নাম: মো: আসলাম হোসাইন
সাংগঠনিক মান: সদস্য
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৭ নভেম্বর ১৯৮৮ রাত সাড়ে বারটায়
পিতার নাম: ডা: জিন্নাত আলী
সর্বশেষ পড়াশুনা: এম.এস.সি, পরীক্ষার্থী, ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য: বাংলার জমিনে কুরআনের রাজ প্রতিষ্ঠা করা।
শহীদ হওয়ার স্থান: ৩২৯ নং কক্ষ, নবাব আব্দুল লতিফ হল।
আঘাতের ধরন: রড, হকিস্টিক, ছোরা, কুড়াল, রামদা।
কাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রমৈত্রী, জাসদ, ছাত্র ইউনিয়ন।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: বুজিডাঙ্গা, ডাক: মুন্দিয়া, থানা: কালিগঞ্জ, জেলা: ঝিনাইদহ।
ভাইবোন : ১০ জন।
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান: বড়।
পরিবারের মোট সদস্য: ১০ জন।
পিতা: জীবিত, পেশা: ডাক্তার।
মাতা: জীবিত, পেশা: গৃহিণী।
শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী: “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আমরা শহীদ হতে প্রস্তুত'ত।”
শাহাদতের পর শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া: “আসলাম ইসলামের পথে শহীদ হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। আমি এক আসলামকে হারিয়ে হাজারো আসলামকে পেয়েছি। আমার দুঃখ নেই; আমি শহীদের পিতা হিসাবে গর্ব বোধ করি।”
[২০১৭ঃ প্রকাশ্যে ও দিনের আলোয় টিভি ক্যামেরার সামনে ছাত্রলীগ কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করে হিন্দু দর্জি বিশ্বজিতকে, বছর দুয়েক প্রহসন চালানোর পর বিশজিৎ হত্যাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের ফাসির সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেয় দুই বিচারপতি, (১) রুহুল কুদ্দুস বাবু (২) ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। বিশ্বজিত হিন্দু হবার কারনে ঘটনাটা বেশ সমালোচিত হয় এবং মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এই বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবু ছিলো জাসদ ছাত্রলীগের নেতা যে ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর শিবির নেতা শহীদ আসলাম হোসাইনকে কুপিয়ে খুন করে। সেই মামলার প্রধান আসামী এই রুহুল কুদ্দুস এবং সকল তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও একই কথা ছিলো ]
কি অপরাধ ছিল আমার আসলামের
আসলাম সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে দারুণ কষ্ট হয়। আসলাম ছিল আমার একমাত্র চাওয়া ও পাওয়ার। ওর জন্ম হয় ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। আমার চার মেয়ের জন্মের পর ওর জন্ম হয়। চার বোনের প্রিয় ভাই হয় আসলাম। তাকে তারা কখনও কোল থেকে নামায়নি। এমন আদরের সন্তান ছিল আসলাম। তারপর সে আসে- আসে- বড় হল, হাঁটা শিখলো। তাকে একদিন উই’পি স্কুলে ভর্তি করলাম। উই’পিতে পাস করার পর তাকে নলডাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করি। সে ঐ ক্লাশ থেকেই নামাজ পড়া শুরু করে এবং সে আমার জানা মতে কোন দিন ইচ্ছা করে নামাজ কাজা করেনি। দাড়ি রাখার পর সে কোনদিন দাড়িতে ক্ষুর দেয়নি। ও পাঞ্জাবী পায়জামা বেশী পড়তো। এস.এস.সি. ১ম বিভাগে পাস করার পর ওকে যশোর এম এম কলেজে ভর্তি করি। ওখান থেকে এইচ.এস.সি. ২য় বিভাগে পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ও জীবনের বেশীর ভাগ সময় বাইরে থেকে লেখা পড়া করেছে। তারপর, ’৮২তে রাজশাহীতে গোলযোগ বাধে। ঐ গোলযোগে ওর মাথা ফেটে যায়। পরবর্তীতে মাথা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু মাথা খারাপ হয়েও আসলাম শুধু লোকদেরকে নামাজের সময় হলেই আজান দিয়ে বাড়ি থেকে ধরে এনে নামাজ পড়াতো। সে লোকদের ইসলামের কথা বলত, নামাজ পড়াতো এই ছিল তার কাজ। এর আগে ও পরে ভাল থাকা অবস্থায় সে গ্রামের লোকদের বাড়ি এসে নামাজের জন্য ডাকতো, নামাজ শিখাতো ইত্যাদি। আসলাম অন্যায়কে কোন দিন প্রশ্রয় দেয়নি।
আমি তার পিতা হয়ে তাকে অনেক বার বলেছি তুই একটু সাবধানে রাজশাহীতে চলাচল করিস।লোকজনে অনেক কথা বলছে। তোকে মেরে ফেলবে নাকি।
আসলাম বলতো, ‘মানুষ কোন দিন মানুষকে মারতে পারে না, আল্লাহ না মারলে।’ তাকে আমি কোন ভাবেই বোঝাতে পারিনি।
যা হোক আমার আসলাম ইসলামের পথে শহীদ হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি এক আসলামকে হারিয়ে হাজার হাজার আসলাম পেয়েছি। আমি গর্ব বোধ করি, আমি একজন শহীদের পিতা। আমি আনন্দিত হব সেই দিন, যে দিন বাংলার প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিবির ছাড়া কিছুই থাকবে না।
বাংলার জমিনে ইসলামের আইন কায়েম হবেই ইনশাআল্লাহ। আমি আসলামের রেখে যাওয়া কাজকে আরো তড়িৎ গতিতে আনজাম দেয়ার জন্য সকলকে আহ্বান করছি।
(লেখক: ডা: জিন্নাত আলী, শহীদ আসলাম হোসাইনের গর্বিত পিতা)
স্মৃতি অম্লান
‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং এইসব লোকেরা প্রকৃতপক্ষে জীবন-।’ (সূরা বাকারা: ১৫৪)
দিনটি ছিল ১৭ নভেম্বর ১৯৮৮। উত্তরবঙ্গে শীত বেশ জাঁকিয়ে বইতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে সারাদিন ধরে ক্যাম্পাসে প্রবল উত্তেজনা। ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র কর্মীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রচন্ড বৈরী মনোভাবের সাথে যুক্ত হয়েছে জাসদ ও ছাত্র মৈত্রীর সম্মিলিত শক্তি। সকলেরই অভিপ্রায় উত্তরবঙ্গের উচ্চশিক্ষার এই একমাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি দাওয়াত-কারীদের এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে, আর নেতা কর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করতে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাও সবর ও সালাতের মাধ্যমে সকল প্রতিকূলতার মুকাবিলা করে আসছে। তাদের সব কিছুই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা:) জন্যে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু তাগুতী শক্তি কোন দিনই তাদের শক্তির মহড়া দেখাতে পিছপা হয়নি। বরং আগবাড়িয়ে চড়াও হয়েছে মর্দে মুজাহিদদের ওপর। বদর, ওহুদ, খন্দক থেকে শুরু করে সর্বত্রই এর প্রমাণ রয়েছে ভুরিভুরি।
ক’দিন ধরেই ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। মাঝে মধ্যেই মিছিল হচ্ছে, সমাবেশ হচ্ছে। জাসদ-মৈত্রীর ছাত্ররা তাদের পেশীশক্তির মহড়া দেখাচ্ছে। প্রতিবাদে ছাত্রশিবিরের ছেলেরাও কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করেছে, তাদের ওপর অন্যায় নিগ্রহের প্রতিবিধানের জন্যে ফরিয়াদ জানিয়েছে।
কিন্তু বাস-বে প্রতিকারের কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বরং পুলিশ দিয়ে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের আরও কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা হয়েছে।
হলগুলিতে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। মাঝে মধ্যেই রাতের আতংক নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান হয়ে যায় বোমার আওয়াজে। সেদিনও সন্ধ্যা পার হয়ে ধীরে ধীরে রাত নেমে এলো ক্যাম্পাসে। হলগুলির সামনে ছিল জটলা। এক সময়ে হলের মেইন গেটগুলিও বন্ধ করে দেওয়া হলো। রাত দশটা পার হতেই মুহূঃর্মুহূ শক্তিশালী পটকা আর বোমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম ক্যাম্পাসের পূর্ব দিক থেকে। ছেলেদের হলগুলি সব ঐ দিকেই। ঘরে বসে খুবই উদ্বেগ আর অস্থিরতা লাগছিল ছাত্রদের কথা ভেবে। কিন্তু কি করণীয় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
এক সময়ে গভীর রাতে বাসার সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাস এসে থামলো। আমার প্রতিবেশী ছিলেন আইন অনুষদের ডীন প্রফেসর বদরুদ্দিন। তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ভাইসচ্যান্সেলরের বাসভবনে। গাড়ির ড্রাইভারের কাছে শুনলাম নবাব আব্দুল লতিফ হলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক ছেলে খুন হয়েছে। ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা হলের শিবির সভাপতির কক্ষে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে। জাসদ-মৈত্রীর তান্ডবের ফলে পূর্বপাড়ায় দারুণ উত্তেজনা ও বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্যই ভিসি প্রফেসর আমানুল্লাহ আহমদ জরুরী মিটিং ডেকেছেন প্রশাসনিক কাউন্সিলের। শুনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম।
নবাব আব্দুল লতিফ হলের শিবির সভাপতিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। নাম তার আসলাম হোসাইন। বাড়ি যতদুর জানি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্স শেষবর্ষের ছাত্র ছিল। খুলনা বিভাগের ছেলে হওয়ায় এবং ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীল ছাত্রনেতা হওয়ার কারণে তার সাথে মোটামুটি ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ভারি অমায়িক আর সৌম্যদর্শন ছেলে ছিল সে। বিনম্র বিনয়ী ব্যবহার ছিল তার। পরে তার বিভাগের শিক্ষকদের কাছেও জেনেছি বিভাগেও সে ছিল শিক্ষকদের প্রিয়। তার আচার-আচরণ, সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বদানের সহজাত ক্ষমতা তাকে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। বাকি রাতটুকু কাটল উদ্বেগ আর অস্থিরতায়। ভোর হতেই জানতে চেষ্টা করলাম পুরো ঘটনাটা। যা জানলাম তাতে শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেই রাতে নবাব আব্দুল লতিফ হলের ৩২৯ নং কক্ষে রাত এগারোটার পরে যা ঘটেছে তা চেঙ্গিসের বর্বরতাকেও হার মানায়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী গুণ্ডারা শিবির নেতার বুকের ওপর হামলা চালায় একযোগে। দা, লোহার রড, হকিস্টিক, ছুরি নিয়ে তারা রুমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু রুমের দরজা ভাঙতে না পেরে ব্যবহার করে কাঠের ভারী খিল। তাদের সম্মিলিত প্রচন্ড আঘাতে হলের অন্যান্য রুমের দরজা-জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ভেতর থেকে আসলাম ও তার সঙ্গীদের সমবেত প্রতিরোধ এক সময়ে ভেঙে ফেলে। রুমে ঢুকে বর্বর উল্লাসে তারা আসলামসহ রুমের সকলের ওপর চড়াও হয়। তাদের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ছিল আসলামের ওপর। তাই প্রথম সুযোগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শকুনের মতো। পিটিয়ে, কুপিয়ে, খুঁচিয়ে বর্বরোচিত ভাবে তারা হত্যা করে আসলামকে। তাদের পৈশাচিকতার এখানেই শেষ নয়। তারা লাশের গলায় ফাঁস লাগিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নামায় তিনতলা থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায় ডাইনিং হলের মধ্যে। মতলব ছিল সেখান থেকে লাশ বের করে অদূরেই ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দিয়ে নিখোঁজ করে ফেলবে। কিন্তু ততক্ষণে অন্যান্য হলের ছেলেদের হাঁক ডাকে ও পূর্বদিকে বসবাসরত কর্মচারীদের হৈচৈ এর ফলে পুলিশ এসে পড়ায় তাদের সে ষড়যন্ত্র আর সফল হতে পারেনি।
হলের অন্যান্য যেসব রুমে শিবিরের ছেলেরা থাকত সেগুলিও ঐ রাতে জোর করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। ফলে আসলামের জীবন রক্ষার জন্যে হলের মধ্যে তার সাথীরাও এগিয়ে আসতে পারেনি। আসলামের সাথেই তার কক্ষে আহত হয় মুকুল, শফিকুল ও আখতার হোসেন। এদের প্রত্যেককে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয় চিকিৎসার জন্য।
ঘটনার পরের দিন হলে শহীদের রুম পরিদর্শন করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারা বসিয়ে রাখা হয়েছে যাতে সাংবাদিকরাও যেতে না পারে, ছবি না তুলতে পারে সেই বীভৎস লোমহর্ষক ঘটনার। অনেক কষ্টে দু’দিন পরে অনুমতি মিলল লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া রুমটা দেখার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কয়েকজন ব্যক্তিও ছিলেন সঙ্গে। ঘটনার ষাট ঘণ্টা পরে গিয়েও যে দৃশ্য দেখেছিলাম আজও সেই বেদনা বিধুর ও বীভৎস ছবি যেন স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। সে দৃশ্য ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়, শুধুই অনুভবের।
দেখলাম রুমের দরজার পাল্লা খসে পড়ে গেছে, চৌকাঠ থেকে। পাল্লাকে পাল্লা বলে চেনার উপায় নেই। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে পাল্লার তক্তা, ফ্রেম। চৌকাঠের অনেকখানি খসে গেছে দেয়াল থেকে। জানালার লোহার শিকগুলোর কোন কোনটা বেঁকে দুমড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। শোয়ার চৌকিগুলির কাঠামোটাই শুধু অক্ষত আছে। পড়ার টেবিল, বুক সেলফ, আলনা কোনটাই আর চেনার উপায় নেই। ছিন্ন-ভিন্ন রক্ত মাখা জামা-কাপড় তছনছ হয়ে যাওয়া বালিশ-তোষক, বিক্ষিপ্ত ছেঁড়া-ফাঁড়া বই-খাতা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রুমের মধ্যে যত্রতত্র। এখানে ওখানে ছাপ ছাপ রক্ত লেগে শুকিয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে রুমের মধ্যে যে বীভৎস এবং একই সঙ্গে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তা দেখে অতি বড় পাষাণ হৃদয়েরও চোখ ভিজে উঠবে।
শহীদের জানাজায় শরীক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মসজিদ প্রাঙ্গণে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার তাৎক্ষণিক সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল। তার ভাষণে আল কুর’আনের সেই আয়াত তিনি তেলাওয়াত করেছিলেন এই লেখার শুরুতে যা উল্লেখ করেছি। জানাজার পর বাড়ি নেওয়ার আগে শহীদের লাশ এক নজর দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল গভীর প্রশান্তি-তে ঘুমিয়ে রয়েছে। মুখখানাতে বেদনার কোনও অভিব্যক্তি নেই। বরং আসল রবের কাছে ফিরে যাওয়ার সৌভাগ্যে যেন আরও উজ্জ্বল হয়েছে। সেই চেহারা ভোলার মত নয়।
(লেখক: শাহ্ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ এবং সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
শহীদ আসলাম হোসাইন: প্রত্যয়-দীপ্ত এক প্রেরণা
না-অমানিশা রাতের ষোড়শী চাঁদের গায়ে তখনো ময়লা লাগেনি, কালের পরিক্রমা-বর্তে রক্তাক্ত হয়ে তখনো ফেরেনি সেই বাঁধভাঙ্গা সমুদ্র-স্রোত হায়েনার রূপ ধরে কচি ঘাস-তুল্য স্বচ্ছ হৃদয় কন্দরে। চন্দ্রের কিরণ রশ্মি-দল তখনো অতটা বিস্মিত হয়নি, বিহ্বল হয়ে পড়েনি সুউচ্চে হিমালয় চূড়া। মাউন্ট এভারেস্ট তখনো নির্ভীক সাহসিকতার সাথেই অবিচল ছিল নিজ অবস্থানে। এ্যান্টার্ক্টিকার নীরব জলরাশি তখনো বরফের অদূরে ঘুমন-ই ছিল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কিঞ্চিৎ ওপর দিয়ে তখনো দুঃসাহসে ছুটে চলছিল এক নাবিক নতুন প্রত্যয়-দীপ্ত অভীষ্ট লক্ষ্যের সন্ধানেই। লক্ষ্য নিযুত স্বপ্ন সাধের তাঁবু নিঃসংকোচে তখনো উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল তার অন্তর মাঝে। না, তখনো তিনি মৃত্যুর ইঙ্গিত দেখতে পাননি। ধুলো ছড়ানো গালিচার বিছানার আহ্বান তখনো মর্মে পৌঁছেনি তার। তখনো এই ভাবোদয় হয়নি তাঁর হৃদয়ের মণি কোঠায়। আর তাইতো সহাস্যে বীরদর্পী রুসতমের ভূমিকায়, বীর হামজার ভূমিকায় বলতে সক্ষম হয়েছিলেন জননীকে “আমি শহীদ হলে সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বারের মায়ের মতো স্পষ্ট করে কথা বলতে পারবে তো।
হ্যাঁ, প্রশ্ন জাগে কোন্ সেই নাবিক তিনি? কোন্ সেই সাহসী পুরুষ তিনি? কোন সেই দরাজ দিলের অধিকারী পুরুষ তিনি যিনি স্বেচ্ছায় ছুটে আসতে পারেন পতনের দিকে? ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্র মাঝে নিজের ভরাডুবির সংবাদ জানা সত্ত্বেও? কোন সেই সিংহমানব যিনি নির্ভীক চিত্তে ছুটে যেতে পারেন সে দিকে? অথচ তাঁকে বলা হলো, “আসলাম ভাই, পরিস্থিতি খুব একটা ভাল নয়, কোন একদিকে সরে পড়েন।” এতদসত্ত্বেও কোন্ সেই বীর, যিনি হিমালয় শৃঙ্গ অথবা পুষ্পের সুঘ্রাণের মত ছুটে আসতে পারেন স্বপ্রকৃতির দিকে?
হ্যাঁ, এমন কিছু ফুলও আছে যাদেরকে সময়ের ক্ষিপ্রতা, হিংস্রের উম্মত্ততা, প্রজাপতির ব্যস-তা নিজ লক্ষ্য থেকে চ্যুত করতে সক্ষম হয়না। উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে “নাইট কুইন” বা “রাত্রি রাণী” এর কথা। যাদের প্রস্থানে শোকার্ত হৃদয়ে মূহ্যমান হয়ে পড়তে হয়েছে সহস্র নিযুত দর্শককে, আবেগের ঢেউয়ে উতালা হয়ে বলতে হয়েছে। এরপরও এমন কবি দর্শকদের আবেগ উচ্ছাস - প্রস্থান যেমন ঠেকাতে পারেনি ঠিক তেমনি ঐ সাহসী পুরুষেরও প্রস্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল সে দিনের আকাশ-বাতাসের আকুতি, নির্জীব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আহাজারী। আর তাইতো তিনি চললেন-ই নিজের আসল ঠিকানায়, উন্মুক্ত প্রকোষ্ঠে।
হ্যাঁ, আজ ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কুয়াশার পর্দায় জড়ানো আহত শতাব্দী। সবে মাত্র মু’য়াজ্জীনের সুললিত কণ্ঠ হতে ভেসে এলো করুণাময়ের প্রেম মিশ্রিত কতগুলো ধ্বনিপুঞ্জ। সেই ধ্বনিপুঞ্জের প্রেমাসক্তে ছুটে চলল শতভক্ত প্রাণ মসজিদ প্রাঙ্গণে। আর তাঁদেরই একজন ডাক্তার মো: জিন্নাত আলী সাহেব। একটু আগে যিনি হৃদয় নিভৃতে অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন করি কায়কোবাদের ‘আজান’ কবিতার ক’টি ছন্দমালা-
“কে ঐ শোনালো মোরে আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর - - - - - - - - - -।”
তিনিও ছুটে চললেন সেই প্রেমের সুধায় মত্ত হয়ে মসজিদে। ইত্যবসরে শ্রদ্ধেয়া জননী আঞ্জুমান আরার গর্ভ হতে জমিনে পদার্পন করলেন ফুটফুটে অথচ প্রদীপ তুল্য আশ্চর্য এক শিশু, যার নাম দেয়া হলো “আসলাম হোসাইন।”
হ্যাঁ, সত্যিই আসলাম হোসাইন এক জ্বলন- প্রদীপ, প্রত্যয়দীপ্ত এক প্রেরণা, যিনি বেড়ে চললেন ঝিনাইদহ জেলার, কালিগঞ্জ থানাধীন বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামে।
পৃথিবীর আলো-বাতাসে পরিপুষ্ট হলো দেহপিঞ্জর তার, ভর্তি করা হল স্থানীয় পাঠশালায়। স্রষ্টাভক্ত কচি প্রাণ শৈশবে পাঠশালা থেকেই ইসলাম জানার আগ্রহ মিশ্রিত সবক নিয়েই বেরুলেন পাঠশালা থেকে। উচ্চ বিদ্যালয় কলেজ থেকেও একই সবক নিয়ে অবশেষে একরাশ স্বপ্ন, একরাশ আশা নিয়ে ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিষয়ে। অনার্স পর্যন- কৃতিত্বের সাথে একই সবক নিয়ে পড়েই চললেন তিনি। কিন্তু নব্য জাহেলিয়াতের খরতর স্রোতে বহমান জুলুম, অন্যায়, শোষণ-নিপীড়ন সর্বোপরি মানুষকে মানুষের গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত করে সার্বিক কল্যাণ ও চিরমুক্তি বিধানের নিমিত্তে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বমানবতাকে সুখী করার চিন-া দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো তাঁর হৃদয়ে। কেননা তিনি নিজেই “ইসলাম” সুধার সুমিষ্ট আচ্ছাদনে পরিতৃপ্ত হয়েই এ পথে নেমেছিলেন। তিনি ছাড়া আর নামবেন-ই বা কে? যিনি এক ওয়াক্ত নামাজ ক্বাযা করা কখনো শ্রেয় মনে করেন না, দাড়ি খাটো করাতো দূরের কথা, যিনি গ্রামের বাড়ি গিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর খোঁজ নেন, অসহায় নিঃস্বদের খবর নেন, তাদেরকে নামাজ পড়ার কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত করেন, পিতামাতাকে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা ‘উহ’ শব্দটাও বলতে সংকোচ বোধ করেন। তিনি ছাড়া আর কে-ই বা এ পথে অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাফেলায় শরীক হতে পারেন? মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তিনি ছাড়া আর কার পক্ষে দেখা সম্ভব?
না, কখনোই না। দ্বীন প্রতিষ্ঠার দুর্গম কণ্টক ছড়ানো পথে কেবল সেই সমস- দুঃসাহসী সিংহ পুরুষরাই আসতে পারেন, যারা মৃত্যুর আলজিভ কামড়ে ধরে উৎফুল্ল্ল চিত্তে, তাকেই আলিঙ্গন করতে পারেন যাদের কাছে পর্বত প্রমাণ বাধা পুষ্পের কোমল আঘাত তুল্য যাদের কাছে শত্রুর চোখ রাঙানী প্রত্যুষের মৃদুমন্দ মিঠেল সমীরের ঘায়ে আন্দোলিত তৃণের সাদৃশ্য মনে হয়। এ পথের জন্য তারাই নির্বাচিত হয়ে থাকেন যাদের রক্ত মাংসে, শ্বাস-প্রশ্বাসে এমনকি দেহের প্রতিটি লৌহ কণিকায় জমে থাকে শাহাদাত লাভের তেজোদ্দীপ্ত কামনা।
হ্যাঁ, আর তাইতো এই পরিচয়-ই আমাদের হৃদয় জমিনে ভেসে ওঠে শহীদ আসলাম হোসাইনের চরিত্র থেকে, যিনি ইচ্ছে করলেই তো ঐ সময় আত্মরক্ষার্থে অন্যান্য সাথী সঙ্গীদের মতোই গা ঢাকা দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু না, অমন তো কাপুরুষদের নৈতিকতা, ওতো ভীতুর লক্ষণ, ও-তো স্বার্থান্ধ ব্যক্তির পরিচয়। যিনি সর্বদা “ইন্নাস সালাতী, ওয়া নুসুকী, ওয়া মাহ্-ইয়া-য়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” এই মন্ত্রের দীক্ষায় উজ্জীবিত, এই পরিতৃপ্ত শরাবে যার দেহ মন পরিচ্ছন্ন। “হে, আল্ল্লাহ্ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার দ্বীনের ঝান্ডাকে বুলন্দ করতে যত প্রয়োজন রক্তের প্রয়োজন আমারা তা দিতে প্রস্থত। তবুও বিদ্যা চর্চার পবিত্র এ অঙ্গনে তোমার বাণী-ই বুলন্দ অবস্থায় দেখতে চাই। প্রয়োজনে আমরা সকলেই শহীদ হতে প্রস্থত।” তাইতো অগ্নিবাণ বিদ্যুৎ পুরুষ এক চমক ঝলসে উঠে বললেন দেখা যাক আল্লাহ পাক কী করেন? শুধু কি তাই? নির্ভীক চিত্তে গিয়ে বসলেন পড়ার টেবিলে।
হ্যাঁ, পড়ায় মগ্ন তিনি। এম এস সি পরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষা-ই তার জীবনের শেষ পরীক্ষা, হয়তো তখনো জানতেন না তিনি। পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে ফিরে যাবে গ্রামের বাড়িতে, ভালো কিছু একটা করে হাসি ফুটাবেন পিতামাতার পরিশ্রমক্লান- মুখে। দেশের জন্য কিছু একটা করবেন, জাতির জন্য কিছু একটা করবেন, এই যার প্রাত্যহিক বাসনা, তার মতো একজন মুসলিম যুবকের কাছে জাতির অনেক কামনা, অনেক প্রাপ্তি-ই আছে। তবে তা কি করে সম্ভব? অল্পক্ষণ পরেই খুনের উন্মত্ততায় হঠাৎ দরজায় লাথি।
সরলপ্রাণ খোদাভক্ত হৃদয় পড়ে ফেললেন “আশহাদু আল্ল্লা লা ইলাহা ইল্ল্লাল্ল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।” তারপর?
তারপর ঘটল কিছুক্ষণের মধ্যেই পৈশাচিক পাশবিকতা নিরীহ আসলামের ওপর। লাথি, কিল, ঘুষি, রামদা, কিরিচ, চাইনিজ কুড়াল, আর হকিষ্টিকের মত আঘাত। ঝাঁঝরা হলো জান্নাতী হৃদয়, খন্ড বিখন্ড হলো নিষ্পাপ কলিজার টুকরা তাঁর, কম্পিত হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যিালয়ের ক্যাম্পাস, আকাশ-বাতাস তুললো তুফান-টাইফুন, ক্রন্দন রোলে প্রকম্পিত হলো মতিহার চত্বর, প্রকম্পিত হলো আল্লাহ্ পাকের আরশে আজিম। সারা বাংলাদেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ জনতা তুললো প্রতিবাদের সাইমুম। সবার মুখে মুখে একই প্রশ্ন আজ কেন এ নারকীয় তান্ডব? কেন রক্ত স্রোত? কোন অপরাধে নব্য জাহেলিয়াতীর ধ্বজাধারী তথাকথিত ছাত্রমৈত্রী নামধারী রক্ত পিপাসু হায়েনারা কেড়ে নিল শহীদ আসলাম হোসাইনকে? কোন অপরাধে শ্রদ্ধেয়া জননী আঞ্জুমান আরা’র কোল খালি হল? কেন আজ পন্ড হলো ডাক্তার জিন্নাত আলী সাহেবের রক্ত ঝরা শ্রম? তিনি কি তাঁর প্রিয় পুত্রের কফিন জড়ানো লাশ পাবার আশায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগান দিয়েছিলন? তাঁদের আহাজারী আজ কে শুনবে? কে দেবে তাঁদের অশ্রুসিক্ত বিগলিত চোখের মৌন প্রশ্নের উত্তর?
দিনটি ছিল ১৯৮৮’র ১৭ নভেম্বর। পবিত্র রবিউল আওয়ালের পোস্টার ছেঁড়ার জের, অবশেষে আসলামের রক্ত পান, সেই সব তথাকথিত পাশ্চাত্যের দালাল ঘাতক নরপশুদের কাছে প্রশ্ন- তোমাদের রক্ত নেশা নিবারিত হয়েছে কি? পবিত্র মাহে রবিউল আওয়ালের পোস্টার ছিঁড়ে আসলামের মতো সুরভী পুষ্পদের হত্যা করে তোমাদের উদ্দেশ্য স্বার্থক হয়েছে তো? বিদেশী প্রভুরা খুশীতো! না কি আরো রক্তের প্রয়োজন? জবাব দাও। তোমরা কি আজও পেরেছ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসলামের মত ১৪টি গোলাপকে হত্যা করে এ কাফেলার অগ্রযাত্রাকে স-ব্ধ করতে? শুধু তাই নয় সারা বাংলাদেশ থেকে ১১৮ জন নিরীহ ছাত্রের রক্ত পান করে, ১১৮ জন পিতা-মাতার কোল শূন্য করে, বাংলার আকাশ বাতাসে মৌলবাদ উৎখাতের ঝড় তুলে বাংলাদেশ থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উৎখাত করতে পারবে কি ভবিষ্যতে কোন দিন? না- অসম্ভব। কখনোই না, কষ্মিন কালেও না।
আল্লাহ পাকের যাতের শপথ কোনদিনও পারবে না। তোমরা শুধু কেন? যদি তোমাদের সাথে সারা বিশ্বের ধ্বজাধারী কাফির শক্তি একত্রিত হয়ে আল্লাহ পাকের জমিন থেকে তাঁর একত্ববাদের ধ্বনি, তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বনি, ইসলামী শক্তিকে মুছে দিতে চাও তবুও পারবে না ইন্শাআল্লাহ, আগেও পারেনি। নমরুদ পারেনি, ফেরাউন পারেনি, শাদ্দাদ পারেনি, আদ-সামুদ, আবরাহা, হিরাক্লিয়াস কেউ-ই পারেনি, যেমন পারেনি আবু জেহেল, উতবা, শায়বা’র দল মক্কার বুক থেকে মুহাম্মাদ (সা:) এর কণ্ঠকে স-ব্ধ করতে। তোমরাও পারবে না আল্লাহ পাকের এ জমিন থেকে তাঁর পবিত্র ইসলাম ও ইসলামী শক্তিকে উৎখাত করতে।
বরং তার বিজয় শিখায় তোমাদের মত মানবতার শত্রুরা, খোদাদ্রোহী শক্তিরা, নাসি-ক মুরতাদ-কাফিররাই পুড়ে মরবে। যদিও সাময়িকভাবে খালি কর শহীদ আসলাম হোসাইনের মতো রক্ত জবাদের, সাব্বির, আইয়ুব, হামিদ, জব্বারের মত হাজার নাইট কুইন ডেফোডিলসদের মাতৃক্রোড়। তোমরা তাদেরকে হত্যা করতে পারো, কিন্তু তাদের আদর্শকে হত্যা করতে কখনোই পারবেনা। তারা যে আদর্শের তপ্ত শপথে উজ্জীবিত। তারা যে আদর্শের প্রেরণায় অনুরোণিত, তারা যে আদর্শের দীক্ষায় দীক্ষিত সেই আদর্শকে তোমরা কোন দিনও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মুছে দিতে পারবে না, যেমন পারে না রাতের অন্ধকার, অমাবস্যার কৃষ্ণ মূর্তি প্রভা রবির উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা কিরণ রশ্মিকে ঠেকিয়ে রাখতে।
শহীদ আসলাম হোসাইনকে যারা হত্যা করলো (মৈত্রী জাসদ), যারা তাঁর মা’র বুক উজাড় করলো, পিতাকে ব্যথিত করলো, তারা কি ভেবেছে কোনদিন, তাদেরও পিতা আছে, মাতা আছে, আত্মীয়-স্বজন, ভ্রাতা-ভগ্নি আছে, স্বপ্ন আছে, আশা আছে? তোমরাও তো অধিকাংশ-ই দাবি করো নিজেদের মুসলমান বলে। যদি তাই হয়ে থাকে তবে কিছু তোমাদের প্রশ্ন করি, আর কত মাতার বুক, পিতার আশাকে হত্যা করতে চাও তোমরা? আর কত রক্ত প্রয়োজন তোমাদের? প্রয়োজন আর কত লাশের? হায়! তোমাদের কি বোধোদয় হবে না? ধিক তোমাদের যারা অস্ত্র হাতে দিয়ে খুনী বানাচ্ছে, সন্ত্রাসীর সার্টিফিকেট দিচ্ছে, রক্ত নেশায় নেশাগ্রস- বানাচ্ছে। তোমরা কি আর ফিরে আসবেনা স্বাভাবিক হয়ে? মানুষের মতো মানুষ হয়ে? মুসলিম সন্তান হয়ে? আর যদি না-ই হও তবে স্পষ্ট ঘোষণা শুনে রেখো যেই শহীদ আসলামের লাশ তোমরা ডাইনিং টেবিল থেকে নড়াতে সক্ষম হওনি সমস- শক্তি প্রয়োগ করেও, সেই শহীদের খুন ছুঁয়ে শপথ করে তোমাদের জানাতে চাই, ‘ক্ষ্যান্ত- হও! ক্ষ্যন্ত- হও! হে জ্যান- নরখাদকের দল।’ যদি তোমরা তোমাদের রক্ত নেশার উন্মত্ততা হতে, সত্যচ্যুত অন্যায়ের পথ হতে ফিরে না আস, বরং একই কর্মের আমদানী রফতানী করতে চাও তবে জেনে রেখো আল্লাহ পাকের এই জমীনে এক একটি ধুলিকণা শুষ্ক থাকা পর্যন্ত- তোমদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম, আমাদের আদর্শের সংগ্রাম চলবেই চলবে ইন্শাআল্লাহ।
কেননা যারা শহীদ আসলামের মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে শেখে, শাহাদাতকে হাতছানি দিয়ে নিজের সাথী বানাতে শেখে, খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে যারা লেলিহান অনল কুন্ডলীর মতো ঝলসে ওঠতে পারে তারা তো অজেয়, দুর্দমনীয় তাদের গতিবেগ, দরাজ তাদের দিল, লৌহ কপাট তাদের বক্ষ, নির্ভীকতা তাদের সাথী, বীরত্ব তাদের ভূষণ, বিজয় তাদের অনিবার্য, সারথী বিপ্ল্লব তাদের অলংকার, বিদ্রোহ তাদের নিত্যসঙ্গী। হ্যাঁ - ঠিক সত্যিই শহীদ আসলাম, যিনি শহীদ হয়ে আজও বেঁচে আছেন শত সহস্র মুসলিম হৃদয়ে প্রেরণা হয়ে। যিনি মরেও অমর। ন্যায়-অন্যায়ের চির অনিবার্য যুদ্ধে বিজয়ী সত্যের স্মৃতি পটে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন তিনি। যার প্রত্যয়োদ্দীপ্ত প্রেরণা চিরদিন উৎসাহ যোগাবে আমাদের, আল্লাহ পাকের রাহে সংগ্রামে লিপ্ত কোটি কোটি দৃপ্ত মুজাহিদদের। শহীদ আসলাম অন্যায়ের সাথে আপোষহীন, মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক, জাহেলিয়ার বিপক্ষে অকুতোভয় এক বীর। একে রুখার শক্তি কারো নেই। প্রয়োজনে লক্ষ লক্ষ এ বাংলার তরুণ আমরা শহীদ হয়ে হলেও “শহীদ আসলাম হোসাইনের“ প্রত্যয়োদ্দীপ্ত প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েই আগামী দিনে এদেশের এ জমিনে ইসলামী বিপ্ল্লব সফল করেই তোমাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেব, প্রতিশোধ নেব, শহীদদের বদলা নেবই নেব ইন্শাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন, আমিন।
(লেখক: আবুল ফাইয়্যাজ মোঃ আকমাল হোসেন,দ্বিতীয় বর্ষ সম্মান, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
শহীদ আসলামকে যেমন দেখেছি
১৯৮৩ সালের জুলাই মাস। ঝিকরগাছায় শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছে তংকালীন যশোর জেলার উদ্যোগে। সে বৎসরই শিবিরে আমার যোগদান। সাথী প্রার্থী হিসাবে আমি যোগদান করলাম উক্ত শিক্ষাশিবিরে। একজন নবাগতের ন্যায় আমার নিকট স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষাশিবিরের বিভিন্ন দিকগুলো বেশ ভাল লাগল।
তার প্রমাণ হিসেবে অনুষ্ঠান শেষে মন-ব্য লিখেছিলাম এ জাতীয় প্রোগ্রাম বছরে কমপক্ষে ৫টি করে হওয়া উচিৎ বলে। অবশ্য তখনও জানতাম না এটা একাধিক করা কত কঠিন, যতটা বুঝছি এখন। যাই হোক, শিক্ষা শিবিরের কর্মকান্ডগুলোর মধ্যে আমাকে বেশি ভাল লেগেছিল স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মতৎপরতা। বিশেষ করে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল একজন ব্যক্তির সতর্কতামূলক দায়িত্বানুভূতিতে।
সময়টা ছিল রমজান মাস তদুপরি গরমের দিন। সারাদিন একটানা প্রোগ্রামের পর সন্ধ্যায় ইফতার ও খাওয়ার পর বিশ্রামে গেলে রাতটা যে কিভাবে অতিবাহিত হয়ে সেহরীর সময় হাজির হয় তা সহজেই অনুমেয়। এমন অবস্থায় এক ব্যক্তিকে দেখতাম কলিংবেল হাতে করে প্রতি রুমে রুমে গিয়ে সকলকে জাগিয়ে দিত। বলত, “উঠুন” সেহরী করবেন তো।
আমি মনে করতাম এ বেচারার কি কোন বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না? শুধু আমারই নয় অনেকেই তাকে নিয়ে চিন-া করত। আর সংকল্প ব্যক্ত করত, আমাদের দেশের সমস- কর্মকর্তারা যদি এমন কর্তব্য পরায়ণ হয়ে গড়ে উঠতেন তাহলে জাতীয় জীবন হতাশায় নিপতিত হতে হত না। কৌতুহল দৃষ্টিতে এক বিরতির ফাঁকে ঐ ব্যক্তির সাথে পরিচিত হলাম। জানতে পারলাম উনি আসলাম ভাই। বাড়ি কালীগঞ্জে। শিক্ষাশিবিরে অফিস বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন।
লেখাপড়া করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গায়ের পোশাক পাজামা, পাঞ্জাবী। মুখে দাড়ী আর মিষ্টি হাসির রেখা। চেহারা আর শিক্ষালয়ের কথা বিবেচনা করে কেউ ভাবতেও পারবে না যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের বেশ ভূষা আর আচার আচরণ এমন হতে পারে। আল্লাহর বিশেষ রহমত যে তিনি অনুগ্রহ করে বিশ শতকের এ ধ্বংসম্মুখ সমাজে ইসলামী ছাত্রশিবিরের মত একটি কাফেলার আবির্ভাব ঘটিয়ে এদেশের আরো হাজারো তরুণকে সাহাবায়ে কিরামের চরিত্রের আলোকে জীবন গঠনে সুযোগ দিয়েছেন। তাই তো বলা হয় বিংশ শতাব্দীর আশির্বাদ শিবিরের আবির্ভাব।
ব্যাপক অনুপ্রেরণা আর উৎসাহের সাথে ফিরে এলাম ঝিকরগাছা থেকে নিজ আন্দোলনের ময়দান ঝিনাইদহে। সাংগঠনিক তৎপরতার সাথে সাথে দায়িত্ব পরিবর্তনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেতে লাগল। এক বৎসরের মধ্যে আমার প্রতি দায়িত্ব অর্পিত হল ঝিনাইদহ প্রশাসনিক জেলার অর্থাৎ ঝিনাইদহ সদর হরিণাকুন্ডু শৈলকুপা ও কালীগঞ্জ উপজেলার। সাংগঠনিক তৎপরতার ফাঁকে ফাঁকে হিসাব করতাম আসলাম ভাইয়ের প্রসঙ্গ যে, তিনি হয়ত এতদিন সদস্য হয়েছেন, অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছেন।
৮২’র ১১ মার্চ নরপিশাচদের পৈশাচিক হামলার শিকারে শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব, এবং জব্বার ভাইয়ের সাথে তিনিও আহত হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা তারও সেই সাথে শহীদ হওয়ার কথা ছিল। আল্লাহ তাকে সেবার কবুল করেননি। তবে তার প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকদিন। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার কারণে মসি-ষ্ক বিকৃতি দেখা দিয়েছিল। কিছুদিন তাই তিনি মানুষের কাছে “আসলাম পাগল” বনে গিয়েছিলেন। তার সে পাগলামীর ঘটনা দিয়ে আরেকটি ছোট কলেবরে বই রচনা সম্ভব। সে সময় আসলাম ভাইয়ের সামনে কোন মহিলা বেপর্দায় চলাফেরা করতে পারত না। আযান হলে তার সামনে দিয়ে নামাজ না পড়ে যেতে পারত এমন সাধ্য কার? তাই বলছিলাম এ পাগলামী তাকে ইসলামের পথ থেকে সামান্যতমও পিছাতে পারেনি বরং বেড়েছিল অস্বাভাবিক গতিতে। এখন বুঝছি তিনি সে সময় আল্লাহর জন্যই পাগল হয়েছিলেন।
৮৪’র রমজানে রওয়ানা হলাম বুঁজিডাঙ্গা মুন্দিয়াতে আসলাম ভাইয়ের প্রয়োজনে। তখন কালীগঞ্জের কাজের অবস্থা আশানুরূপ নয়। কিভাবে ভাল করা যায়, তার জন্যই গিয়েছিলাম আসলাম ভাইয়ের সন্ধানে। সবেমাত্র কয়েক দিন হল রাজশাহী থেকে এসেছেন। ৮২’র প্রতিক্রিয়ায় তিনি রোজা রাখতে পারেননি সেবার। এরপরও আমি তাকে জাপটে ধরে বললাম, ভাই বলেন কোন প্রোসেসে কাজের উন্নতি করা যায়। রাত্রে থেকে অনেক পরামর্শ হল। আসলাম ভাই নিজেই অনেক দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। দেখা গেল অল্প দিনের মধ্যেই জনশক্তির মাঝে সজীবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ তার সফল নেতৃত্বে কর্মীরা উৎসাহ পেত অনেক বেশি। আমিও কিন্তু কম খুশী হইনি। মনে মনে বলতাম আল্লাহ তুমি তার মত কিছু ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে সৃষ্টি করে দাও যাতে তোমার এ কাফেলার গতিকে আরো এগিয়ে নেয়া সহজ হয়। শহীদ আসলাম এত তাড়াতাড়ি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাবে জানলে সে সময় তাকে দিয়ে অসমাপ্ত কাজের অনেক কিছুই সারার চেষ্টা করতাম।
৮৭’র শুরুর দিকে শাখা সমূহের রিপোর্ট পেশ অধিবেশন চলছে। “এ মাসে ৩০ জন সুধী বৃদ্ধি পেয়েছে” বলল সালাম ভাই। সবাই যেন হতবাক। কিভাবে হল জানতে চাইলে উনি বললেন আসলাম ভাইসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ভাই এসেছিলেন তাদের নেতৃত্বে এক অভিযানে এতগুলো সুধী পাওয়া গেছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
’৮৮র ২৮ জুলাই পত্রিকার মারফতে জানতে পারলাম আমাদের বিতাড়িত নির্যাতিত ভাইয়েরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হলে উঠতে সক্ষম হয়েছে। আশ্চার্য কম হলাম না। কেন না দীর্ঘদিন যাবৎ সেখানে যারা রাম রাজত্ব মনে করে আয়েশেই দিনাতিপাত করছিল আর শিবিরের নিরীহ ভাইদেরকে অস্ত্রের জোরে কোণঠাসা করে রেখেছিল। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে তারা হলে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে কি হবে? প্রশাসন হল ভ্যাকেন্ট করায় সবাই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। আসলাম ভাইও এই মুহূর্তে বাড়িতে পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তার সাথী ভাইদের সাথে দেখা না করে যেতে পারেননি। তাই আমাদের মেসে এসেছেন ঝিনাইদহে। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অনেক কিছুই জানলাম উনার কাছ থেকে।
আমি সাংগঠনিক সফরে গিয়েছিলাম হরিণাকুন্ডে। নভেম্বর ১৮ তারিখে সকালে দ্রুত ফিরে আসছি ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে। অফিসের সামনে পৌঁছাতেই সাবেক সাথী নজরুল ভাই গাড়ি থামিয়ে আমাকে বললেন রাজশাহীর খবর শুনেছেন? গত রাতের সংঘর্ষে আমাদের প্রিয় আসলাম ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। ঢাকা থেকে টেলিফোন এসেছে। আপনাকে এখনই লোকজনসহ রাজশাহী যেতে হবে ডেড বডি আনার জন্য...
সবাইকে জানাযার প্রতীক্ষায় থাকতে বলে ছুটলাম আমি আর শহীদের ভগ্নীপতিসহ চারজন। অধিকাংশ পথই আমাদেরকে দাঁড়িয়েই যেতে হল সীটের অভাবে। বেলা ১০ টায় রওয়ানা দিয়ে পৌঁছলাম রাত ৮ টার দিকে রাজশাহীতে।
বিনোদপুর কড়া প্রহরাধীন পুলিশ। এ ছাড়া সারা শহরেই ভীতি ভীতি ভাব। সবার মুখে একই কথা। ছেলে মানুষ বানাবার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে যদি লাশ হিসাবে পাওয়া যায় তাহলে কি লাভ? ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস থেকে নেমে রিক্সায় চেপে বসলাম। রিক্সাওয়ালা জামায়াত অফিসে আমাদেরকে নামিয়ে দিল। থানায় গিয়েই শুনলাম এইমাত্র সবাই বেরিয়ে গেছে শিবির অফিসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম শিবির অফিসে। দেখলাম জানাযার প্রস্থতি চলছে। আর শত শত শিবির কর্মীদের ভীড়। তারা এক নজর দেখতে চায় তাদের প্রিয় আসলাম ভাইকে, গত দু’দিন আগেও যারা তার সাথে দাওয়াতী গ্রুপে গিয়েছিল। যারা নামাজ পড়ে ছিল তার ইমামতিতে আর মুনাজাত শুনেছিল “হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে শাহাদতের মৃত্যুই দান কর।”
হাজার হাজার ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে দুই শহীদের নামাজে জানাযা শেষ হল। মুনাজাতে কাফেলার সৈনিকরা আল্লাহর নিকট ডুকরে কেঁদে আরেকবার শপথ গ্রহণ করল ইসলামী বিপ্ল্লবের মাধ্যমেই খুনীদের প্রতিশোধ নিতে হবে। নামাজ ও প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে রাত ১১ টায় রওয়ানা হলাম শহীদের কফিন নিয়ে ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে। সাথে আছে খুন ঝরা ময়দান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবির নেতা ভাই আব্দুল লতিফ। ছুটে চলেছি পুলিশের ভ্যানে, ছুটছি আর চিন-া করছি অনেক স্বপ্নের নীড় এ আসলামকে তার মাতা-পিতার বুকে লাশ হিসাবে কিভাবে দেবো?
ফজরের নামাজ কালীগঞ্জে পড়লাম। বেলা উঠতে উঠতেই পৌঁছুলাম তার পৈত্রিক জন্মভূমি বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়াতে। ততক্ষণে আত্মীয়বর্গসহ শত শত জনতার ভীড় জমে গেছে। গাড়ি রাখার সাথে সাথে সৃষ্টি হল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। শহীদের মাতা-পিতা, ভাই-বোন সবাই পাগলের মত বার বার মূর্ছা হয়ে পড়ছিলেন। বুঝানোর কোন পরিবেশ নেই ঝিনাইদহে ও মুন্দিয়াতে দু’জায়গায় জানাযা করার সিদ্ধান- নেয়া হয়েছে। উভয় স্থানেই হাজার হাজার ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে শহীদ আসলামের নামাজে জানাযা সমাপ্ত হলো। শহীদী ঈদগাহের অসংখ্য উত্তরসুরীর প্রিয় ভাই আসলাম আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে জান্নাতি সুধা পান করবেন বলে। আসলাম ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু যে স্বপ্ন তিনি বাস-বে পেতে চেয়েছিলেন সেই সাধের ইসলামী সমাজ আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন প্রয়োজন শহীদের পথ ধরে দৃঢ়চিত্তে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যাওয়া। আসুক ঝঞ্ঝা আর অত্যাচারের স্টিম রোলার, শাহাদাতের নেশায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে।
(লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল হাই,সাবেক সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ও কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য)
অসত্যের দাপট ক্ষণস্থায়ী আর সত্যের দাপট চিরস্থায়ী - হযরত সুলাইমান (আ:)
**********
"শহীদ আসলাম হুসাইনের ২৫তম শাহাদাত বার্ষিকী পালিত
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) সংবাদদাতা : ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য শহীদ আসলাম হুসাইনের ২৫তম শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবির ঝিনাইদহ জেলা শাখা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল গত রোববার সকালে শহীদের নিজ বাসভবন ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামে কোরআন খানি, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সভাপতি শেখ শাহজালাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঝিনাইদহ শহর শাখার সভাপতি ইবনুল ইসলাম পারভেজ (পরবর্তিতে শহীদ), কালীগঞ্জ পৌর সাথী শাখার সভাপতি হাফেজ শাহজাহান আলী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কালীগঞ্জ থানা আমীর মাওলানা ওলিউর রহমান, থানা সেক্রেটারি মাওলানা শহিদুজ্জামান প্রমুখ। শহীদ আসলাম হুসাইনের শাহাদাতবার্ষিকী আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, শহীদ আসলাম হুসাইন ইসলামী আন্দোলনের জন্য প্রেরণা। শাহাদাতের রক্ত যত ঝরবে ইসলামী আন্দোলনের জন্য ময়দান তত উর্বর হবে। হত্যা করে জেল খাটিয়ে হুমকি দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর ছাত্র মৈত্রির নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের অতর্কিত হামলায় তিনি শহীদ হন। সে সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি (ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা) পরীক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামের ডাঃ জিন্নাত আলীর বড় ছেলে।"
0 comments: