রাতের শেষ প্রহর। নারী নেত্রী জয়নব আল গাজালী তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে জেগেছেন। এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। তিনি দরজায় এসে জিজ্ঞেস করেন, কে? ‘আমি আমিন খলিল, মাননীয়া।’ জয়নব ্আল গাজালী জিজ্ঞেস করেন, ভালো আছেন তো? এ সময়ে? আমিন খলিল বলেন, খবর ভালো নয়। অনেক রাতে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাই। কিন্তু আমি সে সময় আপনার ঘুম ভাঙানো সঠিক মনে করিনি। আমার জানা ছিলো আপনি তাহাজ্জুদের সময় জাগেন, এ জন্যই এখন চলে এলাম। জয়নব আল গাজালী অপারগতার কণ্ঠে বলেন, ভাই, মাফ করবেন! এ সময় বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই, আপনাকে বসতে দিতেও পারছি না। আমিন খলিল বলেন, বসার মতো সময় আমার হাতেও নেই। আমাকে এুণি আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখী গাড়িতে ওঠে পড়তে হবে। আপনাকে শুধু এটাই বলতে চাচ্ছি যে, আপনি যে কোনোভাবে শাইখ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করে তাকে জানিয়ে দিন যে, এ মুহূর্তেই তিনি যেন কায়রো ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। আমাকে রাতের আঁধারেই কায়রো ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের রাজনৈতিক অফিসের প্রধান কর্মকর্তা মেজর আল জাজারের দফতরে তিনজন কর্মচারী বসা। কামরায় চূড়ান্ত নীরবতা বিরাজমান। অস্থিরতায় পায়চারীরত মেজর আল জাজারের বুটের আওয়াজই শুধুমাত্র শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই নিচে গাড়ি থামানোর শব্দ পাওয়া গেলো। মেজর স্বগতোক্তি করে বলেন, সম্ভবত তারা এসে গেছে। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা যায় এবং এরপরই দুই ব্যক্তি কামরায় প্রবেশ করে। এদের একজনের পরনে ছিলো পুলিশের পোশাক। কাঁধে লাগানো তারকার ব্যাজ যা তার পুলিশ অফিসার হওয়ার সাক্ষ্য বহন করছে। অপর ব্যক্তি কেতাদুরস্ত মিসরী পোশাকে সজ্জিত। কামরায় বসে থাকা পুলিশ কর্মচারীরা তাদের আগমনে দাঁড়িয়ে যায়।
পুলিশ কর্মকর্তা তার সাথে আগত ব্যক্তির পরিচয় করাতে গিয়ে বলেন, ইনি হচ্ছেন মহামান্য মিসর অধিপতি শাহান শাহের বিশেষ সেবক মোহাম্মদ হাসান। এখন ঐ বিশেষ কাজটি সমাধা করার সার্বিক দায়িত্ব তদারকির কাজ মহামান্য বাদশাহ হুজুর তারই ওপর ন্যস্ত করেছেন। এখন আপনি বলুন আপনার প্রস্তুতির অবস্থা কোন পর্যায়ে? “জী, জী! ‘শিকার’ পাঁচটার পরই আবেদীন সড়কে অবস্থিত যুবসংঘের কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে। আমাদের অনুমান, মাগরেবের পরই সে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। সে বাইরে আসার সাথে সাথেই এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যাবে। তিনজন শিকারী এ কাজে নিয়োজিত আছে। এক শিকারী যুবসংঘের অফিসের প্রতি খেয়াল রাখবে আর দুইজন শিকারের ওপর হামলা চালাবে। এ কাজের জন্য পুলিশের ফৌজদারী বিভাগের গাড়িই সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হবে। কেননা, এগুলোর রং কালো এবং অন্ধকারে এগুলোকে চেনা সম্ভব হবে না। ঐ গাড়িতে চড়েই শিকারীরা চম্পট দিবে।” মেজর আল জাজার এভাবেই তার পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেন। নবাগত পুলিশ কর্মকর্তা সম্মতি সূচক মাথা হেলিয়ে বলেন, ঠিক আছে।
মেজর আল জাজার বাদশাহ ফারুকের খাস চামচার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনি এখন আপনার ড্রাইভার সার্জেন্ট মাহফুজকে নির্দেশ প্রদান করুন। আপনিও এ ব্যাপারে সক্রিয় পথ নির্দেশনার কাজ করুন। বাদশাহের খাস চামচা বলে, আপনারা জেনে রাখুন, শিকার কোন অবস্থায়ই আজ বাঁচতে পারবে না। বাদবাকি কাজকর্ম আমি নিজেই সামলিয়ে নিবো। মহামান্য বাদশাহ ও গোটা সরকারের দৃষ্টি এখন আপনাদের তৎপরতার প্রতি নিবদ্ধ। এ কাজের বিনিময়ে আপনারা এমন কিছু পাবেন যা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। আর হ্যাঁ, উস্তাদ নাগীর কানে যেন এ পরিকল্পনার ক্ষীণ আওয়াজও না পৌঁছাতে পারে।
উস্তাদ মোহাম্মদ আল লাইসীর নির্ধারিত সময় মোতাবেক হাসানুল বান্না তার ভগ্নিপতি আবদুল করিম মনসুরকে সাথে নিয়ে আবেদীন সড়কে অবস্থিত মুসলিম যুবসংঘের অফিসে পৌঁছান। উস্তাদ নাগীর সাথে যে আলাপ-আলোচনা হয় তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিণতিতে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। মাগরেবের নামাযের সময় হয়ে গেলে তিনি সেখানেই নামায আদায় করেন। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ভগ্নিপতিকে সাথে নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ পর ঐ ভবন থেকে বেরিয়ে সড়কে এসে দাঁড়ান। এ সময় হাসানুল বান্না একটি টেক্সি ডাকেন। উস্তাদ মোহাম্মদ আল লাইসী হাসানুল বান্নাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তা পর্যন্ত আসেন। পেছন থেকে অফিসের পিয়ন উস্তাদ আল লাইসীকে ডেকে জানায় যে, তার সাথে কথা বলার জন্য কোনো এক ব্যক্তি টেলিফোনে অপেক্ষা করছেন। তিনি হাসানুল বান্না ও তার সঙ্গীকে সেখানে রেখেই আবার অফিসে ঢোকেন।
হাসানুল বান্না তখনো টেক্সিতে বসেননি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ঠিক সে মুহূর্তে কাছেই ছায়ার মতো এক ব্যক্তির আগমন ঘটে। লোকটি টেক্সির কাছাকাছি আসামাত্রই চারদিক প্রকম্পিত করে গুলির আওয়াজ শোনা যেতে থাকে। হাসানুল বান্না ‘আমাকে হত্যা করা হয়েছে, আমাকে হত্যা করা হয়েছে’ বলতে বলতে দ্রুত যুবসংঘের অফিসে প্রবেশ করেন।
হাসানুল বান্নার শরীরে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করে নিজেই হাসপাতালে ফোন করে এ্যাম্বুলেন্স ডাকার ব্যবস্থা করেন। উস্তাদ মোহাম্মদ আল লাইসী গুলির আওয়াজ শুনে টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে গুলির উৎসস্থল বোঝার জন্য আবার অফিসের বাইরের দিকে দৌড়ান। হালকা আলোতে তিনি তার অফিসের সামনে ট্রাকের ওপর দাঁড়ানো সুঠামদেহী এক যুবককে দেখতে পান। যুবকটি ওভারকোট ও মাথায় সাদা রুমাল পরিহিত। তার হাতে ছিলো পিস্তল। উস্তাদ আল লাইসী তাকে ধরার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে সে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ঘটনাচক্রে তার গায়ে গুলি লাগেনি। তিনি যুবকটির পিছে ধাওয়া করলে সে দ্বিতীয়বার গুলি ছোড়ে।
এবারও তার নিশানা ব্যর্থ হয়। এরই মধ্যে যুবকটি রাস্তার অপর পাড়ে চলে যায়। রাস্তার ঐ পাড়ে আরেকজন তার অপেক্ষায় ছিলো। তারা আগে থেকে স্টার্ট দিয়ে রাখা একটি গাড়িতে উঠে দ্রুত পালিয়ে যায়।
উস্তাদ আল লাইসী অফিসে ফিরে এসে দেখেন টেলিফোনকারী এখনো লাইনে অপেক্ষা করছে। তিনি ফোন হাতে নেয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে, আমি মেজর আল জাজার গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার বলছি। উস্তাদ আল লাইসী পুলিশের নাম শুনে তার কথার মাঝখানে বলেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে জনাব! এখানে এইমাত্র সংঘ অফিসের সামনে হাসানুল বান্নার ওপর ভয়াবহ হামলা হয়েছে। অপরপ্রান্ত থেকে তাচ্ছিল্য ও ঔৎসুক্যের সাথে জিজ্ঞেস করা হয়, সে কি মারা গেছে নাকি এখনো বেঁচে আছে। উস্তাদ জবাব দেন, বলতে পারছি না। এ্যাম্বুলেন্স তাকে ও তার আহত সঙ্গীকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
এ্যাম্বুলেন্স আহত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে কাসরুল আইনী হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে হাসপাতালে নির্দেশ পৌঁছায় যে, হাসানুল বান্নার জখম থেকে রক্ত ঝরতে দেয়া হোক এবং তার জীবন বাঁচানোর জন্য যেন কোনো প্রকার চেষ্টা করা না হয়। এর ফলে ডাক্তাররা গুরুত্বহীনভাবে কাজ করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর এক যুবক দৌড়ে এসে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে প্রবেশ করে বলে, আক্রমণকারীদের মোটরকার যেখানে ছিল আমি তার কাছেই এক জায়গায় দাঁড়ানো ছিলাম। গাড়িটির নাম্বার সি-৯৯৭৯ এবং সেটি কালো রংয়ের। একজন ইখওয়ান কর্মী জিজ্ঞেস করেন, তুমি গাড়ির নাম্বার কিভাবে মনে রাখলে? যুবক জানায়, গাড়িটি ঐ এলাকায় কয়েকবার চক্কর দিয়েছে। এ কারণেই আমি সেটার নাম্বার মনে রেখেছি। আমি সেখানে কোনো কাজকর্ম ছাড়াই বসে বসে দেখছিলাম। ইওয়ান কর্মী ঐ যুবককে বলেন, তুমি যে নাম্বার বলেছো সেটা তো পুলিশের ফৌজদারী অপরাধ শাখার গাড়ি। এ বিভাগের দায়িত্বে লেফটেন্যান্ট মাহমুদ আবদুল মজিদ। তুমি কি পুলিশের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি আছো?
যুবকটি আবেগ আপ্লুত হয়ে দৃঢ়তার সাথে বলে, আমি যদি বুঝতে পারতাম এ আক্রমণ শাইখ হাসানুল বান্নার ওপর হতে যাচ্ছে তাহলে নিজের জীবন বাজি রেখে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আর সাক্ষ্য দেয়াতো মামুলী ব্যাপার!
অধ্যায় ২০ : ঘাতকের হিংস্র থাবা
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: