তুরষ্ক - মিশর সহ বিশ্বের অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন আর বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে একটা প্রকট পার্থক্য রয়েছে । তাদের কর্মীরা যুগ যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার হয়ে বারবার দলের নাম পরিবর্তন করেছে কিন্তু কখনো আপোষ করেনি আদর্শের সাথে । কিন্তু জামায়াতে ইসলামী যখনই কোন সুবিধাজনক জায়গা পেয়েছে অমনি আদর্শের ঘষামাজা করে নিজেদেরকে নতুন করে নিয়েছে কিন্তু কখনো নামের সাথে আপোষ করেনি । মাশাআল্লাহ!! যেমন ইখওয়ান নতুন নাম FREEDOM and JUSTICE পার্টি নিয়ে রাজনীতি করছে কিন্ত জামায়াত আদি ও অকৃত্তিম জামায়াত!!
ঠিক এই সময়টায় একজন জামায়াত বা শিবিরের কর্মীর স্বপ্ন বলেন আর মিশন-ভিসন বলেন, তা হলো : ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হাতছাড়া হল আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের রুমটার দখল নেয়া এবং ২০১৮(..?..) সালের নির্বাচনে আবার পরাজিত হয়ে শেখ হাসিনা আর কামরুল মন্ত্রীদের ব্যঙ্গচিত্র বানিয়ে তা ফেসবুকে পোষ্ট করা । ইসলামী সমাজব্যবস্থা বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সুমহান লক্ষ্য উদ্দেশ্য জামাত-শিবিরের কর্মপদ্ধতির টাইপ করা হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে । ইসলামী মুভমেন্ট থেকে এই সংগঠন দুটি পরিনত হয়েছে রাজনৈতিক মুভমেন্টে । অথচ রাজনীতি হওয়া উচিত ছিলো আন্দোলনের একটা সাবজেক্ট মাত্র, আজ ইসলাম হয়েছে তাদের আন্দোলনের একটা সাবজেক্ট শুধু আর রাজনীতি হয়েছে সামগ্রীকতা । ইসলামী জীবনব্যবস্থার নানা শাখা নিয়ে পড়াশুনা - চিন্তাভাবনা ও লেখালেখির চেয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস আর ফ্রী-জামাত লিডার্স কপিপেষ্ট হয়েছে তাদের পছন্দের টপিক! ৬০-৭০ বছর ধরে নিগৃহীত ইখওয়ান কখনো আপোষ করেনি সামরিক স্বৈরাচারের সাথে, আর ৭ বছর ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া জামাত শিবির দুই বছর আওয়ামীলীগের অত্যাচারে "নাজুক অবস্থা্" "খারাপ অবস্খা" "কঠিন অবস্খা" বলে আর্তনাদ শুরু করেছে!
ইখওয়ান যেভাবে ৩০ বছর ধরে স্বৈরশাষক হোসনি মোবারকের কঠোর নিষ্পেসনের শিকার হয়েছে, জামাত-শিবিরের বিশুদ্ধতার জন্য আওয়ামীলীগ কে যদি আল্লাহ আগামী ২৫-৩০ বছর ক্ষমতায় রাখেন, অবাক হবার কিছু নেই ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জনাব গোলাম আজম (এই মানুষটা কে অধ্যাপক বলা হয়, অথচ তিনি কখনো অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক ছিলেন না) সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন । ডাকসুর মনোনীত জিএস হিসেবে স্বারকলিপি পাঠ ছাড়াও জেলজুলুমের ও শিকার হয়েছিলেন । গোলাম আজম একজন ভাষা সৈনিক - এটা খু্বই সত্য কথা । কিন্তু কথা হলো, তাতে জামায়াতের কি ? গোলাম আজম ভাষা সৈনিক না হয়ে শেখ মুজিবের একান্ত সহচর হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত বীর হলেও তাতে জামায়াতের গৌরব বৃদ্ধি হয় কোন জায়গাটায় ?
- ১৭৫৭ সালে নবা্ব সীরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশে সুদীর্ঘ মুসলিম শাষনের অবসান হয় । শুরু হয় দীর্ঘ দুই শতাব্দীর গোলামীর জীবন । ইংরেজরা মুসলমান জাতিকে পরাজিত করে এই উপমহাদেশের শাষনক্ষমতা গ্রহন করে । সীরাজকে পরাজিত করতে ইংরেজদের সবচেয়ে বেশি সহযোগীতা করে হিন্দু রায়ভল্লব - জগৎশেঠেরা । যদিও ঐতিহাসিকের কলমের নির্মমতার শিকার হতে হয় একা মীর-জাফর আলী কে !
- স্বাভাবিক কারনেই মুসলিম জনপদগুলো ইংরেজদের নির্মম আক্রশের লক্ষ্য হয় - ধ্বংস হয়ে যায় ৭-৮ শত বছরে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ একটা জাতি । ঠিক একই সময়ে হিন্দুরা হয়ে ওঠে ইংরেজদের সুবিধাভোগী জাতি । শিক্ষা - সম্পদ - ভুমির অধিকার - ব্যবসা - চাকুরী সব হারিয়ে মুসলমানরা পঙ্গু হয়ে যায় ।
- ৫৭ থেকে ৪৭ : ১৯০ বছর ধরে মুসলিম মুজাহিদ আর আলেম রা একটা মুহুর্তের জন্যও ইংরেজদের কে শান্তিতে থাকতে দেননি । আলেমরা উপমহাদেশকে দারুল-হারব ঘোষনা করেছেন আর তিতুমীর - ব্রেলভীরা একের পর এক বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে গিয়েছেন ।
- ৪৭ এ যখন মুসলিম সংখ্যাগড়িষ্ঠ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলো, তা কতটা ত্যাগ আর সংগ্রামের ফসল একবার অনুধাবনের চেষ্টা করুন । অসংখ্য এলাকা পাকিস্তানের অন্তভূক্ত হলোনা হিন্দু ভারতের কুটকৌশলে হেরে গিয়ে, পূ্র্ব পাকিস্তানের সব সম্পদ - সব ব্যবসা বাণিজ্য কলকাতাকেন্দ্রীক - অথচ কলকাতা পেলো ভারত - হাতছাড়া হতে হতে শেষ মুহুর্তে খুলনা অন্তর্ভুক্ত হলো পাকিস্তানে ।
- ১৯০ বছরের শোষনে জর্জরিত একটা জাতির নতুর পত্তন হওয়া রাষ্ট্রটি কতটা নাজুক অবস্থায় ছিলো, ভাবতে পারেন ? প্রতি মুহুর্তে ভারত থেকে হাজার হাজার মুসলমান রায়টের শিকার হয়ে হিজরত করছে সম্পদহীন এই অঞ্চলটায় - প্রতি মুহুর্তে ভারত জালমুদ্রা পাচার করে ধ্বংস করে দিচ্ছে অর্থনীতির অবশিষ্ট মেরুদন্ডটুকুও । জাতীয় চেতনা বিদ্ধংসী বইযে সয়লাব করে দিচ্ছে এদেশের তরুনদের মস্তিষ্ক!
- ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিলো ৫২ সালে অথচ এই আন্দোলনের রুট- তমদ্দুন মজলিশ নামের সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো সেই নাজুক ৪৭ এ-ই! চিন্তা করতে পারেন, ১৯০ বছর গোলামীর জিন্জিরাবদ্ধ জাতীর মুক্তির বছরেই এমন একটা পরিকল্পিত বিভক্তির সূত্রপাত ঘটাতে কে বা কারা ইন্ধন দিতে পারে ?
- যাহোক বা যেভাবেই হোক, ভাষা আন্দোলন হলো এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান যে একসাথে থাকতে পারেনা সেটা স্পষ্ট ঘোষণা হলো এই আন্দোলনে । অভিযোগ, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া যাবেনা । কারন উর্দু পশ্চিমাদের ভাষা । অথচ, ব্যাপার হলো, উর্দু কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগড়িষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিলো না । উর্দু ছিলো সমস্ত পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার একটা হাতিয়ারমাত্র । পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার প্রচলন ছিল । যেমন, ভারতেও একটা সময়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছে । কিন্তু ততদিনে ভারত তার প্রশাসনিক অবস্থানকে সৃদৃঢ় করে নিয়েছে যার ফলে অসংখ্য বিভক্তি আর অনেক ভাষার ভারত কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নি ভাষা আন্দোলনে । আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা হিন্দী নিয়ে ভারত একটা শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ! উর্দুকে ঠিক তেমনি হিন্দীর বিপরীতে পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ভেবেছিলো সেই সময়ের শাষক শ্রেণী ।
- ভাষা আন্দোলনকারীদের পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রুই ভাবা হতো অন্তত ১৯৭১ র্পয ন্ত্ ! আদর্শিক কারনেই জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলো শুরু থেকেই । জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী নিজে ৪৭ এর দেশবিভাগের দুর্ভোগের শিকার হওয়া একজন মানুষ যাকে হিজরত করতে হয়েছে । ঠিক যে কারনে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত অংশ নিয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্র্রের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে... ঠিক একই কারনে ৫২ এর ভাষা আন্দোলনকেও জামায়াত সবসময়ে বিরোধীতা করেছে ।
*** এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হলো আন্দোলনের এই আদর্শিক অবস্থান সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মানসিকতার বিপক্ষে থাকলেও এটা ছিলো ইসলামী চেতনার পক্ষে । কেননা ততকালীন বিশ্বের সবচেয় বেশি জনগোষ্ঠীর এই মুসলিম রাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্বের পক্ষে ছিলো সব আলেম ওলামা ও সকল ইসলামী দল!! এই উষ্কানী কিম্বা এই ইসলামী চেতনার দোহাইয়েই হাজার হাজার জামায়াত কর্মী এবং বর্তমান শিবিরের পূর্বরূপ ছাত্রসংঘের কমীরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয় । ৭১ এর সেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তারা যেমন মারে ঠিক তেমনি অগনিত সংখ্যায় নিজেরাও মৃত্যুবরন করে ।
গোলাম আজম আজ জামায়াতের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি । কেননা তিনি যোগ্যতার সাথে একটা বিরাট মুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন । ভাষা আন্দোলনের ৫২ সালে এই মানুষটা জামায়াতের নেতা হওয়া দূরের কথা কর্মী-এমনকি সমর্থকও ছিলেন না । ইসলামী চেতনা কিম্বা একটা মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধের এই ভাষা আন্দোলনের সৈনিক হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি নিজেই অনুতপ্ত ছিলেন । তিনি জামায়াতে যোগ দেন ভাষা আন্দোলনের অনেক পরে । এই গোলাম আজমের ভাষা সৈনিকত্বে জামায়াতের ভাগ নেয়াটা ঠিক কোন এঙ্গেলে বৈধ ? ভেবে দেখবেন জামায়াত-শিবিরের নিবেদিতপ্রাণ ভাই-বন্ধুগন!
একটা ইসলামী আন্দোলনের জন্য রাজনীতির একটা সীমা থাকা উচিত । ১৯৭১ এর পরে নতুন বাংলাদেশকে মেনে নেয়াটা জামায়াতের জন্য যথেষ্ঠ ! কিন্তু কিছুদিন পরপর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের অতীতকে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন মানে হয়না । ভাষা সৈনিকদের সম্মাননা দেয়া কিম্বা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেয়া - এটাও মানা গেলো, তাই বলে নিজেদেরকে ভাষা সৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধা বলে সগৌরব প্রচারনায় নামাটা কোন ধরনের ছেলেমানুষী ?? কতটা হীনমন্যতা থেকে এধরনের পরিকণ্পনার উদ্ভব ঘটতে পারে!! আপনারা আজ ভাষা সৈনিক আর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গৌরবে বুক ফোলান, একবার ভেবে দেখেছেন, আপনাদের শহীদ সাথীরা যদি প্রশ্ন করে, আমরা ঠিক কি কারনে জীবন বিলিয়েছিলাম তোমাদের আদর্শের বানী শুনে, জবাব দাও .. কি জবাব দিবেন তাদেরকে ? ভাষা আন্দোলন - যে আন্দোলনের পরিনতি ৭১ এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে তো আপনারা ইসলামী মুভমেন্টের চেতনার জোড় নিয়েই ততকালীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্বপক্ষে দাড়িয়েছিলেন । যে ভাষা আন্দোলন ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত ছিলো রাষ্ট্র্রের বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র, আজ তা আপনাদের মুখে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ?? এই দ্বিচারিতার জবাব প্রস্তুত করে রেখেছেন আপনাদের শহীদ ভাইদের জন্য ? এবং আল্লাহর দরবারে ?
লেখাটার উদ্দেশ্য ও সারমর্ম : রাজনীতির প্রয়োজনে ইতিহাসকে বিবর্তিত করার অধিকার আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেই । ইতিহাস অতীতের ঘটনা । অতীত পরিবর্তনের ক্ষমতা আল্লাহ মানুষকে দেননি । পঞ্চাশ কিবা পাঁচশ বছর আগে যে ঘটনা আল্লাহর কাছে অগ্রহনযোগ্য ছিলো, কোনভাবেই আজ তা আল্লাহর কাছে গ্র্রহনযোগ্য না । অতএব সাবধান... (*ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কয়েকটা বই : http://www.mediafire.com/?c7osnqk9l3bwbgi )
** এইরকম আত্মঘাতী পরিকল্পনা যে কতটা নোংরা পরিনতির দিকে আন্দোলনকে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমান পাবেন, গোলাম আজমের প্রশস্তিমুলক কবিতা রচনাও শুরু হয়ে গেছে! - তা দেখলে ! মনে পড়ে পতনযুগের স্পেনের শাষকদের দরবারে সম্রাটদের প্রশস্তি গেয়ে এরকম কবিতা রচনার একটা ধারা তৈরী হয়েছিলো! - ভুলে গেলে নসীম হিজাজীর বইগুলো আরেকবার রিভিউএর প্রয়োজন রয়েছে !
0 comments: