তারাবাঈ - চতুর্থ খন্ড

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

নৌকা ভরাপালে জোর বাতাসে কল্‌ কল্‌ স্বরে নদীর জলরাশি কাটিয়া তীরের মত বেগে ছুটিল। রাতারাতি নৌকা অনেক দূরে সরিয়া পড়িল। প্রভাত সমাগমে বায়ুর বেগ কিছু মন্দ হইয়া আসিল। দেখিতে দেখিতে বায়ুর প্রবাহ একেবারেই রুদ্ধ হইয়া গেল। সুতরাং মাল্লারা নৌকার পাল নামাইয়া দাঁড় ধরিল। ঝড়ের মত যে নৌকা বায়ুভরে ছুটিয়া যাইতেছিল, এক্ষণে তাহা অপেক্ষাকৃত ধীর মস্থরভাবে যাইতে লাগিল। মালেকা এবং তারা কিছু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। মাল্লাগিদকে যতদূর সম্ভব দ্রুতগতিতে দাঁড় ফেলিবার জন্য পুনঃ পুনঃ আদেশ করিতে লাগিলেন। মাল্লারা যতদূর সম্ভব তীব্র বেগে দাঁড় ফেলিতে লাগিল।

ক্রমশঃ আঁধার ভেদ করিয়া প্রভাতের অরুণিমাজাল পূর্বগগনে দেখা দিল। বিহঙ্গ-কণ্ঠে বিশ্ব-বিধাতার বিবিধ বন্দনা ললিত-স্বরে গীত হইয়া পৃথিবীকে ঝঙ্কৃত করিয়া তুলিল! স্নিগ্ধ গন্ধসহ মৃদু-মন্দ সঞ্চার কুসুম-গন্ধ বহন করিয়া বিশ্ব-বিধাতার মঙ্গলাশীর্বাদের ন্যায় সবত্র প্রবাহিত হইয়া নব জীবনের সূচনা করিতে লাগিল।

নিশাচর প্রাণীদিগের মনে নৈরাশ্য ও ভীতির সঞ্চার এবং দিবাচরদিগের মনে আনন্দ উৎসাহের স্রোত প্রবাহিত করিতে দেখিতে দেখিতে দিবসের আবির্ভাব হইল। দিবা আবির্ভাবে মালেকা এবং তারা স্ত্রীলোকের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের বেশে সজ্জিত হইয়া নৌকার ভিতরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। নৌকায় কয়েকজন পাঠান বীরপুরুষ আসিয়াছিল; তাঁহারা বীর-পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের মাল্লাদিগের সাজে সজ্জিত হইলেন।

নৌকা ভরাপালে তীর বেগে গেলে যেখানে তিন দিনে নিরাপদ স্থানে যাইয়া উপস্থিত হইতে পারত, সেখানে বায়ুর গতি রুদ্ধ হওয়ায় শুধু ক্ষেপনী সাহায্যে চারি দিনে অর্ধপথে যাইয়া উপস্থিত হইল।


এদিকে বিঠঠলপুর হইতে ভৈরবী এবং তারার সহসা অন্তর্ধানে এবং দেবমূর্তির ভগ্নদশা দর্শনে পরদিবস প্রাতঃকালেই এক হুলস্থুল কান্ড পড়িয়া গেল! দেবমূর্তির ভগ্নাবস্থা এবং দারুণ অবমাননা দর্শনে সকলেই মর্মাহত হইল! ভৈরবীর সম্বন্ধে নানাজনে নানা মত প্রকাশ করিতে লাগিল।

কেহ ভৈরবীকে নাস্তিক, কেহ উন্মত্ত বলিতে লাগিল। কিন্তু একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বৃদ্ধা বলিল যে, এই ভৈরবী বাস্তবিক পক্ষে ভৈরবী নহে। এই ভৈরবী নিশ্চয়ই কোন মুসলমান রমণী। রমণী অসাধারণ এখানে আসিয়াছিল। মারাঠীদের ধূর্ততা এবং কৌশলকে এবার মুসলমান রমণী বেশ টেক্কা দিয়াছে। ধন্য রমণীর সাহস এবং বুকেট পাটা! সমস্ত মারাঠীদের মুখ ভোঁতা করিয়া দিয়াছে! কথা তড়িদ্বেগে সর্বত্রই রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। ঘটনা শুনিয়া সকলেই অবাক হইল! ভগ্নপ্রতিমা সন্দর্শনে সহস্র সহস্র নরনারী সমাগত হইল। ভৈরবী এবং তারার উদ্দেশ্যে সহস্রকণ্ঠে সহস্রকণ্ঠে অজস্র অভিসম্পাদ এবং সহস্র গালাগালি বর্ষিত হইতে লাগিল। কোনও কোনও প্রাচীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাহাদের আরাধ্য এই ভগ্নমূর্তির শোকে অশ্রুধারা বহাইতে লাগিল। নবীন-নবীনরাও অনেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল। কেবলমাত্র একটি মারাঠী কুমারী বিস্ময়-বিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “ওমা! বিঠ্ঠালজী আমাদের কেমন প্রভু! একজন মুসলমান রমণীর সঙ্গে যুদ্ধেই চুরমার হয়ে গিয়েছে। তবে দেখছি, এসব দেবতা-টেবতা কিছুই নয়-সবই মাটী! সবই ভুয়া! সবই মিথ্যা!”
তাহার কথা শুনিয়া সকলেই জিব কাটিয়া বলিল, “সর্বনাশ! সর্বনাশ! হীরা বলে কি! হিন্দুর মেয়ের মুখে একটি সর্বনেশে কথা! ঘোর কলি! ঘোর কলি!! ধর্ম আর থাকে না।” এই বলিয়া হীরার প্রতি সকলেই তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল! হীরাবাঈ তাহাতে আরও ত্যক্ত বিরক্ত হইয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, “আমি কি অন্যায় বলছি? যে-দেবতা নিজেকে রাখতে পারে না, সে আমাদিগকে কেমন করে রাখবে, আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি দিব্য দেখতে পাচ্ছি, এটি একটি বড় পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়! উহাতে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই কিছুই নয়! উহাকে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই হতভম্ব হইয়া পড়িল। কেহ কেহ হীরার প্রতি রুখিয়া উঠিল। হীরা ক্রুদ্ধ হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।

তাহার মাতামহ মলহর রাও নানাস্থানে নানাদিকে অনুসন্ধানী লোক পাঠাইলেন। নানুপুরে মালোজীর নিকট একজন অশ্বারোহীকে অবিলম্বেই পাঠান হইল। মালোজী তখন বিশেষ কার্যের জন্য নানুপুরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।

সংবাদ শুনিয়া মালোজী বজ্রাহতের ন্যায় প্রথম স্তম্ভিত হইলে, কিন্তু পর মূহুর্তের পনর জন্য অশ্বারোহী সহ তুঙ্গা নদীর তীর ধরিয়া দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ভবানীপুর নামক স্থানে-যেখানে নদী সঙ্কীর্ণ অথচ গভীর প্রবাহে প্রবাহিত হইতেছে, সেই ভবানীপুর লক্ষ্য করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ঘোড়া ছুটাইলেন। ঘোড়াগুলি পদাঘাতে প্রস্তর-গাত্রে স্ফুলিঙ্গ ছুটাইয়া এবং পর্বত ও বন-প্রান্তরে পদধ্বনির প্রতিধ্বনি তুলিয়া তীব্রবেগে ছুটিয়া চলিল। তরুশাখাসীন বিহঙ্গাবলী এবং ক্ষেত্রমধ্যস্থ বাবুই পক্ষীর ঝাঁক কেবল চকিতে চঞ্চল হইয়া কোলাহল করিতে করিতে উড়িয়া চলিল। পথিকগণের চক্ষে কেবল মারাঠী সৈন্যদিগের রবিকর-প্রতিফলিত বর্শাফলকগুলি ঝলিতে লাগিল।


সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

নৌকা চলিয়াছে। একটু বাতাস বহিতেই মাঝি আবার নৌকায় পাল তুলিয়া দিল। সকলেই নিরুদ্বেগচিত্তে নানা প্রকার গালগল্পে মশগুল! ভবানীপুর আর বেশী দূর নহে। ভবানীপুর পার হইলেই নৌকা প্রশস্ত নদীবক্ষে পড়িবে।

মালেকা বলিলেন, “যে-পর্যন্ত ভবানীপুর না ছাড়াও, সে-পর্যন্ত বিশেষ সাবধানে চলবে।” মালেকা নিজে নৌকার ছইয়ের উপর বসিয়া নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের যেখানে সেখানে বন ছিল, সেখানে সেখানে নিপুণ দৃষ্টিতে দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। ক্রমশঃ সন্ধ্যার প্রাক্কালে নৌকা ভবানীপুরের নিকটবর্তী হইল। নৌকা ভবানীপুর পার হইয়াছে, এমন সময় কতিপয় অশ্বারোহী মারাঠী চীৎকার করিয়া নৌকা থামাইতে বলিল। মালেকার বুঝিতে বাকি রহিল না, ইহারা শত্রু পক্ষেরই লোক। সুতরাং মাঝিকে অপর তীরে নৌকা চালাইতে ইঙ্গিত করিল। নৌকা নদীর অত্যন্ত প্রশস্থ স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে। এ অবস্থায় দস্যুদের পক্ষে নৌকা আক্রমণ করা সহজ নহে! নৌকা অপর তীরে দূর দিয়া চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া মারাঠীরা ভীষণ চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার চীৎকার করিয়া বলিল, “আমরা দস্যু নহি। আমরা কোতয়ালীর লোক। তোমরা কোনও রমণীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছ কি-না, তা’ই মাত্র আমাদের প্রতি দেখবার হুকুম। আমরা তোমাদের কোনও অনিষ্ট করব না। অল্পক্ষণের জন্য তোমাদের নৌকা থামাও, নতুবা আমরা গুলী চালাব। অনর্থক খুন-জখম হবে।”

মালেকার ইঙ্গিতে মাঝি বলিল, “আচ্ছা, তবে আমরা সম্মুখের বাঁকে থামাচ্ছি। তোমরা অনুসন্ধান করে দেখ।” বাতাস খুব জোরে বহিতেছিল, সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে নৌকা বাঁকে আসিয়া লাগিল। নদীব তখন অন্ধকার আচ্ছন্ন। তবে নির্মেঘ আকাশ বলিয়া দৃষ্টি একেবারে অবরুদ্ধ নহে। মালেকার নৌকার ভিতরে মাত্র একটি ক্ষীণ বাতি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিতেছিল। বাহিরে তাহার আলোক প্রায় কিছুই দেখা যাইতেছিল না।

মালেকা সকলকে যাহার যাহা কর্তব্য বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। নৌকার ভিতরে অব্যর্থ-লক্ষ্যে সৈনিকগণ নৌকার পার্শ্বের ছইয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের মুখে বন্দুকের নল সংযোগ করিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিল। দ্বাদশ ছিদ্রে দ্বাদশটি বন্দুক সংস্থাপিত হইল। আট জন মাল্লা এবং এক জন মাঝি মাত্র বাহিরে রহিল। তাহারা সকলেই আপন আপন কার্য সম্পাদনে অত্যন্ত পটু।

দস্যুরা দুইটি প্রকান্ড মশাল জ্বালাইয়া নদীর তীরে সারিবন্দী অবস্থায় দন্ডায়মান রহিল।

মাঝি বিনীতভাবে মালোজীকে বলিল, “সর্দার সাহেব! আপনি যে কয় জন ইচ্ছা লোক লইয়া নৌকার ভিতরে এসে দেখে যান। তবে ভিতরে এরূপ স্থানাভাব যে, ৩/৪ জনের অধিক লোকের দাঁড়াবার জায়গা হবে না। জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে রয়েছে।”
মালোজীঃ বেশি লোক নিয়ে দরকার কি? আমি মাত্র দু’জন লোক নিয়ে উঠেছি। তোমাদিগকে মিছামিছি জ্বালাতন করব না।-এই বলিয়া মালোজী তরবারিধারী দুইজন সৈনিকপুরুষ সহ নৌকার সিঁড়িতে পদার্পণ করিলেন। মাল্লারা কয়েকজন আসিয়া মস্তক নত করিয়া বিশেষ শ্রদ্ধাভরে সালাম করিল। মালোজী সৈনিক পুরুষদ্বয় সহ নৌকায় যেমনি উঠা, অমনি তাহাদের ঘাড়ে বজ্রের ন্যায় ভীষণ মুষ্ট্যাঘাত আর সেই সঙ্গে একেবারে দ্বাদশ বন্দুকের এক সঙ্গে আওয়াজ। দ্বাদশটি অশ্বারোহী সৈন্য মুহুর্ত মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইল। ঘোড়াগুলি ভড়কাইয়া দিদ্বিদিকে উধাও হইয়া পলায়ন করিল। অবশিষ্ট তিনজন অশ্বারোহী প্রাণভয়ে চীৎকার করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়মান হইবার উপক্রমেই মাল্লাদিগের গুলীর আঘাতে হতজীবন হইয়া ভূপতিত হইল।

এদিকে নৌকায় সমাগত মালোজী, সঙ্গীদ্বয়সহ মুহুর্ত মধ্যে বন্দী হইয়া পড়িলেন। অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়া লৌহশৃঙ্খলে কঠোরভাবে আবদ্ধ করিয়া তিন জনকে নৌকার ডহরে রজ্জুবদ্ধ কুর্মের ন্যায় ফেলিয়া রাখা হইল।

এদিকে তিন চার জন্য মাল্লা তীরে উঠিয়া নিহত মারাঠীদিগের অস্ত্র-শস্ত্রগুলি নৌকায় উঠাইয়া তাহাদের লাশগুলি নদীতে ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়িয়া দিল।

প্রবল পবনে তখন নৌকা বিজয়ী বীরের মত স্ফীত বক্ষে ছুটিতে লাগিল। এই ঘটনার বর্ণনা করিতে যে-সময় লাগিল, তাহার দশমাংশ সময়ের মধ্যে সমস্ত কার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। অতঃপর সকলে করুণাময় খোদাতা’লাকে প্রাণ খুলিয়া ধন্যবাদ দিল।


অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

চৈত্র মাসের শেষ। বসন্তের পূর্ণ বিকাশ এবং গ্রীস্মের সমাগমে শিবাজী ক্রমশঃ পরাস্ত হইয়া নিবিড় কাননে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহার সৈন্যদল ছিন্নভিন্ন হইয়া ঝাড়ে জঙ্গলে এবং পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মালোজী বন্দী হওয়ায় শিবাজী যার-পর-নাই হতাশ এবং বিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। রামদাস স্বামী, আবাজী প্রভৃতি তখন সন্ধি করিবার জন্য শিবাজীকে বিশেষভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ শিবাজীকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করিয়া সন্ধি করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সন্ধির জন্য পুনঃ পুনঃ আবেদন-নিবেদন এবং প্রার্থনা ও মিনতি চলিতে লাগিল। অবশেষে শিবাজী এক দিন মালেকা আমেনাবানুর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া তাঁহার কৃপাভিখারী হইলেন।

মালেকা আমেনাবানু তখন আফজাল খাঁকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। পরামর্শ হইল যে, শিবাজী স্বেচ্ছায় আনন্দ-উল্লাসে তারাবাঈকে রাজেচিত আড়ম্বরে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবেন। আর আফজাল খাঁ শিবাজীকে তাঁহার অধিকৃত পরগণা এবং কেল্লাগুলির মাত্র এক চর্তুথাংশ ছাড়িয়া দিবেন। শিবাজী বিজাপুর সোলতানের আধিপত্য ধর্মতঃ এক কার্যতঃ স্বীকার করিবেন।
শিবাজী মুসলমানদের যে-সমস্ত মসজিদ ভগ্ন করিয়াছেন, তাহা সমস্তই যথাযথরূপে প্রস্তত করিয়া দিলেন। শিবাজী রণতরী রাখিতে পারিবেন না। এই সমস্ত শর্ত যথারীতি লিখিয়া বিজাপুর দরবারে প্রেরণ করা হইল। বিজাপুর দরবার একেবারেই শিবাজীর উৎসাদনের পপাতী ছিলেন; কিন্তু আফজাল খাঁর অনুরোধে এই সমস্ত শর্ত স্বীকার করিয়া সন্ধি স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রদান করিলেন।

আফজাল খাঁর সহিত তারাবাঈয়ের বিবাহ সম্বন্ধে বিজাপুরের সোলতান প্রথমতঃ আপত্তি তুলিলেন। কিন্তু তারাবাঈ-এর করুণ প্রার্থনা এবং গভীর ব্যাকুলতাপূর্ণ পত্র পাইয়া পরে অনুমোদন করিলেন।

অতঃপর ২১শে চৈত্র শুক্রবার উভয় পরে প্রধান প্রধান সামন্তদিগের সম্মুখে যথারীতি সন্ধিপত্র স্বারিত হইল। শিবাজীর প্রার্থনানুযায়ী মালোজীকে আমেনাবানু বিনা নিষ্ক্রয়ে মুক্তি প্রদান করিলেন। মালেকা বলিলেন, “মালোজী আপনি তারাকে বেহুঁস করে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সচেতন এবং সশস্ত্রাবস্থায় আপনাকে বন্দী করেছি। সুতরাং আশা করি, আমাতে কোনও হীনতা দর্শন করবেন না।

মালোজী লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিলেন, “আপনার সাহস যেমন অপরিসীম, দয়াও তেমনি তুলনাহীন! আপনি আমাকে চিরকৃজ্ঞপাশে আবদ্ধ করলেন।” অনন্তর যথাসময়ে বৈশাখী পূর্ণিমাতে বিবাহের দিন নির্ধারিত হইল।

শিবাজী তারাকে লইয়া বাড়ী ফিরিলেন। তারার প্রতি যাহাতে কোনও উৎপড়ীন না হয়, সেজন্য মালেকা শিবাজীকে বিশেষভাবে সাবধান করিয়া দিলেন। তারার প্রতি অন্যায় ব্যবহার হইলে শিবাজীকে যে সকল-হারা হইতে হইবে, তাহা বিশেষরূপে বুঝাইয়া দেওয়া হইল।


ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

আজ বৈশাখী শুল্কপরে চর্তুদর্শী। অমল ধবল শশীর মনোহর কৌমুদী জালে গগনমন্ডল ও ভূতল কি সুন্দর ও শোভন দৃশ্য ধারণ করিয়াছে! রায়গড়ে শিবাজীর বাটী আজ বিশেষরূপে ধ্বজপতাকা এবং আলোকমালায় সুসজ্জিত! বিরাট সভামন্ডপে অসংখ্য আলোকের সমাবেশ! রাজবাড়ীর ফটকে ফটকে নহবতে নহবতে মধুর সুরে শাহানা বাজিতেছে! সৈনিকেরা উৎকৃষ্ট বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া নিতান্ত জাঁকজমকের সহিত রাস্তার দুই পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধভাবে দন্ডায়মান রহিয়াছে। বহুসংখ্যক নারী বিচিত্র পরিচ্ছেদ পরিধান করিয়া ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতেছে। ফলতঃ শিবাজীর রাজপুরী আজ উজ্জ্বলিত নাট্যশালার ন্যায় মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে।

একটু রাত্রি হইতেই “বর আসিতেছে, বর আসিতেছে” বলিয়া সর্বত্রই একটা ধুম পড়িয়া গেল। সুর্বণখচিত মনোহর পরিচ্ছদ পরিহিত দুইশত অশ্বারোহী রৌপ্য-নির্মিত বর্শাফলকে রক্তবর্ণ রেশমী পতাকা বিধুনন করিয়া সকলের অগ্রে নমুদার হইল। অতঃপর পঞ্চাশটি হস্তী স্বর্ণাস্তরণে আস্তৃত এবং স্বর্ণমুকুট পরিহিতাবস্থায় অগ্রসর হইল। অতঃপর নানা শ্রেণীর তুরী, ভেরী, বাঁশী, স্বরুদ, রুদ, কুপচাপ, সেতার, সারেঙ্গী, বীণ, রবান, বেহালা প্রভৃতি কোমল সুরের বাদ্যের ঐক্যতান বাজাইতে বাজাইতে বাদ্যকরণ অগ্রসর হইল।

তৎপর খাসগেলাফ, আসাসোটা, অসংখ্য প্রকার ফুলের ঝাড় সহ বাহকগণ অগ্রসর হইল। তৎপর সুবর্ণ তাঞ্জামে চড়িয়া বীরকুঞ্জর, রূপসাগর, বর নাগর আফজাল খাঁ আগমন করিলেন। তাঁহার পশ্চাতে বিজাপুরের কতিপয় অমাত্য সর্দার ও সামস্ত উৎকৃষ্ট অশ্বারোহণে নিতান্ত জাকজমকের সহিত আগমন করিলেন। অতঃপর সোলতানী “তবলখানা,” নানাজাতীয় বিগল, কর্ণাল, ভেরী, দফ, তবল, নাকারা প্রভৃতি নানা প্রকার বাদ্যে শুরু-গম্ভীরভাবে উৎসবের বাজনা বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল।

তৎপর সাধারণ সৈনিক, অন্যান্য লোক এবং রাস্তার জনতা অগ্রসর হইল। ক্রমশঃ বরযাত্রীদল শিবাজীর দীর্ঘ প্রাসাদের সম্মুখে যাইয়া দন্ডায়মান হইলেন। শিবাজী এবং তাঁহার পিতা শাহজী, মালোজী, গুরু রামদাস স্বামী, বলবন্তরাও এবং অন্যান্য কর্মচারীগণ পরম যত্নে সকলকে আদর অভ্যর্থনা এবং সাদর সম্ভাষণে প্রীত এবং সন্তুষ্ট করিয়া যথাযোগ্য আহার ও আবাসস্থান প্রদান করিলেন।
আফজাল খাঁ আনীত নানাপ্রকারের উৎকৃষ্ট মিষ্টান্ন, মোরব্বা, হালুয়া এবং ফলমূল সমস্ত প্রকান্ড প্রকান্ড চুপড়িতে করিয়া অন্তঃপুরে নীত হইল।

আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীয় কতিপয় বিশিষ্ট লোককে প্রাচীর বেষ্টিত একটি উদ্যানবাটিকার মধ্যস্থ সুন্দর গৃহে স্থান দেওয়া হইয়াছিল। শিবাজী সেইখানে আসিয়া আফজাল খাঁ এবং অমাত্যবর্গকে বিশেষভাবে অভ্যর্থনা এবং সম্বর্ধনা করিলেন। শিবাজীর বিনয়নম্র ব্যবহার, মধুর সাদর সম্ভাষণ ও সশ্রদ্ধ যত্নে সকলেই পরশ পরিতোষ লাভ করিলেন।


বিংশ পরিচ্ছেদ

আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। জ্যোৎস্না-জালে জগন্মঙ্গল যেরূপ মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে, রায়গড়ের রাজবাটীও আজ তেমনি আলোক ও পুস্প পতাকা সজ্জায় পূর্বদিন অপোও যেন অধিকতর শোভায় প্রদীপ্ত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে! সমস্ত দিন ভোজের বিপুল উৎসব অন্তে মগরেবের নামাজের পরে যথারীতি ইসলামী প্রথানুযায়ী উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইল।

অতঃপর জামাতা আফজাল খাঁকে অন্তঃপুরে আনয়নের ব্যবস্থা হইল। অন্তঃপুরের একটি নির্দিষ্ট অট্রালিকায় বাসরের জন্য পূর্ণ হইতেই আরাস্তা করা হইয়াছিল। আফজাল খাঁকে সেই অট্রালিকায় লইয়া বসাইবার কিছু পরেই অন্তঃপুরে ভীষণ আর্তনাদ উত্থিত হইল। সে আর্তনাদ অন্তঃপুরের যে যেখানে ছিল সকলেই চকিত হইয়া শিহরিয়া উঠিল!

“খুন! খুন! তারা খুন হয়েছে!” এই ভীষণ অশনিপাততুল্য শব্দ পুনঃ পুনঃ দ্রুত হইতে লাগিল! শিবাজী এবং আফজাল খাঁ উঠিতে পড়িতে প্রাঙ্গণে ছুটিয়া গেলেন! স্ত্রীলোকদিগের ভিড় ঠেলিয়া সত্যই দেখিতে পাইলেন যে, সালঙ্কারা সুসজ্জিতা তারা বুকে শাণিত-ছুরিকা-বিদ্ধ-অবস্থায় ভূতলে পতিত রহিয়াছে! রক্তে মেদিনী ভাসিয়া যাইতেছে! ছুরিকা তন্মুহুর্তেই বক্ষ হইতে তুলিয়া লওয়া হইল। চিকিৎসার যথারীতি বন্দোবস্ত হইল! কিন্তু হায়! সকলি বৃথা। তীক্ষ্ণধার ছুরিকায় হৃদপিন্ড বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা প্রাণত্যাগ করিল। এই লোমহর্ষনকার নিদারুণ সাংঘাতিক ঘটনার বৃত্তান্ত এই যে, তারাকে যখন নববধূ বেশে সাজাইয়া বাসর ঘরের দিকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখন প্রাঙ্গণে অবস্থিত একখানি পালঙ্কির ভিতর হইতে সহসা মালোজী নির্গত হইয়া শাণিত-ছুরিকা তারার বক্ষেবিদ্ধ করিয়া দেন। ছুরি বিদ্ধ করিয়াই মালোজী উর্দ্ধশ্বাসে দরজার দিকে ছুটিয়া যান। দারবান বাধা দিতেই দারবানকেও ছুরি মারিয়া নিজের পথ মুক্ত করেন। কিন্তু অন্তপুরের দ্বার হইতে ছুট পাইলেও বাহিরের দ্বারে সৈনিক-প্রহরী কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।

মহা আনন্দের মধ্যে মহাবিষাদের তরঙ্গ উত্থিত হইয়া! পূর্ণিমার শোভা আমাবস্যার অন্ধাকারে ডুবিয়া গেল। আশার কমল নিরাশার পঙ্কে মগ্ন হইল। রায়গড়ে মহা হাহাকার পড়িয়া গেল! তারা শোকে সকলেই আত্মহারা হইল! সেই বিবাহোৎসব দিনের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের শোকের বিষয় পাঠক-পাঠিকা অনুমানে বুঝিয়া লউন। আর যদি সহানুভূতি থাকে, তবে এক বিন্দু অশ্রুপাত করুন।
পরদিন প্রত্যুষে মালোজীকে শূলে চড়ান হইল। মুহুর্ত মধ্যে নৈরাশ্য-দিগ্ধ হিংসাপরায়ন আত্মা শূন্যে মিশিয়া গেল। রায়গড়ের বিষাদ ভার আরও বাড়িয়া গেল। কারণ সকলেই বুঝিল যে, মালোজী তারার প্রতি একান্তই আসক্ত এবং অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা তাহাকে একেবারেই চাহিত না। সে আফজাল খাঁর রূপসরোবরেই প্রেমের কমল তুলিতে সাঁতার দিয়াছিল। কিন্তু হায়! হতভাগিনীর আশা পূরণ হইল না। দগ্ধজীবনের অতৃপ্ত আকাঙ্খা এবং প্রেমের আগ্নেয়-পিপাসা লইয়াই জীবন ত্যাগ করিল! প্রেম-সরোবরে ডুবিয়াও এক বিন্দু প্রেমসুধা পানের পূর্বেই তাহার জীবনলীলা শেষ হইল। কি তীব্র বিষাদপূর্ণ ভয়াবহ ঘটনা! শিবাজী কন্যার শোকে নিতান্ত বিমনায়মান এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। আফজাল খাঁর নিকটে গভীর দুঃখ ও করুণ বিলাপ প্রকাশ করিলেন। আফজাল খাঁর চক্ষু হইতে অশ্রুধারা নির্গত হইল।

অনন্তর আফজাল খাঁর সহিত আত্মীয়তা এবং কুটুম্বিতা বজায় রাখিবার জন্য শিবাজী তাঁহার ভগ্নী কামিনীবাঈকে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ কিছুতেই স্বীকৃত হইলেন না। আফজাল খাঁ তৎপর দিবস প্রাতঃকালে বিজাপুরে কুচ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীও অগত্যা তাহাতে সম্মত হইলেন। পরদিন প্রত্যুষে সেনাপতি সাহেব রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে, শিবাজী, রামদাস স্বামী প্রভৃতি সকলেই বিদায় দিতে আসিলেন। শিবাজী দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “মহাবীর সেনাপতে! আমার আসা পূর্ণ হ’ল না। নৌকা কূলে লেগেও ডুবে গেল। আপনি আমার প্রবল শক্র ছিলেন। আপনি অসাধারণ বীরপুরুষ! আপনি আমার দক্ষিণ হস্ত হলে, দিল্লীর সিংহাসন দখন করাও অসম্ভব ছিল না। আমার আশা পূর্ণ হ’ল না। আপনার সহিত যুদ্ধে কখনও পারব না! আমার রাজ্যলিপ্সা কখনও দমিত হবে না; সে পথের আপনি কণ্টক। যে উপায়ে সে কণ্টক দূর করার জন্য আশা করেছিলাম, তা’ ব্যর্থ হ’ল! সুতরাং এক্ষণে দস্যুবৃত্তি ব্যতীত আর উপায় নাই।”

শিবাজীর কথা শেষ হইতে না হইতেই আফজাল খাঁ ভীষণ চীৎকার করিয়া উঠিলেন। বিস্ময়-বিস্ফারিতনেত্রে সকলে চমকিত এবং ব্যস্ত ভাবে দেখিল-শিবাজী ভীষণ ব্যাঘ্র-নখাকৃতি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা আফজাল খাঁর বুকে আমূল বসাইয়া দিয়াছেন। সকলে ভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল! আফজাল খাঁর লোকজন প্রস্তুত হইবার পূর্বেই শিবাজী এবং মাওয়ালী সৈন্যগণ মুসলমানগণকে আক্রমণ করিয়া বিপর্যন্ত এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল। বহু সম্ভ্রান্ত সৈন্যগণ নিহত হইলেন। হস্তী, অশ্ব, আসাসোটা এবং অন্যান্য সমস্ত মূল্যবান পদার্থই লুণ্ঠিত হইল। বাদ্যকরগণ বাদ্যযন্ত্রাদিসহ ধৃত হইল।

অল্প সংখ্যক লোকই প্রাণ লইয়া বিজাপুরে প্রত্যাবর্তন করিত সমর্থ হইল। শিবাজী অনতিবিলম্বেই আবার নানাস্থানে লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সহকারী যুদ্ধবিশারদ তেজস্বী বীরপুরুষদিগের নিধনে শিবাজী অতিমাত্রায় স্পর্ধিত এবং সাহসী হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা এবং মহাবীর আফজাল খাঁর শোকে মুহ্যমান এবং ক্রোধ ও প্রতিসিংসায় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর এই অমানুষিক হত্যাকান্ড এবং বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র দক্ষিণ-ভারত চঞ্চল হইয়া উঠিল। যেখানে-সেখানে এই লোমহর্ষক এবং পৈশাচিক হত্যার নিদারুণ কাহিনী একমাত্র আলোচ্য বিষয় হইয়া উঠিল।

শিবাজীর এই নৃশংস হত্যাকান্ড এবং জুগুপ্সিত বিশ্বাসঘাতকতায় দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাজরাজড়াই শিহরিয়া উঠিলেন। সকলেই বুঝিল, শিবাজীর অসাধ্য পাপকর্ম কিছু নাই।


উপসংহার

আফজাল খাঁর হত্যাকান্ডের পরে শিবাজী নানা দুর্গ এবং পরগণা অধিকার করিয়া ক্রমশঃ প্রবল হইয়া উঠিল। অবশেষে বিজাপুরের প্রবল বাহিনীর বিপুল প্রতাপে শিবাজী পুনরায় পর্যুদস্ত এবং নিতান্ত হীনবল হইয়া বিজাপুরের বশ্যতা স্বীকার করেন।

এই যুদ্ধে মোতামদ খান বিশেষ পরাক্রম এবং প্রতিভা প্রদর্শন করায় মালেকা আমেনাবানু তাঁহাকে পরিণয়-পাশে আবদ্ধ করেন।
এই সময়ে দাক্ষিণাত্যে মারাঠীদিগের পুনরভ্যুত্থানের আশা সমূলে নির্মূল হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, এই সময়ে ভারতেই অদ্ভুতকর্মা তপস্বী সম্রাট মহাপরাক্রান্ত মহাযশঃ বাদশাহ আওরঙ্গজেব সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র প্রভুত্বের লালসায় অকারণে গোলকুন্ডা এবং বিজাপুর রাজ্যদ্বয় আক্রমণ করেন। এই দুই রাজ্য পূর্ব হইতে দিল্লীশ্বরদিগের বন্ধুতা সূত্রে আবদ্ধ ছিল এবং শাহজাহানের সময় হইতে উভয় রাজ্য ‘সালামা নজরানা’ দিল্লীর দরবারে পেশ করিতেন। তথাপি আওরঙ্গজেব এই উভয় রাজ্য আক্রমণ করেন।

গোলকুন্ডা এবং বিজাপুর ক্ষুদ্র রাজ্য হইলেও সমৃদ্ধ এবং বলদৃপ্ত ছিল। জ্ঞানচর্চা, শিল্পচর্চা এবং বিজ্ঞানচর্চায় উভয় রাজ্যই বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। উভয় রাজ্যের সোলতান, মন্ত্রী এবং সেনাপতিগণ নিতান্ত দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। আওরঙ্গজেবের মহীয়ান চরিত্রে এবং গরীয়সী বীর্যবত্তা ও দূরদর্শিতার শুভ্র-যশে এই উভয়রাজ্য আক্রমণ করাই হইতেছে অদূরদর্শিতা এবং স্বজাতিদ্রোহিতার দুরপনেয় কলঙ্ককালিমা। এই রাজ্যদ্বয় দখল করিবার জন্য তাঁহাকে প্রায় ত্রিশ বৎসরকাল ভীষণ লোকক্ষয়কর যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। মুসলমান বাদশাহ ও বহু দুর্গ দখল করিয়া স্বাধীন আত্মকলহের সুযোগে শিবাজী অবসর বুঝিয়া বহু পরগণা ও বহু দুর্গ দখল করিয়া স্বাধীন রাজ্য পত্তন করেন। মারাঠীগণ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠে। অবশেষে আওরঙ্গজেবকে এই মারাঠী শক্তি দমনের জন্য বিশেষ বেগ পাইতে হয়। আওরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ না করিলে, শিবাজী আর কখনও মাথা তুলিবার সুবিধা পাইতেন না। বিজাপুরের রাজশক্তিই শিবাজীকে চিরকাল দমন রাখিতে সমর্থ হইত।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম