রাজাকারের দর্শন,একাত্তরের সেক্যুলারিস্ট ব্যাখ্যা ও ছাত্রশিবিরের বিজয় মিছিল


দুর্বৃত্তি ইতিহাস রচনায়
দুর্বৃত্তি, সন্ত্রাস ও ধোকাবাজী শুধু বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতিকেই গ্রাস করেনি, সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তি হয়েছে দেশটির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে। যেদেশের রাজনীতি,প্রশাসন, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো দেশটিকে বিশ্বের ২০০টি দেশের মাঝে দুর্বৃত্তিতে পাঁচবার প্রথম স্থানে পৌঁছে দেয়া, সেদেশে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সততা ও সুবিচার হবে সেটি কি আশা করা যায়? বরং ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো অতি ভয়ংকর দুর্বৃত্তদের মিথ্যা কাহিনীতে পূর্ণ হবে সেটিই কি কাঙ্খিত নয়? বাড়ীতে আগুণ লাগলে এবং সে আগুন না থামালে একে একে সবগুলো ঘরই পুড়ে যায়। তেমনি দেশে দূর্নীতি ঢুকলে সেটি শুধু রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অফিস-আদালতে সীমিত থাকে না। প্রবেশ করে প্রতিক্ষেত্রে, এবং ধ্বসিয়ে দেয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। আগুন নেভানো এবং দূর্নীতি নির্মূল ইসলামের তাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আল্লাহর উপর ঈমানের সাথে মু’মিনের উপর তাই অলংঘনীয় হুকুম “আমারু বিল মা’রুফ ওয়া নিহিয়ানিল মুনকার”। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল। অথচ বাংলাদেশে সে দুর্বৃত্তি রোধের চেষ্টা হয়নি, বরং বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে লাগাতর। দুর্নীতি শুধু অফিস-আদালত, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে হয়নি, প্রচণ্ড দূর্নীতি ও ধোকাবাজি ঘটেছে সত্যকে সত্য,মিথ্যাকে মিথ্যা এবং দুর্বৃত্তকে দুর্বৃত্ত রূপে জানার ক্ষেত্রেও।


মানব  সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান পদার্থ, চিকিৎসা, রসায়ন বা প্রকৌশল বিজ্ঞান নয় বরং সেটি ইতিহাস বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এ শাখাটি মানুষকে মানবিক পরিচয় নিয়ে গড়ে তোলার সাথে সম্পৃক্ত। ইতিহাস দেয় সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে জানার সামর্থ। দেয়,সমাজের দুর্বৃত্ত কীটদের চিনবার এবং তাদের অনুসৃত পথ পরিহারের সামর্থ। ফিরাউন-নমরুদ-হিটলার-মুজিব যে অতি স্বৈরাচারি দুর্বৃত্ত এবং তাদের দর্শন ও রাজনীতি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিধ্বংসী -সেটি অন্য কোন বিজ্ঞানের বই পড়ে জানা যায় না। সে জন্য ইতিহাসের বই পড়তে হয়। তেমনি হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে মহান আল্লাহর মহান রাসূল এবং মানবের শ্রেষ্ঠ বন্ধু -সেটিও ইতিহাস বিজ্ঞানের শিক্ষা। ইতিহাস তো এভাবেই মানুষের চলার পথে সঠিক ও বেঠিক এ দুটো পথই দেখায়। বাঁচায় জাহান্নামের আগুণ থেকে। পবিত্র কোরআনে তাই পদার্থ, চিকিৎসা, রসায়ন বা প্রকৌশল বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হয়নি। বরং তুলে ধরা হয়েছে হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) অবধি মানব জাতির অতিশিক্ষণীয় নির্ভূল ইতিহাস। বার বার বর্ণিত হয়েছে ইতিহাসের নানা পর্বে নানা মানুষের সফলতা ও বিফলতার কারণগুলোও। তুলে ধরা হয়েছে হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত লুত (আঃ), হযরত সালেহ (আঃ), হযরত শোয়েব (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ)এর ন্যায় শ্রেষ্ঠ মানুষদের সাথে দুর্বৃত্তদের আচরন এবং তাদের ভয়াভয়ানক পরিণতি। মহান আল্লাহতায়ালা চান চিন্তাশীল মানুষগুলো এগুলোর উপর দিবারাত্র চিন্তাভাবনা করুক ও শিক্ষা নিক। কম্পিউটার,রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ, রেডিও-টিভি, পারমাণবিক শক্তি এসবের আবিস্কারে শত শত বছর দেরী হলেও শ্রেষ্টতম সভ্যতার নির্মাণে মানব জাতিকে আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বেও কোন সমস্যা হয়নি। কারণ বিজ্ঞানের আবিস্কার আরাম-আয়েশ বাড়াতে সহায়ক হলেও মানবিক গুণে বেড়ে উঠার জন্য তা জরুরী নয়।সেজন্য জরুরী হলো,কোনটি ন্যায়, কোনটি সত্য এবং কোনটি জান্নাতের পথ সেটি চেনার নির্দেশনা। চাই সিরাতুল মোস্তাকীম তথা বা রোডম্যাপ। আজ থেকে চৌদ্দ শত বছর আগেই মুসলিমগণ সেটি পেয়েছিল। ইসলামের মহান নবীজী (সাঃ) সে পথটি স্বহাতে দেখিয়ে গেছেন। ফলে মানব তখন মহানমানব হয়ে বেড়ে উঠেছিল এবং গড়ে তুলেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।

মিথ্যাচারি দুর্বৃত্তদের বড় অপরাধটি মানবধ্বংসী অস্ত্র আবিস্কার বা যুদ্ধবিগ্রহ নয়, বরং সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বিচারের সামর্থ কেড়ে নেয়ায়। সে লক্ষ্যে দুর্বৃত্তদের টার্গেট শুধু দেশের অর্থভাণ্ডার, প্রশাসন, ব্যবসা-বানিজ্য ও রাজনীতি নয়, বরং ইতিহাসের বই। বাংলাদেশে তাই মিথ্যা ইতিহাস লিখতে বিনিয়োগ হচ্ছে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা। অতীতে এরূপ মিথ্যাসেবীরা রাম, রাবন, হনুমান,অসুর, গনেশ,মনসার নামে কত কল্পকথাই না শিখিয়েছে। সেসব মিথ্যার উপর আবার ধর্মের নামে পবিত্রতার লেবাসও পড়িয়েছে। কল্পিত কেচ্ছাকাহিনীর সে বইগুলোকে ধর্মগ্রন্থ রূপেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এভাবে গরুছাগল ও শাপশকুনকে ভগবানের আসনে বসানো হয়েছে। প্রচারের শক্তি বাংলাদেশের জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টরাও বুঝে। কারণ তাদেরও তো পুজনীয় কেউ চাই। গরুছাগল ও শাপশকুন যদি পুজনীয় হতে পারে তবে তাদের নেতাই বা কম কিসে? তেমন একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার ইতিহাসে তারা সীমাহীন মিথ্যাচার ঢুকিয়েছে। স্বৈরাচারি বাকশালী দুর্বৃত্তকে দেয়া হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ বাঙালীর খেতাব। ফলে যে প্রক্রিয়ায় অতীতে নমরুদ-ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ স্রেফ নেতারূপে নয়, ভগবান রূপেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং হত্যা-যোগ্য গণ্য হয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ)এর মহান নবীগণ -সেটিই নেমে এসেছে আজ বাঙালী মুসলমানের জীবনে। তাই হত্যা ও জেল-জুলুম নেমে এসেছে নবী-রাসূলদের অনুসারিদের উপর।

কারা রাজাকার?
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু আলোচিত প্রসঙ্গ হলো রাজাকার এবং একাত্তরে তাদের ভূমিকা। কিন্তু কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের দর্শন ও মিশন ছিল? বাঙালী হয়েও কেন তারা পাকিস্তানের পক্ষ নিল? বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় কেন তারা বিরোধীতা করলো? কেন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে নির্যাতীত হলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের এত আক্রোশ কেন রাজাকারদের বিরুদ্ধে? দেশে হাজার হাজার সন্ত্রাসী আছে, বহু হাজার দুর্নীতিবাজ অফিসার আছে, অসংখ্য খুনি ও চোর-ডাকাতও আছে। তাদের হাতে শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। বহু হাজার কোটি টাকার চুরি হয়ে গেছে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে। লুট হয়ে গেছে  হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি, নদীর তীর ও সমুদ্র সৈকত। কিন্তু তাদের নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে কি কোন উদ্যোগ আছে? তাদের বিচারের কথা দেশের সেক্যুলারিস্টগণ মুখে আনে না, কিন্তু ফাঁসীতে ঝুলাতে চায় রাজাকারদের। হেতু কি? বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি রাজাকারদের হাতে বিপন্ন? এ প্রশ্নগুলি অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিষয়টি শুধু আজকে নয়, শত শত বছর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে।

“রাজাকার” শব্দটি এসেছে ফার্সী থেকে।  ভারতীয় উপমহাদশে রাষ্ট্র ভাষা রূপে বহু শত বছর ফার্সী ছিল । সে সূত্র ধরে হাজার হাজার ফার্সী শব্দের ন্যায় রাজাকার শব্দটিও উর্দুতে স্থান পায়। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বেচ্ছাসেবক। তবে রাজাকার শব্দের সাথে একটি গৌরবজনক ইতিহাসও জড়িত। সেটি আধিপত্যবাদী কাফের হামলার বিরুদ্ধে মুসলমানের জিহাদের। নিযাম শাসিত হায়দারাবাদের উপর যখন ভারতের আগ্রাসী হামলা শুরু হয় তখন স্বাধীনতা বাঁচাতে সেদেশের মুসলমানগণ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিরোধকারি সে মোজাহিদগণ নিজেদের রাজাকার রূপে অভিহিত করে। একই আগ্রাসী ভারত ও তার এজেন্টেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সে ঐতিহ্য নিয়েই একাত্তরে বাংলার হাজার হাজার মুসলমান গড়ে তোলে রাজাকার ফোর্স। একাত্তরের যুদ্ধটি আওয়ামী লীগের কাছে ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লড়াই, আর রাজাকারদের কাছে ছিল পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াই। ভারতের লক্ষ্য ও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য তখন একাকার হয়ে যায়। ভারত তখন আওয়ামী ঘরানার যুবকদের নিয়ে নিজভূমিতে নিজ অর্থে ও নিজ পরিকল্পনায় গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। লক্ষ্য পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি। রাজাকার হলো তারা যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার  আওয়ামী লীগ ও ভারতের যৌথ প্রজেক্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ নয় মাস এ রাজাকারগণই দেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ ও তার মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজাকারদের প্রতিরোধের মুখে ৯ মাসের লড়াইয়ে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশে কোন জেলা দূরে থাক,কোন থানার উপরও দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বড় জোর তারা কিছু পুল-কালভার্ট ধ্বংস করতে পেরেছিল এবং নিরস্ত্র কিছু আলেম,পীস কমিটির কিছু সদস্য এবং পাকিস্তানপন্থি কিছু নিরস্ত্র মানুকে হত্যা করতে পেরেছিল। ভারত বুঝতে পারে,পাকিস্তান আর্মিকে পরাজিত করা দূরে থাক রাজাকারদের মোকাবেলা করার সামর্থও মুক্তিবাহিনীর নেই। ভারতের বিপুল অর্থ,অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ যখন পাকিস্তানে ভাঙ্গতে ব্যর্থ হচ্ছিল,তখনই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বুঝতে পারেন,এ যুদ্ধে তাঁর নিজের নামা ছাড়া বিকল্প নাই। ফলে তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। যুদ্ধ শুরু হয় স্থল, বিমান ও সমুদ্র পথে। এমন একটি যুদ্ধের পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে ভারত বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করে রাশিয়া থেকে। অথচ পাকিস্তান সে সময় ব্যস্ত ছিল দেশে নির্বাচন,সে নির্বাচন শেষে দেশের শাসনতনন্ত্র তৈরীর গভীর সংকট নিয়ে। রাজনৈতীক দলগুলো কাউকে কোন ছাড় দিয়ে আপোষে রাজী ছিল না। ভারতের বিরুদ্ধে তেমনি একটি প্রকান্ড যুদ্ধ লড়ার কোন প্রস্তুতি পাকিস্তানের ছিল না। কাশ্মীরের জনসংখ্যা এক কোটিরও কম। অথচ সেখানে ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ৬ লাখ। অথচ সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মিত সৈন্যের সংখ্যা ৫০ হাজারও ছিল না। যে ৯২ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানীকে যুদ্ধবন্দি রূপে ভারতে নেয়া হয় তাদের অর্ধেকের বেশী ছিল বেসামরিক ব্যক্তি ও তাদের পরিবার-পরিজন। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে, ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপে দেশটি বিভক্ত হয় ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বর।

নিরেট মিথ্যা
হাজারো মিথ্যা রটানো করা হয়েছে একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে। বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেটি যেমন মিথ্যা, তেমনি মিথ্যা হলো ১৯৭১য়ের ২৬ মার্চ অর্জিত হওয়ার কেচ্ছাটিও। ২৬শে মার্চ তো কোন নির্বাচিত নেতার পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষিতই হয়নি। বলা হয় স্বাধীনতা এনেছে মুক্তিবাহিনী। ২৬শে মার্চ কি মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছিল যে স্বাধীনতা আনবে? শেখ মুজিব সে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক -সেটিও আরেক মিথ্যা। তিনি তো স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি। ফলে সে স্বাধীনতা আনলেন কখন? সত্যতো এটাই, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল ১৯৪৭য়ের ১৪ আগষ্ট। একাত্তরে যা অর্জিত হয়েছে সেটি স্বাধীনতা নয়,বরং স্বাধীন পাকিস্তানের বিভক্তি। সেটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। সে বিভক্তির পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে ভারতের সাথে তাজুদ্দীনের ৭ দফা এবং মুজিবের ২৫ দফা চুক্তির জালে আটকা এক পরাধীন বাংলাদেশ। সেটিও ১৯৭১য়ের ২৬ মার্চে নয়, বরং ১৯৭১য়ের ১৬ ডিসেম্বর। ১৬ই ডিসেম্বর অবধি দেশে-বিদেশে স্বাধীন পাকিস্তানের সর্ব বৃহৎ প্রদেশ রূপে পরিচিত ছিল,এবং নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। তাছাড়া এ বিচ্ছিন্নতা মুজিবের বা মুক্তিবাহিনীর বাহুবলে আসেনি, এসেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর হামলার মধ্যদিয়ে। এযুদ্ধে যতজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মারা গেছে তার চেয়ে বেশী মারা গেছে ভারতীয় সৈনিক। স্বৈরাচারি বাকশালী মুজিবকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পিতা বলা যেমন নিরেট প্রতারণা, তেমনি প্রতরণা হলো তাঁকে স্বাধীনতার জনক বলাও। ভারতের এজেন্ট ছাড়া তার অন্য কোন পরিচিতি আছে কি? বাংলাদেশের জনক রূপে যিনি পুরা কৃতিত্বের দাবীদার তিনি ইন্দিরা গান্ধি। এবং মূল যুদ্ধটি করেছে ভারতীয় সৈনিকেরা। ভারতীয় সেনা বাহিনীর সেটি অজানা ছিল না। তাই ১৬ই ডিসেম্বরে জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কোন বাংলাদেশীকে রাখা হয়নি।

একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে দুটি পক্ষ ছিলঃ একটি অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষের,অপরটি বিপক্ষের। এক পক্ষের সাফাই শুনে আদালতে বিচার হয় না। রাজাকারদের মূল্যায়নে নতুন প্রজন্ম তেমন একটি বস্তুনিষ্ঠ বিচার করবে সে পথও খোলা রাখা হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের দর্শন ও ভূমিকা নিয়ে রাজাকারদের কোন ভাষ্য নেই। ফলে প্রচণ্ড অবিচার হয়েছে রাজাকারদের সাথে। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভারতভক্ত সেক্যুলারিস্টদের চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ এক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে।  কি ছিল রাজাকারদের ভাবনা? কি ছিল তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য? তারা কি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার শত্রু? এসব নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ -বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সঠিক ধারণাটি পায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজাকারদের বিরুদ্ধে অশ্লিল গালিগালাজ ছাড়া সে প্রশ্নের কোন বস্তুনিষ্ঠ গভীর আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ –বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম রাজাকারদের ব্যাপারে যা কিছু শুনেছে তা তাদের শত্রুদের থেকে। মিথ্যাসেবীরা সত্যের প্রচারের মাঝে নিজেদের মৃত্যু দেখতে পায়। তাই সর্বশক্তি দিয়ে সত্যের প্রচারে বাধা দেয়। ফিরাউন তার মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে হযরত মূসা (আঃ)এর সত্য প্রচারে শুধু বাধাই দেয়নি, তাঁকে হত্যা করতে সাগর অবধি ধেয়ে গিয়েছিল। মক্কার পথে নবীজী (সাঃ) দ্বীনের দাওয়াতে বেরুলে তাঁর উপর পাথর বর্ষণ করতো। তায়েফ নগরীতে তো পাথরের আঘাতে নবীজী (সাঃ)কে প্রচন্ড ভাবে রক্তাত্ব করা হয়েছিল।একই রূপ সত্যভীতি বাংলাদেশের ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের। একাত্তর নিয়ে নিজেদের মিথ্যাকে বাঁচাতে রাজাকারদের মুখ খুলতে দেয়া দূরে থাক তারা তাদেরকে ফাঁসীতে ঝুলাতে চায়। একাত্তরে নিয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার চেষ্টা করেছেন পশ্চিমবাংলার গবেষক শর্মিলা বোস। কিন্তু তার লেখা “ডেড রেকনিং” বইটিকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

পাকিস্তান ভাঙ্গার লড়াইকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা নিরেট মিথ্যাচার। কোন লড়াইকে স্বাধীনতার লড়াই বলতে হলে সে দেশকে অন্যের পরাধীন বা উপনিবেশ হতে হয়। একাত্তরে যে দেশ পরাধীনই ছিল না, সে দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয় কি করে? পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। দেশটির জনগণকে কেউ ঘুমপাড়ানীর গান গাইয়ে পাকিস্তান ভূক্ত করেনি। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবে বাংলাদেশের নাম ছিল না। সে লাহোর প্রস্তাবে সংশোধন আনেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হোসেন সহরোয়ার্দী। সেটি আনেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী মিটিংয়ে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জনাব সহরোয়ার্দী। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান। আতাউর রহমান খানের সে মন্ত্রীসভায় খোদ মুজিবও মন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জনাব সহরোয়ার্দী  পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস রূপে ১৪ আগষ্ট পালন করেছেন। দিবসটিকে খোদ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও পালন করেছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার সুরক্ষার পক্ষে তারা প্রতিবছর বিভিন্ন দিবসে পত্রিকায় বানীও দিয়েছেন। মুজিব নিজে জনসভার ভাষনে অসংখ্যবার “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” স্লোগান দিয়েছেন। এভাবে নিজেরাই প্রমাণ করেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান পরাধীন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশও হয়নি। বরং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশের সর্ববৃহৎ প্রবেশ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর দেশটির রাষ্ট্র প্রধান রূপে যিনি স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন ঢাকার নওয়াব পরিবারের জনাব খাজা নাজিমুদ্দীন। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী রূপে তিন বার বসেছেন পূর্বপাকিস্তানী। ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ লাহোরের মিন্টো পার্কে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে যিনি পাকিস্তানের প্রস্তাব পেশ করেন তিনিও ছিলেন বাঙালী শেরে বাংলা ফজলুল হক। তাছাড়া যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ দেশটির প্রতিষ্ঠা সে সংগঠনটির জন্মও হয়েছিল ঢাকায়, সেটি ১৯০৬ সালে। মুজিব নিজেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রী বলেও জাহির করেছেন। কিন্তু সেটি যে নিরেট মিথ্যাচার সেটি প্রমাণ করেছেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে। তেমনি মিথ্যাচার হলো, ১৯৭১য়ের বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতা বলা। রাজাকারগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী হবে কেন?  তারা বিরোধীতা করেছে বিচ্ছিন্নতার। পূর্ববাংলার মুসলমান তো স্বাধীনতা পেয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট,সেটি স্বাধীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হওয়ার মধ্য দিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানীরা ২২টি বছর ধরে সে স্বাধীনতা দিবসটি মহাধুমধামে উদযাপনও করেছে। বিচ্ছিন্নতার বিরোধীতাকে কি স্বাধীনতার বিরোধী বলা যায়?


প্রতারণার রাজনীতি
১৯৭০য়ের নির্বাচনে মুজিব ভোট নিয়েছেন ৬ দফায় উল্লেখিত স্বায়ত্বশাসনের দাবী জানিয়ে। নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরীর ওয়াদা দিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে পশ্চিম-পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল সে কথাটি সত্তরের কোন নির্বাচনি জনসভাতেই তিনি বলেননি। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানকে পৃথক করতে চান –সে দাবীও কোথাও বলেননি। সত্তরের নির্বাচনী বিজয়ী পরই হঠাৎ তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এবং সেটি আগ্রাসী ভারতের সাহায্য নিয়ে। অথচ সেজন্য তিনি জনগণ থেকে কোন ম্যান্ডেটও নেননি। ফলে জনগণ কেন তার এ নতুন নীতিতে সমর্থণ দিবে? তিনি ভারতের সাথে গোপন চুক্তি আগরতলাতে করলেও সেটি তো পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ করেনি।

১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারিতে সহরোয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় তিনি বলেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি তিনি একাত্তরে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছেন। প্রতারণা আর কাকে বলে! তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানী শোষণ, বাঙালীদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা,পূর্ব পাকিস্তানের উপনিবেশ হওয়ার কেছ্ছা কি তবে শুধু পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজকে জায়েজ করার স্বার্থে? আওয়ামী লীগের সাথে পাকিস্তান ভাঙ্গার এ প্রকল্পে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয় তৎকালীন মস্কোপন্থি ন্যাপ, আন্ডারগ্রাউন্ড জগতের বহুধা বিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য সোসালিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট দলগুলি। অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয় কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের দুই গ্রুপ, নুরুল আমীন সাহেবের পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলনসহ অন্যান্য ইসলামন্থি দল। সেক্যুলারিস্ট ও ন্যাশনালিস্টদের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পকে সমর্থণ দেয়নি দেশের অধিকাংশ আলেম, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব। বামপন্থিদের মাঝে যারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন তারা হলেন ভাষানী ন্যাপের মশিহুর রহমান যাদু মিয়া গ্রুপ এবং যশোরের জনাব আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি। উপজাতীয়দের মাঝে পাকিস্তানের পক্ষ নেন চাকমা রাজা ত্রিদীব রায়।

প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে নানা মত থাকে,নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সে মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণের বিষয়টি নিয়ে সবাই একই ভাবে না। বিপরীত মুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ী পক্ষই যদি নিজেদের পছন্দমত ইতিহাস লেখা শুরু করে তবে তাতে দেশে বহু রকমের ইতিহাস রচিত হবে। বাংলাদেশে তেমন ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু হয়েছে একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। দলীয় উদ্যোগে ইতিহাস রচনার সাথে তাই গুরুত্ব পেয়েছে বিপক্ষীয় নেতাদের গায়ে কালিমা লেপনের কাজ। রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে, আর নিজেদেরেক চিত্রিত করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যে হাজার হাজার পাকিস্তানপন্থি ও বিহারী খুন হলো, তাদের শত শত ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুন্ঠিত ও ভস্মিভূত হলো, শত শত রেলব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস হলো -বাংলাদেশের ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। লক্ষাধিক বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থিদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি,ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন ঝড়ো হাওয়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নাই। আজও বহুলক্ষ বিহারী রাস্তার পাশে বস্তিতে যেভাবে বসবাস করছে –সেটিই বা কীরূপে হলো? ইতিহাসে সে বিবরণও নাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত শত ট্যাংক ও যুদ্ধাস্ত্রগুলো কোথায় গেল -সে বিবরণও নাই। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ যে ভারতীয় বাহিনী লুটে নিয়ে গেলে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে এভাবেই স্থান পেয়েছে প্রচণ্ড ফাঁকিবাজি, এবং লুকানো হয়েছে ভারত ও তার সেবাদাস আওয়ামী ক্যাডারদের ভয়ংকর অপরাধ।

রাজাকারের দর্শন
মানুষের রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্ত ব্যক্তিটিও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন, জগত ও ন্যায়নীতি নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎসটি ছিল বাঙালী জাতিয়তাবাদ। কিন্তু রাজাকারগণ কোত্থেকে পেল জাতীয়তাবাদী জোয়ারের প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর সাহস? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবের উত্তর নেই। ফলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে একাত্তর নিয়ে এক সীমাহীন অজ্ঞতা নিয়ে। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই -এটি হলো মহান আল্লাহর দেয়া খেতাব। মুসলমানদের দায়িত্ব হলো আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত সে মহান খেতাবকে ধরে রাখা। ভাইদের মাঝে ভাষা,বর্ণ,গোত্র বা ভূগোলের নামে বিভক্তির দেয়াল গড়া হারাম। প্যান-ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের দর্শন নিয়ে নানা ভাষাভাষি মুসলমান একই জায়নামাযে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেমন কাতার বাঁধে, তেমনি কাব্বাকে ঘিরে একাকার হয়ে তাওয়াফ করে। এমন একটি বিশ্ব ভাতৃত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাঙালী, পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান এরূপ নানা ভাষাভাষি মানুষ নিয়ি অখণ্ড পাকিস্তান নির্মানের ভাবনা। সে ভাবনা থেকেই ১৯৭১য়ে জন্ম নেয় অখন্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। সেটিই হলো রাজাকারের চেতনা। তেমন একটি চেতনা নিয়েই ১৯৬৫ সালে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালীরা লড়েছে। এ চেতনায় জুলুম, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনুমতি আছে,কিন্তু মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অনুমতি নাই। ভারতসেবী আওয়ামী পক্ষটির কাছে স্বৈরাচার,অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামায় কোন আগ্রহ ছিল না,বরং ছিল ক্ষমতার প্রচন্ড মোহ। সে মোহ নিয়েই মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্তের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশভাঙ্গার যুদ্ধ। সে যুদ্ধে ভারতকেও ডেকে আনে। অথচ দেশভাঙ্গার এমন যুদ্ধে অংশ নেয়া ইসলামে হারাম। অথচ স্বৈরাচার ও শোষন-বিরোধী আন্দোলনে নামলে বহু পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে মুজিব সমর্থণ পেত। সেরূপ সমর্থন তিনি ১৯৬৯ সালেও পেয়েছেন। আইয়ুব সরকারের জেলখানা থেকে মুজিবকে মুক্তি দেয়ার পক্ষে সে সময় জোড়ালো দাবী জানিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা। এমনকি একাত্তরে মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার দাবী জানিয়েছিল জামায়াতে ইসলামিসহ বহু দল। কিন্তু দেশভাঙ্গার কাজে মুজিবের সমর্থণ করাটি তাদের জন্য ছিল অনতিক্রম্য রেড-লাইন। শুধু রাজনৈতীক কারণেই নয়,ধর্মীয় কারণেও পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়াটি ধর্মভীরু মুসলমানদের জন্য সম্ভব ধর্মীরঅচিন্তনীয় ছিল না। এটি হতো মহান আল্লাহর হুকুমের সাথে গাদ্দারি। বরং দেশভাঙ্গার উদ্যোগ হলে মু’মিনের দায়িত্ব হয় সর্বশক্তি দিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আর এটিই রাজাকারের দর্শন ও অনুপ্রেরণার উৎস। অপরদিকে আওয়ামী লীগের ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতিয়তাবাদী দর্শন। ভাষাগত চেতনার ভিত্তিতে রাজনীতি করা,মানচিত্র গড়া, সে মানচিত্রে অবাঙালীদের নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাই তাদের রাজনীতি। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার মূল উৎস হলো এটি। ইসলামে এটি সুস্পষ্ট কুফরি। এ চেতনাটি আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক। একাত্তরের সংঘাত চলাকালীন ৯ মাস ধরে দেশের বরেণ্য আলেম-উলামাগণ ইসলামের সে মৌলিক শিক্ষাটি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে কার সন্দেহ থাকলে সে আমলের পত্র-পত্রিকায় তাদের দেয়া প্রকাশিত বিবৃতিগুলো পড়ে দেখতে পারেন। তাই বহু আলেম,মাদ্রাসার বহু হাজার ছাত্র, পীরদের হাজার হাজার মুরীদ রাজাকার হলেও তাদের কেউ মু্ক্তিযোদ্ধা হয়েছে সে প্রমাণ নাই বললেই চলে।  আওয়ামী বাকশালীদের পক্ষ থেকে দাড়ি-টুপিধারিদের ঢালাও ভাবে রাজাকার বলার মূল কারণটি তো এখানেই।

একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষনে প্যান-ইসলামিক ও জাতিয়তাবাদী –চিন্তার এ দু’টি মডেলকে অবশ্যই বুঝতে হবে। নইলে দুই পক্ষের বিচারে প্রচন্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্মে, আচরণে, রুচীবোধে ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য তা তো এই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার বা দর্শনের মডেলের পার্থক্যের কারণেই, খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর ভিন্নতার কারণে নয়। তাই একই রূপ খাদ্যপানীয় ও একই জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ যেমন রাজাকার হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাও হয়েছে। মানুষ মরে যায়,কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে। চেতনার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো দর্শন। আর দর্শন তো বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। আর তা যদি হয় ইসলামী দর্শন তবে সেটি তো মৃত্যুহীন। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারের। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটি গণ্য হয় সাম্প্রদায়ীক চেতনা রূপে। চেতনায় সেক্যুলার  হওয়ার কারণে ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদীরা ভাবতেই পারে না, মানুষ কিভাবে অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষকে রাজনীতির ময়দানে আপন রূপে গ্রহণ করতে পারে। তাই ১৯৪৭ সালে ১২শত মাইলের ব্যবধানের দুইটি ভিন্ন এলাকাল মুসলমানদের একত্রে পাকিস্তান সৃষ্টিটি ইসলামি চেতনাশূন্য সেকুলারিস্টদের কাছে আজগুবি মনে হয়। তাদের কাছে বরং প্রিয়তর মনে হয় পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের সাথে একাত্ম হয়ে যাওযায়।  তারা ভাবতেই পারে না, একজন বাঙালী মুসলমান কীরূপে অবাঙালী মুসলমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারে।


সেক্যুলারিস্টদের বিস্ময়
প্রকট এক বিস্ময় নিয়ে সম্প্রতি এক উপসম্পদকীয় লিখেছেন দৈনিকের যুগান্তরের সাংবাদিক এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরকারি পক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মাহবুব কালাম। ১৯/১২/১২ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তাঁর কাছে বিস্ময়ের বিষয় পাকিস্তানের মত একটি দেশের ২৩ বছর বেঁচে থাকাটি নয় বরং দেশটির জন্ম লাভ নিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পোষাক-পরিচ্ছদ, ভিন্ন খাদ্যপানীয় -এত ভিন্নতা নিয়ে বাঙালী মুসলমানগণ কীরূপে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এক দেশ গড়লো? এ বিস্ময়টি শুধু জনাব মাহবুব কামালের একার নয়, প্রতিটি সেকুলারিস্ট, প্রতিটি ন্যাশনালিস্ট ও প্রতিটি নাস্তিকেরও। তারা গোত্রীয় বন্ধন, ভাষার বন্ধন, খাদ্য-পানীয়, জলবায়ু, পোষাক-পরিচ্ছদের বন্ধনের বাইরে কথা ভাবতেই পারেনা। তাদের কাছে ধর্মীয় বন্ধন কোনরূপ বন্ধনই মনে হয় না। অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো ভূগোল, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রীয় সীমারেখার উর্দ্ধে উঠে অন্য দেশে, অন্য গোত্রে বন্ধু খুঁজে বের করা। তাদের সাথে করে এক উম্মতে মুহাম্মদী গড়ে তোলা। মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু নানা ভিন্নতা নিয়ে জায়নামাযে দাড়ানো নয়, বরং রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহের ময়দানে একত্রে দাঁড়ানোও। এটিই মু’মিনের ঈমানদারি। যার মাঝে সে ঈমানদারি নাই সে যেমন পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বিস্মিত হবে,তেমনি বিস্মিত হবে দেশটি ২৩ বছর বেঁচে থাকাতেও। সেটিই ফুটে উঠেছে জনাব মাহবুব কামালের নিবদ্ধে।  তবে তাঁর জন্য আরেক বিস্ময় হলো, আগ্রাসী ভারতের হামলা না হলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যেমন সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি যুগ যুগ তা বেঁচেও থাকতো। ভারতের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়তো শতাধিক পারমানবিক বোমার অধিকারি আজকের পাকিস্তানকে ভাঙ্গা। তাছাড়া ইরান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিমদেশগুলোতে ইসলামপন্থিদের হাতে সেক্যুলারদের যে বিপর্যয় তাতে অখন্ড পাকিস্তানেও কি তার বিপরীত স্রোত বইতো? তখন স্বৈরাচারি মুজিবের সৈনিকেরা কি রাজপথও ধরে রাখতে পারতো? পেরে উঠতো কি ইসলামী চেতনায় উজ্জিবীত রাজাকারদের সাথে? তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ছিল অখন্ড পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের এলাকা। কোন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি বিচ্ছন্নতা চায়? এরূপ নজির কি সমগ্র মানব ইতিহাস আছে? বিচ্ছিন্নতার দাবী করে তো দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠরা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্য থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ যে রাজাকার রূপে শপথ নিবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছিল। এ সহজ সত্যটি মাহবুব কামালগণ না বুঝলেও ভারতীয় নেতাগণ ঠিকই বুঝেছিল। তাই কাল বিলম্ব না করে তারা একাত্তরে দ্রুত হামলা করেছিল। এখন তাদের ভয়, তাদের পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান নিয়ে। তাই একাত্তরের ন্যায় ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে তারা আরেক যুদ্ধ শুরু করেছে। এটিকে নাম দিয়েছে রাজাকার নির্মূলের যুদ্ধ। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর যে রাজাকারদের নির্মূলে আপোষহীন –সে ঘোষণাটি বার বার দিয়েছেন। ভারত সরকার একাত্তরে যেমন আওয়ামী লীগের পাশে ছিল সেরূপ এবারও থাকবে -সে ঘোষণাটি সম্প্রতি সহরোয়ার্দী উদ্দানের এক সমাবেশে দিয়েছেন বাংলাদেশে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তি।

“আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের বিস্ময়টিও কম নয়। ১২/১২/১২ তারিখে তাঁর পত্রিকায় তিনি এক বিশাল উপসম্পাদকীয় লিখেছেন জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে। তার প্রশ্ন, জামায়াত কেন একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিল। এজন্য তিনি জামায়াতের রাজনৈতীক কাণ্ডজ্ঞান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ তিনি ভূলে গেছেন, শুধু জামায়াত নয় বহু সংগঠন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, মশিহুর রহমান, আব্দুল আলীম, আব্দুল মতীন চৌধুরির ন্যায় এমন বহু ব্যক্তি যাদেরকে বিএনপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রী রূপে বসিয়েছিল। কিন্তু জনাব মাহমুদুর রহমান তাদের কাউকে আসামীর কাঠগড়ায় খাড়া করেননি। তাদের রাজনৈতীক কান্ডজ্ঞান ও দেশপ্রেশ নিয়েও প্রশ্ন করেননি। কিন্তু প্রশ্ন তুলেছেন শুধু জামায়াত নেতাদের বেলায়। জনাব মাহবুব কামালের মত জনাব মাহমুদুর রহমানও একাত্তরের বিচার করেছেন চিন্তার সেক্যুলার মডেলে। চেতনার মডেল পাল্টে গেলে বিচারও পাল্টে যায়। চিন্তার মডেল সেক্যূলার হলে জ্বিনাও প্রেম মনে হয়। পতিতাবৃত্তির ন্যায় জঘন্য জিনাকে বাঁচিয়ে রাখাটিও জায়েজ গণ্য হয়। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ তো সে বিচার নিয়েই কাফেরদের প্রচলিত পতিতাবৃত্তিকে একটি পেশা রূপে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইসলামে জ্বিনার চেয়ে জঘন্য হলো সূদ। বলা হয়েছে সেটি নিজের মায়ের সাথে জ্বিনার সমতূল্য। অথচ বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেটিও জায়েজ। আরেক গর্হিত হারাম হলো, কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গা। অথচ সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেটিও জায়েজ মনে হয়। জনাব মাহমুদুর রহমান তেমন এক সেক্যুলার চেতনায় বলিয়ান হয়েই কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে স্বাধীনতা মনে করেছেন।আর যারা সে হারাম কাজে অংশ নেননি তাদের কান্ডজ্ঞান ও দেশপ্রেম নিয়েই তিনি অভিযোগ খাড়া করছেন। তিনি সম্প্রতি বিচারপতি নিজামূল হকের স্কাইপী সংলাপ ছেপে দেশের ইসলামপন্থিদের কাছে সুনাম অর্জন করেছিলেন,আর সেটিকে তিনি বেছে নিয়েছেন একাত্তর নিয়ে নিজের সেক্যুলার ব্যাখ্যা ছড়ানোর মোক্ষম সময় রূপে।

সেক্যুলারিস্ট ও ন্যাশনালিস্টের কথা, পাকিস্তানে স্বৈরাচার ও শোষণ ছিল। অতএব একত্রে থাকা অসম্ভব ছিল। কথাটি সত্য যে,পাকিস্তানে স্বৈরাচার ছিল। কিন্তু স্বৈরাচার তো বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরাচার কি পাকিস্তানের স্বৈরাচারের চেয়েও কম স্বৈরাচারি? আজকের পাকিস্তান তো বাংলাদেশের চেয়ে বহু গণতন্ত্রি। তাছাড়া পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৭১য়ে জেনারেল ইয়াহিয়া যে মাপের নির্বাচন দিয়েছিল সেটি কি বাংলাদেশে আশা করা যায়? কোন কালেই পাকিস্তানে একদলীয় বাকশাল চাপানো হয়নি, সেটি বাংলাদেশে হয়েছে। মুজিব আমলে যেমন ৩০ হাজার রাজনৈতীক কর্মিকে হত্যা করা হয়,অথচ পাকিস্তানে এমন কর্ম ঘটেনি। এমনকি মুজিবকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে সে অভিযোগও মুজিব কোন সময় করেননি। আজ যেরূপ রাজনৈতীক বন্দীদের হাতপায়ে ডান্ডাবেরী পড়ানো সেটিও সে সময় হয়নি। পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য মুজিব ভয়নাক অপরাধী রূপে প্রমাণিত হলেও তাকে জেলে ফাস্ট ক্লাস দেয়া হয়েছে। ১৯৭১য়ে তাকে যখন জেলে নেয়া হয়,তার পরিবারের ভরন পোষন দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানে অনেক ব্যর্থতা ছিল, কিন্তু সেজন্য কি দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বপাকিস্তানীরা কি কম দায়ী? তাছাড়া স্বৈরাচারের কারণে কোন দেশের ভূগোলকে কি দায়ী করা যায়? বাংলাদেশে স্বৈরাচার আছে বলেই কি আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা বৃহত্তর সিলেট জেলাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে হবে? বা বাংলাদেশ ভেঙ্গে চট্টগ্রামকে আলাদা করতে হবে? মুসলিম দেশভাঙ্গা জায়েজ হলে বহু আগেই বিশাল মুসলিম খেলাফত ভেঙ্গে হাজার বছর আগেই শ’খানেক বাংলাদেশ নির্মিত হতো। খেলাফত তো বেঁচেছিল নানা ভাষাভাষি মুসলমানদের ঈমানী বন্ধনের কারণে। সে ভূগোল পাহারা দেয়ার জন্য তখন কি বিশাল সেনাবাহিনী ছিল? ছিল কি আজকের মত এত ক্যান্টনমেন্ট ও সামরিক লজিস্টিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা?

অপ্রাসঙ্গিকতা বনাম স্বাধীনতা
সম্প্রতি জার্মানীর চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল মূল্যবান নসিহত খয়রাত করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি ড্যাভিড ক্যামরনকে। ক্যামেরান ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটেনের একসময় বিশ্বজো্ড়া সাম্রাজ্য ছিল। সে গর্ব নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউনাইটেড স্টেটস অব ইউরোপের সামান্য প্রদেশ হতে তার শরমে বাধে। এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ক্যামেরনকে বলেছেন,পৃথিবীটি খুবই গোলমেলে কঠিন জায়গা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বিশ্বরাজনীতিতে পাত্তা পাবে না। সম্প্রতি ব্রিটেনবাসীদের উদ্দেশ্যে নসিহত দিতে গিয়ে একই সুরে কথা বলেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি বলেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের সামনে ইস্যু ছিল: যুদ্ধ না শান্তি? আমরা শান্তির পথ বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো আমার বিশ্বরাজনীতিতে relevant অর্থাৎ প্রাসঙ্গিক থাকবো না irrelevantতথা অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার দিকে ঝুকবো।” তিনি হুশিয়ার করিয়ে দেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে আমরা বিশ্বরাজনীতি ও ইউরোপীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বো। তাই তিনি নসিহত দিয়েছেন ইউরোপীয় রাজনীতির কেন্দভূমিতে থাকার।

এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও টনি ব্লেয়ার যেটি আজ বুঝেছেন সেটি বাংলার সহরোয়ার্দী, নাজিমুদ্দীন, ফজলুল হল, আকরাম খাঁ, তমিজুদ্দীন খাঁ, আব্দুস সবুর খান,নুরুল আমীন বুঝেছিলেন ১৯৪৭ সালেই। নবাব সলিমুল্লাহ বুঝেছিলেন আরো আগে। তাই তিনি সর্বভারতের মুসলিম নেতাদের ঢাকাতে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা তখন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে থাকার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুধু উপমহাদেশের নয়, বিশ্বের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে থাকার চেষ্টায় ছিলেন। কারন পাকিস্তান ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা বাঙালী মুসলমানদের জন্য যে দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তা ইসলামে অঙ্গিকার শুণ্য আওয়ামী কাপালিকরা পণ্ড করে দেয়। সে অপরাধ কর্মে সহায়তা দিতে দ্রুত এগিয়ে প্রতিবেশী কাফের রাষ্ট্র ভারত। বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্য নদীর ন্যায্য পানি বা চুক্তিমোতাবেক পাওনা তিন বিঘা করিডোর দিতে ভারত রাজী না হলে হবে,পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য বিপুল অর্থ ও অস্ত্রের বিনিয়োগ করে।

প্রশ্ন হলো,পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী রূপে পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দীন, বগুড়ার মহম্মদ আলী বা সহরোয়ার্দী বিশ্বরাজনীতিতে যে গুরুত্ব পেত সেটি কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পায়? হোয়াইট হাউসে তাদের দাওয়াত দিয়ে নেয়া হত।  আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের লবিং কোম্পানীগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়ে তোষামদে লাগিয়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রবেশের সুযোগ পায় না। বরং যা ঘটেছে তা হলো, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কলকাতার এক সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী রূপে আখ্যায়ীত হয়েছিলেন। যা ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, সিকিম, মেঘালয়, মিজোরাম এরূপ ভারতীয় প্রদেশের সরকার প্রধানকে বলা হয়। বিশ্বরাজনীতির উত্তাল বিশাল সমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকা নয়, বিশাল জাহাজ ভাসাতে হয়। আওয়ামী লীগের নৌকা বাংলার খাল-বিলে ভাসানো যায়, কিন্তু সেটি কি বিশ্বরাজনীতির বিশাল সাগরেও পাত্তা পায়? বরং বাংলাদেশ আজ ভারতের কাছেও পাত্তা পাচ্ছে না। বিশ্ব রাজনীতিতে দূরে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ২৩ বছরে কোন বাঙালী মুসলমান কি সীমান্তে গুলির খাদ্য হয়েছে? পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতের বিএসএফের কি গুলি ছুড়ার সাহস আছে? অথচ বাংলাদেশে কিশোরী ফালানীকে হত্যা করে তারা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে পোষ্টার বানিয়ে রাখে। বার্মার আরকানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমান কি পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরে কখনো ঘরহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে? অথচ এখন হচ্ছে। কারণ তারা জানে বাংলাদেশ একটি মেরুদণ্ডহীন একটি শৃঙ্খলিত রাষ্ট্র। এবং নাই মাথা তুলে প্রতিবাদের সাহস।সেটি চূর্ণ করেছে ১৯৭১য়েই।

ইসলামে অঙ্গিকারহীন আওয়ামী সেক্যুলারিষ্টদের অপরাধটি শুধু এ নয় যে, বাংলাদেশকে তারা একটি তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বা বিশ্বের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ রূপে পরিচিত করেছে।  বরং মূল অপরাধটি হলো বাংলার মুসলমানগণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ  নাগরিক হওয়ার কারনে ১৯৪৭থেকে বিশ্বরাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সে সুযোগ পেয়েছিল তা থেকে তারা বঞ্চিত করেছে। সে সাথে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভারতের গোলামীর জিঞ্জিরে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আরেক কাশ্মীরে। আজ হোক কাল হোক এনিয়ে তাদের এ অপরাধের ব্চিার হবেই। পাকিস্তানের বিভক্তিটি ছিল ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্ট,সেক্যুলারিস্ট ও ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকারশূণ্যদের প্রজেক্ট। ইসলামের বিশ্বব্যাপী গৌরব নিয়ে যারা ভাবেন তারা এ প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিল না। ইরানের শরিফ মোসাদ্দেক মুজিবের চেয়ে অনেক বেশী সৎ ও দেশীপ্রেমিক নেতা ছিলেন। তিনি বিদেশী তেল কোম্পানিকে ইরানে জাতীয়করণ করেছিলেন। শাহকেও বিতাড়িত করে দেশকে প্রজাতন্ত্রি করেছিলেন। কিন্তু এরপরও ইরানের ইসলামিস্টগণ তাঁকে মাথায় তুলেনি। মোসাদ্দেকের অপরাধ, তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। মুর্তিপুজারি হওয়ার চেয়ে ইসলামে কি এটি কম অপরাধ? মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অপরাধগুলো পৌত্তলিকদের হাতে হয়নি। হয়েছে ভাষা, বর্ণ, ভূগোল-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দুর্বত্তদের হাতে। আজ ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়ায় যা কিছু হচ্ছে তা তো জাতীয়তাবাদের কামাই। আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের বিজয় নিয়ে মাহমুদুর রহমানের সামান্যতম অঙ্গিকার থাকলে তিনি কি একাত্তর নিয়ে এমন মূল্যায়ন করতেন?

ছাত্রশিবিবের বিজয় মিছিল
পত্রিকায় প্রকাশ গত ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে ইসলামি ছাত্রশিবির বিজয় মিছিল বের করেছে। এটি আরেক বিস্ময়। এ মিছিল কোন বিজয়ের? ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয়ী হয়েছিল সেকুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্টসহ সকল ইসলামের বিপক্ষ শক্তির। সেদিনটি ছিল ঈমানদারদের অশ্রুবর্ষণের দিন। শুধু বাংলাতে নয়, পাকিস্তান বা ভারতের মুসলমানদের মাঝেই নয়, বরং সেদিন হৃদয় শোকাহত হয়েছিল সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের। এ বিশেষ দিনটিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশটি ভেঙ্গে যায়। এবং সেটি কাফের শক্তির হাতে,যারা ১৯৪৭ সালেই দেশটির প্রতিষ্ঠা চায়নি।  মুসলমানরা আজ  ৫৫টির বেশী মুসলিম দেশে বিভক্ত। সে বিভক্তি নিয়ে আজ নানা মানচিত্র, নানা পতাকা, নানা সরকার। আজ  সে বিভক্তি নিয়ে দেশে দেশে উৎসব হচ্ছে। মুসলমানদের আজকের সবচেয়ে বড় দৈন্যতা সম্পদের নয়, জনসংখ্যার কমতিও নয়। সেটি একতার। বিভক্তির কারণেই মুসলমানগণ আজ শক্তিহীন। ইসলামি ছাত্র শিবিরের নেতৃবৃন্দ কি এসমস্যাটি বুঝে?

মুসলমানকে শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা ও  দাওয়াতী কাজ নিয়ে বাঁচলে চলে না। দেশের ভূগোলও বাড়াতে হয়। নইলে রাজনৈতীক শক্তি বাড়ে না। কুয়েত ও কাতারের মাথাপিছু আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অধিক। সেটি যদি আরো দশ গুণ বাড়ে তবুও কি বিশ্ব রাজনীতিতে এ দেশ দুটির কোন গুরুত্ব বাড়বে? ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যা কিছু হচ্ছে সেগুলো প্রভাবিত করতে তাদের কি কোন সামর্থ বাড়বে? বাড়বে না। কারণ তাদের সামর্থ সীমাবন্ধ দেশ দুটির ক্ষুদ্র ভূগোলে। নবীজী (সাঃ) তাই ইসলামকে  শুধু আরবভূখন্ডে সীমাবদ্ধ করার বিরোধী ছিলেন। সাহাবাদেরকে তিনি রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কন্সটান্টিনোপল দখলের নসিহত করেছিলেন। আজ সেটি ইস্তাম্বুল। সে জামানায় সেটি ছিল, আজকের ওয়াশিংটন দখলের নসিহত। কিন্তু মুসলমানগণ তার সে নসিহত পুরা করে ছেড়েছেন।

শিবিরের নেতাকর্মীরা ইসলামি আন্দোলনের কথা বলে, জিহাদের কথা বলে, ইসলামের প্রতিষ্ঠার কথাও বলে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় মিছিলটি কিসের নমুনা? বাংলার নাজিমুদ্দিন, সহরোয়ার্দী, আকরাম খাঁ, নূরুল আমীন, মৌলবী তমিজুদ্দীন,আব্দুস সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরি,শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস –এদের কেউই ইসলামের আন্দোলনের নেতাকর্মী ছিলেন না। তারা মাওলানা মওদূদী, শহীদ কুতুব, হাসানূল বান্নাহর কেতাব পড়েননি। অথচ তারা নিজেদের ভাষা, ক্ষুদ্র ভোগাল ও নিজেদের পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে যে পরিচয় সেটি নিয়ে গর্ব না করে তার উর্দ্ধে প্যান-ইসলামিক চেতনা নিয়ে রাজনীতি করেছেন। পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, বিহারী –এরূপ নানা অবাঙালীদের সাথে মিলে বিশাল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ শিবির ভেসে গেল জাতিয়াতবাদের স্রোতে? আব্দুস সবুর খান,শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, আব্দুল আলীমের ন্যায় নেতারা বিজয় মিছিল না করেও নির্বাচনে বার বার জিতেছেন। ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বর কাদের বিজয় এবং এদিনে কারা শহীদ হয়েছিল সে হুশ কি তাদের আছে? আজ  যে সন্ত্রাসী পক্ষের হাতে শিবির কর্মিরা শহীদ হচ্ছে, তাদের হাতে একাত্তরে ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মী শহীদ হয়েছেন। সে শহীদদের চেহারাগুলো কি তাদের স্মৃতীতে একবারও ভাসে না? ভাসলে তারা বিজয় উৎসব করে কীরূপে? কতো নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। কথা হলো, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে বাঁচার জন্য কি এমন মিছিল জরুরী হয়ে পড়েছিল বিজয় মিছিল করতে হবে? তারা কি মনে করে নিয়েছে, এ বিজয় মিছিল করলেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে তাদের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়বে?

হিকমত না আত্মসমর্পণ?
বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক বিচ্যুতি শুধু যে শিবিবের মধ্যে -তা নয়। আরো উপরে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে বৈধ রূপে নির্বাচনি কমিশনের কাছে নথিভূক্ত বা রেজিস্ট্রী করার প্রয়োজনে দলটির গঠনতন্ত্র থেকে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের কথাটি আস্তাকুরে ফেলে দিয়েছে। কথা হলো দল তো বাঁচে একটি আদর্শকে বাস্তবায়ীত করার জন্য। মুসলমান রাকজনৈতীক দল গড়ে আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করতে তথা শরিয়তের প্রতিষ্ঠায়। সেটিকে আস্তাকুরে ফেললে আর রাজনীতি এবং দলগড়ার প্রয়োজনটাই কি? এটি হিকমত না আত্মসমর্পণ? দলটি গঠনতন্ত্র থেকে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিটি আস্তাকুরে ছুড়ে না ফেলার কারণে জামায়াত যদি নিষিদ্ধও হতো বা নেতাদের জেলে যেতে হতো তবুও তো তাদের ঈমান বেঁচে যেত।আল্লাহ থেকে তখন মহান পুরস্কার পেতেন। আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দল বাঁচানোর চেষ্টা কি শুধু এমপি হওয়া ও মন্ত্রী হওয়ার স্বার্থে? মিশরে ইখওয়ানূল মুসলীমূনকে বিগত ৬০ বছর নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। নেতাদের বছরের পর বছর জেলে থাকতে হয়েছে। শহীদ কুতুবদের মত প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসীতেও ঝুলতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কি তাদের আন্দোলনে ছেদ পড়েছে? তারা এখন বিজয়ী এবং ক্ষমতাসীন। আন্দোলনের জন্য কি দল লাগে? লাগে আদর্শ। লাগে সে আদর্শের পতাকাবাহি আপোষহীন নেতা।দল ছাড়াই আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে স্বৈরাচারি শাহকে হঠিয়ে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়ে গেল।দল ছাড়াই এ উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বড় বড় আন্দোলন হয়ে গেছে। উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটি কংগ্রেসের নেতৃত্বে নয়। সেটি ছিল খেলাফত আন্দোলন। সে আন্দোলনের পিছনে কোন দল ছিল না। ছিল মাওলানা মহম্মদ আলী,মাওলানা শওকত আলীর ন্যায় নেতা ও তাদের প্যান-ইসলামিক আদর্শ। জামায়াত কি শুধু দল নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়? এবং সেটি কি যে কোন মূল্যে?

দলটির নেতারা আদালতে দাঁড়িয়ে যা কিছু বলেছেন সেটিই কি কম বিস্ময়কর? জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভূয়সী শ্রদ্ধা জানিয়ে আদালতে বক্তব্য শুরু করেছেন। কাউকে শ্রদ্ধ জানানোর অর্থ তার নামকে নয়, বরং তার নীতি, কর্ম ও চরিত্রকে সমর্থন করা। অথচ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা এসেছে, সকল ইজ্জত একমাত্র আল্লাহর, তাঁর রাসূল এবং তাঁর অনুসারি ঈমানদারদের। ইসলামি শক্তিকে পরাজিত করা,মুসলিম ভূমিকে দ্বিখন্ডিত করা ও ইসলাম পন্থিদের হত্যার শপথ নিয়ে যারা কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলো,বহু আলেমকে যারা শহীদ করলো,খোদ জামায়াতসহ সকল ইসলামী দলকে যারা নিষিদ্ধ করলো তাদের শ্রদ্ধা জানালে সে নেতার ইসলামি নীতি বা আদর্শ কি ড্রেনে গিয়ে পড়ে না? এমন ব্যক্তিগণ আদালতে দাঁড়িয়ে,“আমি রাজাকার ছিলাম না” বলবে, সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? রাজাকারগণ কি চোরডাকাত,বা ছাত্রলীগ কর্মীদের ন্যায় খুনি সন্ত্রাসী যে রাজাকার বললে তাকে “রাজাকার ছিলাম না” বলে প্রমাণ দিতে হবে? একই সুরে একই কথা বলেছেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী। আদালতে রাজাকার বলায় তিনি যে রাজাকার ছিলেন না সেটি প্রমাণ করতে তিনি উঠে পড়ে লেগে যান। বিস্ময়ের বিষয়, তিনি সাক্ষীসাবুদ খাড়া করেছেন মুক্তি বাহিনী থেকে। অথচ একাত্তরে তাদের চোখের সামনে বহু রাজাকার শহীদ হয়েছেন। অনেকে তাদের সহকর্মীও ছিলেন। অনেকের জানাজাও তারা পড়েছেন। তাদের অপরাধটি কি  ছিল? কোন শহীদ রাজাকারের চেহারা কি এসব নেতাদের চোখের সামনে ভাসে না? অপর দিকে জামায়াতেরর আরেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা তো আদালতে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন,তিনি মু্ক্তিবাহিনীর ট্রেনিংও নিয়েছিলেন। এই হলো জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতাদের চেতনাগত অবস্থা।

জামায়াত নেতারা ভূলে যান, তাদেরকে রাজাকার হওয়ার জন্য আদালতে তোলা হয়নি। তোলা হয়েছে আওয়ামী বাকশালীদের রাজনৈতীক শত্রু হওয়ার কারণে। একাত্তরে লক্ষাধিক ব্যক্তি রাজাকারের পোষাকে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের কাউকে কি আদালতে তোলা হয়েছে? ভারতসেবী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে রাজাকার হলো একটি প্রতিকী শব্দ। যার মধ্যে ইসলামের প্রতি অঙ্গিকার আছে, প্যান-ইসলামি চেতনা আছে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জজবা আছে -তারাই ভারতীয় দালালদের কাছে রাজাকার। শাহ আজিজুর রহমানকে সংসদে বার বার রাজাকার বলা হয়েছে। রাজাকার বলা হয়েছে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে। রাজাকার বলা হয়েছে মেজর আব্দুল জলীলকে। কিন্তু তারা কি তা খন্ডনের চেষ্টা করেছেন? ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেতনা নিয়ে যাদের রাজনীতি বা বুদ্ধিবৃত্তি,তাদের জন্ম একাত্তরের পরে হলেও ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের দৃষ্টিতে তারা রাজাকার। প্রতিটি মুসলমানকে তো এ নিয়ে গর্ব করা উচিত। কারণ ইসলামের শত্রুপক্ষের গালি খাওয়া তো নবীজী (সাঃ)র মহান সুন্নত। এতে প্রতিদান মিলবে পরকালে।সেসাথে একাত্তরে যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের কোরবানীর প্রতিও সম্মান প্রদর্শণ হবে।

লেখক : ফিরোজ মাহবুব কামাল

1 comments:

Unknown বলেছেন...

apnar eishob lekha pagol er paglami sara r kisu nah. Apni jevabe shob musim k vai vabtasen tara west paikka ra amader vai vabto nah. Tai amader proti je ondor obohela hoise tar hishab apnara chan nai. Apnar vabna moto shob muslim jodi ek desh hoito taile to world e 1tai muslim country hoito. Desh kokhono emon dhormo dia vag kora jai nah. Dhormo dia desh vag kore hazar hazar mohajer toiri korsen apnara. Vitemati sara korsen tader. tarai aj rastar pasher bostite koste khaye na khaye jibon japon kortase pakistan & bangladesh e. R apnara ekhane boshe middle east er rajnite nia matha ghaimaiten. Turky te vumikompoo hoile chada tuila pathaiten r deshe bonaa hoile kono shahajoo diten nah. Manush k maunsh hishe dekhen & vaben takeo apnar uporalai toiri korse & apnar uporalai take emon poribeshe boro koraise jekhane allah nam sune nai but apni take kafir mone kore mone je biddesh poshn kortasen shai kintu ta kortase nah. Tai manush k manush hishabe dekhen manobothar dristite dekhen inshallah apnar problem solve hoiya jabe.

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম