দশম পরিচ্ছেদ
বিজাপুরের সোলতানের পক্ষ হইতে পঞ্চদশ সহস্র, পদাতিক, দুই সহস্র অশ্বারোহী, সাতশত গোলন্দাজ সৈন্য কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইয়াছে। শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংস ব্যবহারের সংবাদ শ্রবণে ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হইয়া বিজাপুর দরবার শিবাজীকে সমস্ত দস্যু-সৈন্যসহ ধ্বংস করিতে এই সৈন্যদল প্রেরণ করেন।
আফজাল খাঁ কৃষ্ণগড়ে রাজকীয় বাহিনীর আগমন আশায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। যথাসময়ে এই নূতন বাহিনী কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইলে, মহাবীর আফজাল খাঁ শিবাজীর সহিত যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীর প্রতি নিতান্ত রুষ্ট এবং বিরক্ত হইয়া মালেকা আমেনা বানুও ইসলামের মহাশক্র শিবাজীর ধ্বংস সাধন মানসে মহাবীর আফজাল খাঁর সহিত যোগদান করিলেন।
ক্রমাগত যুদ্ধ চলিতে লাগিল। শিবাজী সন্মুখ-সমরে অক্ষম হইয়া ক্রমাগত পশ্চাদবর্তন করিতে করিতে সহ্যাদ্রি পর্বতের দুর্গম অরণ্য এবং গিরিগহবর পরিপূর্ণ স্থানে যাইয়া আশ্রয় লইলেন। হঠাৎ আক্রমণ, গুপ্ত আক্রমণ এবং নৈশ আক্রমণ এই তিন আক্রমণ দ্বারা মধ্যে মধ্যে মোসলেম বাহিনীকে বিপদাপন্ন এবং চঞ্চল করিতে লাগিলেন। মোসলেম সৈন্য তাহার দস্যুসৈন্যের অনুসরণ করিলে তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া নিবিড় অরণ্যানী এবং পর্বতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ফেরুপালের ন্যায় লুক্কায়িত হইয়া পড়িত। ফলতঃ শিবাজীর মাওয়ালী দস্যুগণ পলায়নে এবং হঠাৎ আক্রমণে যার-পর-নাই অভ্যস্ত হইয়াছিল!
তাহাদের পলায়ন এবং আক্রমণ বস্ততঃই শৃগালের ন্যায় দ্রুত এবং কৌশলপূর্ণ ছিল। ফলতঃ শিবাজীর নামের অর্থ তাঁহার কার্যের সঙ্গে বেশ সার্থক হইয়াছিল। তখনকার দিনে “শিবাজী দরহকিকত শিবাজী আস্ত।” অর্থাৎ শিবাজী কার্যতঃ যথার্থ “শৃগাল,” একথা দাক্ষিণাত্যের সর্বত্রই প্রবাদবাক্যের ন্যায় প্রচলিত হইয়াছিল।
শিবাজীর ধূর্ততা, ছলনা এবং মিথ্যাবাদিতার কিছু ইয়ত্তা ছিল না। স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের আকাঙা তাঁহাকে এমনি অধীর ও আকুল করিয়া তুলিয়াছিল যে, তিনি তাঁহার অভীষ্ট সাধন মানসে কোনও প্রকার পাপ ও অন্যায়কে বিন্দুমাত্রও পরওয়া করিতেন না।
খুন, জখম, চৌর্য, প্রবঞ্চনা তাঁহার জীবনের নিত্য কর্তব্যকর্ম মধ্যে পরিগণিত ছিল। এহেন ধূর্ত শিবাজীর সহিত পুনঃ পুনঃ সন্মুখ-সমরে চেষ্টা করিয়াও আফজাল খাঁ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তরঙ্গায়িত উচ্চাবাস ভূমি, নিবিড় অরণ্য, পর্বতের অসংখ্য গুহা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্বত্য-নদীর গর্ভ ও উচ্চপাড়ের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া শিবাজী মধ্যে মধ্যে ‘রাতহানা’ দিয়া বিজাপুরের সুশিতি বাহিনীকে যার-পর-নাই ত্যক্ত-বিরক্ত করিতে লাগিলেন।
পার্বত্য প্রদেশে দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করা বহু বিলম্ব এবং ক্ষতি সাপেক্ষ দেখিয়া, বীরাঙ্গনা মালেকা আমেনা বানু শিবাজীর জন্মভূমি রায়গড় আক্রমণ করাই ন্যায়সঙ্গত মনে করিলেন। রায়গড় আক্রমণ করিলে, শিবাজী বাধ্য হইয়া সন্মুখ-যুদ্ধ দান করিতে বাধ্য হইবেন বলিয়া, মালেকা আমেনা বানু আফজাল খাঁকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন।
কিন্তু আফজাল খাঁ এই পার্বত্য প্রদেশেই শিবাজীকে হীনবল এবং ধৃত করিবার জন্য নানা প্রকার কায়দা-কৌশল এবং ফন্দী খাটাইতে লাগিলেন। মাওয়ালী ও মারাঠী দস্যুগণ ছদ্মবেশ ধারণ এবং চৌর্যকার্যেও বিলক্ষণ পটু ছিল। রাত্রিতে তাহারা নানা প্রকার পশু, বিশেষতঃ গরু-ঘোড়ার কৃত্রিম বেশে আসিয়া মুসলমান শিবিরের খোঁজ-খবর লইয়া যাইত। পার্বত্য রমণীদিগের রূপ ধারণ করিয়া দিবসে তাহারা নানা প্রকার ফলমূল এবং তরিতরকারীও বিক্রয় করিতে আসিত।
মধ্যে মধ্যে সন্দেহবশে কয়েকজনকে ধৃত করায়, তাহার মারাঠী গুপ্তচর বলিয়া প্রকাশ পাওয়ায় পাহারা আরও কড়াকড়ি করা হইল। মালেকা আমেনা বানু বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাকে এবং শিবাজী-নন্দিনী তারাবাঈকে কোনও রূপে বন্দী বা নিদ্রিতাবস্থায় চুরি করিয়া লইবার জন্য শিবাজীর দলপতিগণ বিশেষ তদবির করিতেছেন।
মালেকা এবং তারাবাঈ সাবধানতার জন্য অস্ত্র-পাণি হইয়া শয়ন করিতেন। মারাঠীরা যে-কোনওরূপে এই সুন্দরীদ্বয়ের কাহাকেও অপহরণ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও চিন্তা করিলেন না। মোতামদ খান স্বয়ং রাত্রিতে মালেকা এবং তাঁহার শিবিরের প্রহরীদিগের সতর্কতার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিলেন।
কিন্তু মানুষ যখন যে-বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধান হয়, অনেক সময় যেমন তাহাতেই অসম্ভাবিতরূপে বিপদ ঘটিয়া থাকে; তেমনি এই সাবধানতার মধ্যেও গুরুতর বিপদ সংঘটিত হইল।
সহসা এক দিন প্রভাতে দেখা গেল যে মালেকার শিবিরে মালেকা নাই। তাঁহার শিবিরের মধ্যে একটি গর্ত রহিয়াছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, তাহা গর্ত নহে সুড়ঙ্গ। অশ্রু বক্র পথে পনর শত হস্ত পরিমিত সুড়ঙ্গ কাটিয়া মালেকাকে গভীর নিশীথে নিদ্রিয়বস্থায় বেহুঁশ করিয়া অপহরণ করিয়াছে।
অতঃপর সেই সুড়ঙ্গ পথে নামিয়া ধীরে ধীরে সকলে এক বনের মধ্যদেশে একখন্ড পরিস্কৃত ভূমি দেখিতে পাইলেন। সেখানে কিছু পূর্বেও লোক ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা গেল। সুড়ঙ্গের মাটিগুলি একস্থানে রাশীকৃত না করিয়া ক্রমশঃ নদীর জলে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
সুড়ঙ্গের মুখে একটি লতাগুল্মের ঝোপ রহিয়াছে। এমন কৌশলপূর্ণ স্থান যে, দেখিয়াও সহসা কেহ কিছু নির্ধারণ করিতে পারে না।
মালেকা আমেনা বানুকে যে মারাঠীরা অচিন্ত্যভাবে সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিয়া অপহরণ করিয়া লইয়াছে, সে-বিষয়ে কাহারও আর কোনও সন্দেহ রহিল না। মালেকার জন্য মোসলেম শিবিরে ভীষণ হাহাকার পড়িয়া গেল! আফজাল খাঁ যার-পর-নাই শোকার্ত হইয়া পড়িলেন। সৈন্য-সামন্ত সকলেই বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইল!
তারাবাঈ তাঁহার আশ্রয়দাত্রী এবং পরম হিতৈষিণী মালেকার অপহরণে যার-পর-নাই ক্ষুণ্নমনা এবং বিষাদের বিমলিন হইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
আমেনা বানুর মাতা শোকে পাগলিনী হইয়া উঠিলেন। পাছে বা ধর্মাধর্ম জ্ঞানশূন্য পাষন্ড কাফেরগণ এই মোসলেম সুন্দরীকে কলঙ্কিত অথবা নিহত করে, ইহা ভাবিয়া সকলেই পেরেশান ও লবেজান হইয়া উঠিলেন।
দরী-গিরি, বন-জঙ্গল, নদ-নালা, সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা হইল। মারাঠীদিগকে ভীষণভাবে যত্র তত্র আক্রমণ করিয়া বিপর্যস্ত ও বিধ্বত করতঃ বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হইল! কিন্তু কোথায়ও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
অনেক মারাঠীকে বন্দী করিয়া বিশেষ প্রলোভন এবং প্রাণদণ্ডের ভয় দেখাইয়াও তাহাদের নিকট হইতে কোনও তত্ত্ব পাওয়া গেল না। চতুর্দিকে বহু গুপ্তচর প্রেরণ করিয়াও কোনও সূত্র আবিস্কার করা গেল না। সকলেই যার-পর-নাই নিমর্ষ ও শোকাকুল চিত্তে দিন-যাপন করিতে লাগিলেন।
মহাবীর আফজাল খাঁ এবং বীরবর মোতামদ খান নানা প্রকার নূতন নূতন পন্থা এবং কৌশল অবলম্বন করিয়া মালেকার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শিবাজীকে বন্দী করিতে পারিলে, সমস্ত উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হইবে বুঝিয়া, শিবাজীকে বন্দী করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগলেন।
কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেল যে, শিবাজী তখন আবহক্ষেত্রে উপস্থিত নাই। সেনাপতি আবাজী তখন শিবাজীর প্রতিনিধি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিতেছেন। অতঃপর শিবাজীর অবস্থান নিরূপণের জন্য বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল।
নবম পরিচ্ছেদ
একটি মনোহর ও প্রশস্ত কক্ষ মধ্যে একটি অনতিউচ্চ পর্যাঙ্কে মহাবীর আফজাল খাঁ শায়িত রহিয়াছেন। একজন হাকিম, দুইজন দাসী এবং স্বয়ং তারাবাঈ প্রাণপণে তাঁহার সেবা শুশ্রূষায় পরিলিপ্ত রহিয়াছেন। গৃহের ছাদের দোদুল্যমান শতবাহুবিশিষ্ট ঝাড় প্রোজ্জ্বলিত হইয়া উজ্জ্বল আলোকে গৃহতল আলোকিত করিয়াছে। ক্রমে রাত্রি বেশি হইলে, হাকিম সাহেব চলিয়া গেলেন। দাসী দুইটিও কান্তরে যাইয়া শয়ন করিল। তখন তারাবাঈ সময় পাইয়া ধীরে ধীরে আফজাল খাঁর ললাটে ও মস্তকে হস্ত বুলাইতে লাগিল। দুইজন দুইজনকে দর্শন করিয়া গভীর প্রেমাবেশে অভিভূত হইতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ দেখিলেন, তারা অসাধারণ সুন্দরী। তাহার প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, উন্নত নাশিকা, আরক্তিম গন্ড, শঙ্খবিনিন্দিত কণ্ঠ সমস্তই চিত্তাবর্ষক এবং মনোহর। তাহার টানাটানি বাঁকা ভুরু আর তাহার নিন্মে সেই ডাগর ও উজ্জ্বল চক্ষুর লাস্যময় বিদ্যুৎ-কটাক্ষে মুনির মনও বিচলিত হইয়া যায়। সুন্দরীর যৌবন-কুসুম মনোহর ভঙ্গিতে বক্ষ-সাগরের বিকাশোন্মুখ সঞ্চার করে। সুন্দরীর বাহু, অধরোষ্ঠ, তালু, অংস, বক্ষ সমস্তই সুবিভক্ত এবং সুবিন্যস্ত। আফজাল খাঁ তারাবাঈ-এই সৌন্দর্য দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেলেন। কৃষ্ণবর্ণ মারাঠীর ঘরে ইরান-তুরানের এই অপরূপ সৌন্দর্য কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল! বস্তুতঃ, তারাবাঈ-এর বেশ পরিবর্তন করিয়া, কোনও শাহজাদীর পোশাকে তাহাকে সজ্জিত করিলে কেহই তাহাকে মারাঠী-সুন্দরী বলিয়া অনুধাবন করিতে পারিবে না। আফজাল খাঁ তারাকে যতই দেখিতে লাগিলেন, ততই মুগ্ধ হইতে লাগিলেন। তারার গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও কমনীয় হস্তখানি নিজ হস্তে ধীরে ধীরে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “তারা! তোমার ঋণ শোধ করা সুকঠিন। তোমার সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রেমেই আমার জীবন রক্ষা হয়েছে। তুমি যদি সেদিন সৈনিকের ছদ্মবেশে সাবধানতাসূচক পত্রখানি না দিতে, তা’ হলে আমি দেহরক্ষী সৈন্যসহ ঘোড়াডুবি-গর্তে পড়ে প্রাণ হারাতাম। তোমার পিতা যে এরূপ নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্র করবেন, তা’ আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল।
“এমন কঠিন পিতার ঔরসে জন্মিলেও তোমার অন্তঃকরণ অতি পবিত্র ও মহৎ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তুমি কেমন করে তোমার পিতার এই গভীর ষড়যন্ত্রের বিষয় অবগত হয়েছিলে? আর কি কৌশলেই বা তুমি রায়গড় পরিত্যাগ করে সেই নিবিড় বনরাজিপূর্ণ দুর্গম স্থানের সন্ধান পেলে?
তারাবাঈ ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেনাপতি! আপনাকে দর্শন করবার পর ত’তেই আমার প্রাণে ধীরে ধীরে আসক্তির তীব্র অনল প্রোজ্জ্বলিত হয়। তারপর আমাকে উন্মত্ত হস্তীর পদতল হ’তে ক্ষিপ্রতা এবং বীরত্ব ও কৌশলের সহিত রক্ষা করায়, আমি আপনার চরণেই আত্ম বিকিয়ে বসি। আমি সেই গভীর রজনীতে বিমনায়মান চিত্তে উদ্যানবাটিকায় বেড়াতে বেড়াতে উদ্যানমধ্যস্থ গৃহের নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারলাম যে, গভীর নিশীথে সেই গৃহের দ্বার রুদ্ধ করে আমার পিতা, গুরু রামদাস স্বামী, মালোজী প্রমুখ কি যেন পরামর্শ করছেন।
“অতঃপর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেই গৃহের অবরুদ্ধ জানালা সংলগ্ন হয়ে এই ভীষণ ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথাই শুনতে পেলাম। শিকারে যাবার কথা এবং শিকারে লয়ে লয়ে যেয়ে কৃষ্ণগড়ের নিকটবর্তী গিরিসঙ্কটে ঘোড়াডুবি-গর্তের মধ্যে কৌশলে নিক্ষেপপূর্বক প্রাণবধ করবার সমস্ত কথা শ্রবণ করে আমি যার-পর-নাই আকুল ও অস্থির হয়ে উঠি।
“কি করব, কোন উপায়ে আপনাকে রক্ষা করব, একান্ত মনে কেবল তাই অবিরাম কয়েকদিন পর্যন্ত চিন্তা করি। অবশেষে মনে করলাম, গোপনে কোনও রূপে দেখা করে বা পত্র দিয়ে আপনাকে সাবধান করে দিব। এইরূপ চিন্তায় একান্ত উন্মনা হয়ে আমার ধাত্রীমাতাকে সমস্ত কথা খুলে বলে তাঁর চরণ ধারণ করলাম। তিনি আমাকে নিবৃত্ত হবার জন্য অনেক বুঝালাম; কিন্তু তাতে আমি আরও অধীর ও ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। আপনার অহিত বা অনিষ্ট হলে আমি যে গলায় ছুরি নিব, তা’ তাঁকে বিশেষ দৃঢ়তার সহিত বললাম। তিনি গোপনে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করে আপনাকে সাবধান করে দিবেন বলে যে-দিন স্বীকার করলেন, দুঃখের বিষয় যে সেই দিনই আপনি পিতার সহিত সহসা শিকারে বহির্গত হয় পড়লেন।
“আপনার মৃগয়ায় গমনের পরে আমি ধাত্রীমাতার সাহায্যে আপনার উদ্দেশে জনৈক ভৃত্যকে আমার বহুমূল্য হার প্রদানের অঙ্গীকারে সঙ্গে লয়ে গভীর নিশীথের অন্ধকারে অশ্বারোহণে কৃষ্ণগড়াভিমুখে যাত্রা করি। অনুমানের উপর নির্ভর করে আমার সেই প্রাচীন ভৃত্যটি ইঙ্গিতে একটি পার্বত্য পথ দিয়ে আপনার নিকট উপস্থিত হই। পাছে কেউ ধরে ফেলে, এই ভয়েই চকিতে বিদ্যুৎ-গতিতে পত্র দিয়েই পলায়ন করি এবং অবিলম্বে কৃষ্ণগড়ের রানী মালেকা আমিনা বানুর নিকটে উপস্থিত হই। তিনি যখন আমাদের বাটী গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সহিত আমার গভীর প্রণয়ের সঞ্চার হয়। তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে আপনার পথের বিপদ এবং গুপ্ত সৈন্যের অবস্থানের কথা নিবেদন করে, আপনাকে রক্ষা করবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করি।
“সেই সূত্রে তিনি একশত তেজস্বী ও বিক্রান্ত অশ্বারোহী পাঠান সৈন্য লয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরমেশ্বরকে অনন্ত ধন্যবাদ যে, এই হতভাগিনীর চেষ্টা ও উদ্যম, আপনার জীবন রক্ষায় কতকটা সফল হয়েছে। আর কিছু পূর্বে মালেকার সৈন্যদল, ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলে, আপনি এরূপ গুরুতরভাবে জখম হতেন না। যা’ হোক, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এবং হাকিম সাহেবের চেষ্টায় আঘাত প্রায় আরোগ্য হয়ে এসেছে। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আপনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন।”
আফজাল খাঁ বলিলেন, “বিশ্বস্রষ্টার কৌশল ও মহিমা অপরিসীম! যিনি তোমার পিতার অন্তঃকরণে ভীষণ কুটিলতা ও হিংসার বিষ প্রদান করেছেন, সেই তিনিই আবার তোমার অন্তঃকরণ কোমলতা এবং প্রেমের সুধায় পরিপূর্ণ করেছেন! যিনি পাষাণকে কঠিন ও নীরস করে সৃষ্ট করেছেন, সেই তিনিই পাষাণের বক্ষ ভেদ করে তরল নির্মল জলের ধারা প্রবাহিত করেছেন।
“একই বৃন্তে একই উপাদানে তিনি কুসুম ও কণ্টক সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রহস্য, তাঁর মহিমা সকল। বিচিত্র ও কৌশলময়! তিনি কোমল কুসুমের কঠিন ফলের জন্ম দেন। আবার কঠিন ফলের মধ্যেই সুমিষ্ট রস ও সুশীতল স্নিগ্ধ বারি রক্ষা করেন। অনন্ত তাঁর মহিমা! অপরিসীম তাঁর কুদরত! তাঁকে ধন্যবাদ দাও।
“যিনি তোমার হৃদয়ে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন, যিনি তোমাকে কল্যাণের পথে পরিচালিত এবং তোমার প্রেমতৃষ্ণাকে তৃপ্তি দান করুন, এই প্রার্থনা করি।”
তারাবাঈ বলিলেন, “সেনাপতে! হৃদয়ের আকুল উন্মাদনায় তোমার জন্য গৃহত্যাগ করে আজ অরণ্যে চলে এসেছি। এখন তোমার পূজায় মন্দিরে যদি স্থান দাও, তোমার পূজায় লাগব, আর যদি স্থান না পাই, তবে অকালে জীবনকুসুম শুঙ্ক হয়ে ঝড়ে পড়বে! যেদিন হ’তে তোমাকে দেখেছি, সেইদিন হতেই সব ভুলে তোমাকে মজেছি। সেইদিন হতে তোমার চরণকমলের ধ্যান ব্যতীত দেবাদিদের মহেশ্বর শিবের ধ্যান আর করতে পারি নাই। মহেশ্বরকে যে ফুল ও বিল্বপত্র যুগিয়েছি, তা’ তোমার চরণেদ্দ্যেশেই যুগিয়েছে। সেইদিন হতে তোমার মোহনমূর্তি আমি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে এক মুহূর্তের জন্যও নিস্মৃত হতে পারি নাই।
“মনকে যত বুঝাতে লাগলাম, মত ততই অবুঝ হয়ে উঠতে লাগল; যতই ধৈর্যধারণ করতে চেষ্টা করলাম ততই অধীর ও উন্মত্ত হয়ে উঠল! চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তোমার হৃদয় তেমনি আমাকে আকর্ষণ করেছে! এ আকর্ষণে এ সন্মিলনে বাধা দিবার শক্তি কা’রও নাই!
“তুমি বিজাপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। তুমি একজন মস্ত বীর পুরুষ! তোমার সস্মুখে যশঃসন্ধান ও উচ্চপদ নিয়তই তোমাকে প্রলুব্ধ করছে! তুমি আমার জীবন-বসন্তের মলয়ানিল, হৃদয়-আকাশের চূর্ণ চন্দ্রমা এবং ঊষার আকাশে শুকতারা হলেও, আমি তোমার সম্পূর্ণ অযোগ্য। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র নদী আজ তোমার উদ্দেশে-তোমার প্রেম-পরিপূর্ণ হৃদয়-পারাবার পানেই ছুটে চলেছে।
“তার গতি অবাধ! সে আজ আত্মহারা অবশভাবে ছুটে চলেছে। তার পরিণামে কি হবে, তদ্বিষয়ে সে কিছুমাত্র চিন্তা না করেই তোমাতেই আত্ম বিকিয়ে বসেছে! হে প্রাণেশ্বর! হে স্বামিন! হে আমার জীবন-প্রভাতের হোমন ঊষা! হে জীবনবারিধির কৌস্তভ রতন! এখন তোমার আদর-অনাদরেই এ হতভাগিনীর জীবন-মরণ নির্ভর করে।”
শিবাজী-নন্দিনী আর কিছু বলিতে পারিলেন না। উচ্ছ্বসিত প্রেমাবেগে সন্দেহ এবং আশঙ্কায় তাহার পদ্মপলাশলোচন হইতে তরল মুক্তাধারা নির্গত হইতে লাগিল।
হে রমণী অনিশ্চিত প্রেমের আশায় চিত্তের উন্মাদনায় পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনের স্নেহের বন্ধন খন্ডন করিয়া তাহার প্রেমাস্পদের সেবায় উপস্থিত হইয়া পিপাসা পরিতৃপ্তি করিতে পারিতেছে না, তাহার প্রেমাস্পদের নিকটে নিজের অবস্থার বিবরণ খুলিয়া বলিতে যাইয়া শোকাবেগে ক্রন্দন করা নিতান্তই স্বাভাবিক।
আফজাল খাঁ সুন্দরীর প্রেমোচ্ছ্বাস এবং হৃদয়ের অবাক হইয়া গেলেন। মনের ভিতর দ্রবীভূত হইয়া নিতান্ত চাঞ্চল্য অভিভূত এবং প্রেমের ধারায় অভিসিক্ত হইলেন। অন্তরে বাহিরে তখন মহাবীর আফজাল খাঁর তুমুল ঝটিকা প্রবাহিত হইল। প্রাণের পরতে পরতে অনন্ত পুলক শিহরিয়া উঠিতে লাগিল! নব বসন্তের মলয়া হাওয়ার প্রথম চুম্বনে শীত-সঙ্কুচিত কুসুমকলিকাগুলি যেমন শিহরিয়া উঠিয়া ফুটিয়া উঠে, আফজাল খাঁর হৃদয়-মালঞ্চ তেমনি শিহরিয়া উঠিয়া প্রেমের পুস্পে ভরিয়া গেল।
অনন্ত প্রেমের কুসুম-সুষমার মোহিনী আভা, সন্ধাকাশে স্বর্ণমেঘের ন্যায় হৃদয় জুড়িয়া বসিল। হৃদয়ে হৃদয়ে আভা ফুটিল। মরমে মরমে বাণ ছুটিল। তখন আগ্রহ ও ব্যগ্রতায় হৃদয়-কুঞ্জে প্রেমের কোকিল পাপিয়া অবিরাম কুজনে ডাকিতে লাগিল।
আফজাল খাঁ প্রেমাবেশে সেই নির্জন দীপালোক-আলোকিত-কক্ষে শিবাজী-নন্দিনীকে বুকের ভিতরে টানিয়া লইয়া তাহার গোলাপী গন্ডে কয়েকটি চুম্বন দান করিলেন। প্রদীপ-শিখা একটু কাঁপিয়া উঠিল! যুবতীর হৃদয় লজ্জা ও প্রেমে সঙ্কুচিত অথচ সহর্ষ হইয়া উঠিল।
উভয়েই ক্ষণকাল নীরব। উভয়ের বক্ষের স্পন্দন দ্রুত চলিতে লাগিল। উভয়ে উভয়ের গভীর প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। মারাঠা রাজকুমারীর নেত্র-কুবলয় হইতে প্রেমের মুক্তধারা বর্ষিত হইয়া পাঠানবীরের বক্ষস্থল বিপ্লাবিত করিতে লাগিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
আফজাল খাঁর আদেশ মাত্রই কতিপয় সৈন্য দুইটি গুরুভার প্রস্তর গড়াইয়া কিয়দ্দূর লইয়া যাইতেই সহসা এক খন্ড প্রস্তর শ্যামল দুর্বাযুক্ত মৃত্তিকা ভেদ করিয়া ভীষণ শব্দে নিন্মে পতিত হইল। এই ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়া সকলেই শিহরিয়া উঠিল। আফজাল খাঁর সর্বনাশ সাধনের জন্যই যে, এই ভীষণ ষড়যন্ত্র করা হইয়াছে, তাই বুঝিতে কাহার ও আর বাকি থাকিল না। এই ভীষণ ষড়যন্ত্র লাইয়া বিশেষ আলোচনা হইবার পূর্বেই শিবাজী সহসা এক বংশীধ্বনি করিলেন। সেই বংশীধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই বহুসংখ্যক লুক্কায়িত মাওয়ালী সৈন্য, প্রতি প্রস্তর খন্ড, প্রতিবৃক্ষ ও প্রতি ঝোপের আড়াল হইতে নির্গত আক্রমণ চতুর্দ্দিক হইতে আফজাল খাঁ এবং তাঁহার মুষ্টিমেয় দেহরক্ষী সৈন্যকে ভীষণভাবে আক্রমণ করিল। অগণ্য হস্তী বা মহিষযুথ কর্তৃক আক্রান্ত হইলে সিংহ ভীষণ প্রদীপ্ত হওয়া উঠে, আফজাল খাঁ এবং তৎসঙ্গিগণও সেইরূপ রোষে-দুঃখে প্রোজ্জ্বলিত হুতাশন প্রায় নিতান্ত প্রদীপ্ত হইয়া ভীষণ তেজে উলঙ্গ কৃপাণ করে অরাতি নিধনে প্রমত্ত হইলেন। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার তাঁহাদের কাফের-শোণিত-পিপাসু তরবারি বিদ্যুৎ চমন প্রদর্শন করিতে লাগিল। ত্রিশজন মোসলেম প্রায় দুই সহস্র শক্রর বিরুদ্ধে যুঝিতে লাগিল।
এই সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখস্থ মাওয়ালী সৈন্যগণের ভিড় ঠেলিয়া এবং প্রচন্ড প্রহারে তাহাদিগকে তরল পারদের ন্যায় চঞ্চল করিয়া আফজাল খাঁ সেই গিরিপথের মধ্যে প্রবেশ করতঃ আত্মরক্ষা করিবার জন্য বিপুল চেষ্টা ও উদ্যোগ করিলেন।
আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সৈন্যগণ কেহই বর্মপরিহিত ছিলেন না। সুতরাং শরীরের নানাস্থানে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়া সন্ত্রস্ত সিংহের ন্যায়, পবনাহত পাবকের ন্যায়, উন্মত্ত কুঞ্জরের ন্যায়, আহত ফণীর ন্যায়, সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায়, ভীষণ বাতাবর্তের ন্যায়, নিতান্ত উগ্র এবং একান্ত আত্মবিস্মৃত হইয়া তেজঃদৃপ্ত ও সংহারক হইয়া পড়িলেন! “দীন দীন” রবে ভীষণ গর্জন ও হুঙ্কার করিয়া শক্র বধ করিতে লাগিলেন। ভীষণ ও অসম যুদ্ধে দশজন মোসলেম বীরপুরুষ নিহত হইলেন। মারাঠীদিগের প্রায় অর্ধেক সৈন্য নিহত হইয়া ভূপতিত হইল। তথাপি রণে ভঙ্গ না দিয়া আফজাল খাঁকে নিহত বা বন্দী করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রের জ্যোৎস্নাজাল পৃথিবীকে আলোকিত করিয়া তুলিল। আফজাল খাঁ বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান শিবাজীর প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিহিংসা সাধন মানসে, শক্রশ্রেণী ভেদ করিয়া তাঁহার প্রতি অভিদ্রুত হইলেন। কিন্তু আর উপায় নাই দেখিয়া সন্মান রক্ষার্থ মরিয়া হইয়া ভল্ল বিস্তারপূর্বক তেজের সহিত ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বহুসংখ্যক মাওয়ালী ও মারাঠী যোদ্ধা আসিয়া আফজাল খাঁর ভীষণ আক্রমণ হইতে দস্যুপতি শিবাজীকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে মন্ডলাকারে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। আফজাল খাঁকে লক্ষ্য করিয়া সকলেই ভীষণ বেগে বিষাক্ত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। কয়েকটি তীর আফজাল খাঁর স্কন্ধে এবং শরীরের নানাস্থানে বিদ্ধ হইলেও, পুরুষসিংহ তৎপ্রতি কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দুর্বিসহ পরাক্রমে শক্র হনন করিতে লাগিলেন। দুর্দ্দমতেজঃ প্রভাবে শিবাজীর দেহরী কতিপয় দস্যুযোদ্ধার মস্তক ছেদনপূর্বক শিবাজীর প্রতি মালেকল মউতের জিহবার ন্যায় ভয়াবহ রক্তরঞ্জিত তরবারি প্রসারণ করিয়া ধাবমান হইলেন। কিন্তু সহসা একটি বিষাক্ত তীর তাঁহার পেশানীতে বিদ্ধ হইল। রক্তধারায় মুহূর্তমধ্যে তাঁহার মুখমন্ডল এবং মনোহর শ্মাশ্রুরাশি আপ্লুত হইয়া গেল। যন্ত্রণায় তিনি অধীর ও বিপন্ন হইয়া পড়িলেন। শিবাজী এবং তাঁহার সঙ্গী যোদ্ধাগণ ভীষণভাবে প্রাণপণ করিয়া আফজাল খাঁকে আক্রমণ করিতে লাগিল।
আফজাল খাঁ সেইরূপ জখমী অবস্থাতেও দুর্জয় বাহুবলে কয়েকজন মারাঠী দস্যুকে নিধন করিয়া শিবাজীকে প্রচন্ড তরবারি প্রহার করিত উদ্যত হইলেন। কিন্তু বহু রক্তপাতে ও বিপুল পরিশ্রমে সহসা মূর্চ্ছিত প্রায় হইয়া ভূপতিত হইলেন।
সোলেমান খাঁ নামক জনৈক বীরপুরুষ অগ্রসর হইয়া আফজাল খাঁর দেহ রক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। আফজাল খাঁকে ভূপতিত দেখিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য দস্যুগণ তাঁহার শিরচ্ছেদ মানসে মাংস-লোলুপ শকুনির ন্যায় ছুটিয়া আসিল। সোলেমান খাঁ গুরুতরূপে আহত হইয়া শক্তির চরম বিন্দুতে নির্ভর করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আর রক্ষা করা অসম্ভব! মোসলেম সৈনিকগণ প্রায় সকলেই নিহত কিংবা গুরুতররূপে আহত হইয়া ভূতলশায়ী। যে দুইজন বাঁচিয়া আছে, তাহারাও বহুদূরে আফজাল খাঁ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সাংঘাতিকরূপে আহত সোলেমান খাঁ মাথা আর ঠিক রাখিতে পারিতেছেন না! হস্ত শিথিল হইয়া আসিতেছে।
এমন সময় সহসা সমস্ত কোলাহল নিবারণ করিয়া অতি ঘন চটাপট অশ্বপদ ধ্বনি শ্রুত হইল। দেখিতে দেখিতে পঞ্চাবিংশতি মোসলেম বীর পুরুষ বিদ্যুৎ গতিতে ভীষণ তরবারি হস্তে সংহারক বেশে শিবাজীর সৈন্যদলের উপর প্রচন্ড বার্তাবর্ত কিংবা সামুদ্রিক উচ্চড ঊর্মির ন্যায় ছুটিয়া পড়িল। তাহার সকলেই বর্মমন্ডিত ছিল। একজন যুবক বীরপুরুষ ভীষণ তেজে শিবাজীর উপরে আসিয়া পড়িলেন! তরবারির ভীষণ আঘাতে শিবাজীর লৌহ-ঢাল বিদীর্ণ করিয়া তাঁহার মস্তক আহত করিয়া ফেলিল।
শিবাজী ভীষণ চীৎকার করিয়া দ্রুত অশ্ব ধাবন করতঃ প্রাণ রক্ষার্থে জঙ্গলের অভ্যন্তরে পলায়ন করিলেন। অত্যল্প সময় মধ্যেই সমরক্ষেত্র নির্জন হইয়া পড়িল। শীতল জলধারা অনবরতঃ মস্তকে বর্ষণ করায় এবং তস্থানে প্রলেপ দিয়া পাটি বাঁধিয়া দেওয়ায় অল্পণ মধ্যেই আফজাল খাঁর চৈতন্য সঞ্চার হইল। অতঃপর তাঁহাকে এবং আহত মোসলেম সৈন্যদিগকে কোনওরূপে অশ্বপৃষ্ঠে সমারূঢ় করিয়া কৃষ্ণগড়ের কেল্লার দিকে আগন্তুক বীর-পুরুষ অগ্রসর হইবার উপক্রম করিলে, আফজাল খাঁ বলিলেন, “হে বীরপুরুষ! আপনার দয়া ও মহানুভবতা অপরিসীম! আপনার ঋণ অপরিশোধ্য! আপনার সহানুভূতি অতুলনীয়! আপনি মঙ্গলের জন্যই আমাকে কৃষ্ণগড়ের দুর্গে লয়ে যেতে চাচ্ছেন, আমি সেজন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কিন্তু, হে মিত্রবর! আপনার ন্যায় মহাজন ও বন্ধুজনের পরিচয় প্রদান করলে প্রাণের ভিতরে গভীর শান্তি ও আরাম পাব।”
আগন্তক বীর পুরুষ কিয়ৎকাল নীরবে দন্ডায়মান রহিলেন। অতঃপর বামাকণ্ঠে সকলের বিস্ময় উৎপাদনপূর্বক বলিলেঃ “মহানুভব সেনাপতে! আমার পরিচয় অতি সামান্য। আমি কৃষ্ণগড় দুর্গের জায়গীরদার সরফরাজ খাঁর কন্যা আমিনা বানু। সুদক্ষ গুপ্ত সন্ধানীর নিকট আপনার তত্ত্ব এবং আপনাকে নিহত করার জন্য নৃশংসপ্রকৃতি শিবাজী যে ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তা’ অবগত হয়ে অতীব ব্যস্ততা সহকারে দ্রুত রণসজ্জাপূর্বক বীরপুরুষগণকে সঙ্গে লয়ে আপনার সাহায্যের জন্য এখানে আগমন করেছি।”
আফজাল খাঁ আমিনা বানুর পরিচয় লাভ করিয়া নিতান্ত প্রীত ও আনন্দিত হইয়া পুনঃ পুনঃ আশীর্বাদ করিলেন। অনন্তর আমিনা বানু আফজাল খাঁকে লইয়া দুর্গের দিকে অগ্রসর হইলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
তরুণ অরুণের কনক-কিরণ-রাগে চতুর্দিকে আলোকিত হইয়াছে। প্রভাত-পবন-বনভূমির স্বভাবজাত কুসুমগন্ধ বহন করিয়া মৃদুমন্দ সঞ্চরণ করিতেছে। শিশির-সিক্ত পাতায় পাতায় সূর্যের রশ্মি পতিত হইয়া শ্যামলিমার অঙ্গে লালিমার কি অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে! নানাজাতীয় বিচিত্র-বর্ণ-বিচিত্র-পক্ষ সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গগণ কুজন-লহরীতে বিশাল আরণ্য প্রকৃতিকে মুখরিত এবং পুলকিত করিয়া তুলিয়াছে! এমন সময়ে কৃষ্ণগড় ও রায়গড়ের সীমানাস্থিত অরণ্যে মৃগয়ার জন্য শিবাজী এবং আফজাল খাঁ কতিপয় শিকারী অনুচর, বহুসংখ্যক কুক্কর, বাজপী ও পালিত চিতা বাঘ সহ প্রবেশ করিলেন। পঞ্চাশটি হস্তী শিকারী ও শিকারের সরঞ্জাম বহন করিয়া নিবিড় অরণ্য তোলপাড় করিয়া ক্রমশঃ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিল। হস্তিযুগল ভয়ে বিহঙ্গগণ ত্রাসিত হইয়া চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় উড়িতে লাগিল। মৃগ, কৃষ্ণসার ও অন্যান্য আরণ্যজন্ত চতুর্দিকে ভয়ে ছুটিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। শিকারীগণ কেহ তীর, কে বা বন্দুকের দ্বারা মৃগ শিকার করিতে লাগিল।
শিকার করিতে করিতে ক্রমশঃ আফজাল খাঁ এবং শিবাজী একটি ক্ষুদ্র পাবর্ত-নদীর তটে গভীর বনে উপস্থি হইলেন। এই নিবিড় বনের একটানা শ্যামল-শোভা-দেখিয়া আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমোহিত হইলেন। এই বনে সিংহ বাস করিত বলিয়া সাধারণ শিকারীরা প্রায় এ-দিকে পদাপর্ণ করিত না। কিন্তু আফজাল খাঁর সিংহ এবং ব্যাঘ্র শিকারের অপরিমিত কৌতূহল ছিল বলিয়া এই বনে স্বেচ্ছায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বনের নিবিড় প্রদেশে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ দুই হস্তে বক্রমুখ ক্ষুদ্রাকৃতি দুইখানি তরবারি ধারণপূর্বক হস্তিপৃষ্ঠ হইতে অবতরণপূর্বক দুইজন অনুচর সহ পদব্রজে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এই সিংহ-নিবাস বনে প্রবেশ করিতে অনেকেরই অমত ছিল। কিন্তু পাঠান বীর আফজাল খাঁর জ্বলন্ত উৎসাহ এবং দৃঢ়তার নিকট সকলের আপত্তি ও ভীতি প্লাবনের মুখে তৃণগুচ্ছের ন্যায় ভাসিয়া গেল। আফজাল খাঁর পশ্চাতে আরও পাঁচজন বীরপুরুষ তরবারি মাত্র হস্তে ধারণ করিয়া সেই শ্বাপদ-সঙ্কুল ভয়াবহ বনে প্রবেশ করিলেন। শিবাজী এবং তাঁহার অন্যান্য মারাঠা অনুচর এবং আফজাল খাঁর সঙ্গীয় অন্যান্য যোদ্ধা ও শিকারী হস্তিপৃষ্ঠে সেই নিবিড় বনের মধ্যে খাঁ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবেশ করিল।
বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সকলেই প্রকান্ড শাল, গজারী, দেবদারু, তমাল, তাল প্রভৃতি বৃক্ষ দর্শনে স্তম্ভিত হইলেন। বহুকালের বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ হইয়া এই নিবিড় বন যার-পর-নাই গম্ভীর দৃশ ধারণ করিয়াছিল। এই কারণে সূর্যরশ্মি কদাচিৎ প্রবেশ করিত। আফজাল খাঁ অনুচর পঞ্চকসহ সেই নিবিড় বনে সিংহ শিকারের জন্য তরবারি হস্তে ক্রমশঃ ধীরে ধীরে জঙ্গল ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অগ্রসর হইতে হইতে এক ক্ষুদ্র পবর্তমূলে একটি গুহার সম্মুখীন হওয়া মাত্র সহসা দুইটি সিংহ ভীষণ গর্জনে অরণ্যভূমি প্রকম্পিত করিয়া উল্লস্ফপূর্বক আফজাল খাঁর উপর পতিত হইবার উপক্রম করিল। তখন মহাবীর আফজাল খাঁ এবং সহচরগণ মুহুর্ত মধ্যে সাবধান হইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে সিংহ লক্ষ্যে তরবারি ধারণ করিলেন। এই সময় বীরবর আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীদের বদনে অপূর্ব দৃঢ়তা এবং বীরত্বের তেজঃ অতি চমৎকাররূপে ফুটিয়া উঠিল। সিংহ আফজাল খাঁর উপরে পতিত হইবার প্রাক্কালে মহাসাহসী আফজাল খাঁ তরবারির প্রচন্ড আঘাতে সিংহের গ্রীবাচ্ছেদন করিয়া লস্ফ প্রদানপূর্বক দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। সিংহিনীও আফজাল খাঁ সরিয়া যাওয়ার তাঁহার উপরে আপতিত হইতে না পারিয়া মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল এবং পর মুহুর্তেই লম্ফ প্রদানপূর্বক বিদ্যুদ্বেগে আফজাল খাঁর বাম বাহুর উপরে পতিত হওয়া মাত্রই খাঁ সাহেব দক্ষিণ হস্তের অসির ভীষণ আঘাতে সিংহিনীর মস্তক বিদ্ধ করিয়া ফেলিলেন।
অর্ধহস্ত পরিমিত তরবারির অগ্রভাগ সিংহিনীর মস্তক মধ্যে প্রবেশ করায় সে ভীষণ হুঙ্কার করিয়া দূরে যাইয়া পতিত হইল। আফজাল খাঁ অসির দ্বিতীয় আঘাতে সিংহিনীটিকেও দ্বিখন্ড করিয়া ফেলিলেন। সকলে আফজাল খাঁর সাহস এবং কৌশল দেখিয়া বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে ‘সাবাস! সাবাস!’ করিতে লাগিল।
আফজাল খাঁর বাম বাহুতে সিংহিনীটা একটু নখর বসাইয়া দিয়াছিল, সেখানে কিঞ্চিৎ চূর্ণ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া পট্রি বাঁধিয়া দেওয়া হইল।
সকলে আফজাল খাঁকে বনপ্রবেশে নিরস্ত হইতে বলিলে, তিনি স্মিত হাস্য করিয়া বিপুল উৎসাহে আরও সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এদিকে হস্তিপৃষ্ঠে থাকিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য বীরপুরুষ ও শিকারীগণ বহু মৃগ, চিতা, বন্য-কুক্কুট, ময়ূর ও অন্যান্য পক্ষী শিকার করিলেন। অতঃপর দ্বিপ্রহর সমাগমে সকলে এক মনোহর উপত্যকায় উপনীত হইয়া আহারের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন।
এইস্থলে নির্মল ও বিশুদ্ধ জলের একটি ঝরণা হইতে অতি বেগে জলরাশি উঞ্ছগত হইতেছিল। ছায়াযুক্ত প্রকান্ড প্রকান্ড বৃসমূহ বিরাজমান থাকায় চন্দ্রাতাপের কার্য সাধিত হইল। সঙ্গে তাম্বুর অভাব না থাকিলেও তাহা খাটাইবার কোনও প্রয়োজন বোধ হইল না। মারহাট্টা এবং মুসলমানগণ পৃথক পৃথক স্থানে মৃগয়ালব্দ নানা জাতীয় মৃগ ও পক্ষিমাংসের কাবাব, কোফ্তা এবং কোরমা প্রস্তুতপূর্বক উদরপূর্তি করিলেন। ঝরণার জল পান করিয়া সকলেই তৃপ্ত হইলেন।
কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিবার পরে সূর্যের তেজঃ কিছু মন্দীভূত হইলে, আফজাল খাঁ এবং শিবাজী দলবল সহ হস্তিপৃষ্ঠে কৃষ্ণগড়ের সীমান্তের দিকে মৃগয়া করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে এক বনের ভিতর দিয়া যাইবার সময় সহসা একটি প্রকান্ডকায় ভীষণ ব্যাঘ্র একটি উচ্চ ভূখন্ড হইতে লম্ফ প্রদানপূর্বক একেবারেই শিবাজীর উপর পতিত হইল! হঠাৎ ব্যাঘ্রের আক্রমণে শিবাজী যার-পর-নাই আড়ষ্ট এবং হতবুদ্ধি হইয়া হস্তিপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইলেন। ব্যাঘ্ররাজ শিবাজীর গ্রীবা ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিবার উদ্যোগ করায় চতুর্দিকে একটি ভীতিজনক অস্ফুট রব উত্থিত হইল। শিবাজীর হস্তের তরবারিখানি ভূপতিত হইবার সময়ে দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল। কোষে আর একখানি তরবারি থাকিলেও শিবাজী ভয়ে মূর্চ্ছিত হইয়া আত্মরক্ষার উদযোগ করিতে অসমর্থ ছিলেন।
সকলেই শিবাজীর আসন্নমৃত্যু কল্পনা করিয়া যখন ভীত ও ব্যাকুল হইতেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সকলে বিস্ময়-বিস্ফোরিত-নেত্রে দেখিতে পাইল যে, মহা সাহসী আফজাল খাঁ হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তরবারি হস্তে বেগে লম্ফ প্রদানপূর্বক ভূমিতলে দন্ডায়মান হইবার পূর্বেই প্রচন্ড আঘাতে ব্যাঘ্ররাজকে দ্বিখন্ড করিয়া মূর্চ্ছিত শিবাজীকে ভূমি হইতে উত্তোলন করিলেন। চতুর্দিকে হইতে হর্ষ-রসাপ্লুত কণ্ঠে “সাবাস! সাবাস!” শব্দ উত্থিত হইল।
আফজাল খাঁর সাহস, কার্যতৎপরতা এবং সত্বরতা দেখিয়া সকলেই অবাক হইয়া গেল! শিবাজী ভক্তিগদ্গদ্ কণ্ঠে তাঁহার প্রাণদাতা বীরবরকে পুনঃ পুনঃ মুক্ত কণ্ঠে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। নিজের আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা জানিয়াও যিনি পরের প্রাণ রক্ষার জন্য ভীষণ ব্যাঘ্রের মুখে লম্ফ প্রদানপূর্বক পতিত হইতে পারেন, তাঁহার বীরত্ব ও পরহিতৈষণার তুলনা কোথায়?
এই ঘটনার পরে আফজাল খাঁর লোকজন আর অগ্রসর না হইয়া রায়গড়ে ফিরিয়া যাইবার জন্য মত প্রকাশ করিলেও, শিবাজী অত্যন্ত আগ্রহতিশয্যে পুনঃ পুনঃ কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত যাইবার জন্য জেদ ও উৎসাহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার উৎসাহে মহাবীর আফজাল খাঁ সাহেব উৎসাহিত হইয়া আরও অগ্রসর হইয়া রাত্রি যাপনের মত প্রকাশ করিলেন, সুতরাং শিকারীর দল আবার অগ্রসর হইতে লাগিল।
বেলাও তখন খুব বেশি ছিল না। খুব দ্রুত গমন করিলেও এক প্রহর রাত্রির পূর্বে কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত উপস্থিত হইবার কোনই আশা ছিল না। সুতরাং মাহুতেরা হস্তিযুথকে খুব দ্রুত গমনের জন্য বিশেষ তাড়া করিল। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইবার পর সকলেই বিস্মিত দৃষ্টিতে দর্শন করিল যে, নিবিড় অরণ্যানীর মধ্য হইতে সহসা সর্বাঙ্গ-বর্মমন্ডিত একজন অশ্বারোহী এক ক্ষুদ্র পর্বতের পার্শ্ব হইতে আফজাল খাঁর সম্মুখীন হইয়া অভিবাদনপূর্বক এখখানি পত্র প্রদান করতঃ পর মুহূর্তেই বিদ্যুদ্বেগে অশ্বচালনা করিয়া সেই নিবিড় বনের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল। আফজাল খাঁ পত্র পাঠ করিয়া তাহাকেও কিছু না বলিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। জনৈক পার্শ্বচর পত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিলে আফজাল খাঁ বলিলেন যে, পত্রখানি বিজাপুর হইতে আসিয়াছে। সোলতান তাঁহাকে শীঘ্রই রাজধানীতে ফিরিবার জন্য লিখিয়াছেন।
শিবাজী সহসা সেই অশ্বারোহীদের আগমন এবং দ্রুত গমনে কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া কয়েকজন সৈনিককে তাহার অনুসরণ করিবার জন্য ইঙ্গিত করিলেন। কয়েকজন সৈনিককে কয়েকজন মারাটী অশ্বারোহী সেই অশ্বারোহীর পশ্চাদ্ধবনের উপক্রম করায় আফজাল খাঁ কঠোর দৃঢ়তার সহিত তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া বলিলেন যে, অশ্বারোহী বিজাপুর সোলতানের খাস সংবাদবাহক। তাহাকে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই। সুতরাং অশ্বারোহীগণ আর তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইল না। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইবার পরে আফজাল খাঁ শিবাজীর পশ্চাতে পড়িবার চেষ্টা করিয়া শিবাজীকে বলিলেন, “এখানের পথ নিতান্তই সঙ্কীর্ণ বিশেষতঃ অন্ধকার হয়ে আসছে, আমার মাহুত ভাল দেখতে পাচ্ছে না, আপনার হাতীটাকে আগে চালান। তা’ হ’লে আমার হাতী তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়ার সুবিধা পাবে।”
শিবাজী অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, “হায়! তাও কি হায়! আপনাকে পিছে রেখে আমি অগ্রে যাব, তা’ তখনও মনে করবেন না। আমা দ্বারা এরূপ বে-আদবী কখনও হবে না।”
আফজাল খাঁ হস্তী থামাইয়া শিবাজীকে অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন; কিন্তু শিবাজী কিছুতেই অগ্রগমনে সম্মত হইলেন না। সুতরাং অগত্যা আফজাল খাঁই পূর্বের ন্যায় অগ্রগামী হইলেন। এক সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ শিবাজীকে আবার অগ্রগমনের জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। শিবাজী পুনরায় অস্বীকৃত হইলেন। আফজাল খাঁ তখন সেইস্থলে হস্তী হইতে অবতরণপূর্বক সঙ্গী সৈন্যদিগকে আহবান করিয়া বলিলেন, “তোমরা কয়েক খন্ড গুরুভার প্রস্তর এই রাস্তার উপর দিয়ে সাবধানে সম্মুখের দিকে গড়িয়ে লয়ে যাও। এই রাস্তায় ঘোড়াডুবি-গর্ত আছে।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অন্তঃপুরস্থ একটি অট্রালিকার সজ্জিত কক্ষে তারাবাঈ একটি জানালার ধারে বসিয়া গভীর চিন্তাসাগরে নিমগ্ন। তারাবাঈয়ের সখী মঞ্জরীমালা এবং ধাত্রী সারদা উভয়ের গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত। ছটায় সমস্ত ক আলোকিত করিয়া জাগিয়া জাগিয়া কি যেন চিন্তা করিতেছে। বাতায়ন-পথে হেমস্তের ঈষৎ শীতল সমীরণ ধীর গতিতে প্রবাহিত হইয়া যুবতীর কুঞ্চিত অলকরাজি এবং চেলাঞ্চল লইয়া ক্রীড়া করিতেছে।
যুবতী যেমনি সুন্দর সুঠাম, তেমনি বেশ তেজস্বিনী অথচ মূর্তিবিশিষ্ট। যুবতী শিশিরসিক্ত বালার্কের নব অরুণিমা-রাগ-রঞ্জিত বস্রাই গোলাপের ন্যায় মনোহর! অথবা শারদীয় ঊষার ন্যায় চিত্তহারিণী। সমগ্র মহারাষ্ট্রে তারাবাঈয়ের ন্যায় সুন্দরী যুবতী আর একটি আছে কি-না সন্দেহ। তারাবাঈকে দেখিলে, তাহাকে আদৌ মারাঠা-কন্যা বলিয়া বোধ হইত না। মনে হয়ত, যেন কোনও ইরাণী-সুন্দরী মারাঠী পরিচ্ছদে দেহ সাজাইয়া অন্তঃপুর আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। যৌবনসমাগমে তারা বর্ষার নদীর ন্যায়, বসন্তের গোলাপের ন্যায়, শরতের পদ্মের ন্যায়, ঊষার তারকার ন্যায়, পরিপুষ্ট, কমনীয়, লোভনীয় এবং শোভনীয় হইয়াছে! তাহার অন্তরের চন্দ্রদর্শনে নদনদী সমুদ্রের স্থির জল যেমন স্ফীত হইয়া উঠে, তারাবাঈয়ের স্থির অচঞ্চল হৃদয়ও আজ তেমনি অসাধারণ সৌন্দর্যশালী পুরুষত্ব আফজাল খাঁকে দর্শন করিয়া প্রেমানুরাগে অধীর ও আকুল হইয়া উঠিয়াছে। যে মালোজীর সঙ্গে তারার বিবাহের কথা হইয়াছে, যে মালোজীর বীরত্বের কথা শুনিয়া এবং বীর্যপুষ্ট-দেহ-কান্তি এবং রূপশ্রী দেখিয়া তারাবাঈ মুগ্ধ হইয়াছিল, আজ সেই মালজীর শ্রী ও কান্তি তারার কাছে তেমন চিত্তবিনোদন বলিয়া আর প্রতিভাত হইতেছে না। তারা মনে মনে তাহার ইষ্টদেবতা শঙ্করকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল যে, মালোজীর সহিত বিবাহের পূর্বেই সে আফজাল খাঁর ন্যায় পুরুষরত্নের দর্শন পাইয়াছে। আশার সহিত দারুণ নিরাশায় তাহার চিত্ত ঝঞ্জানিল-সন্তাড়িত সরসীর ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে।
আফজাল খাঁকে দেখিয়া তারা হৃদয়-মন তাঁহার চরণতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। কিন্ত হায়! প্রকাশ্যে তাহা উৎসগ করিবার কোনও উপায় হইবে কি? পিতার শক্রপক্ষীয় সেনাপতির প্রতি অনুরাধ, কি ভয়ানক কথা! কি অসম্ভব ব্যাপার! তারাবাঈ প্রেমোদ্বেল চিত্তকে নানা প্রকারে শান্ত ও সংযমিত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিল; কিন্তু কৃতকার্যতার অপেক্ষা পরাজয়ের মাত্রাই আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তারা বড়ই বিপদে উজ্জ্বল ও তাঁহার প্রতি প্রেমাশক্তি ততই শত গুণে দৃঢ় বদ্ধমূল হইতে লাগিল। তারার দুই কপোল বহিয়া অশ্রুধারা মুক্তাধারার ন্যায় গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
তারা যতই পাঠান বীরকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল, মন ততই বলিতে লাগিল, আহা! তাঁহাকে কি ভোলা যায়! কি চমৎকার মোহিনী মূর্তি! মরি! মরি! কি রূপেরই বাহার! কি কান্তির ছটা! কি তেজঃ! কি সাহস! কি স্ফূর্তি! যেন সাক্ষাৎ কার্তিক। কি লাবেণ্যর জোয়ার! কি ভুবনভুলানো অক্ষিযুগল! এমন নব্য যুবক, এমন সুঠাম ও সুশ্রী তিজস্বী পুরুষ! হায়! উহার চরণে আত্মবলিদানেও যে সুখ! উহার কথা স্মরণ করিতেও যে হৃদয় অমৃতরসে সিক্ত হইয়া যায়।
তারাবাঈ আফজাল খাঁকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিয়া, আফজাল খাঁর প্রেমোম্মাদনায় আরও উন্মুত্ত হইয়া পড়িল। ধৈর্যের বাঁধ একেবারেই ভাঙ্গিয়া গেল! মনে হইতে লাগিল, কিসে যেন হৃৎপন্ডিটাকে আফজাল খাঁর দিকে সবেগে আকর্ষণ করিতেছে! তাহার শরীরের অণু-পরমাণু যেন শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আফজাল খাঁর প্রতি ছুটিয়া যাইতে চাহিতেছে! কি ভীষণ ব্যাপার! কি অভূর্তপূর্ব ঘটনা! যুবতী বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া পড়িল! বস্তুতঃ প্রেমের আকর্ষণের নিকট সকল আকর্ষণই পরাস্ত! প্রেমের প্রভাবের নিকট সকল প্রভাবকেই খর্ব হইতে হয়। মানব ক্ষুদ্র জীব! তাহার হৃদয়টি আরও ক্ষুদ্র! কিন্তু এই ক্ষুদ্র হৃদয়-সঞ্জাত প্রেমের ধারা সারা বিশ্বকে ভাসাইয়া দিতে পারে।
এই প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বসিত আবেগে তারা অধীর ও আকুল হইয়া উঠিল! তারাবাঈ আকুল প্রাণ লইয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িল। এদিকে সেদিকে, প্রাঙ্গণের ধারে, দীঘির পাড়ে চিন্তা-ভারাক্রান্ত চিত্তে ভ্রমণ করিতে লাগিল! আর পুনঃ পুনঃ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে আফজাল খাঁর অবস্থান অট্রালিকার দিকে দৃকপাত করিতে লাগিল। তারা বেড়াইতেছে কিন্তু হৃদয়ের উদ্বেগ ও কামনার আগুন তাহাকে উন্মত্ত প্রায় করিয়া রাখায় কিছুতেই সাশন্ত পাইতেছে না। তারা ক্রমশ বেড়াইতে বেড়াইতে আপন মনে বাগানের দিকে চলিল। যাইতে যাইতে ক্রমণ বাগানটির রমণীয় সৌধের নিকটবতী হইল। সৌধ দেখিয়া মনে হইল, এই নির্জন সৌধ আফজাল খাঁকে পাইলে সে অশ্রুজলে তাঁহার পদতল অভিষিক্ত করিয়া দিত। কিন্তু হায়! তাহার গগ্ধ অদৃষ্টে এ সুযোগ কখনও জুটিবে কি? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে সেই নির্জন সৌধের যেমনি নিকটবর্তী হইল, অমনি শুনিতে পাইল “আফজাল খাঁকে সেরূপেই হউক, হত্যা করতে হবে। শক্রকে ছলে-বলে-কৌশলে যেকোনও প্রকারে হত্যা করা পরম ধর্ম।”
সহসা বজ্রাঘাত হইলেও তারাবাঈ কখনও এরূপ চমকিত ও আতঙ্কিত হইত না। তারার প্রেমের পাত্র আফজাল খাঁর হত্যার সিদ্ধান্ত শুনিয়া তাহার হৃদয়ের স্পন্দন যেন রুদ্ধ হইয়া গেল! একজন মহা পরাক্রান্ত মতাশালী সেনাপতিকে প্রবৃত্তি এবং ভীষণ হীনতা যে মানুষের মনে স্থান পাইতে পারে, ইহা কিছুতেই সেই সরলা তরলা প্রেমাবিহবলা কুমারীর পক্ষে বুঝিয়া উঠা বা ধারণা করা সজন ছিল না। তাহার পিতা শিবাজী ডাকাতি করেন বটে, কিন্তু এমনি করিয়া ছলনা-পূর্বক যে ঠগীর ন্যায় নির্দোষ ব্যাক্তির প্রাণবধ করিতেও পটু, তাহা জানিতে পারিয়া পিতার প্রতি বিষম ঘৃণা ও অশ্রদ্বার ভাবে হৃদয়ে ব্যথিত হইয়া উঠিল!
এক্ষণে কিরূপে তাহার হৃদয়-আকাশের শরচ্ছন্দ্রমা, জীবন-উদ্যানের রসালবৃক্ষ আফজাল খাঁকে হত্যাকান্ড হইতে রক্ষা করিবে, তচ্ছিন্তায় শিবাজী-নন্দিনী যৎপরোনাস্তি আকুল হইয়া উঠিল। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়াও তাহার আকাঙ্খিত প্রেম-দেবতা আফজাল খাঁকে দস্যুধর্মী পিতার নিদারুণ ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস হত্যাকান্ড বাঁচাইবার জন্য তারাবাঈ ব্যস্ত হইয়া উঠিল।
মানব-হৃদয়ে যখন নবীন প্রেমের সঞ্চার হয়, তখন উহা গিরিগুহা-নির্গত তরঙ্গিণীয় ন্যায় তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ছুটিতে থাকে। নদীর সম্বন্ধে-
“পর্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?”
ইহা যেমন সত্য, প্রেমের সম্বন্ধেও তেমনি নীচের কবিতাটি অটুট সত্য।
মানস কন্দর হ’তে যৌবন-ঊষায়,
যে প্রেমের মন্দাকিনী কারো পানে ধায়,
কার সাধ্য তার গতি করে অবরোধ?
রোধিতে যে চায়, সেই নিতান্ত নির্বোধ!
বায়ু জল উল্কা তীর কত ধরে বেগ
তাহার অধিক জান প্রেমের উদ্বেগ!
প্রেমের সমুখে হায়! কঠিন পাষাণ
হ’য়ে যায় সুকোমল ফুলের সমান!
সাগর গোস্পদ হয়, মরু হয় বন,
দুঃখে উপজয় সুখ, মরণে জীবন!
যত দুঃখ যত কেশ যত নির্যাতন,
প্রেম করে সকলেরে সুধা-প্রস্রবণ!
বিষেরে অমৃত করে, আঁধারে আলোক,
নরকেরে স্বর্গ করে বিষাদে পুলক,
আপনারে ভুলে যাওয়া পরের কারণ
ইহাই প্রেমের বটে প্রথম লণ।
দ্বিতীয় লণ শুধু স্মরণ, সেবন
প্রেমাস্পদ হেতু শেষে আনন্দে মরণ!
তারাবাঈ নিঃশব্দ পদ-সঞ্চারে প্রাচীরের গায়ে কান লাগাইয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শিবাজীর সমস্ত পরামর্শ শ্রবণ করিল। আফজাল খাঁকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্রের সমস্ত মন্ত্রণা শুনিয়া ব্যাকুল চিত্তে চরণে তথা হইতে প্রস্থান করিল।
0 comments: