উস্তাদ মোহাম্মদ আল লাইসী যখন হাসপাতালে পৌঁছান তখন হাসানুল বান্না জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার মুখ থেকে কালেমায়ে শাহাদাতের বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। যিনি সারা জীবন এই কালেমার মর্যাদা উচ্চে তুলে ধরার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি কি করে আজ তা থেকে অচেতন থাকতে পারেন! অতিবাহিত হওয়া প্রতিটি মুহূর্ত তিনি জীবন থেকে দূরে এবং মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থান করছেন। কিন্তু মুখমণ্ডলে ভয়ভীতি কিংবা সন্ত্রস্ত ভাবের পরিবর্তে প্রশান্তির আলোর ঝিলিক ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। মহান রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় বান্দাকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন, হে প্রশান্ত আত্মা তোমার প্রভুর দিকে আনন্দ বিভোর চিত্তে ফিরে আসো। প্রবেশ করো আমার প্রিয় বান্দার অন্তরে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে। ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত নাড়িতে হাত রেখে সত্যের সূর্যের অস্তমিত হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করেন। জরুরি বিভাগে জমায়েত ইখওয়ান কর্মীরা বলে উঠেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এর সাথে সাথে অসংখ্য চোখ থেকে নেমে আসে অশ্রুর বন্যা।
মুসলমানদের ঘরে ঘরে শোকের ছায়া নেমে আসে। এর বিপরীতে ইংরেজ ও ইহুদীদের ঘরে ঘরে ঘিয়ের বাতি জ্বালানো হয়। তাদের এই আনন্দের কারণ ছিল তারা মুসলমানদের মাধ্যমেই মুসলমানদের একজন নিষ্ঠাবান পথ প্রদর্শক নেতাকে হত্যা করাতে সক্ষম হয়েছে। অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠী হাসানুল বান্নাকে শহীদ করে দিলেও ভেতরে ভেতরে তারা ছিল ভীত সন্ত্রস্ত। গণবিস্ফোরণের ভয়ে শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। কাউকেই জানাযার নামাযে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়নি। হাসানুল বান্নার ছোট ভাই অন্যান্য ইখওয়ান কর্মীর সাথে জেলখানায় বন্দি ছিলেন। তার বাড়িতে কয়েকজন মহিলা ও বৃদ্ধ বাবা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। সেই মহাবীর যিনি লাখো মানুষের অন্তরকে ঈমানে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলেন, আজ তার নামাযে জানাযা তার বৃদ্ধ পিতা আহমদ আল বান্নাকে একাই পড়তে হচ্ছে। আর নিজের প্রকম্পিত হাতে কলিজার টুকরা নয়নের মণি পুত্রের লাশ তার সর্বশেষ বিশ্রামাগারে পৌঁছানোর জন্য কয়েকজন মহিলার সাহায্য নিতে হচ্ছে।
পুলিশ হত্যার অভিযোগ সা’দ পার্টির ওপর আরোপ করে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা গাড়ির নাম্বার বলে দেয়ায় গোয়েন্দা পুলিশ বেকায়দায় পড়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা মেজর আল জাজার গাড়ির নাম্বার প্রকাশকারী সাক্ষীকে মেজর আল জাজার এই বলে হুমকি দেয় যে, হাসানুল বান্নার হত্যাকারী স্বাধীন এবং সে ভবিষ্যতেও স্বাধীন থাকবে। যে ব্যক্তি তাকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করবে সে নিজেও নিরাপদ থাকবে না। তোমার পরিবার পরিজন রয়েছে। তুমি নিজের সন্তানদের এতিম বানানোর জন্য কেন এত উৎসাহী হয়ে উঠেছো?
হাসানুল বান্নার শাহাদতের ঘটনায় সমগ্রী নীল উপত্যকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকারি জুলুম-নির্যাতনে চারদিকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। দেশের জন্য জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী জনগোষ্ঠীকে দেশদ্রোহী ও গাদ্দার বলে আখ্যায়িত করা হয়। অগভীর দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ মনে করে যে, এ আন্দোলনের মূলোৎপাটন করা হয়ে গেছে। এরা আর কখনই উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ঈমানের পরীক্ষা ইখওয়ানের জন্য অগ্নিকুণ্ডলী হয়ে আসে, কেউ কেউ এ জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে ব্যর্থ হলেও তাদের অধিকাংশই সেখান থেকে খাটি সোনা হয়ে বেরিয়ে আসেন। তাদের ঈমান ও আনুগত্যের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইমাম হাসানুল বান্নার (র.) জীবনের অবসান হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের রক্তের স্রোতের সাহায্যে এমন এক আলোক শিখা জ্বালিয়ে গেছেন যার সাহায্যে নীল উপত্যকার পথিক অন্ধকারের বক্ষবিদীর্ণ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে পথ চলতে সক্ষম হবে। প্রতিপদক্ষেপে ও প্রতিটি গন্তব্যে ইমাম শহীদের এ বাণী ইখওয়ান কর্মীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে থাকে।
হাসানুল বান্না (র.) বলেছেন, হে আমার ভাইয়েরা। বিশেষ করে ঐসব ভাই যারা অতি উৎসাহী ও দ্রুত ফলাফল প্রত্যাশী, শুনে রাখো! তোমাদের চলার এ পথ, নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত। এর সীমারেখা ও মনজিলের চিহ্ন আগে থেকে নির্ধারণ করা আছে। আমি এ সকল সীমারেখা দেখে শুনে এবং জেনে বুঝেই গ্রহণ করেছি। আর এগুলো সঠিক হওয়ার ব্যাপারে আমার অন্তর নিঃশঙ্ক ও প্রশান্ত। আমি কখনই এর বিপরীত আচরণ করতে কিংবা ভাবতে প্রস্তুত নই। এ পথ দীর্ঘ ও বন্ধুর। কিন্তু একমাত্র সঠিক পথ এটাই। অতি আগ্রহ ও দ্রুততার নাম বাহাদুরী নয়, বরং সত্যিকার বীরত্ব ও বাহাদুরী ধৈর্য, দৃঢ়তা ও স্থিরতা এবং সুস্থির চিত্তের মাঝে লুকায়িত। তোমাদের মধ্যে হাতের মুঠোয় যারা সরিষা জমা করতে আগ্রহী, তারা জেনে রাখ, এ আন্দোলনের ময়দান তার জন্য নয়। যারা পাকার আগেই ফল ছিঁড়তে চায় এবং ফোটার আগেই যারা ফুলের সাথে খেলা করতে চায়-তাদের সাথে খাপ খাওয়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের প্রতি আমার আন্তরিক উপদেশ হলো, তারা যেন এ আন্দোলন ছেড়ে অন্য কোনো আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়।
হে আমার মুসলমান ভাইয়েরা! যারা ধৈর্য ও দৃঢ়তাসহ আমার সাথে নির্ধারিত পথে অবস্থান করতে চায়, তাদের জেনে রাখা উচিত, প্রথমে বীজ বপন করা হয়, এরপর তাতে অঙ্কুর গজায়, এরপর চারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। নির্ধারিত সময়ের পর ফুল ফোটে ও ফল আসে। প্রতীক্ষার পর ফল পাকে, এর পরই আসে ফল আহরণের সময়। যে ব্যক্তি এ নীতিমালা উপলব্ধি করতে পেরেছে তার কর্তব্য হলো এ সফর অব্যাহত রাখা এবং তার প্রতিদান আল্লাহর হাতে। আল্লাহ পুণ্যবানদের প্রতিদান কখনো বিনষ্ট করেন না। তিনি আমাদেরকেও আমাদের প্রাপ্য হতে বঞ্চিত করবেন না। এ প্রতিদান, সাফল্য ও বিজয়ের মাধ্যমে আসতে পারে কিংবা শাহাদাতের গৌরবান্বিত পোশাক পরিধানের মাধ্যমেও দেয়া হতে পারে।
তিন বছর বিচার কার্য চলার পর প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকার পরও অপরাধীদের ধরার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। বরং তাদেরকে সরকারি দফতরে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অবশেষে ১৯৫২ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর এগারজন দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের অপকর্মের শাস্তি প্রদান করা হয়।
অধ্যায় ২১ : নীলের তীরে সূর্যাস্ত
দশটি উপদেশ
* অবস্থা যাই থাকুক, আযানের আওয়াজ কানে আসামাত্র নামাযের জন্য উঠে পড়ো।
* তুমি কোরআন তেলাওয়াত কিংবা অধ্যয়ন যাই করো অথবা অন্য কারোর কাছ থেকে শোন, জেনে রাখ, তুমি তোমার সময়ের কোনো অংশ অর্থহীন ব্যয় করোনি।
* বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করবে। কেননা এ কাজটিও ইসলামী চেতনার অন্তর্ভুক্ত।
* যে কোনো ব্যাপারেই অতিরিক্ত তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে কোন কাজ করবে না। কেন না, বিতর্ক ও অধিক পর্যালোচনা থেকে ভালো কোনো পরিণতি লাভ করা সম্ভব হয় না।
* বেশি হাসবে না, যে অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত তা অতিশয় নীরব হয়ে থাকে।
* অতি উচ্চ আওয়াজে কথা বলবে না। কারণ এতে অহংকারও থাকে এবং অন্যের জন্য কষ্টের কারণও থাকে।
* ঠাট্টা মশকরা ও হালকা আচরণ করবে না, কেননা জাতির মুজাহিদরা ধীর স্থিরতা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট নয়।
* পর নিন্দা, পর চর্চা ও অন্যের প্রতি মিথ্যা দোষারোপ থেকে বিরত থাকো। তোমার মুখ থেকে কল্যাণকর কথা ছাড়া আর কিছু যেন বের না হয়।
* যে কোনো ব্যক্তির সাথেই তোমার দেখা হোক তার কাছে নিজের পরিচয় দাও, এটা তার মনপূত হোক বা না হোক। কেননা, আমাদের দাওয়াতের ভিত্তি ভালোবাসা ও পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল।
* কর্তব্য বা করণীয় সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং নিজের বন্ধুদের পুরোপুরি সাহায্য করো যাতে নিজেদের সময় থেকে অধিকতর কল্যাণ লাভ করতে পারে। তোমার ওপর যদি বিশেষ কোনো কাজের দায়িত্ব থাকে তাহলে যত কম সময়ে সম্ভব তা পালন করার চেষ্টা করো।
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: