এ পর্যন্ত হাসানুল বান্নার দাওয়াত সাধারণের পরিশুদ্ধিতে সীমাবদ্ধ ছিলো। ১৯৩৫ সাল থেকে তিনি বক্তৃতা, সভা সমাবেশ ও অব্যাহত চিঠিপত্রের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তিনি একটি মুসলিম দেশের শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থ ব্যবস্থার মধ্যেও ইসলামী সংস্কারের দাবি জানান। তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন, অন্য কোন ব্যবস্থার ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে সময় অপচয় করার পরিবর্তে ইসলামী ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে একাগ্রচিত্তে এগিয়ে আসা উচিত। ইসলামী ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ।
মিসরের ক্ষমতাসীনরা দেখতে পান, হাসানুল বান্নার তৎপরতায় জনগণ তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যে কোন সময় তাদের জোড়াতালি দেয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য এ আন্দোলন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতএব দাওয়াতী মিশন থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য সরকার নতুন কৌশল অবলম্বন করে। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা হাসানুল বান্নাকে বড় পদের প্রস্তাব দিয়ে একজন সরকারি কর্মচারীকে তার কাছে পাঠায়। কিন্তু তিনি ঐ কর্মকর্তাকে এমন জবাব দেন যাতে তার লজ্জায় মরে যাওয়ার অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।
এর আগে ইখওয়ানের এ তৎপরতাকে সংশোধন ও ধর্মীয় চেষ্টা সাধনা বলে ধরে নিয়ে গুরুত্বহীন মনে করা হয়েছে। কিন্তু ইখওয়ানের দাওয়াত যখনই জীবনের সকল দিক ও বিভাগের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে এবং চিন্তা ও সামাজিক বিপ্লবের সাথে সাথে যখনই এ আন্দোলন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংশোধনের দাবি উত্থাপন করে ঠিক তখনই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কপালের রেখায় কুঞ্চন দেখা দিতে শুরু করে। কেননা ক্ষমতাসীনরা এটাকে মৃত্যুর পরওয়ানা বলে ধরে নেয়। ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বৃটেন মিসরে কোন ধরনের আন্দোলন দানা বেধে উঠার ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
কায়রোতে অবস্থিত বৃটিশ দূতাবাসের একজন ব্রিগেডিয়ার মিসর সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শাসানোর ভঙ্গিতে বলেন, আমি আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম, এই মৌলভীকে খুবই বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে। বৃটিশ সাম্রাজ্য এ মুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যক্তি আপনাদের ও আমাদের জন্য নতুন কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের জানা মতে কায়রো ও আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্র ইখওয়ানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল ও শিক্ষকরাও এ দলে শরীক হয়ে গেছে। আপনারা এখনো পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। মিসরী কর্মকর্তা জবাবে বলেন, ডিয়ার স্যার! আমরা উচ্চ পদ ও চাকরির মিষ্টি বড়ির সাহায্যে তাকে কাবু করতে চেষ্টা করেছি, সম্পদের লোভ দেখিয়ে তাকে জালে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লাহ জানে, সে কোন মাটি দিয়ে তৈরি। সে এর সব কিছুই অত্যন্ত ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখান করেছে।
বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, সেক্রেটারি সাহেব! এ কথাতো পুরানো হয়ে গেছে। যুদ্ধের শুরুতে আমরা এ লোকের মুখ বন্ধ করানোর জন্য আমাদের বিশেষ এজেন্টের মাধ্যমে তাকে হাজার হাজার পাউন্ড দেয়ার চেষ্টা করে ছিলাম। কিন্তু সে আমাদের লোককে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। তাকে সোনা চান্দির জিঞ্জিরে বাঁধা অসম্ভব। তাই মিষ্টি বড়ির খেলা বন্ধ করুন সেক্রেটারি সাহেব। আমরা সমস্যার সমাধান চাই। ব্রিগেডিয়ার ক্রুরতার সাথে বলেন, যদি মিষ্টি বড়ি না খায় তাহলে তাকে তিক্ত বড়ি গিলানোর ব্যবস্থা নিতে হবে মিসর সরকারকে।
মিসরী কর্মকর্তা বলেন, কিন্তু আমরা যদি তাকে গ্রেফতার করি কিংবা কোন কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে গণবিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে। ব্রিগেডিয়ার উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, বিস্ফোরণ বিস্ফোরণ। তার সাথে রাষ্ট্রদূত ও মিসরী কর্মকর্তাও দাঁড়িয়ে যান। ব্রিগেডিয়ার অস্থিরতায় পায়চারী করতে করতে মিসরী কর্মকর্তার দিকে ঘুরে বলেন, পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধান অসম্ভব। মিসরী অফিসার অনুনয় বিনয়ের সাথে বলেন, জী, জী! আমরা বৃষ্টিশ সরকারের শুভাকাক্সী। আপনি যেভাবে নির্দেশ দিবেন আমরা ঠিক সেভাবেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো।
ব্রিগেডিয়ার মিসরী কর্মকর্তার কাঁধে হাত রেখে তার চেহায় তীর্যক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন, দেখো। কোন কাজ করতে হলে তার জন্য পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওষুধ হলো, কোন ব্যক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আগে ঐ ব্যক্তিকে জনগণের দৃষ্টি থেকে দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। তার প্রতি জনগণের ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মিসরী কর্মকর্তা বলেন, এ সব মিথ্যা প্রচারণা প্রতিহত করার উপকরণ ও পত্রপত্রিকা তার কাছে রয়েছে।
‘এটা আমাদের মাথা ব্যথার ব্যাপার নয়। ইখওয়ান আমাদের জন্য যতটুকু বিপজ্জনক তার চেয়ে অধিক বিপজ্জনক তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্য। আর একথাটাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করো। এ কাজটি যদি তোমরা করতে পারো, তাহলে জানতে পারবে, বৃটিশ সরকার তার বন্ধুদের ব্যাপারে কতটুকু উদার। এ কথা বলে ব্রিগেডিয়ার মিসরী কর্মকর্তার দিকে হাতবাড়িয়ে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আর অধিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। মিসরী কর্মকর্তা চলে যাবার পর ব্রিগেডিয়ার বৃটিশ দূতাবাসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাকে বলেন, তোমরা এ বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করো যেন ইখওয়ান ও মিসর সরকার একে অপরের কাছাকাছি না হতে পারে এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে নিজেদের শক্তি নষ্ট করতে থাকে। এ জন্য ইখওয়ানের মধ্যে স্বার্থপর লোকের সন্ধান করো। দূতাবাস কর্মকর্তা বলেন, জী, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
‘হাসানুল বান্না বিদেশের এজেন্ট’, ‘ইখওয়ান চরমপন্থী, সন্ত্রাসী ও বিপজ্জনক দল’ ‘হাসানুল বান্নার কয়েকটি গাড়ি আছে’ হাসানুল বান্না কয়েকটি ব্যবসায়ী কোম্পানিতে অংশীদারিত্ব নিয়ে রেখেছেন’ ‘ইখওয়ান উন্নয়ন বিরোধী’ ‘হাসানুল বান্নার এতো সম্পদ কোথা থেকে আসছে।’
এগুলো এবং এ জাতীয় আরো অনেক অভিযোগ সরকারি ও বেসরকারি পত্রিকায় পাকাপোক্তভাবে ছাপিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে। প্রচারণা এতোই শক্তিশালী ছিল যে, ইখওয়ানের অনেক সমব্যথী ও কল্যাণকামীও বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে থাকেন। ইখওয়ান তার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণার যথাযথ জবাব দিতে থাকে। এ সময় ইংরেজের উচ্চ মহলের চাপে মিসরের প্রধানমন্ত্রী সেরি পাশা ইখওয়ানের সাপ্তাহিক ‘আততারুফ’, ‘আশশুয়ায়ু’ ও মাসিক পত্রিকা ‘আলমানারের’ ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ইখওয়ানের ছাপাখানাও বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর সাথে দেশের সকল পত্রপত্রিকাকে ইখওয়ানের পক্ষের বা ইখওয়ানের প্রতিবাদ সম্বলিত কোন প্রকার সংবাদ না ছাপার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ইখওয়ানের সভা সমাবেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এরপর ইখওয়ান নেতাদেরকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। হাসানুল বান্নাকে কায়রো থেকে দূরে ফানা নামক এলাকার একটি স্কুলে বদলি করা হয়। তার নায়েব আহমদ সুকরীকে ওয়ামিয়াত এলাকায় বদলি করা হয়। পরবর্তীতে কায়রো পার্লামেন্টে প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখে তার বদলি বাতিল করে পুনরায় কায়রো ফিরিয়ে আনা হয় কিন্তু কায়রো পৌঁছার সাথে সাথেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার আবার তাকে ছেড়ে দেয়। এর পর তার তৎপরতার ওপর সরকারি নজরদারি চলতে থাকে।
ইখওয়ানুল মসলেমুনের সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণমূলক কাজের ব্যাপক বিস্তার ঘটায় হাসানুল বান্নার পক্ষে চাকরি ও সাংগঠনিক কাজ একই সাথে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া সরকারি চাকরিও তার বিস্তৃত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুতরাং সরকারি চাকরি থেকে ইস্তেফা দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ করেন।
অধ্যায় ১৬ : সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র
☼→
বান্না-জীবনী
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: