাষা ভিক্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে বিভক্ত হচ্ছিল তেমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতের নানা ভাষী মুসলমানদের পক্ষে একত্রে পাকিস্তানে সৃষ্টি ছিল বিস্ময়কর।

সেদিন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় প্রচন্ড উৎফুল্ল হয়েছিল সারা বিশ্বের মুসলমান। প্রখ্যাত জার্মান নওমুসলমান মহম্মদ আসাদের ন্যায় অনেকে তখন ছুটে এসেছিল পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার কাজে। বহুশত বছরের উপর্যপরি পরাজয় এবং বহু ভাতৃঘাতি যুদ্ধবিগ্রহের পর বিশ্বের মুসলমানদের মনে জাগিয়েছিল এক নতুন স্বপ্ন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগের হাত দিয়ে ১৯৪৭য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলে আফগানিস্তানে জিহাদ সফল হওয়াই কঠিন হতো। ফলে বিধ্বস্ত হতো না সোভিয়েট রাশিয়া এবং প্রতিষ্ঠা পেত না ৬টি মুসলিম রাষ্ট্র, যেগুলির সমুদয় আয়তন ভারতের চেয়েও বৃহৎ। কারণ ভারত অবিভক্ত থাকলে দেশটি যে আফগানিস্তানের মুসলিম নিধনে রাশিয়াকেই সমর্থণ দিত তা নিয়ে সন্দেহ আছে কি? আফগানিস্তানে জিহাদ চলাকালে তারা সেটিই করেছে। মুসলিম ইতিহাসে, বিশেষ করে পাকিস্তানীদের কাছে ১৯০৬ সাল, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এবং ঢাকা নগরী আজও তাই অতি অবিস্মরণীয়। আজকের যে বাংলাদেশ সেটিরও জন্ম পাকিস্তান সৃষ্টির ধারাবাহিকতায়। বাংলাদেশ তার সৃষ্টির শুরু থেকে এ অবধি বিশ্বের নানা দেশ থেকে হাত পেতে শুধু নিয়েই চলেছে, দিচেছ সামান্যই। মিয়ানমারের আরাকান মুসলমানেরা আজ বর্বরতম নিযার্তনের শিকার। শত শত বছর সেখানে বসবাস করেও সকল প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। অথচ তাদের কষ্ট লাঘবে ১৩ কোটি মুসলমানের বাংলাদেশ কিছুই করতে পারিনি। এমন এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুসলমানেরা অতীতে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর শক্তি বৃদ্ধিতে যে কিছু দিতে পেরেছে অন্ততঃ তা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে। অথচ সে ইসলামি চেতনার বিনাশ ঘটেছে সেক্যিউলারলিষ্টদের হাতে। সেক্যিউলারাষ্টিদের কারণেই মুসলমানেরা আর সামনে এগুতে পারিনি। এদের সফলতা শুধু মুসলিম মানচিত্রের খন্ডিত করণেই, বৃদ্ধিতে নয়। এরাই আরবভূমিকে টুকরো টুৃকরো করে জন্ম দিয়েছে বিশেরও বেশী রাষ্ট্রের। তাদের বাহাদুরি শুধু ভাঙ্গাতে, গড়াতে নয়। এমন একটি ঘাতক শক্তি মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে থাকলে তাদের পরাজয়ে আর বিদেশী শক্তির প্রয়োজন আছে কি? এদের পিছনে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিপুল পুঁজি বিণিয়োগের মূল হেতু তো এটিই।

লেখা: ফিরোজ মাহবুব কামাল

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম