মহাপ্রলয় : পর্ব-০৮ (দাজ্জাল)

কেয়ামতের
বৃহত্তম নিদর্শন
o দাজ্জালের আবির্ভাব
o আসমান হতে ঈসা আ.-এর অবতরণ
o ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব
o তিনটি বৃহৎ ভূমিধ্বস
o পশ্চিম দিগন্তে প্রভাতের সূর্যোদয়
o হাশরের ময়দানের দিকে মানুষকে তাড়নাকারী অগ্নি

ভূমিকা


ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ -দু-ভাগে কেয়ামতের নিদর্শনাবলী বিভক্ত হওয়ার বিষয়টি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৩১ টি ক্ষুদ্রতম নিদর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বাকী রইল বৃহৎ নিদর্শন, যে গুলো সংঘটিত হওয়ার পরপর-ই কেয়ামত আপতিত হবে।
বৃহত্তম নিদর্শনাবলী এক কথায় মাল্য-দানা সদৃশ। মালা ছিড়ে গেলে দানাগুলো যেমন দ্রুত একের পর এক মাটিতে পড়ে যায়, তেমনি বৃহৎ নিদর্শন একটি প্রকাশের পর বাকীগুলো অতিদ্রুত একের পর এক ঘটতে থাকবে। উল্লেখ্য- বৃহৎ নিদর্শনের প্রথমটি হচ্ছে- ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশ।
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “বৃহৎ নিদর্শনগুলো সুশৃঙ্খল মাল্য-দানা সদৃশ। ঠিক যেমন সুতা ছিড়ে যাওয়ার সাথে সাথে দ্রুত সবকটি দানার পতন হয়।-” (মুসনাদে আহমদ)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “একের পর এক বৃহৎ নিদর্শন প্রকাশ -মালার দানা পতনের ন্যায় দ্রুত হবে।-” (তাবারানী)
বৃহৎ নিদর্শন প্রকাশের মাঝে মাঝে আবার ক্ষুদ্র নিদর্শনের-ও প্রকাশ ঘটবে বা বৃদ্ধি পাবে। যেমন, ইমাম মাহদী প্রকাশ পেল অতঃপর কিছু ক্ষুদ্র নিদর্শন প্রকাশ পেল অতঃপর দাজ্জাল প্রকাশ পেল... এভাবে.... (আল্লাহই ভাল জানেন)

বৃহত্তম নিদর্শন (১)




দাজ্জাল
ভূমিকা


আল্লাহ পাক -যখন, যেভাবে, যেখানে, যে নিদর্শনটি ঘটাতে চান, তখন সেভাবে সেখানে সেই নিদর্শনটি-ই ঘটবে।
তন্মধ্যে একটি হচ্ছে দাজ্জাল (المسيح الدجال)...

o কে এই মাছীহুদ দাজ্জাল?
o সে কি বর্তমানে জীবিত?
o ইতিপূর্বে কেউ তাকে দেখেছে?
o তার দৈহিক বৈশিষ্ট্য কি?
o আবির্ভাবের কারণ কি?
o কি সেই মহাক্রোধ?
o কতিপয় ভ্রান্ত প্রচারণা

কে এই দাজ্জাল?
সে আদম সন্তানের-ই একজন। মুমিনদের পরীক্ষার জন্য আল্লাহ পাক তাকে অলৌকিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেবেন। তার দৈহিক ও চরিত্রগত গুণাবলী বর্ণনা করে নবী করীম সা. স্বীয় উম্মতকে তার থেকে বেঁচে থাকার আদেশ করেছেন।

দাজ্জাল সম্পর্কে আমাদের বলতে হবে, কারণঃ
জ্ঞান-ই উত্তোরণের একমাত্র পথ। ফেতনা গ্রাস করে ফেলবে- এই ভয়ে হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা. সবসময় নবীজীর কাছে অনিষ্টকর ফেতনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন।
দাজ্জালের ফেতনাটি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ফেতনা। সকল নবী-রাসূল স্ব স্ব উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করতেন। শেষনবী মুহাম্মদ মুস্তফা সা. তার ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উম্মতকে বারংবার সতর্ক করে গেছেন।
সুতরাং দাজ্জালের বৈশিষ্ট্য, ফেতনা ও বাঁচার উপায় জানা থাকলেই -আল্লাহ পাক আপনাকে আমাকে সকলকে তার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন- ইনশাল্লাহ।

“মাছীহুদ দাজ্জাল-” নামকরণঃ
আরবী ‘মাছীহ’ (مسيح) শব্দের অর্থ- বিকৃত করে দেয়া হয়েছে, মোছে দেয়া হয়েছে এমন। তার বাম চক্ষুটি বিকৃত ও মোছিত হবে। কানা, সবকিছু একচোখে দেখবে।
অনেকে বলেছেন যে, সঠিক শব্দটি আসলে -‘মিছছীহ’ বা -‘মিছছীখ’।
আরবীতে مسح শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে- ঘুরাফেরা করা, ভ্রমণ করা। এ হিসেবে অনেকেই বলেছেন যে, দাজ্জাল যেহেতু সারাবিশ্ব ভ্রমণ করবে, তাই তাকে ‘মাছীহ’ (অতি ভ্রমণকারী) বলা হয়ে থাকে।
কেউ কেউ বলেছেন যে, তার চেহারার এক পার্শ্ব ভ্রু ও চক্ষুবিহীন হবে।
অপরদিকে দাজ্জাল এসেছে আরবী শব্দ দাজাল (دجل) থেকে। যার অর্থ- সত্য ঢেকে দেয়া, ছদ্ম আবরণে লুকিয়ে রাখা, প্রতারিত করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি। দাজ্জাল শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হচ্ছে মহা-মিথ্যুক।

দাজ্জাল কিসের দাবী করবে?
মহা-দুর্ভিক্ষের কালে দাজ্জাল খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এসে বলবে, “আমি হচ্ছি সমগ্র জগতের পালনকর্তা। হে লোকসকল! তোমরা আমার প্রতি ঈমান আন! আমি তোমাদের খাদ্য দেব, পানীয় দেব, সম্পদ দেব, যা চাও- সব দেব”। নবী করীম সা. বলেছেন- “স্মরণ রেখো! দাজ্জাল কিন্তু একচোখে কানা হবে। আর তোমাদের প্রকৃত পালনকর্তা কানা নন!!” (বুখারী)
সামনে আরো বিস্তারিত বিবরণ আসছে ইনশাল্লাহ..।।

ইবনে সাইয়াদ সম্পর্কে দু-টি কথা
নবীযুগে মদীনায় এক ইহুদী-পুত্র ছিল। নাম ছিল ইবনে সাইয়াদ। তার অলৌকিক কর্মকাণ্ডের খবর শুনে নবীজী তাকে দাজ্জাল সন্দেহ করেছিলেন।
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত, একদা উমর রা.-কে সাথে নিয়ে নবীজী ইবনে সাইয়াদের খবর নেয়ার জন্য গমন করলেন। গিয়ে দেখেন- সে ছোট্ট বালকদের সাথে বনী মুগালা’র দূর্গের কাছে খেলাধুলা করছে। সে-সময় ইবনে সাইয়াদের বয়স ১৫ ছুঁই ছুঁই। অজান্তেই পেছনে গিয়ে নবীজী তার পিঠে মৃদু আঘাত করলেন।
o ইবনে সাইয়াদকে নবীজী বললেন- তুমি কি মান যে, আমি হলাম আল্লাহর রাসূল?
o ইবনে সাইয়াদ নবীজীর দিকে তাকিয়ে বলল- আমি আপনাকে মূর্খদের নবী মনে করি। অতঃপর সে পাল্টা নবীজীকে বলতে লাগল- আপনি কি মানেন যে, আমি আল্লাহর রাসূল?
o নবীজী প্রত্যাখ্যানের সুরে বললেন- আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনলাম। বললেন- স্বপ্নে তুই কি দেখিস?
o সে বলল- কখনো সত্যবাদী আবার কখনো মিথ্যাবাদী দেখি।
o নবীজী বললেন- তোর বিষয়টি তো গড়বড় মনে হচ্ছে!! আচ্ছা অন্তরে তোর জন্য একটি কথা লুকিয়েছি, বল তো- সেটা কি?!!
o ইবনে সাইয়াদ বলল- (دخ) ধোঁয়া!
o নবীজী বললেন- দূরে সর! নির্ধারিত সময়ের আগে তুই কিছুই করতে পারবি না!!
o উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে উমর রা. বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! অনুমতি দিন- এক্ষুণি তার মস্তক নামিয়ে দেই!
o নবীজী বললেন- সে-ই যদি প্রকৃত দাজ্জাল হয়, তবে তোমার নয়; ঈসা বিন মারিয়ামের হাতে সে নিহত হবে। আর যদি দাজ্জাল না হয়, তবে অনর্থক হত্যা করেই বা কি লাভ..!!” (মুসলিম)
সালেম বিন আব্দুল্লাহ বলেন- আমি আব্দুল্লাহ বিন উমর রা.কে বলতে শুনেছি- “অতঃপর নবী করীম সা. উবাই বিন কা’বকে সাথে নিয়ে ইবনে সাইয়াদের খেজুর বাগানে গেলেন। বাগানে ঢুকার পর নবীজী খর্জুর কাণ্ডের পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে সামনে এগুতে লাগলেন, ইবনে সাইয়াদ টের পাওয়ার আগেই যেন একা একা বসে সে যা বলছে- শুনতে পান। নবীজী তাকে দেখলেন, সে চাদরের বিছানায় গা এলিয়ে কি যেন ফিসফিস করছে। হঠাৎ তার মা এসে নবীজীকে দেখে বলতে লাগল- ওহে সাফী (ইবনে সাইয়াদের ডাকনাম)! মুহাম্মদ এসে পড়েছে! ইবনে সাইয়াদ সজাগ হয়ে ফিসফিস বন্ধ করে দেয়। তখন নবীজী বলতে লাগলেন- হতভাগী না আসলে আজ-ই প্রকাশ হয়ে যেত (যে, সে দাজ্জাল না অন্য কিছু!)।-” (মুসলিম)
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “মদীনার কোন এক পথে নবীজী, আবূ বকর এবং উমরের সাথে ইবনে সাইয়াদের সাক্ষাত হল।
o নবী করীম সা. তাকে লক্ষ করে বললেন- তুমি কি মান যে, আমি হলাম আল্লাহর রাসূল?
o সে বলল- আপনি কি মানেন যে, আমি-ও হলাম আল্লাহর রাসূল?
o নবীজী বললেন- আমি ঈমান আনলাম- আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানী কিতাবাদীর প্রতি। আচ্ছা- তুই কিছু দেখিস নাকি?
o সে বলল- পানিতে সিংসাহন দেখি।
o নবীজী বললেন- তুই আসলে সমুদ্রে ইবলীসের সিংসাহস দেখিস! আর কিছু দেখিস না?
o আমি অনেক সত্যবাদীর মাঝে একজন মিথ্যুক দেখি অথবা অনেক মিথ্যুকের মাঝে একজন সত্যবাদী দেখি।
o নবীজী বললেন- ধূর..!! গড়বড় মনে হচ্ছে। তাকে ছেড়ে দাও!!” (মুসলিম)
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা আমরা হজ্ব বা উমরা পালনে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সাথে ইবনে সাইয়াদ-ও ছিল। পথিমধ্যে আমরা একস্থানে বিশ্রামের জন্য অবতরণ করলাম। সাথীরা বিভিন্ন প্রয়োজনে দূরে চলে গেল। আমি এবং ইবনে সাইয়াদ শুধু রয়ে গেলাম। সে যেহেতু সন্দেজনক -তাই মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর সে তার মালপত্র আমার মালপত্রের সাথে এনে রাখল। আমি বললাম- প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তাই একসাথে রাখার চেয়ে আলাদা রাখাই ভাল, ওই বৃক্ষের নিচে যদি রাখতে..!! ইবনে সাইয়াদ মালপত্র নিয়ে দূরের বৃক্ষের নিচে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বকরীর দুধের ব্যবস্থা হলে একটি পাত্রে দুধ ভর্তি করে সে আমার জন্য নিয়ে এলো। বলল- পান কর হে আবূ সাঈদ! বললাম- এমনিতেই প্রচণ্ড গরম, তার উপর দুধ পান করলে পেটের অবস্থা বারোটা বেজে যাবে (কোন মতেই আমি তার হাতের দুধ পান করতে চাচ্ছিলাম না)। তখন ইবনে সাইয়াদ বলতে লাগল- হে আবু সাঈদ! আমার ইচ্ছা হয়- লম্বা একটা দড়ি গাছের সাথে ঝুলিয়ে নিজেকে ফাঁস দিয়ে দিই। মানুষের এই আচরণ আমার আর ভাল্লাগে না!! হে আবু সাঈদ! তোমরাই (আনসার সম্প্রদায়) নবী করীম সা.এর হাদিস সম্পর্কে বেশি অবগত। বিশেষ করে তুমি তো নবী করীম সা. থেকে অনেক হাদিস জান!। বল তো- নবীজী কি বলে যান নি- যে, তার (দাজ্জালের) কোন সন্তান হবে না!?/ অথচ মদীনায় আমি সন্তান রেখে এসেছি! নবীজী কি বলেননি- সে (দাজ্জাল) মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না!?? অথচ আমি মদীনা থেকে মক্কায় হজ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি!! আবু সাঈদ বলেন- ইবনে সাইয়াদের এ ব্যথাভরা কথাগুলো শুনে আমি তাকে ক্ষমা-ই করে দিতে চেয়েছিলাম- এমন সময় সে বলতে লাগল- আল্লাহ কসম! অবশ্যই আমি দাজ্জালের জন্মস্থান এবং বর্তমানে সে কোথায় আছে, জানি!! আমি বললাম- কপাল পুড়ুক তোর!!” (মুসলিম)
উলামায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধতম মত হচ্ছে যে, সে প্রকৃত দাজ্জাল নয়। তবে অন্যতম মিথ্যুক। গণক শয়তানেরা তার কাছে সংবাদ সরবরাহ করত। ধারণা করা হয় যে, শেষ জীবনে সে তওবা করে সংশোধিত হয়েছিল। (আল্লাহই ভাল জানেন)
কোরআনে কেন দাজ্জালের আলোচনা আসেনি?
নবী করীম সা. সবচে’ বেশি যে ফেতনাটি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তা হচ্ছে দাজ্জালের ফেতনা। আর তাই প্রত্যেক নামাযের শেষে দাজ্জালের মহাফেতনা থেকে বাঁচার জন্য সাহাবাদেরকে দোয়া শিখিয়েছেন।
কোরআনে কিছু নিদর্শনের উল্লেখ এসেছে, কিছু অনুল্লেখ রয়েছে। যেমন, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ এভাবে বলেছেন- “মহা প্রলয় কাছিয়ে গেছে, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে গেছে।” (সূরা ক্বামার-১) ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভবে বলেছেন- “যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্ধন মুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে-” (সূরা আম্বিয়া-৯৬)। কিন্তু মহাফেতনার নেপথ্য নায়ক ‘দাজ্জাল’-এর বিষয়ে পরিস্কার ভাবে কোরআনে কিছুই বলা হয়নি। কোন প্রজ্ঞা নিহিত?
কয়েকভাবে এর উত্তর দেয়া হয়েছেঃ
১) কোরআনে পরোক্ষভাবে এর উত্তর এসেছে। আল্লাহ পাক বলেন- “যেদিন আপনার পালনকর্তার কোন নিদর্শন আসবে, সেদিন এমন কোন ব্যক্তির বিশ্বাস স্থাপন তার জন্যে ফলপ্রসূ হবে না, যে পূর্বে থেকে বিশ্বাস স্থাপন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোনরূপ সৎকর্ম করেনি-” (সূরা আনআ’ম-১৫৮)। (এর ব্যাখ্যাস্বরূপ) নবী করীম সা. বলেন- “তিনটি নিদর্শন প্রকাশ হয়ে গেলে ব্যক্তির ঈমান কোন উপকারে আসবে না, যতক্ষণ না সে পূর্বে থেকে ঈমান এনে সৎকর্ম জমা করে থাকেঃ ১) দাজ্জাল ২) অদ্ভুত প্রাণী ৩) পশ্চিম প্রান্তে প্রভাতের সূর্যোদয়।-” (তিরমিযী)
২) ঈসা বিন মারিয়াম আ.-অবতরণের কথা-ও কোরআনে পরোক্ষভাবে এসেছে। আল্লাহ পাক বলেন- “আর আহলে -কিতাবদের মধ্যে যত শ্রেণী রয়েছে তারা সবাই ঈমান আনবে ঈসার উপর তার মৃত্যুর পূর্বে।-” (সূরা নিসা-১৫৯)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন- “যখনই মরিয়ম তনয়ের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হল, তখনই আপনার সম্প্রদায় হঞ্জগোল শুরু করে দিল এবং বলল- আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ, না সে? তারা আপনার সামনে যে উদাহরণ উপস্থাপন করে তা কেবল বিতর্কের জন্যেই করে। বস্তুতঃ তারা হল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়। সে তো এক বান্দা-ই বটে আমি তার প্রতি অনুগ্রহ করেছি এবং তাকে করেছি বণী-ইসরাঈলের জন্যে আদর্শ। আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের থেকে ফেরেশতা সৃষ্টি করতাম, যারা পৃথিবীতে একের পর এক বসবাস করত। সুতরাং তা হল কেয়ামতের নিদর্শন। কাজেই তোমরা কেয়ামতে সন্দেহ করো না-” (সূরা যুখরুফ ৫৭-৬১)
আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, দাজ্জাল হত্যার জন্য-ই ঈসা বিন মারিয়াম আ. আসমান হতে অবতরণ করবেন। সুতরাং পরস্পর বিপরীতমুখী একটা উল্লেখের মাধ্যমে অপরটার প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে গেল।

যে সকল হাদিসে দাজ্জাল আবির্ভাবকে কেয়ামতের বৃহত্তম নিদর্শনরূপে চিহ্নিত করা হয়েছেঃ
হুযাইফা বিন উছাইদ গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দশটি (বৃহৎ) নিদর্শন প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে নাঃ ধূম্র, দাজ্জাল, অদ্ভুত প্রাণী, পশ্চিম দিগন্তে প্রভাতের সূর্যোদয়...” (মুসলিম)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের তিনটি নিদর্শন- প্রকাশের পর নতুন কারো ঈমান গ্রাহ্য হবে না, যদি না পূর্বে থেকে ঈমান এনে সৎকর্ম করে থাকে।-” (মুসলিম)

দাজ্জালের ফেতনা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ও সুপরিসর ফেতনা
ইমরান বিন হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আদম আ. সৃজন থেকে নিয়ে কেয়ামত অবধি দাজ্জালের ফেতনা অপেক্ষা বৃহৎ ও সুপরিসর ফেতনা দ্বিতীয়টি হবে না।-” (মুসলিম)
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা নবী করীম সা. মানুষের মাঝে ভাষণ দিতে দাড়ালেন। প্রথমে আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করলেন। অতঃপর দাজ্জালের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন- “আমার পূর্বে যত নবী পৃথিবীতে এসেছেন, সবাই এ সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন, আমিও তোমাদের সতর্ক করছি। তবে দাজ্জাল সম্পর্কে তোমাদের এমন তথ্য দিচ্ছি, যা ইতিপূর্বে কোন নবী দেননিঃ মনে রেখো! দাজ্জাল কানা হবে। কিন্তু আল্লাহ পাক কানা নন।-” (বুখারী)
নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল ছাড়া আর-ও একটি বিষয়ে আমি তোমাদের উপর অতি-শঙ্কিত। তবে দাজ্জাল যদি আমার বর্তমানে বের হয়, তবে তোমাদের হয়ে আমি-ই তার মুকাবেলা করব। আমার পর যদি বের হয়, তবে প্রতিটি মুমিন নিজে-ই তার মুকাবেলা করবে। প্রতিটি মুসলমানের জন্য আল্লাহকে আমি প্রতিনিধি বানিয়ে গেলাম।-” (মুসলিম)
দাজ্জালের পূর্বে বিশ্ব পরিস্থিতি
নাফে’ বিন উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অচিরেই তোমরা আরব উপদ্বীপ যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। অতঃপর পারস্যের (তৎকালীন ইরান) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। অতঃপর রোমানদের (তুরস্ক তথা বাইযাইন্টাইন বাহিনীর) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। পরিশেষে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সেখানেও আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন।-” (মুসলিম)
মুয়ায বিন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “জেরুজালেমে জনবসতি বৃদ্ধি মানে মদীনার বিনাশ। মদীনার বিনাশ মানে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মানে কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয়। কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয় মানে দাজ্জালের আবির্ভাব।-”
দাজ্জাল প্রকাশের পূর্বে মুসলমান এবং রোমান খৃষ্টানদের মধ্যে বড় ধরনের কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হবে। আল্লাহর রহমতে মুসলমানগণ চূড়ান্ত বিজয়ার্জন করবেন।
যি মিখমার রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “রোমান (খৃষ্টান)দের সাথে তোমরা শান্তিচুক্তি করবে। অতঃপর তোমরা এবং তারা মিলে পেছনের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রচুর যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ অর্জন করবে। সম্পদ বন্টন শেষে ফিরতি পথে যখন তোমরা উঁচু ভূমিতে অবতরণ করবে, তখন এক খৃষ্টান ক্রোশ তুলে ধরে -“ক্রোশের বিজয় হয়েছে, ক্রোশের বিজয় হয়েছে-” বলতে থাকলে এক মুসলমান গোস্বায় ক্রোশ ভেঙ্গে ফেলবে। আর তখনই খৃষ্ট সম্প্রদায় চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।”
অপর বর্ণনায়- “অতঃপর মুসলমানরা-ও হাতে অস্ত্র তুলে নেবে। তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হবে। মুসলমানদের ঐ দলটিকে আল্লাহ শাহাদাতের সুমহান মর্যাদায় ভূষিত করবেন।-”
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমক (খৃষ্ট) সম্প্রদায় আ’মাক (মতান্তরে দাবেক) প্রান্তরে (শামের প্রসিদ্ধ হালব শহরের সন্নিকটে একটি স্থান, সেখানেই মহাযুদ্ধটি সংঘটিত হবে) এসে একত্রিত হবে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দামেস্ক শহর থেকে একদল শ্রেষ্ঠ মুসলমান বের হবে। উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলে রোমক সম্প্রদায় বলবে- তোমরা সরে যাও! ধর্মত্যাগীদেরকে আমরা হত্যা করতে এসেছি (বুঝা গেল, এর পূর্বে মুসলিম-খৃষ্ট আরো কতিপয় যুদ্ধ সংঘটিত হবে। মুসলমান সেখানে বিজয়ী হয়ে কিছু খৃষ্টানকে বন্দি করে নিয়ে আসবে। পরবর্তীতে বন্দি খৃষ্টানরা মুসলমান হয়ে মুজাহিদদের কাতারে শামিল হয়ে যাবে) মুসলমান তখন বলবে- (দ্বীনী) ভাইদেরকে কস্মিনকালেও তোমাদের হাতে তুলে দেব না। ফলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এক-তৃতীয়াংশ (মুসলমান) পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাবে, এদের তওবা আল্লাহ কখনো কবুল করবেন না। এক-তৃতীয়াংশ নিহত হয়ে যাবে, আল্লাহর কাছে তারা শ্রেষ্ঠ শহীদের মর্যাদা পাবে। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশকে আল্লাহ মহা-বিজয় দান করবেন, ফেতনা কখন-ই এদের গ্রাস করতে পারবে না। সামনে এগিয়ে তারা কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয় করবে। তরবারীগুলো বৃক্ষের সাথে ঝুলিয়ে যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ বন্টন করতে থাকবে, হঠাৎ শয়তান তাদের মাঝে ঘোষণা করবে- “দাজ্জাল তোমাদের পরিবারগুলোকে ধাওয়া করেছে”। ঘোষণাটি মিথ্যে হলেও মুসলমান যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ মাটিতে ফেলে দিয়ে স্বদেশ অভিমুখে রওয়ানা হবে। শামে ফিরে আসার পর সত্যি-ই দাজ্জাল বের হয়ে আসবে।-”
আবু উমাম বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জালের পূর্বে তিনটি মহা দুর্ভিক্ষময় বৎসর অতিবাহিত হবে। প্রাকৃতিক সকল খাদ্যোপকরণ ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষ প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে পড়ে যাবে। প্রথম বৎসর আল্লাহ আসমানকে এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে এক তৃতীয়াংশ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। দ্বিতীয় বৎসর আল্লাহ আসমানকে দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে দুই তৃতীয়াংশ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। তৃতীয় বৎসর আল্লাহ আসমানকে সম্পূর্ণ বৃষ্টি এবং জমিনকে সম্পূর্ণ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। ফলে এক ফোটা বৃষ্টি-ও বর্ষিত হবে না। একটি শস্য-ও অঙ্কুরিত হবে না। আল্লাহ চাহেন তো মুষ্টিমেয় ছাড়া সকল ছায়াদার বস্তু ধ্বংস-মুখে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে (অর্থাৎ গাছ, পালা ও বৃক্ষকুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে)। ‘সেদিন তাহলে মানুষ কি খেয়ে জীবন ধারণ করবে হে আল্লাহর রাসূল?’ প্রশ্নের উত্তরে নবীজী বললেন- তাকবীর (আল্লাহু আকবার পাঠ) এবং তাহমীদ (আলহামুদিলাল্লাহ পাঠ) মানুষের পাকস্থলিতে খাদ্যের কাজ দেবে।-” (ইবনে মাজা)
রাশেদ বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত, ইস্তাখির (পারস্য রাজাদের বসবাসস্থল ও ধন সম্পদে সর্বোন্নত নগরী) যখন বিজয় হয়, ‘দাজ্জাল বেরিয়ে গেছে, দাজ্জাল বেরিয়ে গেছে’ বলে- এক ঘোষক ঘোষণা করতে থাকলে ইবনে জুছামা তার কাছে এসে বললেন- “চুপ কর! নবী করীম সা.কে আমি বলতে শুনেছি- “দাজ্জাল ততক্ষণ পর্যন্ত বের হবে না, যতক্ষণ না মানুষ তার কথা ভুলে যাবে, মিম্বর থেকে দাজ্জালের আলোচনা উঠে যাবে।”

দাজ্জালের দৈহিক গঠন
o খাট এবং দুই নলার মাঝে যথেষ্ট দূরত্বের দরুন চলনে ত্রুটিযুক্ত।
o চুল অস্বাভাবিক কুকড়ো এবং অগোছালো।
o অত্যাধিক ঘন কেশ বিশিষ্ট।
o আলোহীন ভাসন্ত আঙ্গুরের ন্যায় চোখ। বাম চোখে সম্পূর্ণ কানা।
o অস্বাভাবিক শুভ্র দেহবর্ণ।
o প্রশস্ত কপাল।
o দু’চোখের মাঝামাঝিতে ك ف ر (কাফের) লেখা থাকবে, যা শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মুমিনের দৃষ্টিগোচর হবে।
o আঁটকুড়ে।

এক কথায় দাজ্জাল খাট, বিশাল দেহ, বিশাল মাথা, উভয় চোখে ত্রুটিযুক্ত, ডান চোখটি ভাসমান আঙ্গুর সদৃশ (কানা), বাম চোখে চামড়া, ঘন কুকড়ো ও অগোছালো চুল, সাদা চামড়ার দেহ, দুই নলার মধ্যবর্তী স্থানে যথেষ্ট ফাক এবং দুই চোখের মাঝে ك ف ر (কাফের) লেখা বিশিষ্ট হবে।

প্রকাশ-স্থল
আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “নিশ্চয় দাজ্জাল প্রাচ্যের খোরাছান এলাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। স্থূল বর্ম সদৃশ চেহারা-ধারী কিছু প্রজাতি তার অনুসারী হবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)
দাজ্জালের প্রাথমিক প্রকাশ ও প্রসিদ্ধি (আল্লাহই ভাল জানেন) শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী কোন স্থান থেকে হবে।
নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “সে (দাজ্জাল) শাম এবং ইরাকের মধ্যবর্তী একটি সড়ক থেকে আত্মপ্রকাশ করবে।-” (মুসলিম)
দাজ্জাল ও তার গুপ্তচরের কাহিনী
আমের বিন শুরাহিল থেকে বর্ণিত, তিনি ফাতেমা বিনতে কায়েস রা.-কে বললেন- সরাসরি নবী করীম সা. থেকে শুনেছেন, এমন একটি হাদিস আমাকে শুনান! ফাতেমা রা. বললেন- আমার কাছে সেরকম হাদিস-ই আছে! বর্ণনাকারী বললেন- তাহলে শুনান! বলতে লাগলেন- “একদা মুয়াজ্জিনের ‘-নামায দাড়িয়েছে’- ঘোষণা শুনে মসজিদে গেলাম। পুরুষদের পেছনে মহিলাদের কাতারে দাড়িয়ে নবীজীর ইমামতিতে আমরা নামায আদায় করলাম। নামায শেষে মৃদু হাসি নিয়ে নবীজী মিম্বরে বসলেন।
o বললেন, সবাই নিজ নিজ স্থানে বসে থাক! কিছুক্ষণ পর বললেন- বুঝতে পেরেছ? কি জন্য তোমাদের বসতে বলেছি!!
o সবাই বলল- আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল-ই বেশি জানেন!!
o বললেন- আল্লাহর শপথ! কোন উৎসাহ বা ভীতিপ্রদর্শনের জন্য তোমাদের বসতে বলিনি। তামিম দারী একজন খৃষ্টান ছিল। এখানে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছে। মাছীহ দাজ্জাল সম্পর্কে তোমাদের কাছে যা বলতাম, সে-ও আমাকে সে রকম কিছু কথা শুনিয়েছে। বলেছে- একদা লাখম ও জুযাম গোত্রদ্বয়ের কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে সে সমুদ্র ভ্রমণে বের হয়। অতঃপর সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এক মাস পর্যন্ত ঢেও তাদের নিয়ে খেলা করতে থাকে। অবশেষে একদিন সূর্য প্রস্থানের সময় তাদের জাহাজটি এক অচীন দ্বীপে গিয়ে ভিড়ে। জাহাজ থেকে অবতরণ মাত্রই এক অদ্ভূত প্রাণীর সাথে তাদের সাক্ষাত ঘটে। চুল দিয়ে সারা গা ঢাকা থাকায় সামন-পেছন বুঝা যাচ্ছিল না।
o তারা বলল- কপাল পুড়ুক তোর! কে তুই?
o প্রাণীটি বলল- আমি হলাম গুপ্তচর!
o গুপ্তচর মানে?
o এত কিছু জেনে তোমাদের লাভ নেই! ওই জনশূন্য প্রান্তরে এক ব্যক্তি অধির আগ্রহে তোমাদের অপেক্ষা করছে। যাও! তার সাথে গিয়ে সাক্ষাত কর!
o তামীম বলল- অতঃপর শয়তান মনে করে আমরা তার থেকে কেটে পড়লাম। জনশূন্য প্রান্তরে (দুর্গ সদৃশ) গিয়ে দেখি এক মহা মানব। দু-হাত ঘাড় পর্যন্ত এবং দু-হাটু থেকে পায়ের গিঁঠ পর্যন্ত লোহার শিকলে বাঁধা। এমন সুবিশাল মানব এবং শক্ত বাঁধনযুক্ত ব্যক্তি ইতিপূর্বে কোনদিন আমরা দেখিনি।
o বললাম- ধ্বংস হোক তোর! কে তুই!
o মহা মানব বলল- এসেই যখন পড়েছ! তবে অচিরেই জানতে পারবে। আগে বল- তোমরা কারা?
o আমরা আরব্য জাতি। নৌ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। ঝড়ের কবলে পড়ে দীর্ঘ এক মাস দিকভ্রান্ত থাকার পর অবশেষে জাহাজ এই দ্বীপে এসে ভিড়েছে। জাহাজের নিকটেই আমরা বসেছিলাম। হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রাণীর দেখা মিলল। সে নিজের পরিচয় গোপন রেখে তোর কাছে আসতে বলল। তুই নাকি আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিস!
o মহা মানব বলল- বাইছান এলাকার খেজুর বাগানের কি অবস্থা?
o মানে?
o অর্থাৎ বৃক্ষ গুলি থেকে কি এখনো খেজুর হয়?
o বললাম- হ্যাঁ...!
o অচিরেই খেজুর বন্ধ হয়ে যাবে!
o মহা মানব বলল- বুহাইরা তাবারিয়ার কি অবস্থা?
o মানে?
o সেই লেকে কি এখনো পানি আছে?
o হ্যাঁ..! ওখানে প্রচুর পানি!
o অচিরেই সেই পানি চলে যাবে।
o মহা মানব বলল- যুগার ঝর্ণার কি অবস্থা?
o মানে?
o ঝর্ণায় কি আদৌ পানি অবশিষ্ট আছে? নাকি শুকিয়ে গেছে! স্থানীয় লোকেরা কি চাষাবাদের জন্য ঝর্ণার পানি ব্যবহার করতে পারে?
o হ্যাঁ..! ওই ঝর্ণা থেকে প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়। স্থানীয়রা চাষাবাদে সে পানি ব্যবহার করে থাকে।
o মহা মানব বলল- আরবের শেষনবী সম্পর্কে আমাকে বল! সে কি কি করেছে!!
o বললাম- তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে গেছেন।
o আরব জাতি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি?
o হ্যাঁ...! করেছে।
o ফলাফল কি?
o আশপাশের আরবদের উপর তিনি বিজয়ী হয়েছেন। সবাই তার অনুসরণে এগিয়ে আসছে।
o বাস্তবেই এমনটি হয়ে গেছে!
o হ্যাঁ..!
o তাঁকে অনুসরণের মাঝেই আরবের কল্যাণ নিহিত।
o মহা মানব বলল- আমি এখন নিজের পরিচয় দিচ্ছি। শুন! আমি হলাম মাছীহ দাজ্জাল! অচিরেই আমাকে বাঁধন মুক্ত করা হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনে সারাবিশ্ব ভ্রমণ করব। তবে মক্কা এবং তাইবা-য় আমাকে ঢুকতে দেয়া হবে না। যখনই এলাকাদ্বয়ে ঢুকতে চাইব, তরবারী হাতে ফেরেশতা আমাকে ধাওয়া করবে। সেদিন মক্কা-মদীনার প্রতিটি সড়কে ফেরেশতারা প্রহরী থাকবে।
দীর্ঘ হাদিসটি বর্ণনার পর লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করে নবীজী বলতে লাগলেন- এটাই হচ্ছে তাইবা নগরী, এটাই হচ্ছে তাইবা নগরী, এটাই হচ্ছে তাইবা নগরী (অর্থাৎ মদীনার অপর নাম তাইবা)! আমি কি তোমাদের কাছে স্পষ্টরূপে বর্ণনা করতে পেরেছি?!! সকলেই একবাক্যে বলল- হ্যাঁ..! অতঃপর নবীজী বললেন- দাজ্জাল সম্পর্কে আমি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করতাম, অনেকাংশেই তা তামিমে দারীর ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মনে রেখো! দাজ্জাল হয়ত এখন শামের সাগরে আছে অথবা ইয়েমেনের সাগরে আছে; না..! বরং সে পূর্বদিকে আছে... পূর্বদিকে আছে... পূর্বদিকে আছে...!!! (পূর্বদিকে হাতে ইশারা করছিলেন)।” বর্ণনাকারী ফাতেমা রা. বলেন- নবীজীর এই হাদিসটি আমি উত্তমরূপে স্মরণ রেখেছি!!” (মুসলিম)
কতিপয় লেখক-গবেষক দাজ্জালের অস্তিত্বকে রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন। অথচ বারমুডার রহস্য সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট কিছু প্রকাশিত হয়নি।

বারমুডার প্রকৃত বাস্তবতা এবং দাজ্জালের সাথে এর সম্পর্ক
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনী অনেকাংশেই রূপকথার গল্প সদৃশ।

ভৌগোলিক অবস্থান
পশ্চিম আটলান্টিক সমুদ্রে আমেরিকার প্রসিদ্ধ ফ্লোরিডা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এটি। সুনির্দিষ্টরূপে মাক্সিক উপসাগর থেকে নিয়ে পশ্চিমে লিয়োর্ড দ্বীপ পর্যন্ত। অতঃপর লিয়োর্ড থেকে দক্ষিণে বারমুডা পর্যন্ত প্রায় তিনশ বসবাসযুগ্য ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে অবস্থিত একটি বিশাল সামুদ্রিক এলাকা। বাহামা’র দ্বীপপুঞ্জ-ও এর অন্তর্ভুক্ত।

বারমুডায় -জাহাজ/বিমান নিখোঁজ রহস্য
উত্তর-পশ্চিম আটলান্টিক (সার্জেসো) সমুদ্রের পানিতে (সার্জেসাম) পিণ্ডীভূত প্রচুর স্রোতের সৃষ্টি হয়, যা সমুদ্র-পৃষ্ঠে চলমান জাহাজের গতিরোধ করে। সার্জেসো সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিক প্রশান্ত হওয়ায় সেখানে বাতাসের লেশমাত্রও থাকে না। কতিপয় গবেষক একে আতঙ্ক সাগর বা আটলান্টার সমাধিস্থল বলেও আখ্যায়িত করেছেন। ওখানকার সমুদ্রতলে প্রচুর ডুবন্ত জাহাজ পড়ে থাকার কথাও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিশেষজ্ঞ টীম।

বারমুডায় জাহাজ নিখোঁজ, সূচনাকাল
১৮৫০ সালের দিকে এখানে প্রায় অর্ধশত জাহাজ অদৃশ্য হয়েছিল বলে জানা যায়। এর মধ্যে কতিপয় নাবিক শেষমুহূর্তে কিছু অস্পষ্ট বার্তা-ও প্রেরণে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু এগুলোর অর্থ অদ্যাবধি কেউ বুঝতে পারেনি। অধিকাংশ জাহাজ-ই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সর্বপ্রথম ইনসার্জেন্ট নামক জাহাজ ৩৪০ যাত্রীসহ নিখোঁজ হয়। এর পরপরই ১৯৬৮ সনে স্কোরবিয়ন নামক সাবমেরিন ৯৯ জন বিশেষজ্ঞ সহ অদৃশ্য হয়।

বিমান নিখোঁজ, সূচনাকাল
বারমুডার আকাশে উড্ডয়নরত বিমান হঠাৎ গায়েব। এমন রহস্যপূর্ণ ঘটনাও প্রসিদ্ধ। ১৯৪৫ সালে ফ্লোরিডা এয়ারবিস থেকে ধ্বংসাবশেষ একটি জাহাজের খোঁজে পাঁচটি বিমান আকাশে উড্ডয়ন করে। সবগুলো বিমান কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে উড়ছিল। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেনদের কাছ থেকে এয়ারবিসে কিছু বার্তা-সংকেত প্রেরিত হয়ঃ “-“আমরা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। মনে হয় সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে গেছি। ভূ-পৃষ্ঠ আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কোথায় আছি, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আকাশের কোথাও আমরা হারিয়ে গেছি। সবকিছু কেমন যেন অচেনা এবং অদ্ভুত মনে হচ্ছে। দিক ঠিক করতে পারছি না। সমুদ্রের পানি-ও বিস্ময়কর লাগছে। কিছুই বুঝতে পারছি না...।-” এর পরপরই এয়ারবিসের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এছাড়া আর-ও বহু বিমান গায়েবের ঘটনা সেখানে ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ট্রায়াঙ্গেলের সীমানায় রহস্যময় ঘটনা জন্মের কারণঃ
১) ভূ-কম্পন তত্ত্ব। গবেষণায় জানা গেছে যে, ভূ-কম্পনের দরুন সমুদ্রের তলদেশে প্রচণ্ড ঝড় ও বিশালকায় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, যা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে বড় বড় জাহাজকেও সমুদ্রের গভীরে নিয়ে যেতে সক্ষম। এ সকল শক্তিশালী তরঙ্গের দরুন অনেক সময় আকাশে-ও আকর্ষন শক্তি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিমান গায়েবের মত ঘটনা-ও সহজেই ঘটে যায়।
২) বৈদ্যুতিক চুম্বকতত্ত্ব। কতিপয় গবেষকদের দাবি- বারমুডার আকাশ দিয়ে অতিক্রমকালে বিমানের দিকনির্ধারণ যন্ত্র (কম্পাস) আকস্মিক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ঠিক তেমনি জাহাজের কম্পাসে-ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। বুঝা গেল, সেখানকার পানিতে বিস্ময়কর তড়িৎ চুম্বকাকর্ষণ রয়েছে।

দাজ্জালের আবির্ভাব ঘনিয়ে আসার কিছু প্রাসঙ্গিক লক্ষণ
আরব-জাতি হ্রাস
উম্মে শারীক থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সা.কে বলতে শুনেছেন- “দাজ্জালের ভয়ে মানুষ সুদূর পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেবে। জিজ্ঞেস করলাম- আরব-জাতি সেদিন কোথায় থাকবে হে আল্লাহর রাসূল? নবীজী বললেন- তারা তো সেদিন যৎসামান্য..!!” (মুসলিম)
বিশ্বযুদ্ধ এবং কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয়
মুয়ায বিন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “জেরুজালেমে স্থাপত্য গড়ে ওঠা মদীনা বিনাশের নিদর্শন। মদীনার বিনাশ মানে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মানে কনষ্ট্যান্টিপোল বিজয়। কনষ্ট্যান্টিনোপল বিজয় মানে দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ।-” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
আরো কিছু বিজয়
নাফে’ বিন উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অচিরেই তোমরা আরব উপদ্বীপ যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। অতঃপর পারস্যের (তৎকালীন ইরান) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। অতঃপর রোমানদের (তুরস্ক তথা বাইযাইন্টাইন বাহিনীর) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। পরিশেষে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সেখানেও আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন।-” (মুসলিম)
বৃষ্টি এবং ফসল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে
দাজ্জালের প্রকাশপূর্ব তিন বৎসর মহা-দুর্ভিক্ষ-পূর্ণ হবে।
আবু উমাম বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জালের পূর্বে তিনটি মহা-দুর্ভিক্ষময় বৎসর অতিবাহিত হবে। প্রাকৃতিক সকল খাদ্যোপকরণ ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষ প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে পড়ে যাবে। প্রথম বৎসর আল্লাহ আসমানকে এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে এক তৃতীয়াংশ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। দ্বিতীয় বৎসর আল্লাহ আসমানকে দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে দুই তৃতীয়াংশ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। তৃতীয় বৎসর আল্লাহ আসমানকে সম্পূর্ণ বৃষ্টি এবং জমিনকে সম্পূর্ণ ফসল বন্ধ করে দেয়ার আদেশ করবেন। ফলে এক ফোটা বৃষ্টি-ও বর্ষিত হবে না। একটি শস্য-ও অঙ্কুরিত হবে না। আল্লাহ চাহেন তো মুষ্টিমেয় ছাড়া সকল ছায়াদার বস্তু ধ্বংসের মুখে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে (অর্থাৎ গাছ, পালা এবং বৃক্ষকুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে)। ‘সেদিন তাহলে মানুষ কি খেয়ে জীবন ধারণ করবে হে আল্লাহর রাসূল?’ প্রশ্নের উত্তরে নবীজী বললেন- তাকবীর (আল্লাহু আকবার পাঠ) এবং তাহমীদ (আলহামুদিলাল্লাহ পাঠ) মানুষের পাকস্থলিতে খাদ্যের কাজ দেবে।-” (ইবনে মাজা)

ফেতনার আধিক্য এবং পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. এক দীর্ঘ হাদিসে বলেন- “...অতঃপর সচ্ছলতার ফেতনা, যার ধূম্র আমার পরিবারস্থ দাবীকারী ব্যক্তির পদনিচ থেকে সৃষ্টি হবে। মনে মনে ভাববে, সে আমার খুব কাছের। অবশ্যই নয়। শুধু খোদাভীরু ব্যক্তিরা-ই আমার বন্ধু। অতঃপর পাঁজরের হাড় যেমন নিতম্বের দিকে ঝুকে পড়ে, তেমনি সবাই একজন ব্যক্তির দিকে ঝুকে পড়বে (নেতা হিসেবে মেনে নেবে)। অতঃপর অন্ধকার ফেতনা, ফেতনাটি উম্মতের প্রতিটি সদস্যের গালে চপেটাঘাত করবে। যখনি বলা হবে- শেষ, তখনি আরো বেড়ে যাবে। সে কালে সকালে ব্যক্তি মুমিন থাকবে আর বিকালে কাফের হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত মানুষ দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যাবেঃ (১) ঈমানের দল, যাতে কোন কপটতা থাকবে না। (২) নেফাকের দল, যেখানে কোন ঈমান থাকবে না। এরকম ঘটতে দেখলে ঐ দিন বা পরের দিন দাজ্জাল প্রকাশের অপেক্ষা কর।-” (আবু দাউদ)

প্রায় ত্রিশজনের মত মিথ্যুকের আত্মপ্রকাশ
ছামুরা বিন জুন্দুব রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ত্রিশ জনের মত মিথ্যুকের আত্মপ্রকাশ ঘটে, এদের সর্বশেষ জন হচ্ছে কানা দাজ্জাল। তার বাম চোখটি সম্পূর্ণ মোচ্ছিত হবে।-” (মুসনাদে আহমদ)

দাজ্জাল কিভাবে বের হবে?
তামিমে দারী রা.-এর সাথে দাজ্জাল এবং গুপ্তচরের বাক্যালাপ সম্বলিত হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে, দাজ্জাল কোন এক অচীন দ্বীপে লৌহশিকলে বাঁধা রয়েছে। নবীযুগে সে জীবিত ছিল। বিশাল দেহবিশিষ্ট। প্রায় ত্রিশজন সাথী-সঙ্গী সহ তামীমে দারী রা. দাজ্জালকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কথোপকথনের সময় সে নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে-ই দাজ্জাল। শেষ জমানায় সে বাঁধনমুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।

বের হওয়ার কারণ
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “একদা মদীনার কোন এক গলিতে ইবনে সাইয়াদের সাথে আমার সাক্ষাত ঘটে। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বললে গোস্বায় স্ফীত হয়ে সে বিশাল দেহাকার ধারণ করে। বোন হাফসা রা.-এর ঘরে প্রবেশ করলে তিনি আমাকে ধমকের সুরে বলেন- আল্লাহ তোমার সহায় হোন! ইবনে সাইয়াদকে তুমি উত্যোক্ত করো কেন? তুমি কি জান না যে, নবী করীম সা. বলেছেন- নিশ্চয় দাজ্জাল রাগের বশবর্তী হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।-” (মুসলিম)
ভ্রমণ-গতি
নবী করীম সা.কে দাজ্জালের গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- “বাতাসে তাড়িত মেঘমালার ন্যায়-” (মুসলিম)
দাজ্জাল বিশ্বের প্রতিটি শহরে, প্রতিটি অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছবে।
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দ্বীনের দুরবস্থা এবং চরম মূর্খতা-যুগে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। পৃথিবীতে তার অবস্থান-মেয়াদ হবে চল্লিশ দিন। প্রথম দিনটি এক বৎসর, দ্বিতীয় দিনটি এক মাস, তৃতীয় দিনটি এক সপ্তাহ এবং অবশিষ্ট (৩৭) দিনগুলো স্বাভাবিক দিনের মত হবে। দুই কানের মাঝে চল্লিশ গজের ব্যবধান- এমন গাঁধায় সে আরোহণ করবে। মানুষের কাছে এসে বলবে- “আমি তোমাদের পালনকর্তা!” (অথচ আল্লাহ -কানা নন!) তার দুই চোখের মাঝে ك ف ر (কাফের) লেখা থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মুমিন সেটি পড়তে পারবে। মক্কা-মদীনা ছাড়া প্রতিটি শহরে-প্রান্তরে সে পৌঁছুবে। মক্কা-মদীনার প্রতিটি দরজায় সেদিন আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের সমন্বয়ে প্রহরী নিযুক্ত করবেন।-” (মুসনাদে আহমদ)
যে সকল স্থানে দাজ্জালের আগমন ঘটবে
আনাছ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মক্কা-মদীনা ব্যতীত পৃথিবীর এমন কোন শহর নেই, যেখানে দাজ্জাল গিয়ে পৌঁছবে না।-” (বুখারী-মুসলিম)
অপর বর্ণনায়- “মদীনার দরজায় সবসময় ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। দাজ্জাল এবং মহামারী মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না।-” (বুখারী-মুসলিম)
নবী করীম সা. বলেন- “মদীনার উদ্দেশ্যে পূর্বদিক থেকে দাজ্জাল আসবে, এমনকি উহুদ পাহাড়ের অপর প্রান্তে সে অবস্থান নেবে।-” (বুখারী)
অপর বর্ণনায়- “উহুদ পর্বতের চূড়ায় উঠে মসজিদে নববীর দিকে তাকিয়ে অনুসারীদের বলবে- তোমরা কি ঐ সাদা প্রাসাদটি দেখতে পাচ্ছ? (অর্থাৎ মসজিদে নববী) অতঃপর ফেরেশতারা তার চেহারাকে শামের দিকে ঘুরিয়ে দেবেন। সেখানেই তার বিনাশ ঘটবে।-” (মুসলিম)
মিহজান বিন আদরা’ রা. থেকে বর্ণিত, একদা ভাষণকালে নবী করীম সা. বলছিলেন- “পরিত্রাণ দিবস! পরিত্রাণ দিবস! পরিত্রাণ দিবস!, জিজ্ঞেস করা হল- পরিত্রাণ দিবস কি হে আল্লাহর রাসূল? বললেন- দাজ্জাল এসে উহুদ পর্বতে উঠে মদীনার দিকে তাকিয়ে অনুসারীদের বলবে- তোমরা কি ঐ সাদা প্রাসাদটি দেখতে পাচ্ছ? এটি আহমদের মসজিদ!- অতঃপর মদীনায় ঢুকতে চাইলে প্রবেশপথে তরবারী হাতে ফেরেশতাদের দাড়ানো দেখবে। হতাশ হয়ে -সাবখাতুল জুরুফে গিয়ে স্বজোরে ভূমিতে আঘাত করবে। মদীনায় তখন তিনটি ভূ-কম্পন অনুভূত হবে। সকল পাপিষ্ঠ এবং মুনাফিক সেদিন মদীনা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের সাথে চলে যাবে। সেটাই পরিত্রাণ দিবস!” (মুসনাদে আহমদ)
আরবীতে -“সাবখা-” জলাভূমিকে বলা হয়। সাধারণত মদীনার ভূমিকে সাবখা বলা হয়ে থাকে। তবে মদীনার উত্তর প্রান্তের ভূমির ক্ষেত্রে শব্দটি বেশী প্রয়োগ হয়।
“জুরুফ-” মদীনা থেকে তিন মাইল উত্তরে একটি উপশহর। অনেকেই বলেছেন- শামের সড়ক থেকে ক্বাসাসীন পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকাকেই জুরুফ বলা হয়। ত্বরীক হাজ্জাজ থেকে শামের পথ শুরু, যা মাখীয-এর দিক থেকে জাবালে হাবশীর দিকে এসেছে। বর্তমানে জুরুফকে -বুহাই আল আযহার- বলা হয়ে থাকে। কিন্তু হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী জুরুফ বর্তমান -মাররে ক্বানাত- পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
মোটকথা- উহুদ পর্বতের পেছনে কোন এক জলাভূমিতে দাজ্জাল অবতরণ করে স্বজোরে মাটিতে আঘাত করবে। সেখানে অনেক রক্তিম উপপর্বত রয়েছে। ওখানে গেলে বাস্তবেই নবীজীর ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ হয়ে যায়।
অপরদিকে তামিমে দারীর হাদিসে দাজ্জাল-ও বলেছিলঃ
“আমি হলাম মাছীহ দাজ্জাল! অচিরেই আমাকে বাঁধন মুক্ত করে দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনে সারাবিশ্ব ভ্রমণ করব। কিন্তু মক্কা এবং তাইবা-য় আমাকে ঢুকতে দেয়া হবে না। যখনই এলাকাদ্বয়ে ঢুকতে চাইব, তরবারী হাতে ফেরেশতা আমাকে ধাওয়া করবে। সেদিন মক্কা-মদীনার প্রতিটি সড়কে ফেরেশতারা প্রহরী থাকবে।-”
দাজ্জালের ফেতনা
নমুনা-১
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জালের সাথে স্বরচিত জান্নাত-জাহান্নাম থাকবে। সুতরাং তার জাহান্নাম হবে প্রকৃত জান্নাত এবং জান্নাত হবে প্রকৃত জাহান্নাম।-” (মুসলিম)
অপর বর্ণনায়- “দাজ্জালের সাথে পানি এবং আগুন থাকবে। সুতরাং তার পানি হবে প্রকৃত আগুন এবং আগুন হবে ঠাণ্ডা পানি।-” (বুখারী-মুসলিম)
আরো বলেন- “আমি ভাল করেই জানি, দাজ্জালের সাথে কি থাকবে। তার সাথে দু-টি নদী থাকবে। দেখতে একটিকে সাদা পানি এবং অপরটিকে জ্বলন্ত আগুনের মত মনে হবে। তোমরা যদি দাজ্জালকে পেয়ে যাও, তবে তার আগুনে ঝাপ দিয়ে দিও!!” (মুসলিম)
অপর বর্ণনায়- “চোখ বন্ধ করে আগুনের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে পান করতে থেকো! কারণ, সেটি ঠাণ্ডা পানি।-” (মুসলিম)
নমুনা-২
নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল একদল লোকের কাছে এসে প্রভুত্বের দাবী করবে। লোকেরা তার দাবী মেনে নিলে দাজ্জাল আসমানকে বৃষ্টি দিতে বলবে, আসমান বৃষ্টি বর্ষণ করবে। জমিকে ফসল দিতে বলবে, জমি ফসল উদগত করবে। তাদের গবাদিপশু-গুলি চারণভূমি থেকে মোটাতাজা এবং দুধে পূর্ণ হয়ে ফিরবে। অতঃপর দাজ্জাল অপর একদল লোকের কাছে এসে প্রভুত্বের দাবী করবে। লোকেরা তা প্রত্যাখ্যান করলে তাদের জমিগুলো অনুর্বর হয়ে যাবে, গবাদিপশু-গুলি মরে যাবে। দাজ্জাল মৃত জমিতে গিয়ে বলবে- হে ভূমি! তুমি তোমার গুপ্ত রত্ন-ভাণ্ডার প্রকাশ করে দাও! তখন মৌমাছির ঝাপের মত সকল রত্ন-ভাণ্ডার বের হয়ে আসবে।-” (মুসলিম)

নমুনা-৩
দাজ্জাল বেদুইনের কাছে এসে বলবে- “ওহে বেদুইন! আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিই, তবে আমাকে প্রভু বলে মেনে নিতে তোমার কোন আপত্তি থাকবে? বেদুইন বলবে- না!! অতঃপর দু-জন শয়তান তার পিতা-মাতার আকৃতি ধারণ করে তাকে বলবে- ওহে বৎস! একে অনুসরণ কর! সে তোমার প্রভু!!” (মুস্তাদরাকে হাকিম)

নমুনা-৪
দাজ্জাল এক তরুণকে ডেকে এনে তরবারী দিয়ে দু’-টুকরা করে দেবে। মানুষকে বলবে- ওহে লোকসকল! দেখ, আমার এই হতভাগা বান্দাকে আমি মরণ দিয়েছি, আবার জীবিত করে দেব, এরপর-ও সে মনে করবে, আমি তার প্রভু নই!! অতঃপর দাজ্জাল জীবিত হওয়ার আদেশ দিলে তরুণ জীবিত দাড়িয়ে যাবে। অথচ দাজ্জাল নয়; আল্লাহ-ই তাকে জীবিত করেছেন। দাজ্জাল বলবে- তোমার প্রভু কে? তরুণ বলবে- আমার প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ! আর তুই হচ্ছিস আল্লাহর শত্রু দাজ্জাল!

দাজ্জাল সম্পর্কে কতিপয় ভুল ধারণা
দুর্ভিক্ষ কবলিত দুনিয়ায় সে রুটি এবং খাদ্যের পাহাড় নিয়ে আসবে
মুগীরা বিন শু’বা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “দাজ্জাল সম্পর্কে নবীজীর কাছে আমার থেকে বেশি কেউ জিজ্ঞেস করত না। একবার তিনি বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন- হে মুয়ায! তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? সে তোমার কোন-ই ক্ষতি করতে পারবে না। আমি বললাম- মানুষ মনে করে যে, তার সাথে নদী এবং রুটির পাহাড় থাকবে!? নবীজী বললেন- আল্লাহর কাছে এগুলোর কোন-ই মূল্য নেই।-” (বুখারী-মুসলিম)

দাজ্জালের অনুসারী
কোন সন্দেহ নেই- অলৌকিক সব ক্ষমতা এবং জাদুময় কর্মকাণ্ডের দরুন দাজ্জাল প্রচুর লোককে অনুসারী বানিয়ে ফেলবে। কেউ লোভে, আর কেউ আক্রমণের ভয়ে তার দলে যোগ দেবে। আবার কেউ কেউ ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে তার বাহিনীতে শামিল হবেঃ
১) ইহুদী সম্প্রদায়ঃ
আনাছ বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আসফাহান অঞ্চলের সত্তর হাজার চাদর পরিহিত ইহুদী দাজ্জালের অনুসারী হবে।-” (মুসলিম)
রাজধানী তেহরান থেকে ৩৪০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত মধ্য ইরানের প্রসিদ্ধ একটি প্রদেশ আসফাহান। সরকারী গণনানুযায়ী সেখানে প্রায় ৩০ হাজার ইহুদী বাস করে থাকে। বিস্তারিত জানতে www.iranjewish.com ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “সত্তর হাজার অনুসারী নিয়ে দাজ্জাল খোয ও কিরমান অঞ্চলে অবতরণ করবে। তাদের চেহারা স্ফীত বর্মের ন্যায় দেখাবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
খোযঃ- পশ্চিম ইরানের একটি এলাকার নাম। বর্তমানে একে খোযিস্তান বলা হয়।
কিরমানঃ- দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের প্রসিদ্ধ একটি নগরী।
স্ফীত ঢালঃ- অর্থাৎ ক্ষুদ্র মাথা, সাদা ও গোলাকার চেহারা বিশিষ্ট। গালের মাংস কিছুটা উঁচু। এককথায়- তাদের চেহারা মোটা ও প্রশস্ত হবে।

দাজ্জালের অনুসারী অধিকাংশ-ই ইহুদী, কেন?
উত্তরঃ কারণ, ইহুদীদের ধর্মীয় বিশ্বাস- দাজ্জাল হচ্ছে তাদের প্রতীক্ষিত মাছীহা।
ইহুদীরা মনে করে, আল্লাহ পাক তাদের জন্য দাউদ আ.-এর বংশের একজন বাদশা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে ইহুদীদের বিস্তৃত রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। -মিছিয়াহ- বলে যাকে তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইহুদীদের ধর্মীয় প্রথায় -দাজ্জালের তড়িৎ আগমন প্রত্যাশায় বিশেষ উপাসনা করা হয়। ইহুদীদের পাসোভার উৎসবের রাতে দাজ্জালের কল্যাণ কামনায় বিশেষ প্রার্থণা করা হয়।
ইহুদী ধর্মশাস্ত্র তালমূদে বর্ণিত হয়েছেঃ
“মাছীহের আগমনকালে খাদ্য শস্য এবং পশমের পোশাকে বিশ্ব ভরে যাবে। সেদিন যবের একটি দানা গাভীর বৃহৎ স্তন সদৃশ হবে। সেদিন বিশ্বময় ইহুদী কর্তৃত্ব ফিরে আসবে। সবাই মাছীহকে অনুসরণ করবে। সেদিন প্রত্যেক ইহুদী’র ২৮০০ (দু-হাজার আটশত) করে সেবক থাকবে। জল-স্থল সর্বত্র তার-ই নেতৃত্ব চলবে। তবে অনিষ্টদের শাসনব্যবস্থা সমাপ্ত হলে-ই মাছীহ’র আগমন হবে।”
২) কাফের ও মুনাফিক সম্প্রদায়
আনাছ বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মক্কা-মদীনা ব্যতীত সকল শহরে-ই দাজ্জালের অপতৎপরতা ছড়িয়ে পড়বে। সেদিন শহরদ্বয়ের প্রতিটি সড়কে ফেরেশতাগণ নাঙ্গা-তলোয়ার হাতে পাহারায় থাকবেন। দাজ্জাল -ছাবখা প্রান্তরে এসে উপনীত হলে মদীনায় তিনটি ভূ-কম্পন অনুভূত হবে। ফলে সকল কাফের-মুনাফেক মদীনা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের দলে চলে যাবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
৩) আরব বেদুইন
আবু উমামা থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল বেদুইনের কাছে এসে বলবে- “ওহে বেদুইন! আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিই, তবে আমাকে প্রভু বলে মেনে নিতে তোমার কোন আপত্তি থাকবে? বেদুইন বলবে- না!! অতঃপর দু’-জন শয়তান তার পিতা-মাতার রূপ ধরে তাকে বলবে- ওহে বৎস! একে অনুসরণ কর! সে তোমার প্রভু!!” (মুস্তাদরাকে হাকিম)

৪) স্থূল বর্ম সদৃশ স্ফীত চেহারা বিশিষ্ট সম্প্রদায়
আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “নিশ্চয় দাজ্জাল প্রাচ্যের খোরাছান এলাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করবে। স্থূল বর্ম সদৃশ স্ফীত চেহারা বিশিষ্ট লোকেরা তার অনুসারী হবে।-” (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)
৫) নারী সম্প্রদায়
নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল এসে ছাবখা’র মাররে ক্বানাত ভূমিতে অবতরণ করবে। অধিকাংশ নারী-ই তার কাছে চলে যাবে। আতঙ্কে মুমিন পুরুষ ঘরে গিয়ে মা, মেয়ে, বোন, চাচীকে ঘরের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখবে।-” (মুসনাদে আহমদ)

দাজ্জালের অবস্থানকাল
দাজ্জাল পৃথিবীতে কয়দিন অবস্থান করবে? প্রশ্নের উত্তরে নবী করীম সা. বলেছেন- চল্লিশদিন। প্রথম দিন এক বৎসর, দ্বিতীয় দিন এক মাস, তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের ন্যায় হবে।
হাদিসটি শুনার পর সাহাবায়ে কেরাম দীর্ঘ এই দিনগুলোতে নামায পড়ার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! দীর্ঘ এই দিনগুলোতে একদিনের নামায কি যথেষ্ট হবে ?! নবী করীম সা. বলেছিলেনঃ “না! বরং নামাযের জন্য তখন তোমরা সময় ঠিক করে নিও! (অর্থাৎ দীর্ঘ এক বৎসরের দিনে পূর্ণ এক বৎসরের নামায-ই আদায় করতে হবে, তবে এর জন্য সময় ঠিক করে নেয়া আমাদের দায়িত্ব)।

দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তির উপায়
উপায়-(১) মুখোমুখি অবস্থান থেকে দূরে থাকা।
ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জালের আগমন সংবাদ পেলে তোমরা দূরে পালিয়ে যেয়ো! কারণ, নিজেকে মুমিন ভেবে অনেক মানুষ তার মুখোমুখি হবে, কিন্তু অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে অসহায়ের মত তাকে অনুসরণ করে বসবে।-” (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)
অর্থাৎ সবসময় দূরে অবস্থান করতে হবে, নিজেকে সাহসী ভেবে কাছে যাওয়ার দুঃসাহস করা যাবে না।
উম্মে শারীক রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জালের ভয়ে মানুষ সুদূর পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেবে।-” (মুসলিম)
দাজ্জালের সময় ইমাম মাহদী থাকবেন, দামেস্কে তিনি মুসলমানদের নিয়ে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকবেন।

উপায়- (২) আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করা।
আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “যে ব্যক্তি দাজ্জালের আগুনে নিক্ষেপিত হয়, সে যেন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থণা করে।-” (ইবনে মাজা)
উপায়- (৩) আল্লাহর সিফাতী নামসমূহ মুখস্ত করা
দাজ্জাল হবে কানা। অথচ আল্লাহ কানা নন; বরং আল্লাহ পাক সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

উপায়- (৪) সূরা কাহফ’এর প্রথম দশ আয়াত মুখস্ত করে নিয়মিত পাঠ করা।
আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “যে ব্যক্তি সূরা কাহফ’-এর প্রথম দশ আয়াত মুখস্ত করে নিল, সে দাজ্জাল থেকে রক্ষা পেয়ে গেল।-” (মুসলিম)
সূরা কাহফ’-এর দশটি আয়াত নিম্নরূপঃ
سورة الكهف
بسم الله الرحمن الرحيم
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا (1)قَيِّمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا (2) مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا (3) وَيُنْذِرَ الَّذِينَ قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا (4) مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآبَائِهِمْ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ إِنْ يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا (5) فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا (6) إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا (7) وَإِنَّا لَجَاعِلُونَ مَا عَلَيْهَا صَعِيدًا جُرُزًا (8) أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا (9) إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا رَبَّنَا آتِنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا (10)
অনুবাদ- (১) সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি। (২) একে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ভীষণ বিপদের ভয় প্রদর্শন করে এবং মুমিনদেরকে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে- তাদেরকে সুসংবাদ দান করে যে, তাদের জন্যে উত্তম প্রতিদান রয়েছে। (৩) তারা তাতে চিরকাল অবস্থান করবে। (৪) এবং তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করার জন্যে -যারা বলে যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে। (৫) এ সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও নেই। কত কঠিন তাদের মুখের কথা। তারা যা বলে তা তো সবই মিথ্যা। (৬) যদি তারা এই বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন। (৭) আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে। (৮) এবং তার উপর যা কিছু রয়েছে, অবশ্যই তা আমি উদ্ভিতশূন্য মাটিতে পরিণত করে দেব। (৯) আপনি কি ধারণা করেন যে, গুহা ও গর্তের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? (১০) যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয়গ্রহণ করে তখন দোআ করেঃ হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন। (সূরা কাহফ ১-১০)
নাওয়াছ বিন ছামআন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল এসে পড়লে তোমরা সূরা কাহফ’-এর প্রাথমিক আয়াতগুলো পড়ে নিয়ো!” (মুসলিম)
তাৎপর্য
কতিপয় মুমিন যুবককে আল্লাহ পাক প্রতাপশালী কাফের বাদশার আগ্রাসণ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। উপরোক্ত আয়াতগুলিতে এরই বিবরণ এসেছে।
কেউ বলেন- আয়াতগুলোতে গুহা বাসীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাদের মুক্তির নেপথ্য স্মরণ করে প্রতিটি মুসলমান-ও দাজ্জালের আগ্রাসণ থেকে মুক্তির চেষ্টা করবে।

উপায়- (৫) পূর্ণ সূরা কাহফ’ তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তুলা।
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “যে ব্যক্তি নির্ভুলভাবে সূরা কাহফ পাঠ করল। দাজ্জাল তাকে সামনে পেলেও কোন ক্ষতি করতে পারবে না।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
উপায়- (৬) হারামাইন তথা মক্কা-মদীনায় আশ্রয় নেয়া।
কারণ, দাজ্জাল এলাকাদ্বয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।

উপায়- (৭) নামাযের শেষ বৈঠকে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার দোয়া পড়া।
অর্থাৎ তাশাহুদে সালামের পূর্বক্ষণে হাদিসে বর্ণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়াঃ
اللهم إني أعوذ بك من عذاب جهنم ، ومن عذاب القبر ، ومن فتنة المحيا والممات ، ومن شر فتنة المسيح الدجال.
অনুবাদ- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাচ্ছি, কবরের শাস্তি থেকে আশ্রয় চাচ্ছি, জীবন-মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি এবং দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। (বুখারী-মুসলিম)

উপায়- (৮) দাজ্জালের ফেতনাটি বেশি বেশি প্রচার করা।
সা’ব বিন জুছামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল ততক্ষণ বের হবে না, যতক্ষণ না মানুষ তার আলোচনাকে ভুলে যায়।-” (মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)
অর্থাৎ কেউ তখন দাজ্জালের আলোচনা করবে না। ফেতনার আধিক্যের দরুন তার ব্যাপারটি মানুষ ভুলে যেতে বসবে।

উপায়- (৯) শরীয়তের জ্ঞানকে-ই একমাত্র মুক্তির উপায় মনে করা।
একজন মুমিনের জন্য শরয়ী জ্ঞান-ই সকল ফেতনা হতে বাঁচার রক্ষাকবচ। হাদিসে এমন-ই একজন জ্ঞানী যুবকের দাজ্জালের মুকাবেলা করার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মদীনায় ঢুকতে না পেরে দাজ্জাল পাশের জলাভূমিতে অবতরণ করবে। মদীনার এক উৎকৃষ্ট যুবক তখন দাজ্জালের মুকাবেলায় এগিয়ে যাবে।
o বলবে- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুই হচ্ছিস দাজ্জাল, যার ব্যাপারে নবী করীম সা. আমাদের সতর্ক করে গেছেন।
o দাজ্জাল অনুসারীদের লক্ষ করে বলবে- আমি যদি একে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করে দিই, তবে-ও কি তোমরা আমার ব্যাপারে সন্দেহ করবে?!!
o সবাই একবাক্যে বলবে- না..!! অতঃপর দাজ্জাল যুবকটিকে হত্যা করে পুনর্জীবিত করবে। অপর বর্ণনায়- তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করে দু’-টুকরো করে দেবে। অতঃপর দাজ্জাল তাকে জীবিত হতে বললে যুবকটি হাসিমুখে -আল্লাহু আকবার- বলে জীবিত হয়ে যাবে।
o যুবক বলবে- এবার তো আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়ে গেছে যে, তুই-ই হচ্ছিস দাজ্জাল।
অপর বর্ণনায়- দাজ্জাল বের হলে একজন মুমিন তার মুখোমুখি হতে চাইবে।
o দাজ্জালের অনুসারীরা বলবে- কোথায় যাচ্ছ?
o বলবে- এই অসভ্যটার দিকে যাচ্ছি!!
o তুমি কি আমাদের পালনকর্তায় বিশ্বাস কর না?
o যুবক বলবে- আমাদের পালনকর্তার মধ্যে কোন ত্রুটি নেই!!
o একে হত্যা কর!!
o না...! আমাদের প্রভু-ই তাকে হত্যা করবেন। একথা বলে তাকে দাজ্জালের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। দাজ্জালকে দেখে সে বলতে থাকবে- ওহে লোকসকল! এ হচ্ছে মাছীহ দাজ্জাল, যার ব্যাপারে নবী করীম সা. আমাদের সতর্ক করে গেছেন!! তখন দাজ্জাল তাকে শুয়াতে বলবে-
o তুমি কি আমাকে প্রভু বলে বিশ্বাস করনি?
o তুই হচ্ছিস মিথ্যুক দাজ্জাল!!” একথা শুনে দাজ্জাল করাত দিয়ে যুবকটিকে দু’-টুকরো করে দেবে। দাজ্জাল কর্তিত অংশদ্বয়ের মাঝে দিয়ে হেটে গিয়ে বলবে- দাড়িয়ে যাও!! যুবকটি জীবিত দাড়িয়ে যাবে।
o এবার তুমি আমাকে প্রভু মেনেছ?
o এখন তো আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়ে গেছে! ওহে লোকসকল! আমার পর আর কাউকে-ই সে জীবিত করতে পারবে না। অতঃপর দাজ্জাল তাকে ধরে জবাই করতে চাইলে আল্লাহ পাক যুবকটির কণ্ঠাস্থি থেকে বক্ষ পর্যন্ত তামা বানিয়ে দিবেন। ফলে দাজ্জাল তাকে কিছুই করতে পারবে না। শেষে অপারগ হয়ে তাকে স্বরচিত জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দেবে। মানুষ মনে করবে সে জাহান্নামে। কিন্তু বাস্তবে তাকে জান্নাতে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
অতঃপর নবী করীম সা. বলেন- “এই যুবকটি আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ শহীদের মর্যাদা পাবে।-” (মুসলিম)
উপরোক্ত হাদিসে শরয়ী জ্ঞানের উপকারিতা অনুধাবন করা যায়। যুবকটির কাছে শরীয়ত এবং দাজ্জালের গুণাগুণ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান না থাকলে দাজ্জালের বিরুদ্ধে এত কঠোর অবস্থানে যেতে পারত না। সুতরাং প্রতিটি মুমিনের জন্য পর্যাপ্ত শরয়ী জ্ঞানার্জন আবশ্যক।
সে দাজ্জালকে ভালভাবেই চিনতে পেরেছে। হাদিস অধ্যয়নে সে জেনেছে যে, হাদিসে যুবক বলতে সে-ই উদ্দেশ্য এবং তার পরে দাজ্জাল কাউকেই এমন জীবিত করতে পারবে না।

দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “...মুসলমানগণ তখন চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য কাতারবন্দি হতে থাকবেন। এমন সময় ফজরের ইকামত শুরু হলে আসমান থেকে ঈসা বিন মারিয়াম অবতরণ করবেন...।-” (মুসলিম)
হুযাইফা বিন উছাইদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “...অতঃপর দাজ্জাল মদীনা থেকে জেরুজালেম অভিমুখে রওয়ানা হবে। সেখানে একদল মুসলমানকে সে অবরোধ করে ফেলবে। মুমিনগণ সবদিক দিয়ে সঙ্কটে পড়ে যাবে। তাদের একজন বলবে- তোমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছ?!! যাও!! এই পাপিষ্ঠের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাক!! হয়ত আল্লাহর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়ে যাবে অথবা আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। অতঃপর মুসলমানগণ তুমুল লড়াইয়ের প্রস্তুত হয়ে যাবেন। পরদিন সকালে আসমান হতে ঈসা বিন মারিয়াম অবতরণ করবেন।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
দাজ্জাল সামনে এসে গেলে করণীয়ঃ
আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “...তার দুই চোখের মধ্যবর্তী স্থানে কাফের লেখা থাকবে, সকল মুমিন তা পড়তে সক্ষম হবে। সামনে এসে গেলে তার চেহারায় থুথু মেরে সূরা কাহফ’-এর প্রাথমিক আয়াতগুলো পড়ে নিয়ো! শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে সে হত্যা করে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হবে।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
আবু ক্বিলাবা রা. থেকে বর্ণি, নবী করীম সা. বলেন- “তোমাদের পরে একজন মিথ্যুকের আবির্ভাব হবে। তার চুলগুলো মাথার পেছন দিকে জমাট ও অগোছালো থাকবে। বলবে- আমি তোমাদের প্রভু! সুতরাং যে ব্যক্তি -তুই মিথ্যুক! তুই আমাদের প্রভু নস! বরং আল্লাহ-ই আমাদের প্রভু! আল্লাহর উপর-ই আমরা ভরসা করি, তার দিকে-ই প্রত্যাবর্তন করি, তার কাছেই তোর ফেতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থণা করি!- বলে দেবে, দাজ্জাল তাকে কিছুই করতে পারবে না।-” (মুসনাদে আহমদ)
দাজ্জালের বিনাশ শামে
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “প্রাচ্যের দিক থেকে দাজ্জাল মদীনায় আগ্রাসণের উদ্দেশ্যে আগমন করবে। উহুর পর্বতের পেছনে অবতরণ করা মাত্রই ফেরেশতারা তার চেহারাকে শামের দিকে ঘুরিয়ে দেবেন। সেখানেই তার বিনাশ ঘটবে।-” (মুসলিম)
দাজ্জালের ঘাতক ঈসা বিন মারিয়াম আ.
মাজমা বিন জারিয়া রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঈসা বিন মারিয়াম দাজ্জালকে লুদ শহরের প্রধান ফটকের কাছে হত্যা করবেন।-” (তিরমিযী)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মুসলমান তখন যুদ্ধের জন্য কাতারবন্দি করতে থাকবে, এমন সময় ফজরের ইকামত-কালে ঈসা বিন মারিয়াম অবতরণ করবেন।-”
অপর বর্ণনায়- “দামেস্কের পূর্ব-প্রান্তে সাদা মিনারের কাছে ঈসা বিন মারিয়াম দু-টি রঙিন চাদরে আবৃত হয়ে দু’জন ফেরেশতার কাঁধে ভর করে অবতরণ করবেন। মাথা নিচু করলে টপটপ পানি পড়বে। আবার উঁচু করলে কেশগুচ্ছ সুশোভিত মতি-সদৃশ দৃশ্যমান হবে। কোন কাফেরের শরীরে তাঁর নিশ্বাস পড়া মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।” (যতদূর তাঁর দৃষ্টি যাবে, ততদূর তাঁর নিশ্বাস গিয়ে পৌঁছুবে। অর্থাৎ ঈসা আ.-এর দৃষ্টির মাধ্যমে-ই অর্ধেক শত্রুবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে)।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, মুসলমানগণ ফজরের নামাযের প্রস্তুতি নিবেন। সেনাপতি ইমাম মাহদী নামাযের ইমামতির জন্য সামনে এগিয়ে যাবেন। এমন সময় ঈসা নবীর অবতরণ হবে। ঈসা আ.কে দেখে ইমাম মাহদী পেছনে ফিরে আসতে চাইলে কাঁধে হাত রেখে বলবেন- তুমি-ই নামায পড়াও! তোমার জন্যই ইকামত দেয়া হয়েছে (উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এ এক বিরাট সম্মাননা যে, এত বড় নবী সাধারণ একজন উম্মতীর পেছনে নামায আদায় করছেন)। নামায শেষে বলবেন- দরজা খোল! পেছনে দাজ্জাল এবং সত্তর হাজার ইহুদী অত্যাধুনিক রণসাজে সজ্জিত থাকবে।
ঈসা আ.কে দেখামাত্রই দাজ্জাল -পানিতে লবণের ন্যায় গলে যাবে। পলায়নের উদ্দেশ্যে দৌড় দেবে। ঈসা আ. তার পিছু ধাওয়া করে লুদ এলাকার প্রধান ফটকের কাছে তাকে পেয়ে যাবেন (লুদ হচ্ছে বাইতুল মাকদিসের সন্নিকটে প্রসিদ্ধ এলাকা, ইহুদীরা সেখানে অত্যাধুনিক সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে) সেখানেই তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। ফিরে এসে তিনি বর্ষায় লেগে থাকা দাজ্জালের রক্ত মুসলমানদের দেখাবেন।
অতঃপর ইহুদীদের ধ্বংস-ডংকা বেজে উঠবে। মুসলমান তাদের পিছু ধাওয়া করবে। প্রতিটি বস্তু সেদিন মুসলমানকে ডেকে বলবে- ওহে মুসলিম! আমার পেছনে ইহুদী আত্মগোপন করেছে! এদিকে এসো! একে হত্যা কর! তবে গারকাদ বৃক্ষ মুসলমানদের ডাকবে না, কারণ তা ইহুদীদের রোপিত বৃক্ষ।
অতঃপর ফিরে এসে ঈসা আ. মুসলমানদের চোখের অশ্রু মুছে দেবেন। তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনাতে থাকবেন- এমন সময় আল্লাহ ওহী নাযিল করবেন- ওহে ঈসা! এমন কিছু বান্দাকে আমি দুনিয়াতে প্রকাশ করতে যাচ্ছি, যাদের মুকাবেলা করার শক্তি তোমাদের নেই। সুতরাং মুমিনদেরকে নিয়ে তুমি তূর পর্বতে চলে যাও!!
অর্থাৎ ইয়াজূজ-মাজূজ সম্প্রদায়। বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাল্লাহ।

দাজ্জালের বিরুদ্ধে সবচে’ কঠোর বনী তামীম গোত্র
আবু হুরায়রা রা. বলেন- “নবী করীম সা.এর মুখ থেকে শুনা তিনটি কারণে বনী তামীমকে আমি অত্যন্ত ভালবাসিঃ
১) তারা দাজ্জালের বিরুদ্ধে সবচে’ কঠোর হবে।
২) তাদের সাদাকা আসলে নবীজী বলতেন- এটি আমার (প্রিয়) জাতির সাদাকা।
৩) বনী তামিমের এক মহিলা দাসী আয়েশা রা.-এর অধীনে ছিল। নবীজী বলেছিলেন- হে আয়েশা! একে স্বাধীন করে দাও! সে বনী-ইসমাঈল বংশধর।-” (বুখারী-মুসলিম)
বনী তামীম গোত্রের এক-ব্যক্তি সম্পর্কে নবীজীর দরবারে অভিযোগ করা হলে নবীজী বলতে লাগলেন- “তাদের ব্যাপারে অভিযোগ করো না! কারণ, দাজ্জালের বিরুদ্ধে তারাই সবচে’ যুদ্ধবাজ হবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
প্রত্যাখ্যান
পূর্ববর্তী যুগে কতিপয় ভ্রষ্ট দল বিষয়টি অস্বীকার করেছে। যেমন, মুতাযিলা এবং জাহমিয়া সম্প্রদায়। সম্প্রতি যারা এ তালিকায় নাম লিখিয়েছেনঃ
১) শেখ মুহাম্মদ আব্দু (মিসরের প্রখ্যাত মুফতী, মৃত্যু-১৯০৫)
বলেন- “দাজ্জালের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা, উপকথা ও কল্পকাহিনী বৈ কিছুই নয়।-”
২) মুহাম্মদ ফাহিম আবু আইবা
ইবনে কাছীর রহ. রচিত “কিতাবুল মালাহিম-”এ দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদিসে মন্তব্য করতে গিয়ে লেখেন- “অধিক ফেতনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।-”

৩) কেউ কেউ বলেছেন- “দাজ্জাল আসবে, তবে জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে নয়।-” এর অন্যতম প্রবক্তা হচ্ছেন রশীদ রেজা। যথেষ্ট জ্ঞানী হওয়া সত্তেও এই মাছালায় তিনি ইজতেহাদী ভুল করেছেন।
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ভাষণ প্রদানকালে বলেন- “অচিরেই তোমাদের পর এমন এক জাতি আসবে, যারা প্রস্তরাঘাতে হত্যা-বিচার অস্বীকার করবে। দাজ্জাল, হাশরের ময়দানে নবীজীর সুপারিশ, কবরের আযাব এবং অপরাধী মুমিনকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে দেয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
সবশেষে পাঁচটি কথাঃ
১) আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল থেকেও মারাত্মক একটি বিষয় নিয়ে আমি তোমাদের উপর শঙ্কিত- সেটি হচ্ছে গোপন শিরক। মানুষ নামাযে দাড়াবে। প্রিয় মানুষটি তাকিয়ে আছে ভেবে সুন্দর করে নামায পড়বে।-” (মুসনাদে আহমদ)
রিয়া (আত্মপ্রদর্শন) ঘৃণিত একটি বিষয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে বা প্রশংসা কুড়ানোর আশায় কোন কাজ করাকে-ই রিয়া বলা হয়। আত্মপ্রদর্শনকারীকে কাল কেয়ামতে বলা হবে- যাও! যাকে দেখানোর জন্য দুনিয়াতে এবাদত করতে! তার কাছে যাও! দেখ- প্রতিদান পাও কিনা..!!?? (মুসনাদে আহমদ)
২) আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “দাজ্জাল ছাড়া-ও যে বিষয়টি নিয়ে আমি তোমাদের উপর বেশি শঙ্কিত, সেটি হচ্ছে- পথভ্রষ্টকারী নেতৃবর্গ।-” (মুসনাদে আহমদ)
নবীজী ঠিক-ই বলেছেন, সমাজের তৃণমূল স্তর যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে অধীনস্থরা তো এমনিতেই দুশ্চরিত্র হয়ে যাবে। হাদিসে নেতৃবর্গ বলতে সমাজের সকল স্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উদ্দেশ্য।
৩) ইমরান বিন হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদায় সত্যের কালেমা নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকবে। শত্রুদের বিরুদ্ধে সবসময় তারা বিজয়ী থাকবে। তাদের সর্বশেষ দল-ই দাজ্জালকে হত্যা করবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
৪) ফেতনার সময় দৃঢ়পদে অবিচল থাকা ইসলামের মৌলিক বিষয়। এজন্যই নবী করীম সা. দাজ্জাল ফেতনার আলোচনা-কালে বলতেন- “হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা অবিচল থেকো!!”
তাই ফেতনার সময় মন না ভেঙে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে ইসলামের উপর অবিচল থাকা চাই!!
৫) আরেকটি বিষয় হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, শেষ জমানার সকল যুদ্ধ-ই তীর তলোয়ার এবং অশ্বের মাধ্যমে সংঘটিত হবে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম