বংগভংগ আন্দোলন
এ দুরবস্তার প্রধান কারণ এটাই ছিল যে, পূর্ব বাংলাকে বৃটিশ আমলে কোলকাতার পশ্চাদভূমি (হিন্টারল্যান্ড) বানিয়ে রাখা হয়েছিল। এখানকার চাউল, মাছ, মুরগী, ডিম, দুধ, পাট ও যাবতীয় কাঁচামাল কোলকাতার প্রয়োজন পূরণ হতো। তদুপরি শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি অমুসলিমদেরই কুক্ষিগত ছিল।
ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ও আসামের মুসলমানরা নিজেদের এলাকার ও এর অধিবাসীদের উন্নয়নের প্রয়োজনে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি আলাদা প্রদেশ করার আন্দোলন চালায়, যাতে কোলকাতার শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে এ এলাকাটি উন্নতি করতে পারে। এ দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করে ইংরেজ সরকার ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববংগ ও আসাম এলাকা নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে। ১৯০৬ সালে এ নতুন প্রাদেশিক রাজধানীতে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ সম্মেলনে গোটা ভারতবর্ষের বড় বড় মুসলিম নেতা যোগদান করায় ঢাকার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
বংগভংগ বাতিল আন্দোলন
এ নতুন প্রদেশে মুসলমানদের প্রাধান্য, প্রভাব ও উন্নতির যে বিরাট সম্ভবনা দেখা দিল, তাতে কোলকাতার কায়েমী স্বার্থে তীব্র আগাত লাগল। অমুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ও অন্যান্য পেশাজীবীগণ বাংলা-মায়ের দ্বিখন্ডিত হওয়ার বিরুদ্ধে চরম মায়াকান্না জুড়ে দিলেন। অখন্ড মায়ের দরদে তারা গোটা ভারতে তোলপার সৃষ্টি করলেন।
এ আন্দোলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাসূলে মতো কিছুসংখ্যক মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবী ও শরীক হয়ে অখন্ড বাংলার দোহাই দিয়ে বংগভংগের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েন। এ আন্দোলনের পরিণামে ১৯১১ সালে বংগভংগ রহিত না হতো, তাহলে ১৯৪৭ সালে ঢাকাকে একটি উন্নত প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে এবং চট্টগ্রামকে পোর্ট হিসাবে রেডী পাওয়া যেত। তাছাড়া শিক্ষা ও চাকরিতে মুসলমানরা এগিয়ে যাবার সুযোগ এবং এ এলাকায় শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে উঠত।
মজার ব্যাপার এই যে, ১৯৪৭ সালে গোটা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের প্রবল দাবিতে বৃটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে পশ্চিশবংগকে ভারতের হাতে তুলে দিল। যে অমুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯১১ সালে বংগভংগ রহিত করিয়েছিলেন, তারাই ১৯৪৭ সালে বংগভংগ করিয়ে ছাড়লেন। স্বার্থ বড় বালাই!
পূর্ব বাংলার উন্নয়ন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার পরই পূর্ববাংলার সার্বিক উন্নয়ন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সিভিল, পুলিশ সার্ভিস ইত্যাদিতে মুসলমান অফিসার নিয়োগ শুরো হলো। অগনিত পদে মুসলিম যুবকরা ব্যাপকভাবে চাকরি পেতে লাগল। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীতেও বেশ সংখ্যায় লোক ভর্তি হবার সুযোগ এলো।
অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ময়দানে অমুসলিমদের স্থানে মুসলিমদের অগ্রযাত্রা শুরু হলো। ভারত থেকে হিজরাত করে আসা লোকেরাই অমুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে বিনিময়ের ভিত্তিতে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করল। শিল্প-কারখানার পুঁজি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে মুহাজিররাই এ এলাকার উন্নয়নে লেগে গেল।
যদি পাকিস্তান না হতো এবং আমরা যদি অখন্ড ভারতের অন্তর্ভুক্তই থাকতাম, তাহলে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোন রাস্ট্রের জন্ম হতো না। এ অবস্থায় এ এলাকার মুসলমানদের কী দশা হতো তা কি আমরা ভেবে দেখি? আজ যারা জেনারেল, তাদের কয়জন নন-কমিশন অফিসাররের উপর কোন স্থান দখল করার সুযোগ পেতেন? সেক্রেটারীর মর্যাদা নিয়ে আজ যারা সচিবালয়ে কর্তৃত্ব করছেন, তাদের কতজন সেকশন অফিসারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন? আজ যারা পুলিশের বড় কর্তা, তারা দারোগার বেশি হতে পারতেন কী?
মুসলিম নামের অধিকারী হয়েও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বড় বড় মর্যাদার আসন অলংকৃত করছেন, তাদের কি এ সুযোগ ঘটতো? ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের যে বাহিনী এখন বিদেশ পর্যন্ত বিরাট সুযোগ পাচ্ছেন, তাদের মধ্যে শতকরা কতজন মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়াররিং-এ পড়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন?
বাংলাদেশ এখন যেসব শিল্প-কারখানা রয়েছে পাকিস্তান না হলে তা কি সম্ভব হতো? আজ যারা বড় বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন, তারা মাড়োয়ারীদের দাপটে কি মাথা তুলতে পারতেন?
আজ বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে পরিচিত। পাকিস্তান হয়েছিল বলেই এটুকু পজিশন সম্ভব হয়েছে। তা না হলে আমরা ভারতের একটা প্রদেশের অংশ হয়েই থাকতে বাধ্য হতাম। একটা পৃথক প্রদেশের মর্যাদাও পেতাম না।
কেন সার্বিক উন্নয়ন হলো না?
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পূর্ব বংগের সার্বিক উন্নয়ন না হওয়ার জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারই প্রধানত দায়ী। ইংরেজ চলে যাবার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে যারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করলেন, তাদের মধ্যে পূর্ববপংগের কোন বড় কর্মকর্তা ছিল না। আর পাকিস্তান আন্দোলনের যেসব নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের মধ্যে পূর্ববংগের যারা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তারা এত অনভিজ্ঞ ও দুর্বল ছিলেন যে, পূর্ববংগের উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা করণীয় ছিল তার সামান্য কিছুই আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
বৃটিশ আমলে পূর্ববংগ চরমভাবে অবহেলিত থাকার দরুন এ অঞ্চল শিল্প-বাণিজ্য, সেচ প্রকল্প, বন্দর-সুবিধা, কৃষি-উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, পেশাগত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক অনুন্নত ছিল। এ অবস্থায় পূর্ববংগের উন্নয়নের প্রতি শুরু থেকেই বিশেষ মনোযোগ দেয়া কর্তব্য ছিল। এ কর্তব্য পালন করা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি এখানকার জনগণের এমন আস্থা সৃষ্টি হতো, যা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিক দৃঢ় করতে সক্ষম হতো।
পূর্ববংগের সার্বিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার জন্য শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমাদের নিজেদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতা ঢেকে রাখার যারা চেষ্টা করে আমরা তাদের সাথে একমত নই।
যারা নিজেদের পশ্চাদগামিতার জন্য শুধু অপরকে দোষী সাব্যস্ত করেই আপন দায়-দায়িত্ব শেষ করে, তারা নিজেদের দোষ ও ভুল দেখতে পায় না। তাদের পক্ষে সত্যিকার উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হয় না। পাকিস্তান হবার পর এ এলাকার জনগণের অবস্থার সার্বিক উন্নয়ন না হওয়া এবং যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা দ্রুত না হওয়ার জন্য পাকিস্তানীদের উপর দোষ চাপাবার প্রবণতা এত প্রবল ছিল যে, সব ব্যাপারেই শুধু পশ্চিমের শোষণের দোহাই দেয়া হতো।
নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ন্যায্য অধিকার আদায়ের যোগ্যতা না থাকলে এক মায়ের পেটের ভাই-এর কাছেও ঠকতে হয়। যে ভাই ঠকায়, সে নিশ্চয়ই দোষী।
কিন্তু সে তার স্বার্থ যেমন বুঝে নিচ্ছে, অপর ভাইও যদি নিজের অধিকার আদায় করার যোগ্যতা হয়, তাহলে আর ঠকতে হয় না।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল নি:স্বার্থ, জনদরদী, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। পূর্ব পাকিস্তানের উপর যত অবিচার হয়েছে এর জন্য প্রধানত দায়ী এখানকার ঐসব নেতা, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের শরীক থেকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেননি। বিশেষ করে আইয়ুব আমলে যারা মন্ত্রিত্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পেয়ে গণতন্ত্রের বদলে একনায়কত্বকে সমর্থন করেছিলেন, তারা এদেশের জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাথে সাথে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পংগু করে রাখার জন্যও বিশেষভাবে দায়ী।
নওয়াব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের জন্য যারা শুধু লর্ড ক্লাইভকে গালি দেয়, তাদের সাথে একমত হওয়া যায় না। ক্লাইভ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। মীর জাফরের স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দরুনই যে আমরা পরাধীন হয়েছিলাম, তা থেকে শিক্ষা আজও আমরা নিচ্ছি না। পশ্চিম পাকিস্তানের “ক্লাইভদের” চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের “মীরজাফররাই” যে আমাদের অবনতির জন্য অধিকতর দায়ী, সে কথা উপলব্ধি না করার ফলে আজও আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
নি:স্বার্থ নেতৃত্বের অভাব
সত্যিকার আদর্শবান, নি:স্বার্থ, জনদরদী, চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব দূর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে পারে না। আমাদের দেশে কোন পলিটিকেল সিস্টেম গড়ে ওঠার লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এখানে রাজনীতি করা মানে যে-কোন উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা। দলীয় নেতৃত্বের আসন দখল রাজনৈতিক দল গঠনের একমাত্র লক্ষ্য। ঐ আসন বেদখল হয়ে গেলে দল ভেংগে হলেও নেতা হবার নীতি এদেশে প্রচলিত হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের শ্লোগান আমাদের দেশে একনায়করাই বেশি জোর দিয়ে থাকে। কারণ, রাজনৈতিক পরিবেশ আছে বলেই সেনাপতিরাও ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করার ডাক দিলে গণতন্ত্রের বহু তথাকথিত ধ্বজাধারী একনায়ককেই গণতন্ত্রের নায়ক হিসাবে মেনে নেয়।
নি:স্বার্থ নেতৃত্বে থাকলে জনগণের সব অধিকারই অর্জন করা সম্ভব হতো। আর ঐ জিনিসের অভাব থাকায় বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।
নি:স্বার্থ নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন:
১। নিষ্ঠার সাথে গণতন্ত্রের আদর্শ মেনে চলার অভ্যাস।
২। সরকারী ও বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন।
৩। দেশ শাসনের উদ্দেশ্যে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলবার ব্যবস্থা।
৪। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান।
৫। যারা বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে, তাদেরকে গণতন্ত্রের দুশমন মনে করা এবং তাদের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করা।
1 comments:
sss