সতর্কবাণী-
সাহাবাদের পারস্পরিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে আহলে সুন্নাত মুসলমানদের অবস্থানঃ
সাহাবায়ে কেরাম রা. সকলেই সাধারণ মানুষ ছিলেন, নবী ছিলেন না। সুতরাং অন্যান্য মানুষের মত সাহাবাদের মধ্যেও ছোটখাটো ইজতেহাদী ভূল..এমনকি সংঘাত -থাকতেই পারে।
সকল আহলে সুন্নাত উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে,
১) নবীদের পর সাহাবায়ে কেরাম হচ্ছেন সর্বোৎকৃষ্ট, সর্ব পরিশুদ্ধ এবং শেষনবীর আদর্শের সবচে’ কাছাকাছি মানব সম্প্রদায়।
২) সাহাবায়ে কেরামের পারস্পরিক মতবিরোধ এবং সংঘাত নিয়ে -আমাদের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই। নীরবতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের ছিদ্রান্বেষণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে।
৩) সাহাবাদের প্রতি কুধারণা পোষণ বা ফেতনার আশঙ্কার দরুন জনসম্মুখে এ ব্যাপারে কথা বলা বা এ ধরনের কোন দুর্ঘটনা প্রচার করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
(১০)
খারেজী সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ
মুসলমানদের মধ্যে নববী আদর্শের পরিপন্থী কতিপয় ভ্রান্ত মতবাদ সৃষ্টি হওয়া-ও কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। তন্মধ্যে খারেজী সম্প্রদায় অন্যতম। প্রথমে তারা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা.এর সাথে ছিল। অনেক যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে হযরত মুআবিয়া এবং আলী রা.এর মধ্যে বিচারব্যবস্থা সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের পর আলী রা.-এর অনুসরণ থেকে তারা বের হয়ে যায়। সাধারণ মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কূফা অঞ্চলের ‘-হারূরা’- নামক স্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করে।
তাদের মতবাদ হচ্ছেঃ
১) কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফের। যেমন, যিনাকারী, মদ্য পানকারী। এরকম কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
সম্যক পথভ্রষ্টতা; বরং একজন মুসলমান যদি কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়, তবে তাকে কাফের বলা হবে না। বরং সে তো সাধারণ এক গুনাহগার। তার উপর তওবা করা এবং গুনাহ থেকে ফিরে আসা আবশ্যক।
২) তারা হযরত আলী এবং মুআবিয়া রা.সহ যে সকল সাহাবায়ে কেরাম বিচারব্যবস্থা পৃথকিকরণ বিষয়ে একমত হয়েছেন, তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করে থাকে। (নাঊযুবিল্লাহ)
৩) গুনাহে লিপ্ত মুসলিম শাসনকর্তা অপসারণে বিদ্রোহ করাকে তারা জায়েয মনে করে। (তবে যদি কোরআন-হাদিসের পরিস্কার দলিলের মাধ্যমে শাসনকর্তার মুরতাদ হওয়া প্রমাণিত হয়, তবে তার পতন ঘটানো সকলের উপর ফরয)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “শেষ যামানায় একদল নির্বোধ তরুণ জাতির আবির্ভাব হবে। কোরআন পড়বে, কিন্তু কোরআনের তাৎপর্য তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না। উৎকৃষ্ট কথা তারা বর্ণনা করবে। তীর যেমন ধনুক থেকে মুহূর্তে বের হয়ে যায়, তারাও দ্বীনে ইসলাম থেকে মুহূর্তের মধ্যে বের হয়ে যাবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
খারেজী সম্প্রদায় উত্থানের সূচনাঃ
সিফফীন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শাম ও ইরাকের সকল সাহাবীদের ঐক্যমতে বিচারব্যবস্থা পৃথকিকরণ এবং আলী রা.এর কূফায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখনই খারেজী সম্প্রদায় আলী রা.থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘হারূরা’ প্রান্তরে এসে বসতি স্থাপন করে। সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা আট হাজার ছিল। কারো কারো মতে ষোল হাজার। বিচ্ছিন্নতার সংবাদ পেয়ে হযরত আলী রা. -ইবনে আব্বাস রা.কে তাদের কাছে পাঠান। ইবনে আব্বাস রা. বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের থেকে দুই হাজারকে আলী রা.এর অনুসরণে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। অতঃপর আলী রা. কূফার মসজিদে দাড়িয়ে দীর্ঘ ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোণায় “-লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ-” (আল্লাহর বিধান ছাড়া কারো বিধান মানি না, মানব না) স্লোগানে তারা মসজিদ ভারী করে তুলে। আলী রা.-এর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- “আপনি বিচারব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন?! আল্লাহর বিধানে অবজ্ঞা প্রদর্শনের দরুন আপনি মুশরেক হয়ে গেছেন..!!”
তখন আলী রা. বললেন- তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিঃ
১) মসজিদে আসতে তোমাদের আমরা বারণ করব না।
২) রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে তোমাদের বঞ্চিত করব না।
৩) আগে-ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।
কিছুদিন পর সাধারণ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ করতঃ তারা আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব বিন আরিত রা.কে হত্যা করে তার স্ত্রীর পেট ফেড়ে দু-টুকরা করে দেয়। আলী রা. জিজ্ঞেস করেন, আব্দুল্লাহকে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা “-আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি- স্লোগান দিতে থাকে। এরপর আলী রা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ‘নাহরওয়ান’ অঞ্চলে তাদের সাথে মুসলমানদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খারেজী সম্প্রদায়ের ফেতনা-ও সাময়িকভাবে খতম হয়ে যায়।
(১১)
মিথ্যা নবুওয়ত দাবীকারী দাজ্জালদের আত্মপ্রকাশ
মিথ্যা নবুওয়ত দাবীকারী ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশ-ও কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। তাদের আবির্ভাব মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ফেতনা উস্কিয়ে দেবে। সহীহ হাদিস মতে- নবী করীম সা. এদের সংখ্যা ত্রিশ জনের মত বলেছেন।
এরশাদ করেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না প্রায় -ত্রিশজনের মত মিথ্যা নবুওয়ত দাবীকারীর আত্মপ্রকাশ ঘটবে। সবাই নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মনে করবে।-” (বুখারী)
কেয়ামতের এই নিদর্শনটি ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। নবী করীম সা.এর ইন্তেকালের পর থেকে অদ্যাবধি সময়ে সময়ে বিভিন্ন মিথ্যা নবী দাবীকারী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃত দাজ্জালের আবির্ভাব পর্যন্ত এরকম আরো মিথ্যুক আত্মপ্রকাশ করবে বলে মনে হচ্ছে। নবী করীম সা.এর ভাষ্যতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়- “আল্লাহর শপথ! প্রায় ত্রিশ জনের মত মিথ্যুকের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না। এদের সর্বশেষ হল কানা দাজ্জাল।”-” (মুসনাদে আহমদ)
নবী করীম সা. আরো বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না আমার উম্মতের একদল লোক মুশরেকদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে। আরেক দল মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে যাবে। প্রায় ত্রিশজনের মত মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটবে, সবাই নিজেকে নবী বলে মনে করবে, অথচ আমি-ই হলাম সর্বশেষ নবী। আমার পর আর কোন নবী পৃথিবীতে আসবেন না।-” (তিরমিযী-আবূ দাউদ)
অপর হাদিসে- সংখ্যাটি ত্রিশের পরিবর্তে সাতাশ উল্লেখ হয়েছে, যন্মধ্যে চারজন মহিলা মিথ্যুকের কথাও বলা হয়েছে।
হুযায়ফা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার উম্মতের মধ্যে সাতাশ জন মিথ্যুকের আগমন ঘটবে। তন্মধ্যে চারজন- মহিলা। অথচ আমি-ই সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী নেই।-” (মুসনাদে আহমদ, তাবারানী, মুসনাদে বাযযার)
অধিকাংশ-ই অতীতে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে।
১) নবী করীম সা.এর জীবদ্দশাতেই ইয়েমেনে ‘-আসওয়াদ আনসী- নামে প্রথম মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম ত্যাগ করে নিজেকে সে নবী বলে দাবী করতে থাকে। নবীজীর জীবদ্দশায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েও কুফুরীতে ফিরে যাওয়ার ঘটনা তার মাধ্যমেই প্রথম শুরু হয়। ইয়েমেন অঞ্চলে তার তৎপরতা শুরু হয়। তিন/চার মাসের মধ্যেই সারা ইয়েমেনে সে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সামর্থ্য হয়। অতঃপর নবী করীম সা. তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে ইয়েমেন বাসীর প্রতি চিঠি লিখে পাঠান। রাসূলের চিঠি পেয়ে ইয়েমেন বাসীর হুশ ফিরে আসে। অবশেষে স্ত্রীর একনিষ্ঠ সহায়তায় তার হত্যা-কাজ সমাধা করা হয়। স্ত্রী ছিল খাঁটি মুসলিমা। পূর্বের স্বামীকে হত্যা করে এই স্ত্রীকে সে জোরপূর্বক বিবাহ করেছিল। তার হত্যার মধ্য দিয়ে ইয়েমেনে ইসলামের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। হত্যার সংবাদ জানাতে নবীজীর কাছে তারা চিঠি লিখে পাঠায়। চিঠি পৌঁছার পূর্বেই আল্লাহ তা’লা আসমান থেকে ওহী নাযিল করে নবীকে সবকিছু জানিয়ে দেন। তার অপতৎপরতার মেয়াদ ছিল তিন মাস, কেউ বলেছেন- চার মাস।
২) তুলাইহা বিন খুওয়াইলিদ আছদী। প্রথমে সে নবী দাবী করে। মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। অবশেষে তওবা করে একনিষ্ঠভাবে সে ইসলামের দিকে ফিরে আসে। মুসলিম বাহিনীতে যুগ দিয়ে বিভিন্ন জিহাদে সে অংশগ্রহণ করে। জিহাদের রাস্তায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। অবশেষে নেহাওয়ান্দ প্রদেশে এক যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেন।
৩) মুছাইলিমা কাযযাব। রাত্রিকালে তার কাছে ওহী আসে বলে সে দাবী করত। খালেদ বিন ওলীদ, ইকরামা বিন আবি জাহল ও শুরাহবিল বিন হাসানা রা. সাহাবা-ত্রয়ীর নেতৃত্বে আবূ বকর রা. তার বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। চল্লিশ হাজার সৈন্যবাহিনী দিয়ে সে মুসলমানদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ওয়াহশী বিন হারব রা. কর্তৃক মুছাইলিমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মুসলমানগণ আরব বিশ্বে পুনরায় একত্মবাদের পতাকা উড্ডীন করতে সামর্থ্য হন।
৪) ছাজ্জাহ বিনতে হারেস। মহিলা মিথ্যুক। ইসলামপূর্বে সে আরব্য খ্রিষ্টানদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। নবী করীম সা.এর মৃত্যুর পর সে নিজেকে নবী বলে দাবী করা শুরু করে। স্বজাতির অনেকেই তাকে অনুসরণ করে বসে। আশপাশের কতিপয় গোত্রের সাথে যুদ্ধে সে বিজয়ী হয়ে ইয়ামামা’ অভিমুখে রওয়ানা দেয়। সেখানে মুছাইলিমা কাযযাবের সাথে মিলিত হয়ে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। মুছাইলিমা খুশি হয়ে তাকে বিবাহ করে নেয়। মুছাইলিমা নিহত হওয়ার পর স্বদেশে ফিরে এসে সে খাঁটি ইসলামে দীক্ষিত হয়। ইসলাম পরবর্তী তৎপরতা তার প্রশংসার দাবী রাখে। কিছুদিন পর তিনি বছরা’য় হিজরত করেন, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
৫) তাবেয়ীনের (সাহাবা পরবর্তী) যুগে আত্মপ্রকাশকারী মিথ্যুকদের মধ্যে মুখতার বিন আবু উবাইদ সাকাফী অন্যতম। প্রথমে নিজেকে সে কট্টরপন্থী শিয়া দাবী করলে শিয়াদের একটি বড় দল তার সাথে গিয়ে মিলিত হয়। ওহীর বাহক হয়ে জিবরীল আ. তার কাছে আসেন বলে সে দাবী করত। মুসআব বিন যুবাইর রা. তার বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। অবশেষে তার হত্যা-কার্য সমাধা করা হয়।
৬) হারেস বিন সাঈদ কাযযাব। দামেস্কে প্রথমে সে নিজেকে খোদাপ্রেমিক বলে দাবী করে। কিছুদিন পর নবী..। অতঃপর প্রতাপশালী মুসলিম শাসনকর্তা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেছে- জেনে সে গা-ঢাকা দেয়। বসরার এক মুসলিম যুবক তার আস্তানা চিহ্নিত করে ফেলে। সে হারেসের কাছে গিয়ে নিজেকে তার ভক্ত বলে পরিচয় দেয়। হারেস খুশি হয়ে সবসময় তার জন্য আস্তানার দরজা খুলা থাকবে বলে আশ্বাস দেয়। যুবকটি ওখান থেকে ফিরে এসে শাসনকর্তা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললে তিনি তার সাথে একদল সৈনিক প্রেরণ করেন। তারা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসলে বাদশা কতিপয় আলেমকে ডেকে তাকে বুঝিয়ে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে ইসলাম ও তওবা করতে অস্বীকার করলে বাদশা তার হত্যার আদেশ দেন।
৭) সম্প্রতি অর্ধ-শতাব্দী পূর্বে উপমহাদেশে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামে এমন-ই এক মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটে। সে নিজেকে নবী মনে করত। চিটু-চিটু এবং টিচু-টিচু নামক দু-জন ফেরেশতা আসমান থেকে তার কাছে ওহী নিয়ে আসে বলে সে দাবী করত। ‘দুনিয়াতে তার বয়স আশি বৎসর হবে’ -আল্লাহ আগেই তাকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন বলে সে দাবী করত। অল্প দিনের মধ্যেই সে অনেক অনুসারী কাছে টানতে সামর্থ্য হয়েছিল। সমসাময়িক উলামায়ে কেরামের সাহসী তৎপরতায় তার ফেতনাটি বেশিদূর এগুতে পারেনি। তবে হিন্দুস্তানে এখনো তার অনুসারীরা তৎপর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছানাউল্লাহ অমৃতসূরী রহ., আতাউল্লাহ বুখারী রহ. প্রমুখ উলামায়ে কেরাম তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য- এই মিথ্যুকের কুপরিণাম দুনিয়াতেই আল্লাহ পাক দেখিয়ে দেন। পায়খানার ডাষ্টবিনে পড়ে তার মৃত্যু হয়। অনেক উলামায়ে কেরাম কাদিয়ানী ফেতনাকে ইহুদী ষড়যন্ত্র বলেও উল্লেখ করেন। কারণ, কাদিয়ানীদের কমান্ডিং হেড-অফিস হচ্ছে- ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবে।
ছানাউল্লাহ অমৃতসূরী রহ. ১৯০৮ ইং সনে কাদিয়ানীকে চ্যালেঞ্জ করেন যে, দু’জনের মধ্যে যে -মিথ্যুক, অচিরেই তার মৃত্যু হবে। মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মিথ্যুকের ধ্বংস কামনা করে আল্লাহর কাছে তিনি অনেক দোয়া করেন। এক বৎসরের মধ্যেই কাদিয়ানীর উপর বদদোয়ার প্রতিক্রিয়া শুরু হতে থাকে। অন্তিম অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার শ্বশুর বলেন- “ব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করলে একরাতে সে চিল্লাতে থাকে। জ্বালাময়ী যন্ত্রণা হচ্ছিল -অবস্থা দেখে তা-ই বুঝতে পারলাম। আমাকে দেখে সে বলতে থাকে যে, আমি কলেরা-য় আক্রান্ত হয়ে গেছি। এরপর মরণ অবধি সে আর কোন বাক্য উচ্চারণ করতে পারেনি।
ত্রিশজন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই একের পর এক মিথ্যা নবী দাবীকারী মিথ্যুক প্রকাশ হতে থাকবে। এ তালিকায় সবশেষে আছে কানা দাজ্জালের নাম। ঈসা বিন মারয়াম আ. কর্তৃক কানা দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা শেষ হবে না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, নবী করীম সা. আমাদেরকে মিথ্যুকদের সংখ্যা ত্রিশজন বলে গেছেন। অথচ ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপটে তো এর সংখ্যা আরো বেশি দেখা যায়।
উত্তরঃ মূলত আত্মপ্রকাশ ঘটবে অনেক মিথ্যুকের। তন্মধ্যে যাদের প্রসিদ্ধি এবং অনুসারী বেশি হবে, এদের সংখ্যা ত্রিশজনের মত। অপ্রসিদ্ধ মিথ্যুকদের কথা রাসূল গণা-য় ধরেন নি।
(১২)
শান্তি, নিরাপত্তা ও সচ্ছলতার জয়-জয়কার
প্রথমদিকে ইসলামের গণ্ডি মক্কা-মদীনায় সীমাবদ্ধ থাকা-কালে শত্রুদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়মুসলমানদের। নবী করীম সা. বলে গেছেন, সময় যত-ই গড়াবে, কেয়ামত যত-ই সন্নিকটে আসবে -শান্তি, নিরাপত্তা ও সচ্ছলতার ততই জয়-জয়কার হবে। এরশাদ করেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না আরবের ভূমি সবুজ-শ্যামল পরিবেশ ও নদীনালায় পূর্ণ হয়ে উঠে। মক্কা নগরী থেকে সুদূর ইরাক পর্যন্ত মানুষ নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে। পথ হারানো ছাড়া কোন ভয় থাকবে না। কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে সংঘাত বেড়ে যাবে। সংঘাতের অর্থ জিজ্ঞেস করলে নবীজী বলেন- অধিক হত্যাযজ্ঞ!” (মুসনাদে আহমদ)
অপর হাদিসে- “নবী করীম সা. -আদী বিন হাতিম রা.-কে লক্ষ করে বলতে থাকেন- হে আদী! তুমি কি -হাইরা (কূফা থেকে তিন মাইল দূরে ইরাকের একটি) নগরী দেখেছ? বললাম- না..! তবে শুনেছি! নবীজী বললেন- আয়ু দীর্ঘায়িত হলে তুমি দেখতে পাবে যে, মহিলারা হায়রা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে আগমন করবে। পথিমধ্যে আল্লাহ ছাড়া কাউকে তারা ভয় করবে না।” (বুখারী)
অচিরেই ধনসম্পদের আধিক্য ঘটবে, জুলুম-অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটবে, বিশ্বময় শান্তির জয়গান বেজে উঠবে। এ সবই ইমাম মাহদী এবং হযরত ঈসা আ.-এর জমানায়। (আল্লাহই ভাল জানেন)
(১৩)
হেজায ভূমি থেকে বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশ
নবী করীম সা. থেকে বর্ণিত কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর অন্যতম হচ্ছে হেজায ভূমি থেকে বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশ। উলামায়ে কেরাম এবং ঐতিহাসিকদের ঐক্যমতে ঘটনাটি ৬৫৪ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না হেজায ভূমি থেকে বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশ হবে, যার আলোতে সুদূর বছরা’-য় (ইরাকের) উষ্ট্রীর স্কন্ধ আলোকিত হয়ে উঠবে।-” (বুখারী)
তিন মাস পর্যন্ত আগুনটি অবিরাম জ্বলছিল। মদীনার মহিলারা আগুনের আলোতে নৈশ-গল্পের আসর জমাত।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে গিয়ে আবূ শামা বলেন- “৬৫৪ হিজরী সনের ৩ জুমাদাল উখরা বুধবার দিবাগত রাতে মদীনার দিক থেকে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড ভড়কে উঠে। তিনদিন পর্যন্ত মদীনায় খানিক পর পর ভূমিকম্প অনুভূত হতে থাকে। এর পরক্ষণে হাররা প্রান্তরে বনূ কুরায়যার সন্নিকটে আরো একটি বিশাল অগ্নির সূত্রপাত ঘটে, যার আলোতে রাত্রিকালে-ও মদীনার সমস্ত অলিগলি আলোকিত থাকত। দেখে মনে হচ্ছিল যেন আগুনের এক বিশাল শহর মদীনার দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে।”
ইমাম নববী রহ. বলেন-“৬৫৪ হিজরীতে মদীনার পূর্বদিকে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রকাশিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সকল উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত।”
ইবনে হাজার রহ. বলেন- “হাদিসে উল্লেখিত আগুন বলতে ৬৫৪ হিজরী সনে প্রকাশিত সেই আগুনই উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবী রহ.-এর মত আমার-ও একই মতামত।”
(১৪)
তুর্কীদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ
বিধর্মীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অত্যাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। তন্মধ্যে তুর্কীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধটি হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ হয়েছে। সাহাবীদের যুগে-ই বনি উমাইয়ার শাসনামলে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। তুর্কী সম্প্রদায় পরাজিত হলে মুসলমানগণ তাদের থেকে প্রচুর যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ অর্জন করে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না তোমরা তুর্কীদের সাথে যুদ্ধ করবে। (তাদের নিদর্শন হল-) ছোট ছোট চোখ, রক্তিম (লাল) চেহারা, চ্যাপটে নাক, স্থূল বর্ম সদৃশ গোল চেহারা। কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না তোমরা পশমের জুতা পরিধানে অভ্যস্ত জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।”
এর মাধ্যমে উদ্দেশ্য- (আল্লাহই ভাল জানেন) তাতারী (মোগল) সম্প্রদায়। ১২৫৮ ইং সনে পুরো ইসলামী বিশ্বে আগ্রাসণ চালিয়ে মুসলমানদের রক্তে -সাগর নদীগুলো তারা রক্তিম করে তুলে। কিন্তু পরিশেষে সদলবলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।
(১৫)
চাবুকে আঘাতকারী অত্যাচারী ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশ
কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, অত্যাচারী শাসকদের সহায়তাকারী ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশ। ষাঁঢ়ের লেজ সদৃশ এক প্রকার চাবুক দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। চাবুক পশম থেকেও হয়, বৃক্ষের ঢাল থেকেও চাবুক হয়, বৈদ্যুতিক চাবুকও পাওয়া যায় এবং রবার-এর প্রসারণযোগ্য চাবুকও প্রচলিত আছে।
আবূ উমামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “শেষ জমানায় এমন কিছু লোকের আত্মপ্রকাশ ঘটবে, যাদের সাথে ষাঁঢ়ের লেজ সদৃশ এক প্রকার চাবুক থাকবে। আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে তারা সকাল-সন্ধ্যা যাপন করবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “আমার উম্মতের দুই প্রকার লোককে এখনো আমি দেখিনি- ১) যাদের হাতে ষাঁঢ়ের লেজ সদৃশ চাবুক থাকবে। তা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে...” (মুসলিম)
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “আয়ূ থাকলে তুমি এমন কিছু লোককে দেখতে পাবে, যারা আল্লাহর ক্রোধ ও অভিশাপের মধ্য দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা যাপন করবে। তাদের হাতে ষাঁঢ়ের লেজ সৃদশ কিছু একটা থাকবে।-” (মুসলিম)
তারা খুবই অত্যাচারী এবং দুর্নীতি পরায়ণ হবে। দুশ্চরিত্রের দরুন তারা আল্লাহর অভিশাপের পাত্রতে পরিণত হবে।
(১৬)
অধিক পরিমাণে সংঘাত (হত্যাযজ্ঞ)
নবী করীম সা. থেকে বর্ণিত কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর একটি হচ্ছে সংঘাত এবং হত্যাযজ্ঞ অত্যাধিক হারে বেড়ে যাওয়া। এমনকি একজন আরেকজনকে হত্যা করবে, হত্যাকারী জানবে না- কি উদ্দেশ্যে হত্যা করছে। নিহত ব্যক্তিও বুঝবে না- কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হচ্ছে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! ততক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার সমাপ্তি ঘটবে না, যতক্ষণ না একজন অপরজনকে হত্যা করবে। হত্যাকারী জানবে না- কি উদ্দেশ্যে হত্যা করছে। আর নিহত ব্যক্তি বুঝবে না- কি দুষে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হল- এটা আবার কিভাবে সম্ভব!? নবীজী বললেন- সংঘাত-কালে এমনটি-ই ঘটবে। হত্যাকারী এবং নিহত উভয়েই জাহান্নামী হয়ে যাবে।-” (মুসলিম)
ইসলামের তৃতীয় খলীফা আমীরুল মুমেনীন হযরত উসমান বিন আফফান রা. হত্যা ঘটনার মধ্য দিয়ে সংঘাতের সূচনা হয়। বিনা কারণে পর্যায়ক্রমে সংঘাত বাড়তেই থাকে। অদ্যাবধি সে সংঘাত অব্যাহত। অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ আবিস্কারের ফলে সংঘাত আরো সহজ ও ব্যাপক হয়ে পড়েছে।
শুধুমাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘটিত বৃহত্তম যুদ্ধগুলোতে নিহতের পরিসংখ্যান লক্ষ করুনঃ
১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ।
২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- পাঁচ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ।
৩) ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- ত্রিশ লক্ষ।
৪) রাশিয়া-র গৃহযুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- এক কোটি।
৫) স্পেনের গৃহযুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- এক কোটি বিশ লক্ষ।
৬) ইরান-ইরাক (প্রথম উপসাগরীয়) যুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- দশ লক্ষ।
৭) সাম্প্রতিক ইরাক যুদ্ধঃ নিহতের সংখ্যা- এ পর্যন্ত দশ লক্ষের-ও উপরে।
ইসলামের বিগত চৌদ্দশত বৎসরের পরিসংখ্যান চিন্তা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিগত একশত বৎসরে-ই সংঘাতের হার কি পরিমাণ বেড়েছে।
(১৭)
আমানত (বিশ্বস্ততা) অন্তর থেকে উঠে যাবে (কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না)
প্রতিটি বস্তুকে আপন স্থানে রেখে বিচার করা-ই ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট। এর মধ্যেই -জাতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জনগণের কল্যাণ নিহিত। এই মৌলিক বস্তুটি যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন কল্যাণের ঠিক উল্টো দিকটা প্রকাশ হতে শুরু করে। সমাজ সংস্কৃতি সবই বিনাশের মুখে পড়ে যায়। এটা-ই নবী করীম সা. হাদিসের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন।
মানুষের মৌলিক চরিত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া-ই বিশ্বস্ততা ভঙ্গের মূল কারণ।
হুযায়ফা রা. বলেন- নবী করীম সা. বলেছেন- “মানুষের হৃদয়ের গহীনে সর্বপ্রথম বিশ্বস্ততার অবতরণ হয়েছিল। অতঃপর কোরআন নাযিল শুরু হলে মানুষ কোরআন এবং হাদিসকে ধীরে ধীরে শিখতে থাকে।” -এরপর নবীজী বিশ্বস্ততা উঠে যাওয়ার কথা বলছিলেন- “মানুষ শয়নে যাবে, ঘুমের মধ্যেই হৃদয় থেকে বিশ্বস্ততা উঠিয়ে নেয়া হবে, কিন্তু তার প্রভাব অন্তরে থেকে যাবে। এরপর মানুষ শয়নে যাবে, আবারো অন্তর থেকে বিশ্বস্ততা উঠিয়ে নেয়া হবে, কিন্তু তার সূক্ষ্ম ছাপ অন্তরে থেকে যাবে। জ্বলন্ত টুকরা চামড়ায় পতিত হলে চামড়াটি ফোলে যায়, কিছুদিন পর তা শুকিয়ে গেলে চামড়ায় যেমন একপ্রকার ছাপ থেকে যায়, অথচ ভেতরে কিছুই নেই, এরপর শুকনা কিছু নিয়ে চামড়ায় লাগিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি..। এরপর মানুষেরা বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করবে, কেউ কারো বিশ্বস্ততা রক্ষা করবে না। এমনকি বিস্ময়কণ্ঠে মানুষ বলতে থাকবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে। কাউকে সম্বোধন করে বলা হবে যে, লোকটি কত জ্ঞানী! কত ভদ্র! কত সুশীল! -অথচ তার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান নেই।-”
হুযায়ফা রা. বলেন- “এমন এক সময় ছিল- যখন -যে কাউকে বায়আত করার সুযোগ থাকত (সবাই বিশ্বস্ত হওয়ার ফলে)। কিন্তু এখন (বিশ্বস্ততা উঠে যাওয়ার ফলে) অমুক অমুক ছাড়া কাউকে আমি বায়আত করব না।-”
সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা যখন বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়, তখন নেতৃত্ব-ও ঘাতকদের হাতে চলে যায়। আর তখনই বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বিলুপ্তি ঘটে। বর্তমান কালে প্রতিটি স্থানে প্রতিটি দেশে বিশ্বাসঘাতকতা ছেয়ে যাওয়ার ফলে যা কিছু ঘটছে, তা কারো অজানা নয়।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, “একদা নবী করীম সা. সাহাবীদেরকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এক বেদুইন এসে ‘-কেয়ামত কখন?- জিজ্ঞেস করল। নবীজী তার কথায় কান না দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবস্থা দেখে কেউ কেউ ধারণা করল- নবীজী হয়ত শুনেও উত্তর দিতে আগ্রহী না হওয়ায় কিছু বলছেন না। অন্যরা ধারণা করল, বেদুইনের কথাই নবীজী হয়ত শুনেননি। আলোচনা শেষ করে ‘প্রশ্নকারী কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলে বেদুইন বলল- এই তো আমি এখানে হুজুর! বললেন- ‘যখন বিশ্বস্ততা বিনষ্ট হয়ে যায়, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করবে’। বলল- বিশ্বস্ততা কিভাবে নষ্ট হবে? বললেন- ‘যখন অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাবে, তখন কেয়ামতের অপেক্ষা কর।-” (বুখারী)
কেয়ামতের এই নিদর্শনটি সম্প্রতি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সামাজিক পদ, স্কুল-কলেজ এমনকি সরকারী মন্ত্রণালয় পদে-ও আজ অযোগ্য ব্যক্তিদের ছড়াছড়ি। যে সকল পদে আজ বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের দরকার ছিল, সেখানেই বিশ্বাসঘাতকরা সাপের মত ফনা তুলে বসে রয়েছে।
নবী করীম সা.-এর বাণী যে অবশ্যই বাস্তবায়িত হওয়ার ছিল...
(১৮)
পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট জাতির পদাংক অনুসরণ
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে সবচে’ বেশি যে ফেতনাটি আজকাল চোখে পড়ছে, তা -অন্ধ অনুসরণ। ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রচারকৃত কৃষ্টি-কালচার ও ফ্যাশনের শতভাগ বাস্তবায়ন।
নবী করীম সা. বর্ণনা করে গেছেন যে, তাঁর উম্মতের একদল লোক আচরণ, অভ্যাস ও জীবনাচারের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট ইহুদী-খৃষ্টান জাতিকে হুবহু অনুসরণ করবে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না আমার উম্মত পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট জাতির হুবহু অনুসরণ শুরু করবে। এমনকি তারা যদি একহাত সামনে গিয়ে থাকে, আমার উম্মতও যাবে। একগজ পেছনে গিয়ে থাকে, আমার উম্মতও তাই করবে। ‘-পারস্য ও রোম জাতির মত?’ জিজ্ঞেস করলে নবীজী বললেন- তা না হলে আর কাদের মত!?” (বুখারী)
তন্মধ্যে সিংহভাগ বৈশিষ্ট্য তো ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে, যে গুলো বাকী আছে, সেগুলো-ও মুসলমানদের ভেতর চলে আসবে বলে মনে হচ্ছে। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অবশ্যই তোমরা পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট জাতির হুবহু অনুসরণ শুরু করবে। তারা যদি একহাত সামনে গিয়ে থাকে, তোমরাও যাবে। একগজ পেছনে গিয়ে থাকলে তোমরাও তাই করবে। এমনকি তারা যদি কোন সাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও সাপের গর্তে প্রবেশ করবে। ‘-ইহুদী-খৃষ্টানদের মত?’ জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- তা না হলে আর কাদের মত !?” (বুখারী-মুসলিম)
কাযী ইয়ায রহ. হাদিসদ্বয়ের ব্যাখ্যায় লেখেন- এখানে গজ, বিঘা, সাপের গর্তে প্রবেশ -বলে পরিপূর্ণ অনুকরণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী)
ইহুদী-খৃষ্টানদের অন্ধ অনুকরণ বলতে এখানে তাদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিংবা তাদের আবিস্কৃত পণ্যদ্রব্য ব্যবহার উদ্দেশ্য নয়; বরং অন্ধ অনুকরণ বলতে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, সমাজ সংস্কৃতি, অশ্লিলতা-নোংরামি এবং সুদযুক্ত অর্থনীতিতে অবাধ লেনদেনের অনুকরণ উদ্দেশ্য।
(১৯)
দাসীর গর্ভ থেকে মনিবের জন্ম লাভ
কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর একটি হচ্ছে, দাসীর পেট থেকে মনিবের জন্ম গ্রহণ। প্রেক্ষাপটটি এভাবে তৈরি হতে পারে যে, একজন স্বাধীন ব্যক্তির একটি দাসী আছে। সহবাসের ফলে গর্ভবতী হয়ে দাসী একটি পুত্র সন্তানের জনক হয়েছে। পিতা স্বাধীন হওয়ায় ছেলেও বড় হয়ে স্বাধীন হয়েছে। পিতা জীবিত থাকলে মাতা এখনো দাসী-ই রয়ে গেছে। এভাবে নিজের পুত্র মনিব-তুল্য হয়ে গেছে।
ঠিক তেমনি ফেরেশতা জিবরীল আ. যখন নবী করীম সা.কে কেয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন-ও নবীজী -দাসীর গর্ভ থেকে মনিবের জন্মগ্রহণ’- উত্তর দিয়েছিলেন। (মুসলিম)
কেউ কেউ উদ্দেশ্য করেছেন যে, দাসীরা রাজকুমার জন্ম দেবে। রাজকুমার বড় হয়ে রাজা হলে মাতা তার প্রজার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।
অনেকেই বলেছেন যে, শেষ জমানায় ছেলেরা মায়ের সাথে দাস-দাসীর মত আচরণ করবে। মা’-কে ঘর থেকে বের করে দেবে। মায়ের খোজ খবর নেবে না। মায়ের কথা ভুলে যাবে। মায়ের অবাধ্য হয়ে যাবে। মাকে গালিগালাজ করবে... ইত্যাদি। ফলে বহিরাগত কেউ দেখলে দাসী-মনিব ধারণা করবে। (আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
(২০)
স্বল্প কাপড় পরিহিত নগ্ন মহিলাদের আত্মপ্রকাশ
কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম একটি নিদর্শন হচ্ছে, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার ছড়াছড়ি। রাস্তাঘাটে বের হলেই আজকাল নগ্নপ্রায় মহিলাদের অবাধ চলাফেরা প্রত্যক্ষ করা যায়। দেহের অনেকাংশ-ই খোলা থাকে -এমন সংকীর্ণ বস্ত্র পরে তারা পুরুষদের সামনে বেহায়ার মত চলাফেরা করে। বাহ্যত তারা বস্ত্রবাহী হলেও ফেতনা ছড়ানো এবং দেহের বিভিন্ন হটাঙ্গ প্রদর্শনের ফলে তারা নগ্ন।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “দুই প্রকার জাহান্নামী সম্প্রদায় এখনো আমি দেখিনিঃ
১) ষাঁঢ়ের লেজ সদৃশ চাবুক দিয়ে মানুষকে প্রহারকারী অত্যাচারী সম্প্রদায়।
২) আবেদনময়ী বস্ত্রবাহী নগ্ন-নারী সম্প্রদায়। আবেদন সৃষ্টি করতে তাদের মাথাগুলো একপাশে ঝুকিয়ে দেবে। তাদের মাথাগুলো উটের কুঁজের মত উঁচু দেখাবে। এ দু’টি দলের কখনো জান্নাতে প্রবেশ তো দূরের কথা; জান্নাতের সুঘ্রাণও কপালে জুটবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ তো এত....এত.... দূর থেকেই অনুভব করা যায়।-” (মুসলিম)
মহাপ্রলয় : পর্ব-০৩
☼→
মহা প্রলয়
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: