জিহাদের গুরুত্ব
ইতিপূর্বে বিভিন্ন পুস্তিকায় দ্বীন, শরীয়ত ও ইবাদাত প্রভৃতি ইসলামী পরিভাষা সমূহের বিস্তারিত অর্থ লিখিত হয়েছে ৷ এখানে প্রসঙ্গতঃ তার দিকে সামান্য ইংগিত করাই যথেষ্ট হবে ৷
'দ্বীন' অর্থ আনুগত্য করা,
আইনকেই বলা হয় শরীয়ত
ইবাদত অর্থ বন্দেগী ও দাসত্ব ৷
আপনি কারো আনুগত্য স্বীকার করলে এবং তাকে নিজের শাসক ও বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিলে তার অর্থ এই হবে যে, আপনি তার 'দ্বীন' গ্রহণ করেছেন ৷ পরন্তু আপনি যখন তাকে নিজের বিধান দাতা হিসেবে স্বীকার করলেন এবং কার্যতঃ আপনি তার প্রজা হলেন তখন তাঁর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর নির্ধারিত নিয়ম-পন্থা আপনার জন্য আইন কিংবা শরীয়তের মর্যাদা পেল ৷ এমতাবস্থায় আপনি তার 'শরীয়ত' অনুযায়ী জীবন যাপন করেন, তিনি যা কিছুর দাবী করেন আপনি তা পূরণ করেন, তার প্রত্যেকটি হুকুম আপনি পালন করেন, তার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকেন, যে সীমার মধ্যে থেকে আপনার কাজ করা তিনি সঙ্গত ঘোষণা করবেন, সেই সীমার মধ্যে থেকে আপনি কাজ করতে থাকেন, শুধু তাই নয়, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ, কাজ-কর্ম, আত্মীয়তা-শত্রুতা ও মামলা-মোকদ্দমা সব কিছুই তার নির্দিষ্ট নিয়ম-বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করেন ৷ তারই মত ও ফয়সালাকে চূড়ান্ত বলে মনে করেন ও তার সামনে মাথা নত করেন, কাজেই আপনার এ আচরণকে তার ইবাদাত বা বন্দেগী বলে অভিহিত করা যাবে ৷
এ বিশ্লেষণ থেকে সুস্পষ্টরূপে বুঝা গেল যে, দ্বীন মূলতঃ রাষ্ট্র সরকারকেই বলা হয়, শরীয়ত হচ্ছে এর আইন এবং এর আইন ও নিয়ম-প্রথা যথারীতি মেনে চলাকে বলা হয় ইবাদাত ৷ আপনি যাকেই শাসক ও নিরংকুশ রাষ্ট্র-কর্তা রূপে মেনে তার অধীনতা স্বীকার করবেন, আপনি মূলতঃ তারই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হবেন ৷ আপনার এ শাসক ও রাষ্ট্র-কর্তা যদি আল্লাহ্ হন তবে আপনি তাঁর দ্বীনের অধীন হলেন, তিনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হন, তবে বাদশাহর 'দ্বীন'কেই আপনার কবুল করা হবে ৷ বিশেষ কোন জাতিকে এ মর্যাদা দিলে সেই জাতিরই 'দ্বীন' গ্রহণ করা হবে ৷ আর আপনার নিজের জাতি বা নিজ দেশের জনগণকে সেই অধিকার দিলে জনগণের 'দ্বীন'কেই আপনি গ্রহণ করলেন ৷ মোটকথা, যারই আনুগত্য করবেন, প্রকৃতপক্ষে আপনি তারই 'দ্বীন' পালন করতে থাকবেন এবং যারই আইন আপনি মেনে চলবেন, মূলতঃ তারই ইবাদত করা হবে ৷
একথার পরে এ সহজ কথাটিও বুঝতে এতটুকু কষ্ট হবার কথা নয় যে, একজন মানুষ একই সময়কালে দু'টি 'দ্বীন' কোন রূপে পালন করতে পারেনা ৷ বিভিন্ন শাসকের মধ্যে এক সময়ে মূলতঃ ও কার্যত একজনকেই অনুসরণ করা সম্ভব । বিভিন্ন আইনের মধ্যে একটি আইন মানুষের জীবনের দায়িত্ব নিতে পারে এবং অসংখ্য মা'বুদের মধ্যে একজনেরই ইবাদাত করা আপনার পক্ষে সম্ভব ৷ যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে আমরা একজনকে শাসনকর্তা মানবো আর বাস্তব ক্ষেত্রে আনুগত্য করবো অপর জনের এবং বন্দেগী করব তৃতীয় একজনের আইন অনুসারে, এতে আপত্তি কি থাকতে পারে? এর উত্তর এই যে, এটা হতে পারে- বস্তুতঃ এখন চার দিকে এটাই হচ্ছে ৷ কিন্তু জেনে রাখুন, এটা পরিষ্কার শির্ক, আর শির্কের সবটাই সম্পূর্ণ মিথ্যা ৷ বাস্তব ক্ষেত্রে আপনি যারই আইন পালন করে চলবেন, মূলতঃ তারই 'দ্বীন' আপনার পালন করা হবে ৷
অতএব, যার আনুগত্য আপনি করেন না তাকে শাসনকর্তা এবং তার 'দ্বীন'কে নিজের 'দ্বীন' বলে প্রকাশ করা বিরাট মিথ্যা ছাড়া কিইবা হতে পারে? মুখে একথা প্রকাশ করলে কিংবা মন দিয়ে তা বুঝতে থাকলে তাতে লাভ কি এবং বাহ্য জগতে তার কিইবা ফল পাওয়া যায়? আপনার জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম যখন একজনের শরীয়ত নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করে, আর কার্যতঃ আপনি অপর কারো শরীয়ত পালন করতে থাকেন, তখন সেই শরীয়ত মেনে চলা সম্পর্কে আপনার দাবী কি একেবারেই অর্থহীন হয়ে যায় না? বাস্তবক্ষেত্রে আপনি যখন এক জনের বন্দেগী করেন তখন অন্য কাউকে নিজের মা'বুদ বলে প্রচার করা এবং নিজের মস্তক তার সামনে অবনত করা কি একটি কৃত্রিম ব্যাপারে পরিণত হয় না? কারণ, প্রকৃতপক্ষে আপনি তারই হুকুম পালন করে চলেন, তারই নিষিদ্ধ কাজ থেকে আপনি বিরত থাকেন, তারই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে সকল কাজ সম্পন্ন করেন এবং তারই উপস্থাপিত নিয়ম-পন্থা আপনি বাস্তব ক্ষেত্রে পালন করে চলেন ৷ নিজেদের মধ্যে লেনদেনও তারই দেয়া নিয়ম-নীতি অনুসারে করে থাকেন। আপনার যাবতীয় ব্যাপারে ও কাজকর্মে আপনি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আপনাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সংগঠন এবং অধিকার বন্টনের কাজও তারই দেয়া বিধান অনুযায়ী করে থাকেন ৷ শুধু তাই নয় তারই দাবী ও নির্দেশ অনুযায়ী আপনি আপনার মন-মগজ ও হাতপায়ের সমগ্র শক্তি, প্রতিভা, শ্রমোপার্জিত সমস্ত ধন-সম্পদ এবং সবশেষে নিজের মহামূল্যবান জীবন-প্রাণ পর্যন্ত তার সামনে পেশ করে থাকেন ৷ অতএব, আপনার কাজ যদি আকীদা-বিশ্বাসের বিপরীত হয়, তবে আপনার বাস্তব কাজই হবে আসল ধর্তব্য ব্যাপার ৷ এমতাবস্থায় নিছক আকীদা-বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই, তা হিসেবের মধ্যে আসতে পারে না ৷ এমন আকীদা-বিশ্বাসের গুরুত্বইবা কি হতে পারে- বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই? বাস্তব ক্ষেত্রে একজন লোক যদি বাদশাহর 'দ্বীন' মেনে চলে, তবে আল্লাহর 'দ্বীনের' কোন স্থানই সেখানে হতে পারে না ৷ অনুরূপভাবে বাস্তব কাজ-কর্ম যদি জনগণের 'দ্বীন' কিংবা ইংল্যান্ড, জামার্ন দেশ ও রাজ্যের 'দ্বীন' পালন করা হয়, তবে সেখানেও আল্লাহর 'দ্বীনের' আদৌ কোন স্থান হাতে পারেনা ৷ পক্ষান্তরে আপনি যদি আল্লাহর 'দ্বীন' মেনে চলেন তবে অন্যান্য কোন দ্বীনের স্থানই সেখানে হবে না ৷ এক কথায় এটা চূড়ান্তভাবে মনে রাখা দরকার যে, শির্ক নিছক মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
এ তত্ত্ব বুঝে নেয়ার পর কোন দীর্ঘ ও জটিল আলোচনা ছাড়া আপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উপলব্ধি করতে পরবেন যে, 'দ্বীন' যাই এবং যে ধরনেরই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারী কর্তৃত্ব ছাড়া তার কোন মূল্য নেই ৷ গণ-দ্বীন, শাহী-দ্বীন, কমিউনিষ্ট-দ্বীন কিংবা আল্লাহর দ্বীন যা-ই হোক না কেন, একটি দ্বীনেরও প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া আদৌ সম্ভব নয় ৷ প্রাসাদের শুধু কাল্পনিক চিত্র-যার বাস্তব কোন অস্তিত্বই নেই-যেমন অর্থহীন, অনুরূপভাবে রাষ্ট্র সরকার ছাড়া একটি দ্বীন(এবং জীবনব্যবস্থা)ও সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক ৷ আপনি যখন বাস করবেন বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদে, তারই দ্বারে প্রবেশ করবেন, তা থেকে বের হবেন, তার ছাদ ও প্রাচীরের ছায়া আপনাকে আশ্রয় দান করবে, তখন এক কাল্পনিক প্রাসাদের রঙীন চিত্র হতে কি ফায়দা আপনি আশা করতে পারেন ৷ আপনাকে তো বসবাসের সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ অনুযায়ী ৷ পরন্তু একটি চিত্র অনুযায়ী নির্মিত প্রাসাদে বসবাস শুরু করে অন্য প্রাসাদের চিত্র কল্পনা করা কিংবা তার প্রতি নিছক একটা ভক্তি বা বিশ্বাস রাখার বাস্তব ক্ষেত্রে কি ফল পাওয়া যেতে পারে? একটি কাল্পনিক প্রাসাদ মনের মধ্যে রেখে বাস্তব বসবাস অন্য কোন প্রাসাদে করা কতখানি হাস্যকর ব্যাপার তা সহজেই অনুমেয় ৷ মস্তিষ্কের মধ্যে যে প্রাসাদের কাল্পনিক চিত্র রয়েছে, তাকে কখনো প্রাসাদ বলা যায় না, আর তাতে বসবাস করাও কারো পক্ষে সম্ভব নয় ৷ এ উদাহরণ অনুযায়ী কোন দ্বীনকে 'সত্য দ্বীন' হিসেবে শুধু বিশ্বাস করার কোনই অর্থ হয় না ৷ মানুষ যখন বাস্তব জীবন যাপন করবে একটি 'দ্বীন' অনুসারে তখন অন্য কোন 'দ্বীন'কে কাল্পনিকভাবে বিশ্বাস করা একেবারেই অর্থহীন ৷ কাল্পনিক 'দ্বীন'কেও অনুরূপভাবে 'দ্বীন' বলা যায় না এবং কল্পিত প্রাসাদের ন্যায় কাল্পনিক 'দ্বীন'কেও কেউ প্রকৃত 'দ্বীন' রূপে গ্রহণ করতে পারে না ৷ বাস্তব ক্ষেত্রে যার ক্ষমতা স্বীকৃত ও কর্তত্ব স্থাপিত হবে, যার আইন কার্যতঃ চলবে এবং যার দেয়া ব্যবস্থানুযায়ী মানব জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম সুসম্পন্ন হবে, বস্তুতঃ দ্বীন তার হবে ৷ অতএব প্রত্যেক দ্বীন স্বভাবতঃই নিজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী রাখে এবং দ্বীন এ জন্যই হয় যে, তা যে ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় বন্দেগী, দাসত্ব ও আইন পালনও একমাত্র তারই হবে ৷ একটি উদাহরণ দেয়া যাচ্ছেঃ
'গণ-দ্বীন'-এর অর্থ কি? একটি দেশের অধিবাসী জনগণই সেখানে নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রভুত্বের মালিক হয়, তাদের নিজেদের রচিত আইনই তাদের উপর জারী হয় এবং দেশের সমগ্র অধিবাসী সম্মিলিতভাবে নিজেরদের গণ-শক্তির আনুগত্য ও দাসত্ব করে- বস্তুতঃ তাই হচ্ছে গণ-দ্বীন বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ৷ কাজেই দেশের প্রকৃত ক্ষমতায় যতদিন জনগণ রচিত আইন জারী না হয়, ততদিন পর্যন্ত এ গণ-দ্বীন বা গণ-রাষ্ট্র কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ৷ প্রতিষ্ঠিত হলো বলে মনে করাও যায় না ৷ কিন্তু জনগণের পরিবর্তে দেশের শক্তি প্রভুত্ব যদি কোন ভিন্ন জাতি কিংবা কোন বাদশাহ করায়ত্ব করে নেয় এবং সারা দেশে তারই রচিত আইন জারী হয়, তবে গণ-দ্বীন এর অস্তিত্ব কোথায় থাকবে? সেখানে কেউ যদি গণ-দ্বীন বা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তবে তার কি মূল্য হতে পারে? কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত বাদশাহ কিংবা ভিন্ন জাতির দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন সে গণ-রাষ্ট্রের অনুসরণ করতে পারে না ৷
শাহী-দ্বীনের কথাই ধরা যাক ৷ এ দ্বীন অনুযায়ী যে বাদশাহ উচ্চতর কর্তা ও প্রভু নিধার্রিত হয়, তার আনুগত্য ও ইবাদাত করা এবং তার আইন বাস্তবে জারী করাই তার মূল লক্ষ্য ৷ তাই যদি না হয় তবে বাদশাহকে বাদশাহ মানলে এবং তাকে শ্রেষ্ঠ প্রভু স্বীকার করলে বাস্তবে কি লাভ হবে? বাস্তব ক্ষেত্রে যদি গণ-দ্বীন বা গণ-রাষ্ট্র কিংবা ভিন্ন জাতির শাসন স্থাপিত হয় তাহলে 'শাহী-দ্বীন' থাকলো কোথায়? তার অনুসরণই বা কে করতে পারে?
বেশী দিনের কথা নয়, এ দেশে (অধুনা তিরোহিত) ইংরেজের দ্বীন বা রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা করলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ৷ ইংরেজের শক্তি ও প্রভুত্বের মারফতে ভারত শাসন আইন ও দেওয়ানী আইন জারী ছিল বলেই তো এ দ্বীন চলছিল ৷ দেশবাসীর সমস্ত কাজ-কর্ম ইংরেজের নিধার্রিত নিয়ম-পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতো ৷ সকল মানুষ তারই হুকুম মাথা নত করে পালন করতো ৷ এ দ্বীন এতখানি শক্তি সহাকারে যতদিন পর্যন্ত স্থাপিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত এখানে অন্য কোন দ্বীনের বস্তুতঃই কোন স্থান ছিল না ৷ ফৌজদারী দণ্ডবিধি ও দেওয়ানী কার্যবিধি রহিত হয়ে গেলে এবং ইংরেজের আইন পালন ও কার্যত তার দাসত্ব না করা হলে ইংরেজ রাষ্ট্র বা দ্বীন কোথায় থাকবে? বস্তুতঃ দ্বীন ইসলামের অবস্থাও ঠিক এরূপ ৷ এ দ্বীনের মূল কথা এই যে, পৃথিবীর মালিক ও সমগ্র মানুষের একমাত্র বাদশাহ হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলা ৷ কাজেই আনুগত্য ও দাসত্ব একমাত্র তাঁরই করতে হবে এবং তাঁর দেয়া শরীয়ত অনুযায়ী মানব জীবনের সকল প্রকার কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতে হবে ৷ ইসলাম কর্তৃক স্থাপিত এ মত-উচ্চতর ক্ষমতা ও প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহর-কেবলমাত্র এজন্যই পেশ করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহরই আইন চলবে, অন্য কারো নয় ৷ আদালতের বিচার তাঁর বিধান অনুযায়ী হবে, পুলিশ তাঁরই বিধান জারী করবে ৷ লোকদের পারস্পরিক যাবতীয় কাজ-কর্ম, লেন-দেন ইত্যাদি তাঁর বিধান অনুসারে সম্পন্ন হবে ৷ তাঁরই মর্জি অনুযায়ী 'কর' নিধার্রিত হবে- তার ব্যয়ও হবে একমাত্র তাঁরই দেয়া রীতিনীতি অনুযায়ী ৷ সিভিল সার্ভিস এবং সৈন্য বিভাগ তাঁরই হুকুমের অধীন হবে ৷ সকল লোক ভয় করবে, অন্তরের সাথে সমীহ করে চলবে, দেশের প্রজা সাধারণ একমাত্র তাঁরই অনুগত হবে ৷ এক কথায় মানুষ আল্লাহ ভিন্ন কারো দাসত্ব বরণ করবে না ৷ অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, খাঁটি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত না হলে উক্ত উদ্দেশ্য কিছুতেই লাভ করা যেতে পারে না ৷ অন্য কোন দ্বীনের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই, অংশীদারিত্বও নেই, আর সত্য কথা এই যে, কোন 'দ্বীন'ই অন্য দ্বীনের অংশীদারিত্ব বরদাশত করতে পারে না ৷ অন্যান্য দ্বীনের ন্যায় দ্বীন ইসলামও এ দাবী করে যে, ক্ষমতা ও প্রভুত্ব নিরংকুশভাবে কেবলমাত্র আমারই হবে এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি 'দ্বীন'ই আমার সামনে অবনত পরাজিত থাকবে ৷ অন্যথায় আমার অনুসরণ কি করে সম্ভব হতে পারে? আমার দ্বীন 'গণ-দ্বীন' হবে না, 'শাহী-দ্বীন' হবে না, 'কমিউনিষ্ট-দ্বীন' হবে না ৷ অপর কোন দ্বীনেরই অস্তিত্ব থাকবে না ৷ পক্ষান্তরে অন্য কোন দ্বীনের অস্তিত্ব থাকলে আমি থাকবো না ৷ তখন আমাকে শুধু মুখেই সত্য বলে স্বীকার করলে কোন বাস্তব ফল পাওয়া যাবে না ৷ কুরআন মজীদ বার বার এ কথারই ঘোষণা রয়েছেঃ
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ...
"লোকদের শুধু এ হুকুমই দেয়া হয়েছে (এছাড়া অন্য কোন নির্দেশই দেয়া হয়নি) যে, তারা সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদাত করবে ৷" [সূরা আল-বাইয়্যেনাহঃ ৫]
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ.
"তিনি তাঁর রাসূলকে জীবন ব্যবস্থা ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন এ জন্য যে, একে সমগ্র দ্বীনের উপর জয়ী করে দেবেন; যদিও শির্কবাদীগণ এটা মোটেই বরদাশত করে না ৷" [সূরা আত্-তাওবাঃ ৩৩]
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.
"তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতদিন না ফেৎনা নির্মূল হয়ে যায় এবং 'দ্বীন' সামগ্রীকভাবে আল্লাহ তা'আলারই স্থাপিত হয়৷" [সূরা আল-আনফালঃ ৩৯]
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ..
"আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম দেয়ার অধিকার নেই ৷ তাঁরই নির্দেশ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করো না ৷" [সূরা ইউসুফঃ ৪০]
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً.
"যে ব্যক্তি নিজের রবের সাক্ষাত লাভ করতে ইচ্ছুক সত্কাজ করা এবং রবের ইবাদাতের ব্যাপারে অপর কাউকে শরীক না করা তার একান্তই কর্তব্য ৷" [সূরা আল-কাহাফঃ ১১০]
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ.......... وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ.
"যারা দাবী করে যে, তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি আল্লাহর তরফ থেকে যা নাযিল হয়েছে, তার প্রতি তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের এ বৈষম্য তুমি লক্ষ্য করনি যে, তারা 'তাগূত'(আল্লাহদ্রোহী রাষ্ট্রশক্তি ও বিচার ব্যবস্থা)-এর কাছে নিজেদের (মোকদ্দমার) বিচার ফয়সালা চায় ৷ অথচ তাকে অস্বীকার ও অমান্য করার নির্দেশই তাদেরকে দেয়া হয়েছিল ৷ .... আমরা যে রাসূলকেই পঠিয়েছি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর অনুসরণ করার উদ্দেশ্যেই তাকে পাঠিয়েছি ৷" [সূরা আন্-নিসাঃ ৬০-৬৪]
ইবাদাত, দ্বীন ও শরীয়তের পূর্বোক্ত ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের এ আয়াতসমূহের মূল অর্থ ও ভাবধারা অনুধাবন করতে পাঠকদের আদৌ অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ৷
ইসলামে জিহাদের এতদূর গুরুত্ব কেন, তাও পূর্বোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে ৷ অন্যান্য ধর্ম ও দ্বীনের ন্যায় শুধু সত্য বলে মেনে নিলেই এবং এই আকীদা ও বিশ্বাসের বাহ্যিক নিদর্শন স্বরূপ শুধু পূজা-উপাসনার অনুষ্ঠান পালন করলেই আল্লাহর 'দ্বীন' সন্তুষ্ট হতে পারে না ৷ কারণ অন্য কোন দ্বীনের অধীন থেকে আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্য ও অনুসরণ আদৌ সম্ভব নয়, -অন্য কোন দ্বীনের সংমিশ্রণে তার অনুসরণ অসম্ভব ৷ অতএব আল্লাহর এই দ্বীনকে যদি বাস্তবিকই সত্য দ্বীন বলে বিশ্বাস করেন, তবে তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ সাধনা ও সংগ্রাম করা ভিন্ন অন্য কোন উপায় থাকতে পারে না ৷ এ সাধনা ও সংগ্রামের ফলেই ইসলাম কায়েম হবে, অন্যথায় এই প্রচেষ্টায় নিযুক্ত থেকে জীবন দান করতে হবে, বস্তুত এটি একটি শাশ্বত মানদণ্ড, এতে আপনার ঈমান ও আকীদার সত্যতার যাচাই হতে পারে ৷ ইসলামের প্রতি আপনার যথার্থ ঈমান থাকলে অপর কোন দ্বীনের অধীন থেকে সুখ নিদ্রায় অচেতন থাকা আপনার পক্ষে অসম্ভব হবে, তার খেদমত করা এবং তার বিনিময়ে লব্ধ জীবিকার কিছুমাত্র স্বাদ গ্রহণ করার তো কোন কথাই উঠতে পারে না ৷ দ্বীন ইসলামকে একমাত্র সত্য হিসাবে মেনে নেয়ার পর অন্য কোন দ্বীনের অধীন আপনার জীবন যদি অতিবাহিত হয়ও তবুও আপনার শয্যা কন্টকাকীর্ণ, খাদ্য বিষাক্ত ও তিক্ত বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর এ সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ সাধনা না করে একবিন্দু স্বস্তিও আপনি লাভ করতে পারবেন না ৷ কিন্তু আল্লাহর দ্বীন ভিন্ন অপর কোন দ্বীনের অধীন জীবন যাপন করায় আপনার যদি তৃপ্তি লাভ হয় এবং সেই অবস্থায় আপনার মন সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত হয়ে থাকে, তবে আপনি আদৌ ঈমানদার নন- আপনি মনোযোগ দিয়ে যতই নামায পড়েন, দীর্ঘ সময় ধরে 'মোরাকাবা' করেন, আর কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা করেন ও ইসলামের দর্শন প্রচার করেন না কেন; কিন্তু আপনার ঈমানদার না হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই ৷ দ্বীন ইসলাম বিশ্বাস করে অন্য কোন দ্বীনের প্রতি যে সন্তুষ্ট থাকবে, তার সম্পর্কে এটাই চূড়ান্ত কথা ৷ কিন্তু যে সব মুনাফিক অন্যান্য দ্বীনের নিষ্ঠাপূর্ণ খেদমত করে, কিংবা অন্য কোন দ্বীন (যথা গণ-দ্বীন) প্রতিষ্ঠার জন্য সাধনা ও চেষ্টা করে তাদের সম্পর্কে কিইবা বলা যায়? …..মৃত্যু দূরে নয়, যখন তা উপস্থিত হবে, তখন তাদের বৈষয়িক জীবনের 'আমলনামা' স্বয়ং আল্লাহই তাদের সামনে উপস্থিত করবেন ৷ বস্তুত এরা নিজেদেরকে যদি মুসলমান বলে মনে করে, তবে এটা তাদের চরম নির্বুদ্ধিতা ভিন্ন আর কিছুই নয় ৷ তাদের সুষ্ঠু বুদ্ধি থাকলে তারা নিজেরাই বুঝতে পারতো যে, একটি দ্বীনকে সত্য বলে মানা ও স্বীকার করা আর বাস্তব ক্ষেত্রে অপর কোন দ্বীনের প্রতিষ্টায় সন্তুষ্ট থাকা কিংবা সেই কাজে অংশগ্রহণ করা ও সে জন্য চেষ্টা করা- পরস্পর বিরোধী কাজ ৷ আগুন ও পানি হয়ত মিলতে পারে; কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে এরূপ কার্য পদ্ধতির কোন সামঞ্জস্যই হতে পারে না ৷
কুরআন শরীফে এ সম্পর্কীয় সমস্ত আয়াত এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় ৷ মাত্র কয়েকটি আয়াত এখানে উদ্বৃত হলোঃ
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لا يُفْتَنُونَ * وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ.
"তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি বললেই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে? এ ব্যাপারে তাদেরকে বিন্দুমাত্র পরীক্ষা করা হবে না; অথচ তাদের পূর্বে যারাই ঈমানের দাবী করেছে তাদেরকে আমরা পরীক্ষা করেছি, যেন আল্লাহ জানতে পারেন যে, ঈমানের দাবী করার ব্যাপারে কে খাঁটি ও সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী ৷" [সূরা আল-'আনকাবুতঃ ২-৩]
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِنْ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ * وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ.
"কিছু সংখ্যক লোক এমন আছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাবী করে; কিন্তু আল্লাহর পথে তারা যখনই নির্যাতিত হয়েছে, তখনই মানুষের নিযার্তনে তারা এতদূর ভীত হয়ে পড়েছে, ঠিক যতখানি ভীত হওয়া উচিত আল্লাহর আযাবের ৷ অথচ তোমার রবের কাছ থেকে সাফল্য ও বিজয় লাভ হলে এরাই অগ্রসর হয়ে বলবেঃ 'আমরা তোমাদের সাথেই ছিলাম' ৷ এদের মনের কথা কি আল্লাহ জানেন না? তবুও কোন্ সব লোক প্রকৃত মু'মিন এবং কোন্ সব লোক মুনাফিক, তা আল্লাহ অবশ্যই দেখে নেবেন ৷" [সূরা আল-আনকাবুতঃ ১০- ১১]
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ.
"মুমিনগণকে বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দেয়া আল্লাহর নীতি বিরোধী, (কেননা, এখন সতবাদী, মিথ্যাবাদী এবং খাঁটি ঈমানদার ও মুনাফিক একাকার হয়ে আছে) আল্লাহ পবিত্র ও পাপীদের মধ্যে নিশ্চয়ই তারতম্য করবেন ৷" [সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৯]
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلا رَسُولِهِ وَلا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً.
"তোমরা কি মনে কর, তোমাদেরকে আল্লাহ এমনি ছেড়ে দেবেন? অথচ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিন লোকদেরকে ত্যাগ করে অন্য লোকদের সাথে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেনি, তা এখনও আল্লাহ তা'আলা পার্থক্য করে দেখেননি ৷" [সুরা আত্-তাওবাঃ ১৬]
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْماً غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مَا هُمْ مِنْكُمْ وَلا مِنْهُمْ.
"তুমি কি ওসব লোকের কথা চিন্তা করে দেখেছ, যারা অভিশপ্ত লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করে? মূলতঃ এরা না তোমাদের আপন লোক না তাদের ৷ [সূরা আল-মুজাদালাহঃ ১৪]
أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ * إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ * كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
"...... এরা শয়তানের দলভুক্ত! সাবধান! শয়তানের দলই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় (দ্বীন ইসমলাম প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ করে) তারা নিশ্চয়ই পরাজিত হবে ৷ আল্লাহর চুড়ান্ত ফয়সালা এই যে, আমি (আল্লাহ) এবং আমার রাসূলগণই জয়ী হব। প্রকৃত শক্তিশালী পরাক্রমশালী হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলা ৷" [সূরা আল-মুজাদালাহঃ ১৯-২১]
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন কোথাও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকলে তথাকার সত্যনিষ্ঠ আদর্শবাদী মুমিনদের পরিচয় এই হবে যে, এ বাতিল 'দ্বীন' নির্মূল করে প্রকৃত আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সাধনা করবে ৷ তারা যদি বাস্তবিক তাই করে, নিজেদের সমগ্র শক্তি এ উদ্দেশ্যেই নিযুক্ত করে, নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত কুরবানী দেয় ও সকল প্রকার ক্ষতি-লোকসান অকাতরে বরদাশত করে, তবে তাদের সাচ্চা ঈমানদার হওয়ায় কোন সন্দেহ নেই ৷ তাদের চেষ্টা-সাধনা সাফল্য লাভ করলো, কি করলো না সেই প্রশ্ন অবান্তর ৷ কিন্তু তারা যদি বাতিল দ্বীনের প্রতিষ্ঠায়ই সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত থাকে, কিংবা তাকে জয়ী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার কাজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অংশগ্রহণ করে, তবে তাদের ঈমানদার হওয়ার দাবী একেবারেই মিথ্যা, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ৷
পরন্তু দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নানা প্রকার বাধা-প্রতিবন্ধকতার কথা যারা ওযর হিসেবে পেশ করে থাকে, উল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাদেরও জবাব দিয়েছেন ৷ দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যখন কোথাও চেষ্টা করা হবে, কোন না কোন বাতিল 'দ্বীন' পূর্ণ শক্তি সহকারে তথায় পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত থাকবেই ৷ সকল প্রকার শক্তি ক্ষমতা তার দখলে থাকবে, জীবিকার ভাণ্ডার তারই কুক্ষিগত হবে এবং মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তার প্রভাব প্রবল থাকবে; এরূপ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনকে চূর্ণ করে অপর কোন দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি আর যাই হোক- কোন কুসুমাস্তীর্ণ পথ হতে পারে না ৷ পরম শান্তি ও স্বস্তি সহকারে নবাবী চালে কাজ করলে এ উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারে না, আর কখনও সম্ভব নয় ৷ বাতিল দ্বীনের অধীনে থেকে কিছু না কিছু বৈষয়িক সুখ-শান্তি লাভ হতে থাকবে, আর সেই সাথে দ্বীন ইসলামও প্রতিষ্ঠিত হবে- এটা একেবারেই অসম্ভব ৷ এ বিরাট কাজ তখনই সম্পন্ন হতে পারে যখন বাতিল দ্বীনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সকল অধিকার, স্বার্থ ও যাবতীয় আয়েশ-আরামকে আপনারা পদাঘাত করতে প্রস্তুত হবেন এবং এ কাজে যত ক্ষতি-লোকসানেরই সম্মুখীন হতে হয়, সাহসের সাথে আপনারা তা বরদাশত করতে প্রস্তুত থাকবেন ৷ বস্তুত যারা এ কঠোর সাধনা করতে প্রস্তুত থাকবে, আল্লাহর পথে জিহাদ করা কেবলমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে ৷ কিন্তু এ ধরনের লোক সকল সমাজেই মুষ্টিমেয়ই থাকে ৷ আর যারা দ্বীন ইসলাম অনুসরণ করে চলতে চাইলেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তাদের সম্পর্কে আমি কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই না, তারা নিরাপদে নিজেদের নফসের খেদমত করতে থাকুক, সত্যের মুজাহিদগণ দুঃখ-নিযার্তন অকাতরে ভোগ করে এ পথে অপরিসীম কুরবানী দিয়ে যখন দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করে দেবে তখনই তারা এসে বলবে- 'আমরা তো তোমাদেরই দলের লোক, অতএব এখন আমাদেরও প্রাপ্য অংশ দাও' ৷
ইতিপূর্বে বিভিন্ন পুস্তিকায় দ্বীন, শরীয়ত ও ইবাদাত প্রভৃতি ইসলামী পরিভাষা সমূহের বিস্তারিত অর্থ লিখিত হয়েছে ৷ এখানে প্রসঙ্গতঃ তার দিকে সামান্য ইংগিত করাই যথেষ্ট হবে ৷
'দ্বীন' অর্থ আনুগত্য করা,
আইনকেই বলা হয় শরীয়ত
ইবাদত অর্থ বন্দেগী ও দাসত্ব ৷
আপনি কারো আনুগত্য স্বীকার করলে এবং তাকে নিজের শাসক ও বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিলে তার অর্থ এই হবে যে, আপনি তার 'দ্বীন' গ্রহণ করেছেন ৷ পরন্তু আপনি যখন তাকে নিজের বিধান দাতা হিসেবে স্বীকার করলেন এবং কার্যতঃ আপনি তার প্রজা হলেন তখন তাঁর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর নির্ধারিত নিয়ম-পন্থা আপনার জন্য আইন কিংবা শরীয়তের মর্যাদা পেল ৷ এমতাবস্থায় আপনি তার 'শরীয়ত' অনুযায়ী জীবন যাপন করেন, তিনি যা কিছুর দাবী করেন আপনি তা পূরণ করেন, তার প্রত্যেকটি হুকুম আপনি পালন করেন, তার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকেন, যে সীমার মধ্যে থেকে আপনার কাজ করা তিনি সঙ্গত ঘোষণা করবেন, সেই সীমার মধ্যে থেকে আপনি কাজ করতে থাকেন, শুধু তাই নয়, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ, কাজ-কর্ম, আত্মীয়তা-শত্রুতা ও মামলা-মোকদ্দমা সব কিছুই তার নির্দিষ্ট নিয়ম-বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করেন ৷ তারই মত ও ফয়সালাকে চূড়ান্ত বলে মনে করেন ও তার সামনে মাথা নত করেন, কাজেই আপনার এ আচরণকে তার ইবাদাত বা বন্দেগী বলে অভিহিত করা যাবে ৷
এ বিশ্লেষণ থেকে সুস্পষ্টরূপে বুঝা গেল যে, দ্বীন মূলতঃ রাষ্ট্র সরকারকেই বলা হয়, শরীয়ত হচ্ছে এর আইন এবং এর আইন ও নিয়ম-প্রথা যথারীতি মেনে চলাকে বলা হয় ইবাদাত ৷ আপনি যাকেই শাসক ও নিরংকুশ রাষ্ট্র-কর্তা রূপে মেনে তার অধীনতা স্বীকার করবেন, আপনি মূলতঃ তারই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হবেন ৷ আপনার এ শাসক ও রাষ্ট্র-কর্তা যদি আল্লাহ্ হন তবে আপনি তাঁর দ্বীনের অধীন হলেন, তিনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হন, তবে বাদশাহর 'দ্বীন'কেই আপনার কবুল করা হবে ৷ বিশেষ কোন জাতিকে এ মর্যাদা দিলে সেই জাতিরই 'দ্বীন' গ্রহণ করা হবে ৷ আর আপনার নিজের জাতি বা নিজ দেশের জনগণকে সেই অধিকার দিলে জনগণের 'দ্বীন'কেই আপনি গ্রহণ করলেন ৷ মোটকথা, যারই আনুগত্য করবেন, প্রকৃতপক্ষে আপনি তারই 'দ্বীন' পালন করতে থাকবেন এবং যারই আইন আপনি মেনে চলবেন, মূলতঃ তারই ইবাদত করা হবে ৷
একথার পরে এ সহজ কথাটিও বুঝতে এতটুকু কষ্ট হবার কথা নয় যে, একজন মানুষ একই সময়কালে দু'টি 'দ্বীন' কোন রূপে পালন করতে পারেনা ৷ বিভিন্ন শাসকের মধ্যে এক সময়ে মূলতঃ ও কার্যত একজনকেই অনুসরণ করা সম্ভব । বিভিন্ন আইনের মধ্যে একটি আইন মানুষের জীবনের দায়িত্ব নিতে পারে এবং অসংখ্য মা'বুদের মধ্যে একজনেরই ইবাদাত করা আপনার পক্ষে সম্ভব ৷ যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আকীদা-বিশ্বাসের দিক দিয়ে আমরা একজনকে শাসনকর্তা মানবো আর বাস্তব ক্ষেত্রে আনুগত্য করবো অপর জনের এবং বন্দেগী করব তৃতীয় একজনের আইন অনুসারে, এতে আপত্তি কি থাকতে পারে? এর উত্তর এই যে, এটা হতে পারে- বস্তুতঃ এখন চার দিকে এটাই হচ্ছে ৷ কিন্তু জেনে রাখুন, এটা পরিষ্কার শির্ক, আর শির্কের সবটাই সম্পূর্ণ মিথ্যা ৷ বাস্তব ক্ষেত্রে আপনি যারই আইন পালন করে চলবেন, মূলতঃ তারই 'দ্বীন' আপনার পালন করা হবে ৷
অতএব, যার আনুগত্য আপনি করেন না তাকে শাসনকর্তা এবং তার 'দ্বীন'কে নিজের 'দ্বীন' বলে প্রকাশ করা বিরাট মিথ্যা ছাড়া কিইবা হতে পারে? মুখে একথা প্রকাশ করলে কিংবা মন দিয়ে তা বুঝতে থাকলে তাতে লাভ কি এবং বাহ্য জগতে তার কিইবা ফল পাওয়া যায়? আপনার জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম যখন একজনের শরীয়ত নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করে, আর কার্যতঃ আপনি অপর কারো শরীয়ত পালন করতে থাকেন, তখন সেই শরীয়ত মেনে চলা সম্পর্কে আপনার দাবী কি একেবারেই অর্থহীন হয়ে যায় না? বাস্তবক্ষেত্রে আপনি যখন এক জনের বন্দেগী করেন তখন অন্য কাউকে নিজের মা'বুদ বলে প্রচার করা এবং নিজের মস্তক তার সামনে অবনত করা কি একটি কৃত্রিম ব্যাপারে পরিণত হয় না? কারণ, প্রকৃতপক্ষে আপনি তারই হুকুম পালন করে চলেন, তারই নিষিদ্ধ কাজ থেকে আপনি বিরত থাকেন, তারই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে সকল কাজ সম্পন্ন করেন এবং তারই উপস্থাপিত নিয়ম-পন্থা আপনি বাস্তব ক্ষেত্রে পালন করে চলেন ৷ নিজেদের মধ্যে লেনদেনও তারই দেয়া নিয়ম-নীতি অনুসারে করে থাকেন। আপনার যাবতীয় ব্যাপারে ও কাজকর্মে আপনি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আপনাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সংগঠন এবং অধিকার বন্টনের কাজও তারই দেয়া বিধান অনুযায়ী করে থাকেন ৷ শুধু তাই নয় তারই দাবী ও নির্দেশ অনুযায়ী আপনি আপনার মন-মগজ ও হাতপায়ের সমগ্র শক্তি, প্রতিভা, শ্রমোপার্জিত সমস্ত ধন-সম্পদ এবং সবশেষে নিজের মহামূল্যবান জীবন-প্রাণ পর্যন্ত তার সামনে পেশ করে থাকেন ৷ অতএব, আপনার কাজ যদি আকীদা-বিশ্বাসের বিপরীত হয়, তবে আপনার বাস্তব কাজই হবে আসল ধর্তব্য ব্যাপার ৷ এমতাবস্থায় নিছক আকীদা-বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই, তা হিসেবের মধ্যে আসতে পারে না ৷ এমন আকীদা-বিশ্বাসের গুরুত্বইবা কি হতে পারে- বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই? বাস্তব ক্ষেত্রে একজন লোক যদি বাদশাহর 'দ্বীন' মেনে চলে, তবে আল্লাহর 'দ্বীনের' কোন স্থানই সেখানে হতে পারে না ৷ অনুরূপভাবে বাস্তব কাজ-কর্ম যদি জনগণের 'দ্বীন' কিংবা ইংল্যান্ড, জামার্ন দেশ ও রাজ্যের 'দ্বীন' পালন করা হয়, তবে সেখানেও আল্লাহর 'দ্বীনের' আদৌ কোন স্থান হাতে পারেনা ৷ পক্ষান্তরে আপনি যদি আল্লাহর 'দ্বীন' মেনে চলেন তবে অন্যান্য কোন দ্বীনের স্থানই সেখানে হবে না ৷ এক কথায় এটা চূড়ান্তভাবে মনে রাখা দরকার যে, শির্ক নিছক মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
এ তত্ত্ব বুঝে নেয়ার পর কোন দীর্ঘ ও জটিল আলোচনা ছাড়া আপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উপলব্ধি করতে পরবেন যে, 'দ্বীন' যাই এবং যে ধরনেরই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও সরকারী কর্তৃত্ব ছাড়া তার কোন মূল্য নেই ৷ গণ-দ্বীন, শাহী-দ্বীন, কমিউনিষ্ট-দ্বীন কিংবা আল্লাহর দ্বীন যা-ই হোক না কেন, একটি দ্বীনেরও প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া আদৌ সম্ভব নয় ৷ প্রাসাদের শুধু কাল্পনিক চিত্র-যার বাস্তব কোন অস্তিত্বই নেই-যেমন অর্থহীন, অনুরূপভাবে রাষ্ট্র সরকার ছাড়া একটি দ্বীন(এবং জীবনব্যবস্থা)ও সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক ৷ আপনি যখন বাস করবেন বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদে, তারই দ্বারে প্রবেশ করবেন, তা থেকে বের হবেন, তার ছাদ ও প্রাচীরের ছায়া আপনাকে আশ্রয় দান করবে, তখন এক কাল্পনিক প্রাসাদের রঙীন চিত্র হতে কি ফায়দা আপনি আশা করতে পারেন ৷ আপনাকে তো বসবাসের সমস্ত ব্যবস্থা করতে হবে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ অনুযায়ী ৷ পরন্তু একটি চিত্র অনুযায়ী নির্মিত প্রাসাদে বসবাস শুরু করে অন্য প্রাসাদের চিত্র কল্পনা করা কিংবা তার প্রতি নিছক একটা ভক্তি বা বিশ্বাস রাখার বাস্তব ক্ষেত্রে কি ফল পাওয়া যেতে পারে? একটি কাল্পনিক প্রাসাদ মনের মধ্যে রেখে বাস্তব বসবাস অন্য কোন প্রাসাদে করা কতখানি হাস্যকর ব্যাপার তা সহজেই অনুমেয় ৷ মস্তিষ্কের মধ্যে যে প্রাসাদের কাল্পনিক চিত্র রয়েছে, তাকে কখনো প্রাসাদ বলা যায় না, আর তাতে বসবাস করাও কারো পক্ষে সম্ভব নয় ৷ এ উদাহরণ অনুযায়ী কোন দ্বীনকে 'সত্য দ্বীন' হিসেবে শুধু বিশ্বাস করার কোনই অর্থ হয় না ৷ মানুষ যখন বাস্তব জীবন যাপন করবে একটি 'দ্বীন' অনুসারে তখন অন্য কোন 'দ্বীন'কে কাল্পনিকভাবে বিশ্বাস করা একেবারেই অর্থহীন ৷ কাল্পনিক 'দ্বীন'কেও অনুরূপভাবে 'দ্বীন' বলা যায় না এবং কল্পিত প্রাসাদের ন্যায় কাল্পনিক 'দ্বীন'কেও কেউ প্রকৃত 'দ্বীন' রূপে গ্রহণ করতে পারে না ৷ বাস্তব ক্ষেত্রে যার ক্ষমতা স্বীকৃত ও কর্তত্ব স্থাপিত হবে, যার আইন কার্যতঃ চলবে এবং যার দেয়া ব্যবস্থানুযায়ী মানব জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম সুসম্পন্ন হবে, বস্তুতঃ দ্বীন তার হবে ৷ অতএব প্রত্যেক দ্বীন স্বভাবতঃই নিজের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী রাখে এবং দ্বীন এ জন্যই হয় যে, তা যে ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় বন্দেগী, দাসত্ব ও আইন পালনও একমাত্র তারই হবে ৷ একটি উদাহরণ দেয়া যাচ্ছেঃ
'গণ-দ্বীন'-এর অর্থ কি? একটি দেশের অধিবাসী জনগণই সেখানে নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রভুত্বের মালিক হয়, তাদের নিজেদের রচিত আইনই তাদের উপর জারী হয় এবং দেশের সমগ্র অধিবাসী সম্মিলিতভাবে নিজেরদের গণ-শক্তির আনুগত্য ও দাসত্ব করে- বস্তুতঃ তাই হচ্ছে গণ-দ্বীন বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ৷ কাজেই দেশের প্রকৃত ক্ষমতায় যতদিন জনগণ রচিত আইন জারী না হয়, ততদিন পর্যন্ত এ গণ-দ্বীন বা গণ-রাষ্ট্র কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ৷ প্রতিষ্ঠিত হলো বলে মনে করাও যায় না ৷ কিন্তু জনগণের পরিবর্তে দেশের শক্তি প্রভুত্ব যদি কোন ভিন্ন জাতি কিংবা কোন বাদশাহ করায়ত্ব করে নেয় এবং সারা দেশে তারই রচিত আইন জারী হয়, তবে গণ-দ্বীন এর অস্তিত্ব কোথায় থাকবে? সেখানে কেউ যদি গণ-দ্বীন বা রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তবে তার কি মূল্য হতে পারে? কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত বাদশাহ কিংবা ভিন্ন জাতির দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন সে গণ-রাষ্ট্রের অনুসরণ করতে পারে না ৷
শাহী-দ্বীনের কথাই ধরা যাক ৷ এ দ্বীন অনুযায়ী যে বাদশাহ উচ্চতর কর্তা ও প্রভু নিধার্রিত হয়, তার আনুগত্য ও ইবাদাত করা এবং তার আইন বাস্তবে জারী করাই তার মূল লক্ষ্য ৷ তাই যদি না হয় তবে বাদশাহকে বাদশাহ মানলে এবং তাকে শ্রেষ্ঠ প্রভু স্বীকার করলে বাস্তবে কি লাভ হবে? বাস্তব ক্ষেত্রে যদি গণ-দ্বীন বা গণ-রাষ্ট্র কিংবা ভিন্ন জাতির শাসন স্থাপিত হয় তাহলে 'শাহী-দ্বীন' থাকলো কোথায়? তার অনুসরণই বা কে করতে পারে?
বেশী দিনের কথা নয়, এ দেশে (অধুনা তিরোহিত) ইংরেজের দ্বীন বা রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তা করলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ৷ ইংরেজের শক্তি ও প্রভুত্বের মারফতে ভারত শাসন আইন ও দেওয়ানী আইন জারী ছিল বলেই তো এ দ্বীন চলছিল ৷ দেশবাসীর সমস্ত কাজ-কর্ম ইংরেজের নিধার্রিত নিয়ম-পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতো ৷ সকল মানুষ তারই হুকুম মাথা নত করে পালন করতো ৷ এ দ্বীন এতখানি শক্তি সহাকারে যতদিন পর্যন্ত স্থাপিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত এখানে অন্য কোন দ্বীনের বস্তুতঃই কোন স্থান ছিল না ৷ ফৌজদারী দণ্ডবিধি ও দেওয়ানী কার্যবিধি রহিত হয়ে গেলে এবং ইংরেজের আইন পালন ও কার্যত তার দাসত্ব না করা হলে ইংরেজ রাষ্ট্র বা দ্বীন কোথায় থাকবে? বস্তুতঃ দ্বীন ইসলামের অবস্থাও ঠিক এরূপ ৷ এ দ্বীনের মূল কথা এই যে, পৃথিবীর মালিক ও সমগ্র মানুষের একমাত্র বাদশাহ হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলা ৷ কাজেই আনুগত্য ও দাসত্ব একমাত্র তাঁরই করতে হবে এবং তাঁর দেয়া শরীয়ত অনুযায়ী মানব জীবনের সকল প্রকার কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতে হবে ৷ ইসলাম কর্তৃক স্থাপিত এ মত-উচ্চতর ক্ষমতা ও প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহর-কেবলমাত্র এজন্যই পেশ করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহরই আইন চলবে, অন্য কারো নয় ৷ আদালতের বিচার তাঁর বিধান অনুযায়ী হবে, পুলিশ তাঁরই বিধান জারী করবে ৷ লোকদের পারস্পরিক যাবতীয় কাজ-কর্ম, লেন-দেন ইত্যাদি তাঁর বিধান অনুসারে সম্পন্ন হবে ৷ তাঁরই মর্জি অনুযায়ী 'কর' নিধার্রিত হবে- তার ব্যয়ও হবে একমাত্র তাঁরই দেয়া রীতিনীতি অনুযায়ী ৷ সিভিল সার্ভিস এবং সৈন্য বিভাগ তাঁরই হুকুমের অধীন হবে ৷ সকল লোক ভয় করবে, অন্তরের সাথে সমীহ করে চলবে, দেশের প্রজা সাধারণ একমাত্র তাঁরই অনুগত হবে ৷ এক কথায় মানুষ আল্লাহ ভিন্ন কারো দাসত্ব বরণ করবে না ৷ অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, খাঁটি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত না হলে উক্ত উদ্দেশ্য কিছুতেই লাভ করা যেতে পারে না ৷ অন্য কোন দ্বীনের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই, অংশীদারিত্বও নেই, আর সত্য কথা এই যে, কোন 'দ্বীন'ই অন্য দ্বীনের অংশীদারিত্ব বরদাশত করতে পারে না ৷ অন্যান্য দ্বীনের ন্যায় দ্বীন ইসলামও এ দাবী করে যে, ক্ষমতা ও প্রভুত্ব নিরংকুশভাবে কেবলমাত্র আমারই হবে এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি 'দ্বীন'ই আমার সামনে অবনত পরাজিত থাকবে ৷ অন্যথায় আমার অনুসরণ কি করে সম্ভব হতে পারে? আমার দ্বীন 'গণ-দ্বীন' হবে না, 'শাহী-দ্বীন' হবে না, 'কমিউনিষ্ট-দ্বীন' হবে না ৷ অপর কোন দ্বীনেরই অস্তিত্ব থাকবে না ৷ পক্ষান্তরে অন্য কোন দ্বীনের অস্তিত্ব থাকলে আমি থাকবো না ৷ তখন আমাকে শুধু মুখেই সত্য বলে স্বীকার করলে কোন বাস্তব ফল পাওয়া যাবে না ৷ কুরআন মজীদ বার বার এ কথারই ঘোষণা রয়েছেঃ
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ...
"লোকদের শুধু এ হুকুমই দেয়া হয়েছে (এছাড়া অন্য কোন নির্দেশই দেয়া হয়নি) যে, তারা সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই ইবাদাত করবে ৷" [সূরা আল-বাইয়্যেনাহঃ ৫]
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ.
"তিনি তাঁর রাসূলকে জীবন ব্যবস্থা ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন এ জন্য যে, একে সমগ্র দ্বীনের উপর জয়ী করে দেবেন; যদিও শির্কবাদীগণ এটা মোটেই বরদাশত করে না ৷" [সূরা আত্-তাওবাঃ ৩৩]
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.
"তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতদিন না ফেৎনা নির্মূল হয়ে যায় এবং 'দ্বীন' সামগ্রীকভাবে আল্লাহ তা'আলারই স্থাপিত হয়৷" [সূরা আল-আনফালঃ ৩৯]
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ..
"আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম দেয়ার অধিকার নেই ৷ তাঁরই নির্দেশ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করো না ৷" [সূরা ইউসুফঃ ৪০]
فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً.
"যে ব্যক্তি নিজের রবের সাক্ষাত লাভ করতে ইচ্ছুক সত্কাজ করা এবং রবের ইবাদাতের ব্যাপারে অপর কাউকে শরীক না করা তার একান্তই কর্তব্য ৷" [সূরা আল-কাহাফঃ ১১০]
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ.......... وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ.
"যারা দাবী করে যে, তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি আল্লাহর তরফ থেকে যা নাযিল হয়েছে, তার প্রতি তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের এ বৈষম্য তুমি লক্ষ্য করনি যে, তারা 'তাগূত'(আল্লাহদ্রোহী রাষ্ট্রশক্তি ও বিচার ব্যবস্থা)-এর কাছে নিজেদের (মোকদ্দমার) বিচার ফয়সালা চায় ৷ অথচ তাকে অস্বীকার ও অমান্য করার নির্দেশই তাদেরকে দেয়া হয়েছিল ৷ .... আমরা যে রাসূলকেই পঠিয়েছি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর অনুসরণ করার উদ্দেশ্যেই তাকে পাঠিয়েছি ৷" [সূরা আন্-নিসাঃ ৬০-৬৪]
ইবাদাত, দ্বীন ও শরীয়তের পূর্বোক্ত ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের এ আয়াতসমূহের মূল অর্থ ও ভাবধারা অনুধাবন করতে পাঠকদের আদৌ অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ৷
ইসলামে জিহাদের এতদূর গুরুত্ব কেন, তাও পূর্বোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে ৷ অন্যান্য ধর্ম ও দ্বীনের ন্যায় শুধু সত্য বলে মেনে নিলেই এবং এই আকীদা ও বিশ্বাসের বাহ্যিক নিদর্শন স্বরূপ শুধু পূজা-উপাসনার অনুষ্ঠান পালন করলেই আল্লাহর 'দ্বীন' সন্তুষ্ট হতে পারে না ৷ কারণ অন্য কোন দ্বীনের অধীন থেকে আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্য ও অনুসরণ আদৌ সম্ভব নয়, -অন্য কোন দ্বীনের সংমিশ্রণে তার অনুসরণ অসম্ভব ৷ অতএব আল্লাহর এই দ্বীনকে যদি বাস্তবিকই সত্য দ্বীন বলে বিশ্বাস করেন, তবে তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ সাধনা ও সংগ্রাম করা ভিন্ন অন্য কোন উপায় থাকতে পারে না ৷ এ সাধনা ও সংগ্রামের ফলেই ইসলাম কায়েম হবে, অন্যথায় এই প্রচেষ্টায় নিযুক্ত থেকে জীবন দান করতে হবে, বস্তুত এটি একটি শাশ্বত মানদণ্ড, এতে আপনার ঈমান ও আকীদার সত্যতার যাচাই হতে পারে ৷ ইসলামের প্রতি আপনার যথার্থ ঈমান থাকলে অপর কোন দ্বীনের অধীন থেকে সুখ নিদ্রায় অচেতন থাকা আপনার পক্ষে অসম্ভব হবে, তার খেদমত করা এবং তার বিনিময়ে লব্ধ জীবিকার কিছুমাত্র স্বাদ গ্রহণ করার তো কোন কথাই উঠতে পারে না ৷ দ্বীন ইসলামকে একমাত্র সত্য হিসাবে মেনে নেয়ার পর অন্য কোন দ্বীনের অধীন আপনার জীবন যদি অতিবাহিত হয়ও তবুও আপনার শয্যা কন্টকাকীর্ণ, খাদ্য বিষাক্ত ও তিক্ত বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর এ সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ সাধনা না করে একবিন্দু স্বস্তিও আপনি লাভ করতে পারবেন না ৷ কিন্তু আল্লাহর দ্বীন ভিন্ন অপর কোন দ্বীনের অধীন জীবন যাপন করায় আপনার যদি তৃপ্তি লাভ হয় এবং সেই অবস্থায় আপনার মন সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত হয়ে থাকে, তবে আপনি আদৌ ঈমানদার নন- আপনি মনোযোগ দিয়ে যতই নামায পড়েন, দীর্ঘ সময় ধরে 'মোরাকাবা' করেন, আর কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা করেন ও ইসলামের দর্শন প্রচার করেন না কেন; কিন্তু আপনার ঈমানদার না হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই ৷ দ্বীন ইসলাম বিশ্বাস করে অন্য কোন দ্বীনের প্রতি যে সন্তুষ্ট থাকবে, তার সম্পর্কে এটাই চূড়ান্ত কথা ৷ কিন্তু যে সব মুনাফিক অন্যান্য দ্বীনের নিষ্ঠাপূর্ণ খেদমত করে, কিংবা অন্য কোন দ্বীন (যথা গণ-দ্বীন) প্রতিষ্ঠার জন্য সাধনা ও চেষ্টা করে তাদের সম্পর্কে কিইবা বলা যায়? …..মৃত্যু দূরে নয়, যখন তা উপস্থিত হবে, তখন তাদের বৈষয়িক জীবনের 'আমলনামা' স্বয়ং আল্লাহই তাদের সামনে উপস্থিত করবেন ৷ বস্তুত এরা নিজেদেরকে যদি মুসলমান বলে মনে করে, তবে এটা তাদের চরম নির্বুদ্ধিতা ভিন্ন আর কিছুই নয় ৷ তাদের সুষ্ঠু বুদ্ধি থাকলে তারা নিজেরাই বুঝতে পারতো যে, একটি দ্বীনকে সত্য বলে মানা ও স্বীকার করা আর বাস্তব ক্ষেত্রে অপর কোন দ্বীনের প্রতিষ্টায় সন্তুষ্ট থাকা কিংবা সেই কাজে অংশগ্রহণ করা ও সে জন্য চেষ্টা করা- পরস্পর বিরোধী কাজ ৷ আগুন ও পানি হয়ত মিলতে পারে; কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে এরূপ কার্য পদ্ধতির কোন সামঞ্জস্যই হতে পারে না ৷
কুরআন শরীফে এ সম্পর্কীয় সমস্ত আয়াত এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় ৷ মাত্র কয়েকটি আয়াত এখানে উদ্বৃত হলোঃ
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لا يُفْتَنُونَ * وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ.
"তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি বললেই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে? এ ব্যাপারে তাদেরকে বিন্দুমাত্র পরীক্ষা করা হবে না; অথচ তাদের পূর্বে যারাই ঈমানের দাবী করেছে তাদেরকে আমরা পরীক্ষা করেছি, যেন আল্লাহ জানতে পারেন যে, ঈমানের দাবী করার ব্যাপারে কে খাঁটি ও সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী ৷" [সূরা আল-'আনকাবুতঃ ২-৩]
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِنْ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ * وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ.
"কিছু সংখ্যক লোক এমন আছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাবী করে; কিন্তু আল্লাহর পথে তারা যখনই নির্যাতিত হয়েছে, তখনই মানুষের নিযার্তনে তারা এতদূর ভীত হয়ে পড়েছে, ঠিক যতখানি ভীত হওয়া উচিত আল্লাহর আযাবের ৷ অথচ তোমার রবের কাছ থেকে সাফল্য ও বিজয় লাভ হলে এরাই অগ্রসর হয়ে বলবেঃ 'আমরা তোমাদের সাথেই ছিলাম' ৷ এদের মনের কথা কি আল্লাহ জানেন না? তবুও কোন্ সব লোক প্রকৃত মু'মিন এবং কোন্ সব লোক মুনাফিক, তা আল্লাহ অবশ্যই দেখে নেবেন ৷" [সূরা আল-আনকাবুতঃ ১০- ১১]
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ.
"মুমিনগণকে বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দেয়া আল্লাহর নীতি বিরোধী, (কেননা, এখন সতবাদী, মিথ্যাবাদী এবং খাঁটি ঈমানদার ও মুনাফিক একাকার হয়ে আছে) আল্লাহ পবিত্র ও পাপীদের মধ্যে নিশ্চয়ই তারতম্য করবেন ৷" [সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৯]
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلا رَسُولِهِ وَلا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً.
"তোমরা কি মনে কর, তোমাদেরকে আল্লাহ এমনি ছেড়ে দেবেন? অথচ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিন লোকদেরকে ত্যাগ করে অন্য লোকদের সাথে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করেনি, তা এখনও আল্লাহ তা'আলা পার্থক্য করে দেখেননি ৷" [সুরা আত্-তাওবাঃ ১৬]
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْماً غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مَا هُمْ مِنْكُمْ وَلا مِنْهُمْ.
"তুমি কি ওসব লোকের কথা চিন্তা করে দেখেছ, যারা অভিশপ্ত লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করে? মূলতঃ এরা না তোমাদের আপন লোক না তাদের ৷ [সূরা আল-মুজাদালাহঃ ১৪]
أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ * إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ * كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
"...... এরা শয়তানের দলভুক্ত! সাবধান! শয়তানের দলই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় (দ্বীন ইসমলাম প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ করে) তারা নিশ্চয়ই পরাজিত হবে ৷ আল্লাহর চুড়ান্ত ফয়সালা এই যে, আমি (আল্লাহ) এবং আমার রাসূলগণই জয়ী হব। প্রকৃত শক্তিশালী পরাক্রমশালী হচ্ছেন আল্লাহ তা'আলা ৷" [সূরা আল-মুজাদালাহঃ ১৯-২১]
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন কোথাও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকলে তথাকার সত্যনিষ্ঠ আদর্শবাদী মুমিনদের পরিচয় এই হবে যে, এ বাতিল 'দ্বীন' নির্মূল করে প্রকৃত আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সাধনা করবে ৷ তারা যদি বাস্তবিক তাই করে, নিজেদের সমগ্র শক্তি এ উদ্দেশ্যেই নিযুক্ত করে, নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত কুরবানী দেয় ও সকল প্রকার ক্ষতি-লোকসান অকাতরে বরদাশত করে, তবে তাদের সাচ্চা ঈমানদার হওয়ায় কোন সন্দেহ নেই ৷ তাদের চেষ্টা-সাধনা সাফল্য লাভ করলো, কি করলো না সেই প্রশ্ন অবান্তর ৷ কিন্তু তারা যদি বাতিল দ্বীনের প্রতিষ্ঠায়ই সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত থাকে, কিংবা তাকে জয়ী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার কাজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অংশগ্রহণ করে, তবে তাদের ঈমানদার হওয়ার দাবী একেবারেই মিথ্যা, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ৷
পরন্তু দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নানা প্রকার বাধা-প্রতিবন্ধকতার কথা যারা ওযর হিসেবে পেশ করে থাকে, উল্লেখিত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাদেরও জবাব দিয়েছেন ৷ দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যখন কোথাও চেষ্টা করা হবে, কোন না কোন বাতিল 'দ্বীন' পূর্ণ শক্তি সহকারে তথায় পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত থাকবেই ৷ সকল প্রকার শক্তি ক্ষমতা তার দখলে থাকবে, জীবিকার ভাণ্ডার তারই কুক্ষিগত হবে এবং মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তার প্রভাব প্রবল থাকবে; এরূপ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনকে চূর্ণ করে অপর কোন দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি আর যাই হোক- কোন কুসুমাস্তীর্ণ পথ হতে পারে না ৷ পরম শান্তি ও স্বস্তি সহকারে নবাবী চালে কাজ করলে এ উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারে না, আর কখনও সম্ভব নয় ৷ বাতিল দ্বীনের অধীনে থেকে কিছু না কিছু বৈষয়িক সুখ-শান্তি লাভ হতে থাকবে, আর সেই সাথে দ্বীন ইসলামও প্রতিষ্ঠিত হবে- এটা একেবারেই অসম্ভব ৷ এ বিরাট কাজ তখনই সম্পন্ন হতে পারে যখন বাতিল দ্বীনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সকল অধিকার, স্বার্থ ও যাবতীয় আয়েশ-আরামকে আপনারা পদাঘাত করতে প্রস্তুত হবেন এবং এ কাজে যত ক্ষতি-লোকসানেরই সম্মুখীন হতে হয়, সাহসের সাথে আপনারা তা বরদাশত করতে প্রস্তুত থাকবেন ৷ বস্তুত যারা এ কঠোর সাধনা করতে প্রস্তুত থাকবে, আল্লাহর পথে জিহাদ করা কেবলমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে ৷ কিন্তু এ ধরনের লোক সকল সমাজেই মুষ্টিমেয়ই থাকে ৷ আর যারা দ্বীন ইসলাম অনুসরণ করে চলতে চাইলেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তাদের সম্পর্কে আমি কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাই না, তারা নিরাপদে নিজেদের নফসের খেদমত করতে থাকুক, সত্যের মুজাহিদগণ দুঃখ-নিযার্তন অকাতরে ভোগ করে এ পথে অপরিসীম কুরবানী দিয়ে যখন দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করে দেবে তখনই তারা এসে বলবে- 'আমরা তো তোমাদেরই দলের লোক, অতএব এখন আমাদেরও প্রাপ্য অংশ দাও' ৷
0 comments: