পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
বিঠ্ঠশপুরে বিঠঠলজীর একটি মন্দির ছিল। এই বিগ্রহের নামানুসারে গ্রামের নাম বিঠ্ঠুলপুর হইয়াছিল। বাসন্তী পূর্ণিমার তিথিতে এই বিঠঠলদেবের মন্দিরে কোথা হইতে এক তেজঃপুঞ্জতনু তপ্তাকাঞ্চনকান্তি ললনা-কুল-ললাম ভূতা মহাতেজস্বিনী ভৈরবী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
প্রভাত হইতে হইতেই ভৈরবীর আগমন-সংবাদ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। দলে দলে নরনারী কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে এই নবীনা ভৈরবীকে দেখিবার জন্য সমবেত হইতে লাগিল। ভৈরবী অনেক পীড়িত ব্যক্তিকে ঔষধ দান করিয়া অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আরোগ্য করিলেন। ভৈরবীকে রূপে-গুণে-জ্ঞানে আকৃষ্ট হইয়া দলে দলে লোক চতুর্দিক হইতে উপস্থিত হইতে লাগিল।
বিঠ্ঠলপুর লোকের হলহলায় সজাগ হইয়া উঠিল। নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য, নজর-নেয়াজ এবং মানতের ফল-ফুল, নানাপ্রাকার উপাদেয় ভোজ্য জাত, বস্ত্র এবং মুদ্রায় মন্দির পূর্ণ হইয়া উঠিল। সন্তান লাভ কামনায় নারীদিগের বিপুল জনতা হইতে লাগিল। ভৈরবী এই বিপুল খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থরাশি প্রফুল্ল চিত্তে গরীব-দুঃখীদিগকে দান করিতে লাগিলেন।
ভৈরবীর রূপের ছটা, তেজস্বিনী মূর্তি, বিনয়নম্র ব্যবহার, সরল ধর্মোপদেশ এবং রোগ আরোগ্য-শক্তি অবলোকন করিয়া সকলেই বিমুগ্ধ হইতে লাগিল! চতুর্দিকে ভৈরবীর নামে ধন্য ধন্য রব পড়িয়া গেল।
ভৈরবীর প্রশংসায় আকৃষ্ট হইয়া একদিন স্বয়ং তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে লইয়া ভৈরবী সন্দর্শনে বিঠ্ঠলজীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীর অনিন্দ্যসুন্দর কমনীয় মূর্তি এবং মধুর বাক্যালাপে অম্বুজা বাঈ এবং উভয়ের মোহিত হইয়া পড়িলেন। তারার অসুখের কথা উঠিলে ভৈরবী বলিলেন যে, তিনি একরাত্রি তারাকে নির্জনে নিজের কাছে রাখিয়া একটি মন্ত্র জপ করিয়া গভীর রাত্রে হোম করিবেন।
অম্বজা বাঈ আনন্দের সহিত তাহাতে অনুরাগপূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করিলেন। অতঃপর নির্দিষ্ট রাত্রে তারাবাঈকে লইয়া ভৈরবী মন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। কিছু রাত্রি পর্যন্ত মন্ত্র জপ করিবার পরে, ভৈরবী তারাকে বলিলেন, “তোমার এ মানসিক বিকার প্রেমের জন্যই সংঘটিত হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই কারও প্রেম-পাশে আবদ্ধ হয়েছে। তিনি কে আমাকে খুলে বল।”
তারাবাঈ ভৈরবীর কথা শুনিয়া লজ্জায় অধোবদন হইল, তাহার গণ্ড রক্তাক্ত হইয়া আবার মলিন হইয়া গেল। তারা নীরবে হতাশের দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।
ভৈরবী বলিলেন, “আমি গণনায় দেখছি যে, সেই নাগররাজ মুসলমান কুলোদ্ভব। তুমি মারাঠী-রাজকুমারী হয়ে কিরূপে মুসলমান নাগরের রূপে মুগ্ধ হলে, ইহা ত নিতান্তই আশ্চর্যের বিষয়! যা হ’বার তা’ ত হয়ে গিয়েছে। এক্ষণে তাতে ভুলে যাবার চেষ্টা করাই সঙ্গত। ভুলবার চেষ্টা করলে, ভুলে যাওয়াটা কঠিন নহে?”
তারা কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন “তা’ সম্পূণ অসম্ভব।
ভৈরবীঃ বটে! প্রেম কি এতই গভীর হয়েছে? এত ফাঁসিয়া গেলে ত মুশকিল! জাতি কুল মজাইয়া প্রেম করা ত ভাল নয়।
তারাঃ প্রেম কি জাতি-কুল বুঝিয়া চলে? তটিনী যেমন নিভৃত গিরিকন্দর হ’তে নির্গত হয়ে আপনার মনে আপনার ভাবে পথ কাটিয়ে সাগর-সঙ্গমে প্রবাহিত হয়, প্রেমও তেমনি উদ্দাম গতিতে আপনার মনের পথে ছুটে চলে। নদী যেমন পথে চলতে কা’কেও জিজ্ঞাসা সমুদ্রের সম্মিলন লাভ না করে কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না, প্রেমও তেমনি আকাঙ্খিতকে প্রাপ্ত না হয়ে স্থির হতে পারে না।
ভৈরবীঃ তুমি দেখছি, প্রেম-রাজ্যের মস্ত দার্শনিক পন্ডিত হয়ে পড়েছে! তোমার সঙ্গে এটে উঠা কঠিন!
তারাঃ আপনার বিনয় প্রকাশের কায়দা অতি চমৎকার! এই অধীনা এবং অধমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আপনার চেহারা দেখে এবং কথা শুনে আমি একরূপ অনির্বচনীয় শান্তি লাভ করেছি। আপনার স্বর যেন কত কালের পরিচিত! আর আপনাকে যেন কতই প্রাণের জন বলে বোধ হচ্ছে! কেন এরূপ হচ্ছে, তা’ ঠিক বুঝতে পারছি না!
ভৈরবীঃ আমিও সত্য সত্যই তোমার জন্য প্রাণের ভিতরে গভীর মমতা বোধ করছি। তোমাকে নিতান্তই আত্মীয়তম, মধুরতম এবং প্রিয়তম বলে বোধ হচ্ছে। এণে আমি তোমার অভীষ্ট সিন্ধ হবার কোনও আনুকূল্য করতে পারলেই কৃতার্থ এবং সুখী হতে পারি।- এই বলিয়া ভৈরবী গভীরভাবে ধ্যানমগ্না হইলেন। দীর্ঘ ধ্যানের পর সহসা ধীরে চুরুম্মিলন পূর্বক প্রভাত-প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় স্মিত হাস্যে বলিলেন, “তোমার ভাগ্যাকাশ ঊষালোক আলোকিত দেখে আশ্বস্ত হলাম!-এই বলিয়া ভৈরবী গম্ভীর মূর্তি ধারণ করিলেন।
তারাঃ কি দেখলেন? বিশদরূপে বুঝিয়ে বলুন।
ভৈরবীঃ আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। অভীষ্ট সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হবে।
তারাঃ এখানে বসেই কি অভীষ্ট সিদ্ধ হবে?
ভৈরবীঃ নিশ্চয়ই না।
তারাঃ তবে কোথায় যেতে হবে?
ভৈরবীঃ তা’ আমি জানি। সমুদ্র-সঙ্গম ব্যতীত গতি আর কোথায়?
তারাঃ কে আমাকে নিয়ে যাবে?
ভৈরবীঃ যে তোমাকে নিতে এসেছে।
তারাঃ আপনি! আপনি!! আপনি আমাকে নিতে এসেছেন! বটে, প্রেমাস্পদের সহিত মিলনের জন্য, কিম্বা দেবতার মন্দিরে
বলিদানের জন্য! ভৈরবীর প্রাণ যে অতি কঠোর। আমার জন্য আপনার এত গরজ কি? কে আপনি?
ভৈরবীঃ বেশী কথা বলো না। স্থির হও। আমি কে, এই দেখ।
ভৈরবী এই বলিয়া তাহার বাহুর উপরের অংশে একটি দাগ দেখাইল। এতক্ষণ ইহা বস্ত্রাবৃত ছিল।
তারা এই অস্ত্র লেখা দেখিয়া বিস্মিত এবং আনন্দিত হইল। ভৈরবীর কণ্ঠ আলিঙ্গন করিয়া তারার বক্ষে মুখ লুকাইয়া আনন্দাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল। ভৈরবী আনন্দোদ্বেলিত চিত্তে তারা পেলবগন্ডে দুইটি গাঢ় চুম্বন করিয়া স্নেহভরে বলিলেন, “আর অশ্রু বর্ষণ করো না। তোমার ক্রন্দনে আমার হৃদয় মথিত হচ্ছে। প্রস্তত হও। নদীর ঘাটেই নৌকা। এখনই এই স্থান ত্যাগ করে নৌকায় আরোহন করতে হবে।”
তারার মুখমন্ডল সহসা মেঘাবরণ মুক্ত শরচ্চন্দ্রের মত সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল! আনন্দোজ্জ্বাসে তারার হৃদয়ের স্তরে স্তরে এবং শোণিতের কণায় কণায় বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল!! নৈরাশ্যের গ্রীস্ম-জ্বালা পরিশুঙ্ক হৃদয়-তটিনীতে আশা ও আনন্দের বর্ষাকালীন জীমূত-ধারা মূষলধারে বর্ষিত হইতে লাগিল। সে বর্ষণে প্রেমের দু’কূল-প্লাবী বান ডাকিয়া যুবতীর হৃদয় তোলপাড় করিয়া দিল। ঝটিকা-সংক্ষুব্ধ-অম্বুধির ন্যায় তাহা চঞ্চল এবং উত্তাল হইয়া উঠিল।
অতি সত্বর ভৈরবীও বেশ পরিবর্তন করিয়া সাধারণ মারাঠী যুবকের ন্যায় সজ্জিত হইলেন। অতঃপর আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সহ নির্গত হইবার উপক্রম কালে তারা বিঠ্ঠলজীর প্রতিমাটি ভূপাতিত করিয়া পদাঘাতে তাহা ভগ্ন করিয়া ফেলিল! ভৈরবী বলিলেন, “তারা! ছি! ছি! এ করলে কেন? প্রতিমার সহিত প্রতিহিংসা কিসের?
তারাঃ প্রতিহিংসার জন্য নহে। মারাঠীদের ভ্রমাপনোদনের জন্য। তাহারা এই মূর্তিকে জাগ্রত এবং জীবিত বলিয়া জানে! আমার সঙ্গে মত দিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমি এই প্রমাণ করে গেলাম যে, ইহা প্রস্তর ব্যতীত আর কিছুই নহে। এতে তাদের অনেকের ভ্রান্তি দূর হবে।
ভৈরবীঃ দেখছি, তুমি মূর্তিপূজক কাফেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ন্যায় প্রতিমা চূর্ণ করতে বিশেষ আনন্দ লাভ করে।
অতঃপর ভৈরবী এবং তারা নিশীথের গভীর অন্ধকারের মধ্যে যথাস্থানে যাইয়া নৌকায় আরোহন করিলেন। সুবাতাস বহিতেছিল। নৌকা পাল-ভরে তীরের মত ছুটিয়া চলিল। পাঠক-পাঠিকা! বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই ভৈরবী আর কেহ নহে, ভৈরবী আমাদেরই অসাধারণ তেজঃস্বিনী বিচিত্রকর্মা মালেকা আমেনাবানু।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
গভীর নিশীথে সুড়ঙ্গপথে বেহুঁশ অবস্থায় তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া মালোজী এক পর্বত গুহায় লুকাইয়া রাখিলেন। কিন্তু সেখানে আফজাল খাঁর চরগণ আশু অনুসন্ধান পাইতে পারে বলিয়া পিত্রালয় রায়গড়ে পাঠাইবার কথা হয়। কিন্তু সেখানে রাখিলে পাছে আফজাল খাঁ রায়গড় আক্রমণ করিয়া বসেন, এই ভয়ে শিবাজী তাহাকে মাতুলালয়ে রাখিতে আদেশ করেন। কঙ্কন প্রদেশের বিঠ্ঠলপুরের এক গিরি-উপত্যকার তারার মাতুলালয়। স্থানটি নিতান্ত দুর্গম, অথচ প্রাকৃতিক দৃশ্যে নিতান্তই মনোরম। তারার মাতামহ মলহর রাও একজন বড় জোতদার এবং হায়দ্রাবাদ নিজামের তহশীলদার। সুতরাং বিঠঠপুলপুরে তিনি একজন মতা ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। তারাকে এখানে বিশেষ যত্নে গোপনে রাখা হইল। তারার মনের গতি পরিবর্তনের জন্য নানাবিধ অবলম্বন করা হইল। কোনও রূপে একটি সন্ধি স্থাপিত হওয়া মাত্রই মালোজীর সঙ্গে তারার উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইবে, এই আশায় সকলেই উদ্বিগ্ন রহিল।
তারা সহস্র যত্ন এবং আদর পাইলেও কিছুতেই আফজাল খাঁর অতুল গরিমাপূর্ণ সৌন্দর্য এবং প্রেমের মাদকতা ভুলিতে পারিল না। স্বাধীন বনচারী বিহঙ্গকে পিঞ্জারাবদ্ধ করিতে তাহার মানসিক অবস্থা যেরূপ হয়, তারার অবস্থাও তদ্রুপ।
তারার প্রাণের ব্যাকুলতা এবং চাঞ্চল্য দিনের পর দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল। পলায়ন করিবার জন্য নানা চেষ্টা করিয়াও কোনও সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিল না।
জীবন, তারার কাছে নিত্যই দুর্বহ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তারার মনের কথা, প্রাণের ব্যথা, ব্যক্ত করিবার জন্য একটি লোকও নাই। তাহার প্রণয়-দেবতা আফজাল খাঁর কোনও সংবাদ না পাইয়া সে আরও অধীর চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে কাহারও সহিত মিশিত না বা কথা কহিত না। মনের অশান্তি ও চাঞ্চল্য হাজার চেষ্টা করিয়াও তারা লুকাইতে পারিত না। তাহার মনের প্রতি অণুপরমাণু তুষানলে যে দগ্ধ হইতে লাগিল
হায়! সে দুঃখ এবং সে জ্বালা ব্যক্ত করিবার ভাষা নাই। তারার মাতামহী তাহার মানসিক শান্তি বিধানের জন্য অনেক চেষ্টা ও তদ্বির করিলেন। অনেক হোম এবং যজ্ঞ করিলেন। তারার বিত্তরঞ্জনের জন্য গান-বাদ্যের বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু জলের পিপাসা কি দুগ্ধে নিবারিত হয়? ক্ষুধার পেট কি কখনও কথায় ভরে? তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।
তারা পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইতে লাগিল। ক্রমশঃ সুবর্ণ কান্তি বিমলিন হইতে লাগিল। তারার উজ্জ্বল কটাপূর্ণ চক্ষু ক্রমশঃ উদাস ও কাতর-দৃষ্টিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কেশ বেশ এবং অঙ্গরাগে তাহার আর কিছুই যত্ন রহিল না। কিছুদিন মধ্যে তারাতে কিছু কিছু উম্মাদের লক্ষণও পরিদৃষ্ট হইতে লাগিল।
বায়ু শান্তির জন্য নানা প্রকার আয়ুর্বেদীয় তৈল এবং ঔষধের ব্যবস্থা হইল। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোনও সুফল পরিদৃষ্ট হইল না। তারার নধর ও পুষ্ট তণু ক্রমশঃ ক্ষীণ ও শ্রীহীন হইতে লাগিল। সকলেই বুঝিল, প্রেমাস্পদ লাভের দারুণ নৈরাশ্যেই তারার শরীর-মন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে চক্ষের তারার ন্যায় দেখিতেন। তারার শোচনীয় বিষন্ন অবস্থা অবলোকন করিয়া তিনি যার-পর-নাই মর্ম-পীড়িত হইলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
শিবাজীঃ মা! তুমি সাক্ষাৎ ভবানী। তুমি দয়া করে সন্ধি করে দাও। এ ভীষণ যুদ্ধের শাস্তি হলেই রক্ষা পাই। অসংখ্য লোক এই সমরাগ্নিতে পতঙ্গের ন্যায় ভস্মীভূত হচ্ছে। দেশের কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প ক্রমশঃ বিলুপ্ত হচ্ছে। আর কিছুদিন এই সমরানল প্রোজ্জ্বলিত থাকলে, একবারেই উৎসন্ন যাবে।
মালেকাঃ আমি এখনও তোমার বন্দিনী। এই পশ্চিমঘাট গিরি-গুহার নির্জন প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থেকে কেমন করে প্রস্তাব করতে পারি? আর সন্ধি করবার মত থাকলে, মহামতি আফজাল খাঁর নিকটে সে-প্রস্তাব পেশ করলেই ত হ’তে পারে।
শিবাজীঃ আফজাল খাঁ সন্ধি করবেন, এরূপ ত কিছুতেই মনে হয় না। মারাঠী শক্তিকে সমূলে নিমূল করাই তাঁর উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য প্রতিপালনের জন্য তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করলে, তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন।
মালেকাঃ অপহৃত রাজ্য ও দুর্গ ফিরিয়ে দিলে এবং বিজাপুরের আধিপত্য স্বীকার করলে, তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করবেন।
শিবাজীঃ তা’ হ’লে আমার কি লাভ হ’বে? আমার স্বাধীনতা বজায় না থাকলে, সন্ধি করে লাভ কি? যা’তে আমার স্বাধীনতা থাকে, অথচ সন্ধি হয়, তোমাকে সেইরূপ চেষ্টাই করতে হবে।
মালেকাঃ অসম্ভব বলে বোধ হয়। তোমাকে “পুনর্মূষিক” হতেই হবে। বিজাপুর দরবারের কঠোর আদেশ যে, তোমাকে বন্দী বা নিহত করতে হ’বে। এর জন্য অর্থব্যয় ও বলক্ষয় করতে বিজাপুর দরবার কুণ্ঠিত নহে। সোলতান তোমার প্রতি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন।
শিবাজীঃ তবে উপায় কি?
মালেকাঃ উপায়-রাজ্য প্রত্যর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
শিবাজীঃ প্রাণান্তেও স্বেচ্ছায় রাজ্য ফিরিয়ে দিতে পারব না।
মালেকাঃ তবে সন্ধির কথা মুখে আনিও না। যথার্থ বীরপুরুষের ন্যায় যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হও।
শিবাজীঃ মা! তুমি অন্ততঃ আমার অনুকূল হও।
মালেকাঃ অসম্ভব! তুমি মুসলমানের প্রতি যেরূপ ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করেছ, মসজিদগুলি যেরূপভাবে অপবিত্র করেছ, তা’তে তোমার পক্ষ অবলম্বন করা দূরের কথা, তোমার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান না হওয়াই পাপ। আমাকে শিবিরে পৌঁছিয়ে দিবার জন্য কি করছ? যত বিলম্ব হচ্ছে, আফজাল খাঁ এবং মোতামদ খান ততই উন্মত্ত হয়ে যুদ্ধ করছেন। আমাকে ফিরিয়ে পেলে, তাঁরা অনেকটা শান্তি লাভ করবেন।
শিবাজীঃ মা! তোমাকে মা বলেই মেনে নিয়েছি। সাক্ষাৎ ভবানী-মূর্তি বলে পূজাও করছি। অন্ততঃ মা সন্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না, এ আশা করা কি বিড়ম্বনা?
মালেকাঃ নিশ্চয়ই নহে। আমি ত প্রথমে যুদ্ধ করি নাই। তুমি পুনঃ পুনঃ কৃষ্ণগড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমার কত সর্বনাশ করেছ; তা’ একবার ভেবে দেখ।
শিবাজীঃ যত শীঘ্র পারি, পৌঁছিয়ে দিবার জন্য চেষ্টা করব। কিন্তু মা! আমার স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে।
মালেকাঃ আমার তা’তে হাত নাই।
শিবাজীঃ আমি মনে করি যথেষ্ট আছে।
মালেকাঃ সম্বন্ধ পাততে পারলে, রক্ষা পাবার সম্ভাবনা হ’তে পারে। কিন্তু তোমার কি তা’তে মত হবে।?
শিবাজীঃ সে কিরূপ সম্বন্ধ? সে কিরূপ ব্যাপার?
মালেকাঃ কেন? কিছুই কি জান না? তোমার কন্যা তারা যে আফজাল খাঁর রূপে প্রেমোম্মাদিনী। আফজাল খাঁও তার সেবা-শুশূষায় মুগ্ধ হয়েছেন। আফজাল খাঁর করে তারাকে সমর্পণ করে সন্ধি করলে, হয়ত সোলতান তোমার অনুগ্রহ করতে পারেন। কারণ, আফজাল খাঁ সোলতানের একান্ত প্রীতিভাজন।
শিবাজীঃ অসম্ভব! মালোজীকে কন্যা সম্প্রদানে পূর্বেই সম্মতি প্রকাশ করেছি। বাগদত্তা কন্যা কিরূপে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করব।
মালেকাঃ তা’তো বটে! কিন্তু তারা আফজাল খাঁকেই হৃদয়-মন দিয়ে বরণ করেছে, সুতরাং মালোজীর পক্ষে তারা আকাশের ন্যায় অপ্রাপ্য।
শিবাজীঃ আমিও তা’ বুঝেছি, কিন্তু কি করব! যেমন করে হউক মালোজীর করেই সমর্পণ করতে হবে। পরিণাম যা’ হয়, হবে। মালোজী তারার রূপে মুগ্ধ! মালোজী মুসলমান শিবির হ’তে তা’কে হরণ করে লুকিয়ে রেখেছে।
মালেকাঃ আমাকে হরণের সঙ্গে সঙ্গে নাকি? কেমন করে হরণ করলে? সেই সুড়ঙ্গ পথে নাকি?
শিবাজীঃ না, তার অনেক পরে। ছদ্মবেশে শেরমর্দান খাঁ রূপে! তোমাদের শিবিরে অনেক দিব বাস করবার পরে।
মালেকাঃ শেরমর্দান খাঁই তবে মালোজী!
শিবাজীঃ হাঁ।
মালেকাঃ সাবাস বটে! অদ্ভুত সাহস এবং ছদ্মবেশ ধারণে অপরিসীম নৈপুণ্য! আমরা কোনও সন্দেহ করতে পারি নাই। বাস্তবিকই মারাঠীরা কি ভীষণ ধূর্ত! তোমাদের অসাধ্য কর্ম কিছু নাই!
শিবাজীঃ প্রেমের দায়ে সকলি সম্ভব।
এই সময়ে মালেকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
শিবাজীঃ মা! তুমি বুঝি তারাকে খুব ভালবেসেছ?
মালেকাঃ তাঁ, খুবই! নিজের ছোট ভগ্নী এবং সখির মত! তারাকে মালোজী হরণ করেছে এ-সংবাদ শেলসম অন্তঃকরণকে বিদ্ধ করছে। হায় তারা! তারাকে বোধ হয় রায়গড়ে নিয়ে গিয়েছে?
শিবাজীঃ না। তারাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে আমি তা’ ঠিক অবগত নহি। তবে শুনেছি, তার মাতুলালয়ে আছে।
মালেকাঃ এ অপহরণে কোনও ফল হবে না। তারা, আফজাল খাঁ ব্যতীত আর কা’কেও স্বামীত্বে বরণ করবে না। জোর-জবরদস্তি ক’রে কুফল ব্যতীত কোন সুফল হবে না।
শিবাজীঃ তা’ খুবই বুঝছি। কিন্তু মালোজীর করে কন্যা সমর্পণ না করলে, মালোজী বিদ্রোহী হবে। আত্মীয়-স্বজন ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হবে। মহাসঙ্কট। তারার মৃত্যুই এক্ষণে মঙ্গলজনক। এমন কুলত্যাগিনী কন্যার পিতা হওয়া বিষম পাপের ফল! লোক-সমাজে মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না।
মালেকাঃ তুমি অন্যের কুলের প্রতি হস্ত প্রসারণ করেছিলে, কাজেই তোমার কূলে কলঙ্ক হবেই। প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া, প্রত্যেক নিঃশ্বাসের প্রশ্বাস, প্রত্যেক ধ্বনির প্রতিধ্বনি এবং প্রত্যেক দানের প্রতিদান আছে। অনুতাপ বৃথা! এ তোমার স্বকৃত কর্মফল।
শিবাজী লজ্জায় অধোবদন হইলেন। একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার ঠিক হইয়া বসিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “আফজাল খাঁকে কন্যা দান করলেই বা কি লাভ হবে? তিনি কি আমার পাবলম্বন করে বিজয়পুর দরবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?”
মালেকাঃ তা’ নহে। মুসলমান হয়ে তিনি কখনো বিশ্বাসঘাতকা করতে পারেন না। তিনি আদর্শ মুসলমান। তবে তোমার জায়গীর যা’তে বাজেয়াপ্ত না হয়, তার চেষ্টা করতে পারেন।
শিবাজীঃ আফজাল খাঁই আমার প্রধান শক্র। তাঁর মত দক্ষ সেনাপতি না থাকলে বিজয়পুর বাহিনীকে অনেক পূর্বেই পর্যুদস্ত করতে পারতাম!
মালেকাঃ আফজাল খাঁকে কন্যা দান করলে সন্ধি হতে পারে এবং তারার জীবনও রক্ষা পেতে পারে।
শিবাজীঃ দেখা যাক কোথাকার ঘটনা কোথায় যেয়ে দাঁড়ায়! তোমাকে আগামীকালই কৃষ্ণগড়ে পৌঁছিয়ে দিচ্ছি। মা! তুমি আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে না, এটাই আমার বিশেষ ভরসা।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
নৈশ-অন্ধকার দূর করিয়া ঊষার শুভ্র আলোক-রেখা পূর্ব-গগণে ফুটিয়া উঠিয়াছে। নানাজাতীয় বিহঙ্গরাজি সুমধুর কুজনে কাননরাজি মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বিহগকণ্ঠে নানা ছন্দে বিশ্ববিধাতার বন্দনাগীতি গীত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই আফজাল খাঁর শিবিরে ফজরের নামাজের সুধাবর্ষী আজান ধ্বনি ধ্বনিত হইল। যোদ্ধৃগণ শীঘ্র শীঘ্র অজু করিয়া উপাসায় মনোনিবেশ করিলেন।
উপাসনা শেষে মোসলেম শিবিরের প্রধান প্রহরী আসিয়া আফজাল খাঁকে নিবেদন করিলেন যে, শেরমর্দান খান এবং তাঁহার অনুচরগণ কেহই তাম্বুতে নাই। পরে প্রকাশ পাইল, তারাবাঈও তাম্বুতে নাই। তাহার জিনিসপত্র সমস্তই পড়িয়া রহিয়াছে। তখন চতুর্দিকে একটি মহা খোঁজ পড়িয়া গেল! নাই-নাই-নাই ত শেরমর্দান খানের দলের কোনও লোকই নাই! চারিদিকে সবাই খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।
শিবিরে মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। সুদ গুপ্তচরদিগকে চুতর্দিকে মারাঠী শিবিরে প্রেরণ করা হইল। ক্রমশঃ জানিতে পারা গেল যে, শেরমর্দান খানই তারাবাঈকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছে। শেরমর্দান খান এবং তাহার অনুচরগণ কেহই মুসলমান নহে, সকলেই মারাঠী।
তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া যাইবার জন্যই তাহারা মুসলমানের বেশে আসিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদল-ভুক্ত হইয়াছিল।
শেরমর্দান-স্বয়ং মালোজী। এই মালোজীর করেই শিবাজী তারাবাঈকে সমর্পণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। মালোজী তারার রূপ-মাধুরী দর্শনে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। তারাকে মুসলমান শিবির হইতে উদ্ধার করিবার আর কোনও পথ না পাইয়া অবশেষে মালোজী ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদলে ভর্তি হইয়াছিলেন।
ক্রমশঃ সেনাপতির নিকট কৃতিত্বের পরিচয় প্রদানপূর্বক বিশ্বাসভাজন হইয়াছিলেন। অবশেষে সেনাপতি ইহার দলভুক্ত লোকের উপরেই তারারা শিবির রক্ষার ভার সমর্পণ করিয়াছিলেন। সেই সুযোগে মালোজী ঔষধ প্রয়োগে তারাকে বেহুঁস করিয়া গভীর নিশীথে হরণ করিয়া লইবার সুবিধা পাইয়াছিলেন। মালোজীর চাতুরী এবং কৌশলে সকলেই ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন।
মারাঠীদিগের চাতুর্য এবং ধূর্ততা সম্বন্ধে এতদিন যাহারা অবিশ্বাসী ছিল, আজ তাহারাও মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা কীর্তন করিতে লাগিল। তারাবাঈয়ের অপহরণে আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমনায়মনা হইয়া পড়িলেন। মালেকা এবং তারার উদ্ধারের জন্য নানাবিধ পরামর্শ ও প্রচেষ্টা চলিতে লাগিল।
একাদশ পরিচ্ছেদ
গভীর রজনী। চতুর্দিক নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। পশ্চিমঘাট গিরিগহবরের একটা মনোহর কক্ষ বিশেষরূপে সজ্জিত। এই নির্জন রাজা অশোকের সময় শ্রমণদিগের নির্বাস জন্য নির্মিত হইয়াছিল।
গভীর নির্জনে বাস করিবার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত কৃত্রিম গুহা খোদিত করা হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে তিনি শক্রর অনুসরণ অব্যাহতি এবং যুদ্ধ হইতে বিশ্রাম লাভ করিবার জন্য এই নির্জন গিরিহুহার বাস এবং স্বকীয় ভোগলালসা পরিতৃপ্তি করিতেন।
এইখানেই ভীষণ হত্যা এবং লুণ্ঠনের গুপ্ত পরামর্শ হইত। গভীর বনরাজিপূর্ণ এই দুর্গম পর্বতের পাদমূলে ভীষণ অরণ্যের সম্মুখে একটি পরিখা খোদিত ছিল। লোকে তাহাকে পার্বত্য নদী বলিয়াই মনে করিত।
পরিখার উভয় পার্শ্বে উচ্চ গড়; তাহা নানাজাতীয় বৃলতা বিশেষতঃ বৃহৎ বৃহৎ শাল ও তালবৃক্ষে সমাচ্ছন্ন হইয়া স্বাভাবিক ক্ষুদ্র পর্বতের স্তুপ বলিয়া ভ্রম জন্মাইত! গড়ের উপরে নানা স্থানে বৃরাজির পাদমূলের অন্তরালে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তোপ সজ্জিত ছিল।
এতদ্ব্যতীত বনের নানা স্থানে অদৃশ্যভাবে তোপ সজ্জা ছিল। বনের মধ্যে মৃত্তিকার নীচে কয়েকটি পাতালপুরী বা গুপ্ত-কক্ষ ছিল। এই সমস্ত পাতাল-গৃহে নানাবিধ যুদ্ধের উপকরণ, লুণ্ঠিত সামগ্রী এবং ধন-ভান্ডার সংস্থাপিত ছিল। এই গোপনীয় গুহাবলীর একটি প্রশস্ত এবং অধিকতর রমণীয় গুহাতে ললনাকুল ললাম-ভূতা এক ষোড়শী রূপসী রূপের ছটায় কক্ষ আলোকিত করিয়া একখানি পালঙ্কোপরি অর্ধহেলিত অবস্থায় অবস্থিত!
রমণীর ঈষৎ কুঞ্চিত সুচিক্কণ ঈষন্নী লাভ কেশকলাপ ললাট এবং গন্ডে পতিত হওয়ায় তাহার মুখখানি শৈবালে ঈষদাচ্ছন্ন প্রভাত-প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় অথবা মেঘ-কিরীট-চন্দ্রমায় ন্যায় শোভা পাইতেছে। সে মুখের ও চক্ষুর ছটায় তেজস্বিতা, দৃঢ়তা এবং পবিত্রতার আভাই কেবল বিকীর্ণ হইতেছে।
গৃহস্থিত প্রদীপের আলোক, রমণীর বিশ্ববিমোহন রূপের ছটায় যেন মলিন বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। উন্নত বিশাল বক্ষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বাত্যাহতা স্ফীত বা তরঙ্গায়িত পদ্মার ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে উন্নত এবং অবনত হইতেছে।
রমণীর নেত্রকুবলয়ের প্রশান্ত এবং স্থির দৃষ্টি হইতে উন্নত চিন্তার ইঙ্গিতই সূচিত হইতেছে। রমণী যুবতী-প্রস্ফুটিত-যৌবনা এবং অসাধারণ সৌন্দর্যশালিনী হইলেও, তাঁহাকে দর্শন করিয়া কাম-গন্ধী প্রেমের উদ্রেক না হইয়া সশ্রদ্ধ ভালোবাসারই সঞ্চার হয়।
রমণী অলৌকিক সুন্দরী। তাহার মুখমন্ডলে তরুণ অরুণের অরুণিমা, নয়নে বর্ষণ-মুক্ত শারদাকাশের নীলিমা, গঠন-বৈচিত্র্যে কাফ-কৌশলের অপূর্ব মহিমা পরিদূশ্যমা! রমণী নির্বাতি সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় তরল সৌন্দর্যে ভরপুর হইয়াও অচঞ্চল!
সুতরাং, তাঁহাকে দর্শন করিলে আনন্দ এবং শ্রদ্ধারই উদ্রেক হয়। সে সৌন্দর্য-সে লাবণ্য কেবল কবিত্বময়, রসময় এবং আনন্দময়! তাহাতে স্বপ্নের আবেশ এবং মদিরার বিহবলতা নাই, তাহা স্পষ্ট, মুক্ত এবং ব্যক্ত; সুতরাং সহসা তাহাতে মনশ্চাঞ্চল্য ঘটে না।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এই গরীয়সী সুষমা-সম্পন্ন মহিমময়ী রমণী আমাদেরই সেই মালেকা আমেনাবানু। রমণী অর্ধশায়িতাবস্থায় বাম হস্ত বাম কপোলে রাখিয়া দক্ষিণ হস্তে “দেওয়ান হাফেজ” ধারণ করিয়া পড়িতেছিলেন।
এমন সময় শিবাজী তথায় আসিয়া একাকী উপস্থিত হইলেন। মালেকা আমেনা তখন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বসিলেন। শিবাজী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিকটবতী একখানি সোফাতে উপবেশন করিলেন। ক্ষণকাল নীরবে যাপন করিবার পরে বলিলেন, “মালেকা! মালেকা! আমার প্রাণের মালেকা! একবার তুমি আমার দিকে মুখ ফিরাও। একটিবার মাত্র কথা শুন। আমি তোমার জন্যই উন্মুত্ত হয়েছি। তোমার প্রেমামৃত পানের জন্যই মানস-চকোর চঞ্চল হয়েছে। কিছুতেই তোমাকে পরিণয় পাশে আবদ্ধ করতে স্বীকৃতা করতে না পেরে অবশেষে তোমাকে হরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
“তোমাকে বশীভূত করবার জন্যই অপহরণ করে এই নিভৃত নির্জন গিরিগুহায় নিয়ে এসেছি। তোমার প্রেমে প্রমত্ত হয়ে রাজ্য, ধন-সম্পদ নিসর্জন দিয়েছি। তোমাকে লাভ করতে না পারলে, জীবনের আর কোনও প্রয়োজন নাই।
“হে সুন্দরী! হে মানসি! নব-বসন্তের নব-বিকাশোন্মুখ অবস্থায় অভিমান-ভরে তোমার এই প্রেমদাসকে তুচ্ছ করে উভয়ের অকল্যাণ ও অমঙ্গল আনয়ন করো না। বসন্ত এসেছে, তবে সৌরভ-সুধা বিতরণে বিলম্ব কেন?
“হ মানিনী! শিবাজী দস্যু হলেও রাজা, মারাঠী হ’লেও বীর-পুরুষ, কাফের হলেও প্রেমিক এবং মূর্খ হলেও কৃতজ্ঞ। সুতরাং একেবারে তোমার অযোগ্য নহে। তোমার প্রেম-প্রবাহের রসসিক্ত হ’লে, শিবাজী ভারত-সিংহাসনে সমারূঢ় হ’বারও কল্পনা করে।
“হে বীর্যবতী! তোমার বীরত্ব এবং সাহস সহায় হ’লে, এ বাহু আরও বলশালী হবে, এ মস্তিস্কে আরও উচ্চ উচ্চ রাজনৈতিক চিন্তা-স্রোত প্রবাহিত হবে। তাই বলি, মালেকা! তুমি আমার হৃদয়রাজ্যের মালেকা হ’য়ে মালেকা নামের সার্থকতা সম্পাদন কর। নিশ্চয় জানিও, তোমার প্রেমে হতাশ করলে এ জীবন-তরু অকালে শুঙ্ক হবে। এস মালেকা! এস, আমার বক্ষে এস। নতুবা এই বক্ষে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করে এ বিদগ্ধ জীবনের অভিনয় শেষ কর।
“ক্রমাগত আজ দু’মাস কাল তোমার সাধনা করে মন বড়ই চঞ্চল এবং বিধুর হয়েছে, আর ধৈর্যধারণ অসম্ভব। মনের স্থৈর্য ক্রমশঃ নষ্ট হচ্ছে। এস তুমি! এস, আমার মরুভূমিতুল্য দগ্ধবক্ষে তুমি মিত্রাপ-জ্বালা-নিবারণী মন্দাকিনীর ধারার ন্যায় প্রবাহিত হও।
“এস মালেকা! এস, তা’তে কোন কলঙ্ক নেই। আমি তোমাকে কলঙ্কিনী করব না। আমি তোমাকে রাজ-আড়ম্বরে যথারীতি বিবাহ করব। ভগবান রামদাস স্বামী আমার অনুকূলে। বাহুবল, অর্থবল, বুদ্ধিবল সমস্তই আমার পদতলে।
“মালেকা! একবার তুমি সম্মতি প্রকাশ কর। আজ দীর্ঘ দু’টি মাস ধরে তোমার সাধনা করছি! তোমার রূপবহিৃতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মবিসর্জন করতে বসেছি। হায়! তবুও কি তুমি পাষাণী হয়ে থাকবে? মালেকা! আজ সাধনার শেষ দিন!
“আজ যেমন করেই হউক মনের বাসনা পূর্ণ করব। আজ আর তোমার সম্মতি-অসম্মতির অপো করতে পারি না। এস রূপসি! এস, এস, বক্ষে এস!”
এইরূপ উন্মত্ত প্রলাপ বকিতে বকিতে শিবাজী দুই বাহু প্রসার করিয়া মালেকাকে সহসা আবেষ্টন করিয়া অধর-চুম্বনে উদ্যতপ্রায়। রোষেন্মত্তা মালেকা আমেনাবানু সহসা ক্রুদ্ধা ব্যাঘ্রীর ন্যায় ভীষণ বলে উত্থিত হইয়া শিবাজীকে দূরে ঝটকাইয়া ফেলিলেন। দেওয়ালে আহত হইয়া শিবাজী কতলে ঘূর্ণিত হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন, উঠিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু শক্তিশালীনী মালেকা সহসা ভীমবলে পদতলে শিবাজীকে চাপিয়া ধরিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে শাণিত ছুরিকা বক্ষ-লক্ষে উদ্যত করিয়া বলিলেন, “বল দুরাত্মন। বল জাহান্নামী কাফের! বল কাম-কুক্কুর! পাষন্ড শয়তান। আর কখনও নারী হরণ করবি? পাষন্ড, আজ হ’তে তোর জীবনের পাপভিনয়ের শেষ করব।”
মালেকা ভীষণ ক্রুদ্ধ মূর্তিতে ক্রকুটি-কুটিল আঁখিতে বিকীরণ করিয়া এবং ক্রোধাবেগে কম্পিত হইতে হইতে ভীষণ গর্জন করিয়া শিবাজীকে পদতলে আরও ভীষণভাবে চাপিয়া ধরিলেন। ছুরিকার শাণিত মৃত্যুর করালী জিহবার ন্যায় শিবাজীর চক্ষে প্রতিভাত হইল!
শিবাজী ভীতি-বিহবলচিত্তে রূদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “মালেকা! আমায় মাফ কর। আর না, যথেষ্ট হয়েছে। দোহাই তোমার, প্রাণবধ করো না! আর কখনও পরনারী হরণ করব না! আর কখনও তোমার প্রতি লালসার দৃষ্টিপাত করব না। আজ হ’তে বুঝলাম, মুসলমান রমণী সতী। সতীত্বের এবং ধর্মের সন্মান মুসলমান রমণীর মত আর কোনও জাতীয়রা রমণীর কাছে আদৃত এবং রতি নহে।”
মালেকার তর্জন-গর্জনে এবং শিবাজীর করুণ প্রার্থনায় সমস্ত গিরিগুহা শব্দায়মান হইয়া উঠায়, ভিতরের প্রহরী এবং দাস-দাসীগণ ব্যস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল। তাহার আসিয়া দেখিল যে, মালেকা আমেনাবানু ভীষণ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ভ্রুকুটি-কুটিল নেত্রে শিবাজীকে পদতলে চাপিয়া দন্ডায়মান! একজন দাসী আনন্দ-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ঠিক হয়েছে, মা! এ যে, উগ্রচন্ডী কালী করালী মূর্তি! পদতলে কাম-কুক্কুর শিবাজী! আজ নরাধমের উপযুক্ত প্রতিশোধ হয়েছে। কি বলব, মা! এই নরাধম কাম-কুক্কুরই আমাকে পাপ-লালসায় ভাসিয়ে স্বকীয় ঘৃণিত পাপ-লিপ্সা চরিতার্থ করেছে। আমি এক্ষণে পুরাতন হয়েছি। তাই নূতন রস ভোগের জন্য নবীনা তোমাকে হরণ করে এনেছে। বেশ হয়েছে, মা! পাষন্ডের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ কর!”
এই বলিয়া দাসী আনন্দে করতালি দিয়া অট্র হাস্যে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। মালেকা ভীষণ গর্জনে, দন্তে দন্ত সংঘর্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, “বল নরাধম কুক্কুর! আর কখনও পরনারীর প্রতি কুভাব পোষণ করবি কি-না?” এই বলিয়া মালেকা আমেনাবানু ছুরিকাখানি বক্ষের দিকে আরও বিনত করিলেন।
শিবাজী ভীত এবং আর্তকণ্ঠে বলিলেনঃ “মালেকা! মালেকা! রক্ষা কর! দোহাই তোমার! আজ হইতে তুমি আমার মাতা! তোমার মাতৃ সম্বোধন করছি। রক্ষা কর, মা! সত্যই তুমি দানবদলনী পাপ-তাপ-নাশিনী দুর্গা। এতদ্ব্যতীত নারীতে কখনও এমন তেজঃ ও সাহসের সঞ্চার সম্ভব নহে।
“মা কর, মা! আমায় মা কর! আজ হ’তে তোমাকে পরম পূজনীয়া জননী বলেই পূজা করব। ধন্য সতী! তুমি শত ধন্য! তোমায় ও পবিত্র পদাঘাতেই কাম-বিকারের নেশা আজ হতে ছুটে গেল। কিন্তু মা! এই পাপী সন্তানের বক্ষ হতে পাদপদ্ম অপসারিত কর, মা! আমার শ্বাস রুদ্ধ হয় আসছে!”
প্রহরী ও দাসদাসীগণ মালেকাবানুর ভীষণ প্রলয়ঙ্কারী মূর্তি সন্দর্শনে সকলেই স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিল। এতক্ষণে তাহাদের মোহ ভঙ্গ হওয়ায় সকলেই “একি কান্ড, মা! ছাড় ছাড়! মহারাজার প্রাণ বধ করে না”-বলিয়া সমস্বরে করুণ চীৎকার করিয়া উঠিল।
মালেকা বক্ষ হইতে দণি পদ তুলিয়া লইয়া একটু দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া আলুলায়িতকেশা মালেকা আমেনাবানুর পাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া যুক্ত করে বলিলেন, “মা! অধম সন্তানের অপরাধ মার্জনা কর। তোমার পূত পদস্পর্শে আমার দিব্যজ্ঞানের উদয় হয়েছে। আমি মহাপাতকী সন্তান, তুমি পুণ্যবতী সাক্ষাৎ জগন্মতা ভবানী। আমার অপরাধ লইও না। আমার ধর্ম-বুদ্ধি সঞ্চারের জন্যই তুমি ও মায়া-প্রপঞ্চ বিস্তার করেছ।” সকলেই দেখিল, শিবাজীর চক্ষু অশ্রুপ্লুত। সত্যই তাঁহার প্রাণে তীব্র অনুতাপের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে।
গভীর অন্ধকার ভেদ করিয়া বিশ্বপ্রহলাদিনী ঊষার মৃদু হাস্য যেমন বিশ্ববক্ষে নবজীবনের সঞ্চার করে, তেমনি অদ্যকার এই ভীষণ পাপলিপ্সা এবং কামাসক্তির সূচীভেদ্য অন্ধ তসমা ভেদ করিয়া দিব্যজ্ঞানের কিরণ শিবাজীর কলুষিত অন্তঃকরণে পদ্মের নির্মল সৌন্দর্য এবং বিমল সৌরভ ফুটাইয়া তুলিল। অকস্মাৎ যেন মেঘরাশি বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রমার বিমল জ্যোতিঃ গগনবক্ষে ফুটিয়া উঠিল!
0 comments: