অধ্যায় ০৫ : স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি

স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি

স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব যারা ছিলেন, তারা সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজুদ্দীনের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালিত হয়। ছাত্র জীবনে আমি তাদের সমসমায়িক ছিলাম।

পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কত বলিষ্ঠ ছি আমি এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মুসলিম জাতীয়তা পতাকাবাহী হিসাবেই তারা ভারতীয় কংগ্রেসের ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। গান্ধী ও নেহেরুর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতে আকটিমাত্র রাষ্ট্র কায়েমের কংগ্রেসী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

তাঁরা ছিলেন তখন তরুণ ছাত্রনেতা। তাঁরা মুসলিম লীগ নেতা শহীদ সোহরায়ওয়ার্দীর ভক্ত ও অনুরুক্ত হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলনে সাক্রিয় ছিলেন। গোটা বংগদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এবং কংগ্রেসের দাবি মেনে নিয়ে বৃটিশ শাসকরা পশ্চিম বংগকে পূর্ববংগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতে শামিল করার ফলে পূর্ববংগে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কায়েম হতে পারেনি।

অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগে দুটো গ্রুপ ছিল। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জনাব আবুল হাশেম এবং অপর গ্রুপের নেতা ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দীন ও জনাব নুরুল আমীন। বংগদেশ বিভক্ত না হলে হয়ত সোহরাওয়ার্দীই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। পশ্চিম বংগ আলাদা হবার ফলে পূর্ববংগে খাজা নাজিমুদ্দীন গ্রুপের হাতেই ক্ষমতা আসে। শেখ মুজিব ও জনাব তাজুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের অন্তুর্ভুক্ত ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন নাজিমুদ্দীন গ্রুপের প্রতি বিরূপ ছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব কোলকাতায়ই রয়ে গেলেন বলে তারা নেতৃত্বহীন অবস্থায় পড়ে গেলেন। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এসে এ গ্রুপের নেতৃত্বের অভাব পূরণ করেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে মুসলিম লীগের বিকল্প দল গঠন করেন। এভাবে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দ্বারাই সরকার বিরোধী দল গঠিত হয়।

সরকারের ভ্রান্তনীতি

পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবাহনী সরকারি ও বিরোধী দলে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার যদি ইসলামী আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় দিতেন, মুসলিম জাতীয়তাকে শুধু শ্লোগান হিসাবে ব্যবহার না করতেন, গণতান্ত্রিক নীতি মেনে চলতেন এবং অর্থনৈতিক ময়দানে ইনসাফের পরিচয় দিতেন, তাহলে জাতিকে যে ধরনের সংকটের মুকাবিলা করতে হয়েছে তা সৃষ্টি হত না। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার সকল ক্ষেত্রেই ভ্রান্তনীতি অবলম্বন করে দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেন।

রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে

পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ পূর্ববংগের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করতে অস্বীকার করা এবং বাংলাভাষীদের উপর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেবার ভ্রান্তনীতিই সর্বপ্রথম বিভেদের বীজ বপন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীরা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেনি। তারা উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবি জানিয়েছিল।

এ দাবি জানাবার আগেই জনসংখ্যার বিচারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করা সমরকারের কত্যব্য ছিল। অথচ দাবি জানাবার পর এটাকে ‘প্রাদেশিকতা’ বলে গালি দিয়ে সরকার সংগত কারণেই বাংলাভাষীদের আস্থা হারালেন। ভাষার দাবীটিকে সরকার এমন রাষ্ট্রবিরোধী মনে করলেন যে, গুলি করে ভাষা আন্দোলনকে দাবিয়ে দিতে চাইলেন এ ভ্রান্ত সিদ্ধান্তই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার জন্ম দেয়।

গণতন্ত্রের প্রশ্নে

গণতান্ত্রিক পন্থায় পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্ত্বেও সরকার অগণতান্ত্রিক পদ্ধটিতে টিকে থাকার ষড়যন্ত্র করলেন। শাসনতন্ত্র রচনায় গড়িমসি করে নির্বাচন বিলম্বিত করতে থাকলেন। ১৯৫৪ সালে পুর্বাঞ্চলে প্রাদেশিক নির্বাচনে সরকারি মুসলিম লীগ দলের ভরাডুবির পর কেন্দ্রে ষড়যন্ত্র আরও গভীর হয়। পরিণামে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারী হয়।

আইয়ুব খান গণতন্ত্র হত্যা করার এক অভিনব উপায় আবিষ্কার করলেন। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে জনগণকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় এবং আসল ক্ষমতা আইয়ুব খানের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে, আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয় এবং এর পরিণামে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। আইয়ুব খানের দশ বছরের শাসনকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব দ্রুত বেড়ে যায়।

অর্থনৈতিক ময়দানে

শাসন ক্ষমতায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এবং ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার দরুন শিল্প ও বাণিজ্য নীতি প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার হওয়া স্বাভাবিক ছিল না। মন্ত্রিসভায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে গণপ্রতিনিধি গ্রহণ করার পরিবর্তে সুবিধাবাদীদেরকেই গ্রহণ করা হতো। এর ফলে অর্থনৈতিক ময়দানে পুর্ব পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে অক্ষম হতেন। এভাবে গণতান্ত্রিক সরকারের অভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অর্থনৈতিক দিক থেকেও আস্থা হারাতে থাকে।

ভুট্টো-ইয়াহইয়া ষড়যন্ত্র

উপর্যুক্ত কারণসমূহ স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করলেও ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি এবং অবশেষে দমনমূলক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণই এ আন্দোলনের জন্ম দেয়। নির্বাচনের পর জামায়অতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমি বার বার সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার দাবী জানিয়েছি। জেনারেল ইয়াহইয়া ভুট্টোর দাবী মেনে নিয়ে ১লা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ড অধিবেশন মুলতবী করায় চরম রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়।

১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ইয়াহইয়া-মুজিব সংলাপে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার মহল্লায় তাঁর এক আত্মীয়েরে বাড়িতে অবস্থান করতেন। ছাত্রজীবনের বন্ধু হিসাবে তাঁর সাথে যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এর সুযোগে তার কাছ থেকে সংলাপের যেটুকু রিপোর্ট পেতাম, তাতে আমার এ ধারণাই হয়েছে যে, সংলাপ ব্যর্থ হবার জন্য ভুট্টোই প্রধানত দায়ী এবং ইয়াহইয়া খান দ্বিতীয় নম্বর দোষী।

নির্বাচনের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে আওয়ামী লীগের হাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব অর্পিত হতো। সে অবস্থায় পরিস্থিতির চিত্র ভিন্নরূপ হতো। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকায় রাজনৈতিক সমস্যা অবশ্যই দেখা দিত। কিন্তু ৭১-এ যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হলো তা থেকে অবশ্যই রক্ষা পাওয়া যেত। শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের মাধ্যমেই হয়ত এক সময় দেশ বিভক্ত হবার প্রয়োজন হয়ে পড়ত। ঐ অবস্থায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হতো না।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম