মহাপ্রলয় : পর্ব-০৪

(২১)
সুউচ্চ বাড়ীঘর নির্মাণে নগ্নপদ নগ্নদেহ আরব্য রাখালদের প্রতিযোগিতা

নবী করীম সা. থেকে বর্ণিত কেয়ামতের ঘটিত নিদর্শনাবলীর অন্যতম হচ্ছে নগ্নপদ নগ্নদেহ রাখাল (আরব)দের বাড়ীঘর সুউচ্চ করণ প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে উচু করে বিল্ডিং নির্মাণ করতে পারে.. কে কার চেয়ে বেশি ডিজাইন/ষ্টাইল করে বাংলো বানাতে পারে..। অথচ এইতো কিছুদিন পূর্বেই তারা ছিল মেষপালের রাখাল। গায়ে ছিল না বস্ত্র, পায়ে ছিল না জুতো।
উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে -ইসলাম, ঈমান ও ইহসান সংক্রান্ত আলোচনার পর নবী করীম সা. কেয়ামতের নিদর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন- “দাসীর গর্ভ থেকে মনিবের জন্ম হবে এবং নগ্নপদ নগ্নদেহ রাখালদের -সুউচ্চ বাড়ীঘর নির্মাণে প্রতিযোগিতায় মত্ত দেখবে।-” (মুসলিম)
অপর হাদিসে- “দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত অভাবী লোকদেরকে নেতৃত্বের পদে দেখতে পেলে সেটাই হবে কেয়ামতের নিদর্শন। দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত, অভাবী, নগ্নপদ ও নগ্নদেহ রাখাল বলতে আপনি কাদের বুঝাচ্ছেন? প্রশ্নের উত্তরে নবীজী বলেন- আরব জাতি।-” (মুসনাদে আহমদ)
মানুষের উপকার ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কল-কারখানা, কোম্পানী, টাওয়ার বা কোন বিল্ডিং উচু করে নির্মাণে দুষের কিছু নেই। তবে যদি তা পরস্পর অহংকার প্রকাশ, বা বহির্বিশ্বের সামনে দেশীয় ভাবমূর্তি উজ্জল করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তবে অবশ্যই তা বৈধতার গণ্ডিতে পড়বে না।
হাদিসে বাড়ীঘর উঁচু বলতে উপরের দিকে বিল্ডিংয়ের স্তর বা তলা বৃদ্ধি করা, নিত্য নতুন কারুকার্যে সুশোভিত করা, মাত্র এক/দুই জনের জন্য বিশাল বাংলো নির্মাণ করে আসবাবপত্র বৃদ্ধি করা ইত্যাদি উদ্দেশ্য।
এ সব কিছুই ধন সম্পদ ও বিলাসিতার বর্তমান জমানায় অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে।
হাদিসে উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাহাড় পর্বত এবং সুদূর মরু প্রান্তরের রাখালেরা ছাগলের রাখালি ছেড়ে উঁচু উঁচু টাওয়ার নির্মাণে মত্ত হয়ে উঠবে। সকলেই চাইবে আমার-টা সবার চেয়ে উঁচুতে থাকুক!
বর্তমান আরব দেশগুলোতে এটা ব্যাপক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। প্রত্যেকটি দেশ-ই চাইছে, বিশ্বের সবচে’ দীর্ঘতম টাওয়ারটি তার দেশে হোক! এর জন্য যত টাকা দরকার হয়, খরচ করতে রাজী।
সম্প্রতি ১৬০ তলা বিশিষ্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ -“বুরজ আল-খলীফা-” টাওয়ারটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই-তে অবস্থিত। এদিকে সৌদি সরকার বিশ্বের সর্ববৃহৎ ৩০০ তলা বিশিষ্ট টাওয়ার নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যেই নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়েছে।
(২২)
ব্যক্তি বিশেষে সালাম প্রদান

মুসলমানদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায়ের লক্ষ্যে আল্লাহ পাক সালামের বিধান চালু করেছেন। ছোট -বড়কে সালাম দেবে, ধনী -গরিবকে সালাম দেবে, আরব -অনারবকে সালাম দেবে, সাদা -কালোকে সালাম দেবে। পরিচিত অপরিচিত সকলকেই সালাম দিবে।
নবী করীম সা. বলেন- “পরিপূর্ণ মুমিন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পরস্পরের প্রতি পূর্ণ ভালবাসা ও সম্প্রীতি পোষণ না করা পর্যন্ত তোমরা মুমিন-ও হতে পারবে না। কিভাবে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে সেই রহস্য কি তোমাদের বলব?! ‘বেশি বেশি সালাম দাও! আগে-ভাগে সালাম দাও!’ (মুসলিম)
ব্যক্তি বিশেষে সালাম প্রদান কিংবা শুধু পরিচিত বুঝে সালাম প্রদান -কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। অথচ ইসলামী বিধান হচ্ছে, পরিচিত অপরিচিত সকলকেই সালাম দিতে হবে।
আবূ জা’দ বলেন- ইবনে মাসঊদ রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ-কালে এক ব্যক্তি বলল- আস সালামু আলাইকুম হে আব্দুল্লাহ! সালাম শুনে ইবনে মাসঊদ রা. বলে উঠলেন- “নবীজী সত্য-ই বলেছেন। আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি- “কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে- মানুষ মসজিদে গমণ করবে, কিন্তু (তাহিয়্যাতুল মসজিদের) দুই রাকাত নামায আদায় করবে না এবং পরিচিত ছাড়া কাউকে সালাম দিবে না।-” (সহীহ বিন খুযাইমা)
বুখারী-মুসলিমের বর্ণনায়- এক ব্যক্তি নবীজীকে -“ইসলামের কোন কাজটি সবচে ভালো-” জিজ্ঞেস করলে নবীজী বলতে লাগলেন- “অসহায়কে খাদ্যদান এবং পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম প্রদান।-”
(২৩) (২৪) (২৫)
ব্যাপক বাণিজ্য, স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবসায় স্ত্রীর অংশগ্রহণ, সারা বাজারে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর প্রভাব

অর্থাৎ বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে। পদ্ধতি সহজ হয়ে যাওয়ায় সকল মানুষ ব্যবসায় অংশীদার হয়ে যাবে (এমএলএম পদ্ধতির কথা চিন্তা করা যায়)। এমনকি স্ত্রী-ও স্বামীর সাথে ব্যবসায় অংশগ্রহণ করবে। উভয় নিদর্শন-ই এক-ই সাথে এক-ই হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে ব্যক্তি বিশেষে সালাম দেয়া হবে, বাণিজ্য ব্যাপক হয়ে যাবে এমনকি ব্যবসায় স্ত্রী -স্বামীকে সহযোগিতা করবে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে (তাদের খোঁজখবর নেয়ার সময় থাকবে না), মিথ্যা সাক্ষ্য -মহামারীর আকার ধারণ করবে, সত্য সাক্ষ্য গুম করা হবে এবং (মৌখিক দাওয়াতের তুলনায়) লেখালেখি বেশি হতে থাকবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
আমর বিন তাগলিব রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. এরশাদ করেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর অন্যতম হচ্ছে, ধন সম্পদের ব্যাপক ছড়াছড়ি, ব্যাপক বাণিজ্য, ব্যাপক মূর্খতা -একজন অপরজনের কাছে ক্রয় বিক্রয় কালে বলবে- অমুকের সাথে বুঝাপড়া না করে লেনদেন করব না। সারা গ্রাম তালাশ করেও লেখতে জানে -এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।-” (সুনানে নাসায়ী)
হাদিসে বুঝাপড়া বলে মূলধনের অধিকারী বড় বড় ব্যবসায়ী বা আমদানী-রপ্তানী বিষয়ক তৃণমূল ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা-ই মূলত বাজারদর কন্ট্রোলে রাখবে, যদ্দরুন ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা বিনা অনুমতিতে ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
অথবা অন্য ব্যবসায়ীর সদিচ্ছার উপর ক্রয়-বিক্রয়ে শর্তারোপ থাকবে।
অপর হাদিসে- লেখালেখি অধিক হয়ে যাবে। এই হাদিসে- লেখতে জানে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, কেবল উচ্চারণে-ই অটো-লিপি হয়ে যায় -এরকম প্রযুক্তি আবিস্কারের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এমন প্রজন্ম আসবে -যারা তারা হস্তলিপি বুঝবে না বা লেখতে পারবে না -হাদিসের মাধ্যমে তা উদ্দেশ্য হতে পারে।
অথবা হালাল-ব্যবসা সংক্রান্ত বিধি-বিধান জানে এবং মানুষের মাঝে সবকিছু ন্যায়সঙ্গত ভাবে লিখে বন্টন করতে পারে -এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।
(২৬)
ব্যাপক হারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান

মামলা মোকদ্দমায় বা বিচার সালিশে সাক্ষ্যদান-কালে মিথ্যা কথা বলা মহা অপরাধ। কবীরা গুনাহের অন্যতম।
নবী করীম সা. বলেন- “সবচে বড় কবীরা গুনাহ কি- তোমাদের বলব? (এভাবে তিনবার বললেন) সাহাবায়ে কেরাম বললেন- বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! বললেন- আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, (এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলেন, এবার হেলান দিয়ে বসে বলতে লাগলেন-) এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।-” (বুখারী-মুসলিম)
শুধূ বিচারক বা জজ সাহেব বরাবর মিথ্যা বলা-ই এখানে উদ্দেশ্য নয়; সব ধরনের সাক্ষীর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে। একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যা তুহমত লাগানো। কর্মক্ষেত্রে, অফিসে, কোম্পানীতে বা সংস্থায় প্রধানের কাছে কর্মীদের ব্যাপারে মিথ্যা বলা। কলেজ, মাদ্রাসা, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের ব্যাপারে টিচারের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট দেয়া। সন্তানের ব্যাপারে পিতা বরাবর মিথ্যা বলে পাঠানো -সবই এর অন্তর্ভূক্ত।
অপর হাদিসে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং মিথ্যা শপথ করে মানুষের অধিকার হরণ থেকে কঠোর সতর্ক করা হয়েছে। নবী করীম সা. বলেন- “মিথ্যা শপথ করে যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের মাল হরণ করল -গোস্বান্বিত অবস্থায় সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে।” অতঃপর নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন- “যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মুল্যে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই। আর তাদের সাথে কেয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না।” (সূরা আলে ইমরান-৭৭) (বুখারী)
আবূ উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “মিথ্যা শপথ করে যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের সম্পদ হরণ করল, তার উপর আল্লাহ তা’লা জাহান্নামকে আবশ্যক করে দেবেন, জান্নাত থেকে বঞ্চিত করবেন।” এক ব্যক্তি বলল- সামান্য হলেও? বললেন- কাঁটা গাছের মূল্যহীন সামান্য ঢাল হরণ করলেও..!!”
(২৭)
সত্য সাক্ষ্য গোপন

আল্লাহ তা’লা প্রতিটি মুসলমানকে -জালেম বা মজলুমকে সাহায্য করার আদেশ করেছেন। জালেমকে জুলুম থেকে বারণ করতে হবে আর মজলুমকে জালেমের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অপরদিকে সত্য সাক্ষ্য গোপনকে হারাম করেছেন।
“তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে কেউ তা গোপন করবে, তার অন্তর পাপপূর্ণ হবে।” (সূরা বাকারা-২৮৩)
শেষ জমানায় মানুষ অন্যায়ভাবে একে অপরের অধিকার ভোগ করতে থাকবে। ব্যক্তি-স্বার্থ রক্ষায় জেনেও সত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবে। এটাই কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন।
(২৮)
সুশিক্ষার অভাব, মূর্খতার ব্যাপক প্রসারণ

আল্লাহ তা’লা তাঁর প্রিয়নবীকে জ্ঞান অন্বেষণের আদেশ করেছেন -“বল! হে প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন!” (সূরা ত্বাহা-১১৪) ঐশী আদেশের প্রেক্ষিতে নবী করীম সা. সবসময় শিখতেন এবং শিক্ষা দিতেন।
অপরদিকে মূর্খতা থেকে নবী করীম সা. মানুষকে বারণ করতেন -“নিশ্চয় আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন- প্রত্যেক রুক্ষ স্বভাবী, রাক্ষস, বাজারে হৈ হুল্লোড়ে অভ্যস্ত, দিনের বেলায় গাঁধা আর রাতে (আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে) মৃতের মত শয়নোম্মাদ এবং পার্থিব জ্ঞানী কিন্তু আখেরাত বিষয়ে গণ্ডমূর্খ।-” (সহীহ ইবনে হিব্বান)
সমাজে (আখেরাতের বিষয়ে) মূর্খতা ছেয়ে যাওয়াকে কেয়ামতের নিদর্শন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নবী করীম সা. বলেন- “নিশ্চয় কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে (ইসলামী) জ্ঞান উঠে যাবে এবং সর্বত্র মূর্খতা ছেয়ে যাবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
অন্যত্র বলেন- “এমন এক কাল আসবে, যখন মানুষ জানবে না -নামায কি! রোযা কি! সাদাকা কি!” (তাবারানী)
অধিকাংশ মুসলিম দেশে আজকাল মুসলমানদের জ্ঞানের পরিধি পর্যবেক্ষণ করলে দেখবেন যে, সবাই -সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানী। কিভাবে কম্পিউটার চালাতে হয়, মোবাইলের বাটন চাপতে হয়, কিভাবে গাড়ী চালাতে হয় -সবাই জানে। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করেন- الله الصمد শব্দের কি অর্থ? -বলতে পারবে না। নামাযে সহু-সেজদা -কখন, কি কারণে দেয়া লাগে -জিজ্ঞেস করলে মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।
একবার এক লোক আমাকে প্রশ্ন করল যে, নফল নামায পড়ার জন্যও কি অযু করতে হয়? নাকি অযু শুধু ফরয নামাযের জন্যই..! প্রশ্নটি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আরো আশ্চর্য হলাম- যখন জানতে পারি যে, সে ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
এছাড়াও মুসলমানদের ৯৫% মানুষই আজ বিবাহ-তালাক ও ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত নয়। অথচ সামাজিক জীবনে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অর্থনৈতিক বিষয়ে অধিক সম্পৃক্ততা, অনর্থক বিষয়ের সীমাতিরিক্ত ব্যবহার, জ্ঞানের মজলিসে তাদের নিয়মিত অনুপস্থিতি এবং কোরআন-হাদিস থেকে তাদের বিমুখ থাকাটাই এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। (আল্লাহ সবাইকে সতর্ক হওয়ার তওফীক দান করুন)
(২৯) (৩০) (৩১)
ব্যয়কুণ্ঠতা ও কার্পণ্যতা বৃদ্ধি, ব্যাপক হারে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকরণ, প্রতিবেশীর সাথে দুর্ব্যবহার
ইসলামী সমাজে ব্যয়কুণ্ঠতা ও কার্পণ্যতার মত -মানসিক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “কার্পণ্যতা অধিক হারে বেড়ে যাওয়া কেয়ামতের আলামত।-” (তাবারানী)
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “সবকিছু কঠোর হয়ে যাবে, মানুষের মধ্যে কার্পণ্যতা বেড়ে যাবে।-” (ইবনে মাজা)
অন্যত্র নবী করীম সা. বলেন- “সময় দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাবে, (আখেরাতের জন্য) মানুষের আমল কমে যাবে, অন্তরে কার্পণ্যতা সৃষ্টি হবে এবং অধিক হারে সংঘাত (হত্যাযজ্ঞ) ঘটতে থাকবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
অপর হাদিসে নবী করীম সা. এরশাদ করেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না অশ্লীলতা-বেহায়পনা বৃদ্ধি পাবে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে এবং প্রতিবেশীর সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ- যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না অশ্লীলতা ও কার্পণ্যতা বৃদ্ধি পাবে, বিশ্বস্তকে ঘাতক এবং ঘাতককে বিশ্বস্ত মনে করা হবে, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি ঘটবে। মূর্খদের জনপ্রিয়তা ও মাতব্বরী বেড়ে যাবে।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
বর্তমান মুসলিম সামাজিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে সেই দৃশ্যই আমাদের চোখে পড়ে। আত্মীয়দের খোঁজখবর নেয়ার সময় নেই। আছে না মরে গেছে- আল্লাহই ভাল জানেন। প্রতিবেশীর সাথে অবাধে দুর্ব্যবহার হচ্ছে।
(৩২)
অশ্লীলতা বেয়াহাপনা বৃদ্ধি

অশ্লীলতা বলতে মহিলারা শর্ট ড্রেস পরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করবে। কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল গালিগালাজ বেড়ে যাবে।
নবী করীম সা. একে কেয়ামতের নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন- “ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত.! কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনা বেড়ে যাবে..!”
(৩৩)
বিশ্বস্তকে ঘাতক এবং ঘাতককে বিশ্বস্ত জ্ঞান

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে- বিশ্বস্ততা উঠে যাবে, অযোগ্যদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাবে। তদ্রূপ বিশ্বস্তকে ঘাতক আর ঘাতককে বিশ্বস্ত মনে করা হবে। সন্দেহ করে বিশ্বস্তের কাছে কেউ আমানত রাখবে না। অপরদিকে ঘাতক, মিথ্যুক, কপট ও লম্পটদেরকে বিশ্বস্ত মনে করা হবে।
নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত.! কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না বিশ্বস্তকে ঘাতক আর ঘাতকে বিশ্বস্ত মনে করা হবে...।-”
(৩৪)
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি এবং মূর্খদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, সমাজ থেকে জ্ঞানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি ঘটবে। মূর্খ ও নির্বোধেরা তাদের স্থল-বর্তি হবে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ঐ সত্তার শপথ- যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত.! কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না অশ্লীলতা ও কার্পণ্যতা বৃদ্ধি পাবে, বিশ্বস্তকে ঘাতক এবং ঘাতককে বিশ্বস্ত মনে করা হবে, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি ঘটবে। মূর্খদের জনপ্রিয়তা ও মাতব্বরী বেড়ে যাবে।-”
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বা প্রচার মাধ্যমের কল্যাণকে কাজে লাগিয়ে তারা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। অপরদিকে সম্ভ্রান্ত, গুণী ও উপদেশদাতা ব্যক্তিগণ পর্দার আড়ালে থেকে যাবে, ব্যাপক অশ্লীলতার কারণে মিডিয়া থেকে তারা নিজেদের দূরে রাখবে। ফলে যারা নাচ-গান ভাল করতে পারে, দ্রুত অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে পারে -তারাই প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। উৎকৃষ্ট ও প্রতিভাধর কারোর-ই কোন চান্স থাকবে না।
নিদর্শনটি বর্তমান কালে স্বতঃসিদ্ধ ও প্রসিদ্ধ।
যদি-ও এখনো কিছু কিছু ভাল ব্যক্তিদের অবস্থান রয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশসমূহে জ্ঞানী ও দ্বীনের দায়ীদেরকে যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হচ্ছে। কুরআনের মাহফিলে যথেষ্ট লোক সমাগম হচ্ছে। ইসলামী চ্যানেলে পর্যায়ক্রমে দর্শকের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি দ্বীনী আলোচনা-অনুষ্ঠানে আজকাল অমুসলিমদের-ও ব্যাপক আনাগোনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারপরও......!!
(৩৫)
সম্পদ উপার্জনে হালাল-হারামের তোয়াক্কা বিলুপ্তি

আল্লাহর ভয় যখন অন্তর থেকে লুপ পায়, কাজ-কর্মেও তখন ধর্মীয় অনুভূতি হ্রাস পায়। ধর্মীয় অনুভূতি হ্রাস পাওয়ার ফলে শুরুতে সন্দেহে.. এরপর হারামে লিপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ধন সম্পদ উপার্জনে আর হালাল-হারামের বাছ-বিচার থাকে না। মুসলিম সমাজে আজকাল নিদর্শনটি প্রতিনিয়ত বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ সম্পদ উপার্জনে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করবে না।-” (বুখারী)
হালাল বা হারাম যে কোন উপায়েই হোক -টাকা পয়সা আমাকে কামাতে-ই হবে’ -বর্তমান কালে এটি সকলের একমাত্র জীবন-লক্ষে পরিণত হয়েছে।
এ কারণেই আজ হালাল-হারামের বাঁধন ছিড়ে গেছে। মানুষ অবৈধ চাকুরী এবং হারাম ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে গেছে। সিগারেট ব্যবসা, মদের ব্যবসা, মহিলাদের শর্ট ড্রেস বিক্রি, সুদি কারবারি, কু-কর্মীদের জন্য বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ। এগুলো-ই আজকাল অভিজাত ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অথচ আল্লাহ পাক বলেছেন- “তোমরা উত্তম বস্তু বক্ষণ কর।-”
আল্লাহ পাক হচ্ছেন পবিত্র, পবিত্র বস্তু ছাড়া তিনি কিছুই গ্রহণ করবেন না। সুদ ও হারামের টাকায় কেনা খাদ্য খেয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হলে জাহান্নাম-ই তার একমাত্র ঠিকানা হবে -এতে কোন সন্দেহ নেই।
অপরদিকে যারা হারাম এবং সন্দেহযুক্ত বস্তু থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন, তারা আজ অপরিচিত। বরং সুদ গ্রহণে অস্বীকার করতঃ হালাল পথে চলার কারণে হয়ত আজ তার চাকুরীটি-ও খোয়া গেছে। নবী করীম সা. বলেছেন- “যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকল, সে তার দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচিয়ে নিল। পক্ষান্তরে যে সন্দেহযুক্ত কাজকর্মে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল।-” (বুখারী-মুসলিম)
আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তওফীক দান করুন!!
(৩৬)
যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ জ্ঞান

মুজাহিদীন কর্তৃক বিনাযুদ্ধে (শত্রুবাহিনী পলায়ন বা আত্মসমর্পনের দরুন) অর্জিত সম্পদ বন্টনে আল্লাহ পাক নিম্নোক্ত বিধান প্রণয়ন করেছেনঃ
“আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতীমের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।” (সূরা হাশর-৭)
সম্পদ যাতে শুধু বিত্তশালীদের কাছেই সীমাবদ্ধ না থাকে এ কারণে উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক বিনাযুদ্ধে অর্জিত সম্পদের সুসম বন্টন-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে মানুষ আল্লাহর উপরোক্ত বিধানকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মানবরচিত বন্টন নীতি প্রয়োগ করবে। ফলে সম্পদ শুধু নেতৃস্থানীয় বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। গরিবদের হাতে পৌঁছবে না। হাদিসে এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(৩৭)
আমানতকে খরচের মাল জ্ঞান

আমানতের মালকে আল্লাহ পাক বিনা হস্তক্ষেপে মূল মালিকের কাছে পৌছে দেয়ার আদেশ করেছেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকের নিকট পৌছে দাও।-” (সূরা নিসা-৫৮)
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে আমানত রক্ষিত থাকবে না। কারো কাছে আমানত রাখা হলে সে তা খরচ করে ফেলবে। ফেরৎ চাইলে সামনাসামনি অস্বীকার করে দেবে। ফেরৎ দিতে অনিহা করবে।

(৩৮)
যাকাত প্রদানকে জরিমানা জ্ঞান

দরকার তো ছিল- বছর ঘুরে আসার সাথে সাথেই মানুষ স্বর্ণ ও সম্পদের যাকাত আদায়ে উঠে পড়ে লেগে যাবে। কারণ, যাকাত -সম্পদকে পবিত্র করে দেয়, যাকাত প্রদানে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়।
শেষ জমানায় ব্যয়কুণ্ঠতা বেড়ে যাওয়ার বিত্তবানরা যাকাত আদায়কে এক প্রকার চাঁদা ও জরিমানা মনে করবে। মনের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে সে যাকাত আদায় করবে। সৎ নিয়তের অভাবে আল্লাহ এরকম ব্যক্তির যাকাত কখন-ই গ্রহণ করবেন না।

(৩৯)
আল্লাহর জ্ঞান ছেড়ে পার্থিব জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ

মুসলমান হিসেবে একজন ব্যক্তির জন্য সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসলামী শিক্ষা অর্জন করা অতঃপর দ্বীন শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করা। নবী করীম সা. এরশাদ করেন- “যারা মানুষকে কল্যাণ (দ্বীনের জ্ঞান) শিক্ষা দেয়, তাদের উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন, আসমানের ফেরেশতাকুল, গর্তের পিপীলিকা এবং সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করতে থাকে।-” (তিরমিযী)
শেষ জমানায় ইসলামী শিক্ষা অবহেলার পাত্রে পরিণত হবে। সকলেই যুগোপযোগী আধুনিক জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত থাকবে। যে কয়জন কুরআন-হাদিসের জ্ঞান চর্চা করবে, তারাও আবার দুনিয়ার আশায়, টাকা কামানোর আশায়; বরং সমাজে সুনাম-সুখ্যাতি পাওয়ার আশায় করবে।

(৪০)
মায়ের অবাধ্য হয়ে স্ত্রীকে সন্তুষ্টকরণ

কেয়ামতের অন্যতম মৌলিক নিদর্শন হচ্ছে, মানুষ তার জন্মদাতা পিতা-মাতাকে ছেড়ে স্ত্রীর কথায় উঠা-বসা করবে। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মায়ের অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিটি মুসলিম পরিবার বর্তমানে এ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। অধিকাংশ সময় মা তার ছোট্ট কুঠিরে পড়ে থাকে, ছেলে পাশের রুমে থাকা সত্তেও মাকে একনজর দেখার সময় নেই। অথচ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সে মহা ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছে। পিতা-মাতা যদি চুপ থাকেন, তবে সেই অবাধ্যতা দিন দিন চরম আকার ধারণ করে। যার নমুনা আমরা প্রতিদিন পেপার-পত্রিকায় পড়ে থাকি।
দীর্ঘ হাদিসটি সামনে উল্লেখ করা হবে ইনশাল্লাহ।

(৪১)
জন্মদাতা পিতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বন্ধু বান্ধবকে কাছে আনয়ন

এটাও কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন যে, বন্ধু বান্ধবের সাথে সারাদিন বসে গল্প করবে, তাদেরকে কাছে ডাকবে। কিন্তু পিতার সাথে যে দু একটি কথা বলবে, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করবে, তার মনে প্রশান্তি দিবে, তার কাছ থেকে দোয়া নেবে- এ যেন মহা বিরক্তিকর বিষয়। বিশেষত পিতা যদি বয়োবৃদ্ধ হয়, তবে তো কোন কথা-ই নেই।
প্রতিটি সন্তানকে তার পিতার অধিকার সম্পর্কে অবগত হতে হবে। আল্লাহ তা’লা বলেন- “আর তোমরা পিতা-মাতার সহিত নম্র, ভদ্র ও সম্মানজনক আচরণ কর।”

(৪২)
মসজিদে চিল্লাচিল্লি ও ব্যাপক হৈ হুল্লোড়

মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর। সবসময় সেখানে নীরবতা ও প্রশান্তিময় পরিবেশ বিরাজ থাকা চাই। কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, মসজিদগুলোতে দুনিয়াবী কথাবার্তা, হৈ হুল্লোড় ও বাক-বিতণ্ডা বেড়ে যাবে।

(৪৩)
গোত্রীয় নেতৃত্বে পাপিষ্ঠদের আগমন

নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সর্বাধিক যোগ্য হচ্ছে জ্ঞানী, নিষ্ঠাবান ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হল- পাপিষ্ঠ-রা নেতৃত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। বংশীয় মর্যাদা, ধন সম্পদ বা এলাকায় সীমাহীন প্রতাপের দরুন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পাবে না।

(৪৪)
সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি -সমাজের নেতা

পূর্বের নিদর্শনের সাথে যথেষ্ট সামঞ্জস্য-পূর্ণ। সর্ব বিষয়ে এমন ব্যক্তিদেরকে নেতা মানবে, যারা নগণ্য ও নিকৃষ্ট স্তরের লোক। দুরবস্থা বা সমাজে নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ই এর জন্য দায়ী হবে।

(৪৫)
আক্রমণের ভয়ে সম্মান

দাঙ্গাবাজ এবং সন্ত্রাসীদের হাতে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব চলে যাবে। মনে মনে ঘৃণা করলে-ও অনিষ্টতা ও আক্রমণের ভয়ে সর্বসাধারণ তাদেরকে সম্মান ও স্যালুট করতে বাধ্য হবে।
উপরোক্ত কতিপয় নিদর্শনের বিবরণ এক হাদিসেই বর্ণিত হয়েছেঃ
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “নিম্নোক্ত নিদর্শনগুলো প্রকাশ হতে দেখলে -লাল বাতাস, ভূ-কম্পন, ভূমিধ্বস, রূপবিকৃতি, পাথর-বর্ষণ এবং ছিড়ে যাওয়া তছবীহ-র দানার মত দ্রুত একের পর এক কেয়ামতের নিদর্শন বাস্তবায়নের অপেক্ষা করঃ
(১) যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ জ্ঞান
(২) আমানতকে খরচের বস্তু জ্ঞান
(৩) যাকাতকে জরিমানা জ্ঞান
(৪) আল্লাহর জ্ঞান ছেড়ে পার্থিব জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ
(৫) মায়ের অবাধ্য হয়ে স্ত্রীকে সন্তুষ্টকরণ
(৬) পিতা-কে দূরে ঠেলে বন্ধু বান্ধবকে কাছে আনয়ন
(৭) মসজিদের ভেতর উচ্চস্বরে হৈ হুল্লোড়
(৮) গোত্রীয় নেতৃত্বে পাপিষ্ঠদের আগমন
(৯) সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিদের হাতে জাতির নেতৃত্ব
(১০) আক্রমণের ভয়ে সম্মান
(১১) হরেক রকম বাদ্য-যন্ত্র ও অশ্লীল নর্তকীদের আত্মপ্রকাশ
(১২) ব্যাপক হারে মদ্য-পান
(১৩) পরবর্তী উম্মত কর্তৃক পূর্ববর্তী উম্মতকে গালমন্দ ও অভিশাপ দান
(তিরমিযী)

(৪৬) (৪৭) (৪৮) (৪৯)
মেয়েদের সাথে মেলামেশা, রেশমী কাপড় পরিধান, মদ্য এবং গান-বাজনা বৈধ জ্ঞান

ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ নিষিদ্ধ বিষয়াবলীর মধ্যে -ভ্যবিচার, মদ্য পান, অশ্লীল নৃত্য, পুরুষদের জন্য রেশমী কাপড় পরিধান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শেষ জমানায় একদল মুসলমান এই হারাম বিষয়াবলীকে হালাল মনে করে অবাধ ব্যবহার শুরু করবে। নবী করীম সা. একে কেয়ামত ঘনিয়ে আসার নিকটতম নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন।
হালাল জ্ঞান -দু-ভাবে হতে পারেঃ
(১) মনে প্রাণে এগুলোকে হালাল মনে করা।
(২) অথবা অধিকাংশ মানুষ-ই এতে লিপ্ত হয়ে যাবে। গুনাহ করার সময় সংকোচ লাগবে না।
আবু মালেক আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যারা মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশা, রেশমী কাপড় পরিধান, মদ্য পান এবং গান-বাজনাকে হালাল মনে করবে। আরেক দল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে মেষপাল নিয়ে অবতরণ করবে, তাদের কাছে ফকির এসে সাহায্যের আবেদন করলে তারা বলবে- আগামীকাল এসো!, এসকল ব্যক্তিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিবেন, সুউচ্চ পাহাড় (ধ্বসে) তাদের উপর আপতিত হবে। অপর দলকে আল্লাহ (কেয়ামত পর্যন্তের জন্য) শুকর-বানরের আকৃতিতে পরিবর্তন করে দেবেন।-” (বুখারী)
অনেক মুসলিম দেশে আজ ভ্যবিচার ও মদ্য-পান রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারী অনুমোদন নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় বেশ্যা-পাড়া গড়ে উঠেছে। হোটেলগুলোতে সুন্দরী নারীদের দিয়ে ভ্যবিচারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
আজকাল দিনে-দুপুরে অলিতে গলিতে অবাধ মদ্য-পান চলছে। অনেক মুসলিম দেশ -মদের ব্যবসা এবং বাজারে বিদেশী মদের আমদানীকে বৈধ ঘোষণা করেছে।
আবু মালেক আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অবশ্যই আমার উম্মতের একদল -মদ্যপানে লিপ্ত হবে। (ব্যবসার সুবিধার্থে) মদের নামকে তারা পরিবর্তন করে দেবে। তাদের মাথার উপর গান-বাজনা এবং নর্তকীদের নৃত্যানুষ্ঠান শোভা পাবে। আল্লাহ তা’লা তাদেরকে মাটির নিচে ধ্বসে দেবেন। কতিপয়কে শুকর-বানরে পরিবর্তন করে দেবেন।-” (ইবনে মাজা)
বর্তমান সময়ে গান-বাদ্য এবং অশ্লীল মিউজিক -মানুষের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়ার ফলে অন্তরে কপটতার ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। এই কপটতা-ই মানুষকে -নামায, আল্লাহর স্মরণ, কুরআন পাঠ এবং কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ করে দিয়েছে। আল্লাহ তা’লা বলেন- “একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করতে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।-” (সূরা লুকমান-৬)
অধিকাংশ ব্যাখ্যাকার উপরোক্ত আয়াতে -“অবান্তর কথাবার্তা”-” বলতে গান-বাজনা এবং বাদ্যযন্ত্র উদ্দেশ্য বলেছেন।
হাদিসে গান-বাদ্য শ্রবণকে নবী করীম সা. ভ্যবিচার এবং মদ্য পানের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
ব্যাপকভাবে গান-বাজনা এবং আধুনিক মিউজিককে কেন্দ্র করে প্রতিদিন নিত্যনতুন স্যাটেলাইট মিউজিক-চ্যানেল আবিস্কৃত হচ্ছে। দিন-রাত ২৪ ঘন্টার বিশেষ মিউজিক রেডিও-ষ্টেশন গড়ে উঠছে। এগুলোতে কোন সংবাদ বা ভাল কিছু প্রচারিত হচ্ছে না। এটা-ই কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন, যা নবী করীম সা. বহুকাল পূর্বেই আমাদেরকে বলে গেছেন। সকল মুসলমানকে এগুলো থেকে সতর্ক হতে হবে।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. বলেন- “পানি সিঞ্চনে যেমন ফসল বেড়ে উঠে, তেমনি গান-বাদ্য শুনার ফলে অন্তরে কপটতা (নেফাকী) গড়ে উঠে।-”

(৫০)
(তীব্র সঙ্কটের ফলে) মানুষের মৃত্যু কামনা

বিপদাপদ, ফেতনা, ব্যাপক সংঘাত এবং জুলুম-অত্যাচারের জমানা আসবে বলে নবী করীম সা. আগেই সতর্ক করে গেছেন। এমনকি সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তি -মৃত বন্ধুর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতে থাকবে- “হায়! আমি যদি বন্ধুর স্থানে (কবরের ভেতর) থাকতাম..!”
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তি -কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আফসোস করে বলতে থাকবে- “হায়! আমি যদি তার স্থানে হতাম!” (বুখারী-মুসলিম)
ইবনে মাসঊদ রা. বলেন- “মৃত্যু যদি বাজারে কিনতে পাওয়া যেত, তবে মানুষ মৃত্যুকে কিনে ফেলত-” এমন সঙ্কটাপন্ন কাল অচিরেই তোমাদের উপর আবর্তিত হবে।-”
এক হাদিসে নবী করীম সা. বলেন- “সঙ্কটের ফলে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে”।-”
উভয় হাদিসের মাঝে বাহ্যিক বৈপরীত্য দেখা গেলে-ও মূলত কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ, শেষ জমানায় -দুনিয়া থেকে নিরাশ হয়ে নয়; বরং অপরাধ-ভরা সমাজ এবং ঈমান হরণকারী ফেতনাসমূহ থেকে নিস্তার পেতে আল্লাহর দরবারে সরাসরি মরণ প্রার্থণা করা হবে।
প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে-ই এমন যাতনা-র উদ্রেক হওয়া আবশ্যক নয়। বরং রাষ্ট্রভিত্তিক পরিস্থিতি এবং মাত্রা বুঝে এগুলো ঘটতে থাকবে। সবার ঈমান তো আর সমান নয়! যার ঈমান যত বেশি, কষ্ট ও ফেতনার মুকাবেলায় তার ধৈর্য-ও তত বেশি হবে।

(৫১)
যখন মানুষ -সকালে মুমিন থাকবে, বিকালে কাফের হয়ে যাবে

ফেতনা এবং স্বভাব বিবর্তনের দরুন মানুষের চেতনার-ও বিবর্তন ঘটবে। মনোচাহিদা পূরণের জন্য সমাজে পাপাচার ছেয়ে যাবে। অবাধ পাপাচারে লিপ্ত হওয়ায় মানুষ সকালে মুমিন থাকবে আর বিকালে কাফের হয়ে যাবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অন্ধকার রাত্রির ন্যায় ক্রমাগত ফেতনা আসার আগে-ই যা আমল করার -করে ফেলো।! মানুষ তখন সকালে মুমিন থাকবে, বিকালে কাফের হয়ে যাবে। বিকালে মুমিন থাকবে, সকালে কাফের হয়ে যাবে। দুনিয়ার তুচ্ছ লাভের আশায় নিজের ঈমানকে সে বিক্রি করে দেবে।-” (বুখারী)
উপরোক্ত হাদিসে নবী করীম সা. মানুষকে দ্রুত আমল করার তাগিদ দিয়েছেন। কারণ, অচিরেই এমন সব ফেতনার আবির্ভাব হবে, যা মানুষকে সৎ কাজ থেকে বিমুখ করে দেবে। অমাবস্যার অন্ধকারের ন্যায় কালো ফেতনায় লিপ্ত হওয়ার ফলে মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, আর বিকালে কাফের হয়ে যাবে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ঈমানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।
মুসলমানদের ঈমান তখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বে, মূর্খতা-বশত ঈমান নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হবে। এমন কথা বলবে- কাফের হয়ে যাবে। সামান্য মুনাফা-য় ঈমানকে বিক্রি করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে এসবকিছু চেনা-পরিচিত মনে হয়।

(৫২)
মসজিদকে রকমারি ডিজাইন ও কারুকার্যকরণ প্রতিযোগিতা

মসজিদ নির্মাণের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহ পাককে সন্তুষ্ট করতে সঠিকভাবে এবাদত পালনের সুযোগ তৈরি করা। বাহ্যিক কারুকার্যকরণ যথাসম্ভব কমিয়ে নামাযের গুরুত্ব এবং ইসলামী শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা।
কিন্তু শেষ জমানায় মানুষ প্রচুর পরিমাণে মসজিদ নির্মাণ করবে, নানান কারুকার্য ও হরেক রকম ডিজাইন দিয়ে মসজিদ সাজিয়ে তুলবে। সবাই চাইবে, আমার মসজিদটি সবার থেকে আলাদা হোক। ফলে নামাযের চেয়ে কারুকার্যের দিকেই মানুষের দৃষ্টি বেশি থাকবে। মিডিয়া ব্যবহার করে তারা মসজিদগুলোর প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হয়ে যাবে। (কারণ, সরাসরি নামায সম্প্রচারের ফলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি মসজিদের উপর থাকবে)
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মানুষ মসজিদ (কারুকার্যকরণ) নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে।-” (আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা)
সাহাবায়ে কেরাম রা. সবসময় মসজিদ সুসজ্জিত করা থেকে সতর্ক করতেন। এবাদত, আল্লাহর স্মরণ এবং দ্বীনী শিক্ষার মাধ্যমেই মসজিদ আবাদ করার প্রতি তাগিদ দিতেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন- “অচিরেই তোমরা মসজিদগুলোকে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের মত কারুকার্য করে গড়ে তুলবে।-” (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ)
ইমাম বগভী রহ. বলেন- “প্রাথমিক যুগে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়গুলো কারুকার্যমন্ডিত ছিল না, আসমানী কিতাব বিকৃত হওয়ার পর-ই তারা কারুকার্যকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে।-” (ফাতহুল বারী)
খাত্তাবী রহ. বলেন- “ইহুদী-খ্রিষ্টানরা যখন আসমানী কিতাব বিকৃত করে ফেলে, আল্লাহর দ্বীনকে বিনষ্ট করে ফেলে, তখন-ই তারা গির্জা সুসজ্জিতকরণে আত্মনিয়োগ করে।-” (উমদাতুল ক্বারী)
মসজিদ ডিজাইনের কয়েকটি পদ্ধতি হতে পারেঃ
(১) দেয়ালে রঙ-বেরঙয়ের বর্ণিল ছাপ।
(২) মনমোগ্ধকর দৃশ্যের ছবি স্থাপন। যেমন, মক্কা-মদীনার ছবি।
(৩) কারুকার্যকৃত বা নকশাকৃত জায়নামায (কার্পেট) বিছানো।
(৪) বিভিন্ন লেখা (কুরআনের বাণী, হাদিসের বাণী) দিয়ে মেহরাব সুসজ্জিত করণ।
হিসেব করলে আপনি দেখবেন যে, একটি বড় মসজিদের ডিজাইন এবং মেহরাব কারুকার্য করতে গিয়ে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা দিয়েই আরো চার/পাঁচটি ছোট মসজিদ অনায়াসে তৈরি করা যেত।
এর মাধ্যমে মসজিদগুলোকে দুর্বল গঠনে তৈরি করা বা সুন্দর কার্পেটে অবহেলা করা উদ্দেশ্য নয়; বরং হাদিসে সুন্দর করতে গিয়ে সীমাতিরিক্ত করে ফেলা কিংবা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আবু দারদা রা. বলেন- “যখন তোমরা মসজিদগুলোকে ডিজাইন করবে, কোরআনের আয়াতগুলোকে কারুকার্যমণ্ডিত করবে -তখন তোমাদের ধ্বংস কাছিয়ে যাবে।-” (ইবনে আবি দাউদ, তাহছীনে আলবানী রহ.)

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম