ইসলামের জীবন পদ্ধতি


ভূমিকা : মানব চরিত মুলত এমন এক বিশ্বব্যাপী শাশ্বত সত্য যা দুনিয়ার সকল মানুষই অবগত আছে। পাপ ও পুন্য কিংবা ভাল ও মন্দ এমন কোন গোপনীয় বস্তু্ নয় যে, এটাকে অন্য কোন স্থান হতে খুজে বের করে আনতে হবে। এতে তো মানুষের জ্ঞাত ও চির পরিচিত সত্য। এর চেতনা ও অনুভুতি মানব প্রকৃতিতে খুবই স্বাভাবিক। কুরআনের ভাষায় ?? আল্লাহ তায়ালা মানব প্রকৃতিতে ভালো এবং মন্দের জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই দান করেছেন। নেকীকে ‘মারূফ’ (জানা) এবং পাপকে ‘মুনকার (অজানা) নামে অভিহিত করা হয়েছে।


এ ছাড়াও চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন আদর্শের সৃষ্টি হলো কেন? কেনইবা বিভিন্ন চরিত্র নীতির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য সৃষ্টি হলো? উল্লেখিত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ইসলামের জবাব এবং সেই অনুযায়ী রচিত বিশেষ ধরনের চরিত্র বিধান সম্পর্কেই এ পুস্তকখানিতে আলোচনা পেশ করেছেন বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহমাতুল্লাহ আলাইহে তার ?? নামক উর্দু গ্রন্থে, ‘ইসলামের জীবন পদ্ধতি’ তারই বাংলা অনুবাদ। ইতিমধ্যে বাংলা ভাষায় বইখানির বেশ কয়েকটি সংস্করণই শেষ হয়েছে। পাঠকবর্গের আগ্রহ ও চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে এর পুন:প্রকাশ করা হলো।




ইসলামের নৈতিক আদর্শ

মানুষের প্রকৃতিতে চরিত্রের অনুভুতি একটা স্বাভাবিক অনুভুতি। ইহা এক প্রকারের গুণ ও কাজকে পসন্দ করে এবং আর এক প্রকারের গুণ ও কাজকে করে অপসন্দ। এ অনুভুতি ব্যক্তিগতভাবে মানুষের মধ্যেও কমও হতে পারে, বেশীও হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানবতার তীব্র চেতনা চরিত্রের কোন কোন গুণকে ভাল এবং কোন কোন গুণকে মন্দ বলে চিরদিন একইরূপে অভিহিত করেছে। সততা সুবিচার, ওয়াদাপূর্ণ করা এবং বিশ্বাসপরায়ণতাকে চিরদিন মানব চরিত্রের প্রশংসনীয় গুণ বলে মনে করা হয়েছে। মিথ্যা, যুলুম, প্রতিশ্রুতি ভংগ করা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে মানবেতিহাসের কোন যুগেই পসন্দ করা হয়নি। সহানুভুতি, দয়া, দানশীলতা এবং উদারতাকে চিরদিনই সম্মান করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, কৃপণতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিকে কোন দিনই মর্যাদা দান করা হয়নি। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা ও আদর্শপরায়ণতা এবং বীরত্ব ও উচ্চ আশা চিরদিনই শ্রদ্ধা পাবার উপযুক্ত গুণ হিসেবে গণ্য হয়েছে। পক্ষান্তরে অস্থিরতা, নীচতা, খোশামোদী, হীন মনোবৃত্তি ও কাপুরুষতাকে কোন দিনই অভিনন্দিত করা হয়নি। আত্নসংযম, আত্নসম্মান জ্ঞান, নিয়ামানুবর্তিতা ও অকপট মেলামেশাকে চিরদিনই মানুষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ করা হয়েছে এবং প্রবৃত্তির গোলামী, অশালীন আচরণ, সংকীর্ণতা, বে-আদবী ও কুটিল মনোবৃত্তি মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের তালিকায় কোন দিনই স্থান পায়নি।

কর্তব্যপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, কর্মপটুতা এবং দায়িত্ববোধ চিরদিনই সম্মান পেয়ে এসেছে। কিন্তু কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ও কর্মবিমুখ মানুষকে কোনদিনই সুনজরে দেখা হয়নি। এভাবে সমাজ জীবনের ভাল ও মন্দ গুণাবলী সম্পর্কেও মানবতার সিদ্ধান্ত চিরকাল প্রায় একই প্রকারের রয়েছে।

পৃথিবীর দরবারে সম্মান এবং মর্যাদা চিরদিন কেবল সেই সমাজই লাভ করতে পেরেছে যাতে নিয়ম-শৃংখলা আছে, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা আছে, পারস্পরিক ভালোবাসা ও হিতাকাংখা আছে এবং সামাজিক সুবিচার ও সাম্য ব্যবস্থা আছে। দলাদলি উচ্ছৃংখলতা, ভেদ-বৈষম্য, অনিয়ম-অনৈক্য, পারস্পরিক শত্রুতা, যুলুম ও অসহযোগিতাকে দুনিয়ার ইতিহাসে কোন দিনই সামাজিক সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করা হয়নি। কাজ-কর্মের ভাল-মন্দ সম্পর্কেও একথা সম্পূর্ণ রূপে সত্য। চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, হত্যা, জালিয়াতি ও ঘুষখোরকী কোন দিনই ভাল কাজ বলে মনে করা হয়নি। কটুক্তি, নিপীড়ন, কুৎসা, চোগলখুরী, হিংসা-দ্বেষ, অকারণে দোষারোপ এবং মানব সমাজে অশান্তি ও উচ্ছৃংখলতা সৃষ্টি করাকে কোন সময়েই পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়নি। প্রতারক, ধোকাবাজ, অহংকারী, রিয়াকারী (শুধু পরকে দেখাবার জন্য যে পুণ্যের কাজ করে) মুনাফিক ও অন্যায় জেদপরায়ণ এবং লোভী ব্যক্তি কখনও ভাল লোকের মধ্যে পরিগণিত হয়নি। পক্ষান্তরে পিতা-মাতার খেদমত করা, আত্নীয়-স্বজনকে সাহায্য করা, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করা, বন্ধু-বান্ধের সাথে অকপট ও আন্তরিক সম্বন্ধ স্থাপন করা, ইয়াতীম, মিসকীন ও অসহায় লোকদের দেখাশুনা করা, রুগ্ন ও অসুস্থ লোকদের সেবা শুশ্রুষা করা এবং বিপদগ্রস্ত লোকদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা চিরকালই নেকীর কাজ বলে অভিহিত হয়েছে।


সৎকর্মশীল, মিষ্টভাষী, কোমল স্বভাব ও হিতাকাংখী মানুষ চিরদিনই সম্মান লাভ করেছে। মানবতা চিরদিনই সেসব লোককেই শ্রেষ্ঠ ও উত্তম বলে মনে কের এসেছে যারা সত্যবাদী, সত্যের অনুসন্ধানকারী, যাদের উপর সকল কাজেই নির্ভর করা চলে, যাদের ভিতর বাহির একই প্রকার এবং যাদের কথা ও কাজে পরিপূর্ণ মিল আছে, যারা শুধু নিজেদের প্রাপ্য অংশ লাভ করে তৃপ্ত হন এবং অন্যের অধিকারকে উদার চিত্তে আদায় করে থাকেন, যারা নিজেরা শান্তিতে থাকতে অভ্যস্ত এবং মানুষকেও শান্তি দান করতে যত্নবান, যাদের নিকট হতে প্রত্যেকেই মঙ্গলময় কাজের আশা করতে পারে এবং যাদের দ্বারা কিছুমাত্র ক্ষতি-লোকসান হবার কারো আশংকা থাকে না।


এ আলোচনা হতে স্পষ্টরূপে জানা গেল যে, মানব চরিত্র মূলত এমন এক বিশ্বব্যাপী সনাতন সত্য যা দুনিয়ার সকল মানুষই অবগত আছে। পাপ ও পূণ্য কিংবা ভাল ও মন্দ এমন কোন গোপনীয় বস্তু নয় যে, সেটাকে অন্য কোন স্থান হতে খুজে বের করে আনতে হবে। এটাতো মানুষের জ্ঞাত ও চির পরিচিত সত্য। এর চেতনা ও অনুভুতি মানব প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই ঠিক। এ কারণেই পবিত্র কুরআনে নেকীকে ‘মারূফ’ (জানা) এবং পাপকে ‘মুনকার (অজানা) নামে অভিহিত করেছেন। নেকী তা-ই যাকে সকল মানুষ ভাল বলে জানে এবং পাপ তাই যাকে মানুষই ভাল বলে জানে না। এ তত্ত্ব সম্পর্কেই পবিত্র কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে: ?? আল্লাহ তায়ালা মানব প্রকৃতিকে ভাল এবং মন্দের জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই দান করেছেন। (সূরা আশ শামস : ৮)








0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম