প্রশ্নবিদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি : আমাদের বক্তব্য

পূর্বকথা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জনগণকে স্বাধীনচেতা ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন। এরপর সময়ের  

ক্রমপরম্পরায় বিভিন্ন সময়ে আরো নয়টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি গঠিত হয়। সর্বশেষ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০০৯ গঠন করে। গত ৭ সেপ্টেম্বর এ কমিটি তাদের চূড়ান্ত খসড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করে। স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৩৮ বছরে আমরা সর্বমোট ১০টি শিক্ষা কমিশন/শিক্ষা সংস্কার কমিটি/অন্তর্বর্তীকালীন টাস্কফোর্স/শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির বিশাল বিশাল রিপোর্ট পেয়েছি। এ সকল কমিশন/কমিটির রিপোর্টে প্রদত্ত সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সামগ্রিকভাবে এসব কমিশন/কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশি জাতির শিক্ষার ভিত্তি নির্ধারণ তথা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরিবর্তে শিক্ষার কাঠামোগত বিন্যাস, গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের উপর তাদের পূর্ণ প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করেছে। অধিকন্তু এসব কমিশন/কমিটির সুপারিশমালার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নের মুখ দেখে নি। তাই আঙ্গিক দিক থেকে আমরা উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও আমাদের মনন ও মানসজগতকে ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকল ও নব্য সাম্রাজ্যবাদী/ নব্য উপনিবেশবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারি নি।



সারসংক্ষেপ
_________

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করার পর তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট http://www.moedu.gov.bd/ -তে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে পরামর্শ ও মতামত চাওয়া হয়েছে। ই-মেইল ঠিকানা হলো-

minister@moedu.gov.bd
info@moedu.gov.bd

__________________________________________________________
চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্ট পর্যালোচনা করার পর এর যে সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় তা নিম্নরূপ:
__________________________________________________________

# প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে,



“মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। ... এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী, সুলভ, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”


* শিক্ষার কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস করে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে; উচ্চ শিক্ষার কাঠামো অপরিবর্তিত রয়েছে।

* সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই প্রাথমিক স্তর হবে বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষার স্তর এবং এতে অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসৃত হবে। তবে মাদরাসার ক্ষেত্রে কুরআন, হাদীস, আরবিÑ এসব বিষয় অতিরিক্ত পড়তে হবে।

* প্রাথমিক স্তরে শিশুদের শিখনকার্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ১ বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং এর জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়েছে।

* প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণী থেকে সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’কে বাধ্যতামূলক করা হলেও মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারার মানবিক শাখা ও ভোকেশনাল শিক্ষায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে; কিন্তু বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পাঠ্যক্রম থেকে তা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়েছে।

* মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলেও মাদরাসা শিক্ষায় তা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে এবং প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা-উপকরণ ((teaching aid)) হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

* তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার নবম ও দশম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। খসড়া রিপোর্টের কোথাও এর পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ((content) সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ‘জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ’ নামের একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

* প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর শেষে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্তরভিত্তিক পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হবে। এর উপর ভিত্তি করে সনদ প্রদান করা হবে। এর মধ্যবর্তী সময়ের জন্য পঞ্চম ও দশম শ্রেণী শেষে আঞ্চলিক পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে।

- মাদরাসা শিক্ষাধারায় পূর্বের মানবিক ও বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি ‘ব্যবসায় শিক্ষা’ শাখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

- সাধারণ শিক্ষা ধারায় প্রাথমিক স্তর থেকেই ‘ললিতকলা শিক্ষা’কে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

* ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে বিদেশী ধারার কারণে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে কোনো রূপ সংস্কারপ্রস্তাব ও নিরীক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরে রেখে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দেয়া হয়েছে।

* মাদরাসা শিক্ষাধারার এ যাবতকাল পর্যন্ত চলমান স্বাতন্ত্র্যকে সমতায়নের ((homogenization) যুক্তিতে বহুলাংশে সংকুচিত করে নিয়ে আসা হয়েছে।

* বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার ক্বাওমি ও আলিয়া এ দুটো পৃথক ধারাকে পুরোপুরি একইভাবে দেখা হয়েছে এবং একই নীতিমালার আওতায় আনা হয়েছে।



_______________________
উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিকসমূহ
_______________________

চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্টটি পর্যালোচনার পর আমরা এর ভেতরে কতক আশাব্যঞ্জক দিক খুঁজে পাই। শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের যে দাবি বহু দিন ধরে উত্থাপিত হচ্ছিল, তার অনেকখানি কমিশন রিপোর্ট ধারণ করছে।

বিশেষ করে শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে স্তরগত পুনর্বিন্যাস প্রবর্তন ছিল সময়ের দাবি। এর বাইরেও কতক বিষয় উঠে এসেছে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি কল্যাণধর্মী উন্নত জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেমন

* প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে ১ বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা।

* ৮ বছর মেয়াদী (১ম থেকে ৮ম শ্রেণী) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে মাদরাসায় ‘ব্যবসায় শিক্ষা’ শাখা সংযোজন।

* কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ।

* মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারায় বাধ্যতামূলকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ।

* শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ নির্ধারণ।

* প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষণ-শিখন (eachinglearning)-এর ব্যবস্থা করা।

* সমমর্যাদাভুক্ত বা একীভূত শিক্ষা ((Inclusive Education) ব্যবস্থা চালুকরণ।

* প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ।

* প্রাথমিক স্তরে (৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী) ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।

* শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্তকরণ।

* উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির কারণে ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত শিথিল না করা।

* উচ্চ শিক্ষায় গবেষণাকে উৎসাহিত করা এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কনসালটেন্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া।


* সকল প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন।

* সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি।

* জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন।

* প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠন।

* প্রচলিত প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করে ক্রমে এর অবসান।
* বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ।








_______________________________
কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা ও আমাদের বক্তব্য
_______________________________

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) অনেক আশাব্যঞ্জক ও বাস্তবভিত্তিক হওয়ার পরও বিশেষ কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনকে ধারণ করতে সক্ষম হয় নি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে। তাই এ রিপোর্টকে কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন শিক্ষানীতি হিসেবে গণ্য করা যায় না। এর কারণগুলো নিম্নরূপ:

১।।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,


“জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাসমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।”

আরো বলা হয়েছে,

“এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”

খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ১-এ সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৭-এ বলা হয়েছে,

“অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা

রাষ্ট্র

(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা র্নিধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,

(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

কিন্তু খসড়া রিপোর্টের ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই অনুচ্ছেদকে সুকৌশলে বিকৃত করে লেখা হয়েছে,

‘এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার গণমুখী ...’।

এখানে সংবিধানের শব্দ চয়ন ‘একই পদ্ধতির গণমুখী’কে সুকৌশলে ‘সেক্যুলার গণমুখী’ বলা হয়েছে। অথচ সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।

সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ৪টি। যথা

ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস

খ) জাতীয়তাবাদ

গ) গণতন্ত্র

ঘ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র

সংবিধানের ৮(১এ) অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়েছে,

“সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।”

খসড়া রিপোর্টের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ৩-এ সুনাগরিকের গুণাবলির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘ন্যায়বোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, শৃঙ্খলা, সহজীবন যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায়’ ইত্যাদি। কিন্তু সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ’ ধারণাটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। আবার বাংলাদেশের নাগরিকদের কর্তব্য সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।”

তাই বাংলাদেশের কোনো সুনাগরিকের জন্য সংবিধানের অধীনে থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ-এর মতো অসাংবিধানিক তথাকথিত সুনাগরিকের গুণাবলি বিকাশের কোনো সুযোগ নেই।

Secularism বা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ দর্শনটি ঊনিশ শতকে যুক্তরাজ্য থেকে প্রথমত উদ্ভূত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে জর্জ জ্যাকব হোলিওক ((George Jacob Holliock) নামক এক ব্যক্তি সেক্যুলারিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রধানত মানুষের ইহজাগতিক দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত। নিম্নে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর দুটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো

Oxford Dictionary-তে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "Belief that religion
should not be involved in the organization of society, education, etc."

আবার এ মতবাদের অনুসারী (Secular) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ""Not connected with spiritual or religious
matter."."

‘ই‘লিশ সেক্যুলারিজম’ গ্রন্থ অনুযায়ী ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ হলো, Secularism is a code of duty pertaining to
this life founded on considerations purely human, and intended mainly for those who find
theology indefinite or inadequate, unreliable or unbelievable. Its essential principles are
three_ The improvement of this life by material means; That science is the available
providence of man; That is good to do good, whether there is other good or not, the good of
present life is good and it is good to seek that good. (English Secularism, P. 35)

মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যুক্তি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে Enlightenment Movement-এর জরায়ু ফেটে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (secularism)এর প্রসব ঘটে।Enlightenment Movement তথা মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের মাধ্যমে এর অনুসারীরা মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন দর্শন আমদানি করলেন যে, রাষ্ট্র ও সমাজের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই; ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অন্তরের ব্যাপার; অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রভৃতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, যুক্তি (logic)-ই জীবন পরিচালনার ভিত্তি হবে। এক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নির্দেশনা বা ওহীর জ্ঞান ((divine guidance)-এর কোনো প্রয়োজন নেই। ইউরোপে এই আন্দোলনের সফলতার ফলে ধর্মহীন যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠল, তাতে মানুষ নিতান্তই স্বার্থপর হয়ে গেল, ভোগবাদী হয়ে পড়ল, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। সর্বোপরি নীতিবোধের লোপ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ই এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে প্রকাশ পেল।

সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোনোভাবেই শিক্ষা ও শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হতে পারে না।

২।।

এ রিপোর্টের ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ের ৪, ৫ ও ১৪ নম্বর পয়েন্টে যথাক্রমে বলা হয়েছে,

“জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।”

“দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন-ঘনিষ্ট বিকাশে সহায়তা করা। ”

“সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলা এবং জাতির জন্য সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারার শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো। একই উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরেও একইভাবে কয়েকটি মৌলিক বিষয় পড়ানো।”

অথচ এই বিষয় বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ক্ষেত্রে। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে একটি বিদেশী ধারার শিক্ষা হিসেবে গণ্য করে তাকে বিশেষ শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি ও পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দিয়ে সকল প্রকার পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার

আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে শত বছর ধরে চলে আসা মাদরাসা শিক্ষাধারার (যার সাথে জড়িত এ দেশেরই লাখ লাখ মানুষ) যাবতীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এর স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও স্বকীয়তাকে বহুলাংশে সংকুচিত করা হয়েছে। এ নীতি দ্বিমুখী, স্ববিরোধিতাপূর্ণ ও অযৌক্তিক।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় অন্য সব বিষয়ের ব্যাখ্যায় পৃথক পৃথক অধ্যায় রাখা হলেও দেশের ক্রমবর্ধমান ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারা সম্পর্কে কয়েক বাক্যেই সমাপ্ত করা হয়েছে। অথচ এখানে পড়ছে এ দেশেরই বিপুল সংখ্যক ছেলে-মেয়ে। আবার এ শিক্ষাধারায় এদেশের ঐতিহ্য শিক্ষাদান বা সংস্কৃতির ছোঁয়াও নেই। যে বৈষম্যহীন সমাজ এবং সম-মৌলিক নাগরিক চেতনা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, তা থেকে ইংরেজি মাধ্যমকে রেহাই দেয়া হলো কেন? তাদের কি জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নেই।

বাস্তবতা হলো, এদেশীয় বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, রুচি ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় না থাকায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই এদেশে অন্য একটি sub-culture গড়ে তুলছে যা আমাদের সমাজের সাথে খাপ খায় না। তারা বেড়ে ওঠে একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে, যা জাতিগত ঐক্যবদ্ধতা ও চেতনার পরিপন্থী।

সুতরাং আমাদের এ ধরনের শিক্ষাধারার বিষয়ে চিন্তাশীল বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ যদি ইংরেজিতে পারদর্শিতা অর্জন করতে চায় তবে তাদের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এন সি টি বি) প্রণীত শিক্ষাক্রমের ইংরেজি সংস্করণ (national curriculum in English version) অনুসরণ করা যেতে পারে।

৩।।

প্রস্তাবিত খসড়া রিপোর্টে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম থেকে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’ বাতিল করা হয়েছে। শুধু সাধারণ শিক্ষাধারার ভোকেশনাল শিক্ষা ও মানবিক শাখার ৯ম-১০ম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হলেও ১৪টি ঐচ্ছিক বিষয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা টিকে উঠতে পারবে না । আমরা প্রত্যেক শিক্ষাধারার সকল স্তরের সকল শাখা ও বিভাগে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা'কে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি। কারণ, এ রিপোর্টে শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু,

অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। ”

অন্যদিকে শিক্ষা-মনোবিজ্ঞানের আলোকে বলা যায়, সাধারণত মাধ্যমিক স্তরের বয়ঃক্রম হলো নানাবিধ টানাপোড়েনের সময়। এ বয়সে মনো-দৈহিক বিশেষ পরিবর্তনের ফলে তারা বিপথে পা বাড়ায়, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ সময়টাতে খুব সহজেই বিকৃতি আর অনাচার বাসা বাঁধে তাদের মনে। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আত্ম-নিন্ত্রয়ণ। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাই ব্যক্তিকে তার চিন্তা-চেতনা, কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সুপথে পরিচালনা করে। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবই ব্যক্তিকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়। ফলে সে নানা রূপ অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের আজকের সমাজ বাস্তবতা তারই প্রমাণ। কারণ, আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অপ্রতুলতা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। আর আজকের উত্তপ্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সব স্তরের জন্যই ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণ শিক্ষাধারায় প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণী থেকে ১০০ নম্বরের ‘ধর্মীয় শিক্ষা’ রাখা হয়েছে, যা খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী গল্প ও জীবনীর মাধ্যমে শেখানো হবে। এটা ধর্ম শিক্ষার পদ্ধতি নয়। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা না রেখে ‘ললিত কলা’ রাখার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

ধর্ম ও নৈতিকতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এদের অবস্থান সর্বদাই পাশাপাশি। অনেকেই মনে করেন যে, নৈতিকতার উৎপত্তি ধর্মের এমন জায়গা থেকে যা কখনও আলাদা করার মতো নয়। নৈতিকতা মানুষের একটি সহজাত বিষয়। বয়সের সাথে সাথে এটা বিকশিত হয়ে কিছু বিষয়কে গ্রহণ এবং অনেক বিষয়কে বাদ দিয়ে একটা মানদণ্ডে পৌঁছায়, যাকে আমরা মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে নৈতিক মানদণ্ড বলি। মানুষে মানুষে এ আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এসব কারণেই মানুষের বিবেক কিছু নৈতিক গুণাবলিকে ভালো বলে স্বীকৃতি দেয় এবং কিছু বিষয়কে মন্দ বলে প্রত্যাখ্যান করে।


_____________________
নৈতিকতার উৎপত্তি ধর্ম থেকে
_____________________


নৈতিকতার উৎপত্তি যে ধর্ম থেকে তার কিছু বর্ণনা নিম্নরূপ

______
ইসলাম
______

ইসলামের বক্তব্য হলো, এই পৃথিবী মহান আল্লাহর তৈরী; তিনি এক ও অদ্বিতীয়। এই বিশ্বের পরিচালনা, সার্বভৌমত্ব এবং স্থায়িত্ব তাঁরই উপর ন্যস্ত। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সব ধরনের সমস্যা, ভুল ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত এবং সদা পবিত্র। তাঁর প্রভুত্ব সব ধরনের পক্ষপাতিত্ব এবং অবিচার থেকে মুক্ত।

মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করা এবং সরল-সঠিক পথে চলাই হলো মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য। কোন্ ধরনের ইবাদত ও আনুগত্য করতে হবে সেটা আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তাআলা মানবতাকে সঠিক পথনির্দেশনা দেয়ার জন্য আসমানী কিতাবসহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

মানুষ তার প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য এবং পরকালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পৃথিবীতে মানুষের ক্ষুদ্র জীবনকাল হলো পরকালের জন্য নিজেকে তৈরি করার একটা সুযোগ। মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজ, চলাফেরা, কথাবার্তা, চিন্তা, উদ্দেশ্য ও অনুভূতির পূর্ণ সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং এর উপর ভিত্তি করেই তাকে পরকালে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কুরআন মাজীদ অনুযায়ী নৈতিকতার তিনটি উৎস রয়েছে এবং তা মানবপ্রকৃতির সাথে মিশ্রিত। যথা

আত্মপরিচালনা:
নিজেকে নিয়ন্ত্রণই আত্মপরিচালনা, যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে শয়তান থেকে রক্ষা করে। আল কুরআনের বাণী,

“আমি আমার প্রবৃত্তিকে দোষমুক্ত বলে দাবি করছি না। প্রবৃত্তি তো মন্দের দিকে উসকাতেই থাকে। আমার রব কারো উপর রহমত করলে আলাদা কথা। নিশ্চয়ই আমার রব ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়।” (১২:৫৩)

আত্মসমালোচনা:
এটি নৈতিকতার দ্বিতীয় উৎস, যার অর্থ হলো নৈতিকতার মাধ্যমে কাজের গুণাগুণ বিচার করা। যখন কোনো অশালীন কাজ সম্পন্ন হবে তখনই সেটা বিবেকের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে এই গুণের অধিকারী। আল কুরআনে এসেছে,

“আমি আরো শপথ করছি সে আত্মার, যা ত্র“টি-বিচ্যুতির জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয়।” (৭৫:২)

সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভালোবাসা: আল কুরআনের ভাষায়,

“(অপরদিকে) যারা বলে, আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন আমাদের মালিক, অতঃপর (এ ঈমানের উপর) তারা অবিচল থাকে, (মৃত্যুর সময় যখন) তাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল হবে তখন তাদেরকে বলবে, (হে আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দারা!), তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তিত হয়ো না; (উপরন্তু) তোমাদের কাছে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছিল, (আজ) তোমরা তারই সুসংবাদ গ্রহণ করো (এবং আনন্দিত হও)।” (৪১:৩০)

______
হিন্দু ধর্ম
______


হিন্দু ধর্ম মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। আত্মশুদ্ধি (ইয়ামা) ও নিয়ামা হলো যোগ ও বেদান্ত মতবাদের মূল ভিত্তি। নৈতিকতাই হলো ধর্মের প্রবেশ পথ। যে নৈতিক ও আদর্শিক জীবন নির্বাহ করে সে মুক্তি ও মোক্ষ লাভ করে।

মূল্যবোধের চর্চা আপনাকে প্রতিবেশী, বন্ধুমহল ও পরিবারের সাথে ঐক্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এ মূল্যবোধ ‘সুখ ও মোক্ষ’কে দীর্ঘস্থায়ী করে।

প্রত্যেক ধর্মই নৈতিক উপদেশের শিক্ষা দেয়। যেমন

“হত্যা করো না, আঘাত করো না , প্রতিবেশীকে ভালোবাসো, কখনো প্রতিবেশীর দোষ খুঁজিও না।”

হিন্দু ধর্মের মূলনীতি হচ্ছে

সব জায়গায় আত্মার পরিব্যাপ্তি রয়েছে। এটি হলো সকল জীবের অন্তর্নিহিত আত্মা। এটি সকল শ্রেণীর জন্য সচেতনতামূলক। যদি তুমি প্রতিবেশীকে আহত কর, প্রকৃতপক্ষে নিজেকে আহত করেছ। যদি তুমি অন্য সৃষ্টিকে আহত কর, তাও নিজেকে আহত করেছ। কারণ, পুরো বিশ্বই তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারো নয়।



_______
বৌদ্ধ ধর্ম
_______


বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী মানুষের ভাগ্যকে দুঃখ-বেদনা থেকে মুক্ত থাকতে হয়। আর এজন্য বৌদ্ধ ধর্মে জীবনে আটটি পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে, যা নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে গঠিত। সেগুলো হলো

* বাস্তবতাকে গতানুগতিক দৃষ্টিতে না দেখা
* আত্ম-অস্বীকৃতি এবং স্বাধীনতা ও নির্দোষতার অভিপ্রায় প্রত্যাখ্যান
* সত্যবাদিতার সাথে এবং কাউকে আঘাত না দিয়ে কথা বলা
* কাউকে আঘাত না দিয়ে কাজ করা
* অহিংস জীবন যাপন
* আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করা
* চারপাশের বস্তুগুলোকে সতর্কতা এবং সচেতনতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা; কোনো ধরনের বিরক্তি ও ব্যগ্রতা ছাড়াই বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া

* সঠিক ধ্যান ও মনোযোগ

এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মে পঞ্চশীলা বা পাঁচটি নৈতিক অনুশাসন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। তা হলো

* জীব হত্যা না করা এবং কষ্ট না দেওয়া
* চুরি না করা
* ধর্মীয় বিধি ছাড়া যৌন সম্পর্ক পরিহার করা
* মিথ্যা অথবা কষ্টদায়ক কোনো কথা না বলা
* মদ ও মাদকজাতীয় দ্রব্য পরিহার করা, কেননা এটি সুস্থ চেতনাবোধ হ্রাস করে


_______
খ্রিস্ট ধর্ম
_______

খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা সকল নৈতিকতাকে বাইবেল থেকে উৎসারিত বলেই মনে করেন।

মানব-উৎসর্গ, গণহত্যা, দাস ব্যবস্থা, নারী-বিদ্বেষকে সঙ্গতিপূর্ণভাবে স্থির করা হয়েছে। অবশ্য পিতা-মাতার প্রতি স্রষ্টার উপদেশ চিত্তাকর্ষকভাবে সহজ করা হয়েছে,

“যখন সন্তানেরা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তাদের প্রহার করা উচিত।” (প্রবাদ ১৩:২৪, ২০:৩০ ও ২৩:১৩-১৪)

“যদি তারা (সন্তানেরা) লজ্জাহীন হয়ে স্পর্ধা দেখায় তবে তাদের হত্যা করো।” (এক্সোডাস ২১:১৫, লেভিটিকাস ২০:৯, ডিউটারোনমি ২১:১৮-২১, মার্ক ৭:৯-১৩ এবং ম্যাথু ১৫:৪-৭)

খ্রিস্ট ধর্মে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদেরকে প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে বিশ্বাস, ব্যভিচার, সমকামিতা, ছুটির দিবসে কর্ম সাধন, সমাধিস্থ প্রতিচ্ছবির পূজা সাধন, জাদুর ব্যবহার এবং অন্যান্য মনোকল্পিত অপরাধের ক্ষেত্রে খুব কঠোর হতে হবে।

থ্যাসালোনিয়াসে (একটি পবিত্র গ্রন্থ) বলা হয়েছে-

(১:৭-৯) যিশু ও তাঁর শক্তিশালী দূত জ্বলন্ত আগুনে আসবেনÑ যারা স্রষ্টা সম্পর্কে অজ্ঞতা পোষণ করে এবং যারা যিশুর জীবনী শিক্ষা সম্বলিত নীতিমালা (গসফল) অনুসরণ করে না তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে।

(১:৯) সেসব অবিশ্বাসীদের স্রষ্টার উপস্থিতিতে চিরস্থায়ী ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হবে।

(২:৮) তারপর তার খারাপ ও ক্ষতিকর কাজ প্রকাশিত হবে, স্্রষ্টা তাদের মুখের গতিশীলতা নিঃশেষ করবেন এবং তাদের আগমনের সম্ভাবনা ধ্বংস করবেন।


_______
ইহুদি ধর্ম
_______


ইহুদিদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টা ও নৈতিকতা থেকে উৎসারিত।

ইহুদি ধর্মের ঐশ্বরিক আদেশ হলো

* আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো স্রষ্টা থাকবে না
* নিজের জন্য কোনো প্রতিমা তৈরি করতে পারবে না; এদের কাছে মাথা নত বা কোনো পূজা করতে পারবে না
* তোমরা স্রষ্টার নামের অপব্যবহার করো না
* বিশ্রাম ও ছুটির দিনকে খেয়াল রাখতে হবে
* মা-বাবাকে সম্মান করো
* হত্যা করো না
* ব্যভিচার করো না
* চুরি করো না
* প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ করো না
* প্রতিবেশীর সুখে ঈর্ষান্বিত হয়ো না; প্রতিবেশীর সম্পদ, স্ত্রী বা অন্য কোনো বিষয়ে ঈর্ষা পরিহার করো



অবশেষে বলা যায়, নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি (সৃষ্টিকর্তার) উপর এক ধরনের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই আমাদেরকে তার আদেশ ও নিয়ম অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করে। এটি আমাদেরকে কু-কর্মের শাস্তি সম্পর্কে অবহিত করে এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করে।

পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ধর্মসমূহ থেকে উপর্যুক্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম ও নৈতিকতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এ জন্যই পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিয়ে বলেছেন,

“বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ ধ্বংসের উপকরণ অনেক বেশি জোগাড় করে ফেলেছে।”

৪।।

প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার সংযোজনী ২-এ প্রাথমিক স্তরের জন্য

শিক্ষাক্রম উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা মাদরাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় সংশোধনী আনার দাবি জানাচ্ছি।

(ক) মাদরাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরে যেসব বিষয় অতিরিক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষাধারার স্বকীয়তার স্বার্থে সেগুলো মাদরাসার জন্য আবশ্যিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

(খ) ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ‘কুরআন মাজীদ’ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(গ) ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত যেহেতু আকাইদ ও ফিক্হ এবং কুরআন মাজীদ ও তাজবিদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেহেতু একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কারণে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টি বাদ দিতে হবে।

(ঘ) ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আরবিতে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে আরবি ১ম পত্র ১০০ নম্বর ও আরবি ২য় পত্র ১০০ নম্বর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫।।

এ খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’কে বাতিল করা হয়েছে। শুধু ভোকেশনাল শিক্ষা ও মানবিক শাখার নবম-দশম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যেক ধারার সকল স্তরের সকল শাখা ও বিভাগে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা’কে অবশ্যই আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারার মানবিক শাখায় সামাজিক বিজ্ঞানকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে, আবার নৈর্বাচনিক বিষয় হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ (যেমন সমাজবিজ্ঞান, পৌরনীতি, অর্থনীতি ও ভূগোল প্রভৃতি) রাখা হয়েছে। পুনরাবৃত্তি হওয়ার কারণে মানবিক শাখার আবশ্যিক বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি বা সাধারণ বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এ উল্লিখিত মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় মৌলিক বিষয়কে সংকোচন/পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে কিংবা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে অথবা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়েছে। যার ফলে মাদরাসা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং এর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য হ্রাস পাবে। উল্লেখ্য, এ কথা সর্বজনবিদিত এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ২৭ পৃষ্ঠায় মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“... শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা এমনভাবে তৈরি হবে যেন তারা ইসলামের আর্দশ ও মর্মবাণী ভাল করে জানে ও বুঝে, সে অনুসারে নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ঘটায়।”


নিম্নে এ রিপোর্টের আলোকে মাদরাসা পাঠ্যক্রমের বাতিলকৃত/সংকুচিত/ পুনরাবৃত্তিকৃত চিত্র দেখানো হলো

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম