মহাপ্রলয় : পর্ব-০৫

(৫৩)
ঘরবাড়ী ডিজাইন ও সুসজ্জিতকরণ

অত্যাধিক অপচয়, অনর্থক বিষয়ে প্রতিযোগিতা, অহংকার -এগুলো অতি-নিন্দনীয় ব্যাপার। আল্লাহ তা’লা বলেন- “আর তোমরা সীমাতিরিক্ত ব্যয় করো না, নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না-” (সূরা আনআ’ম-১৪১)
সম্পদের আধিক্যের ফলে শেষ জমানায় মানুষ বাড়ীঘর/বাংলো ডিজাইন করবে। দুয়ারে দামী চাদর ঝুলিয়ে রাখবে, সুগন্ধিময় কাঠ দিয়ে দরজা-জানালা নির্মাণ করবে, রকমারি টাইলস লাগিয়ে ঘরের শোভা বৃদ্ধি-র চেষ্টা করবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মানুষ সু-বিশাল বাড়ী নির্মাণ করবে। ডোরাকাটা মহামূল্যবাণ চাদর দিয়ে দেয়ালকে সুসজ্জিত করবে।-”
অর্থাৎ চাদর যেমন সুন্দর ডিজাইনে বুনা হয়, দেয়াল-ও সে রকম কারুকার্যে বানানো হবে।
ঘরকে সুদর্শন করতে চাদর ঝুলানো -হারাম কিছু নয়; কিন্তু এক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত অপচয়, অহংকার এবং প্রতিযোগিতায় মত্ত হওয়া হারাম।
(৫৪)
শেষ জমানায় অত্যাধিক বজ্রপাত

বজ্রাঘাতে নিহতের হার বেড়ে যাওয়া কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত ঘনিয়ে আসার পাশাপাশি বজ্রপাতের ঘটনাও বেড়ে যাবে। এমনকি মানুষ পাশের এলাকায় গিয়ে বলতে থাকবে- “গতরাতে তোমাদের এদিকে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেলাম”। উত্তরে তারা বলবে- অমুক, অমুক এবং অমুক বজ্রপাতে মারা গেছে।-”
বজ্র হচ্ছে এক প্রকার বৈদ্যুতিক ঝট্‌কা, যা বিজলী গর্জনের মুহূর্তে আকাশ থেকে বর্ষিত হয়।
এরকম বজ্রাঘাতের মাধ্যমেই আল্লাহ পাক ছামূদ জাতিকে ধ্বংস করেছিলেন- “আর যারা ছামূদ, আমি তাদেরকে হেদায়েত দেখিয়েছিলাম, অতঃপর তারা সৎপথের পরিবর্তে অন্ধ থাকা-ই পছন্দ করল। অতঃপর তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে অবমাননাকর আযাব এসে ধৃত করল।-” (সূরা ফুছছিলাত-১৭)
অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন- “অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলুন, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করলাম এক কঠোর আযাব সম্পর্কে -আদ ও ছামূদের আযাবের মত।-” (সূরা ফুছছিলাত-১৩)
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বজ্রাঘাতকে মহা প্রলয়ঙ্করী বলে সাব্যস্ত করেছেন।

(৫৫)
ব্যাপক লেখালেখি এবং কলামিষ্টদের ছড়াছড়ি

আগের যুগে লেখালেখি এবং প্রচার-মাধ্যম এত ব্যাপক ছিল না। একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য কত কষ্ট, কত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হত। কিন্তু এখন...! প্রেক্ষাপট কত বদলে গেছে! অধিক লেখালেখি, বই-পুস্তক প্রকাশ এবং কলামিষ্টদের আধিক্যকে নবী করীম সা. কেয়ামতের নিদর্শনরূপে চিহ্নিত করেছেন।
ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী অধিক হারে ঘটতে থাকবেঃ
(১) ব্যক্তি বিশেষে সালাম প্রদান
(২) ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্য। এমনকি স্ত্রী-ও ব্যবসায় স্বামীকে সাহায্য করবে।
(৩) আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকরণ
(৪) মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান
(৫) সত্য সাক্ষ্য গোপন
(৬) কলম প্রকাশ।-” (মুসনাদে আহমদ)

“কলম প্রকাশ-” বলতে সম্ভবত লেখালেখি এবং অধিক হারে বই পুস্তক প্রকাশের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। প্রকাশনা এবং ছাপানোর জন্য অত্যাধুনিক মেশিন আবিস্কার ও মাধ্যম সহজ হওয়ার ফলে যে কেউ চাইলেই পুস্তক প্রকাশ করতে পারবে। এতকিছুর পর-ও দ্বীনী এবং ইসলামী শিক্ষায় মানুষের মধ্যে মূর্খতা প্রকাশ পাবে।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যেঃ
(১) কোরআনের জ্ঞান উত্তোলন
(২) (ইসলামী শিক্ষায়) ব্যাপক হারে মূর্খতা প্রকাশ
(৩) (যিনা) ভ্যবিচার অধিক ও ব্যাপক
(৪) মদ্য-পান
(৫) পুরুষ হ্রাস এবং মহিলা বৃদ্ধি। এক পর্যায়ে- পঞ্চাশজন নারীর দায়ভার একজন পুরুষ গ্রহণ করবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
উপরোক্ত নিদর্শনসমূহ বর্তমান সমাজে হুবহু বাস্তবায়িত হচ্ছে -এতে কোন সন্দেহ নেই। দেখেও আমরা না দেখার ভান করছি। অথচ সাহাবায়ে কেরাম সামান্য কিছু ঘটলেই কত সতর্ক হয়ে যেতেন। মানুষকে কেয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে সচেতন করতেন..। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন।

(৫৬)
বাক-জাদুতে সম্পদ উপার্জন এবং চাঁপাবাজি প্রতিযোগিতা

শরীয়ত সম্মত পন্থায় পয়সা উপার্জনে দুষের কিছু নেই। জজ, উকিল ও ব্যরিষ্টারগণ এ নিয়মেই বেতনভূক্ত চাকুরী করে থাকেন। কিন্তু ভ্রান্ত কথা, ব্যবসায় মিথ্যা শপথ, আর অধিক চাঁপাবাজিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ-কে ইসলাম সম্পূর্ণ নিন্দা করে।
উমর বিন সাঈদ বিন আস রা. একদা পিতা বরাবর খুবই পাণ্ডিত্য ও সাহিত্যপূর্ণ ভাষায় একটি আবেদন পেশ করলেন। আবেদন পাঠ শেষ হলে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন- তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? ছেলে বলল- জ্বি হ্যাঁ..! পিতা বললেন- (ওহে বৎস্য! ভেবো না যে, তোমাকে আমি অবহেলা করছি অথবা তোমার আবেদন পূরণে আমি অসম্মত। তবে শুনে রাখ-) নবী করীম সা.কে আমি বলতে শুনেছি- “অচিরেই এমন জাতির আবির্ভাব হবে, যারা গরু-গাভীর মত -মুখ ব্যবহার করে উপার্জন করবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত ঘনিয়ে অন্যতম নিদর্শন হচ্ছেঃ
(১) অসৎ ব্যক্তিদের মর্যাদা দান
(২) সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের অসম্মান
(৩) অশ্লীল কথাবার্তা ব্যাপক আকার ধারণ
(৪) (দ্বীন ছাড়া) সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন
(৫) সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপক অনাচার প্রকাশ
‘ব্যাপক অনাচার-’ কি জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- আল্লাহর কালাম ছেড়ে যা কিছুই লেখা হবে, সবই অন্যায়।-” (তাবারানী)

(৫৭)
কোরআনকে অবহেলা-করণ, অনর্থক গ্রন্থের ছড়াছড়ি
কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, মানুষেরা প্রচুর পরিমাণে বই-পুস্তক পড়বে। বিভিন্ন বিষয়ের বই দিয়ে ঘরোয়া লাইব্রেরী সাজিয়ে তুলবে। কিন্তু কোরআন শরীফ শুভা পাবে না। কোরআনের জ্ঞান অবহেলা করে পার্থিব জ্ঞান অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

(৫৮)
কোরআনের পাঠক বেড়ে যাবে, জ্ঞানসম্পন্ন লোক কমে যাবে

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অচিরেই এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআনের পাঠক বেড়ে যাবে, দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞানসম্পন্ন লোক কমে যাবে, ওহীর জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে এবং সংঘাত বেড়ে যাবে। ‘সংঘাত’ কি জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- “পারস্পরিক হত্যাযজ্ঞ-”। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কোরআন পাঠ করা হবে, কিন্তু কোরআনের আয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করবে না (কোরআনের বিধান বাস্তবায়িত হবে না)। অতঃপর এমন এক জমানা আসবে, যখন কাফের, মুনাফেক, মুশরেক ব্যক্তি ইসলাম নিয়ে মুমিনের সাথে তর্কযুদ্ধ করবে।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
পরিস্থিতি আরও সঙ্কটময় হয়ে যাবে -যখন আলেমদের মৃত্যুতে এলেম উঠে যাবে। বিশুদ্ধ আলেমদের অনুপস্থিতিতে মানুষ মূর্খদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবে। মূর্খরা ভুল ফতোয়া দিয়ে নিজেরা-ও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদের-ও পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে।
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে জ্ঞানকে আল্লাহ আকস্মিক উঠিয়ে নেবেন না; বরং উলামাদেরকে উঠিয়ে নেবেন। অবশেষে যখন বিশুদ্ধ আলেম বলে কেউ থাকবে না, তখন মানুষ মূর্খদের শরণাপন্ন হয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবে। আলেম নামধারী মূর্খরা ভুল ফতোয়া দিয়ে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদের-ও পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে।-” (বুখারী-মুসলিম)
অর্থাৎ দ্বীনের জ্ঞানকে আল্লাহ পাক আকস্মিক মানুষের অন্তর থেকে উঠিয়ে নেবেন না; বরং দ্বীনের ধারক-বাহকদের উঠিয়ে নেবেন। বিগত দশ বছরের মধ্যেই সৌদি আরব বড় মাপের কয়েকজন আলেমকে হারিয়েছে।
সৌদি আরবের উচ্চতর উলামা পরিষদের প্রধান -শেখ আব্দুল আজীজ বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. -১৯৯৯ ইং-১৪২০ হিঃ সনে ইন্তেকাল করেন। আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন রহ. -২০০০ ইং-১৪২১ হিঃ সনে ইন্তেকাল করেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ১৯৯৯ ইং-১৪২০ হিঃ সনে ইন্তেকাল করেন।
বর্তমান সময়ে মুসলমানদের ধর্মীয় পরিস্থিতি যাচাই করলে দেখবেন যে, একদল যুবসম্প্রদায় সুমধুর কণ্ঠে কোরআন পাঠে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। রকমারি ডিজাইনে, নানান সুরে, বাহারি ভঙ্গিতে কোরআনের আওয়াজ ভেসে আসছে। অপরদিকে কোরআনের সঠিক শিক্ষা ও ইসলামী বিধি-বিধান নিয়ে গবেষণা করার মত লোক নেই। যারা কোরআন পাঠ সুমধুর করতে গিয়ে এত সময় ব্যয় করছে, তাদের কাউকে যদি আপনি পবিত্রতা সংক্রান্ত একটি মাসালা জিজ্ঞেস করেন বা ছহু সেজদা -কখন -কি কারণে দেওয়া লাগে -জিজ্ঞেস করেন, সঠিক উত্তরটি পাবেন না।

(৫৯)
তুচ্ছ ও স্বল্পজ্ঞানীদের কাছে এলেম অন্বেষণ

নবী যুগে মানুষ -খোদাভক্ত এবং মর্যাদাবান জ্ঞানীদের কাছে জ্ঞান অন্বেষণে যেত। কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে স্বল্পজ্ঞানী এবং নির্বোধ লোকেরা নিজেদেরকে আলেম বলে পরিচয় দেবে। আলেম ভেবে মানুষ তাদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবে। ভুল ফতোয়া দিয়ে তারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে থাকবে।
আবু উমাইয়া জুমাহী রা. থেকে বর্নিত, নবী করীম সা. বলেন- “স্বল্পজ্ঞানীদের কাছে জ্ঞান অন্বেষণে যাওয়া কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন।” ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ.কে ‘স্বল্পজ্ঞানী’র পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- “যারা ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করে-”।”
অর্থাৎ তাদের জ্ঞান পরিপক্ব হবে না। ফতোয়ার বিষয়ে তারা যাচাই-বাছাই করবে না। কোরআন-হাদিস ছেড়ে ব্যক্তিগত যুক্তি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করবে।
কেউ কেউ বলেন- এখানে স্বল্পজ্ঞানী বলতে কুসংস্কারী (বেদআতী) উদ্দেশ্য।
বর্তমান সময়ে (সৌদি আরবে) আলহামদুল্লিাহ ইসলামী জ্ঞান -পূর্ণ সংরক্ষণে রয়েছে। তবে মিডিয়া -স্বল্পবয়সী বহু নামধারী আলেমকে জনপ্রিয় করে তুলছে। মৌলিক বিষয়ে পারদর্শী হলেও দ্বীনের সকল বিষয়ে তারা পরিপক্ব নয়। তাদেরকে ফক্বীহ-এর কাতারে বিবেচনা করা হয় না। মানুষ মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করছে, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অন্বেষণে মনযোগী হচ্ছে। উচ্চ পর্যায়ের অনেক উলামায়ে কেরাম মিডিয়াতে আসেন না। তারা যদি বিভিন্ন টি ভি চ্যানেলে আসতেন, নিজেদের মতামতগুলো ইন্টারনেটে প্রচার করতেন, তাহলে মানুষ সহজেই তাদেরকে চিনতে পারত। ফতোয়ার জন্য তাদের-ই শরণাপন্ন হত।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরকম-ই ঘটছে। তবে বয়স বেশি হওয়া কিন্তু অধিক জ্ঞানের মাপকাঠি নয়। পক্ষান্তরে অল্পবয়স্ক হওয়া-ও কিন্তু মূর্খতার নিদর্শন নয়। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন- “জ্ঞান বয়সের সাথে সম্পৃক্ত নয়।” উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন- “বয়স কমবেশি হওয়া জ্ঞানের মাপকাঠি নয়; বরং আল্লাহ তা’লা (প্রচেষ্টা ও নিয়ত দেখে) যাকে ইচ্ছা -দান করেন।-”
মিডিয়াতে আগন্তুক স্বল্পজ্ঞানীদের বলছি, আপনারা স্বল্পতার গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ-স্তরে পৌঁছতে সচেষ্ট হোন। ব্যক্তিগত মতামতের উপর কোরআন-হাদিসকে প্রাধান্য দিন। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন..!!

(৬০)
আকস্মিক মৃত্যুর হার বৃদ্ধি

সম্প্রতি ঘটিত কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যে আকস্মিক মৃত্যু অন্যতম। হার্ড এ্যাটাক, হাই প্রেসার এবং ব্যাপক সড়ক দুর্ঘটনার ফলে অধিক হারে আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম বলেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যে -ব্যাপক হারে আকস্মিক মৃত্যু অন্যতম।-” (তাবারানী)
আগে মানুষ দুই-তিন দিন পূর্বে থেকে-ই মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে টের পেত। কিছুদিন বিছানায় অসুস্থ পড়ে থাকত। মরণ কাছিয়ে গেছে বুঝে -অসিয়ত লিখে রাখত। পরিবারের কাছে দোয়া ও বিদায় চাইত। সারা জীবনের পাপ থেকে আল্লাহর দরবারে তওবার সুযোগ পেত। বেশি বেশি কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করত।
কিন্তু এখন...!! শুনে থাকবেন যে, সুস্থ সবল পূর্ণ আরোগ্য ব্যক্তিটি হার্ড এ্যাটাক করে গত রাতে মারা গেছে..। অমুক মন্ত্রীর ছেলে পাঁচ বন্ধু সহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে..। সুতরাং জ্ঞানী মাত্র-ই সদা নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত রাখা চাই। গুনাহ হওয়ার সাথে সাথে তওবা করে নেয়া চাই।

(৬১)
নির্বোধ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব
কথায় আছে- নেতৃত্ব ঠিক থাকলে জনগণ ঠিক-। নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে। কোরআন-হাদিসে অবজ্ঞা প্রদর্শনকারী নির্বোধ ব্যক্তিদের -নেতৃত্বে আগমনকে নবী করীম সা. কেয়ামতের নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, একদা -কা’ব বিন উজরা রা.কে উদ্দেশ্য করে নবী করীম সা. বলতে লাগলেন- “নির্বোধ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে আল্লাহ পাক তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুন!” নির্বোধের নেতৃত্ব কি? -জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- “আমার পর এমন সব নেতা-নেত্রীদের আগমন হবে, যারা আমার আদর্শকে অবহেলা করবে। প্রচুর মিথ্যা কথা বলবে। সুতরাং যারা-ই মিথ্যুকদেরকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে, অপরাধ-দুর্নীতিতে তাদেরকে সহায়তা করবে, অবশ্যই তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমি তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। হাউজে কাউসারে -তারা আমার ধারে-কাছেও আসতে পারবে না। পক্ষান্তরে যারা মিথ্যুকদেরকে সত্যায়ন করেনি, অপরাধ-দুর্নীতিতে সহায়তা করেনি, তারাই আমার উম্মত। আমি তাদের পক্ষে থাকব। হাউজে কাউসারে তারা আমার কাছে আসবে। ওহে কা’ব বিন উজরা..! (জেনে রেখো!) রোযা হচ্ছে ঢাল, সাদাকা -পাপকে ধুয়ে দেয় এবং নামায হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায়। ওহে কা’ব বিন উজরা..! (জেনে রেখো!) অবৈধ উপার্জনে ক্রিত খাদ্যে যে মাংস শরীরে বেড়ে উঠল, তা কখনো-ই জান্নাতে প্রবেশ করবে না; বরং জাহান্নামের আগুনই তার জন্য অধিক মানানসই। ওহে কা’ব.! মানুষ প্রতিদিন (কর্ম শেষে) প্রত্যাগমন করে, কেউ নিজেকে বিক্রি করে দিয়ে আসে, কেউ (নিজেকে জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করে আসে।-” (মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে বাযযার)
অপর হাদিসে- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না প্রত্যেক জাতিকে মুনাফেক-রা নেতৃত্ব দেবে।-” এখানে মুনাফিক বলতে যাদের অন্তরে খোদাভীতি বলতে কিছু নেই, দুর্বল ঈমান, প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী এবং গণ্ডমূর্খ লোক উদ্দেশ্য।
এ রকম নির্বোধ গণ্ডমূর্খ ব্যক্তিরা -নেতৃত্বে আসার ফলে সমাজের আমূল বিবর্তন ঘটবে। মিথ্যুককে সত্যবাদী বলা হবে, সত্যবাদীকে -মিথ্যুক বলে অবহেলা করা হবে। ঘাতককে বিশ্বস্ত আর বিশ্বস্তকে ঘাতক মনে করা হবে। জ্ঞানীদের মুখ বন্ধ করে -মূর্খরা সমাজ নিয়ে কথা বলবে।
ইমাম শা’বী রহ. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে প্রকৃত জ্ঞান হয়ে যাবে মূর্খতা, আর মূর্খতা হয়ে যাবে প্রকৃত জ্ঞান।” এভাবেই দৃশ্যপট পাল্টে যাবে।-”
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, উৎকৃষ্টদের অবহেলা করা হবে এবং নিকৃষ্টদের মর্যাদা দেয়া হবে।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)

(৬২)
দ্রুত সময় পার
দ্রুত সময় পার হয়ে যাওয়াকে নবী করীম সা. কেয়ামতের নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “(কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে) দ্রুত সময় পার হয়ে যাবে। (দ্বীনের) জ্ঞান কমে যাবে। পর্যায়ক্রমে ফেতনা প্রকাশ হতে থাকবে। ব্যয়কুণ্ঠতা প্রকাশ পাবে। অধিক হারে সংঘাতের ঘটনা ঘটবে। ‘সংঘাত’ কি -জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বলেন- হত্যাযজ্ঞ... হত্যাযজ্ঞ...।-”
উলামায়ে কেরাম এখানে কয়েকটি সম্ভাবনার কথা বলেছেনঃ
(১) সময়ের বরকত শেষ হয়ে যাবে। পূর্ববর্তী লোকেরা (দ্বীনী বিষয়ে) যে কাজ এক ঘন্টায় সেরে ফেলত, পরবর্তীগণ কয়েক ঘন্টায়ে-ও তা পারবে না।
ইবনে হাজার রহ. বলেন- “আমরা দ্রুত সময় পার হওয়ার বিষয়টি অনুভব করছি। অথচ পূর্বের যুগে এমনটি ছিল না।-” (ফাতহুল বারী)
(২) মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ একে অন্যের কাছাকাছি হয়ে যাবে, কেউ কাউকে দূরে ভাববে না।
(৩) বাহ্যিক সংকোচন। হতে পারে শেষ জমানায় আল্লাহ পাক সময়কে দ্রুত করে দেবেন। আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে দিবস দীর্ঘ করতে পারেন, ইচ্ছা করলে সংকীর্ণ করতে পারেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে মহা ক্ষমতাবান।
কারণ, দাজ্জাল আবির্ভাবের প্রথম তিনদিন এরকম-ই হবে। প্রথম দিনটি এক বৎসরের ন্যায় দীর্ঘ হবে। দ্বিতীয় দিনটি এক মাসের ন্যায় দীর্ঘ হবে। তৃতীয় দিনটি এক সপ্তাহের ন্যায় দীর্ঘ হবে। তদ্রূপ আল্লাহ চাইলে দিবসকে সংকীর্ণ-ও করতে পারেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না সময় কাছাকাছি হয়ে যাবে। ফলে বৎসরকে মাসের মত মনে হবে। মাসকে সপ্তাহের মত মনে হবে। সপ্তাহকে এক দিনের মত মনে হবে। দিনকে এক ঘন্টার মত মনে হবে। এক ঘন্টাকে বাতাসে উড়ে যাওয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত মনে হবে।-” (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী)
(৪) কেউ কেউ এখানে -মানুষের আয়ু হ্রাস পাওয়া উদ্দেশ্য বলেছেন।

(৬৩)
জন-কল্যাণ বিষয়ে নির্বোধ ব্যক্তিদের বাক্যালাপ
নিয়ম তো হচ্ছে, রাষ্ট্র এবং জনগণের বিষয়ে শুধু জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই কথা বলবে। কিন্তু শেষ জমানায় জ্ঞানীদের অভাবে গণ্ডমূর্খরা জনকল্যাণ নিয়ে কথা বলবে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “(কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে) প্রতারণার যুগ আসবে, মিথ্যুককে তখন সত্যবাদী এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী প্রচার করা হবে। ঘাতককে বিশ্বস্ত আর বিশ্বস্তকে ঘাতক মনে করা হবে। জনগণের বিষয়ে তখন নির্বোধ গণ্ডমূর্খরা কথা বলতে থাকবে।-” (তাবারানী)
নির্বোধ গণ্ডমূর্খ-রা জ্ঞানীদের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। ফলে ক্ষমতা এবং শাসনকার্য সম্পূর্ণ তাদের হাতে থাকবে, যেমনটি বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
জনকল্যাণ ও বিচারব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে সবসময় জ্ঞানী, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞদেরকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

(৬৪)
পৃথিবীর সবচে’ সুখী ব্যক্তি হবে -‘লুকা’ বিন লুকা-’
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না পৃথিবীর সবচে’ সুখী ব্যক্তি হবে -‘লুকা’ বিন লুকা’।-” (তাবারানী)
আরবীতে দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে لكع (লুকা’) বলা হয়। নির্বোধ ও গণ্ডমূর্খ অর্থ বুঝানোর জন্য এর ব্যবহার বেশি হয়। এ কারণেই দুশ্চরিত্রা, খারাপ ও নষ্টা মহিলার ক্ষেত্রে-ও لكاع এর প্রযোজ্য হয়।
শেষ জমানায় এ রকম দুশ্চরিত্র ব্যক্তি -গাড়ী, বাড়ী, ধন সম্পদ, মর্যাদা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সবচে’ সুখী ব্যক্তি গণ্য হবে। হালাল-হারাম যাচাই না করে সব ধরনের সোর্স থেকে উপার্জন করবে।

(৬৫)
মসজিদকে পর্যটন ও পারাপারের পথ হিসেবে ব্যবহার
অর্থাৎ কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে মসজিদকে মানুষ -যাতায়াতের পথ ও পর্যটন কেন্দ্রের মত ব্যবহার করবে। নামায পড়তে নয়; মসজিদের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসবে।

(৬৬) (৬৭)
মুহরের মূল্য বৃদ্ধি অতঃপর হ্রাস, অশ্বের মূল্য বৃদ্ধি অতঃপর হ্রাস
খারেজা বিন সাল্ত বারজামী বলেন- “নামাযের উদ্দেশ্যে আমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদের সাথে ঘর থেকে বের হলাম। ইমাম তখন রুকুতে ছিলেন, আমরা রুকু করলাম। অতঃপর গিয়ে মুসল্লীদের সাথে কাতারে শরীক হলাম। তখন এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ’র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় “-আস সালামু আলাইকুম হে আবু আব্দুর রহমান”- বলল। উত্তরে তিনি “আল্লাহু আকবার! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন! নামায শেষে আমরা বললাম- “ব্যক্তি বিশেষে সালাম প্রদানকে কেন্দ্র করেই হয় আপনি তা বলেছিলেন!! বললেন- হ্যাঁ..! আমি নবী করীম সা.কে বলতে শুনেছি- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যেঃ
(১) মসজিদকে পারাপারের পথ হিসেবে ব্যবহার
(২) ব্যক্তি বিশেষে সালাম প্রদান
(৩) ব্যবসায় স্বামীর সাথে স্ত্রীর অংশগ্রহণ
(৪) মুহরের মূল্য বৃদ্ধি অতঃপর হ্রাস
(৫) এবং অশ্বের মূল্য বৃদ্ধি অতঃপর হ্রাস
একবার হ্রাস পেলে কেয়ামত অবধি আর মূল্য-বৃদ্ধি হবে না।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম, তাবারানী)

(৬৮)
বাজার ও দোকানপাট নিকটবর্তী হয়ে যাওয়া
বর্তমান কালে বাজারগুলো কাছাকাছি হয়ে গেছে। এক মার্কেট থেকে অন্য মার্কেটে যাতায়াত-ব্যবস্থা সহজ হয়ে গেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই মানুষ একাধিক শপিং-মল ঘুরে কেনাকাটা করে আসছে। টেলিভিশান, মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ আগেই পণ্যের নির্ধারিত মূল্য জানতে পারছে। কোনটা আসল, কোনটা নকল বাড়ীতে বসেই চিনতে পারছে।
রিক্সা, গাড়ী, টেক্সি, কার, মাইক্রো, বাস, ট্রেন ও বিমান ইত্যাদি অত্যাধুনিক যান-বাহন আবিস্কারের ফলে দূরের মার্কেট গুলো এখন আর দূরের মনে হয় না। শত শত মাইল দূর থেকে মানুষ রাজধানীর অভিজাত মার্কেটগুলোতে ঈদের বাজার করতে আসছে। বিয়ের মার্কেট করতে এক দেশ থেকে মানুষ অন্য দেশে যাচ্ছে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফেতনাসমূহ প্রকাশ পায়, মিথ্যার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং বাজারসমূহ নিকটবর্তী হয়ে যায়।-” (মুসনাদে আহমদ)
বাজার নিকটবর্তী হওয়া-র ব্যাখ্যা তিনভাবে করা যেতে পারেঃ
(১) বাজার-দর সম্পর্কে দ্রুত জ্ঞান হয়ে যাবে
(২) শত শত মাইল দূরে হওয়া সত্তেও এক বাজার থেকে অন্য বাজরে দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকবে।
(৩) এক মার্কেটের দর অন্য মার্কেটের কাছাকাছি হবে। সমিতি ভিত্তিকি চুক্তি করে ব্যবসায়ীগণ সব মার্কেটের দর সমান রাখবে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
শেখ আব্দুল আজীজ বিন বায রহ. উপরোক্ত হাদিসের নিম্নোক্ত ব্যাখ্যা করেছেনঃ
“সম্প্রতি আধুনিক সড়ক, পরিবহন ও বিমান আবিস্কারের ফলে দূর দূরান্তের শহরগুলি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। যাতায়াত ও ভ্রমণের জন্য এখন আর পূর্বের মত কষ্ট করতে হয় না। এক ঘন্টার ব্যবধানেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া যায়। হাদিসে কাছাকাছি হওয়ার অর্থ এভাবেই করা যেতে পারে।-”

(৬৯)
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সকল বিধর্মী রাষ্ট্রের একক অবস্থান
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে সকল বিধর্মী পরাশক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কিন্তু বরাবরের মত আল্লাহ মুসলমানদেরকে কাফেরদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করবেন।
ইতিহাসে আপনি পড়ে থাকবেন, মুসলিম বিশ্বের উপর দিয়ে এ পর্যন্ত অনেক ক্রান্তিকাল এবং ঝড়-ঝাপ্টা অতিবাহিত হয়েছে। প্রতিবারই আল্লাহ মুসলমানদেরকে রক্ষা করেছেন। প্রথম বার খৃষ্ট-সম্প্রদায় মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে বিজয়ী করেছেন। এরপর তাতারী সম্প্রদায় মুসলিম বিশ্বে আগ্রাসন চালিয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মুসলমান বানিয়ে মুসলিম বিশ্বের শক্তিকে আরো দ্বিগুণ করেছেন। সম্প্রতি ইহুদী-খ্রিষ্টান সমন্বিত ক্রুসেড-যুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব আক্রান্ত। সঠিক পথে ফিরে আসলে আল্লাহ তা’লা মুসলমানদেরকে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- “আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর।-” (সূরা হজ্ব-৪০) অপর আয়াতে- “আল্লাহ লিখে দিয়েছেনঃ আমি এবং আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।-” (সূরা মুজাদালা-২১)
ছাউবান রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “প্লেট সামনে রেখে যেমন একে অপরকে খাদ্যের জন্য ডাকাডাকি করে, ঠিক তেমনি সকল বিধর্মী জাতি মুসলমানদের নিঃশেষ একে অপরকে ডাকাডাকি করবে। -“সেদিন কি আমরা সংখ্যায় কম থাকব হে আল্লাহর রাসূল?” জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- না.! সংখ্যায় তোমরা অনেক থাকবে। তবে স্রোতের আবর্জনার মত। শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক উঠিয়ে আল্লাহ তোমাদের অন্তরে এক প্রকার লাঞ্ছনা গেঁথে দেবেন। ‘লাঞ্ছনা’ কি -জিজ্ঞেস করা হলে বললেন- ‘দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা এবং মৃত্যুর প্রতি বিতৃষ্ণা।-” (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)
বর্তমান সময়ে সকল কুফুরী মতবাদ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে। মুসলমানদের চেহারায় আজ লাঞ্ছনা আর অসহায়ত্বের ছাপ। সংখ্যায় কম বলে..?! না..! সংখ্যায় প্রায় দেড়শ কোটি। পৃথিবীর একচতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী। কিন্তু স্রোতের আবর্জনার মত তারা আজ বিক্ষিপ্ত। বিধর্মীদের অন্তরে আজ মুসলমানদের আতঙ্ক নেই। ইসলাম ও মুসলমানকে তারা আজ অবহেলা ও তিরস্কারের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
এত উজ্জ্বল অতীতেতিহাস থাকা সত্তেও মুসলমান আজ দুর্বল কেন..?! হ্যাঁ..! নবীজী সত্যই বলেছেন- “দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা এবং মৃত্যুর প্রতি বিতৃষ্ণা।-” আল্লাহ আমাদেরকে বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে ফিরে আসার তওফীক দান করুন।

(৭০)
নামাযের ইমামতিতে মুসল্লীদের ধাক্কাধাক্কি
আগেই পড়ে এসেছেন যে, দ্বীনের ব্যাপারে ব্যাপক মূর্খতা প্রকাশের ফলে নির্বোধ লোকদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাবে। এমনকি মসজিদে ইমামতি করার জন্যও তখন ভাল ইমাম পাওয়া যাবে না। ফলে ইমাম নির্ধারণে মুসল্লীরা ধাক্কাধাক্কি করবে। শরীয়তের বিষয়ে মূর্খ এবং ক্বেরাত অশুদ্ধ বলে কেউ-ই ইমামতি করতে চাইবে না।
ছালামা বিনতে হুর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর একটি হচ্ছে, নামাযের সময় মুসল্লীরা ইমাম নির্ধারণে ধাক্কাধাক্কি করবে। বিশুদ্ধ কোরআন পাঠ জানে -এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।-” (আবু দাউদ)
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বলেন- “এমন এক জমানা আসবে, যখন মানুষ মসজিদে সমবেত হয়ে নামায আদায় করবে। তাদের মধ্যে একজন মুমিন-ও পাওয়া যাবে না।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
বহিঃর্বিশ্বের কথা জানি না। তবে আরববিশ্বে (আলহামদুলিল্লাহ) এখন পর্যন্ত এমন কাল আসেনি। প্রতিটি শহরে জ্ঞানীগণ কাজ করে যাচ্ছেন। মসজিদে মসজিদে দ্বীনের দরস চালু আছে। শিক্ষার্থী এবং কোরআনের পাঠক-ও প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।
((আমাদের উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা আজ অবহেলার বস্তু। মুসলমান আজ বিধর্মী স্কুলমুখী। ধর্মহীন আধুনিক শিক্ষা-ই তাদের কাছে প্রকৃত শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষা যতটুকু আছে, তা-ও বন্ধ করার ষড়যন্ত্র। অনেক মসজিদ আছে, যেখানে হাজারো মুসল্লীর সমাগম হয়, কিন্তু একজন বিশুদ্ধ জ্ঞানীর দেখা পাওয়া যায় না। হাদিসের প্রেক্ষাপট আরব বিশ্বে তৈরি না হলে-ও অনারবে ঠিক-ই হয়ে গেছে।_ অনুবাদক))
(৭১)
মুমিনের সত্য-স্বপ্ন
মানুষ ঘুমের মধ্যে যা কিছু দেখে, তন্মধ্যে কিছু -প্রভাত-রবির ন্যায় সত্য। কিছু সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিছু দুঃস্বপ্ন। আর কিছু নফসের ধোকা। কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে মুমিনদেরকে আল্লাহ প্রচুর সত্য-স্বপ্ন দেখাবেন। কেয়ামতের নিদর্শন সম্বলিত বহু ইঙ্গিত তাতে দেয়া থাকবে।
মুমিনের সত্য-স্বপ্ন হচ্ছে নবুওয়তের ছয়চল্লিশ ভাগের এক ভাগ।
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার মৃত্যুর পর সুসংবাদ ছাড়া নবুওয়তের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ‘সুসংবাদ’ কি? -জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- মুমিনের সত্য-স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দেখানো হবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
সুসংবাদবাহী মুমিনের সত্য-স্বপ্ন কেয়ামত ঘনিয়ে আসার নিদর্শন। বিশৃঙ্খলা ও সঙ্কট যতই গভীর হতে থাকবে, ততই তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে থাকবে।
নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত যখন সন্নিকটে এসে যাবে, মুসলমানের স্বপ্ন তখন খুব কম-ই মিথ্যা হবে। কথায় যে বেশি সত্যবাদী, স্বপ্নেও সে অধিক সত্যবাদী বলে বিবেচিত হবে। মুসলমানের স্বপ্ন নবুওয়তের পয়তাল্লিশ ভাগের এক ভাগ। স্বপ্ন তিন প্রকারঃ
(১) আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ বাহক সু-স্বপ্ন
(২) অভিশপ্ত শয়তান কর্তৃক দুঃস্বপ্ন
(৩) ব্যক্তিগত কর্ম অনুযায়ী স্বপ্ন
তোমাদের কেউ যদি স্বপ্নে খারাপ ও ভয়ঙ্কর কিছু দেখে, সাথে সাথে উঠে যেন সে বাম দিকে থুথু নিক্ষেপ করে। দুঃস্বপ্নের বিবরণ কাউকে শুনানো থেকে বিরত থেকো! স্বপ্নে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় বন্দি থাকতে দেখা ভাল লক্ষণ। কিন্তু উভয় হাত ঘাড়ের পেছনে বাঁধা অবস্থায় দেখা খারাপ লক্ষণ। শিকল পায়ে বন্দি থাকার ব্যাখ্যা হবে, দ্বীনের উপর অবিচল থাকা।-” (মুসনাদে আহমদ, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ)
হাফেয ইবনে হাজার রহ. হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখেন- “শেষ জমানায় মুমিনের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না’-” এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, স্বপ্নগুলো সম্পূর্ণ সত্য ও বাস্তবসম্মত হবে। মিথ্যা বা সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। বাস্তবসম্মত হওয়ায় মুমিনের কাছে স্বপ্নটি সম্পূর্ণরূপে ধরা পড়বে। শেষ জমানায় মুমিন অপরিচিত (গরিব) থাকবে, যেমনটি হাদিসে এসেছে- “অপরিচিত অবস্থার মধ্য দিয়ে ইসলামের সূচনা। অচিরেই ইসলাম আবার অপরিচিত অবস্থায় ফিরে যাবে।” সত্য-স্বপ্নই হবে তখন মুমিনের একমাত্র সম্বল। সত্য-স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ পাক তাকে সুসংবাদ দেবেন। দ্বীনের উপর দৃঢ়-অবিচল থাকতে সাহায্য করবেন।-” (ফাতহুল বারী)
সত্য-স্বপ্ন দর্শনের কাল। দু-ধরনের সম্ভাবনাঃ
(১) যখন এলেম উঠিয়ে নেয়া হবে, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও ফেতনার দরুন শরীয়তের বিধি-বিধান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন-ই মুমিন অপরিচিত হয়ে যাবে। সে সময় দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তৎপর মুমিনদেরকে আল্লাহ অনেক সত্য স্বপ্ন দেখাবেন।
(২) অথবা ঈসা বিন মারিয়াম আ.-এর আসমান থেকে অবতরণকালে-ও এমন হতে পারে। কারণ, ঈসা আ.-এর জমানার মুমিনগণ সবচে’ সত্যবাদী মুমিন হিসেবে আল্লাহর কাছে বিবেচিত হবে। তাদের স্বপ্ন খুব কমই অবাস্তব থাকবে।

(৭২)
মিথ্যার ব্যাপক প্রচার প্রসার
সমাজে অত্যন্ত ন্যাক্কার ও ঘৃণিত একটি অভ্যাস হচ্ছে মিথ্যা বলা। মিথ্যুককে সবাই ঘৃণা করে। অধিক মিথ্যার কারণে এক পর্যায়ে আল্লাহর কাছে সে মহা-মিথ্যুক সাব্যস্ত হয়।
ঘরের ভেতর কেউ কখনো মিথ্যা বললে নিষ্ঠার সাথে তওবা না করা পর্যন্ত নবী করীম সা. তাকে অবজ্ঞা করতেন। কথা বলা বন্ধ করে দিতেন।
ব্যাপক হারে মিথ্যা বেড়ে যাওয়া -কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে মিথ্যাকে কেউ-ই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে না। কোথাও কিছু শুনলে যাচাই ছাড়াই তা অন্যের কাছে বর্ণনা করে দেবে।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “শেষ জমানায় প্রচুর মিথ্যুক দাজ্জালদের আবির্ভাব ঘটবে। কখনোই তোমাদের কানে পৌঁছেনি, এমন কথা তারা বর্ণনা করবে। তাদের থেকে তোমরা বেঁচে থেকো! অন্যথায় পথভ্রষ্ট করে তারা তোমাদেরকে ফেতনায় নিক্ষেপ করে দেবে।-” (মুসলিম)
জাবের বিন ছামুরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে কতিপয় মিথ্যুকদের আগমন ঘটবে, তাদের থেকে তোমরা নিরাপদ দূরত্বে থেকো!” (মুসলিম)
অন্তরে আল্লাহর ভয় হ্রাস পাওয়ায় প্রতিদিন কত মিথ্যা-সংবাদ এবং মিথ্যা কাহিনীর জন্ম হচ্ছে। এ কারণেই নবী করীম সা. আমাদের সতর্ক করে গেছেন- বিনা যাচাই-য়ে কোন কথাই বিশ্বাস করা যাবে না। মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করে, এমন কথা প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় আমরাও মিথ্যুকদের সাড়িতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব। আল্লাহ পাক আমাদেরকে রক্ষা করুন!!

(৭৩)
পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ
দুঃখ, কষ্ট আর ফেতনাসমূহ পর্যায়ক্রমে প্রকাশের ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকরণ এবং পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে। স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে চিনবে না।
হুযায়ফা রা. বর্ণনা করেন- নবী করীম সা.এর কাছে একবার -‘কেয়ামত কখন?’ জিজ্ঞেস করা হলে বলতে লাগলেন- “কেয়ামতের প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ-ই ভাল জানেন। মূল-সময়ে আল্লাহ ছাড়া কেউ এর প্রকাশ ঘটাতে পারবে না। তবে কেয়ামতের কিছু নিদর্শন তোমাদের বলে যাচ্ছি, ফেতনা এবং সংঘাত ব্যাপক হারে ঘটতে থাকবে। সংঘাতের অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে নবীজী বললেন- হত্যাযজ্ঞ এবং পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে যাবে। ফলে কেউ কাউকে চিনবে না।-” (মুসনাদে আহমদ)
শঙ্কা-টি বর্তমান জমানায় অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সকল সম্পর্কই এখন পার্থিব উদ্দেশ্যে স্থাপিত হচ্ছে। স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে চিনতে চায় না। ফলে স্বার্থ উদ্ধারের সাথে সাথেই সম্পর্কহানি ঘটছে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস দুর্বল হওয়ায় পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেতে চলেছে।

(৭৪)
অধিক হারে ভূ-কম্পন
অধিক হারে ভূ-কম্পন -কেয়ামতের অন্যতম নিদর্শন। হয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপ মার্জনা ও রহমত স্বরূপঃ
যেমন, আবু মুছা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “আমার উম্মত অনুগ্রহপ্রাপ্ত। আখেরাতে তাদের কোন শাস্তি নেই। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, অধিক ভূ-কম্পন ও ফেতনাসমূহের মাধ্যমে শাস্তির পালা তাদের দুনিয়াতে-ই শেষ।-” (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
অথবা অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় শাস্তি স্বরূপঃ
যেমন, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না (দ্বীনের) জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হয় এবং অধিক হারে ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয়।-” (বুখারী)
আব্দুল্লাহ বিন হাওয়ালা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “ওহে ইবনে হাওয়ালা! যখন জেরুজালেমে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা হয়েছে -দেখতে পাবে, (মনে রেখো) তখন অধিক ভূ-কম্পন, আসমানী বিপদাপদ এবং কেয়ামতের বৃহত্তম নিদর্শনাবলী প্রকাশের সময় কাছিয়ে গেছে। (সাহাবীর মাথার উপরে হাত নিয়ে নবীজী বলেন-) কেয়ামত তখন তোমার মাথা থেকে আমার হাত অপেক্ষা মানুষের অধিক নিকটে।-” (আবু দাউদ)

(৭৫) (৭৬)
পুরুষ হ্রাস, মহিলা বৃদ্ধি
কেয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে পুরুষ হ্রাস পাওয়া এবং নারী জাতি বৃদ্ধি পাওয়া।
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে অধিক সংঘাত ও হত্যাযজ্ঞের দরুন পুরুষ নিঃশেষ হতে থাকবে।
কেউ কেউ বলেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে অধিক হারে মুসলমানদের বিজয় উদ্দেশ্য। বন্দী হিসেবে তখন প্রচুর দাসী তাদের হস্তগত হবে।
ইবনে হাজার রহ. বলেন- “হাদিসের বাহ্যিক অর্থে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, অন্য কোন কারণে নয়; কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে এমনিতেই আল্লাহ পুত্র-সন্তান জন্মের হার কমিয়ে কন্যা-সন্তান বাড়িয়ে দিবেন।”
আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যেঃ
(১) (দ্বীনের) জ্ঞান উত্তোলন
(২) (দ্বীনের ব্যাপারে) ব্যাপক মূর্খতা প্রকাশ
(৩) মদ্য-পান
(৪) (যিনা) ভ্যবিচার ব্যাপকতা লাভ
(৫) পুরুষ হ্রাস
(৬) এবং মহিলার সংখ্যা বৃদ্ধি। এক পর্যায়ে পঞ্চাশ জন মহিলার দায়ভার একজন পুরুষ গ্রহণ করবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
বর্তমান বিশ্বে কন্যা সন্তান জন্মের হার এবং আন্তর্জাতিক জরিপগুলো যাচাই করলেই বুঝতে পারবেন যে, নিদর্শনটি সূচনা হয়ে গেছে এবং দ্রুত সামনের দিকে এগুচ্ছে।

(৭৭)
ব্যাপক ও খুলাখুলি অশ্লীলতা প্রকাশ
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে গান-বাজনা, মদ্য পান এবং কু-প্রবৃত্তি পূরণের মাধ্যমগুলো সহজ ও ব্যাপক হয়ে যাবে। এমনকি দিনে দুপুরে রাস্তাঘাটে যুবক-যুবতী যৌনাচারে লিপ্ত হবে।
প্রথমতঃ ভ্যবিচার প্রকাশ পাবে
দ্বিতীয়তঃ লুকিয়ে নয়; ব্যাপক ও খুলাখুলি যৌনাচার চোখে পড়বে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “কেয়ামতের নিদর্শনাবলীর মধ্যেঃ
(১) ভূ-পৃষ্ঠে এমন কেউ থাকবে না, যার প্রতি আল্লাহর কোন প্রয়োজন আছে (অর্থাৎ আল্লাহর কাছে যার সামান্য মূল্য আছে)
(২) রাস্তা-ঘাটে খোলামেলা যৌনাচার চোখে পড়বে, বাঁধা দেয়ার কেউ থাকবে না। সে কালের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি সেই, যে সাহস করে বলবে- রাস্তা থেকে সরে গিয়ে একটু আড়ালে যদি এই কাজ করতে!! সে কালে সে-ই এ কালে তোমাদের আবু বকর-উমর সদৃশ।-” (মুস্তাদরাকে হাকিম)
বর্তমান কালে নিদর্শনটি বাস্তবায়ন লক্ষ করা যাচ্ছে। টিভি পর্দায় প্রতিদিন হাজারো অশ্লীল-নোংরা দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। ইন্টারনেটে খুলাখুলি যৌনাচারের দৃশ্য-প্রচার -ব্যাপক করে যুব সম্প্রদায়কে ভ্যবিচারে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এহেন পরিস্থিতিতে মুমিন মাত্র-ই আল্লার কাছে বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থণা করতে হবে। নিজেকে সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে পবিত্র রাখতে হবে। সর্বদা দৃষ্টি নিচের দিকে রাখতে হবে। লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে হবে। টেলিভিশনের সামনে বসে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং দুষ্টু বন্ধু-বান্ধবের সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন! আমীন!

(৭৮)
কোরআন পড়ে বিনিময় গ্রহণ
কোরআন পাঠ করা সুমহান এক এবাদত। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সর্বোত্তম উপায়। উপার্জনের উপকরণ নয়; কোরআন পাঠ নিতান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া চাই।
কেয়ামতের পূর্বমুহূর্তে একদল ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে, যারা জনসমাবেশে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পয়সা উপার্জনের লক্ষে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন পাঠ করবে।
একদা প্রখ্যাত সাহাবী ইমরান বিন হুছাইন রা. মানুষের সামনে কোরআন পাঠে লিপ্ত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কোরআন পাঠ শেষে ব্যক্তিটি লোকদের কাছে কিছু মাল চাইলে তিনি -ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ূন- বলে উঠলেন। বলতে লাগলেন- আমি নবী করীম সা.কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোরআন পড়ল, এর বিনিময় সে যেন একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থণা করে। কারণ, অচিরেই একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যারা কোরআন পড়ে মানুষের কাছে বিনিময় আশা করবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. বলেন- একদা আমরা কোরআন পাঠে লিপ্ত ছিলাম, আমাদের মধ্যে আরব-অনারবের সংমিশ্রণ ছিল। নবী করীম সা. আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন- শ্রেষ্ঠ কাজ! পড়তে থাকো! (আর মনে রেখো!) অচিরেই একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যারা সুমধুর কণ্ঠে কোরআন পড়ার চেষ্টা করবে। আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়াতেই তারা এর বিনিময় আশা করবে।-” (আবু দাউদ)

(৭৯)
দেহে মাংসলতা ও স্থূলতা বৃদ্ধি
ইমরান বিন হুছাইন রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “সর্বোত্তম যুগ আমার যুগ। এরপর আমার সাহাবীদের যুগ। এরপর তৎপর-বর্তীদের যুগ। এরপর এমন লোকদের আবির্ভাব হবে, যারা বিনা সাক্ষ্য কামনায় সাক্ষ্য দিবে। বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাদের কাছে আমনত রাখা হবে না। মানত করেও পূরণ করবে না। তাদের দেহে মাংসলতা ও স্থূলতা প্রকাশ পাবে।-” (বুখারী-মুসলিম)
রকমারি সুস্বাদু খাবার এবং অত্যাধুনিক সব হোটেল-রেস্তোরা গড়ে উঠার ফলে হয়ত মানুষের দেহে স্থূলতা দেখা দেবে। দৈহিক পরিশ্রমের ক্ষেত্র কমে যাবে। অত্যাধুনিক যানবাহন আবিস্কারের ফলে যাতায়াতে কষ্ট হবে না। এভাবেই ছোট-বড় সকলের দেহে মাংসলতা দেখা দেবে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত জরিপমতে- পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ মানুষ অতিরিক্ত মেদ সমস্যায় আক্রান্ত।
এ কারণেই অতিরিক্ত ওজন কমাতে আজকাল বহু ইলেক্ট্রিক যন্ত্র আবিস্কৃত হয়েছে। টিভি পর্দায় নিয়মিত ব্যায়ামের ট্রেনিং প্রচারিত হচ্ছে।

(৮০) (৮১)
বিনা সাক্ষ্য কামনায় সাক্ষ্য প্রদান, মানত করে অপূরণ
উপরোক্ত হাদিসেই এর বিবরণ গত হয়েছে। দ্বীন নিয়ে অবহেলা, দুর্বল ঈমান এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে হ্রাস পাওয়ায় এ জাতিয় ঘটনা বহুল পরিমাণে ঘটতে থাকবে।

(৮২)
সবল দুর্বলকে খেয়ে ফেলবে
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, -হে আয়েশা! তোমার গোত্র সবার আগে আমার সাথে মিলিত হবে!- বলতে বলতে নবী করীম সা. একদা আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। বসার পর বললাম- হে আল্লাহর রাসূল! -আপনার জন্য আমার প্রাণ কুরবান- ঘরে ঢুকেই আপনি এমন হৃদয়বিদারক কথা বললেন? নবীজী বললেন- হ্যাঁ.! বললাম- এটা কেন হবে? বললেন- কারণ, মৃত্যু তাদেরকে চারদিক থেকে গ্রাস করে ফেলবে। সবাই তাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করবে। বললাম- সে সময় মানুষের অবস্থা কেমন হবে? বললেন- ঘাস-ফড়িংয়ের ন্যায় সবলরা দুর্বলদের খেয়ে ফেলবে। কেয়ামত পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে।-” (মুসনাদে আহমদ)
নবীজীর মৃত্যুর পরপরই মহা ফেতনা এসে উম্মতকে গ্রাস করে ফেলবে, সবলরা দুর্বলদের চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে- এ ইঙ্গিত-ই হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

(৮৩)
আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানে অবহেলা
মুসলমানদের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোরআনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ফরয। আল্লাহ পাক বলেন- “যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।-” (সূরা মায়েদা-৪৪)
শেষ জমানায় ইসলামের মৌলিক সিড়িগুলো এক এক করে ভেঙ্গে পড়বে। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে কোরআনের শাসন।
আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন- “অবশ্যই ইসলামের স্তম্ভগুলো একে একে ভেঙ্গে পড়বে। একটি ভেঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষ অপর স্তম্ভকে ধরে ফেলবে। সর্বপ্রথম ভাঙবে- কোরআনের শাসন। সর্বশেষে- নামায।-” (মুসনাদে আহমদ, তাবারানী)
মহা পরিতাপের বিষয়- আজকাল অধিকাংশ মুসলিম দেশে কোরআনের বিধান অবহেলার বস্তু। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো বহু আগে থেকেই; এমনকি আজকাল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়েও কোরআনের বিধান উপেক্ষিত হচ্ছে। বিবাহ, তালাক, মৃতের ত্যাজ্য সম্পদ বন্টন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অপরাধ-দণ্ড ইত্যাদি বিষয়-ও এখন বৃটিশ প্রবর্তিত শাসন-নীতি অনুসারে প্রয়োগ হচ্ছে, যা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের সরাসরি অস্বীকার। আল্লাহ পাক বলেন- “আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?” (সূরা মায়েদা-৫০)

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম