[পুস্তিকাটি মূলত মাওলানার একটি ভাষণ। ১৯৪৩ সালের ২১শে মার্চ দিল্লীর ‘জামেয়া ইসলামীয়ায়’ মাওলানা এ ভাষণ প্রদান করেন।]
কুরআন শরীফ সমগ্র মানব জাতিকে তার নিজ প্রচারিত জীবনাদর্শের দিকে এই বলে আহবান জানাচ্ছেঃ ان الدين عند الله الاسلام .
এ ছোট্ট আয়াতটুকু এ পুস্তকে আমার আলোচ্য বিষয়। বিস্তারিত করে বলার স্থান এটা নয়, যথাসম্ভব সংক্ষেপে এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবো। এ আয়াতটুকুতে প্রকৃতপক্ষে কি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা হতেই সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যাবে। উপরন্তু সেই দাবি গ্রহণ করা উচিত কিনা সে বিষয়েও বিশেষ আলোচনা করবো এবং কুরআনের এ দাবি মেনে নিলে কি কি কাজ করা আমাদের কর্তব্য হয়, তাকে বিশ্বাস করলে কিভাবে মানবজাতির জীবনকে গঠন করা বাঞ্ছনীয় হয়, সর্বশেষে আমি তাও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
সাধারণত এ ছোট আয়াতটির খুব সাদাসিদে অর্থ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আবহমানকাল হতে আপনারা এর অর্থ শুনে এসেছেন, “আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম হচ্ছে শুধু ইসলাম।” আর ইসলাম সম্পর্কে সাধারণভাবে সকলেরই মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে যে, ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা আজ হতে সাড়ে তেরোশত বছর পূর্বে আরব দেশে প্রচারিত হয়েছিল এবং যার প্রথম ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। “প্রথম ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন” কথাটি আমি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেছি। কারণ, কেবল অমুসলিমগণই নয়, অসংখ্য মুসলমান এবং ভালো ভালো শিক্ষিত ও বিদগ্ধ মুসলমান পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে “ইসলামের প্রবর্তক ও ভিত্তিস্থাপক” বলে মনে করেন এবং বই পুস্তকে সে কথাই নানাভাবে লিখে থাকেন। তাদের বিশ্বাস হযরত মুহাম্মদ (সা)-ই ইসলামের সর্বপ্রথম প্রচারক দুনিয়াতে তিনিই তার প্রথম ভিত্তিস্থাপন করেছেন। এজন্যই একজন অমুসলিম ব্যক্তি কুরআন শরীফ অধ্যয়নকালে যখন এ আয়াতটি পাঠ করে, তখন সে ধারণা করে যে, দুনিয়ার সকল ধর্মই যেমন কেবল নিজেকেই ‘একমাত্র সত্য ধর্ম’ বলে অভিহিত করে থাকে এবং অন্যান্য ধর্মকে বাতিল বলে মনে করে অনুরূপভাবে কুরআনও নিজের উপস্থাপিত ধর্মের একমাত্র সত্য হওয়ার দাবি করেছে, এটা বিচিত্র কিছু নয়। অমুসলিম পাঠক এ ধারণার বশবর্তী হয়ে খুব দ্রুততার সাথেই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যায় এ দাবির মৌলিকতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই বোধ করে না। পক্ষান্তরে একজন মুসলিমও এ সম্পর্কে চিন্তা করার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা এজন্যই বোধ করে না যে, এ আয়াতে যে ধর্মকে ‘একমাত্র সত্য ধর্ম’ বলে দাবি করা হয়েছে, সে নিজেও তাকে সত্য ধর্ম বলেই বিশ্বাস করে। কারো মনে কোনো সময় এ সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তাবোধ হলেও সে কেবল খৃষ্ট ধর্ম, হিন্দু ধর্ম এবং এরূপ অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের তুলনা করে তার সত্যতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে মাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুরআন শরীফের এ ছোট্ট আয়াতটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাথে যতোটুকু চিন্তা করা হয়েছে তদপেক্ষা অনেক বেশি চিন্তা করা একান্ত আবশ্যক। উক্ত আয়াতে উল্লেখিত কুরআনের দাবিকে সুস্পষ্টরূপে বুঝতে হলে সর্বপ্রথম ‘আদ্-দীন’ (الدين) এবং ‘আল ইসলাম’ (الاسلام) এ দু’টি শব্দের অন্তর্নিহিত ভাব বিস্তারিতরূপে বুঝে নিতে হবে।
আদ্-দীন (الدين) শব্দের বিশ্লেষণ
আরবি ভাষায় ‘দীন’ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তার এক অর্থ প্রভুত্ব ও প্রাধান্য, শক্তি ও আধিপত্য। দ্বিতীয় অর্থ আনুগত্য ও দাসত্ব। তৃতীয় অর্থ প্রতিফল ও কর্মফল এবং চতুর্থ অর্থ পথ, পন্থা, ব্যবস্থা, আইন। উল্লেখিত আয়াতে ‘দীন’ (دين) শব্দটি এ শেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ‘দীন’ শব্দের অর্থ জীবন যাপনের পন্থা কিংবা কর্মের প্রণালী, এমন পন্থা বা প্রণালী যা মানুষের জীবনে অনুসরণ করা যেতে পারে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, কুরআন কেবল ‘দীন’ই বলেনি কুরআন বলছে, ‘আদ্-দীন’, (الدين)। ইংরেজি ভাষা This is a way (এই একটি পথ)-এর পরিবর্তে This is the way (এ একমাত্র পথ) বলায় অর্থের দিক দিয়ে যতোখানি পার্থক্য হয় ‘দীন’ (دين) এবং ‘আদ্-দীন’ (الدين) শব্দের মধ্যেও অর্থের দিক দিয়ে ঠিক ততোখানি পাথর্ক্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ কুরআন একথা বলছে না যে, “ইসলাম আল্লাহর নিকট একটি (মনোনীত) ধর্ম” বরং তার দাবি, “আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র প্রকৃত, বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জীবনব্যবস্থা বা চিন্তা ও কর্মের প্রণালী।” এছাড়া একথাও মনে রাখতে হবে যে, কুরআন এ ‘আদ্-দীন’ শব্দটি কোনো সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করেনি, কুরআনে তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক।
‘জীবন ব্যবস্থা’ বলতে জীবনের বিশেষ কোনো দিক বা বিশেষ কোনো বিভাগের ব্যবস্থা বুঝায় না, তার অর্থ সমগ্র জীবনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা-স্বতন্ত্রভাবে কেবল এক একটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যবস্থা নয়, তা দ্বারা সমষ্টিগতভাবে সমগ্র সমাজের ব্যবস্থাই বুঝায়। বিশেষ কোনো দেশ বা বিশেষ কোনো জাতি বা বিশেষ কোনো কাল ও যুগের জীবন ব্যবস্থা নয়, বরং সকল কালের সকল মানুষের এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সমগ্র সমাজের ব্যবস্থার কথাই এখানে বলা হয়েছে। অতএব পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, কুরআনের উক্ত দাবির অর্থ এ নয় যে, ইসলাম আল্লাহর নিকট পূজা-উপাসনা, অতি প্রাকৃতিক ধারণা-বিশ্বাস এবং পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাসস্থাপনের একটি সমষ্টি মাত্র, তার অর্থ এটাও নয় যে, ব্যক্তি মানুষের ধর্মীয় চিন্তা কর্মপদ্ধতির (বর্তমান পাশ্চাত্য পরিভাষায় ‘ধর্মীয়’ শব্দটি যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে) একটি রূপ হচ্ছে ইসলাম। পক্ষান্তরে তার অর্থে এটাও নয় যে, কেবল আরববাসীদের জন্য কিংবা একটি নির্দিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত অথবা একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত, যথা শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী মানুষদের জন্য ইসলাম একটি বিশুদ্ধ জীবনব্যবস্থা; বরং কুরআন শরীফ স্পষ্ট ভাষায় ও উদাত্তকণ্ঠে দাবি করছে যে, “প্রত্যেক কালের অধ্যায়ের সমগ্র মানবজাতীর জন্য পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য এবং মানব জীবনের সমগ্র বিভাগের জন্য একটি মাত্র পন্থা ও পদ্ধতি আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধ ও মনোনীত” সেই স্বাভাবিক পদ্ধতিরই নাম হচ্ছে ইসলাম।
আমি শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি যে, এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী কোনো এক দেশে কুরআন শরীফের এক নুতন তফসীর প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে যে, ‘দীন’ (دين) শব্দটিতে শুধু আল্লাহ ও মানুষের মধ্যস্থিত ব্যক্তিগত সম্পর্কিত বিষয় বুঝায় রাষ্ট্র ও তামাদ্দুনের বিপুল ক্ষেত্রের সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই। এ তফসীর যদি কুরআন হতেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই দেখার বস্তু বটে কিন্তু আমি দীর্ঘ অষ্টাদশ বছরকাল পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে, বিশেষ যত্ন ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সহকারে কুরআন শরীফের যে গভীর তত্ত্বানুসন্ধান করেছি, তার উপর নির্ভর করে আমি অকুতোভয়ে ও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে পারি যে, কুরআন এসব নতুন তফসীরকারদের স্বেচ্ছাচারিতা সমর্থন করে ‘আদ্-দীন’ (الدين) শব্দটিকে কোনো সীমাবদ্ধ অর্থে আদৌ ব্যবহার করেনি ; বরং তাকে সমগ্র কালে সমগ্র মানুষের জন্য, মানুষের চিন্তা ও কর্মের একমাত্র সুষ্ঠু বিধান বলে ঘোষণা করেছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, কুরআন কেবল ‘দীন’ই বলেনি কুরআন বলছে, ‘আদ্-দীন’, (الدين)। ইংরেজি ভাষা This is a way (এই একটি পথ)-এর পরিবর্তে This is the way (এ একমাত্র পথ) বলায় অর্থের দিক দিয়ে যতোখানি পার্থক্য হয় ‘দীন’ (دين) এবং ‘আদ্-দীন’ (الدين) শব্দের মধ্যেও অর্থের দিক দিয়ে ঠিক ততোখানি পাথর্ক্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ কুরআন একথা বলছে না যে, “ইসলাম আল্লাহর নিকট একটি (মনোনীত) ধর্ম” বরং তার দাবি, “আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র প্রকৃত, বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জীবনব্যবস্থা বা চিন্তা ও কর্মের প্রণালী।” এছাড়া একথাও মনে রাখতে হবে যে, কুরআন এ ‘আদ্-দীন’ শব্দটি কোনো সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করেনি, কুরআনে তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক।
‘জীবন ব্যবস্থা’ বলতে জীবনের বিশেষ কোনো দিক বা বিশেষ কোনো বিভাগের ব্যবস্থা বুঝায় না, তার অর্থ সমগ্র জীবনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা-স্বতন্ত্রভাবে কেবল এক একটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যবস্থা নয়, তা দ্বারা সমষ্টিগতভাবে সমগ্র সমাজের ব্যবস্থাই বুঝায়। বিশেষ কোনো দেশ বা বিশেষ কোনো জাতি বা বিশেষ কোনো কাল ও যুগের জীবন ব্যবস্থা নয়, বরং সকল কালের সকল মানুষের এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সমগ্র সমাজের ব্যবস্থার কথাই এখানে বলা হয়েছে। অতএব পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, কুরআনের উক্ত দাবির অর্থ এ নয় যে, ইসলাম আল্লাহর নিকট পূজা-উপাসনা, অতি প্রাকৃতিক ধারণা-বিশ্বাস এবং পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাসস্থাপনের একটি সমষ্টি মাত্র, তার অর্থ এটাও নয় যে, ব্যক্তি মানুষের ধর্মীয় চিন্তা কর্মপদ্ধতির (বর্তমান পাশ্চাত্য পরিভাষায় ‘ধর্মীয়’ শব্দটি যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে) একটি রূপ হচ্ছে ইসলাম। পক্ষান্তরে তার অর্থে এটাও নয় যে, কেবল আরববাসীদের জন্য কিংবা একটি নির্দিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত অথবা একটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত, যথা শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী মানুষদের জন্য ইসলাম একটি বিশুদ্ধ জীবনব্যবস্থা; বরং কুরআন শরীফ স্পষ্ট ভাষায় ও উদাত্তকণ্ঠে দাবি করছে যে, “প্রত্যেক কালের অধ্যায়ের সমগ্র মানবজাতীর জন্য পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য এবং মানব জীবনের সমগ্র বিভাগের জন্য একটি মাত্র পন্থা ও পদ্ধতি আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধ ও মনোনীত” সেই স্বাভাবিক পদ্ধতিরই নাম হচ্ছে ইসলাম।
আমি শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি যে, এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী কোনো এক দেশে কুরআন শরীফের এক নুতন তফসীর প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে যে, ‘দীন’ (دين) শব্দটিতে শুধু আল্লাহ ও মানুষের মধ্যস্থিত ব্যক্তিগত সম্পর্কিত বিষয় বুঝায় রাষ্ট্র ও তামাদ্দুনের বিপুল ক্ষেত্রের সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই। এ তফসীর যদি কুরআন হতেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই দেখার বস্তু বটে কিন্তু আমি দীর্ঘ অষ্টাদশ বছরকাল পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে, বিশেষ যত্ন ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সহকারে কুরআন শরীফের যে গভীর তত্ত্বানুসন্ধান করেছি, তার উপর নির্ভর করে আমি অকুতোভয়ে ও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে পারি যে, কুরআন এসব নতুন তফসীরকারদের স্বেচ্ছাচারিতা সমর্থন করে ‘আদ্-দীন’ (الدين) শব্দটিকে কোনো সীমাবদ্ধ অর্থে আদৌ ব্যবহার করেনি ; বরং তাকে সমগ্র কালে সমগ্র মানুষের জন্য, মানুষের চিন্তা ও কর্মের একমাত্র সুষ্ঠু বিধান বলে ঘোষণা করেছে।
2 comments:
দামী বই। ডাউনলোড করেছি।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। সব নবীদের ধর্মই ইসলাম ছিলো । মানুষ বিকৃত করে নাম পাল্টে ফেলেছে।