ইখওয়ানের সাথে নুহাস পাশার নমনীয় নীতি ইংরেজদের পছন্দ ছিল না। অতএব ১৯৪৪ সালে নুহাস পাশার সরকারকে বরখাস্ত করা হয় এবং আহমদ পাশা সরকার গঠন করেন। ইংরেজদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি পুনরায় ইখওয়ানের ওপর জুলুম নির্যাতন শুরু করেন। আহমদ পাশা ইংরেজদের চাপের মুখে ইতালী ও জার্মানীর বিরুদ্ধে বৃটিশের পক্ষে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইখওয়ান সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে আহমদ পাশা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। এ সময় আল ইসুবী নামক এক ব্যক্তি আহমদ পাশাকে হত্যা করে।
এরপর নকরাশী পাশা সরকার গঠন করেন। তিনি তার মন্ত্রীত্বের শুরুতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে হাসানুল বান্না ও ইখওয়ানের সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। ইখওয়ান এ অন্যায় গ্রেফতারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত তাদেরকে মুক্তির নির্দেশ দেয়।
ইংরেজরা মিসরী জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা ইংরেজদের সহযোগিতা করলে যুদ্ধের পর বৃটেন তাদেরকে স্বাধীনতা দিবে। তাই ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান গোটা দেশব্যাপী শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলে এবং ইংরেজদের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের দাবি জানায়। অপরদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। এ সময় ‘আল ইখওয়ান’ নামে একটি দৈনিক প্রকাশ করা হয় এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠন করা হয়। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য স্থানে স্থানে কেন্দ্র খোলা হয়। নতুন নতুন বাণিজ্যিক অফিস এবং শিল্প কারখানাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে ইখওয়ানের দুইদিক থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রথমত অর্থনৈতিকভাবে ইখওয়ানের লাভবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, দ্বিতীয়ত শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে প্রবেশের পথ সুগম হয়।
শুধু মিসরই নয়, আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ইখওয়ান জনসাধারণকে সুসংগঠিত করে। শুধু মিসরেই ইখওয়ানের সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছে। সমর্থক ও শুভাকাক্সীর সংখ্যাও ছিল সক্রিয় কর্মীদের কয়েকগুণ বেশি। এ সময় মিসরে দুই হাজার ও সুদানে শাখার সংখ্যা পঞ্চাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য আরব দেশ সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ফিলিস্তিনেও ইখওয়ানের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। নকরাশী পাশার আমলে শাইখ হাসানুল বান্না ইংরেজদের বিরুদ্ধে জ্বেহাদ ঘোষণা করেন। হাসানুল বান্নার বজ্রকণ্ঠ সারাদেশে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
নকরাশী পাশার সরকার এ আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে মন্ত্রিপরিষদকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর ইসমাইল সেদকী পাশার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। তিনিও ইখওয়ান কর্মীদেরকে ধরপাকড় অব্যাহত রাখেন। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে তিনি মন্ত্রীত্বে ইস্তফা দেন এবং ১৯৪৬ সালের ১০ ডিসেম্বর নকরাশী পাশা দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করেন। অবস্থা দাঁড়ায়, একদিকে ইখওয়ানের স্বাধীনতা আন্দোলন অপরদিকে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় নকরাশী পাশা সরকারের টিকে থাকার লড়াই। এ সময় সারা পৃথিবীর ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে একত্রিত করে ইংরেজরা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে বিভোর ছিল। আর এ ষড়যন্ত্রে পর্দার আড়ালে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সক্রিয় ছিল। এরা আরবদেরকে সার্বক্ষণিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য তাদের কলিজার ভিতরে একটি ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী ষড়যন্ত্রে সমগ্র আরব বিশ্ব বিশেষ করে মিসর উদ্বিগ্ন ও বিুব্ধ ছিল।
ফিলিস্তিন সমস্যার ব্যাপারে ইখওয়ান জাতির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নামে এবং জনগণের আবেগ, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিপরীতে মিসরী শাসকগোষ্ঠী নিজদের মসনদ রক্ষায় ইংরেজের পদলেহনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিন সমস্যা মিসর ও এর বাইরের ইখওয়ানদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
০ ০ ০ ০
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বরের সুন্দর একটি দিন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ ও কাছাকাছি স্থানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে জনসাধারণের ব্যাপক সমাগম। থেমে থেমে স্লোগানের আওয়াজ উঠছে। ক্যাম্পাসের বাইরে বড় সড়কে স্লোগানের আওয়াজ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। ‘ইহুদীদের এক চিকিৎসা ... আল জেহাদ আল জেহাদ।’ এর কিছুক্ষণ পরই কাফন পরিহিত যুবকদের একটি গ্রুপ ‘জেহাদ আমাদের পথ’ এবং ‘শাহাদত আমাদের আকাক্সা’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে উপস্থিত হয়। এদের সামনে জীপে দাঁড়িয়ে হাসানুল বান্না মাইকে জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। মিছিল যতই এগিয়ে যাচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ ও উচ্ছ্বাস ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা ছিল একথারই প্রতিধ্বনি যে, মিসরী জাতি ফিলিস্তিনী ভাইদের দুর্দিনে ও বিপদ মুছিবতে তাদেরই সাথে রয়েছে।
জনগণের দাবি ছিলো, মিসর সরকার ইংরেজদের পদলেহনের পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করবে এবং ফিলিস্তিনীদেরকে ইহুদীদের গোলামী থেকে বাঁচানোর জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
শান্তিপূর্ণ মিছিল ধীরে ধীরে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মিছিলে সাধারণ মানুষের এতো ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সরকার কল্পনাও করতে পারেনি। সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণের পরও সরকার ভিতরে ভিতরে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। জনগণের এ বিশাল জমায়েত আল উতবা আল খাদরা ময়দানে পৌঁছার পর মিছিলের ওপর পুলিশী হামলা শুরু হয়ে যায়।
শাইখ হাসানুল বান্না সামনে এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে বলেন। তিনি যখন দেখেন মিছিলকারীদের ওপর গুলি চলছে তখন তাদেরকে বাঁচানোর জন্যে নিজের হাত দিয়ে গুলি ফিরানোর চেষ্টা করেন। এতে তার দুই হাতই ব্যাপকভাবে রক্তাক্ত হয়ে যায়।
নিজেদের নেতাকে রক্তাক্ত দেখে জনতা তার দিকে দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করে। এরপরও তিনি জনতাকে শান্ত থাকার নির্দেশ দেন।
কায়রোর একটি বিখ্যাত সড়কে খেজুর বাগানে ঘেরা বিশাল এক ভবনে বাস করেন আরব লীগের সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রহমান আজজাম। সেখানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হযেছে।
সেখানে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শাইখ হাসানুল বান্না ও ফিলিস্তিনের মুফতিয়ে আজম আলহাজ্ব আমীন আল হোসাইনী সবার আগে অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফররত কায়েদে আযম নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানসহ নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠানে পৌঁছান।
ফিলিস্তিনের মুফতিয়ে আজম ও শাইখ হাসানুল বান্না পাকিস্তানী দুই নেতার সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন।
কায়েদে আযম পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্বের নানাবিধ সমস্যা সংক্রান্ত এ আলোচনা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে শ্রবণ করতে থাকেন। আলোচনার এক পর্যায়ে কায়েদে আযম বলেন, পাকিস্তান যদিও একটি নতুন ও দুর্বল রাষ্ট্র তথাপি মুসলিম উম্মাহর উপস্থিতি ও সহযোগিতায় আমরা নিজেদেরকে দুর্বল নয় বরং শক্তিশালী মনে করি। বিশেষভাবে আমরা মনে করি যেসব দেশে ইখওয়ান আছে সেখানে তারাই আমাদের উত্তম রাষ্ট্রদূত। ফিলিস্তিন মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পাকিস্তান কোনোভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ফিলিস্তিন রক্ষায় সকল ক্ষেত্রে এ সকল দিক থেকে লড়াই অব্যাহত রাখা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এরপর অন্যান্য আমন্ত্রিত ব্যক্তিরাও আসতে শুরু করেন। হাসানুল বান্না বিশেষ অতিথির আসনের কাছেই ছিলেন। যখনই কেউ আসেন তখনই তিনি নিজের আসন ছেড়ে পিছিয়ে যেতে থাকেন। এভাবে পিছাতে পিছাতে তিনি দরজার কাছে চলে যান। অতিথিদের আগমন শেষ হলে গৃহকর্তা তাদের খাবার কক্ষে যাবার অনুরোধ জানান। হাসানুল বান্না দরজার কাছে থাকার কারণে খাবার ঘরের সন্নিকটেই ছিলেন।
শাইখ আজজাম তাকে খাবার ঘরে প্রবেশ করার অনুরোধ জানালে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে অন্য অতিথিদেরকে অগ্রাধিকার দিতে থাকেন এবং নিজে পিছন দিকে সরে যেতে থাকেন। খাবার ঘরে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন শাইখ হাসানুল বান্না। ফিলিস্তিনের মুফতিয়ে আযম হাসানুল বান্নার এহেন বিনয় ও মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হন।
অধ্যায় ১৮ : শাহাদাত ছিল কাম্য যাদের
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: