নীরব নিঝুম রাত। জনমানবহীন মহাসড়ক। লাফাতে লাফাতে কায়রোর দিকে ছুটে চলেছে জীপ। হাসানুল বান্না চালকের আসনে বসা আহমদ সুকরীকে হঠাৎ বলে বসেন, সামনে কোনো লোক গাড়ি থামানোর ইঙ্গিত করছে। জবাবে আহমদ সুকরী বলেন, হ্যাঁ, আমিও তা দেখতে পেয়েছি। হাসানুল বান্না পুনরায় বলেন, গাড়ির গতি কমাও, হতে পারে আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। লোকটির সাথে তার গাড়িও দাঁড়ানো। হয়তো গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। আহমদ সুকরী বলেন, মাননীয় মুরশেদ! আজকাল অবস্থা খুবই খারাপ। এ এলাকায় অপরাধী চক্র অসহায়ের ভান করে গাড়ি থামিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।
‘কিন্তু যদি সত্যি সত্যি কেউ বিপদগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে অসহায় এ লোকটিকে সারারাত বিপদের মধ্যে কাটাতে হবে। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। আপনি লোকটির কিছুটা সামনে গিয়ে সতর্কতার সাথে গাড়ি দাঁড় করাবেন।’ আসলে উচিত ছিল না ...’ একথা বলে আহমদ সুকরী সড়কের এক কিনারে গাড়ি থামিয়ে চারদিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। হাসানুল বান্না একাই গাড়ি থেকে নেমে ঐ লোককে জিজ্ঞেস করেন, আপনার কি প্রয়োজন।
পথচারী বলেন, আমার গাড়ির তেল শেষ হয়ে গেছে। নিকটবর্তী পেট্রল পাম্প পর্যন্ত পৌঁছার জন্য তেল প্রয়োজন।’ হাসানুল বান্না বলেন, আপনার কাছে গ্যালন জাতীয় কোন পাত্র আছে কি না? পথিক বলেন, জী না, আমার কাছে এ ধরনের কোন পাত্র নেই। হাসানুল বান্না বলেন, আমাদের কাছেও এ ধরনের কিছু নেই। কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, একটা উপায় মাথায় এসেছে। একথা বলে তিনি নিজের গাড়ির দিকে এসে হর্নের ধাতব নলের মাথায় লাগানো রাবারের বস্তুটি যাতে চাপ দিলে হর্ন বাজে খুলে ফেলেন। ঐ রাবারের বস্তুটি খুলে বেশ কয়েকবার এর সাহায্যে তেল নিয়ে অচেনা পথিকের গাড়ির ট্যাংকিতে ঢেলে দিতে থাকেন। হাসানুল বান্নার এহেন কর্মকাণ্ডে ভদ্রলোক খুবই প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তিনি ভাবতে থাকেন, এই পরোপকারী সম্মানিত ব্যক্তিটি কোনো প্রকার নাম ঠিকানা বা অবস্থান জিজ্ঞেস না করেই এ ধরনের কাজ করেছেন। তিনি বিস্মিত হয়ে নিজ থেকেই পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, আমার নাম মোহাম্মদ আবদুর রসুল, কায়রোর আদালতের বিচারক। আপনার পরিচয় কি? হাসানুল বান্না বিনয়ের সাথে বলেন, আমার নাম হাসানুল বান্না। কায়রোর সাবতিয়ায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বিচারক বিস্ময় ও অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, শাইখ হাসানুল বান্না, ইখওয়ানুল মুসলেমুনের মুর্শেদে আম? হাসানুল বান্না অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মাথা হেলিয়ে ভদ্রলোকের কথাকে সমর্থন করে বলেন, ‘জি হ্যাঁ’।
তাহলে আপনি সেই বিপজ্জনক ভযাবহ ভীতি সৃষ্টিকারী কুখ্যাত ঘৃণ্য ব্যক্তি যার ব্যাপারে মিসর সরকার জনগণকে সতর্ক করে আসছে।’ একথা বলে জজ সাহেব কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, মিস্টার হাসানুল বান্না! ভয় ভীতি ও সন্ত্রাসের নিকষ কালো রাতে আপনার মতো ব্যক্তিরাই মানবতার জন্য আশা-আকাক্সার কিরণ। আশা করছি, কোনো একদিন মানবতার কল্যাণে আমাকেও সেবার সুযোগ দিয়ে বাধিত করবেন। কথা শেষ করে বিচারক হাত মিলানোর জন্য হাসানুল বান্নার দিকে নিজের হাত এগিয়ে দেন। হাত মিলাতে মিলাতে সম্মতিসূচক মাথা হেলিয়ে হাসানুল বান্না বলেন, ইনশাআল্লাহ।’
ওমর তিলমেসানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা বিদ্রƒপ ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন, জনাব কি বিষয়? আপনার মুর্শেদে আম নির্বাচন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। ওমর তিলমেসানী প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেন, না, না, অসম্ভব। এটা হতে পারে না। ভদ্রলোক নিজের রাজনৈতিক বিজ্ঞতার বাহাদুরী জাহির করে বলেন, মনে হয় আপনি আজকের পত্রিকা পড়েননি। আমি তো প্রথমেই বলেছি, এই রাজনীতি মোল্লা মৌলবীদের সাধ্যের কাজ নয়। এখন দেখলেন তো আপনার মৌলবী সাহেব প্রধানমন্ত্রীর সাথে একবার সাক্ষাৎ করেই পদস্খলন ঘটে গেছে। ওমর তিলমেসানীর জন্য এ খবর বোমা বিস্ফোরণের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিলো না। তিনি জবাব দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
নুহাস পাশা মিসরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইখওয়ানের ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করেন। ইংরেজের উপস্থিতিতে মিসর সরকারের সাথে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থায় যাওয়াকে ইখওয়ান বুদ্ধিমত্তার পরিপন্থী কাজ বলে বিবেচনা করেছে। কেননা, এ জাতীয় সংঘর্ষে তাদের শত্রু সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরাই লাভবান হবে। নুহাস পাশার শাসনামলে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা হলে ইখওয়ান ইসমাঈলিয়ার নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী হিসেবে হাসানুল বান্নার নাম ঘোষণা করে। কেননা এ নির্বাচনী এলাকার সকল গ্রাম ও মহল্লায় ইখওয়ানের শাখা প্রতিষ্ঠিত ছিলো এবং এখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে হাসানুল বান্নার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। এ কারণেই এ এলাকা থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে হাসানুল বান্নার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিলো। এ খবরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শিবিরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং হৈ চৈ পড়ে যায়।
নির্বাচনে হাসানুল বান্নার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে অশুভ শক্তি নিজদের মৃত্যুর পরোয়ানা হিসেবে বিবেচনা করে। সুতরাং নির্বাচন থেকে তাকে বিরত রাখার জন্য তারা নুহাস পাশাকে নির্দেশ দেয়। নুহাস পাশা হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাতের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ডেকে পাঠান। দু’জনের দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। নুহাস পাশা দেখতে পান যে, কোনো অবস্থায়ই হাসানুল বান্নাকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না তখন তিনি বৃটেনের কাছ থেকে পাওয়া হুমকির কথা উল্লেখ করেন। তিনি হাসানুল বান্নাকে বলেন, আপনি নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে দেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। একথা শুনে হাসানুল বান্না নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইখওয়ানকর্মীরা খুবই অসন্তুষ্ট হন। ওমর তিলমেসানীও ঐসব অসন্তুষ্ট কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় দফতরে আসা যাওয়া ছেড়ে দেন। ইখওয়ান কর্মীদের কাছে হাসানুল বান্না ওমর তিলমেসানীর অফিসে আসা ছেড়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তাকে জানানো হয় যে, তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। হাসানুল বান্না সাক্ষাতের জন্য পত্র পাঠালে ওমর তিলমেসানী জানিয়ে দেন যে, তিনি হাসানুল বান্নার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান না। এ প্রেক্ষিতে তিনি ইখওয়ানের দুইজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি উস্তাদ আবদুল হাকিম আবেদীন ও হাজী আবদু কাসেমকে ওমর তেলমেসানীর খামারে পাঠান। তারা খুব জোরাজুরি করে ওমর তিলমেসানীকে হাসানুল বান্নার কাছে নিয়ে আসেন।
দু’জনের সাক্ষাৎ হলে তিনি বলেন, ভাই ওমর। প্রধানমন্ত্রীর জন্য কখনোই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু নুহাস পাশা ইংরেজের হুমকির কথা উল্লেখ করলেন। এরপর আমার জন্য দু’টি পথই খোলা ছিল। এক হলো, দেশ ও জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু সময়ের জন্য মওসুমী রাজনীতিকে কোরবানী করে দিবো। দ্বিতীয় পন্থা হলো, নিজের রাজনীতির চাকচিক্য ও ঔজ্জ্বল্য প্রকাশের জন্য জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবো। আমি ঐ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছি যাতে আমার মন ও মস্তিষ্ক সায় দিয়েছে। আর এ সিদ্ধান্তে আমার বিবেক সন্তুষ্ট। এতে যদি আপনার সন্দেহ সংশয় দূরীভূত না হয় তাহলে আপনার যদি আরো অধিক প্রশ্ন থেকে থাকে আমি সেগুলোরও জবাব দেয়ার জন্য তৈরি আছি।
উস্তাদ হাসানুল বান্নার এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ওমর তিলমেসানী সন্তুষ্ট হয়ে আগের মতো ইখওয়ানের সাথে দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
অধ্যায় ১৭ : পরোপকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: