কেউ কেউ বলতে পারেন যে, "অন্যান্য পিতা যেমন জন্ম না দিলেও পিতার মর্যাদা সমার্থে পিতার মর্যাদা পান, তেমনি শুধুমাত্র দেশ ও জনগণকে শত্রুমুক্ত করার গুণটিই জাতির পিতা হবার জন্য যথেষ্ট", কখনোই নয়; বরং "জাতির পিতা"র উদাহরণ মানুষের ইতিহাসে তাদের স্রষ্টা কর্তৃক স্বীকৃত ঘোষিত হয়েছে এবং আজো সে পিতৃত্ব মজুদ রয়েছে, তাই এটা বলে বিভ্রান্ত করার কোন সুযোগই থাকছে না।
আল্লাহ প্রদত্ত পিতৃত্ব:
আল্লাহ্ রাব্বুল 'আলামীন সমগ্র মানব জাতির মধ্য থেকে মাত্র দু'জনকে তাদের পিতা হিসেবে গণ্য করেছেন। একজন হলেন আদম 'আলাইহিস্ সালাম এবং অপর জন ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম।
আদম 'আলাইহিস্ সালাম:
আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে আমাদেরকে بَنِي آَدَمَ বলে উল্লেখ করেছেন সর্বমোট সাত বার, এছাড়াও কুরআনের অন্যান্য বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট যে, সৃষ্টির প্রথম মানুষ আদম 'আলাইহিস্ সালামই আমাদের আদি পিতা, তার মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানবের আবাদ এবং তিনিই প্রথম 'মানব জাতি' নামে একটা জাতির জন্ম দেন, তাদেরকে ভাষা শেখান, তাদের আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা দান করেন, তাদেরকে জীবন ধারনের নানা কৌশল শেখান, কৃষি কাজ শেখান ও অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের পদ্ধতি শেখান। অতএব এসব থেকে যে কেউই একবাক্যে আদি পিতা আদম 'আলাইহিস্ সালামকে মানব জাতির পিতা মানতে বাধ্য; বরং স্বতঃস্ফূর্ত।
ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম:
আল্লাহ্ প্রদত্ত পিতৃত্বের মধ্যে তারপর হলেন পিতা ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম, যিনি তার প্রভুর আদেশে নিজের পক্ষ হতে নতুন জাতির ঘোষণা দিয়েছেন। কেননা, আদি পিতা আদমের সন্তানেরা ততদিনের আর এক পরিবার ভুক্ত ছিল না; আকীদা-বিশ্বাসে, শুদ্ধে-ভ্রান্তিতে তারা হয়ে গেল দ্বিধাবিভক্ত। তাই প্রয়োজন পড়লো দিকভ্রান্ত পৃথিবীকে সত্যের পথ দেখানোর জন্য নতুন কোন জাতির উত্থান। আর সে শুরুটা করলেন ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম। আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনে বলেন: مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ ((এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের জাতি(মুসলিম জাতি)। তিনি আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন 'মুসলিম'।)) [সূরা আল-হাজ্জ: ৭৮] দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, পৃথিবীতে এর পূর্বে 'মুসলমান' নামক কোন জাতি ছিল না, পিতা ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম এ জাতির প্রবর্তন করেন বা জন্ম দেন, তিনি তাদের জন্য তার রব-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত আকীদা-বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার-জীবনাচার ইত্যাদির প্রবর্তন করেন যা একজন পিতা হিসেবে সন্তানদের জন্য করা উচিত। অতএব, নিঃসন্দেহে ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালাম জাতির পিতার যোগ্যতা রাখেন যা ইয়াহূদী এবং খৃষ্টানরাও স্বীকার করে থাকে। কিন্তু তারা মূলত এখন আর পিতা ইবরাহীমের জাতির অন্তর্ভুক্ত নেই, কেননা তিনি যে আকীদা-বিশ্বাসকে ভিত্তি করে পিতা মুসলিম জাতির প্রবর্তন করেছেন, তারা সে অবস্থান থেকে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহিস্ সালামের আগমনের পূর্বেই বহু দূরে ছিটকে পড়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে যে:
সমস্ত মানুষের পিতা হিসেবে আদম 'আলাইহিস্ সালামকে মেনে নিলাম, কিন্তু যারা মুসলিম নয় তারা কি নিজ নিজ জাতির জন্য পিতা নির্ধারণ করতে পারবে না? উত্তর: অবশ্যই পারবে, আল্লাহ্ প্রদত্ত দ্বীনের আওতার বাইরে থাকলে তো যে কেউ যাচ্ছেতাই করতে পারে; তবে তাদের ঘোষিত সেসব পিতাদের নিকট অবশ্যই পিতৃত্বের গুণাগুণ থাকতে হবে। পিতা যদি ভাই-বন্ধু অথবা সাধারণ সাহায্যকারীর মত কিছু বড় ধরণের সাহায্য করেই সে আখ্যা হাসিল করতে চায় বা তাকে দেয়া হয়, তবে নিঃসন্দেহে তা হবে ভুল, বিতর্কিত কিংবা চাপানো হবে জাতি-গোষ্ঠীর উপর। বলা বাহুল্য যে, জাতির পিতা হতে কি কি গুণ থাকা দরকার তা উপরে উল্লেখিত দু'জন পিতার গুণাগুণ থেকেই সুস্পষ্ট। (যদিও এই লেখায় তার বিস্তারিত দেয়া সম্ভব নয়; বরং তাদের সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানার প্রয়োজন সেজন্য।) পরন্তু আল্লাহর প্রেরিত বিধানানুসারে মানব জাতির জন্য দুনিয়াতে যেমন সংস্কারক হিসেবে দায়িত্ব মুসলিম জাতির উপর তেমনি আখেরাতের বিচারেও সাক্ষ্য হিসেবে মানবজাতির জন্য দাঁড় করানো হবে মুসলিম জাতিকে। যেমনটি আয়াতে এসেছে: وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ ((এবং এ কিতাবেও(তোমাদের নামকরণ করা হয়েছে মুসলিম); যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হন এবং তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হও মানব জাতির জন্য।)) [সূরা আল-হাজ্জ: ৭৮]
বিশেষ লক্ষ্যণীয়:
আগেই বলেছি যে, পিতা হতে হলে পিতৃত্বের গুণ থাকা প্রয়োজন; ভ্রাতৃত্বের কিংবা বন্ধুত্বের গুণে পিতা হওয়া যায় না। পিতা আদম 'আলাইহিস্ সালামের পূর্বে পৃথিবীতে মানুষ ছিল না, তিনিই প্রথম মানুষ এবং তার মাধ্যমেই মানুষের সূচনা কিংবা মানব জাতির শুরু; অতএব তিনিই পিতার গুণাবলী শুধু রাখেনই নয় বরং তার মাধ্যমেই মানবজাতি চিনেছে পিতা কি জিনিস। আবার পিতা ইবরাহীম 'আলাইহিস্ সালামের পূর্বে আক্ষরিক অর্থে মুসলিম জাতি ছিল না, তাই একটা জাতির জন্য সার্বিক সবকিছু আনয়নকারী হিসেবে তিনি মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন। তিনি তার স্রষ্টার অনুসন্ধানে সফল হয়ে বলেছিলেন: (('আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই আর আমি এজন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান।')) [সূরা আল-আন'আম: ১৬২-১৬৩] অন্য দিকে দেখুন, তূরস্কবাসী তাদের পিতা বলে কথিত কামাল পাশার পূর্বেও সে দেশে সে নামেই বর্তমান ছিল, কামাল নতুন কিছু করেনি, ধর্মনিরপেক্ষতা তো আসলেই কোন মতবাদ হবার যোগ্যতাও রাখে না পরন্তু তাও তার আমদানী করা যা পৃথিবীতে তার আগেও বর্তমান ছিল, সে তুরস্কের অক্ষরকে ইংরেজী রূপ দিয়েছে এবং এটাও তার ইংরেজ প্রভুদের নিকট থেকে দয়ার দান হিসেবে পাওয়া, অনেকটা আমরা এতদিন যেরূপ ইউনিকোড আসার আগে 'বাংরেজী' বাংলা লিখতাম; তুরস্কবাসীকে তার এই দান তেমনি এক হাস্যকর উপহার(?)। দেশে দেশে এমন অনেক "জাতির পিতা" দেখা যায়; আমাদের দেশেও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সচেতন বিবেক নাগরিকদের ভাবা উচিত যে, শুধুমাত্র ভূখণ্ডকে স্বাধীন করার আন্দোলন ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দানই পিতা হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা নয়; বরং এটা কিছু অতি আবেগী কিংবা অভিসন্ধি লোকের আবেগ বা দূরভিসন্ধিকে সমগ্র জাতির ঘাড়ে চাপানো ছাড়া আর কিছু নয়।
অতএব, দেশে দেশে যা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ভুল হচ্ছে। পিতার গুণাবলী না থাকলেও আবেগে "জাতির পিতা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং এসব নিয়ে অন্তহীন বিতর্কও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কেননা, ভুলকে আবেগ স্বীকার করে নিলেও বিবেক স্বীকার করে না আর একটা দেশে জাগ্রত বিবেক মানুষ থাকবে না কিংবা অন্তত বিরুদ্ধ চিন্তারও মানুষ থাকবে না তা তো হয় না। বিতর্কগুলো এ দু'টি কারণেই হয়ে থাকে। তাই এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের জন্য কাউকে অতিজোর "জাতীয় নেতা", "জাতীয় বীর" ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করা যেতে পারে ভূখণ্ড বা দেশ হিসেবে জাতীয়তার অর্থে; "পিতা" কখনোই নয়। পরন্তু ভূখণ্ড বা দেশের বিস্তৃতি কিংবা সংকীর্ণতায়ও তা আবার পরিবর্তনশীল। সুতরাং আর কতদিন ভ্রান্তিতে ডুবে থাকা? শ্রেষ্ঠত্বের পতাকাবাহীদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে বেমানান, বিতর্কের অবসান হোক এবং জাতির (দেশের) জন্য বিশেষ অবদান রাখার পর্যায় অনুযায়ীই জাতীয় ব্যক্তিত্বদের সম্মানিত করা হোক; ভ্রান্তিতে অথবা অতিতোষণে নয়।
0 comments: