[এটি মাওলানা মওদূদীর একটি ভাষণ। ১৯৩৯ সালের ১৩ই এপ্রিল ‘ইকবাল দিবস’ উপলক্ষে লাহোর টাউন হলে মাওলানা এ ভাষণ প্রদান করেন।] ....সাধারণত ইংরেজি ভাষায় জিহাদ শব্দটির অনুবাদ holy war (পবিত্র যুদ্ধ) করে মারাত্মক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়। দীর্ঘকাল যাবত এই শব্দটির যেরূপ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তার ফলে ইহা এখন ‘উন্মাদনা’ বা ‘পাগলামীর’ প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। এই শব্দটি শ্রুত হওয়ার সংগে সংগেই শ্রোতার কল্পনা দৃষ্টিতে এমন এক ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় দৃশ্য ভেসে উঠে যে, ধর্মপাগলের একটি দল যেন নগ্ন তরবারি হস্তে, শ্মশ্রু উত্তোলন করে রক্ত পিপাসু চোখে ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে আর কাফেরদের পাওয়া মাত্র গ্রেফতার করছে এবং তাদের গর্দানে তরবারি রেখে বলছেঃ ‘কালেমা পড়’ নতুবা এক্ষুণি গর্দান দ্বিখণ্ডিত করা হবে। শঠ লেখকগণ বিশেষ চাতুর্যের সাথে আমাদের এরূপ চিত্র অংকিত করছে এবং তার সাথে এ মন্তব্যটি জুড়ে দিয়েছে “রক্তের গন্ধ আসে এ জাতির ইতিহাস হতে।”
মজার ব্যাপার এই যে, আমাদের এই চিত্র যারা অংকিত করেছে, তারা নিজেরাই বিগত কয়েক শতাব্দীকাল যাবৎ মারাত্মক অপবিত্র যুদ্ধে (unholy war) লিপ্ত রয়েছে। তাদের চরিত্র অত্যন্ত বীভৎস। তারা সম্পদ ও শক্তির লোভে সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিতান্ত দস্যুর ন্যায় সমগ্র পৃথিবীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা সর্বত্র ব্যবসায়ের বাজার, কাঁচামালের সম্ভার, উপনিবেশ স্থাপনের উপযোগী অঞ্চল এবং মূল্যবান দ্রব্যের খনির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। লালসার আগুনের ইন্ধন সংগ্রহ করে এটাকে চির প্রজ্বলিত করে রাখাই হলো তাদের লক্ষ্য। লালসা ও লোভের পংকিল পথেই তাদের সকল চেষ্টা নিয়োজিত। তাদের দৃষ্টিতে কোনো দেশে বিপুল খনিজ সম্পদ বর্তমান থাকা কিংবা প্রচুর কাঁচামাল উৎপন্ন হওয়াই তার উপর প্রচন্ড বিক্রমের সাথে তাদের আক্রমণ করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ। এমন কি, তাদের নিজ দেশে উৎপন্ন ব্যবসায় পণ্য বিক্রয়ের উপযুক্ত বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা কোথাও পরিলক্ষিত হলে অথবা তাদের অতিরিক্ত জনসংখ্যা সে দেশে প্রেরণ করা সম্ভব হলে সে দেশের উপর অনায়াসেই তারা আক্রমণ চালাতে পারে। আর কিছু না হলেও তাদের অধিকৃত কিংবা অধিকার করতে ইচ্ছুক এমন কোনো দেশে যাওয়ার পথে অপর কোনো দেশের অবস্থানও উহার আক্রান্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ। বলা বাহুল্য, আমরা যা কিছু করেছি তা অতীতের ইতিহাস ; কিন্তু তাদের এ র্কীতিকলাপ তো অত্যাধুনিক। সাম্প্রতিক কালের প্রত্যেকটি দিন ও রাত্রই বিশ্ববাসীর চোখের সম্মুখেই তাদের কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, ভূ-মণ্ডলের কোনো একটি অংশও এই লালসা পঙ্কিল যুদ্ধ লিপ্সু জাতির অপবিত্র আক্রমণের আঘাত হতে রক্ষা পাচ্ছে না। তথাপি তাদের চতুরতা বড়ই প্রশংসনীয়। কারণ তারা আমাদের চিত্র এতোখানি ভয়ানক ও বিভীষিকাপূর্ণ করে তুলে ধরেছে যে, তাদের নিজস্ব কদর্য চিত্র উহার অন্তরালে লুকিয়ে গিয়েছে।
পক্ষান্তরে আমাদের সরলতাও কম প্রশংসার যোগ্য নয়। শত্রুপক্ষ কর্তৃক অংকিত আমাদের চিত্র দেখে আমরা এতোদূর ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছি যে, উহার পশ্চাতে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বয়ং চিত্র নির্মাতাদের চেহারাটি দেখার কথা পর্যন্ত একদম ভুলে বসেছি। উপরন্তু আমরা কাতর কণ্ঠে ও অনুতাপের সুরে বলতে শুরু করেছিঃ “হুযুর যুদ্ধ ও প্রাণ-নাশের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই। আমরা তো বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পাদ্রির ন্যায় শান্তিপ্রিয় ধর্ম প্রচারক মাত্র। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিশ্বাসের প্রতিবাদ এবং তদস্থলে অপর কয়েকটি আকীদা-বিশ্বাসের প্রচার ও লোকদের তা মেনে নিতে বলাই আমাদের কাজ। তরবারির সংগে তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অপরাধ কখনো কখনো হয়ত আমরা করে ফেলেছি। কিন্তু বর্তমানে তা হতেও তওবা করেছি ; এমনকি, হুযুরের অস্বস্তির জন্য ‘তরবারির যুদ্ধকে’ সরকারিভাবে বাতিল করেও দেয়া হয়েছে। এখন শুধু মুখ ও লেখনির মারফতে ধর্ম প্রচারেরই নাম হচ্ছে জিহাদ ; কামান, বন্দুক ও গোলা-বারুদ ব্যবহার করা সরকারের কাজ, মুখ ও লেখনি প্রয়োগই হচ্ছে আমাদের একমাত্র উপায়।”
- চতুর্থ অধ্যায় : বিশ্ব-বিপ্লব, যিম্মীদের অবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের সন্দেহ
- তৃতীয় অধ্যায় : জিহাদের প্রয়োজন ও উহার লক্ষ্য
- দ্বিতীয় অধ্যায় : ইসলামী বিপ্লবী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য
- প্রথম অধ্যায় : জিহাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণ
0 comments: