বৃহত্তম নিদর্শন- (২)
ঈসা বিন মারিয়াম আ.-এর প্রত্যাগমন
ভুমিকা
ঈসা বিন মারিয়াম আ. -আল্লাহর একজন নবী এবং উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণের অন্যতম। পিতা ব্যতীত-ই আল্লাহ পাক তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। মাতা মারিয়াম আ.-ও ছিলেন সৎ, যোগ্য ও খোদাভীরু মহিলা। আল্লাহ পাক দুনিয়াতে-ই তাঁকে জান্নাতী রিযিক দান করতেন।
আল্লাহ পাক বলেন- “যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন। জিজ্ঞেস করতেন- মারিয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এলো? তিনি বলতেন, “এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।-” (সূরা আলে ইমরান-৩৭)
আল্লাহর নবী যাকারিয়া আ. তাঁর জন্য মসজিদে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। মারিয়াম আ. ছাড়া সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারত না। যখন-ই কোন প্রয়োজনে যাকারিয়া আ. তাঁর কাছে যেতেন, সেখানে মওসুম-হীন তরতাজা ফলমূল দেখতে পেতেন। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করতেন, এগুলো কোত্থেকে আসল? মারিয়াম আ. বলতেন- আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে!! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।
ফেরেশতারা মারিয়াম আ.-এর কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিল- “আর যখন ফেরেশতারা বলল- হে মারিয়াম! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন, তোমাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। আর তোমাকে বিশ্ব নারী-সমাজের উর্ধ্বে মনোনীত করেছেন। হে মারিয়াম! তোমার পালনকর্তার উপাসনা কর এবং রুকুকারীদের সাথে সেজদা ও রুকু কর!” (সূরা আলে ইমরান-৪২)
অর্থাৎ মারিয়াম আ.কে আল্লাহ পাক স্বামী-বিহীন সন্তান প্রদানের জন্য নির্বাচিত করেছেন। সেই সন্তান বনী ইসরাইলের বড় নবী হবে, শৈশবে মায়ের কোলে শুয়ে এবং বড় হয়ে মানুষের সাথে কথা বলবে।
আনাছ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “জগদ্বিখ্যাত চারজন মহিলার নাম স্মরণ রেখো!
১) মারিয়াম বিনতে ইমরান ‘
২) আসিয়া ফেরাউন
৩) খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ
৪) ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ।-” (তিরমিযী)
মারিয়াম আ. যেভাবে শিশু ঈসাকে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন
আল্লাহ পাক তাকে পবিত্র, সম্মানিত ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নবী-সন্তান দান করবেন- ফেরেশতাদের এই সুসংবাদ শুনে স্বভাবত-ই তিনি চমকে উঠেছিলেন। স্বামী ছাড়া সন্তান!! হ্যাঁ..। আল্লাহ পাক সর্ববিষয়ে ক্ষমতাধর। যখন যা চান- “হয়ে যাও!” বলা মাত্রই -হয়ে যায়।
আল্লাহর এই মহান ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য হয়ে তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন। সত্য বুঝতে না পেরে মানুষ তাকে দোষারোপ করবে -ভেবেও ধৈর্যের পথ বেছে নিলেন।
বমি বা ঋতুস্রাব জাতিয় কারণে মাঝে মাঝে তিনি মসজিদের বাইরেও যেতেন। এমনি এক কারণে একদিন তিনি মসজিদে আকসার পূর্বদিকে বাইরে বসে ছিলেন। সে মুহূর্তে আল্লাহ পাক ফেরেশতা জিবরীল আ.কে মানুষের আকৃতিতে প্রেরণ করলেন। তাকে দেখা মাত্রই পরপুরুষ ভেবে তিনি বলে উঠলেন- “তোমার অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই”! আল্লাহকে ভয় কর! এবং এখান থেকে চলে যাও! জিবরীল বললেন- “আমি তো শুধু তোমার পালনকর্তা প্রেরিত (একজন ফেরেশতা), তোমাকে এক পবিত্র-পুত্র দান করতে এসেছি।” মারিয়াম আ. বললেন- “কিরূপে আমার পুত্র হবে, যখন কোন মানব আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি কখনো ব্যভিচারিণীও ছিলাম না.!!?” ফেরেশতা বললেন- “আল্লাহর জন্য সবকিছুই সহজ। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। আল্লাহ পাক মানুষের জন্য একটি নিদর্শন রাখতে চান। কারণ,
o আল্লাহ পাক আদমকে পিতা-মাতাবিহীন সৃষ্টি করেছেন
o হাওয়া’কে পিতৃ-হীন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন
o ঈসা’কে স্বামী-হীনা সতী মহিলা থেকে সৃষ্টি করেছেন
o বাকী সবাইকে পিতা-মাতা থেকে সৃষ্টি করেছেন
আল্লাহ পাক বলেন- “আর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন ইমরান-তনয়া মরিয়মের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে জীবন ফুঁকে দিয়েছিলাম..” অর্থাৎ জিবরীল -তার জামার আঁচলের দিকে ফুঁ দিলেন। সে ফুঁ গিয়ে জরায়ু স্পর্শ করে। অতঃপর গর্ভবতী হলে মরিয়ম আ. এক দূরবর্তী স্থানে চলে যান।
ঈসা আ.-এর জন্ম
আল্লাহ পাক বলেন- “প্রসব বেদনা তাঁকে এক খেজুর বৃক্ষ-মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তিনি বললেন- হায়, আমি যদি কোনরূপে এর পূর্বে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম! অতঃপর (শিশু) ঈসা নিম্নদিক থেকে আওয়ায দিলেন যে, আপনি দুঃখ করবেন না! আপনার পালনকর্তা আপনার পায়ের তলায় একটি নহর জারি করেছেন! আপনি নিজের দিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে নাড়া দিন! তা থেকে আপনার উপর সুপক্ক খেজুর পতিত হবে। সেখান থেকে আহার করুন! পান করুন! এবং চক্ষু শীতল করুন! যদি মানুষের মধ্যে কাউকে দেখতে পান, তবে বলে দিবেন যে, আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোযা মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মরিয়ম! তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ! হে হারূণ-ভাগিনী, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতা-ও ছিল না ব্যভিচারিনী!” (সূরা মারিয়াম ২২-২৮)
মায়ের কোলে শিশু ঈসা’র বাক্যালাপ
অতঃপর মরিয়ম আ.-এর উপর দোষারোপ বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে তিনি কোলের শিশুর দিকে ইশারা করলেন (অর্থাৎ শিশুর সাথে কথা বলুন সবাই!) তখন জাতি বলল- কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?
তখন-ই শিশু ঈসা বলতে লাগলেন- “আমি তো আল্লাহর বান্দা (দাস)। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে। এবং জননীর অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব।-” (সূরা মারিয়াম ২৮-৩৩)
উল্লেখ্য- ঈসা নিজেকে আল্লাহর দাস বলেছেন; পুত্র নয়। কারণ, আল্লাহর কোন শরীক নেই। কোন সাথী বা পুত্র গ্রহণ থেকে তিনি পবিত্র। পবিত্র সেই সত্তা, যিনি প্রতিটি বস্তুকে যথাযথ স্থানে রেখেছেন, মানুষকে সৎ-পথ দেখিয়েছেন।
হ্যাঁ...! এই হচ্ছে প্রকৃত ঈসা আ.। আল্লাহ পাক বলেন- “এই হচ্ছে মারিয়ামের পুত্র ঈসা। সত্যকথা, যে সম্পর্কে লোকেরা বিতর্ক করে। আল্লাহ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, তিনি যখন কোন কাজ করা সিদ্ধান্ত করেন, তখন একথাই বলেনঃ হও এবং তা হয়ে যায়।-” (সূরা মারিয়াম ৩৪-৩৫)
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন- “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমের-ই মতো। তাকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন এবং তারপর তাকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল।-” (সূরা আলে ইমরান-৫৯)
ঈসা আ.কে আল্লাহ পাক মহা নেয়ামত দান করেছেন। এরশাদ করেছেন- “স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ বলবেন- হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তোমার প্রতি ও তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মার দ্বারা সাহায্য করেছি। তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে কোলে থাকতেও এবং পরিণত বয়সেও এবং যখন আমি তোমাকে গ্রন্থ, প্রগাঢ় জ্ঞান, তওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছি এবং যখন তুমি কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে আমার আদেশে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন আমি বনী-ইসরাঈলকে তোমা-থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে, অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের ছিল, তারা বলল- এটা প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছুই নয়। আর যখন আমি হাওয়ারী (ঈসা সঙ্গী)দের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলতে লাগল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা আনুগত্যশীল।-” (সূরা মায়েদা ১১০-১১১)
শেষনবী মুহাম্মদ সা. সম্পর্কেও ঈসা আ. ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন- “স্মরণ কর! যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলল- হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল- এ তো এক প্রকাশ্য যাদু!” (সূরা সাফ-৬)
সুতরাং ইসা আ. হচ্ছেন বনি ইসরাইলের উদ্দেশ্যে প্রেরিত নবী। তিনি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সা.এর ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছিলেন। চেনার সুবিধার্থে এমনকি নাম ও গুণাগুণ পর্যন্ত বর্ণনা করেছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন- “সেসমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রসূলের, যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের উপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের উপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর উপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই নিজেদের উদ্দেশ্যে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।-” (সূরা আ’রাফ-১৫৭)
সাহাবায়ে কেরাম -নবীজীকে বলেছিলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! নিজের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন! নবীজী বললেন- “পিতা ইবরাহীমের দোয়া এবং ঈসার সুসংবাদ। আমার মাতা যখন আমাকে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন, তখন শামের সম্রাটদের প্রাসাদগুলো উজ্জ্বল প্রত্যক্ষ করেছিলেন।-” (মুসনাদে আহমদ)
ঈসা নবীকে আসমানে উত্তোলন
আল্লাহ পাক বলেন- “এবং কাফেররা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন, বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী। স্মরণ কর! যখন আল্লাহ বলেছিলেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে নিয়ে নেবো এবং তোমাকে নিজের দিকে তুলে নিবো, কাফেরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করে দেবো।-” (সূরা আলে ইমরান ৫৫-৫৬)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন- “(অভিশাপ দিয়েছি ইহুদী জাতিকে) তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি। বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ পাক নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আহলে-কিতাবদের মধ্যে যত শ্রেণী রয়েছে তারা সবাই ঈমান আনবে ঈসার উপর তাদের মৃত্যুর পূর্বে। আর কেয়ামতের দিন তাদের জন্য সাক্ষীর উপর সাক্ষী উপস্থিত হবে।-” (সূরা নিসা ১৫৫-১৫৯)
ইহুদীরা ঈসা আ.-এর বিরুদ্ধে তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসকের কাছে কুৎসা রটিয়েছিল। বিচারে ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার সিদ্ধান্ত হলে ঈসাকে গ্রেফতার করতে বাড়ীতে বাহিনী পাঠানো হয়। নিজ-গৃহে অবরোধকালে ঘুমের মধ্যে ঈসাকে আল্লাহ আসমানের দিকে উঠিয়ে নিয়ে বাহিনীর একজনকে ঈসা সদৃশ বানিয়ে দেন। শত আকুতি সত্তেও লোকেরা তাকে বাদশা’র দরবারে ধরে এনে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে দেয়। অতঃপর ঈসা মছীহ ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন শুনে সাধারণ খৃষ্টানরা ইহুদীদের কাছে আত্মসমর্পন করে। এরপর ইহুদীদের ষড়যন্ত্রে তারা ধীরে ধীরে ভ্রষ্টতার গভীর সাগরে হারিয়ে যায়। আল্লাহ পাক বলেন- “আহলে কিতাবদের সকল শ্রেণী তাদের মৃত্যুর পূর্বে ঈসার উপর ঈমান আনবে”। অর্থাৎ শেষ জমানায় পৃথিবীতে ঈসা আ.-এর আগমণের পর সমকালীন সকল খৃষ্টান মুসলমান হয়ে যাবে। তিনি এসে শুকর হত্যা করবেন, ক্রোশ ভেঙ্গে দেবেন, জিযয়ার বিধান রহিত করবেন। ইসলাম ছাড়া সেদিন কিছুই গ্রাহ্য হবে না।
ঈসা নবীকে মাছীহ- নামকরণের কারণঃ
মাছীহ শব্দের অর্থ- যিনি মুছে দেন বা যিনি অধিক ভ্রমণ করেন।
o যে কোন রোগীকে মুছে দেয়া মাত্রই রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়ে যেত।
o যাকারিয়া আ. তাকে স্পর্শ করে দিয়েছিলেন।
o কেউ বলেন- তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন
o কেউ বলেন- অধিক সত্যবাদী হওয়ায় উনাকে মাছীহ বলা হত।
প্রশ্নঃ ঈসানবীর জীবিত থাকা এবং অন্যান্য নবীদের জীবিত থাকায় কি পার্থক্য? অথচ নবী করীম সা. বলেছেন- “নবীগণ কবরে জীবিত আছেন!!”
উত্তরঃ ঈসানবী সশরীরে আত্মাসহ আসমানে উত্থিত হয়েছেন। এখনো আসমানেই আছেন। মৃত্যুবরণ করেননি। আর অন্যান্য নবীগণ মৃত্যু আস্বাদন করে বরযখী জীবনে চলে গেছেন। প্রত্যেক নবী-ই কবরজগতে এক বিশেষ জীবন লাভ করেন।
ঈসানবী অবতরণের দলিলঃ
শেষ জমানায় দাজ্জালকে হত্যা করতে ঈসানবী আসমান থেকে অবতরণ করবেন। শরীয়তে এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দলিল বিদ্যমানঃ
কোরআনের দলিলঃ
আল্লাহ পাক বলেন- “যখনই মরিয়ম তনয়ের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হল, তখনই আপনার সম্প্রদায় হঞ্জগোল শুরু করে দিল এবং বলল, আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ, না সে? তারা আপনার সামনে যে উদাহরণ উপস্থাপন করে তা কেবল বিতর্কের জন্যেই করে। বস্তুতঃ তারা হল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়। সে তো এক বান্দাই বটে আমি তার প্রতি অনুগ্রহ করেছি এবং তাকে করেছি বনী-ইসরাইলের জন্যে আদর্শ। আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের থেকে ফেরেশতা সৃষ্টি করতাম, যারা পৃথিবীতে একের পর এক বসবাস করত। সুতরাং তা হল কেয়ামতের নিদর্শন। কাজেই তোমরা কেয়ামতে সন্দেহ করো না এবং আমার কথা মান। এটা এক সরল পথ।-” (সূরা যুখরুফ ৭৫-৬১)
উপরোক্ত আয়াতে ঈসানবীকে আল্লাহ কেয়ামতের নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইবনে আব্বাস রা. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- “শেষ জমানায় ঈসা আ.-এর আবির্ভাব হওয়া কেয়ামত ঘনিয়ে আসার নিদর্শন।-” (মুসনাদে আহমদ)
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন- “(ইহুদী জাতি অভিশপ্ত) এ কথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি। বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’লা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আহলে-কিতাবদের মধ্যে যত শ্রেণী রয়েছে তারা সবাই ঈমান আনবে ঈসার উপর তাঁর মৃত্যুর পূর্বে। আর কেয়ামতের দিন তাদের জন্য সাক্ষীর উপর সাক্ষী উপস্থিত হবে।-” (সুরা নিসা ১৫৭-১৫৯)
আবু মালিক রহ. বলেন- “অর্থাৎ ঈসা বিন মারিয়াম আ. আসমান হতে অবতরণের পর সকল খৃষ্টান তাঁর প্রতি ঈমান আনবে।-” (তাফসীরে তাবারী)
ইবনে কাছীর রহ. বলেন- “কোরআনের ভাষ্যমতে- ঈসাকে তারা হত্যা করেনি; বরং ঈসা সদৃশ অন্যজনকে হত্যা করেছে। ঈসাকে আল্লাহ পাক আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। আসমানে তিনি এখনো জীবিত আছেন। কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে পৃথিবীতে অবতরণ করে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর নিশ্চিহ্ন করবেন। জিযয়ার বিধান রহিত করবেন। ইসলাম ছাড়া সেদিন কিছুই গ্রাহ্য হবে না।
হাদিসের দলিলঃ
হুযাইফা বিন উছাইদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “আমরা কেয়ামত প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় নবী করীম সা. এসে জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কি আলোচনা করছ? বললাম- কেয়ামত প্রসঙ্গে আলোচনা করছি। নবীজী বলতে লাগলেন- কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না দশটি (বৃহৎ) নিদর্শন প্রত্যক্ষ করঃ
১) ধূম্র (ধোঁয়া)
২) দাজ্জাল
৩) অদ্ভুত প্রাণী
৪) পশ্চিম দিগন্তে প্রভাতের সূর্যোদয়
৫) ঈসা বিন মারিয়ামের অবতরণ
৬) ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব
৭) ৮) ৯) তিনটি ভূমিধ্বস। প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে এবং আরব উপদ্বীপে।
১০) ইয়েমেনের আদন থেকে উত্থিত হাশরের দিকে তাড়নাকারী অগ্নি।-” (মুসলিম)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত, অচিরেই মরিয়ম-তনয় -সৎ নিষ্ঠাবান বিচারক হিসেবে আসমান থেকে অবতরণ করবেন। ক্রোশ ভেঙ্গে দেবেন, শুকর নিশ্চিহ্ন করবেন, জিযয়ার বিধান রহিত করবেন, কোন কাফের থেকে জিযয়া নেয়া হবে না (ইসলাম ছাড়া কিছুই গ্রাহ্য হবে না) সেদিন ধনৈশ্বর্যের প্রাচুর্য ঘটবে। আল্লাহর জন্য একটি সেজদা সেদিন সারা দুনিয়া অপেক্ষা উত্তম হবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
অপর বর্ণনায়- “আল্লাহর শপথ! মরিয়ম-তনয় -সৎ বিচারক রূপে অবতরণ করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর হত্যা করবেন। জিযয়া রহিত করবেন। দামী সুদর্শন উষ্ট্রীগুলো ছেড়ে দেবেন, কেউ-ই তাতে চরবে না। পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ ও কৃপণতা উঠে যাবে। সম্পদ গ্রহণে ডাকা হবে, কেউ সাড়া দেবে না।-” (মুসলিম)
ক্রেশঃ- ঈসা নবীকে ক্রোশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে বিশ্বাসে খৃষ্টানরা যাকে ধর্মীয় প্রতীক বানিয়েছে।
শুকরঃ- প্রসিদ্ধ জন্তু। ইসলামে এর মাংস বক্ষণ সম্পূর্ণ হারাম। ঈসা নবী এসে শুকর নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দিবেন।
জিযয়াঃ- মুসলিম ভূ-খণ্ডে নিরাপদ বসবাসের স্বার্থে আহলে কিতাব (ইহুদী-খৃষ্টান) কর্তৃক মুসলিম শাসক বরাবর যে টেক্স প্রদান করা হয়, কোরআনের ভাষায় সেটাই জিযয়া। ঠিক যেমন মুসলিম সাধারণ থেকে যাকাত নেয়া হয়। ঈসা নবী অবতরণের পর ইসলাম ছাড়া কিছুই গ্রাহ্য হবে না। এর মাধ্যমে ঈসা নবী তাদেরকে বলপূর্বক মুসলমান বানাবেন- উদ্দেশ্য নয়; বরং সবাই তখন খাঁটি অনুসারী হিসেবে মুসলমান হয়ে যাবে। যে সকল খৃষ্টান ঈসা নবীর পূর্ণ অনুসরণের দাবী করত, তারা যখন ঈসা নবীকে দেখবে এবং তাঁর সাথে কথা বলবে তখন আল্লাহর পুত্র হওয়ার যে ভ্রান্ত বিশ্বাস এতদিন তারা পোষন করে আসছিল, তা প্রত্যাহার করে সঠিক (ইসলামের) বিশ্বাস গ্রহণ করবে। যেমনটি আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন- “আহলে কিতাবের সকল শ্রেণী তাদের মৃত্যুর পূর্বে ঈসার উপর ঈমান আনবে।” অর্থাৎ আসমান হতে অবতরণের পর সমকালীন সকল খৃষ্টান ঈসা নবীর উপর ঈমান এনে সঠিক ধর্মে ফিরে আসবে। যারা ঈমান আনবে না, তাদেরকে হত্যা করা হবে (কাফের হিসেবে ঈসা আ.কে দেখা মাত্রই হয়ত তাদের মরণ হবে, অথবা মুসলমানদের হাতে তাদের মৃত্যু ঘটবে)
অপর বর্ণনায়- “সেদিন একটি মাত্র কালিমার দাওয়াত থাকবে-” অর্থাৎ সেদিন শুধুমাত্র ইসলামের দাওয়াত অবশিষ্ট থাকবে। অন্যসব ধর্মের বিলুপ্তি ঘটবে। না থাকবে হিন্দুধর্ম, না বৌদ্ধ, না ইহুদী, না খৃষ্ট, না শিখ সম্প্রদায় আর না অগ্নিপূজারী।
“একটি মাত্র সেজদা সেদিন সারা দুনিয়া অপেক্ষা উত্তম হবে-” অর্থাৎ ধন সম্পদের আধিক্য এবং কেয়ামত সন্নিকটে বিশ্বাসে কেউ-ই সেদিন দুনিয়া উপার্জনের আশায় ইবাদত ছেড়ে দিতে রাজী হবে না।
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মরিয়ম-তনয় ঈসা -আসমান হতে অবতরণের পর মুসলিম সেনাপতি মাহদী বলবেন- নামাযের ইমামতি করুন! ঈসা নবী বলবেন- না! বরং তুমি-ই নামায পড়াও! তোমাদের একজন অপরজনের ইমাম। আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এটা এক বিরাট সম্মাননা।-”
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মরিয়ম-তনয় ঈসা যার পেছনে নামায আদায় করবেন, সে আমার-ই উম্মতের একজন সদস্য।-” (নুআইম বিন হাম্মাদ)
প্রশ্নঃ ঈসা নবী কি -শরীয়ত প্রণেতা হবেন? নাকি নবী করীম সা.এর শরীয়তের অনুসারী হবেন?
উত্তরঃ এ প্রেক্ষিতে ইমাম সাফারীনী রহ. বলেন-
“সকল উলামায়ে উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে, ঈসা নবী অবতীর্ণ হয়ে মুহাম্মদী শরীয়ত-মতে শাসন করবেন। নতুন শরীয়ত প্রণয়ন করবেন না।-” (লাওয়ামেউল আনওয়ার আলবাহিয়্যা)
সিদ্দীক হাসান খান লিখেন-
“এ ব্যাপারে প্রচুর হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম শাওক্বানী প্রায় ঊনত্রিশটি হাদিস গণনা করেছেন। পাশাপাশি সাহাবায়ে কেরাম থেকেও প্রচুর আছার বর্ণিত হয়েছে। বিষয়টি পৌনঃপুনিকতার স্তরে পৌঁছেছে, যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।-” (আল-ইযাআ)
শেখ আহমদ শাকের বলেন-
“শেষ জমানায় ঈসা নবী অবতরণের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। নবী করীম সা. থেকে অসংখ্য হাদিস এর সাক্ষী হয়ে আছে।-” (তাফসীরে তাবারী)
প্রশ্নঃ ঈসা নবী কি উম্মতে মুহাম্মদীর একজন সদস্য?
উত্তরঃ ঈসা নবী হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল এবং উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণের অন্যতম। আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদা অনেক উঁচু। মে’রাজের রাত্রিতে নবী করীম সা.এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। উম্মতে মুহাম্মদী হয়েই তিনি পৃথিবীতে আসবেন এবং মৃত্যু বরণ করবেন। মদীনার রওজা শরীফে তাঁকে কবরস্থ করা হবে।
মে’রাজের হাদিসে নবী করীম সা. বলেন- “...অতঃপর আমাকে দ্বিতীয় আসমানের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। প্রহরী ফেরেশতাদের কাছে জিবরীল দরজা খোলার অনুমতি চাইলে বলা হল-
o কে?
o জিবরীল!!
o সাথে কে?
o মুহাম্মদ সা.!!
o প্রেরিত হয়েছেন?
o হ্যাঁ...!!
o সুস্বাগতম আপনাদের জন্য..!! অতঃপর দরজা খোলা হলে ইয়াহইয়া এবং ঈসা নবীদ্বয়ের সাক্ষাত মিলল। তারা পরস্পর মামাত-ফুফাত ভাই।
o জিবরীল পরিচয় করিয়ে দিলেন- “উনারা হচ্ছেন ইয়াহইয়া এবং ঈসা। উনাদেরকে সালাম দিন! আমি সালাম দিলাম, উনারা উত্তর দিলেন!!
o উনারা বললেন, খোশ আমদেদ- সৎ নবী এবং সৎ ভাইয়ের জন্য!!” (বুখারী-মুসলিম)
ঈসা নবী অবতরণের বিষয়ে খৃষ্ট ধর্ম বিশ্বাস
খৃষ্ট সম্প্রদায় মনে করে, ঈসা নবী (নাঊযুবিল্লাহ) আল্লাহর পুত্র। ক্রোশবিদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর তিনদিন পর সমাধিস্থল থেকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি (নাঊযুবিল্লাহ) পিতার পাশে বসে আছেন। শেষ জমানায় তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। কোরআনের বরাতে ঈসা নবী ক্রোশবিদ্ধ না হওয়ার বিষয়টি উপরে বর্ণিত হয়েছে।
দু-জন মাছীহ’র আগমন হবে, এ ব্যাপারে সকল আহলে কিতাব একমত
১) দাউদ আ.-এর বংশধর থেকে সত্যের দিশারী মাছীহ। তিনি হচ্ছেন ঈসা আ.।
২) পথভ্রষ্টকারী মিথ্যুক মাছীহ দাজ্জাল। আহলে কিতাবদের মতে সে ইউসুফ আ.-এর বংশধর।
ঈসা নবীকে নিয়ে কতিপয় খৃষ্ট ধর্ম বিশ্বাস ইসলামের সাথে সংঘাতপূর্ণ
১) খৃষ্টানদের বিশ্বাস- ঈসা হচ্ছেন আল্লাহর পুত্র। সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্বাস। সঠিক হচ্ছে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল।
২) খৃষ্টানদের বিশ্বাস- ইহুদী জাতি ঈসাকে ক্রোশবিদ্ধ করে হত্যা করেছে। সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্বাস। সঠিক হচ্ছে, তারা তাঁকে ক্রোশবিদ্ধ করেনি; হত্যাও করেনি।
৩) খৃষ্টানদের বিশ্বাস- ক্রোশবিদ্ধ করে হত্যার তিনদিন পর সমাধিস্থল থেকে আসমানে উঠানো হয়েছে। ভ্রান্ত বিশ্বাস। সঠিক হচ্ছে, হত্যার পূর্বেই তাঁকে আসমানে উঠানো হয়েছে।
যে পরিস্থিতিতে তিনি অবতরণ করবেন
সদ্যই মুসলমান বৃহৎ যুদ্ধে খৃষ্টানদের পরাজিত করে কনষ্ট্যান্টিনোপল শহর বিজয় করেছে। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, অস্ত্রের মাধ্যমে নয়; শুধুমাত্র আল্লাহু আকবার ধ্বনিতেই কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয় হবে। অতঃপর শয়তানের ঘোষণা শুনে সবাই দামেস্কে ফিরে আসবে। এর পরপরই দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। সারাবিশ্ব ভ্রমণ করে সে মহা-ফেতনা ছড়িয়ে দেবে।
অপর বিস্তারিত বর্ণনায়- নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল জলাভূমিতে অবতরণ করলে মদীনায় দু-টি ভূ-কম্পন অনুভূত হবে। আতঙ্কে সকল মুনাফিক মদীনা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের সাথে চলে যাবে। অতঃপর দাজ্জাল শামে এসে মুসলিম বাহিনীকে অবরোধ করবে। মুসলমান সেখানে মহা দুর্ভিক্ষে পতিত হবে। এহেন পরিস্থিতিতে এক মুসলমান বলতে থাকবে- ওহে মুসলমান! তোমরা এভাবে বসে আছ কেন? শত্রুবাহিনী তোমাদের ভূমিতে উপনীত হয়েছে!! জেগে উঠ..!! এখন-ই সময় পুণ্য অর্জনের, এখন-ই সময় শহীদ হওয়ার..!! অতঃপর সকলেই মৃত্যুর উপর বায়আত গ্রহণ করবে। আল্লাহ পাক তাদের সততাকে কবুল করে নেবেন। কিছুক্ষণ পর কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার এসে মুসলমানদের ঢেকে ফেলবে- এমন সময় মরিয়ম তনয় ঈসা আসমান থেকে অবতরণ করবেন। অন্ধকার দূরভীত হলে রণসাজে সজ্জিত অচীন ব্যক্তিকে সবাই দেখতে পাবে। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করবে, কে আপনি? তিনি বলবেন, আমি আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল, আল্লাহর কালিমা এবং প্রেরিত রূহ ঈসা বিন মরিয়ম..!! তোমাদের সামনে তিনটি অপশন রয়েছে-
১) দাজ্জাল ও তার বাহিনীর উপর আল্লাহ আসমানী গযব নাযিল করবেন।
২) তাদেরকে মাটির নিচে ধ্বসে দেবেন।
৩) তাদের অস্ত্র-সস্ত্র নিষ্ক্রিয় করে তোমাদের হাতে তাদের মৃত্যু ঘটাবেন। মুসলমান বলবে- শেষোক্ত অপশনটি-ই আমাদের জন্য অধিক শান্তিদায়ক। সেদিন সুঠাম দেহবিশিষ্ট শক্তিশালী ইহুদী-ও ভয়ে তরবারী উত্তোলনে সক্ষম হবে না। আল্লাহ পাক তাদেরকে নির্মম শাস্তি দেবেন। সেদিন ইহুদীবাদ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ঈসা নবীকে দেখে দাজ্জাল মোমের মত গলতে থাকবে। কিন্তু আল্লাহর নবী ঈসা -দৌড়ে গিয়ে স্ব-হস্তে দাজ্জালকে বর্ষার আঘাতে হত্যা করবেন।”
কোথায়.. কিভাবে.. ঈসা নবী অবতরণ করবেন
দামেস্কের পূর্বাঞ্চলে সাদা মিনারের সন্নিকটে দু’জন ফেরেশতার কাঁধে ভর করে তিনি অবতরণ করবেন। গায়ে দু-টি রঙিন চাদর পরা থাকবে।
ইবনে কাছীর রহ. বলেন- “প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তে সাদা মিনারের কাছাকাছি স্থানে অবতরণ করবেন। তখন নামাযের ইক্বামত হতে থাকবে, তাঁকে দেখে মুসলমান বলবে- হে আল্লাহর নবী! নামাযের ইমামতি করুন! ঈসা নবী বলবেন- না! তুমি-ই পড়াও! ইক্বামত তোমার জন্য দেয়া হয়েছে!!”
ইবনে কাছীর রহ. আরও বলেন- “আমাদের সময় (৭৪১ হিজরী) মিনারটি সাদা পাথরে পুনর্নির্মিত হয়েছে। পূর্বের মিনারটি খৃষ্টানদের অর্থায়নে নির্মিত ছিল। ঈসা নবীর অবতরণস্থল হিসেবে হয়ত আল্লাহ মুসলমানদের হাতে এটি নির্মাণের ফায়সালা করেছেন।-”
১৯৯২ সালে সিরিয়া ভ্রমণকালে পূর্ব দামেস্কের সেই স্থানে গিয়ে সাদা মিনারটি দেখেছিলাম। পরে ছবি-ও তুলে নিয়ে এসেছি। স্থানীয় লোকদের নিকট প্রসিদ্ধ যে, এটি-ই সেই সাদা মিনার যেখানে ঈসা নবী অবতরণ করবেন। কোন মসজিদ ভিত্তিক মিনার নয়; বরং শহরের প্রবেশদ্বারে এটি নির্মিত। এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা-ই খৃষ্টান। বুঝার সুবিধার্থে ছবিটি এখানে দিয়ে দিলাম। ঈসা নবী কি এখানেই অবতরণ করবেন নাকি অন্য কোথাও..!? আল্লাহই ভাল জানেন।
কারো কারো মতে- দামেস্কের উমাভী জামে মসজিদের মিনারের কাছে ঈসা আ. অবতরণ করবেন। আল্লাহ-ই ভাল জানেন..!! নিশ্চিতভাবে কোনটি-ই বলা যায় না।
ঈসা আ. এর দৈহিক গঠন
বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য নবী করীম সা. ঈসা নবীর দৈহিক গঠন পর্যন্ত বর্ণনা করেছেনঃ
o স্বাভাবিক দেহগড়ন। না খাট, না লম্বা।
o শুভ্র ও রক্তিম মাঝামাঝি বর্ণ।
o সুপরিসর বক্ষদেশ।
o স্বাভাবিক ও কোমল কেশ। অবতরণকালে চুল থেকে পানি টপকাচ্ছে মনে হবে, অথচ মাথা সম্পূর্ণ অসিক্ত।
o ঈসা আ. প্রখ্যাত সাহাবী উরওয়া বিন মাসঊদ রা. সদৃশ হবেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মে’রাজের রাত্রিতে আমি -মূসা এবং ঈসার সাথে সাক্ষাত করেছি।” একপর্যায়ে ঈসা আ.-এর দৈহিক বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন- “স্বাভাবিক দেহ। শুভ্র ও রক্তিম মাঝামাঝি বর্ণ। দেখে মনে হচ্ছিল, সদ্যই তিনি গোসল সেরে এসেছেন।-” (বুখারী-মুসলিম)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমি ঈসা, মূসা এবং ইবরাহীম আ.কে দেখেছি। তন্মধ্যে ঈসা হচ্ছেন কিছুটা রক্তিম বর্ণের। স্বাভাবিক চুল। প্রশস্ত বক্ষদেশ.....।-” (বুখারী)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মে’রাজ থেকে প্রত্যাগত হওয়ার পর নিজেকে আমি হজরে আসওয়াদের নিকটে আবিস্কার করলাম। কুরায়েশ আমাকে ভ্রমণের খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করছিল। এক পর্যায়ে তারা বাইতুল মাকদিসের গুণ-প্রকৃতি জিজ্ঞেস করলে আমি প্রচণ্ড ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। অতঃপর আল্লাহ -বাইতুল মাকদিসকে আমার চোখের সামনে ভাসিয়ে দেন। ফলে নিমিষেই তাদের সকলের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকি। সেখানে আমি অনেক নবীদেরকে দেখেছিলাম। মূসাকে নামায পড়তে দেখেছিলাম, হালকা দেহগড়ন ও স্বাভাবিক কেশ। শানুআ গোত্রীয় লোকদের মত দেখাচ্ছিল। ঈসা বিন মারিয়াম নামায পড়ছিলেন, উরওয়া বিন মাসঊদের মত দেখতে। ইবরাহীম আ.-ও সেখানে নামায পড়ছিলেন, ঠিক তোমাদের সাথী (স্বয়ং নবী করীম সা.)র মত। এমন সময় জামাতের সময় হলে আমি নামাযের ইমামতি করলাম। নামায শেষে কে যেন বলল- হে মুহাম্মদ! উনি হচ্ছেন জাহান্নামের প্রহরী! সালাম দিন! আমি তার দিকে তাকালে সে-ই সালামের সূচনা করল...।-” (মুসলিম)
নবী করীম সা. বলেন- “একদা স্বপ্নে কা’বার সন্নিকটে পিঙ্গলবর্ণের সুন্দরতর এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক কেশগুচ্ছ পেছন দিকে ঢেও খেলছিল। দেখে -মাথা থেকে পানি ঝরছে মনে হচ্ছিল। দু-জন ব্যক্তির স্কন্ধে হাত রেখে কা’বা শরীফ তওয়াফ করছিলেন। উনি কে? জিজ্ঞেস করলে- উত্তর আসল -‘ঈসা বিন মরিয়ম-’। ঠিক পেছনে আর-ও একজনকে দেখতে পেলাম। উস্কখুস্ক চুল, ডান চোখে কানা। দেখতে ইবনে কুতন-’এর মত লাগছিল। দু’-জন ব্যক্তির স্কন্ধে ভর দিয়ে সে-ও বাইতুল্লাহ তওয়াফ করছিল। এ কে? জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসল- ‘মাছীহ দাজ্জাল’।-” (বুখারী-মুসলিম)
প্রশ্নঃ ঈসা আ. এবং দাজ্জাল একসাথে কিভাবে? অথচ ঈসা আ.কে দেখা মাত্রই দাজ্জাল মোমের মত গলে যাবে বলা হয়েছে..!? দাজ্জাল কা’বায় কিভাবে ঢুকল? অথচ মক্কা দাজ্জালের জন্য নিষিদ্ধ নগরী।
উত্তরঃ এটা কেবল-ই স্বপ্ন, যা নবী করীম সা.কে দেখানো হয়েছিল। বাস্তবে এমনটি ঘটেনি।
ঈসা আ.-এর জমানায় যা ঘটবে...
দাজ্জাল হত্যা কার্য সম্পাদনার পর যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠিত হবেঃ
o বিশ্বময় পূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সকল ভ্রান্ত মতবাদের অবসান ঘটবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত, অচিরেই সৎ ও নিষ্ঠাবান শাসক হয়ে মরিয়ম-তনয় ঈসা আসমান হতে অবতরণ করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর হত্যা করবেন। জিযয়ার বিধান রহিত করবেন।-” (বুখারী-মুসলিম)
o বিশ্বব্যাপী সত্যের কালেমার বিজয় হবে। ইহুদী খৃষ্টানদের দাবী ভ্রান্ত বিবেচিত হবে। জিযয়ার বিধান রহিত হবে।
o মহা ফেতনার প্রকৃত হোতা দাজ্জাল নিহত হবে।
o ন্যায়, নিষ্ঠা এবং শান্তির জয়-জয়কার হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “নবীগণ সকলেই পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই। মাতা ভিন্ন, কিন্তু ধর্ম এক। ঈসা বিন মরিয়মের সবচে’ কাছাকাছি হলাম আমি। আমার এবং তাঁর মাঝে কোন নবী নেই। অচিরেই সে অবতরণ করবে। তোমরা তাঁকে ভাল করে চিনে নিয়ো!- মাঝারি গড়ন, শুভ্র ও রক্তিম মাঝামাঝি বর্ণ। দু’-টি বর্ণিল চাদরে আবৃত থাকবে। দেখে মনে হবে- মাথা থেকে পানির ফুটা ঝরছে। অতঃপর ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর হত্যা করবেন। জিযয়ার বিধান রহিত করবেন। সকল বিধর্মীকে ইসলামের দাওয়াত দেবেন। তাঁর সময়ে আল্লাহ পাক ইসলাম ছাড়া অন্যসব ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। তাঁর সময়ে দাজ্জাল নিহত হবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ইসলাম সেদিন প্রশান্তচিত্তে ভূমিতে স্থির পাবে। সর্প, ঊট, ষাঁঢ়, নেকড়ে, ছাগল, শেয়াল সব একসাথে ঘুরে বেড়াবে- কেউ কারো ক্ষতি করবে না। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলা করবে, দংশন করবে না। এভাবে চল্লিশ বৎসর চলবে। অতঃপর ঈসা আ. ইন্তেকাল করবেন। মুসলমানগণ তাঁর জানাযায় শরীক হবে।-” (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
o শান্তি ও সচ্ছলতার জয়-জয়কার হবে।
o কুরায়েশ নেতৃত্বের অবসান হবে।
আবু উমামা বাহেলী রা. বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “...অতঃপর আমার উম্মতের মাঝে সৎ নিষ্ঠাবান বিচারকের বেসে ঈসা বিন মরিয়ম অবতরণ করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর হত্যা করবেন। জিযয়া-র বিধান রহিত করবেন। সাদাকা গ্রহণে কেউ তখন আগ্রহী হবে না। ঊট-বকরী পালনে কেউ মনযোগী হবে না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষের বিলুপ্তি ঘটবে। বিষাক্ত প্রাণী থেকে বিষ উঠিয়ে নেয়া হবে। বাচ্চারা সাপের মুখের ভিতর হাত দিয়ে খেলা করবে, কোন ক্ষতি করবে না। কোলের শিশু বাঘের সামনে দৌড়াদৌড়ি করবে, কোন ক্ষতি করবে না। শেয়াল -ছাগলের সামনে কুকুর হয়ে যাবে। পানি যেমন পাত্রভর্তি হয়ে যায়, তেমনি সেদিন পুরো বিশ্ব শান্তিতে ভরে যাবে। চারিদিকে একটি মাত্র কালেমার জয়-ধ্বনি হবে। আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করা হবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহের চির অবসান হবে। কুরায়েশ গোত্র নেতৃত্ব থেকে হারিয়ে যাবে। বিশ্ব সেদিন রূপার পাত্র সদৃশ হবে। পিতা আদম আ.-এর যুগের মত জমিতে ফসল তৈরি হবে। আঙ্গুরের একটি থোকা একাধিক ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করবে। একটি মাত্র ডালিম চার/পাঁচজন তৃপ্তিসহ খাবে। ষাঁঢ়ের মূল্য সেদিন এত...এত... হবে। কয়েক দিরহাম দিয়ে-ই অশ্ব কেনা যাবে।-” (ইবনে মাজা)
o অন্তরীক্ষ থেকে হিংসা বিদ্বেষ উঠে যাবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মাছীহ দাজ্জাল হত্যা-পরবর্তী-কালে আকাশ থেকে পুণ্যময় বারিধারা বর্ষণ হবে। জমিতে প্রচুর ফসলাদি তৈরি হবে। এমনকি সাফা পর্বতের পাথরে কেউ বৃক্ষ রোপন করলে সেখানে-ও অঙ্কুরিত হবে। বাঘের পাশ দিয়ে মানুষ অতিক্রম করবে, কোন ক্ষতি করবে না। সাপ নিয়ে খেলা করবে, কোন ক্ষতি করবে না। কেউ কারো প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও গোস্বা করবে না।-” (দাইলামী, আলবানী সমর্থিত)
o যুদ্ধ-বিগ্রহের চির অবসান হবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “সৎ নিষ্ঠাবান বিচারক হিসেবে ঈসা বিন মরিয়ম পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। শুকর হত্যা করবেন। সর্বত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করবে। (যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য ব্যবহৃত) তরবারী ধান-কাটার কাজে ব্যবহৃত হবে। সকল বিষাক্ত প্রাণী থেকে বিষ উঠিয়ে নেয়া হবে। আকাশ থেকে পুণ্যদ বারি বর্ষিত হবে। ফসলাদিতে জমি ভরে উঠবে। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলা করবে...। ছাগল, শেয়াল, ষাঁঢ়, নেকড়ে এক সারিতে পাশাপাশি চলবে, কেউ কারো ক্ষতি করবে না।-” (মুসনাদে আহমদ)
ঈসা-সঙ্গীদের মর্যাদা
ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার উম্মতের দু-টি দলকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। এক- হিন্দুস্তানে যুদ্ধরত দল। দুই- ঈসা বিন মরিয়মের সঙ্গী-দল।-” (সুনানে নাসায়ী)
ঈসা নবী অবতরণে প্রজ্ঞা
মনে হয়ত প্রশ্ন জাগবে, এত নবী থাকতে শেষ জমানার জন্য ঈসা আ.কে কেন নির্বাচন করা হল?
উলামায়ে কেরাম এক্ষেত্রে একাধিক প্রজ্ঞার কথা বর্ণনা করেছেনঃ
o ইহুদীদের দাবী খণ্ডন করা। কারণ, তারা ঈসা নবীকে হত্যা করেছে বলে মানুষের মাঝে প্রচার করেছিল। ঈসা আ. এসে দাজ্জালের পর ইহুদীদেরকে নির্বিচারে হত্যার আদেশ দেবেন। ইবনে হাজার রহ. এই মতামতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
o শেষ নবীর উম্মতের মর্যাদা ইঞ্জিলে বর্ণিত হয়েছিল। আল্লাহ পাক বলেন- “ইঞ্জিলে তাদের অবস্থা যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে..” (সূরা ফাতহ-২৯)
মর্যাদার কথা শুনে ঈসা নবী সে উম্মতের একজন সদস্য হওয়ার ফরিয়াদ করেছিলেন। আল্লাহ পাক তাঁর ফরিয়াদ কবুল করেছেন। ফলশ্রুতিতে তিনি শেষ জমানায় উম্মতে মুহাম্মদীর একজন নিষ্ঠাবান বিচারক হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন।
o পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া সকল প্রাণী-ই মৃত্যু আস্বাদন করবে- আল্লাহর এই শাশ্বত বিধান সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ঈসা নবী পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, কিন্তু মরণ বরণ করেননি। দাজ্জাল হত্যার পাশাপাশি তাই জীবনের বাকী অংশটুকু পুর্ণ করতে আল্লাহ পাক তাকে দুনিয়াতে পাঠাবেন।
o খৃষ্টানদের ভূয়া বিশ্বাস দূরীকরণ। ঈসা আ. এসে খৃষ্টানদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেবেন। সবাই বুঝতে পারবে যে, এতদিন তারা ভুল বিশ্বাসের উপর ছিল। ইসলাম ছাড়া আল্লাহ -সকল ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।
o পাশাপাশি কালের বিবেচনায় ঈসা আ. এবং মুহাম্মদ সা.-এর মাঝে এক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমনটি নবী করীম সা. বলে গেছেন- “ঈসা বিন মরিয়ম হচ্ছেন আমার সবচে’ কাছের। কারণ, তাঁর ও আমার মাঝে কোন নবী নেই।” এখানে নবীজী নিজেই ঈসাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। তাছাড়া ঈসা আ.-ও মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে স্বজাতিকে সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। তাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার উপদেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন- “স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বললঃ হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমদ। অতঃপর যখন সে (মুহাম্মদ) স্পষ্ট প্রমাণাদী নিয়ে আগমন করল, তখন তারা (ইহুদী) বললঃ এ তো এক প্রকাশ্য যাদু।” (সূরা সাফ-৬)
হাদিসে এসেছে- সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওহে আল্লাহর রাসূল! নিজের সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন! নবীজী বলেছিলেন, আমি পিতা ইবরাহীমের দোয়া এবং ভাই ঈসার সুসংবাদের ফসল।-” (মুসনাদে আহমদ)
ঈসা আ.কে পেলে নবীজী আমাদেরকে তাঁর প্রতি সালাম দিতে বলেছেন
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অচিরেই ঈসা বিন মরিয়ম সৎ নিষ্ঠাবান বিচারক রূপে অবতরণ করবেন। শুকর হত্যা করবেন। ক্রোশ ভেঙে দেবেন। বিশ্বময় এক কালেমার জয়ধ্বনি বেজে উঠবে। তাঁকে পেলে আমার পক্ষ থেকে সালাম দিয়ো! অথবা আমার কথা বলো- সে আমাকে সত্যায়ন করবে।-” বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছিলেন, তাঁকে পেলে তোমরা নবীর পক্ষ থেকে সালাম দিয়ো!” (মুসনাদে আহমদ)
আবূ হুরায়রা-র অপর বর্ণনায় নবী করীম সা. বলেন- “আয়ূ দীর্ঘ হলে ঈসার সাথে সাক্ষাত করতে পারব আশা করি, তবে এর আগেই যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে আমার পক্ষ থেকে তোমরা তাঁকে সালাম জানিয়ে দিয়ো!” (মুসনাদে আহমদ)
অবতরণের পর পৃথিবীতে তাঁর জীবনকাল
ঈসা আ. চল্লিশ বৎসর পৃথিবীতে অবস্থান করবেন। বিশ্বব্যাপী তখন শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়ের জয়-জয়কার হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “নবীগণ সকলেই পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই। মাতা ভিন্ন, কিন্তু ধর্ম এক। ঈসা বিন মরিয়মের সবচে’ কাছাকাছি হলাম আমি। আমার এবং তাঁর মাঝে কোন নবী নেই। ...(দীর্ঘ হাদিসটির শেষে নবীজী বলেন-) চল্লিশ বৎসর সে পৃথিবীতে অবস্থান করে ইন্তেকাল করবে। মুসলমানগণ তাঁর জানাযায় শরীক হবে।-” (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
وإنه لعلم الساعة কোরআানের এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আবু হুরায়রা বলেন- “ঈসা নবী অবতরণ করবেন। চল্লিশ বৎসর তিনি জীবিত থাকবেন। ঐ চল্লিশ -চার বৎসরের মত মনে হবে। তিনি হজ্ব করবেন, উমরা পালন করবেন।”
ঈসা আ. হজ্ব করবেন
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! হজ্ব বা উমরা পালনের উদ্দেশ্যে ঈসা বিন মরিয়ম রাওহা প্রান্তর থেকে “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” বলবেন।-” (মুসলিম)
আবু হুরায়রার অপর বর্ণনায় নবী করীম সা. বলেন- “অবশ্যই ন্যায় নিষ্ঠাবান শাসক রূপে ঈসা বিন মরিয়ম অবতরণ করবেন। হজ্ব বা উমরার উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন পথ পাড়ি দিবেন। (রওজা শরীফে) কবরের পাশে এসে আমাকে তিনি সালাম দিবেন, আমি-ও তাঁর সালামের জবাব দেব।” আবু হুরায়রা বলেন- হে ভাতিজা! তাঁকে পেলে আমার পক্ষ থেকে সালাম জানাবে!” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
মহাপ্রলয় : পর্ব-০৯ (ইশা-আ:)
☼→
মহা প্রলয়
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: