ইসলামী সংগঠন
সংগঠনের অর্থ ও সংজ্ঞা
সংগঠন শব্দটিরে ইংরেজি প্রতিশব্দ Organisation যার শাব্দিক অর্থ বিভিন্ন Organ কে একত্রিত করণ, গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণ বা আত্মীকরণ। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও এক একটি Organ বলা হয়। মানবদেহের এই ভিন্ন ভিন্ন Organ গুলোর গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণের রূপটাই সংগঠন বা Organisation - এর একটা জীবন্ত রূপ। মানব দেহের প্রতিটি সেল, প্রতিটি অনু পরমানু একটা নিয়মের অধীনে সুশৃঙ্খলভাবে যার যার কাজ সম্পাদন করে যাচ্ছে। মানুষের দৈহিক অবয়বগুলোর বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, এখানে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে। আবার কাজের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা আছ, পরস্পরের সাথে অদ্ভুদ রকমের সহযোগিতা আছে। মন-মগজের চিন্তা-ভাবনা কল্পনা ও সিদ্ধান্তের প্রতি দেহের বিভিন্ন Organ দ্রুত সমর্থন-সহযোগীতা প্রদর্শন কর। তেমন দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাব-অভিযোগ, অসুবিধা ইত্যাদির ব্যাপারে দেহরূপ এই সংগঠনের কেন্দ্র অর্থাৎ মন ও মগজ দ্রুত অবহিত হয়।
মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এই একীভূত রূপের অনুকরণে কিছুসংখ্যক মানুষের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এক দেহ এক প্রাণ রূপে কাজ করার সামষ্টিক কাঠামোকেই বলা হয় সংগঠন বা Organization.
মুসলিম জনগোষ্ঠী মূলত একটি সংগঠন, জামায়াত বা Organisation। এই জন্যেই হাদিসে রাসূলে এই জনসমষ্টিকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে:
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِى تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى ».
অর্থ: হযরত নুমান বিন বশীর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন- মুমিনদের পারস্পরিক ভালবাসা, দায় ও সাহনুভূতি মানবদেহ সাদৃশ্য। তার কোন অংশ রোগাক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়ে। (বুখারী ও মুসলিম)
এখানে মুমিনদের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক, সংযোগ ও অনুভূমি প্রবণতার বাঞ্ছিত রূপটা কি হওয়া উচিত, এটা বোঝানোর জন্যেই মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের, সংযোগের এবং সহানুভূতির ও সহযোগীতার বাস্তব রূপটি উদহারণস্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে।
এভাবে মানুষের বিভিন্ন Organকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে যেমন মানবদেহ বেকার ও অচল হওয়ার সাথে সাথে ঐসব Organ গুলোও বেকার হয়ে যায়, তেমনি এটা সত্য সমাজবদ্ধ জীব মানুষের বেলায়ও। এই সমাজ একটা দেহ এবং ব্যক্তি মানুষগুলো এই সমাজ দেহের এক একটা Organ। মানব দেহের Organ গুলো পরস্পর বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হলে যেমন দেহ ও Organ সবটাই বেকার হয়ে যায়, তেমনি সমাজ দেহের Organ গুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে, ব্যক্তি মানুষগুলোও মানুষের মর্যাদায় থাকতে পারে না এবং এই ব্যক্তিদের সামষ্টিক যে রূপটা সমাজ নামে পরিচিত, সেটাও মানুষের সমাজ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য থাকে না। সুতরাং সংগঠন মানুষের জন্যে, মানুষের ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে একটা একান্ত স্বাভাবিক ও অনিবার্য প্রয়োজন।
মানুষের এই সংগঠনের আদর্শ রূপ হবে মানব দেহেরই অনুরূপ। অর্থাৎ দেহের যেমন একটা কেন্দ্রয় নিয়ন্ত্রণ আছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নির্দেশ দেয়া হয়, সিদ্ধান্ত জানানো হয়, প্রয়োজন পূরণ করা হয়, অভাব অভিযোগ দ্রুত শোনা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেমন সুন্দরভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে আবার যার যার জায়গায় স্বাধীনও বটে, আবার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরস্পরের মধ্যেও একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, সুন্দর আদান প্রদান মানে team spirit আছে। তেমনি মানুষের সমাজ পরিচালনার জন্যে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থাকতে হবে। যার কাজ হবে সমাজের সমষ্টির ও ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এমনভাবে যেন সমষ্টির স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। আবার ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতা যেন সমষ্টির এবং অন্য ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতার পরিপন্থী না হয়। এখানে সমাজ ব্যক্তিদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। ব্যক্তিরা যুগপৎভাবে সমাজের প্রতি এবং পরস্পর একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে।
মানুষ সমাজের এই রূপটাই আদর্শ রূপ। মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ এমনি একটা পরিবেশ, এমনি একটা সামাজিক কাঠামোতেই সম্ভব হতে পারে। মানুষের এই সহজাত এবং স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাকিদেই মানুষ কোন না কোন প্রক্রিয়ায় সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কোন না কোন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মেনে চলারও চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষের সমাজে বিভিন্ন প্রকৃতির, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন গোত্রের, দেশের ও ভাষার মানুষকে এক দেহ, এক প্রাণ হিসেবে গ্রন্থায়নে, আত্মিকরণে- মানুষের মনগড়া কোন প্রচেষ্টাই আজ পর্যন্ত সফল হয়নি, হতে পারছে না। মানুষের তৈরী সমাজ কাঠামো সংগঠন, সংস্থা ভারসাম্যমূলক কোন ব্যবস্থাই মানবজাতিকে উপহার দিতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কখনও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তির স্বার্থে ও স্বাধীনতা এতটা খর্ব করেছে যে, তার প্রতিক্রিয়া সমাজকেও প্রভাবিত করেছে। কারণ সমাজ তো ব্যক্তিরই সমষ্টি। আবার কখনও অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক স্বার্থ ও সমাজের ব্যক্তিদের পারস্পরিক স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ফলে কোথাও মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিকাশ সাধনের সুযোগ হয়নি। বরং মানুষের সমাজে পাশবিকতা, পৈশাচিকতা ও বর্বরতাকেই লালন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
পক্ষান্তরে মানবজাতি ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সমাজের আদর্শ রূপেও দেখছে। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত সমাজ এবং খোলাফায়ে রাসেদীন পরিচালিত সমাজই সর্বকালের সর্বযুগের জন্যে আদর্শ সমাজ ও সংগঠন, যেখানে বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন ভাষার মানুষকে এক দেহ এক প্রাণরূপে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করেও সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ইনসাফ স্বার্থকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উল্লিখিত আদর্শ সমাজ সংগঠনের আওতায় মানুষের জীবনে শান্তি কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নবী রাসূলগণ সবাই একই ধরনের মৌলিক নীতি ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে কর্মকৌশল ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। আজকের বিশ্বের মানবজাতিকে যদি আমরা এক দেহ এক প্রাণরূপে সংগঠিত করতে চাই তাহলে (এবং করতেই হবে) ঐ সব মৌলিক নীতি-পদ্ধতি এবং শেষ নবী (সা.) গৃহীত কর্মকৌশল অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শেষ নবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সারা বিশ্বের মানুষ আবার খেলাফত আলা মিনহাজিন্নাবুয়াতের সাক্ষাৎ পাবে এবং নবী রাসূলগণের গৃহীত সেই নিয়ম পদ্ধতির ভিত্তিতে গোটা বিশ্বের মানুষ আবার এক দেহ-মন-প্রাণ হবে। নিখিল বিশ্বে গোটা মানব সমাজের এই বৃহত্তর সমাজ সংগঠনই ইসলামী সংগঠনের মূল লক্ষ্য। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনসমূহ মূলত এই বৃহত্তর লক্ষ্য পানেই ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে।
ইসলামের সঠিক আকিদা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কিছু সংখ্যক লোকের সম্মিলিত ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার নাম ইসলামী আন্দোলন, আর এর সামষ্টিক রূপ ও কাঠামোর প্রক্রিয়ার নাম ইসলামী সংগঠন।
ইসলামের সাথে আন্দোলন যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ইসলাম ও আন্দোলন যেমন সম্পূর্ণরূপে এক ও অভিন্ন, ইসলামের সাথে সংগঠনের সম্পর্কও তেমনই। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারণে সমাজ ও সংগঠন ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। ইসলাম এই মানুষের জন্যে, মানুষের সমাজের জন্যেই। সুতরাং সমাজ সংগঠন ছাড়া, জামায়াত বদ্ধ জীবন ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনা করাই সম্ভব নয়। ইসলামী আদর্শের প্রথম ও প্রধান উৎস এবং আল কোরআনের শিক্ষা আলোচনা করলে কোথাও ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবন যাপনের সুযোগ দেখা যায় না। আল কোরআনের আহবান হয় গোটা মানব জাতির জন্যে, আর না হয় মানুষের মধ্য থেকে যার ঈমান এনেছে তাদের সকলের জন্যে। কেবলমাত্র আখেরাতের জবাবদিহির ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে হবে। কিন্তু সেই জবাবদিহিতে বাঁচতে হলেও এই দুনিয়ায় সামষ্টিকভাবে দ্বীন মেনে চলার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত আয়াতগুলো বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থঃ হে মানব জাতি! তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা মুক্তিলাভে সক্ষম হও। (আল বাকারা: ২১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
অর্থঃ হে মানবজাতি! তোমরা ভয় কর তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদেরকে একটি নফস থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের দু’জন হতে অসংখ্য নারীপুরুষ ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহকে ভয় কর এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারেও ভয় কর, এসব ব্যাপারে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তোমাদের উপর প্রহরীরূপে আছেন। (আন নিসা: ১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থঃ হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রের ও বংশের অন্তর্ভুক্ত করেছি, যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যারা বেশী খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে বেশী মর্যাদাবান। অবশ্যই আল্লাহ জ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল। (আল হুজরাতঃ ১৩)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, সুদ যা এখন চালু আছে- বর্জন কর যদি হও সত্যিই ঈমানদার। (আল বাকারা: ২৭৮)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদ খাবে না- আল্লাহকে ভয় কর যাতে করে সাফল্যমন্ডিত হতে পার। (আল ইমরান: ১৩০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের মাল ভক্ষণ করবে না- হ্যাঁ, যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যৌথ ব্যবসা হয়, সেটা ভিন্ন কথা। (আন নিসা: ২৯)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيم- تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে এমন একটা ব্যবসার কথা বলব কি যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? ঈমান আন আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি। আ জিহাদ কর আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে। তোমরা প্রকৃত জ্ঞানী হলে বুঝবে এটাই তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। (আস সফ: ১০-১১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ: তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও। (আস সফ: ১৪)
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থঃ তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর, বিচ্ছিন্ন হবে না। (আল ইমরান: ১০৩)
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানব জাতিকে কল্যাণের পথে আহবান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে বাধা দেবে, তারাই সফলকাম। (আল ইমরান: ১০৪)
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
অর্থঃ ঈমানদার নারী পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা দান। তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। তাদের প্রতি সত্বর আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। আল্লাহ পরক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞ। (আত তাওবা: ৭১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা শাসন ক্ষমতার অধিকারী তাদের। (আন নিসা: ৫৯)
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং সৎকর্মশীল হবেন, তাদের প্রতি আল্লাহর ওয়াদা তাদেরকে দুনিয়ার খেলাফত দান করা হবে যেমন তার পূর্ববর্তিদেরকে দান করা হয়েছে। (আন নূর: ৫৫)
ইসলামী আদর্শের দ্বিতীয় উৎস সুন্নাতের রাসূল বা হাদিসে রাসূল। সেখানেও জামায়াতী জিন্দেগীর বাইরে ইসলামের কোন ধারণা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এখানে তো বলা হয়েছে মাত্র দুজন কোথাও ভ্রমণ করলেও তার একজনকে আমীর করে নিয়ে জামায়াতী শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলবে।
আল্লাহর রাসূল জামায়াতী জিন্দেগীর ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত হাদিসটির মাধ্যমে:
عن الحارث الاشعري قال قال رسول الله صلعم انا امركم بخمس الله امرني بهن بالجماعة والسمع والطاعة والهجرة والجهاد فئ سبيل الله
অর্থ: হযরত হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) বলেন, আমি পাঁচটি জিনিসের ব্যাপারে তোমাদের আদেশ করছি (অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আর আমার আল্লাহ আমাকে এই পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন) (১) জামায়াত বদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) নেতার আদেশ মেনে চলবে (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। (আহমদ ও তিরমিজী)
উক্ত হাদিসে একই সাথে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের উপাদান, কাঠামো ও কার্যক্রমের মৌলিক কথাগুলো সংক্ষেপে অথচ সুন্দরভাবে বলা হয়েছে।
আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহ বাস্তবায়নে অন্যতম সার্থক ও সফল রূপকার হযরত ওমর ফারুক (রা.) কোরআন ও সুন্নাহর স্পিরিটকে সামনে রেখে ইসলামের যে সংজ্ঞার দিয়েছেন তাতেও ইসলামের সংজ্ঞার পাশাপশি ইসলামী জামায়াত বা সংগঠনের উপাদান এবং কাঠামো এসে গেছে। তিনি বলেছেন:
لا اسلام الا بجماعة و لا جماعة الا بامارة و لا امارة الا بطاعة
অর্থ: জামায়াত ছাড়া ইসলামের কোন অস্তিত্ব নেই। আর নেতৃত্ব ছাড়া জামায়াতের কোন ধারণা করা যায় না। তেমনিভাবে আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্বও অর্থহীন। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে:
يد الله مع الجماعة ومن شذ شذ الى النار
অর্থ: জামায়াতের প্রতি আল্লাহর রহমতের হাত প্রসারিত থাকে। যে জামায়াত ছাড়া একা চলে সে তো একাকী দোযখের পথেই ধাবিত হয়। (তিরমিজী)
من خرج من الطاعة و فارق الجماعة فمات ميتة جاهلية
যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করে এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছন্ন হওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
সুতরাং আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নহ এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমার ভিত্তিতে অকাট্যভাবে প্রামণিত হয় যে, দ্বীন ইসলামে জামায়াত বিহীন জীবনের কোন ধারণা নেই। জামায়াতবিহীন মৃত্যুকে তো জাহেলিয়াতের মৃত্যু হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। আতএব জামায়াতবদ্ধ হওয়া, জামায়াতবদ্ধ হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো ফরজ। আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করে এসেছি, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা ফরজ আর আন্দোলনের জন্যে সংগঠন অপরিহার্য। কাজেই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত হওয়া অনিবার্য কারণেই ফরজ হতে বাধ্য।
ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সংগঠনেও উল্লিখিত উপাদানগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান থাকে। ইসলামী সংগঠন সঠিক ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠন বিধায় সে একমাত্র কোরআন সুন্নাহর আদর্শকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং মুমিন জীবনরে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা হওয়া উচিত তাকেই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আদর্শ যেমন কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই নেয়, তেমনি সে আদর্শ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতিও কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করে সংগঠনের দ্বিতীয় উপাদান নেতৃত্বের ব্যাপারে। এই সংগঠন রাসূলে খোদার আদর্শ অনুযায়ী নেতৃত্ব গড়ে তোলাকে অন্যতম সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। এই সংগঠনের যাত্রাই শুরু হয় নেতৃত্বের মাধ্যমে। এই সংগঠনের নেতৃত্ব নায়েবে রাসূলের মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য গ্রহণের প্রশ্ন একান্ত স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়। সুতরাং ইসলামী সংগঠনের উপাদান সমূহরে কথা আমরা এভাবে সাজাতে পারি।
(১) কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতি।
(২) কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী নেতৃত্ব।
(৩) কোরআন ও সুন্নাহর বাঞ্ছিত মানের আনুগত্য।
(৪) এর সাধারণ এবং বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র সমগ্র দুনিয়া, সমগ্র দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু প্রাথমিক কর্মক্ষেত্রে, যারা যে দেশে জন্মেছে, যে দেশে বসবাস করছে সেই দেশ এবং সেই দেশের জনগণ।
উল্লেখিত উপাদানগুলোর সাথে আরো দুটো উপাদান ইসলামী সংগঠনের প্রাণশক্তির ভূমিকা পালন করে আর আন্দোলনকে করে তোলে গতিশীল। তার একটা হলো পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা আর দ্বিতীয়টি হলো সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনার ব্যবস্থা চালু থাকা। আমরা এই পুক্তিকার শেষ অংশে নেতৃত্ব, আনুগত্য পরামর্শ এবং সমালোচনা এই চার বিষয় পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার চেষ্টা করব।
عليكم بسنتى و سنة الخلفاء الرشدين المهديين
অর্থ: তোমদেরকে আমার ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবশ্য অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
রাসূলে (সা.) প্রতিষ্ঠিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত, আল জামায়াত। এই মডেল অনুকরণে ও অনুসরণে গড়ে ওঠা জামায়াতের প্রকৃত লক্ষ্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। এইরূপ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রকৃত জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব। আমরা বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত আছি- অথচ হাদিসের আলোচনায় বুঝা যায়, ইসলামী জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে ইসলামী নেতৃত্বের বাইয়াত গ্রহণ ছাড়া মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি? জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচার উপায় কি?
এই অবস্থায় আমাদের বাঁচার উপায় হলো, একমাত্র কারণীয় কাজ হলো আল্লাহর রাসূলের ও খোলাফায়ে রাশেদীনের মডেল বা সুন্নাতকে সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা খেলাফত আলা মিনহাজিন্নবুয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করতে একমত- এমন লেঅকদের সম্বন্বয়ে জামায়াত কায়েম করা। এই জামায়াত হবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প। আর এই জামায়াতের নেতৃত্ব হবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিকল্প। এভাবে একটা অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা করে জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ করা এবং জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই জামায়াতকে প্রকৃত জামায়াত গড়ার means রূপে ব্যবগার করতে হবে। এটাকে end ভাবা ঠিক হবে না বা end ভাবলে এর মাধ্যমে যে বৃহত্তর কাজ, মহান দায়িত্বে আঞ্জাম দেয়ার কথা তা দেয়া সম্ভব হবে না। পরিণামে এটা একটা ফেরকায় রূপ নেয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
ইসলামী আন্দোলনের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা যে পাঁচটি পরিভাষা যেমনঃ ১. দাওয়াত ২. শাহাদাত ৩. কিতাল ৪. ইকামাতে দ্বীন এবং ৫. আমর বিল মা’রূফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার - এর সামগ্রিক রূপটিই ইসলামী আন্দোলন বলে বুঝে থাকি। আর ইসলামী সংগঠন তো ইসলামী আন্দোলনের জন্যেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত জনশক্তি ইসলামী সংগঠন পরিকল্পিতভাবে উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্যেই ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ইসলামী সংগঠন দাওয়াত ইলাল্লাহ ও শাহাদাত হকের
সংগঠনের অর্থ ও সংজ্ঞা
সংগঠন শব্দটিরে ইংরেজি প্রতিশব্দ Organisation যার শাব্দিক অর্থ বিভিন্ন Organ কে একত্রিত করণ, গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণ বা আত্মীকরণ। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও এক একটি Organ বলা হয়। মানবদেহের এই ভিন্ন ভিন্ন Organ গুলোর গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণের রূপটাই সংগঠন বা Organisation - এর একটা জীবন্ত রূপ। মানব দেহের প্রতিটি সেল, প্রতিটি অনু পরমানু একটা নিয়মের অধীনে সুশৃঙ্খলভাবে যার যার কাজ সম্পাদন করে যাচ্ছে। মানুষের দৈহিক অবয়বগুলোর বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, এখানে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে। আবার কাজের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা আছ, পরস্পরের সাথে অদ্ভুদ রকমের সহযোগিতা আছে। মন-মগজের চিন্তা-ভাবনা কল্পনা ও সিদ্ধান্তের প্রতি দেহের বিভিন্ন Organ দ্রুত সমর্থন-সহযোগীতা প্রদর্শন কর। তেমন দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাব-অভিযোগ, অসুবিধা ইত্যাদির ব্যাপারে দেহরূপ এই সংগঠনের কেন্দ্র অর্থাৎ মন ও মগজ দ্রুত অবহিত হয়।
মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এই একীভূত রূপের অনুকরণে কিছুসংখ্যক মানুষের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এক দেহ এক প্রাণ রূপে কাজ করার সামষ্টিক কাঠামোকেই বলা হয় সংগঠন বা Organization.
মুসলিম জনগোষ্ঠী মূলত একটি সংগঠন, জামায়াত বা Organisation। এই জন্যেই হাদিসে রাসূলে এই জনসমষ্টিকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে:
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِى تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى ».
অর্থ: হযরত নুমান বিন বশীর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন- মুমিনদের পারস্পরিক ভালবাসা, দায় ও সাহনুভূতি মানবদেহ সাদৃশ্য। তার কোন অংশ রোগাক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়ে। (বুখারী ও মুসলিম)
এখানে মুমিনদের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক, সংযোগ ও অনুভূমি প্রবণতার বাঞ্ছিত রূপটা কি হওয়া উচিত, এটা বোঝানোর জন্যেই মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের, সংযোগের এবং সহানুভূতির ও সহযোগীতার বাস্তব রূপটি উদহারণস্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে।
এভাবে মানুষের বিভিন্ন Organকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে যেমন মানবদেহ বেকার ও অচল হওয়ার সাথে সাথে ঐসব Organ গুলোও বেকার হয়ে যায়, তেমনি এটা সত্য সমাজবদ্ধ জীব মানুষের বেলায়ও। এই সমাজ একটা দেহ এবং ব্যক্তি মানুষগুলো এই সমাজ দেহের এক একটা Organ। মানব দেহের Organ গুলো পরস্পর বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হলে যেমন দেহ ও Organ সবটাই বেকার হয়ে যায়, তেমনি সমাজ দেহের Organ গুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে, ব্যক্তি মানুষগুলোও মানুষের মর্যাদায় থাকতে পারে না এবং এই ব্যক্তিদের সামষ্টিক যে রূপটা সমাজ নামে পরিচিত, সেটাও মানুষের সমাজ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য থাকে না। সুতরাং সংগঠন মানুষের জন্যে, মানুষের ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে একটা একান্ত স্বাভাবিক ও অনিবার্য প্রয়োজন।
মানুষের এই সংগঠনের আদর্শ রূপ হবে মানব দেহেরই অনুরূপ। অর্থাৎ দেহের যেমন একটা কেন্দ্রয় নিয়ন্ত্রণ আছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নির্দেশ দেয়া হয়, সিদ্ধান্ত জানানো হয়, প্রয়োজন পূরণ করা হয়, অভাব অভিযোগ দ্রুত শোনা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেমন সুন্দরভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে আবার যার যার জায়গায় স্বাধীনও বটে, আবার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরস্পরের মধ্যেও একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, সুন্দর আদান প্রদান মানে team spirit আছে। তেমনি মানুষের সমাজ পরিচালনার জন্যে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থাকতে হবে। যার কাজ হবে সমাজের সমষ্টির ও ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এমনভাবে যেন সমষ্টির স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। আবার ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতা যেন সমষ্টির এবং অন্য ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতার পরিপন্থী না হয়। এখানে সমাজ ব্যক্তিদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। ব্যক্তিরা যুগপৎভাবে সমাজের প্রতি এবং পরস্পর একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে।
মানুষ সমাজের এই রূপটাই আদর্শ রূপ। মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ এমনি একটা পরিবেশ, এমনি একটা সামাজিক কাঠামোতেই সম্ভব হতে পারে। মানুষের এই সহজাত এবং স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাকিদেই মানুষ কোন না কোন প্রক্রিয়ায় সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কোন না কোন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মেনে চলারও চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষের সমাজে বিভিন্ন প্রকৃতির, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন গোত্রের, দেশের ও ভাষার মানুষকে এক দেহ, এক প্রাণ হিসেবে গ্রন্থায়নে, আত্মিকরণে- মানুষের মনগড়া কোন প্রচেষ্টাই আজ পর্যন্ত সফল হয়নি, হতে পারছে না। মানুষের তৈরী সমাজ কাঠামো সংগঠন, সংস্থা ভারসাম্যমূলক কোন ব্যবস্থাই মানবজাতিকে উপহার দিতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কখনও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তির স্বার্থে ও স্বাধীনতা এতটা খর্ব করেছে যে, তার প্রতিক্রিয়া সমাজকেও প্রভাবিত করেছে। কারণ সমাজ তো ব্যক্তিরই সমষ্টি। আবার কখনও অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক স্বার্থ ও সমাজের ব্যক্তিদের পারস্পরিক স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ফলে কোথাও মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিকাশ সাধনের সুযোগ হয়নি। বরং মানুষের সমাজে পাশবিকতা, পৈশাচিকতা ও বর্বরতাকেই লালন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
পক্ষান্তরে মানবজাতি ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সমাজের আদর্শ রূপেও দেখছে। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত সমাজ এবং খোলাফায়ে রাসেদীন পরিচালিত সমাজই সর্বকালের সর্বযুগের জন্যে আদর্শ সমাজ ও সংগঠন, যেখানে বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন ভাষার মানুষকে এক দেহ এক প্রাণরূপে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করেও সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ইনসাফ স্বার্থকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উল্লিখিত আদর্শ সমাজ সংগঠনের আওতায় মানুষের জীবনে শান্তি কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নবী রাসূলগণ সবাই একই ধরনের মৌলিক নীতি ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে কর্মকৌশল ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। আজকের বিশ্বের মানবজাতিকে যদি আমরা এক দেহ এক প্রাণরূপে সংগঠিত করতে চাই তাহলে (এবং করতেই হবে) ঐ সব মৌলিক নীতি-পদ্ধতি এবং শেষ নবী (সা.) গৃহীত কর্মকৌশল অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শেষ নবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সারা বিশ্বের মানুষ আবার খেলাফত আলা মিনহাজিন্নাবুয়াতের সাক্ষাৎ পাবে এবং নবী রাসূলগণের গৃহীত সেই নিয়ম পদ্ধতির ভিত্তিতে গোটা বিশ্বের মানুষ আবার এক দেহ-মন-প্রাণ হবে। নিখিল বিশ্বে গোটা মানব সমাজের এই বৃহত্তর সমাজ সংগঠনই ইসলামী সংগঠনের মূল লক্ষ্য। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনসমূহ মূলত এই বৃহত্তর লক্ষ্য পানেই ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে।
ইসলামের সঠিক আকিদা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কিছু সংখ্যক লোকের সম্মিলিত ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার নাম ইসলামী আন্দোলন, আর এর সামষ্টিক রূপ ও কাঠামোর প্রক্রিয়ার নাম ইসলামী সংগঠন।
ইসলামের সাথে আন্দোলন যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ইসলাম ও আন্দোলন যেমন সম্পূর্ণরূপে এক ও অভিন্ন, ইসলামের সাথে সংগঠনের সম্পর্কও তেমনই। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারণে সমাজ ও সংগঠন ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। ইসলাম এই মানুষের জন্যে, মানুষের সমাজের জন্যেই। সুতরাং সমাজ সংগঠন ছাড়া, জামায়াত বদ্ধ জীবন ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনা করাই সম্ভব নয়। ইসলামী আদর্শের প্রথম ও প্রধান উৎস এবং আল কোরআনের শিক্ষা আলোচনা করলে কোথাও ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবন যাপনের সুযোগ দেখা যায় না। আল কোরআনের আহবান হয় গোটা মানব জাতির জন্যে, আর না হয় মানুষের মধ্য থেকে যার ঈমান এনেছে তাদের সকলের জন্যে। কেবলমাত্র আখেরাতের জবাবদিহির ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে হবে। কিন্তু সেই জবাবদিহিতে বাঁচতে হলেও এই দুনিয়ায় সামষ্টিকভাবে দ্বীন মেনে চলার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত আয়াতগুলো বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থঃ হে মানব জাতি! তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা মুক্তিলাভে সক্ষম হও। (আল বাকারা: ২১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
অর্থঃ হে মানবজাতি! তোমরা ভয় কর তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদেরকে একটি নফস থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের দু’জন হতে অসংখ্য নারীপুরুষ ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহকে ভয় কর এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারেও ভয় কর, এসব ব্যাপারে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তোমাদের উপর প্রহরীরূপে আছেন। (আন নিসা: ১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থঃ হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রের ও বংশের অন্তর্ভুক্ত করেছি, যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যারা বেশী খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে বেশী মর্যাদাবান। অবশ্যই আল্লাহ জ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল। (আল হুজরাতঃ ১৩)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, সুদ যা এখন চালু আছে- বর্জন কর যদি হও সত্যিই ঈমানদার। (আল বাকারা: ২৭৮)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদ খাবে না- আল্লাহকে ভয় কর যাতে করে সাফল্যমন্ডিত হতে পার। (আল ইমরান: ১৩০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের মাল ভক্ষণ করবে না- হ্যাঁ, যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যৌথ ব্যবসা হয়, সেটা ভিন্ন কথা। (আন নিসা: ২৯)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيم- تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে এমন একটা ব্যবসার কথা বলব কি যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? ঈমান আন আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি। আ জিহাদ কর আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে। তোমরা প্রকৃত জ্ঞানী হলে বুঝবে এটাই তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। (আস সফ: ১০-১১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ: তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও। (আস সফ: ১৪)
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থঃ তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর, বিচ্ছিন্ন হবে না। (আল ইমরান: ১০৩)
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানব জাতিকে কল্যাণের পথে আহবান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে বাধা দেবে, তারাই সফলকাম। (আল ইমরান: ১০৪)
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
অর্থঃ ঈমানদার নারী পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা দান। তারা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। তাদের প্রতি সত্বর আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। আল্লাহ পরক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞ। (আত তাওবা: ৭১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা শাসন ক্ষমতার অধিকারী তাদের। (আন নিসা: ৫৯)
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং সৎকর্মশীল হবেন, তাদের প্রতি আল্লাহর ওয়াদা তাদেরকে দুনিয়ার খেলাফত দান করা হবে যেমন তার পূর্ববর্তিদেরকে দান করা হয়েছে। (আন নূর: ৫৫)
ইসলামী আদর্শের দ্বিতীয় উৎস সুন্নাতের রাসূল বা হাদিসে রাসূল। সেখানেও জামায়াতী জিন্দেগীর বাইরে ইসলামের কোন ধারণা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এখানে তো বলা হয়েছে মাত্র দুজন কোথাও ভ্রমণ করলেও তার একজনকে আমীর করে নিয়ে জামায়াতী শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলবে।
আল্লাহর রাসূল জামায়াতী জিন্দেগীর ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত হাদিসটির মাধ্যমে:
عن الحارث الاشعري قال قال رسول الله صلعم انا امركم بخمس الله امرني بهن بالجماعة والسمع والطاعة والهجرة والجهاد فئ سبيل الله
অর্থ: হযরত হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) বলেন, আমি পাঁচটি জিনিসের ব্যাপারে তোমাদের আদেশ করছি (অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আর আমার আল্লাহ আমাকে এই পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন) (১) জামায়াত বদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) নেতার আদেশ মেনে চলবে (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। (আহমদ ও তিরমিজী)
উক্ত হাদিসে একই সাথে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের উপাদান, কাঠামো ও কার্যক্রমের মৌলিক কথাগুলো সংক্ষেপে অথচ সুন্দরভাবে বলা হয়েছে।
আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহ বাস্তবায়নে অন্যতম সার্থক ও সফল রূপকার হযরত ওমর ফারুক (রা.) কোরআন ও সুন্নাহর স্পিরিটকে সামনে রেখে ইসলামের যে সংজ্ঞার দিয়েছেন তাতেও ইসলামের সংজ্ঞার পাশাপশি ইসলামী জামায়াত বা সংগঠনের উপাদান এবং কাঠামো এসে গেছে। তিনি বলেছেন:
لا اسلام الا بجماعة و لا جماعة الا بامارة و لا امارة الا بطاعة
অর্থ: জামায়াত ছাড়া ইসলামের কোন অস্তিত্ব নেই। আর নেতৃত্ব ছাড়া জামায়াতের কোন ধারণা করা যায় না। তেমনিভাবে আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্বও অর্থহীন। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে:
يد الله مع الجماعة ومن شذ شذ الى النار
অর্থ: জামায়াতের প্রতি আল্লাহর রহমতের হাত প্রসারিত থাকে। যে জামায়াত ছাড়া একা চলে সে তো একাকী দোযখের পথেই ধাবিত হয়। (তিরমিজী)
من خرج من الطاعة و فارق الجماعة فمات ميتة جاهلية
যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করে এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছন্ন হওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
সুতরাং আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নহ এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমার ভিত্তিতে অকাট্যভাবে প্রামণিত হয় যে, দ্বীন ইসলামে জামায়াত বিহীন জীবনের কোন ধারণা নেই। জামায়াতবিহীন মৃত্যুকে তো জাহেলিয়াতের মৃত্যু হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। আতএব জামায়াতবদ্ধ হওয়া, জামায়াতবদ্ধ হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো ফরজ। আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করে এসেছি, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা ফরজ আর আন্দোলনের জন্যে সংগঠন অপরিহার্য। কাজেই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত হওয়া অনিবার্য কারণেই ফরজ হতে বাধ্য।
সংগঠনের উপাদান
মানুষের সমাজে কিছু কাজ করার জন্যে যে সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, মোটামুটি তার কিছু উপাদান থাকে। যেমন (১) আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি (২) নেতৃত্ব (৩) কর্মীবাহিনী (৪) কর্মক্ষেত্র।ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সংগঠনেও উল্লিখিত উপাদানগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান থাকে। ইসলামী সংগঠন সঠিক ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠন বিধায় সে একমাত্র কোরআন সুন্নাহর আদর্শকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং মুমিন জীবনরে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা হওয়া উচিত তাকেই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আদর্শ যেমন কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই নেয়, তেমনি সে আদর্শ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতিও কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করে সংগঠনের দ্বিতীয় উপাদান নেতৃত্বের ব্যাপারে। এই সংগঠন রাসূলে খোদার আদর্শ অনুযায়ী নেতৃত্ব গড়ে তোলাকে অন্যতম সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। এই সংগঠনের যাত্রাই শুরু হয় নেতৃত্বের মাধ্যমে। এই সংগঠনের নেতৃত্ব নায়েবে রাসূলের মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য গ্রহণের প্রশ্ন একান্ত স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়। সুতরাং ইসলামী সংগঠনের উপাদান সমূহরে কথা আমরা এভাবে সাজাতে পারি।
(১) কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতি।
(২) কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী নেতৃত্ব।
(৩) কোরআন ও সুন্নাহর বাঞ্ছিত মানের আনুগত্য।
(৪) এর সাধারণ এবং বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র সমগ্র দুনিয়া, সমগ্র দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু প্রাথমিক কর্মক্ষেত্রে, যারা যে দেশে জন্মেছে, যে দেশে বসবাস করছে সেই দেশ এবং সেই দেশের জনগণ।
উল্লেখিত উপাদানগুলোর সাথে আরো দুটো উপাদান ইসলামী সংগঠনের প্রাণশক্তির ভূমিকা পালন করে আর আন্দোলনকে করে তোলে গতিশীল। তার একটা হলো পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা আর দ্বিতীয়টি হলো সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনার ব্যবস্থা চালু থাকা। আমরা এই পুক্তিকার শেষ অংশে নেতৃত্ব, আনুগত্য পরামর্শ এবং সমালোচনা এই চার বিষয় পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার চেষ্টা করব।
ইসলামী সংগঠনের প্রকৃত মডেল
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত ইসলামই ‘জামায়াতে ইসলামী’ সংগঠনের প্রকৃত মডেল। একইভাবে মুহাম্মদ (সা.)- এর নেতৃত্বই ইসলামী নেতৃত্বের একমাত্র মডেল। মুহাম্মদ (সা.) এর পরবর্তী মডেল হলো খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত। এরপরে আর কোন মডেল নেই। আল্লাহর রাসূলের নির্দেশঃعليكم بسنتى و سنة الخلفاء الرشدين المهديين
অর্থ: তোমদেরকে আমার ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবশ্য অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
রাসূলে (সা.) প্রতিষ্ঠিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত, আল জামায়াত। এই মডেল অনুকরণে ও অনুসরণে গড়ে ওঠা জামায়াতের প্রকৃত লক্ষ্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। এইরূপ রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রকৃত জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব। আমরা বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত আছি- অথচ হাদিসের আলোচনায় বুঝা যায়, ইসলামী জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে ইসলামী নেতৃত্বের বাইয়াত গ্রহণ ছাড়া মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি? জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচার উপায় কি?
এই অবস্থায় আমাদের বাঁচার উপায় হলো, একমাত্র কারণীয় কাজ হলো আল্লাহর রাসূলের ও খোলাফায়ে রাশেদীনের মডেল বা সুন্নাতকে সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা খেলাফত আলা মিনহাজিন্নবুয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করতে একমত- এমন লেঅকদের সম্বন্বয়ে জামায়াত কায়েম করা। এই জামায়াত হবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প। আর এই জামায়াতের নেতৃত্ব হবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিকল্প। এভাবে একটা অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা করে জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ করা এবং জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই জামায়াতকে প্রকৃত জামায়াত গড়ার means রূপে ব্যবগার করতে হবে। এটাকে end ভাবা ঠিক হবে না বা end ভাবলে এর মাধ্যমে যে বৃহত্তর কাজ, মহান দায়িত্বে আঞ্জাম দেয়ার কথা তা দেয়া সম্ভব হবে না। পরিণামে এটা একটা ফেরকায় রূপ নেয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম ও শরয়ী মর্যাদা
ইসলামী আন্দোলনের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা যে পাঁচটি পরিভাষা যেমনঃ ১. দাওয়াত ২. শাহাদাত ৩. কিতাল ৪. ইকামাতে দ্বীন এবং ৫. আমর বিল মা’রূফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার - এর সামগ্রিক রূপটিই ইসলামী আন্দোলন বলে বুঝে থাকি। আর ইসলামী সংগঠন তো ইসলামী আন্দোলনের জন্যেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত জনশক্তি ইসলামী সংগঠন পরিকল্পিতভাবে উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্যেই ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ইসলামী সংগঠন দাওয়াত ইলাল্লাহ ও শাহাদাত হকের
0 comments: