তালেবান...

আমরা যখন প্রথম ইসলামি আন্দোলনের পরোক্ষ দাওয়াত পাই, সময়টা ৯৭-৯৮ সাল হবে। ছেলে-মেয়েদের কম্বাইন্ড ইসকুলের স্টুডেন্ট ছিলাম। সেসময় কিশোরকণ্ঠ পত্রিকায় প্রতি মাসে ছাপা হতো "পাহাড়ি এক লড়াকু" নামের ধারাবাহিক আফগান উপন্যাস। অতীব জনপ্রিয় এ উপন্যাসটি অনুবাদ করতেন আমাদের প্রিয় কবি ও সুপরিচিত গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক।

সোভিয়েত রাশিয়া কেন্দ্রীক নাস্তিক  কম্যুনিস্ট বাহিনী আফগানিস্তান সহ পুরো মধ্যএশিয়া দখল করে রেখেছিলো। আফগান মুজাহিদদের দুর্দান্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ, নিখুঁত গোয়েন্দাগিরি, পাতাল ফাঁদের মত কৌশল, ক্লাশিনকভ অস্ত্র, কম্যুনিস্টদের ট্যাঙ্কবহর উড়িয়ে দিতে পুতে রাখা মাইন, কম্যুনিস্টদের বোমার খোলসে মুজাহিদদের ফুলের চারা রোপন, আফগানিস্তানের পাহাড়ে পাহাড়ে গুহা-বাঙ্কার-মারকাজ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বিমান ক্রাশ ষড়যন্ত্রে মৃত্যুতে কম্যুনেস্টদের আনন্দের আতশবাজী...... চরম উত্তেজনাপূর্ণ সত্যি ঘটনা ও ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসটি  শেষ হয় মুজাহিদদের বিজয়ে এবং কম্যুনিস্ট রাশানদের আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে। আফগান মুজাহিদরা তখন পুরো মুসলিম বিশ্বের জনগনের চোখের মনি - শ্রেষ্ঠ বিজয়ী বীর যারা কম্যুনিষ্ট পরাশক্তি রাশিয়ার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।

চিড়স্বাধীনচেতা, পানিপথ যুদ্ধে মারাঠা হিন্দুদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া আহমদ শাহ আবদালীর জাতি  আফগানদের আমরা তখন থেকেই ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলাম। আমরা জানতাম , পানিপথ থেকে টিপু-সুলতানের সময় পর্যন্ত আফগান মেহমানদারীর উন্মুক্ত দরোজা উপমহাদেশের রাজ্যহারা মুহাজির মুসলমানদের ভরসার বড় এর আশ্রয়স্থল!

এরপর ২-৩ বছরের মধ্যে ইয়াহুদীদের সফল ষড়যন্ত্রের টুইনটাওয়ার হামলার ভিকটিম হলো আফগানিস্তান। শক্তিশালী আমেরিকা ততদিনে আবিস্কার করে ফেলেছে পারমানবিক বোমার চে শতগুন কার্যকর মিডিয়া বোমা। তুমি তোমার শত্রুকে একটা খারাপ নাম দাও এবং হত্যা করো, এই নীতিতে কম্যুনিষ্টবিজয়ী আফগান মুজাহিদদেরকে ট্যাগ দেয়া হতে লাগলো জঙ্গী টেররিষ্ট - এসব নামে। ছাত্র বা তালেবান শব্দটিকেই পরিণত করা হলো ভয়াবহতার অর্থে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যাবস্থা গড়ার আন্দোলনের কারিগড়েরাও ভুলে গেলেন আফগান নাগরিকদের কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধে মহান বিজয়কে, তারা ভুলে গেলেন যে আফগানরা আক্রান্ত আর বিপুল সামরিক শক্তি নিয়ে আমেরিকা নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা যুদ্ধবাজরা আফগানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।

আজো নাস্তিক রাশিয়ানদের এদেশীয় এজেন্ট বিভিন্ন শাহবাগী বাম সমাজতান্ত্রিক দলের লেজে আগুন লেগে যায় আফগানদের নাম শুনলে। কলিজা কেঁপে ওঠে। খেয়াল করবেন, ইসলামের কথা শুনলে এরা প্রায় ই বলবে, এইরে বাংলাস্তান হয়ে গেলো, দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেলো! আসলে আফগানদের হাতে প্রচন্ড মার খাওয়া এ নাস্তিক শাহবাগীদের শিরদাঁড়া আজো চিনচিন করে পুর্নিমা অমাবস্যায়।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর একবার প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আফগান মুজাহিদদের প্রসঙ্গ যে আমরা এড়িয়ে চলি ইহুদিদের টুইনটাওয়ার ষড়যন্ত্রের পর থেকে - অথচ একসময় আমরা তাদের নিয়ে গর্ব করতাম, এটা কি ঠিক হচ্ছে? জবাব পেয়েছিলাম গোঁজামিল মিশ্রিত ও অস্পষ্ট। আমেরিকার নীতি, হ্য় তুমি আমার পক্ষে অথবা তুমি আমার শত্রু, এই সন্ত্রাসী হুমকিতে আন্দোলনের রথি মহারথিরাও কাবু।

তালেবান নামে ভয়াবহ টেররিষ্ট হিসেবে মিডিয়া বোমায় চিহ্নিত - আফগানদের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া সম্ভব! ইসলামে জঙ্গীবাদ (মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত শব্দ) সমর্থন করেনা টাইপ লো কোয়ালিটি তোতাপাখি বক্তব্যের বাইরেও বক্তব্য আছে।

কোন নির্জন দ্বীপে আটকা পরা অবস্থায় নিরূপায় আদম সন্তানের জন্য আল্লাহ ইসলামের কড়া হালাল-হারামের বিধান ও শিথিল করে দিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের জায়েজ কৌশল নির্ধারনের খুব বড় একটা নিয়ামক হল ভূ-রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি।  যেমন জামায়াত ইসলামী বর্তমান ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এমনকি  শ্রীলঙ্কাতেও ইসলামের পক্ষে সক্রিয়। কিন্তু প্রতিটা ভূ-খন্ডে আন্দোলনের ধরন ও মাত্রা ভিন্ন। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে হয়তো রাজপথে মিছিল করা আন্দোলনের একটা চিহ্নিত মার্ক, কিন্তু ভারতে এটা আপনাকে করতে হবেনা, স্রেফ ব্যাক্তিজীবনে ভাল মুসলমান হন আর ইস্যুভিত্তিক বক্তব্য রাখুন; পৌত্তলিক মুশরেক হিন্দুদেরকে আপনার জীবনে চর্চার মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য দেখিয়ে দিন, ব্যাস!

বাংলাদেশে আপনি যদি বম্বিং করে সেক্যুলার - কম্যুনিষ্টদের শায়েস্তা করতে চান আর আফগানরা যদি গণতান্ত্রিক সিস্টেমে দখলদার পশ্চিমা ও তাদের দালালদের প্রতিহত করতে চায়, দুটোই মারাত্মক ভুল আর ক্ষতিকর কর্মপন্থা। সুইজারল্যান্ড বা জার্মানীতে আপনি যদি সরকারের কাছ থেকে একটা মসজিদ স্থাপনের অনুমতি আদায় করতে পারেন  সেটাই আপনার  জন্য মর্যাদাপূর্ণ ইসলামী আন্দোলন কিন্তু বাংলাদেশে বসে একটা মসজিদ বানিয়ে যদি ভেবে বসেন ইসলামের জন্য অনেক কিছু করে ফেল্লাম, তবে আপনার ধারণা ভুল। সিরিয়ায় যদি রাস্তায় গণজমায়েত করে আসাদ বাহিনির বোমার শিকার হবার কর্মসূচী নেয়া হয় আর মিশরে যদি অস্ত্র হাতে নিয়ে বাম তামারুদ সন্ত্রাসীদের তামা বানানোর কর্মসূচী নেয়া হয়, এক্ষেত্রেও দুটো পদ্ধতি-ই ভুল। অথচ কর্মপদ্ধতি দুটা যদি দেশ পালটিয়ে ফেলে তাহলে-ই ঠিক হয়ে যায়।

আফগান তালেবান সশস্ত্র  ও কট্টর প্রতিরোধ কৌশল বাংলাদেশে সম্পুর্ণ অন্যায়, অবৈধ, নাজায়েজ ও অপ্রয়োজনীয় কিন্তু আফগানিস্তানকে পশ্চিমা ক্রুসেডারদের থাবা থেকে স্বাধীন করতে শতভাগ সমর্থনযোগ্য। যেমনটা আলেমগণ ফিলিস্তীনি অসহায় নিরস্ত্র মজলুমদের আত্মঘাতী হামলাকে জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন কিন্তু সেটা নিশ্চয়-ই মালেশিয়ান মুসলমানদের জন্য বৈধ না!

আল্লাহ আমাদের চিন্তাধারাকে প্রশস্ততা দান করুন, বিশ্বব্যাপী আমাদের ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যময়তার মাঝ থেকেই রহমতের ঐক্য দান করুন, আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীমের সঠিক পথে পরিচালিত করুন!

1 comments:

Unknown বলেছেন...

Download koi

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম