মহাপ্রলয় : পর্ব-০১

কেয়ামতের নিদর্শনাবলী নিয়ে আলোচনা-গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

মানুষ যত কথা বলে, যত কাজ করে, সবের পেছনেই নির্দিষ্ট একটা ফলাফল বা লাভ আশা করে। কেয়ামতের নিদর্শনাবলী নিয়ে আলোচনা-গবেষণা এবং এ বিষয়ে অবগত হয়ে দৈনন্দিন জীবনে আমরা কি লাভ আশা করতে পারি ? নাকি তা শুধু সাধারণ জ্ঞান-ভাণ্ডারে যৎসামান্য সংযোজন বৈ কিছু নয়!!
উত্তরঃ কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর বিবরণ কোরআন-হাদিসের পাতায় পাতায় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর জ্ঞান থাকলে সবার জীবনে বহুবিধ কল্যাণ নিহিত হবে।

যেমন,
১। অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ়করণ, যা ঈমানের ছয়টি মৌলিক বিষয়ের অন্যতম। আল্লাহ পাক বলেন- “আর যারা অদৃশ্যের বিষয়াবলীতে পূর্ণ বিশ্বাস রেখে নামায কায়েম করবে...” (সূরা বাকারা)
হযরত আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করতে আমি আদিষ্ট, যতক্ষণ না তারা -“আল্লাহ ব্যতিত কোন প্রভূ নেই”- সাক্ষ্য প্রদান করে, আমার এবং আমার আনীত বিষয়ে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা যদি তা মেনে নেয়, তবে নিজেদের রক্ত ও আসবাবকে তারা নিরাপদ করে নিল। তবে বিশেষ কোন বিধানে নিরাপত্তা ব্যাহত হতে পারে, আল্লাহর দরবারেই সে এর হিসাব দেবে।”-” (বুখারী-মুসলিম)
অদৃশ্যের প্রতি ঈমান বলতে -আল্লাহ পাক ও তাঁর নবী কর্তৃক যত বিষয় বর্ণিত হয়েছে, পরস্পর বর্ণনাসূত্রে তা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, -এসবই আমরা মহাসত্য বলে বিশ্বাস করব, পূর্ণ সত্যায়ন করব।
অদৃশ্য বিষয়াদির মধ্যে -কেয়ামতের নিদর্শনাবলী অন্যতম। যেমন, দাজ্জাল আবির্ভাব, মরিয়ম-তনয় ঈসা আ.-র পৃথিবীতে প্রত্যাগমন, ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব, অদ্ভুত প্রাণীর আত্মপ্রকাশ, পশ্চিম দিগন্তে প্রভাতের সূর্যোদয়.. -এরকম আরো যা কিছু বিশুদ্ধ বর্ণনা-সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
২। কেয়ামতের নিদর্শনাবলী জ্ঞানে মুসলমানদের জন্য নিম্নোক্ত কল্যাণসমূহ অর্জিত হবে ইনশাল্লাহ..!!
o নিজেকে আল্লাহর এবাদতে লিপ্তকরণে বিপুল উৎসাহ পাবে।
o বিচার দিবসের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণে মনোনিবেশ করবে।
o বিস্মৃত ব্যক্তিদেরকে সতর্ক ও তড়িৎ তওবার তাগিদ দেবে।
কেয়ামতের নিদর্শনাবলী জেনে -নবী করীম সা. এবং সাহাবায়ে কেরাম তাই করেছিলেন। সহীহাইন (বুখারী-মুসলিম)-এ বর্ণিত, একদা নবী করীম সা. হঠাৎ রাতে জেগে উঠে বলতে লাগলেনঃ “ধিক আরব্য জাতির! তাদের অকল্যাণ কাছিয়ে গেছে। ইয়াজূজ-মাজূজের প্রাচীর নির্দিষ্ট পরিমাণ উন্মুক্ত হয়ে গেছে...।”-” অন্য বর্ণনায় ““-“ঘরণীদেরকে নামাযের জন্য জাগিয়ে দাও! জেনে রেখো! দুনিয়ার জীবনে বহু বিলাসী রমণী আখেরাতে নগ্ন-উলঙ্গ থাকবে।-”
৩। এর উপর অনেক শরয়ী বিধি-বিধান নির্ভরশীল।
দাজ্জাল আবির্ভাবের প্রথম দিন এক বৎসর, দ্বিতীয় দিন এক মাস, তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের ন্যায় দীর্ঘ হবে। হাদিসটি শুনার পর সাহাবায়ে কেরাম এ অস্বাভাবিক দিনগুলোতে নামায পড়ার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ -হে আল্লাহর রাসূল! দীর্ঘ এই দিনগুলোতে একদিনের নামায কি যথেষ্ট হবে?! নবীজী বলেছিলেনঃ “না! তখন নামাযের জন্য তোমরা সময় ঠিক করে নিও! (অর্থাৎ দীর্ঘ এক বৎসরের দিনে পূর্ণ এক বৎসরের নামায-ই আদায় করতে হবে। তবে এর জন্য সূচী ঠিক করে নেয়া আমাদের দায়িত্ব)।
রাত এবং দিন একসাথে চলতে থাকে -এমন দেশে নামায আদায়ের বিধানটি এখান থেকেই আমরা আবিস্কার করলাম।
৪। কেয়ামতের নিদর্শনাবলী বর্ণনায় নবীজীর সততা-র পরিচয় উদ্ভাসিত হয়েছে। কারণ, অদৃশ্যের বিষয়াবলী নিয়ে কথা বলা -কোন ধারণাপ্রসূত বা খেয়ালী-পনা বিষয় নয়। এতেই তাঁর সততা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য নবী হওয়ার বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়েছে। কারণ, অদৃশ্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহই জানেন। আল্লাহ পাক বলেন- “তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। পরন্ত তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না -তাঁর মনোনীত রসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন।-” (সূরা জ্বীন-২৬)
৫। কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর জ্ঞান থাকলেই -শরয়ী বিষয়ে আমরা নিরেট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব। দাজ্জালের আবির্ভাব সম্পর্কে সবিস্তার বিশ্লেষণ, দাজ্জালের চোখের বিবরণ, দাজ্জালের কপালের বিবরণ, দাজ্জালের আনীত অলৌকিক বিষয়াবলীর বিবরণ। দেখা মাত্রই ফেতনায় না পড়ে প্রকৃত পরিচয়ের জ্ঞান... ইত্যাদি, জানতে পারব।
৬। আকস্মিক কোন কিছুর সম্মুখীন হওয়ার আগেই ভবিষ্যতে সংঘটিত বিষয়াবলীর জন্য মানসিক প্রস্তুতি।
৭। মুসলমানদের জন্য প্রত্যাশা-র দ্বার উন্মোচন। কারণ, কেয়ামতের সন্নিকটে ইহুদ-খৃষ্ট ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে ইসলাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেবে।
৮। জনমনে ভবিষ্যতের বিষয়াবলী নিয়ে কৌতুহলের চিরসমাপ্তি। ইসলাম একদিকে সকল মিথ্যাবাদী, অপপ্রচারক, জ্যোতিষী, গণক-দাজ্জালদের দোয়ার বন্ধ করেছে, অপরদিকে ভবিষ্যতের বিষয়াবলীকে সবিস্তারে বর্ণনা করে সংশয়ের শঙ্কা চিরতরে নিঃশেষ করেছে।
৯। কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস -মুসলমানদের ঈমানকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করতে থাকে। কারণ, নিদর্শনাবলী একের পর এক ঘটতে থাকা ইসলাম ধর্ম চিরন্তন সত্য হওয়া প্রমাণ করে।


***
কেয়ামতের নিদর্শনাবলী
গবেষণা-র কতিপয় মূলনীতি
পূর্ব ও পরবর্তী উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করে গেছেন, অজস্র গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এখন পর্যন্ত গ্রন্থাদী প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন নতুন তথ্য বের হয়ে আসছে। রেডিও টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের মত প্রচার মাধ্যমে সময়ে সময়ে এ নিয়ে আলোচনা-গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়... কতিপয় নামধারী আলেম এ বিষয়ে ভুল ও সংশয়যুক্ত তথ্য প্রচার করছেন বলে শুনা যাচ্ছে।
শুরুতেই তাই আমরা কেয়ামতের আলামত নিয়ে গবেষণার কতিপয় মূলনীতি তুলে ধরছিঃ
১। প্রামাণ্য স্বরূপ একমাত্র কোরআন হাদিসকেই বেছে নিতে হবে।
কারণ, এ জাতিয় সকল কিছুই অদৃশ্য বিষয়াবলীর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ পাক বলেন- “বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে কেউ গায়বের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে।” (সূরা নামল-৬৫)
অন্যত্র বলেন- “তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। পরন্ত তিনি অদৃশ্য বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না -তাঁর মনোনীত রসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন।” (সূরা জ্বীন-২৬)
একমাত্র দ্বীনী কল্যাণেই আল্লাহ পাক অদৃশ্যের কিছু জ্ঞান তাঁর প্রিয় নবীকে জানিয়েছিলেন। তন্মধ্যে কেয়ামতের নিদর্শনাবলী অন্যতম।
সুতরাং ইসরায়েলী বিকৃত বর্ণনা বা কোন স্বপ্নের উপর নির্ভর করে কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর ব্যাখ্যা দেয়া বা কোন ঐশী প্রমাণ ব্যতীত রাজনৈতিক দুর্ঘটনাসমূহকে কেয়ামত ঘনিয়ে আসার আলামত মনে করা একেবারেই সঠিক নয়।
পাশাপাশি প্রামাণ্য হাদিসটিও বিশুদ্ধ বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হতে হবে -সরাসরি নবী করীম সা. থেকে হোক বা তাঁর কোন সাহাবী থেকে।
বর্তমানে বিষয়টিকে উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি এবং বাণিজ্যিক সফলতা লাভের উপকরণ বানিয়ে নেয়া হয়েছে। দুর্বল ও দুর্লভ আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষনের অপচেষ্টা চলছে। তুর্কী ইস্তাম্বুলের -দারুল কুতুব আল ইসলামিয়া- লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত তৃতীয় শতাব্দীর একটি হস্তলিখিত গ্রন্থে এমন-ই এক দুর্লভ বর্ণনা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিলঃ
আবূ হুরায়রা, ইবনে আব্বাস এবং আলী বিন আবি তালিব রা. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অন্য বর্ণনায়- আবূ হুরায়রা হাদিসটি বর্ণনা করতে ভয় পাচ্ছিলেন, কিন্তু মৃত্যু-র কিছু পূর্বে -“জ্ঞান গোপন-”এর ভয়ে উপস্থিত লোকদের কাছে হাদিসটি বর্ণনা করেছেনঃ তিনি বলেনঃ “শেষ জমানায় যে সকল মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে -সে সম্পর্কে আমি ভাল করেই জানি।” লোকেরা বললঃ আপনি বলুন, ভয়ের কিছু নেই, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন। তিনি বলতে লাগলেনঃ “১৩০৫ বা ১৩০৬ হিজরী সনে -নাসের নামে এক ব্যক্তি মিসরের শাসনকর্তা হবে। লোকেরা তাকে ‘আরব্য-বীর’ বলে সম্বোধন করবে। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে বিভিন্ন যুদ্ধে লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন। কস্মিনকালে-ও সে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবে না। অবশেষে আল্লাহ সর্বোত্তম মাসে মিসর তার করায়ত্বে দিবেন। অতঃপর মিসর অধিবাসী -“সাদা যার পিতা -আনোয়ার-” সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আক্রান্ত শহরের বিনিময়ে মসজিদে আকসা হরণকারীদের সাথে সে চুক্তিবদ্ধ হবে।
তখন শামের ইরাকে এক অহংকারী প্রতাপী ব্যক্তির আবির্ভাব হবে, সে-ই সুফয়ানী। এক চোখে কিছু ত্রুটি থাকবে। নাম হবে সাদ্দাম। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি সে সংঘাতপরায়ণ হবে। পুরো বিশ্ব তার বিরুদ্ধে -কুতে- (কুয়েতে) একত্রিত হবে। বীরদর্পে সেখানে সে প্রবেশ করবে। ইসলাম ছাড়া সূফিয়ানীর মধ্যে কোন কল্যাণ থাকবে না। ভালমন্দের সংমিশ্রণ থাকবে তার স্বভাবে। -মাহদী-র বিশ্বাসঘাতকের প্রতি আল্লাহর শত অভিশাপ...।
১৪০২ বা ১৪০৩ হিজরী সনে প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হবে। গোটা বিশ্বের সাথে তিনি যুদ্ধ করবেন। তাঁর বিরুদ্ধে সকল ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুনাফিক জেরুজালেমের (বাইতুল মাকদিস) মাজদূন পর্বতের পাদদেশে একত্রিত হয়ে যাবে। ইমাম মাহদীর বিরুদ্ধে পৃথিবীর নিকৃষ্ট ব্যভিচারিণী বের হবে, যার নাম ‘আমেরিকা’। বিশ্ব তখন ভ্রষ্টতা এবং কুফুরীর অতল গহবরে নিমজ্জিত থাকবে। ইহুদী সম্প্রদায় তখন বিশ্বের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন থাকবে। জেরুজালেম এবং পবিত্র ভূমি তাদের দখলে থাকবে। সকল দেশ-ই তখন সমুদ্র এবং আকাশপথে (আগ্রাসণে) আসবে। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও প্রচণ্ড গরমের দু-টি দেশ তাদের অধিকারে থাকবে না। ইমাম মাহদী দেখবেন- সারাবিশ্ব ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আল্লাহ পাক-ও কৌশল অবলম্বন করবেন। ইমাম মাহদীর বিশ্বাস থাকবে- বিশ্বের সকল কিছু-ই আল্লাহর। আল্লাহর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। অতঃপর আল্লাহ পাক মাহদীর বাহিনীকে সাহায্য করবেন। কাফেরদের উপর আকাশ ও ভূমিকে সংকীর্ণ করে দেবেন। সেদিন বিশ্ব প্রতিটি কাফেরকে ধিক্কার জানাবে। এভাবেই আল্লাহ পাক কুফুরীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।”
এ ধরনের দুর্বল, দুর্লভ এবং অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা -প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
২। নির্ভরযোগ্য ও সু-প্রসিদ্ধ সত্যনিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত-ই এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হবে।
কারো অন্তরে যদি এ ব্যাপারে কিছু উদয় হয়, তবে অন্যকে জানানোর পূর্বে নির্ভরযোগ্য কোন আলেমের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী মনে করতে হবে। আল্লাহ পাক বলেন- “অতএব তোমরা যদি না জান তবে যারা স্মরণ রাখে, তাদেরকে জিজ্ঞেস কর!” (সূরা আম্বিয়া-৭)
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন- “আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রসূল পর্যন্ত কিংবা তাদের শাসকদের পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেত সে-সব বিষয়, যা তাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মত। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কতিপয় লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত!” (সূরা নিসা-৮৩)
কেয়ামতের নিদর্শন চিহ্নিতকরণে এটাই ছিল পূর্ববর্তীদের মূলনীতি। আবূ তুফায়েল রা. বলেন- “একদা আমি কূফায় ছিলাম। সংবাদ এলো- দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেছে। আমি তখন দ্রুত হুযায়ফা রা.-এর কাছে এসে বিষয়টি সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, চুপ করে এখানে বস! ততক্ষণে কূফার একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও এসে একই সংবাদ শুনাল। হুযায়ফা রা. তাকেও চুপ করে বসতে বললেন। ঠিক তখন-ই ঘোষণা ভেসে এলো- “সংবাদটি মিথ্যা!” আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম- হে আবু ছুরাইহা! অবশ্যই আপনি -গুরুত্বপূর্ণ কিছু শুনাবেন বলেই আমাদের বসিয়েছেন। বলুন! তিনি বলতে লাগলেন- দাজ্জাল এখন-ই যদি আত্মপ্রকাশ করে, তবে শিশুরা-ই তাকে পাথর মেরে হত্যা করে দেবে। অবশ্যই দাজ্জাল -মারামারি হানাহানি, দ্বীন নিয়ে অবহেলা এবং হত্যা-রাহাজানি-র কালে আত্মপ্রকাশ করবে। প্রতিটি শহর-বন্দরে সে উপস্থিত হবে। ছাগলের চামড়ার মত পুরো বিশ্বকে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
৩। জন সাধারণের বিবেক বুঝে হাদিস বর্ণনা করা।
কতিপয় প্রবক্তা কেয়ামতের নিদর্শনাবলী নিয়ে সর্বসাধারণের সামনে বিশদ আলোচনা শুরু করে দেয়, যা অনেক সময় মানুষের বিবেক -বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারে না। জানলেই যে বলতে হবে -এমন তো কোন কথা নেই। সঠিক হলেই যে প্রচারাভিযানে নেমে যাবে -বুদ্ধিমানের কাজ নয়। হয়ত বিবেক অনেক সময় অপারগ হয়ে যায় বা স্থানভেদে প্রচার করলে ফেতনার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। নবী করীম সা. বলেছেন- “মানুষ যা ভাল মনে করে (যা তাদের জন্য সহজবোধ্য হয়), তাই তাদের কাছে বর্ণনা কর। অন্যথায় -তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যারোপ করুক তোমরা কি তা চাও..?!” (বুখারী)
ইবনে মাসঊদ রা. বলেন- “বিবেকবিরোদ্ধ কোন কথা প্রকাশ করলেই জাতির মাঝে ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে। (অতএব তোমরা তা করো না।)” (মুসলিম)

কেয়ামতের নিদর্শন-সম্বলিত ঘটনাগুলোকে যেভাবে বাস্তবের সাথে মেলাবো

বিগত এবং সম্প্রতি কালে কেয়ামতের নিদর্শন-সম্বলিত বাণীগুলোকে জোরপূর্বক প্রেক্ষাপটের সাথে মেলানোর অপচেষ্টা প্রত্যক্ষ করা গেছে। যার সরল নমুনা সবেমাত্র আমরা পড়ে এলাম। মূল বিষয়ে আলোচনার পূর্বে এ বিষয়ে তাই কতিপয় মূলনীতি স্মরণ না করালেই নয়ঃ
প্রথম মূলনীতিঃ আবশ্যকীয় নয় যে, কেয়ামতের নিদর্শন-সম্বলিত বাণীকে টেনে এনে বাস্তবের সাথে মেলাতে হবে।
মানুষ তার সামনে পিছনে যা কিছু-ই প্রত্যক্ষ করে, ছোট হলেও সেটাকে-ই সে বড় মনে করে বসে। যদিও পেছনে এর চেয়ে-ও বড় ঘটনা গত হয়েছে। এ ব্যাপারে জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ যথেষ্ট পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন, হযরত উমর রা. -নবী করীম সা.-এর সামনে শপথ করে বলতেন যে, ইবনে সাইয়াদ-ই প্রকৃত দাজ্জাল। নবী করীম সা. তার মন্তব্য খণ্ডন করেননি।
এ ক্ষেত্রে কোন জ্ঞানীর ইজতেহাদ যদি মুসলিম জনসাধারণের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিন্নকরণে উস্কিয়ে দেয় অথবা এর পেছনে কোন শরয়ী ব্যাখ্যা থাকে, যা অধিকতর ব্যাখ্যার দাবী রাখে, তবে সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতীত মানুষকে তা প্রচার থেকে বিরত রাখতে হবে।
কতিপয় গবেষক কেয়ামতের নিদর্শন-সম্বলিত বাণীগুলোকে অতীত-বর্তমানের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছেন। একটি বিশুদ্ধ হাদিসে আপনি পড়ে থাকবেন যে -“অচিরেই এমন সময় আসবে যখন ইরাকবাসীর কাছে কোন টাকা-পয়সা ও খাদ্যদ্রব্য আমদানী বন্ধ হয়ে যাবে-” (মুসলিম)। হাদিসটির ব্যাখ্যায় অনেকে বলে থাকেন যে, ১৪১০ হিজরী (১৯৯০ সনে) আমেরিকার (অনারব) পক্ষ থেকে ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ-কালে এর বাস্তবায়ন ঘটেছে। সুতরাং এটাই কেয়ামত ঘনিয়ে আসার বড় আলামত-।
ব্যাখ্যাটি যদিও ফেলে দেয়ার মত নয়; অনেকাংশে তা সে সম্ভাবনার-ই দাবী রাখে, তবু-ও জোরপূর্বক টেনে এনে প্রচণ্ড দৃঢ়তার সাথে কোন ঘটনাকে চিহ্নিত করে দেয়া -জ্ঞানীর পরিচয় নয়।
এত্থেকে-ও বড় আশ্চর্যের বিষয়- যা বিশিষ্ট জ্ঞানীদের বরাতে প্রচারিত হয়েছে যে, দুনিয়ার অবশিষ্ট আয়ূ হচ্ছে ৯০০ বছর। আবার কেউ কেউ বলেছেন- ১০০০ বছর। কতিপয় হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা উক্ত মতামত পেশ করেছেন, যাদের মধ্যে ইমাম সুয়ূতী এবং ইমাম সাখাভী রহ. অন্যতম।
যাইহোক, শরয়ী কোন সুস্পষ্ট‘ প্রমাণ ছাড়া দৃঢ়ভাবে কোনক্রমেই বলা ঠিক নয় যে, ঘটনাটি অমুক সময়ে ঘটেছে। ইমাম মাহদীর সুসংবাদ-সম্বলিত হাদিসগুলোকে-ও অনেকেই নির্ধারিত কিছু ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করে প্রচার করেছেন যে, অমুক ব্যক্তি-ই ইমাম মাহদী ছিল এবং তার সময়ে অমুক অমুক ফেতনা প্রকাশ হয়েছিল, রক্তপাত ঘটেছিল...ইত্যাদি!!
অপপ্রচারের নমুনাঃ
“আছরারে ছাআ-” গ্রন্থকার (ফাহাদ ছালেম) লিখেছেন- “ইমাম মাহদী প্রকাশের পূর্বে -দাজ্জাল ইরানের শাসনকার্য পরিচালনা করবে।” এর পরক্ষণেই লেখেন, আয়াতুল্লাহ যরবাতশুফ-খ্যাত মুহাম্মাদ খাতামী-ই হচ্ছে সেই দাজ্জাল।-”
‘মাছীহুদ্দাজ্জাল-’ গ্রন্থকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে লিখেছেন যে, ইরাকের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইন হচ্ছে ইমাম মাহদী।
আমিন মুহাম্মদ জামাল- স্বীয় গ্রন্থ ‘-হারমাজিদ্দূন’-এ সাদ্দাম হুসেইন-কে হাদিসে উল্লেখিত ‘সূফিয়ানী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অপর ‘-‘আশরাতুছ ছাআ ওয়া হুজূমুল গারব-’ গ্রন্থকার জর্ডানের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ‘মালেক হুসেইন’কে সূফিয়ানী বলে ব্যক্ত করেছেন।
এ সব-ই ব্যক্তিগত মতামত মাত্র। কোনক্রমেই দৃঢ়তার সাথে এগুলোর প্রচার উচিত নয়। তবে যদি কোন ঘটনা হাদিসে উল্লেখিত ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে হুবহু মিলে যায়, সংশয়ের অবকাশ না থাকে, দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে যায় তবে হাদিসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তা প্রচার করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ.. স্মরণ রাখতে হবে- ভবিষ্যতে এর চেয়ে-ও বড় ঘটনা ঘটতে পারে, যা হাদিসের অর্থের সাথে আরো বেশি খাপ খেয়ে যাবে, আরো বেশি পরিস্কারভাবে ধরা পড়বে।
এর কিছু নমুনাঃ
১। মুসলিম শরীফের একটি হাদিস। আব্দুল্লাহ বিন যুবাইরের হত্যা ঘটনায় তার মাতা আসমা বিনতে আবি বকর রা. -হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সামনে বলেছিলেন- “অবশ্যই নব করীম সা. আমাদেরকে সাকীফ গোত্রে একজন মিথ্যুক এবং একজন খুনী-র আবির্ভাব হবে বলে জানিয়েছেন। মিথ্যুককে তো ইতিপূর্বেই চিনেছিলাম। খুনী-কেও আজ চিনে নিলাম।” একথা শুনার পর হাজ্জাজ কোন বাড়াবাড়ি না করে উঠে চলে গিয়েছিল। (উল্লেখ্য- হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-ই আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রা.কে হত্যা করেছিল)
ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহ. বলেন- “উপরোক্ত হাদিসে হযরত আসমা রা. মিথ্যুক বলতে ‘মুখতার বিন আবি উবাইদ সাকাফী’কে উদ্দেশ্য করেছিলেন। সে ছিল প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী। জিবরাইল আ. তার কাছে ওহী নিয়ে আসেন বলে সে দাবী করত। উলামাদের ঐক্যমতে এখানে মিথ্যুক বলতে ‘-মুখতার বিন আবি উবাইদ এবং খুনী বলতে ‘-হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উদ্দেশ্য। (আল্লাহই ভাল জানেন)
২। মুসলিম শরীফের আরেকটি বর্ণনা। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যাবৎ না হেজায ভূমি থেকে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড প্রকাশ হবে, যার আলোতে সুদূর বছরা’য় (ইরাকের) ঊষ্ট্রীর স্কন্ধ আলোকিত হয়ে উঠবে।-”
ঘটনাটি বহু-পূর্বে ঘটে গেছে। তিন মাস পর্যন্ত আগুনটি অবিরাম জ্বলছিল। মদীনা’য় সেই আগুনের আলোতে মহিলারা নৈশগল্পের আসর জমাত।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে গিয়ে আবূ শামা বলেন- “৬৫৪ হিজরী সনের ৩ জুমাদাল উখরা বুধবার দিবাগত রাতে মদীনার দিক থেকে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড ভড়কে উঠে। তিনদিন পর্যন্ত মদীনায় খানিক পর পর ভূমিকম্প অনুভূত হতে থাকে। এর পরক্ষণে -হাররা- প্রান্তরে বনূ কুরায়যা-র সন্নিকটে আরো একটি বিশাল অগ্নির সূত্রপাত ঘটে, যার আলোতে রাত্রিকালেও মদীনার সমস্ত অলিগলি আলোকিত থাকত। দেখে মনে হচ্ছিল- আগুনের এক বিশাল শহর মদীনার প্রান্ত-সীমায় এসে দাড়িয়েছে।”
ইমাম নববী রহ. বলেন-“৬৫৪ হিজরীতে মদীনার পূর্বদিকে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সকল উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত।”-”
ইবনে হাজার রহ. বলেন- “হাদিসে উল্লেখিত আগুন বলতে ৬৫৪ হিজরী সনে প্রকাশিত সেই আগুন-ই উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবী রহ.-র মত আমার-ও একই মতামত।”-”
৩। ইমাম আহমদ রহ. -আবূ হুরায়রা রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন- নবী করীম সা. বলেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফেতনাসমূহ প্রকাশ পাবে, মিথ্যা অধিক ও ব্যাপক হয়ে যাবে, দোকানপাট (মার্কেট) কাছাকাছি হয়ে যাবে, সময় দ্রুত অতিবাহিত হবে এবং প্রচুর সংঘাত সৃষ্টি হবে।” জিজ্ঞেস করা হল- সংঘাত কি? বললেন- “হত্যাযজ্ঞ”।-”
বিন বায রহ. লিখেন- “গণমাধ্যম, অত্যাধুনিক যাতায়াত-ব্যবস্থা এবং বিমান আবিস্কারের ফলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পারাপার সহজ হয়ে গেছে। এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে এখনা-র দীর্ঘ সময়ের দরকার হয় না। হাদিসে উল্লেখিত -‘দোকানপাট কাছাকাছি হয়ে যাবে’-র ব্যাখ্যা এভাবেই করা যেতে পারে।
দ্বিতীয় মূলনীতিঃ কেয়ামতের অতি সন্নিকটে-ই ঘটতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। কারণ, কেয়ামতের অনেক নিদর্শন বহু আগেই ঘটে অতিবাহিত হয়ে গেছে।
কেয়ামতের নিদর্শন বলতে ঐ সকল আলামত উদ্দেশ্য, যা মহাপ্রলয় নিকটবর্তী হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। চায় সে সকল নিদর্শন কেয়ামতের খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটুক বা বহুকাল পূর্বে ঘটুক..!!
উদাহরণস্বরূপঃ নবী করীম সা. বলেছেন- “আমার এবং কেয়ামতের মাঝে -দুই আঙ্গুলের মধ্যবর্তী স্বল্প ফাকা জায়গার ন্যায় ব্যবধান”।-” (বুখারী-মুসলিম)
বুঝা গেল- নবী করীম সা.এর আবির্ভাব এবং তাঁর মৃত্যু -কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন। তাহলে নবীজীর মৃত্যুর পর যে সকল ঘটনা ঘটবে -দূরে হোক আর কাছে হোক- সব-ই কেয়ামতের নিদর্শন বলে গণ্য হবে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম