১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তার আপন বৈশিষ্টে মহীয়ান। ছাত্র আন্দোলনে, সমাজ সেবায়, কল্যানমুখী রাজনীতি এবং জাতির যে কোন সংকটে ছাত্রশিবির সব সময়ই অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে। মাত্র ৬ জন মানুষের মাধ্যমে যে সংগঠনের জন্ম তা আজ দেশ ও জাতির গর্বের ধনে পরিনত হয়েছে।এই সংগঠনের নাম যখন রাখা হয়, তখন শুভাকাংখী অনেকেই নানা নাম প্রস্তাব করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যে মানুষটির নাম সবাই গ্রহন করেন, অর্থাৎ ছাত্রশিবির নামটির প্রস্তাব যিনি দেন, তিনি হলেন মরহুম সিদ্দিক জামাল।
সিদ্দিক জামাল চাচাকে হয়তো অনেকেই চিনেন না। নীরবে নিভৃতে চলে গেছেন তিনি। শুধু ছাত্রশিবিরের নাম প্রস্তাব করাই নয়, তার অারও অনেক ভুমিকা আছে। ইসলামী সংস্কৃতি নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। সংস্কৃতিকে শুধু পুস্তকে নয়, কাজেও প্রমান করে গেছেন তিনি। সংস্কৃতিমনা অনেককেই তিনি ইসলামী সংস্কৃতির ভিজুয়াল ভুমিকা ও স্বরূপ শিখিয়ে গেছেন। টিভি নাটক, মঞ্চ নাটক যে ইসলামী আদর্শের প্রচারের কাজেও তৈরী করা যায়, এই ধারনা তিনি দিয়ে গেছেন। আজকাল বিভিন্ন মিডিয়ায়, প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সফল হয়েছেন, হচ্ছেন- এমন অনেকেই তার কাছে কাজ শিখেছে। শিষ্যরা অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলেও এই মানুষটা খুব বেশী অর্থের ছোঁয়া তার জীবনে পাননি।
অন্তরের অন্তস্থল থেকে এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা। হে আল্লাহ আপনি সিদ্দিক জামাল চাচার সব নেক অামলকে কবুল করে নিন। আমীন।
১৯৪৬ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। মাস্টার্স সম্পন্ন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা বেশ কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে হলেও ছিলেন সংস্কৃতিমনা ও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক। কর্মজীবন শুরু করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি বিভাগে। তখন থেকেই তিনি চিন্তা করতে শুরু করেন কীভাবে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ এবং ধর্মকে যুগোপযোগী করে উপস্থাপন করা যায়। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের প্রথম ব্যাচেই ভর্তি হন। সেখানে তিনি ব্যাচমেট হিসেবে পান তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মতো খ্যাতিমানদের। সে সময় তিনি এম এ বেগ (মনজুরুল আলম বেগ)-এর ফটোগ্রাফি কোর্সও সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র ও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বই’-এর অডিও রূপ দেন। একই কার্যক্রমের আওতায় ‘প্রত্যাশায়’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। আমাদের দেশে ধর্মীয় গান, নাটককে অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ ছিলেন। ধর্মবিষয়ক চলচ্চিত্রের বাংলা ডাবিং এবং ডকুমেন্টারি নির্মাণে কাজ করেছেন। দেশের গুণী ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বদেরকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ অনেকদূর এগিয়েছিলেন। এ সুবাদে এঁদের সংস্পর্শে আসার সুযোগও তার হয়েছিলো।
সৃজনশীলতা ছিলো তার বড় গুণ। পড়তে ভালবাসতেন। বই-এর বেশ বড় সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। পরিবারেও বই পড়া ও সংস্কৃতির চর্চা চালু করতে পেরেছিলেন। তার অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে সন্তানেরা সেই ছোটবেলায় নিজেদের লেখা দিয়ে পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা বের করতো। সংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। হযরত খাদিজা (রা) এবং খাতুনে জান্নাত ফাতেমা (রা)-এর জীবনী লিখেছেন ধারাবাহিকভাবে। স্বপ্ন ছিলো তার প্রিয় নবী (স)-র জীবনী লিখবেন। প্রস্ত্ততিও সম্পন্ন করেছিলেন। এসময় ক্যান্সার এসে হানা দিলো। পরিশ্রমী ও নিয়মানুবর্তী হওয়ার কারণেই হয়তো কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতা ছিলো না। কিন্তু পরাজিত হলেন রেকটাম ক্যান্সারের কাছে। ২০০৪ সালের ২৬ আগস্ট সবাইকে শোকার্ত করে নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, পরোপকারী, ধর্মপ্রাণ মানুষটি চলে গেলেন তার মালিকের সান্নিধ্যে। রেখে গেলেন স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী আর তার স্বপ্ন আর অসমাপ্ত কাজ। বৈষয়িক চিন্তা কখনোই করেন নি। অর্থের সাশ্রয়ও তাই ছিলো না। কিন্তু পরিবারকে একাত্ম করে গিয়েছিলেন কোয়ান্টামের মতো সঙ্ঘের সাথে। তাই ইতিবাচকতা ও দৃঢ় মানসিক শক্তি সঙ্গী হয়েছিলো তার
সন্তানদের। তারা সবাই লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করে নিজের এবং পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেছে।
0 comments: