অধ্যায় ১৯ : ফিলিস্তিন জেহাদে ইখওয়ান

শাইখ হাসুনুল বান্না তার অতীব তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টির সাহায্যে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন যে, সামগ্রিকভাবে একটি জাতি হিসেবে মুসলমানরা ভয়াবহবিপদের মধ্যে রয়েছে। অপরদিকে মুসলমান শাসকদের অবস্থা হলো, নিজদের গদি রক্ষা ব্যতীত অন্য কোন কল্যাণ চিন্তা তাদের মাথায় নেই। তাই তিনি একজন মর্দে মোমেনের দৃষ্টিকোণ থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য বেইজ্জতি, লজ্জা ও অপমানের বিষয়। এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো মুসলমানরা শক্তি অর্জন করবে এবং ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ঠেকানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে জেহাদ করে নিজদের জীবন বিলিয়ে দিবে।

অন্যদের দিকে তাকিয়ে না থেকে ইখওয়ান এ সময় হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদ ফিলিস্তিনে পাঠাতে থাকে। তারা এ যুদ্ধে সৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এমন বিস্ময়কর নজির স্থাপন করেন যা দেখে ইংরেজ ও ইহুদী উভয় গোষ্ঠীর বুদ্ধি লোপ পাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে মিসরের প্রধানমন্ত্রী নকরাশী পাশা বিস্মিত ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। মিসরের বাদশা ফারুক মোল্লাহদের এহেন একক শক্তি দেখে অস্থির হয়ে পড়েন।

এই বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ক্রুসেডার ও ইহুদী শক্তি অতি সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা মুসলমান শাসকদের মগজে বিষ ঢালতে শুরু করে। তারা ক্ষমতাসীনদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে, ইখওয়ানুল মুসলেমুন তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিপজ্জনক। কুচক্রীদের উস্কে দেয়া অগ্নিস্ফূলিঙ্গ এবং যুব সমাজের ওপর সরকারের মাত্রাহীন জুলুম নির্যাতনে ইখওয়ান চরম ধৈর্যের পরিচয় প্রদান করে। কিন্তু এরপরও সরকারের মাত্রাহীন জুলুম নির্যাতনের মোকাবেলায় কোথাও কোথাও দু’একজন সরলমনা যুবক বিুব্ধ হয়ে উঠে। দু’চারজন যুবকের এহেন বিুব্ধ অবস্থাকে পুঁজি করে সরকার তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে শত শত যুবককে সরকার কারাগারে ঢোকানো শুরু করে।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরের আনাতোলিয়া বাগিচায় লোকজন প্রাতঃভ্রমণে ব্যস্ত। ভ্রমণ করতে করতে এক ব্যক্তি বাগানের এক কোণায় পৌঁছে যান। তিনি নিকটেই কোন এক ব্যক্তির গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পান। তিনি প্রথমে এটাকে মনের ভ্রান্তি বলে ধরে নেন। কিন্তু বার বার কোঁকানোর আওয়াজ শুনে ঐ দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কাছে গিয়ে দেখতে পান, ঝোপের ভিতর অর্ধমৃত এক ব্যক্তি পড়ে রয়েছেন- যিনি জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ে ব্যস্ত। তিনি দেখতে পান ঐ লোকটির পাশে আরো দু’জন যুবকের লাশ পড়ে রয়েছে। লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে ঐ অর্ধমৃত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, হত্যাকারীর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঘটনা হলো, শহরের কানাওয়ী নামের এক বিত্তবান ঠিকাদার কাজের বাহানা করে লোকটিকে মাঝরাতে বাগিচায় নিয়ে যায়। ঠিকাদার লোকটিকে আকস্মিক মারতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তাকে মৃত মনে করে সে চোপে চোপে সটকে পড়ে। দুইজন যুবকের হত্যাকারীর কোন সন্ধান পাওয়া না গেলেও বেঁচে যাওয়া যুবকের দায়ের করা মামলায় ঠিকাদারের আট বছরের জেল হয়।

এ সময় কিছু যুবক ইংরেজ বিরোধী তৎপরতায় সোচ্চার হয়ে উঠে। তারা দেশপ্রেমিক জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, ইংরেজকে এ মুহূর্তেই দেশছাড়া করার ব্যবস্থা করা উচিত। এ সময় বহু যুবককে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া যুবকদের অনেকেই ইখওয়ানুল মুসলেমুনের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। গ্রেফতার হওয়া যুবকদেরকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের কারণে আদালত দশ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করে। অথচ এরা কাউকে হত্যাও করেনি কিংবা অন্যকোন মারাত্মক অপরাধও করেনি।

ইখওয়ানের উৎসাহী কর্মীরা এদু’টি ঘটনার তুলনা করার চেষ্টা করে। একদিকে দুই ব্যক্তির হত্যা ও অপরজনকে হত্যা চেষ্টার প্রমাণ্য মামলা এবং অপর দিকে ইংরেজ তাড়ানোর মামলা-যেখানে কাউকে হত্যাও করা হয়নি কিংবা কেউ আহতও হয়নি। অথচ একই আদালত থেকে এসব যুবককে দশ বছর করে কারা ভোগের সাজা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রহসনমূলক বিচারে যুবকদের তাজা রক্ত গরম হয়ে উঠে। তারা উপলব্ধি করে, সরকার বিদেশি প্রভুদের সন্তুষ্টির জন্য মুসলমানদের ওপর কি ধরনের জুলুম নির্যতন চালাচ্ছে। ফলে বিক্সুদ্ধ যুবকরা ঐ বিচারককে হত্যা করে বসে।

এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষ যেমন পত্রপত্রিকা পড়ে জানতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে এই দুঃখজনক ঘটনার খবর ইখওয়ান নেতৃবৃন্দও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারেন। এতে ইখওয়ানের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তাদের শত্রুরা তো সুযোগের সন্ধানেই ছিলো। তারা এটাকে বাহানা বানিয়ে ইখওয়ানের বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম প্রচারণা যুদ্ধে নেমে পড়ে। তারা প্রচার করে, ইখওয়ান ভয়াবহ সন্ত্রাসী একটি সংগঠন। এ সময় ইখওয়ান ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ। মুসলিম উম্মাহর মান ইজ্জতের সংরক্ষণ ও পুনর্বহাল কাজে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ত। হাসানুল বান্না অব্যাহতভাবে স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের সংগঠিত করে যুদ্ধের ময়দানে পাঠাচ্ছেন। এ সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর মিসরী সদর দফতর ‘ফায়েদে’ বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তারা নকরাশী পাশার মাধ্যমে ইখওয়ানের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নে ঐক্যমত পোষণ করেন। নকরাশী পাশা বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৮ ডিসেম্বর জরুরি আইনের আওতায় ইখওয়ানকে বেআইনী ঘোষণা করেন।

এ পদক্ষেপের পর গোটা মিসর জুড়ে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের পাহাড় নেমে আসে। ইখওয়ানের সকল দফতর ও কেন্দ্রে সরকারের পক্ষ থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। শত শত শিক্ষিত মানুষকে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এসব ধরপাকড় ও হাঙ্গামার সময় নকরাশী পাশা এক যুবকের হাতে নিহত হন। নকরাশী পাশা নিহত হওয়ার পর ইব্রাহিম আব্দুল হাদী পাশা প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসেন। তিনি ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহী ব্যক্তিবর্গের সাথে এমন আচরণ করেন-যা একজন অমুসলিম শাসকের পক্ষেও করা সম্ভব ছিল না।

প্রতিদিন হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে গ্রেফতার করা হতে থাকে। কিন্তু হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার না করে তাকে জেলের বাইরে রাখা হয়। তার মিসরের বাইরে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দেশের অভ্যন্তরেও সরকারি নির্দেশ ছাড়া চলাচলের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। ইখওয়ানদের ব্যাপক ধরপাকড়ে সারাদেশের জেলখানা ভরে যায়। শাইখ হাসানুল বান্না সরকারের কাছে দাবি করেন যে, ইখওয়ান যদি কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের নেতা হিসেবে আমিই বড় অপরাধী। অতএব আমাকেও গ্রেফতার করা হোক। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, সরকার তার ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

শাইখ হাসানুল বান্না একজন মর্দেমোমেন হিসেবে ইসলামী দাওয়াতের সকল কঠোর ও বন্ধুর পথ অতিক্রমে প্রস্তুত ছিলেন। ‘জান্নাতের পথ বিপদ মুছিবতের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে’-রাসূলে পাকের এই পবিত্র বাণীর মর্ম তিনি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলেন। তিনি বহু বছর পূর্বে যখন এসব অগ্নিপরীক্ষার চিহ্নমাত্রও দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি-তখনই তিনি বিষয়টি ইখওয়ানদের সামনে পরিস্কার করে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই এখনো পুরোপুরি ওয়াকেফহাল নয়। যখন মানুষের কাছে এ দাওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিস্কার হয়ে যাবে তখন তারা তোমাদেরকে কষ্ট দেয়ার জন্য তোমাদের পিছু নিবে। এ সময় তোমাদের খুব বড় বড় কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে। বড় বড় প্রতিবন্ধকতা তোমাদের পথ আগলে দাঁড়াবে। সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাও তোমাদের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। দরবারী আলেম ও মাশায়েখ তোমাদের ইসলামের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করবে এবং তোমাদের জেহাদকে ভ্রান্ত বলে প্রচারণা চালাবে। ক্ষমতাসীন শক্তি ও জাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তোমাদেরকে হিংসা করবে। সরকার ও গোটা প্রশাসন যন্ত্র তোমাদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এরা তোমাদের কর্মতৎপরতায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।

বিদেশি লুটেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে। দুর্বল শাসক গোষ্ঠী তোমাদের বিরুদ্ধে ঐ সব লুটেরাকে সাহায্য করবে। তোমাদের বিরুদ্ধে সন্দেহ সংশয় ও অপপ্রচারের ঝড় তোলা হবে। তোমাদের মধ্যে সকল প্রকার দোষত্রুটি অনুসন্ধান করে তোমাদের সেবা ও অবদানকে জাতির সামনে বিকৃত করে তুলে ধরা হবে। তোমাদেরকে জেলে পুরা হবে, তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে গৃহহীন ও দেশ মাতৃকার আলোবাতাস থেকে দূরে নিক্ষেপ করা হবে। তোমাদের প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তোমাদের বাড়িতে তল্লাশী চালানো হবে। এমনও হতে পারে এ কঠিন পরীক্ষা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকবে। ‘মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি-একথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে?’ কিন্তু আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, অবশেষে তিনি তার পথে সংগ্রামকারীদেরকেই সাহায্য করবেন এবং পুণ্যবানদের উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করবেন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম