আনুগত্য কাকে বলে?
আনুগত্য অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা, উপরন্তু কোন কর্তৃপক্ষের ফরমান-ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ করা প্রভৃতি। আল কোরআনে এবং হাদিসে রাসূলে এর প্রতিশব্দ হিসেবে যেটা পাই সেটা হলো এতায়াত। এতায়াতের বিপরীত শব্দ হলো মাছিয়াত বা এছইয়ান। যার অর্থ নাফরমানী করা, হুকুম অমান্য করা প্রভৃতি।
প্রকৃত আনুগত্য বা প্রকৃত এতায়াত হলো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলা। এটাই মানুষের একমাত্র দায়িত্ব, কর্তব্য এবং করণীয় কাজ যা ইবাদত নামেই অভিহিত। এই প্রকৃত এতায়াতের ব্যবহারিক রূপ হলোঃ
أَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থঃ আল্লাহর এতায়াত করা, রাসূলের এতায়াত কর এবং উলিল আমরের এতায়াত কর। (আন নিসাঃ ৫৯)
من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله ومن يطع الأمير فقد أطاعني ومن يعص الأمير فقد عصاني
অর্থঃ যে আমার এতায়াত বা আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার হুকুম অমান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই অমান্য করল। যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমীরের আদেশ অমান্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই আদেশ অমান্য করল। (বুখারী, মুসলিম)
উপরে উল্লেখিত কোরআনের ঘোষণা এবং হাদিসে রাসূলের আলোকে পরিষ্কার বুঝা যায় - আল্লাহর আনুগত্য রাসূলের মাধ্যমে। আর আল্লাহ ও রাসূল উভয়ের আনুগত্য উলিল আমর বা আমীরের মাধ্যমে। তবে আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য শর্তহীন এবং নিরঙ্কুশ, উলিল আমর বা আমীরের আনুগত্য শর্ত সাপেক্ষ এবং আল্লাহ ও রাসূল প্রদত্ত সীমারেখার মধ্যে সীমিত।
ইসলামের সাথে আনুগত্যের সম্পর্ক
ইসলাম ও আনুগত্য অর্থের দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন, তেমনি দ্বীন এবং এতায়াতও অর্থের দিক দিয়ে একটা অপরটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলামের শাব্দিক অর্থও তাই আনুগত্য বা অত্মসর্মপণ করা, এতায়াত শব্দের অর্থ তাই। এভাবে দ্বীন শব্দটির চারটি অর্থ আছে, তার একটি আনুগত্য বা এতায়াত। দ্বীন ও ইসলাম যে বৃহত্তর আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা উপস্থাপন করে, সেই আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থার মধ্যে দ্বীন ও ইসলামের আভিধানিক অর্থের, ধাতুগত অর্থের ছাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই শাব্দিক অর্থের আলোকে দ্বীনের এবং ইসলামের অন্তর্নিহিত দাবী অনুধাবন করলে দেখা যাবে যে, এখানে আনুগত্যই মূল কথা। সুতরাং আমরা এটা বলতে পারি, ইসলামই আনুগত্য অথবা আনুগত্যই ইসলাম। দ্বীনের অপর নাম আনুগত্য। আনুগত্যেরই অপর নাম দ্বীন। যেখানে আনুগত্য নেই সেখানে দ্বীন নেই, ইসলাম নেই। যেখানে ইসলাম নেই, দ্বীন নেই, সেখানে আনুগত্য নেই। যার মধ্যে আনুগত্য নেই, বাহ্যত সে ইসলামের যতবড় পাবন্দ হোক না কেন, যতই দ্বীনদার হোক না কেন, তার মধ্যে দ্বীন নেই, ইসলাম নেই। কারণ আনুগত্যই দ্বীন ইসলামের প্রাণসত্তা।আনুগত্যের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতাঃ
কোরআনের ঘোষণাঃ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ
অর্থঃ আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (আশ-শুআরাঃ ১৫০)
এখানে আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং তার পছন্দনীয় পথে জীবন যাপন করার জন্যে রাসূলের আনুগত্যকে অপরিহার্য করা হয়েছে। আর এই দুটো শব্দ বিশিষ্ট নির্দেশ অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর, আমার আনুগত্য করা- মক্কার সূরাগুলোতে বার বার এসেছে।
কোরআনে হাকিমের আরও ঘোষণাঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর খোদার, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেসব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিক ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই খোদা ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটাই উত্তম। (আন নিসাঃ ৫৯)
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا
অর্থঃ ঈমানদার লোকেদের কাজতো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হবে - যেমন রাসূল তাদের মামলা মুকাদ্দমা ফায়সালা করে দেয় তখন করা বলেঃ আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। (আন নূরঃ ৫১)
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
অর্থঃ কোন মুমিন পুরুষ ও মুমিন স্ত্রীলোকেরও এই অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে ফায়সালা করে দেবে তখন সে নিজেই সেই ব্যাপারে কোন ফায়সালা করার ইখতিয়ার রাখবে। (আল আহযাবঃ ৩৬)
এখানে লক্ষণীয় এই এতায়াতকে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি ঈমানের অনিবার্য দাবী হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
হাদিসে রাসূলে বলা হয়েছেঃ
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- أَنَّهُ قَالَ « عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ إِلاَّ أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ ».
অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মুসলমানদের উপর নেতার আদেশ শোনা ও মানা অপরিহার্য কর্তব্য। চাই সে আদেশ তার পছন্দনীয় হোক, আর অপছন্দনীয় হোক। তবে হ্যাঁ, যদি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কোন কাজের নির্দেশ হয় তবে সেই নির্দেশ শোনা ও মানার কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী ও মুসলিম)
عن عبادة بن الصامت قال
: بايعنا رسول الله صلى الله عليه و سلم على السمع و الطاعة في المنشط والمكره وأن لا ننازع الأمر أهله وأن نقوم أو نقول بالحق حيثما كنا لا نخاف في الله لومة لائم
অর্থঃ আবু অলিদ ওবাদা ইবনে ছামেত (রা.) বলেন, আমরা নিম্নোক্ত কাজগুলোর জন্যে রাসূলের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলামঃ (১) নেতার আদেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে- তা দুঃসময়ে হোক, আর সুসময়ে হোক। খুশির মুহুর্তে হোক, আর অখুশির মুহুর্তে হোক। (২) নিজের তুলনায় অপরের সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। (৩) ছাহেবে আমরের সাথে বিতর্কে জড়াবে না, তবে হ্যাঁ, যদি নেতার আদেশ প্রকাশ্য কুফরীর শামিল হয় এবং সে ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যথেষ্ট দলিল প্রমাণ থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। (৪) যেখানে সে অবস্থাতেই থাকি না কেন হক কথা বলতে হবে। আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের ভয় করা চলবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
এখানে আল কোরআন এবং হাদিসে রাসূল (সা.) এর আলোকে আনুগত্যের যে গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা আমরা বুঝতে পারি, মানুষের সমাজ জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন কি প্রাণীজগতেও এর বাস্তবতার ও যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র একটা পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্নমুখী প্রতিষ্ঠানের গঠনমুখী কার্যক্রম প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের আনুগত্যের উপরই নির্ভরশীল। বিশেষ করে যে কোন আন্দোলনের, সংগঠনের জন্যে আনুগত্যই চালিকাশক্তি বা প্রাণশক্তির ভূমিকা পালন করে।
ইসলামে আনুগত্য ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব আরো অনেক বেশী। ইসলামের এই আনুগত্য ও শৃঙ্খলাকে অনেকে আবার অবাস্তবও মনে করতে চান। তাদের মনকে সন্দেহ-সংশয় মুক্ত করার জন্যে ইসলামের বাইরেও যে এর গুরুত্ব স্বীকৃত এর বাস্তব পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে।
ইসলামের বিজয়ের শুভ সংবাদ, বিশ্বজোড়া খেলাফতের ওয়াদা, আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরায়ে নূরের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এই ওয়াদার আগে ঈমানদারদের যে পরিচয় দেয়া হচ্ছে, তাতে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখাবার কথাই উল্লিখিত হয়েছে। বলা হয়েছে মুমিনদের একমাত্র পরিচয় হলো যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে কোন ফরমান শুনার জন্যে ডাকা হয় তখন তাদের মুখ থেকে মাত্র দুটি শব্দই উচ্চারিত হয়। একটা হলো, আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম; দ্বিতীয়টা হলো, মাথা পেতে এই নির্দেশ মেনে নিলাম। এইরূপ দ্বিধাহীন নির্ভেজাল আনুগত্যই সাফল্যের চাবিকাঠি।
আনুগত্যহীনতার পরিণামঃ
আল কোরআন ঘোষণা করেছেঃيَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের অনুসরণ কর আর নিজেদের আমল বিনষ্ট করো না।(মুহাম্মদঃ ৩৩)
এই আয়াতের পূর্বাপর যোগসূত্র এবং নাযিলের পরিবেশের দৃষ্টিতে এর অর্থ দাঁড়ায়, আনুগত্যহীনতা সমস্ত নেক আমলকে বরবাদ করে দেয়। নবী (সা.) এর পেছনে জামায়াতের সাথে নামাজ পড়েছে তারাই যখন যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ অমান্য করল, তাদের সমস্ত আমল ধূলায় মিশে গেল। আল্লাহ তাদেরকে মুনাফিক নামে ঘোষণা করলেন।
কোরআন পাকের আরও ঘোষণাঃ
فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِين
অর্থঃ অথচ তোমরা তাদের প্রতি রাজী ও সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো কিছুতেই ফাসেকদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না। (আত তাওবাঃ ৯৬)
এই আয়াতের আলোকে বুঝা যাচ্ছে আনুগত্যহীনতার পরিণামে আল্লাহর রেজামন্দী থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
কোরআনে আরও ঘোষণা করেঃ
وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
অর্থঃ যদি তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর, তাহলে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আমার রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র দ্বীনের দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌছিয়ে দেয়া। (আন নূরঃ ৫৪)
এই আয়াতে পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে- আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে হেদায়াত লাভে খোদা প্রদত্ত তৌফিক থেকে বঞ্চিত হওয়া আশঙ্কা থাকে।
হাদিসে রাসূলে বলা হয়েছেঃ
من خرج من الطاعة و فارق الجماعة فمات مات ميتة جاهلية
অর্থঃ যে আনুগত্যের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায় এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হয় জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
উক্ত হাদিসে প্রথমতঃ আনুগত্যহীনতাকে জামায়াত ত্যাগের শামিল বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এর পরিণাম হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।
আরও বলা হয়েছেঃ
من كره من اميره شيئا فليصبر فانه من خرج من السلطا ن شبرا ما ت ميتة جاهلية
অর্থঃ যদি কেউ তার আমীরের মধ্যে অপছন্দনীয় কোন কাজ দেখতে পায় তাহলে যেন ছবর করে। (আনুগত্য পরিহার না করে) কেননা যে ইসলামী কর্তৃপক্ষের আনুগত্য থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে যায় বা বের হয়ে যায় তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (আল হাদিস)
উক্ত হাদিসে প্রথমতঃ আনুগত্যহীনতাকে জামায়াত ত্যাগের শামিল বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এর পরিণাম হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু।
আরও বলা হয়েছেঃ
عن ابن عمر رضى الله تعالى عنه عن النبى (ص)قال« مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِىَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ».
অর্থঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) রাসূলে পাক (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আনুগত্যের বন্ধন থেকে হাত খুলে নেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে, নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনে কার বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
এই হাদিসেও আনুগত্য প্রদর্শনে অপারগতাকে বাইয়াতহীনতার শামিল বুঝানো হয়েছে- যার ফলে জাহেলিয়াতের মৃত্যু এবং আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে অক্ষম হওয়া।
দ্বীনি ও ঈমানী দৃষ্টিকোন থেকে আনুগত্যহীনতার এই পরিণামের পাশাপাশি এর জাগতিক কুফল, শান্তি-শৃঙ্খলাহীনতা, অরাজকতা, ঐক্য-সংহতির বিঘ্ন হওয়া প্রভৃতির উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ আমাদের কে আনুগত্যহীনতার এই উভয়বিধ কুফল থেকে হেফাজত করুন।
আনুগত্যের দাবী
আমরা দ্বীন ও ইসলামের সাথে আনুগত্য বা এতায়াতের যে সম্পর্ক দেখিয়েছি, তার আলোকেই বলেতে হয়, ইসলামের বাঞ্ছিত আনুগত্য তাকেই বলা যাবে, যেটা মনের ষোলআনা ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে, পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে, স্বতঃস্ফূর্ত সহকারে। কোন প্রকারের কৃত্রিমতা বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংকোচ-সংশয়ের কোন ছাপ বা পরশ থাকতে পারবে না। এই আনুগত্য প্রাণহীন আনুষ্ঠানিক মাত্র হলে চলবে না। কোন নির্দেশ বা সিদ্ধান্তের আক্ষরিক দিকটাই কেবল বাস্তবায়ন করলে চলবে না, উক্ত নির্দেশ বা সিদ্ধান্তের অন্তর্নিহিত দাবী মন-মগজ দিয়ে উপলব্ধি করে নিষ্ঠার সাথে এবং সাধ্যমত সর্বোত্তম উপায়ে বাস্তাবয়নের চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর কোরআন এই প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেঃ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ আপনার রবের কসম! তারা কখনও ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মুকাদ্দমার ব্যাপারে একমাত্র আপনাকেই ফায়সালা দানকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, অতঃপর আপনার দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের মনে দ্বিধা-সংশয় থাকবে না এবং ঐ সিদ্ধান্ত সর্বোত্তম উপায়ে মাথা পেতে নেবে। (আন নিসাঃ ৬৫)
মুনাফিকদের আনুগত্যের দাবীর কৃত্রিমতা প্রসঙ্গে সূরায়ে নূরে আল্লাহ বলেছেন
لَا تُقْسِمُوا طَاعَةٌ مَعْرُوفَةٌ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থঃ বলেন হে নবী! কসম খেয়ে আনুগত্য প্রমাণের তো কোন প্রয়োজন নেই। আনুগত্যের ব্যাপারটা তো খুবই পরিচিত ব্যাপার। সন্দেহ নেই, আল্লাহ তোমাদের আমল সম্পর্কে অবগত আছেন। (আন নূরঃ ৫৩)
আনুগত্যের পূর্বশর্ত
আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে এবং নবী (সা.) হাদিসে যত জায়গায় এই আয়াত উল্লেখ করেছেন, তার প্রায় সব জায়গাতেই এই আয়াতের আগে সামায়াত শব্দটা ব্যবহার করেছেন, যার শাব্দিক অর্থ হলো শোনা, শ্রবণ করা। বলা হয়েছে واسمعوا واطيعوا শোন এবং মান سمعنا و اتطعناশুনলাম এবং মানলাম। যে হাদিসটির মাধ্যমে আমরা জামায়াতী জিন্দেগীর পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই সেখানে বলা হয়েছেঃ امركم بخمس الجماعة و السمع و الطاعة و الهجرة و الجهاد فى سبيل الله
আর্থঃ ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি জিনিসের নির্দেশ দিচ্ছি- জামায়াতের, শুনার এবং আনুগত্য করার, হিজরত এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্যে।’ এখানে এতায়াতের আগে জামায়াতের কথা বলা হয়েছে। এই থেকেও পরিষ্কার হয় যে, কোন নির্দেশ ও কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সেই সিদ্ধান্তটা কি তা আগে ভালভাবে জানা ও বুঝা দরকার। কোন কিছুর উপর সঠিকভাবে আমল তো তখনই সম্ভব হবে যখন ব্যাপারটা সম্পর্কে, এর গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হবে। শুধু নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত আক্ষরিকভাবে জানলেও যথেষ্ট হয় না। এর অন্তর্নিহিত দাবী এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। তাই কোন সিদ্ধান্ত তা মৌখিক হোক অথবা লিখিত হোক, আসার সাথে সাথে মনোযোগ দিয়ে তা জানার ও বুঝার চেষ্টা করতে হবে, এর গুরুত্ব তাৎপর্যও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করতে হবে। কোথাও কোন ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকলে, বা বঝে না আসলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে, অস্পষ্টতা দূর করে সঠিক বুঝ হাসিলের চেষ্টা করতে হয়। রাসূলের শেখানো দোয়াঃ
اللهم ارنا الحقا و ارزقنا اتباعه وارنا الباطل باطلا وارزقنا اجتنابه
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমাদের হককে হক হিসেবে দেখান আর তৌফিক দিন তার অনুসরণ করার এবং বাতিলকেও বাতিল হিসেবে দেখান আর তৌফিক দিন তাকে বর্জন করার।
এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কি? হকের অনুসরণ করার জন্যে হককে হক হিসেবে চিনতে পারা অপরিহার্য। বাতিলকে বর্জন করতে হলে তেমনি বাতিল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরী। এমনিভাবে যে কোন জিনিসের গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং অনুসরণের ব্যাপারটা উক্ত সিদ্ধান্ত জানা, বুঝা এবং গুরুত্ব ও পদ্ধতিগত জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল।
ওজর পেশ করা গুনাহঃ
ইসলামী আন্দোলনের সারকথা- এটা ঈমানের দাবী, নাজাতের উপায় এবং মুসলমানের প্রধানতম কর্তব্য। সুতরাং এই কর্তব্য পালনের পথ করে নেয়া বা সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করাই ব্যক্তির দায়িত্ব। এভাবে যারা সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়, আল্লাহ তাদেরকে সুযোগ করে দেন। আল্লাহ পাকের ঘোষণা রয়েছেঃ وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَاد
অর্থঃ যারা আমার রাস্তায় সংগ্রাম-সাধনা করে আমি তাদের পথ করে দেই। (আল আনকাবূতঃ ৬৯)
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
অর্থঃ যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ করে দেয়-এমন উপায়ে তার রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন যা কল্পনা করা যায় না। (আত তালাকঃ ২,৩)
অভাব, অভিযোগ ও অসুবিধা প্রত্যেকের কিছু না কিছু থাকেই এবং যার যার বিচারে নিজের সমস্যাই বড় করে দেখা মানুষের একটি প্রকৃতিগত দুর্বলতা। ঈমানের দাবী হলো, এসব অভাব-অভিযোগ বা অসুবিধা, বাধা-প্রতিবন্ধকতাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে এর অজুহাতে কাজ থেকে অব্যাহতি না চেয়ে বরং আরো বেশী বেশী করা। আল্লাহর কালামের ঘোষণাঃ
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ
অর্থঃ কোন বিপদ-মুছিবত আল্লাহর অনুমোদন বা নির্দেশ ছাড়া আসতে পারে না। যারা আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান এনেছে তাদের দিলকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেন। (আত তাগাবুনঃ ১১)
অর্থাৎ তাদের দিলে এই ব্যাপারে সঠিক বুঝ পেয়ে যায় এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা অজুহাত হিসেবে নিয়ে কাজ থেকে দুরে থাকার চিন্তা করে না।
আল কোরআনের ঘোষণা এক পর্যায়ে এভাবে ওজর পেশ করে কোন নির্দেশ পালন থেকে অব্যাহতি চাওয়াকে ঈমানের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র অনুমতি প্রার্থনার সুযোগ দেয়া হয়েছে বটে কিন্তু আলোচনার ধরন-প্রকৃতি ভালভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করলে দেখা যায়, অনুমতি চাওয়াকে অপছন্দ করা হয়েছে- এটা গুনাহর কাজ এই বলে সূক্ষ্মভাবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যেঃ
لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ
অর্থঃ যারা আল্লাহর এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে, তারা কখনো আল্লাহর পথে জানমাল দিয়ে জিহাদ করা থেকে আপনার কাছে অব্যাহতি চাইবে না। (সূরা তাওবাঃ ৪৪)
সূরা নূরে কথাটা অন্যভাবে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
অর্থঃ মুমিন তো প্রকৃতপক্ষে তারাই যারা আল্লাহ রাসূলকে অন্তর থেকে মানে। আর যখন কো সামষ্টিক কাজ উপলক্ষে রাসূলের সাথে থাকে, তখন অনুমতি না নিয়ে কোথাও যায় না। হে নবী! এভাবে যারা আপনার কাছ থেকে অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ ও রাসূলকে মান্য করে চলে। অতএব তারা যখন কোন ব্যাপারে অনুমতি কামনা করে তাহলে তাদের মধ্য থেকে যাকে চান অনুমতি দিতে পারেন এবং এরূপ লোকদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (অন নূরঃ ৬২)
এখানে সূরা নূরের আয়াতটি মূলত মুনাফিকদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যারা দায়িত্ব ও কর্তব্য ফাঁকি দেয়ার মন-মানসিকতা নিয়ে অনুমতি চাইত। এই মন-মানসিকতাসহ ওজর পেশ ও অনুমতি অব্যাহতি কামনা আসলেই ঈমানের পরিপন্থী। সূরা নূরের কথাটা কোন মৌলিক সিদ্ধান্তের ওপর আমল করা থেকে সাময়িক প্রয়োজনে একটু এদিক ওদিক যাওয়া আসার মধ্যেও সীমাবদ্ধ। এখানে জামায়াতী শৃঙ্খলার ব্যাপারটাই প্রধান। সে ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়, যারা কোন কারণে অনুমতি প্রার্থনা করবে তাদের সবাইকে অনুমতি দিতে বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যাদের আপনি অনুমতি দিতে চান। দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছে, তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে দোয় করবেন।
ওজর পেশের সঠিক পদ্ধতি হলো, ব্যক্তি নিজে এই ওজরের কারণে কাজ না করার ফায়সালা নেবে না। বরং শুধু সমস্যাটা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যাই আসুক তাতেই কল্যাণ আছে, এই আস্থা রাখবে।
আনুগত্যের পথে অন্তরায় কি কিঃ
আনুগত্য প্রদর্শনে যারা ব্যর্থ হয়, তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে অনেক অজুহাত পেশ করে থাকে। অনেক সুবিধা অসুবিধার কথা বলে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এগুলোর স্বীকৃতি দেন না। তার পক্ষ থেকে আনুগত্যহীনতার কারণ হিসেবে পরকালের জবাবদিহির অনুভূতির অভাব, আখেরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন বলেছেঃ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآَخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ
অর্থঃ হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদের কি হয়েছে যে যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বলা হলো তোমরা মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকলে? তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবনকেই পছন্দ করে নিলে? যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে জেনে নিও, দুনিয়ার এইসব বিষয় সামগ্রী আখেরাতে অতি তুচ্ছ ও নগণ্য হিসেবে পাবে।(আত তাওবাঃ ৩৮)
كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُونَ بِالدِّينِ
অর্থঃ কখনও না, বরং প্রকৃত ব্যাপার হলো, তোমরা প্রতিফল দিবসের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ কর। (আল ইনফিতারঃ ৯)
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى
অর্থঃ বরং তোমরা তো দুনিয়ার এই পার্থিব জীবনকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখেরাতের জীবনই উত্তম ও স্থায়ী। (আল আ’লাঃ ১৬-১৭)
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ
অর্থ: তোমাদেরকে বেশী বেশী দুনিয়া ভোগ করার প্রবণতা এবং একে অপরকে এই ব্যাপারে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গাফলতির মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছে। (আত তাকসুরঃ ১)
আল কোরআনের উল্লিখিত আয়াতসমূহের আলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আখেরাতের অনুভূতির অভাব এবং দুনিয়া পূজার মনোভাবই আনুগত্যহীনতার প্রধানতম কারণ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কারণ হিসেবে আসে যার যার জায়গায় নিজ নিজ দায়িত্বের যথার্থ অনুভূতির অভাব। সেই সাথে বিভিন্ন কাজের বা সিদ্ধান্তের গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক চেতনার (Proper motivation)- এর অভাব। কাজটা হলে কি কি কল্যাণ কা লাভ হবে, না করলে কতটা ক্ষতি ব্যক্তির হবে, কতটা ক্ষতি আন্দোলন ও সংগঠনের হবে - এই চেতনা ও উপলব্ধির অভাবও সাধারণভাবে আনুগত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
উপরে বর্ণিত কারণ ছাড়াও কিছু মারাত্মক ও ক্ষতিকর কারণ রয়েছে, যেগুলোর কারণে জেনে বুঝেও মানুষ আনুগত্য করতে ব্যর্থ হয়।
একঃ গর্ব, অহংকার, আত্মপূজা ও আত্মম্ভরিতা।
গর্ব- অহংকার মূলত ইবলিসি চরিত্র। ইবলিস আল্লাহর হুকুম পালনে ব্যর্থ হলো কেন?
আল্লাহ বলেনঃ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ
অর্থঃ সে হুকুম পালনে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। (আল বাকারাহঃ ৩৪)
إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
অর্থঃ আল্লাহ কখনও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।(লুকমানঃ ১৮)
হাদিসে কুদসীতে বলা হয়েছে- আল্লাহ বলেনঃ অহংকার তো আমার চাদর (একমাত্র আমার জন্যেই শোভনীয়)। যে অহংকার করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমার চাদর নিয়েই টানাটানি করতে ব্যর্থ প্রয়াস পায়।
মানুষের দুর্বলতার এই ছিদ্রপথ বেয়ে ইবলিস সুযোগ গ্রহণ করে, তার মনে আবার হাজারো প্রশ্ন তুলে দেয়- সিদ্ধান্ত কে দিল? হুকুম আবার কার মানব? আমি কি, আর সে কে? এই অবস্থায় মানুষের উচিত ইবলিসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া। তাঁর কাছ আশ্রয় প্রার্থনা করা। এটা একটা রোগ মনে করা, ইবলিসি প্রতারণা মনে করে কেউ যদি কাতর কন্ঠে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আল্লাহ সে ফরিয়াদ শুনে থাকেন, তাঁর বিপন্ন বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন। আল্লাহ পাকের ঘোষণাঃ
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
অর্থঃ যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন উস্কানি অনুভব কর, তাহলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা কর। তিনি তো অবশ্যই সব কিছু শোনেন এবং জানেন। (হা-মীম আস সাজদাঃ ৩৬)
দুইঃ এই পর্যায়ের দ্বিতীয় কারণ- হৃদয়ের বক্রতা যা সাধারণত সৃষ্টি হয়ে থাকে দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলস্বরূপ নানারূপ জটিল কুটিল প্রশ্ন তোলার বা সৃষ্টির মাধ্যমে। মূসা (আ.) এর কওম সম্পর্কে আল্লাহ সূরায়ে সফে বলেছেনঃ
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ
অর্থঃ মূসা (আ.) এর কথা স্মরণ কর, যখন তিনি তার কওমকে লক্ষ করে বললেন, আমাকে তোমরা পীড়া দিচ্ছ কেন বা উৎপীড়ন করছ কেন? অথচ তোমরা তো জান যে, আমি আল্লাহর রাসূল। এরপরও যখন তারা বাঁকা পথে পা বাড়াল, আল্লাহ তাদের দিলকে বাঁকা করে দিলেন। (আস সফঃ ৫)
মূসা (আ.) কে তারা উৎপীড়ন করতো কিভাবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন নির্দেশ ফাঁকি দেয়ার, পাশ কাটানোর উদ্দেশ্যে আবোল-তাবোল ও জটিল-কুটিল প্রশ্নের অবতারণা করতো। আল্লাহ তায়ালা এটাকেই বাঁকা পথে চলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এর পরিণাম সত্যি সত্যি আল্লাহ তাদের দিলকে বক্র করে দিয়েছেন - এভাবে নবীর প্রতি ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পরও ফসেকদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিজেদের কর্মদোষে।
আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদীকে এই রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্যেই বণী ইসরাঈলের কীর্তিকলাপ ও তার পরিণাম সম্পর্কে অবহিত করেছেন। সেই সাথে হেদায়াত লাভের পর হৃদয়ের বক্রতার শিকার হয়ে যাতে আবার গোমরাহীর শিকার না হয় এই জন্যে দোয়া শিখিয়েছেনঃ
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
অর্থঃ হে আমাদের রব! একবার হেদায়াত দানের পর তুমি আমাদের হৃদয়কে বাঁকা করে দিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে খাস রহমত দান কর, তুমি তো অতিশয় দাতা ও দয়ালু। (আল ইমরারঃ ৮)
তিনঃ এই পর্যায়ে তৃতীয় কারণটি হলো, অন্তরের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়-সন্দেহের প্রবণতা। সাধারণত এই মানসিকতা জন্মলাভ করে লাভ-ক্ষতির জাগতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও হিসাব-নিকাশের প্রবণতা থেকেই। আল কোরআনে সূরা হাদীসের মাধ্যমে আখেরাতের ঈমানদার ও মুনাফিকদের সংলাপের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এই সত্যটাই ধরা পড়ে। আল্লাহ বলেনঃ
يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آَمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُورٍ لَهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ يُنَادُونَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ قَالُوا بَلَى وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْأَمَانِيُّ حَتَّى جَاءَ أَمْرُ اللَّهِ وَغَرَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ
সেই দিন মুনাফিক নারী পুরুষের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মুমিনদেরকে ডেকে বলবে একটু আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখ না। যাতে করে আমরা তোমাদের নূর থেকে একটু ফায়দা নিতে পারি। কিন্তু তাদের বলা হবে, পেছনে ভাগ। অন্য কোথাও নূর তালাশ করে দেখ। অতঃপর তাদের মাঝে একটা প্রাচীর দিয়ে আড়াল করে দেয়া হবে। যার একটা দরজা থাকবে। সেই দরজা ভেতরে থাকবে রাহমত, আর বাইরে থাকবে আজাব, তারা (মুনাফিক) মুমিনদেরকে ডেকে ডেকে বলবে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? মুমিনরা উত্তরে বলবে, হ্যাঁ, ছিলে তো বটেই, তবে তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ফেতনার শিকারে পরিণত করেছিলে। তোমরা ছিলে সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, তোমরা ছিলে সন্দেহ-সংশয়ের শিকার। মিথ্যা আশার ছলনায় তোমরা ধোঁকা খেয়েছ। অবশেষে আল্লাহর শেষে সিদ্ধান্ত এসেই গেছে। আর সেই ধোঁকাবাজ (শয়তান) শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারেও ধোঁকায় ফেলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। (আল হাদীদঃ ১৩, ১৪)
উক্ত আয়াতের শেষ দিকের কথাগুলো সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদী মন-মানসিকতা, সন্দেহ-সংশয় এবং মিথ্যা আশার ছলনা এই তিনটি জিনিসই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় বস্তুবাদী চিন্তা থেকে, লাভ-ক্ষতির জাগতিক হিসাব-নিকাশ থেকে। যা পরিণামে আনুগত্যহীনতার জন্ম দিয়ে থাকে।
আনুগত্যের পরিবেশ সৃষ্টির রুহানী উপকরণঃ
এই বিষয়টা বিশেষ করে দায়িত্বশীলদের জন্যে। কিন্তু সর্বস্তরের দায়িত্বশীল তো কর্মীদের মধ্য থেকেই এসে থাকে। তা ছাড়া সংগঠনের বাইরে জনগোষ্ঠীর মাঝে আন্দোলনের প্রভাব বলয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাধারণ কর্মীরাও তো পরিচালনা বা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজেই নেতা কর্মী সবার জন্যেই এটা প্রযোজ্য। আনুগত্যের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার জানা মতে তিনটি উপকরণকে রূহানী উপকরণ বলা যায়। অথবা এই তিনটিকে কেন্দ্র করে আনুগত্যের ক্ষেত্রে রূহানী পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
একঃ সর্ব পর্যায়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগতভাবে এবং সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। এই পথে উন্নতির জন্যে প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনার সাথে এই আনুগত্যের মান বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
দুইঃ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় বডির সিদ্ধান্তের প্রতি নিষ্ঠার সাথে শ্রদ্ধা পোষণ করবে। অত্যন্ত যত্ন সহকারে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস চালাবে। আর অধস্তন সংগঠনের নেতৃত্বের দায়িত্বে যারা থাকবে তাদের ঊর্ধ্বতন সংগঠনের, ঊর্ধ্বতন নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে আদর্শ স্থাপনের প্রয়াস পেতে হবে।
তিনঃ যাদের সাথে নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হচ্ছে, যাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কামনা করা হয়, তাদের জন্যে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করা অভ্যাসে পরিণত হতে হবে।
এছাড়া নেতৃত্ব যারা দেবে বা সংগঠন যারা পরিচালনা করবে, তাদেরকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কয়েকটি ব্যাপারে অগ্রগামী হতে হবে। নিজস্ব সহকর্মী, সাথী-সঙ্গীর গন্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষও তাদের এই অগ্রগামী ভূমিকা বাস্তবে উপলব্ধি করবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা স্বীকারও করবে।
(১) ঈমানী শক্তি ও ঈমানের দাবী পূরণের ক্ষেত্রে
(২) ঈমানী শক্তি অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে
(৩) আমল, আখলাক ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে
(৪) সাংগঠনিক যোগ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে
(৫) মাঠে ময়দানের কর্মতৎপরতা ও ত্যাগ, কোরবানী ও ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে।
উল্লেখিত পাঁচটি ব্যাপারে কোন নেতা বা পরিচালক অগ্রগামী হলে তার প্রতি কর্মী তথা সাধারণ মানুষের মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভক্তি শ্রদ্ধা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এই ভক্তি শ্রদ্ধার সাধে দ্বীনি আবেগ জড়িত হওয়াটাও একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। নেতা এই পর্যায়ে পৌছতে পারলেই কর্মীরা তাকে প্রাণঢালা ভালবাসা, তার জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করে। তার কথায় সাড়া দিতে গিয়ে যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয় দ্বিধাহীন চিত্তে।
0 comments: