ঘোড়াডিঙি বটতলা
দিন দুপুরেও যায় না চলা
ঘোড়াডিঙি বটতলা!
নাম শুনলেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। এক ধরনের ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায় বুকের ভেতর।
রাত তো দূরে থাক, দিনের বেলাও মানুষ ঐ রাস্তাটুকু পার হয় ভয়ে ভয়ে।
মুকুন্দপুর ও শিমুলিয়া পার হয়ে সোজা পশ্চিম বরাবর রাস্তা। কচুর বিলের পেটের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সেটা।
বিলের এপার শিমুলিয়া। ওপারে খড়শে।
মাঝখানের রাস্তাটি দুই পাশের সেতুবন্ধ।
ঘোড়াডিঙি বটতলা খড়শির প্রায় কাছাকাছি। কোনো অঞ্চলের মানুষ সহজে বটতলা পার হতে চায় না।
বটতলা বলে কথা!
বিশাল বটগাছ!
চারপাশে ছড়া ডালপালা আর ঝুরি। গা ছম ছম করার সুদৃশ্য
দিন দুপুরেও যায় না চলা
ঘোড়াডিঙি বটতলা!
নাম শুনলেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। এক ধরনের ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায় বুকের ভেতর।
রাত তো দূরে থাক, দিনের বেলাও মানুষ ঐ রাস্তাটুকু পার হয় ভয়ে ভয়ে।
মুকুন্দপুর ও শিমুলিয়া পার হয়ে সোজা পশ্চিম বরাবর রাস্তা। কচুর বিলের পেটের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সেটা।
বিলের এপার শিমুলিয়া। ওপারে খড়শে।
মাঝখানের রাস্তাটি দুই পাশের সেতুবন্ধ।
ঘোড়াডিঙি বটতলা খড়শির প্রায় কাছাকাছি। কোনো অঞ্চলের মানুষ সহজে বটতলা পার হতে চায় না।
বটতলা বলে কথা!
বিশাল বটগাছ!
চারপাশে ছড়া ডালপালা আর ঝুরি। গা ছম ছম করার সুদৃশ্য
ছায়াঘেরা ঘনপাতায় সম্রাটের মত দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটি। তার পুবের পাশে একটা সামান্য উঁচু ঢিবি।
ঐ ঢিবির মধ্যে নাকি একটি ঘোড়াকে কবর দেয়া হয়েছে।
কত যুগ কিংবা কতকাল আগে সে কথা কেউ বলতে পারে না।
শুধু বলে, হ্যাঁ আছে।
ঐ কবরের মধ্যেই ঘোড়াটি আছে।
সেই ঘোড়া নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের গল্প-কাহিনী।
ঠিক যেন রূপকথার মত।
রাতে শুনলে ছোটরা আর ঘুমুতে পারে না।
কুড়মুড় হয়ে দলা পাকিয়ে মাকে কিংবা দাদীকে আঁকড়ে ধরে পার করে দেয় সারাটি রাত।
কেউ কেউ মায়ের বুকের নিচে মাথা গুঁজে কাঁপতে থাকে।
এমনি ভয় ধরানো, গা ছম ছম করা সব কিচ্ছা-কাহিনী! সবার মুখে মুখে!
কেউ বলে উড়াল ঘোড়া!
সে আবার কী!
হ্যাঁ, ঘোড়াটি দিনের বেলা কচুর বিলসহ চারপাশে দাবড়ে বেড়াতো আর রাত হলেই নাকি উড়ে উড়ে যেখানে খুশি যেতে পারতো।
সন্ধ্যার পর বাঁশবাগানে তাকে দেখা যেত।
অমাবস্যার অন্ধকার রাতে রাস্তার মাঝে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো। চৈত্র মাসের খা খা দুপুরে তেপান্তনের মাঠের মধ্যে দেখা যেত।
সে নাকি কপোতাক্ষ হেঁটে পার হত।
এক চুমুকে কোয়ার পানি খেয়ে ফেলতো।
দিনের বেলায় যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতো।
আর রাতের সময় কখনো বিশ্রামের জন্য বটগাছের মাথায় উঠে শুয়ে থাকতো।
এইসব গল্প-কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে ভাসে। হাওয়ায় ভাসে।
জোছনা রাতে পুকুর পারে ভাসে। বর্ষাকালে হাতনে ভাসে।
দোলুজে টাকুর ঘোরানোর সময় ভাসে।
দুষ্টু ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর সময় ভাসে।
কেবল ভাসতেই থাকে।
কিন্তু কেউ ঘোড়াটিকে দেখেছে-এমন কথা বলতে পারে না।
তারা সবাই শুনেছে।
কেবল শুনেই এসেছে বংশ পরম্পরায়।
এজন্যই তো যত ভয় সব ওখানে জমা হয়ে আছে।
যত বিস্ময় আর কৌতূহল ওখানে রয়ে গেছে। ঘোড়াটি নিয়ে আর একটি অসম্ভব অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে।
সে নাকি ইচ্ছে মতো বটগাছটিকে ডিঙিয়ে এপার-ওপার পাড়ি দিতে পারতো।
যেখান থেকে তো নাম হয়ে গেল ‘ঘোড়াডিঙি বটতলা’।
এসব কিচ্ছা-কাহিনী গ্রামের সরল সহজ মানুষগুলো বিশ্বাস করে। ছোটরাও বিশ্বাস করে।
আমি তখন ছোট, কিশোর বয়স।
আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘোড়াডিঙি বটতলার কথা কি সত্যি?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বললেন, তোমার কী মনে হয়?
-আমি তো এর আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছিনে।
-তোমারও কি ভয় করে?
-আমি চুপ।
আববা আবারও মুচকি হাসলেন। কিন্তু মুখে কিছুই আর বললেন না।
কয়েকদিন পর।-
আব্বা বললেন, বিজয়!-
-জি!-
-আমার বাগআঁচড়ায় যেতে হবে। সেখানে থেকে সাতক্ষীরা। তুমি কি আমার সাথে বাগআঁচড়া পর্যন্ত যেতে পারবে?
আমি আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আব্বা বললেন, ভয় নেই! বেলায় বেলায় বাড়ি আসতে পারবো। খুব জরুরি দরকার।
আমি ছাড়া আব্বার সাথে যাবার আর কেউ বাড়িতে নেই।
বললাম, পারবো। আপনার সাথে যাবো।
আব্বা খুশি হলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে গুছিয়ে নাও।
আমি দ্রুত গুছিয়ে নিলাম।
মা আড়চোখে একবার আব্বা দিকে, আর একবার আমার দিকে তাকান।
বাগআঁচড়া কতদূর?
আমি জানি না।
কোন পথে যেতে হয়?
আমি জানি না।
কিভাবে যেতে হয়?
কত সময় লাগে?
না, কিচ্ছু আমি জানি না।
শুধু জানি পথ চলতে। জানি হাঁটতে।
তাই করলাম।
আব্বা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
আমি আব্বার পিছু পিছু।
হাঁটছি দু’জনে।
আব্বা বললেন, জানো তো এখান থেকে বাগআঁচড়া সাত মাইলের পথ। কাঁচা। হাঁটাপথ। কোনো যানবাহন নেই। আমাদের তো আবার সাইকেলও নেই। আছে কেবল মাথার ওপর আকাশ ও সূর্য! -
-তবে? আমি একটু অবাক হলাম।
আব্বা বললেন, হাঁটতে হবে। পারবে না? মাত্র তো সাত মাইল পথ!
-সা-ত মা-ই-ল! তাও মাত্র!
আব্বার কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম।
তিনি বললেন, সাত মাইল হাঁটা কোনো ব্যাপার হলো! আমি প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার ঝিকরগাছা ও কলারোয়া যাই। এবং আসি। পায়ে হেঁটে। দূরত্ব কত জানো?
-কত?
-দশ-বারো মাইল তো হবেই।
-তার মানে আসা-যাওয়া বিশ মাইল হাঁটা।
আমি হিসাবটা কষে ফেললাম। সেই তুলনায় অবশ্য বাগআঁচড়ার পথ কম সাত-সাত চৌদ্দ মাইল।
চৌদ্দ মাইল আমাকে হাঁটতে হবে আজ।
মনটাকে শান্ত করে নিলাম। দেখলাম মনের শক্তির কাছে পথের দূরত্ব পরাজিত হয়েছে।
আমি হেসে আব্বাকে বললাম, এটা কোনো ব্যাপার হলো!
হাঁটুন আব্বা! আমিও পারবো।
আব্বা আমার গালে আদর করে বললেন, এইতো ‘বিজয়ের’ মতো কথা! চলো।
মুকুন্দপুর পার হয়ে, শিমুলিয়া।
আমাকে নিয়ে আব্বা শিমুলিয়া ঢুকেই ডানের রাস্তায় উঠলেন। বিলের মধ্য দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে-আঁকাবাঁকা। গরুর গাড়ির চাকায় রাস্তার দু’পাশ সোজাসুজিভাবে দেবে গেছে। রাস্তার দু’পাশে ঘাস আর বুনো ফুলের গন্ধ। নাকে এসে লাগছে বাতাসের ঝাপটায়। গন্ধটি বেশ মায়াবী।
এ রাস্তায় তেমন কোনো মানুষ নেই। ডানে দিগন্তব্যাপী যেন কচুর বিল। চোখ যতদূর যায়, কেবল বিল আর বিল।
আমরা হাঁটছি।
মাঝামাঝি দ্রততায়। যাতে করে সহজে কান্ত না হয়ে পড়ি। বিলে প্রায় মাথার কাছাকাছি এসে গেছি।
এখন দেখতে পাচ্ছি একটু দূরে একটি বড় বটগাছ। দূর থেকে দেখলে গোলাকার মতই মনে হয়।
গাছটির কাছাকাছি এলে আব্বা পেছন ফিরলেন।
বললেন, এসো, বটগাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেই।
আব্বা বসে পড়লেন।
আমার হাত ধরে তার পাশে বসালেন। তারপর একটা কান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলছেন,
-জানো তো, এই জায়গাটির কি নাম?
-না!
-এটাই ঘোড়াডিঙি বটতলা।
-তাই!-
-হ্যাঁ। আর ঐ দেখ-বলে আব্বা পুবের দিকে আঙুল ইশারা করে বললেন, ঐ যে উঁচু ঢিবিটা দেখতে পাচ্ছো, ওর ভেতরেই সেই ঘোড়াটি আছে।
আব্বা হাসলেন।
তার হাসির অর্থ বুঝতে না পারলেও কেমন এক তুচ্ছতা কিংবা উপেক্ষার ভাব আছে তাতে।
আব্বার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আব্বা বললেন, জানো বিজয়!-
-কী?
-কত মুখে কত কিচ্ছা, কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে মানুষ ভাবে না। চিন্তাও করে না।
-তার মানে?
-আরে ধুর বাপু! ঘোড়াতো ঘোড়াই। যদিও এখানে কোনো কালে ছিল কি না! তা যা বলছি, ঘোড়ার এমন কী শক্তি কিংবা ডানা আছে যে সে উড়ে উড়ে বেড়াবে।
তার এমনকি বড় পেট আছে যে এক কুয়ো পানি খেয়ে ফেলবে!
তার এমন কী লম্বা পা আছে যে কপোতক্ষ হেঁটে পার হবে!
-তাহলে?
-সব বানানো, ভয়ো বুঝলে।
-বুঝলাম কিন্তু ঐ যে উঁচু ঢিবিটা?
আব্বা হাসলেন সে কী হাসি!
বললেন, পাগল ছেলে! ও রকম উঁচু ঢিবিতো কত্ত আছে মাঠে ঘাটে। ধরো ওটা ঘোড়ারই কবর। কিন্তু সে কতকাল আগের কথা! এখানে কি তার হাড়-হাড্ডি আস্ত আছে! নাকি থাকে। সবই বিলীন হয়ে যায় মাটির গর্ভে, বুঝেছো।
আমি আব্বার কথা শুনছি আর বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখছি। আব্বা আবার বললেন, মানুষ মরলে তো কবর দেয়া হয়, নাকি!
-হ্যাঁ।
-সেটা মানব সৃষ্টির প্রথম থেকেই, তাই না!
-হ্যাঁ
-এবার ধরো, মৃত মানুষ যদি কবরে সেইভাবে থাকতো, তাহলে কি এখন পৃথিবীতে পা রাখার জায়গা হত!
-না।
-এই দেখো, সেদিন পুকুর কাটতে গিয়ে বিশ হাত গভীরে হাড়ের সন্ধান পাওয়া গেল।
-হ্যাঁ।
-তাহলে কী বুঝলে!
-কবরে কোনো মৃত ব্যক্তি বা প্রাণী শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না।
-হ্যাঁ, সবই বিলীন হয়ে যায়। ঠিক তেমনি, যদি সত্যি বলেও মানি যে, ওটা ঘোড়ার কবর, তাহলেও এটা বিশ্বাস করো যে ওটা এখন ঘোড়াশূন্য কেবল একটি মাটির ঢিবি। আর শোনো যে মরে যায়, তার ভালো কিংবা মন্দ করার আর কোনো ক্ষমতাই থাকে না।
-কিন্তু ঘোড়টি এখনও নাকি রাত-বিরাতে চলাফেরা করে, কখনও বা ওড়ে, শুনেছি।
-কেউ কি চোখে দেখেছে।
-তা জানি না। তেমনটি শুনিনি।
-সবাই ওরকম শুনে শুনে আসছে। আর এ ধরনের শোনাকথা কখনো সত্যি হয় না। কেবল বানানো কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবতার সাথে যার কোনো মিল নেই, তা আবার সত্যি হয় কেমন করে!
-ঠিকই তো!
আমি চিন্তামুক্ত হলাম।
হলাম ভারমুক্ত।
আব্বা বললেন, শোনো কখনই শোনা কথায় কান দেবে না। বিশ্বাসও করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে না নিতে পারছো।
চলো এবার ওঠা যাক।
আব্বা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
সেই দাঁড়ানোটা ছিল যেন আমার সত্যের মুখোমুখি।
বাস্তবতার মুখোমুখি।
সাহস আর অবিরাম চিন্তার মুখোমুখি।
আমরা আবারও হাঁটা শুরু করলাম।
বাগআঁচড়ায় যখন পৌঁছুলাম, তখন দুপুর।
পেটে প্রচণ্ড ুধা।
বুকে পিপাসা।
আব্বা বলে কথা!
ওসব মুখে না বললেও তিনি বুঝে ফেলেন।
আমাকে বললেন, চলো ঐ দোকানের সামনে গিয়ে বসি।
আমরা বসলাম।
আব্বা মায়ের বানানো রুটি বের করে আমার সামনে মেলে ধরলেন, নাও খাও।
শুকনো রুটি আর আলু ভাজি।
আব্বাও আমার সাথে খাচ্ছেন।
খাওয়া শেষ হলে আাব্বা দোকানদারকে বললেন পানি দিতে।
পাশে টিউবওয়েল।
সুতরাং পানির কোনো সমস্যা নেই।
দোকানদার তার ছোট ছেলেকে জগ ভরিয়ে পানি আনলেন। তারপর একটি গ্লাসসহ এগিয়ে দিলেন আব্বার কাছে।
আব্বা আগে আমাকে পানি দিলেন।
তারপর নিজে খেলেন।
এখন বেশ তৃপ্ত মনে হচ্ছে।
ওজু করে যখন জোহরের নামাজ আদায় করলাম, তখন বেশ ফুরফুরে।
কান্তিও দূরে চলে গেছে।
আব্বা প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলেন দ্রুত।
তারপর আমার পকেটে কিছু টাকা দিয়ে বললেন,
-বাড়িতে গিয়ে তোমার মায়ের কাছে দিও। আমার ফিরতে দু-একদিন দেরি হতে পারে।
বুঝলাম, সংসার খরচের জন্য এই টাকা। আর এই টাকার জন্যই আমাকে সাথে করে আনা।
আব্বা!
তাকে কত চিন্তা করতে হয়।
কতদিকে খেয়াল রাখতে হয়।
কতকিছু বুঝতে হয়।
আমার বুকের ভেতর কত কথা, কত প্রশ্ন উঁকি মারছে।
আব্বার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতার বৃষ্টি ঝরে ঝরে পড়ছে।
মাত্র দু-একদিন তিনি বাইরে থাকবেন।
আমাদের যাতে কোনোপ্রকার কষ্ট না হয়, তার জন্য আগে থেকেই কত ভাবনা।
কত আয়োজন।
আব্বা আমার দিকে ফিরে বললেন, তুমি এখন হাঁটা শুরু করলে বেলায় বেলায় বাড়ি পৌঁছুতে পারবে। কি, পারবে না?
-জি।
আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। তারপর বললেন, এই তো আমার বাবা রহিম বখশের মতো কথা।
-আমি তাহলে যাই?
-যাও।-
আব্বার কথা শেষ না হতেই দেখলাম সাইকেলের ব্রেক কষে সামনে দাঁড়িয়ে গেছে পশ্চিম পাড়ার হাসান।
আব্বাকে সালাম দিয়ে বললো, চাচা বিজয়কে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
-এইতো এখন এই পর্যন্ত।
-বাড়ি যাবেন?
-আমি যাবো না। বিজয় যাবে।
-ও একা কিভাবে যাবে।
-ইনশাআল্লাহ পারবে। তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-আমি তো বাড়ি যাচ্ছি।
-ও তাই?
-হ্যাঁ। তাহলে বিজয় আমার সাইকেলে যাক। আমরা দু’জন
গল্প করতে করতে যেতে পারবো।
-সে তো খুব ভালো কথা। পারবে। পারবে ওকে নিয়ে যেতে! ছেলেটিকে একা ছাড়তে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কী করবো।
হাসান হেসে বললো, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না চাচা। আপনি চলে যান যেখানে যাবার।
-যাবো একটু সাতক্ষীরায়।
-তাহলে বাসে উঠে পড়–ন। ঐতো বাস আসছে। আমরাও রওয়ানা দেই।
-আচ্ছা।
আব্বা আচ্ছা বললেন বটে, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেতে তার যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝলাম।
একটি বাস চলে এলো।
আব্বা ছাতাটি হাতে নিয়ে বাসে উঠতে গিয়েও আবার আমার দিকে তাকালেন।
আমিও আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি।
যতক্ষণ বাসটি না ছাড়লো, ততোক্ষণ আমি আর হাসান দাঁড়িয়ে থাকলাম।
বাস চলে গেল।
হাসান বললো, আয়। সাইকেলের রডে বসবি নাকি পেছনের কেরিয়ারে?
-রডে বসলে তো কষ্ট হবে বেশি। বরং পেছনেই বসি।
-তাই বোস।
হাসান সাইকেল চালানো শুরু করলো।
আমি পেছনে বসে পড়লাম।
হাসান কেমন সুন্দর করে, কত কৌশলে, শিল্পীত ভঙ্গিতে সাইকেল চালাচ্ছে। বেশ দ্রুত।
চারপাশে বাতাসে আমার চুল উড়ছে।
জামা উড়ছে।
সেই সাথে উড়ছে এক অপার্থিব আনন্দ মিশ্রিত স্বপ্ন।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত।
বাতাস দু’ভাগ করে।
চলতে চলতে এক সময় ঘোড়াডিঙি বটতলার কাছাকাছি চলে এলাম।
হাসান মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, সামনে বটতলা। তোর কি ভয় করছে?
-একটুও না। তোর?
-হাসান হেসে বললো, আরে ভয় করবে না। উড়ন্ত ঘোড়া বলে কথা। যদি আমাদের ঘাড়ে এসে উড়ে বসে!
-ধুর!
-ধুর কী?
-ওসব বাজে কথা।
-কে বলেছে?
-আব্বা।
-কখন?
-যাবার সময়। বটতলায় বসে।
-তাই?
-হ্যাঁ।
-তুই চাচার কথা বিশ্বাস করলি?
-অবশ্যই। আব্বার কথায় যুক্তি আছে।
-কী যুক্তি?
-বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখার যুক্তি।
-ও, তই বুঝি।
-হ্যাঁ।
-তাহলে ঠিকই আছে। বুঝলি, আমিও ওসবে বিশ্বাস করিনে।
-ভূত-প্রেতে?
-তাও না।
-কেন?
-ভূত-প্রেত বলতে কিছু নেই, তাই্
-কে বলছে?
-কেন, তোর আব্বাই তো অমারকে একদিন বলেছিলেন!
-তাই?
-তবে কি মিথ্যে বলছি।
-না, তুই মিথ্যা বলিসনে, আমি জানি।
-তাহলে তুইও বিশ্বাস করলি তো।
-হ্যাঁ।
কথা বলতে বলতে কোন সময় যে আমরা সেই অতি ভয়ঙ্কর অতি আতঙ্কিত বটতলাটি পেরিয়ে এলাম, তা বুঝতেই পারলাম না।
এক সময় আমরা খালপাড়ের শান্তি দাদি দজির দোকানের সামনে এসে পৌঁছুলাম।
তখন আসরের সময়।
হাসান বললো, এবার নাম। খাল পার হয়ে সোজা বাড়ি যা।
-যাচ্ছি। তা, তুই?
-আমিও বাড়ি যাবো।
-তোকে অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্য এত কষ্ট করলি!
-আরে, এটা আবার কষ্ট কিসের? যা বাড়ি যা। চাচী অপেক্ষা করছেন। আমি খাল পা হয়ে এক্কেবারে তেঁতুল গাছতলায় দাঁড়িয়ে একবার পশ্চিমের দিকে তাকালাম।
না, ওপার রাস্তায় হাসানকে আর দেখতে পেলাম না। আমি সোজা বাড়িতে গেলাম।
বাড়ির বাইরে থেকে মা-মা বলে হাঁক দিলাম।
মা কোথায় ছিলেন, দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু খাইছ্যিস? কিভাবে এলে!
দুটো প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই মা আমার জামার বোতাম খুলে দিলেন। তারপর বললেন, যাও পুকুর থেকে গোছল করে এসো। আমি ভাত বাড়ছি।
আমি মায়ের আদেশ মত দ্রুত গোছল সেরে হাতনে এসে বসলাম। বিছানার ওপর
মা ভাত মাখিয়ে আমার মুখে তুলে দিচ্ছেন। আর একটা একটা করে প্রশ্ন করছেন। কিন্তু টাকার কথা একবারও জিজ্ঞেস করলেন না।
আমি মায়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই খাওয়া শেষ করলাম। তারপর জামার পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিলাম। আদরে আদরে মা আমার কান্ত-শ্রান্ত মুখখানিতে প্রশান্তির স্রোত বইয়ে দিলেন।
আমার কান্তি যে কোথায় হারিয়ে গেল মায়ের আদর আর পরশে তা বুঝতেই পারলাম না।
পরদিন বাঁকড়ার হাটবার।
মা আমার হাতে চটের থলে আর টাকা দিয়ে কী কী আনতে হবে বুঝিয়ে দিলেন।
আমি থলে হাতে নিয়ে, বিকেলে হাটের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
দরগা ডাঙার রাস্তায় উঠেই দেখতে পেলাম হাসানকে।
সে হাটে যাচ্ছে।
পায়ে হেঁটে।
জিজ্ঞেস করলাম, কিরে তোর সাইকেল কোথায়?
-সাইকেল!
হাসান যেন আকাশ থেকে পড়লো আমার প্রশ্ন শুনে।
আমিও অবাক। বলে কিরে! আবারো জানতে চাইলাম,
-তোর সাইকেল আছে না!
-আরে পাগল! আমি সাইকেল পাবো কোথায়।
সংসারের অবস্থা বুঝিস! আমাদের নুন আনতি পান্তা ফোরায়।
হাসানের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।
হাসান বলে কী!-
আমার মুখ দিয়ে কেবল বেরিয়ে আসছিল, তাহলে কাল যে আমাকে সাইকেলে করে বাগআঁচড়া থেকে বাড়ি পর্যন্ত আনলি।-
কিন্তু ভাগ্যিস কথাটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসেনি।
হাসান বললো, চল, আমরা দু’জনে গল্প করতে করতে হাটে যাই।
গল্প!
আমার মুখে আর গল্প আসছে না। কেবল ভাবছি আর ভাবছি।
কথা যা বলার সবই বলছে হাসান।
আর আমি!
আমি তখন মনে মনে কেবল নাসিরের সাথে বোঝাপড়া করছি।
নাসির।
হ্যাঁ, আবারও সেই নাসিরের কথা আমার মনে পড়লো। সে ছাড়া আমার উপকারে এমন করে আর কে বা আসে। সে আসে বারবার।
নানা রূপে।
নানা আয়োজনে।
আমার প্রয়োজনে।
আমি নাসিরের প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম। আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করলাম।
আমার দুই চোখ তখন ঝাঁপসা হয়ে গেল। হাসান আমাকে একটা গুঁতা দিয়ে বললো, কিরে! তুই কোন জগতে আছিস! কথা বলছিসনে কেন?
আমার মুখে কোনো ভাষা নেই। শুধু উচ্চারণ করলাম, হুঁ!..
বাড়ির পাশে পুকুর ঘাট
জোছনা রাতে চাঁদের হাট
সকালেও আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা।
এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। সে জন্য রাস্তাঘাট, ক্ষেত-খামার কাদাপানিতে একাকার।
স্কুল বন্ধ।
সংসারে অভাব লেগেই আছে।
পাশের বাড়ির সুরত আলী দাদা। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্ত।
দাদা আমাকে দুটো গরুর দড়ি হাতে ধরিয়ে বললেন, যাতো! মাঠের রাস্তায় লকলকানো ঘাস। গরু দুটোকে একটু খাইয়ে নিয়ে আয়।
তোর কিছু পয়সা দিবানে।
পয়সার জন্য নয়। গরুকে ঘাস খাওয়ানোর আনন্দেই আমি রাজি হয়ে গেলাম।
গরুর দড়ি ধরে পিছে পিছে যা যা ডানে বায়ে বলতে বেশ মজাই লাগে।
গরু নিয়ে আমি পুব মাঠের রাস্তার শেষ দিকটায় গেলাম। দেখলাম রাস্তার দু’পাশে সত্যিই তরতাজা ঘাস।
দুটো গরুকে দুই পাশে দিয়ে দড়ি ধরে আমি রাস্তার মাঝখানে বসে আছি।
বসে আমি আর কথা বলছি আকাশের সাথে।
সাদা সাদা মেঘের সাথে।
পাখির সাথে।
গাছগাছালির সাথে।
ঘাস, লতাপাতা আর বুনো ফুলের সাথে।
আমার কথা আর শেষ হয় না।
শেষ হয় না গল্প-কাহিনী।
আমি এক মনে কথা বলে যাচ্ছি তাদের সাথে।
কোথায় মোজের দাদা।
খুব পান খায়।
লুঙ্গির গাঁটে কাপড়ের সেলাইকরা থলেতে সব সময় পান থাকে।
বাটা পান। গালে দাঁত নেই বলে আস্ত পান-সুপারি চিবুতে পারে না।
তাই বলে তার পান খাওয়া থেমেও থাকে না। সকল সময় মুখের ভেতর তার পান আছেই। ঠোঁট দুটো তাই ঘুঘুর ঠোঁটের মতো।
খুব চমৎকার দেখায়।
দারুণ ভালো লাগে।
জোছনা রাতে চাঁদের হাট
সকালেও আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা।
এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। সে জন্য রাস্তাঘাট, ক্ষেত-খামার কাদাপানিতে একাকার।
স্কুল বন্ধ।
সংসারে অভাব লেগেই আছে।
পাশের বাড়ির সুরত আলী দাদা। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্ত।
দাদা আমাকে দুটো গরুর দড়ি হাতে ধরিয়ে বললেন, যাতো! মাঠের রাস্তায় লকলকানো ঘাস। গরু দুটোকে একটু খাইয়ে নিয়ে আয়।
তোর কিছু পয়সা দিবানে।
পয়সার জন্য নয়। গরুকে ঘাস খাওয়ানোর আনন্দেই আমি রাজি হয়ে গেলাম।
গরুর দড়ি ধরে পিছে পিছে যা যা ডানে বায়ে বলতে বেশ মজাই লাগে।
গরু নিয়ে আমি পুব মাঠের রাস্তার শেষ দিকটায় গেলাম। দেখলাম রাস্তার দু’পাশে সত্যিই তরতাজা ঘাস।
দুটো গরুকে দুই পাশে দিয়ে দড়ি ধরে আমি রাস্তার মাঝখানে বসে আছি।
বসে আমি আর কথা বলছি আকাশের সাথে।
সাদা সাদা মেঘের সাথে।
পাখির সাথে।
গাছগাছালির সাথে।
ঘাস, লতাপাতা আর বুনো ফুলের সাথে।
আমার কথা আর শেষ হয় না।
শেষ হয় না গল্প-কাহিনী।
আমি এক মনে কথা বলে যাচ্ছি তাদের সাথে।
কোথায় মোজের দাদা।
খুব পান খায়।
লুঙ্গির গাঁটে কাপড়ের সেলাইকরা থলেতে সব সময় পান থাকে।
বাটা পান। গালে দাঁত নেই বলে আস্ত পান-সুপারি চিবুতে পারে না।
তাই বলে তার পান খাওয়া থেমেও থাকে না। সকল সময় মুখের ভেতর তার পান আছেই। ঠোঁট দুটো তাই ঘুঘুর ঠোঁটের মতো।
খুব চমৎকার দেখায়।
দারুণ ভালো লাগে।
মোজের দাদা এক-পা দু-পা করে কাছে এলো। বুঝলাম, গল্প জমাতে চায়।
জিজ্ঞেস করলেন, গরু দুটো কার?
-সুরত আলী দাদার।
-বেশ তো! কী ভালো স্বাস্থ্য!
-হ্যাঁ।
-তো তোর কাছে কেন?
- এমনিই। বললো খাওয়াতে। নিয়ে এলাম।
মোজের দাদা আমার পাশে বসলো।
একটা দম ছেড়ে বললো, একেই বলে ভাগ্য!-
-তার মানে!
-এমন একটা সময় ছিল, যখন তোর দাদার গরু চরাতো অন্য রাখালে। গোয়াল ভরা গরু। এই যে ডানে-বামে যত জমি-সব-সবই ছিল তোর দাদার। হায়! কী হতে কী হয়ে গেল। রাজা গেল, রাজ্যও গেল।
এতক্ষণ আমি যে ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম, তা মুহূর্তেই উবে গেল। সেখানে ভর করলো এক আকাশ সমান মেঘাচ্ছন্ন কষ্ট। আমিও একটা দম ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ। আব্বার কাছে সব শুনেছি।
-তোর আব্বা তো একটা নিপাট ভালো মানুষ।
-হু।
-তার কোনো তুলনা হয় না।
-হু ।
-তুই আর কী জানিস! তোর দাদা যখন মারা গেল, তখন বিশাল সহায়-সম্পত্তি। কিন্তু ঐ যে গোচান, সেই তো যত নষ্টের মূল।
-কেন?
-গোছান তো ছিল তোদের আজন্ম শত্রু। তোর দাদার মৃত্যুর পর নানা কৌশলে একে একে সব সম্পত্তি বেহাত করে দিল। তারপর তো তোর বাপ-দাদাকে ভিটেছাড়া পর্যন্ত করলো। তুই তার পোতা জানিস?
-হু।
-হু, বললেই শুধু হবে না। দশ গ্রামের মাথা রহিম বখশের পোতাছেলে তুই। আজ তোর এই দশা! সত্যিই আমার চোখে পানি আসেরে! মোজের দাদা চোখ মুছলো।
তারপর আবার বলা শুরু করলো, যাদের গোলার ধান ফুরাতো না, আজ তাদেরই পেটে ভাত জোটে না!
আমি বললাম, ওসব কথা থাক না দাদা। পুরনো দিনের কথা মনে করে কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী?
-পুরনো দিনের কথা কিরে? এই সেদিনের কথা। আমরাই নিজের চোখে দেখেছি। সেসব কি ভোলা যায়!
-না গেলেও কী করবো, বলো দাদা।
মোজের দাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললো, লেখাপড়া শেখ। মানুষ হ। আজ পরের গরু চরাচ্ছিস, পরের ক্ষেতে দিন-মজুর খাটিস, না খেয়ে থাকিস-কত কষ্ট! এসব তখন কিছু থাকবে না। মানুষ হলে নিজেরাই আবার সব করতে পারবি। ভাগ্য বলে কথা! খোদার ওপর ভরসা রাখ।-বলে মোজের দাদা কোমর থেকে পানের পোটলা বের করলো।
সেই ফাঁকে আমি আমার চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। আমার শিক্ষক সিরাজ স্যারও এই রকম কথা বলেন।
তিনি প্রায়ই আমার মাথায় হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বলেন, দোয়া করি, তুই একদিন মস্ত বড় মানুষ হবি। সেদিন বুঝবি জীবন কারে কয়। আব্রাহাম লিংকনের চেয়ে তোদের জীবনও কম মহৎ হবে না। তিনি বাদাম বিক্রি করতেন। স্কুল ছুটির সময়, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তোরা দুই ভাই এমন কোনা শ্রমের কাজ নেই, যা করিসনে। তিনি নিজের ক্ষেতে চাষ করতেন। তোরা অন্যের ক্ষেতে দিনমজুর খানা খাটিস। দিনের পর দিন উপোস থাকিস। তারপরও লেখাপড়ার হাল ছাড়িসনি। পরীক্ষায় ভালো করিস। হ্যাঁ। এইভাবে এগিয়ে যা, দেখবি একদিন সময় আসবে। সেদিন যেন আবার আমার কথাগুলো ভুলে যাসনে।
না, ভুলিনি। কিছুই ভুলিনি। সিরাজ স্যারের আদর, সোহাগ, আশাবাদ, দোয়া-সব, সবই মনে আছে।
মনে আছে সেই জোছনা রাতে পুকুরঘাটের কথাগুলোও। তখন ছিল গরমের কাল। মাঠশের হাট থেকে আম-কাঁঠাল কেনার জন্য বাবু, আমাদের একমাত্র ছোট চাচা-যাকে আমরা আদর করে বাবু বলে ডাকি-দুই ভাইকে সাথে করে নিয়ে গেল।
বাবু আমাদের এত আদর করতো যে তুই-তুকারি করতাম তার সাথে। দুই ভাইকে দুই কাঁধে করে পুকুরে নেয়া, গোছল করানো, গল্প গল্প-স্বল্প, হাসি-তামাশায় আমাদেরকে বাবু একেবারে জড়িয়ে রাখতো। আমরাই ছিলাম তার চোখের মণি। তো সেই বাবুর সাথে আমরা মাঠশের হাটে গেছি। অনেক আম-কাঁঠাল কেনা হয়েছে।
দুই ভাইয়ের কাছে আমগুলো ভাগ করে দিয়ে বাবু দুই কাঁধে দুটো ইয়া বড় মস্ত কাঁঠাল তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে।
পুব আকাশেও চাঁদ উঠেছে।
আব্বা বললেন, যাও! পুকুর পাড়ে বিছানা ফেল।
তাই হলো!
মা আম-কাঁঠাল রেডি করে দুটো গামলায় ভরে পাঠিয়ে দিলেন পুকুর পাড়ে।
মাঝখানে আম-কাঁঠালের গামলা।
আর তার চারপাশে আব্বা, বাবু, ম্যাভাইসহ আমরা সকল ভাইবোন। যেন সে এক চাঁদের হাট। জোছনা রাতে।
আমরা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছি আর আব্বা ও বাবুর কথা শুনছি। এক সময় আব্বা ম্যাভাই ও আমার কাছে জানতে চাইলেন, বড় হয়ে তোমরা কী হবে?
ম্যাভাই যেন জবাবটা ঠিক করেই রেখেছিল। চট করে বললো,
-বড় হয়ে আমরা দু’ভাই মাওলানা মুহাম্মদ আলী শওকত আলীর মত হবো।
বাবু একটু চুপসে গেল জবাব শুনে। যাবারই তো কথা! কোথায় ছেলেরা কষ্ট করে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি, এসপি হতে চাইবে, তা না কোথায় ফাঁসিতে মৃত্যুবরণকারী আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মত হবে!
বাবুর মুখটা আশঙ্কায় শুকিয়ে গেল।
কিন্তু আব্বা জোরে হেসে উঠলেন।
বললেন, ঠিক, ঠিকই তো! এই তো আমার সাহসী বাবার মতো কথা। বাবু জিজ্ঞেস করলো, এর মধ্যে তুমি বড় কী দেখলে ম্যাভাই!
-ধুর, ত্ই বুঝিসনে।
-তাহলে বোঝাও।
-শোন।-মাওলানা মুহাম্মদ আলী আর শওকত আলী-দুই ভাই-ই সারা জীবন সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সংগ্রাম করেছেন। জেল খেটেছেন। জেলের ভেতর অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলেছেন। তবু, তবুও তারা মিথ্যার কাছে মাথা করেননি। এ জন্যই তো তারা মহৎ। সত্যের এমনি শক্তি বুঝলি!
আব্বা বলেই চলেছেন। তার কত কিছু পড়া!
কত কিছু জানা।
তিনি বখতিয়ার খিলজি, সিরাজউদদৌলা, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ কত যে সংগ্রামী মানুষের কথা বলে গেলেন!
বাবুর মুখ শুকিয়ে গেল তবুও।
আব্বা সেটা বুঝলেন। বললেন, শোন ঘুষখোর- বাটপাড়ের বাপ-চাচা হওয়ার চেয়ে সত্যের সংগ্রামী বীরের বাপ-চাচা হওয়া কি বেশি মর্যাদার নয়! যারা সত্যের জন্য, দেশের জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রামে করে-তারা যদি শহীদও হয়, তবু কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকা উচিত নয়। বরং যেটা অনেক মহৎ, অনেক গৌরবের। বল, কয়জনের ভাগ্যে সেটা জোটে।
আব্বা জোর দিয়ে বলেন, খোকন যা বলেছে, যা হতে চেয়েছে ওরা দুই ভাই-তাই হোক। বল্ আল্লাহ ওদের কবুল করুন।
বাবুর চোখ পানিতে ভিজে গেল।
দুইভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আব্বা কষে ধমক লাগালেন, হ্যাঁ! কানছিস কেন শুনি! বরং খুশি হ। আল্লার শোকর আদায় কর। ওরা চোর-ডাকাত, বাটপাড় হতে চায়নি, বরং সত্যের সাহসী সৈনিক হতে রেখেছে-এর চেয়ে আনন্দের আর কি আছে!
বাবু স্থির হল।
কিন্তু আমাদের দুই ভায়ের দু’টি মাথা বুক থেকে কিছুতেই নামালে না। আমি বললাম বাবু!-
-হু
-হাত ধোবো।
-তোর হাত আমার মাথায় মোছ।
-মাথায়!-
-হ্যা, কাঁঠালের আঁটা পানিতে যায় না, তেলে যায়। আমার মাথায় তেল আছে। মোছ। আব্বা হেসে বললেন, পাগলের দল!
আব্বার হাসিটা আনন্দের।
প্রশ্রয়ের।
প্রশান্তির
বাবুর কথা শুনে পুকুরঘাটে, জোছনারাতে, সেই পাতানো বিছানাটি হাসির ঠেলায় দুলতে লাগলো।
সম্ভবত সেই সাথে পুকুরও।
পুকুরের মাছও।
এমন সময় আমার কানে একটি শব্দ ভেসে এলো।
আমার নাম ধরে কে যেন আস্তে করে ডাকছে।
কে? কে ডাকে!
বাবুকে বললাম, ছেড়ে দে না একটু!
-কই যাবি?
-একটু আসছি।
বাবু আমার মুখে একটা চিমটি কেটে বললো, যা ভাগ! দুষ্টু কোথাকার! আমি বাবুর বুক থেকে মাথা তুলে সজনে তলার দিকে গেলাম। ডাকটি ওদিক থেকেই ভেসে আসছিল।
হ্যাঁ, তাই।
আমি সজনে তলায় যেতেই দেখি নাসির দাঁড়িয়ে আছে। হেসে বললো, আমার ডাক তুই শুনতে পেয়েছিস?
-হ্যাঁ।
-এত আস্তে, তাও!
-হ্যাঁ। তোর কণ্ঠস্বর তো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। মুখস্থ। যত আস্তেই ডাকিস না কেন, শুনতে পাবো।
-যদি দূর থেকে ডাকি?
-তাও।
-যদি শূন্য থেকে ডাকি!
-তাও।
-নাসির হাসলো।
বললাম, চল পুকুর পাড়ে যাই। ওখানে আজ আমাদের চাঁদের হাট বসেছে।
-না থাক।
-কেনরে।
-এমনিই।
-চল, কিছু আম-কাঁঠাল খাবি।
-না, আজ থাক।
-তবে?
-তবে আর কী! জোছনা রাত। কিছু ভালো লাগছে না। তাই চলে এলাম। তোর কাছে কি খারাপ লাগছে?
-না।
Ñতাহলে চল্।
-কোথায়! -
-পুর্ব মাঠে।
-কেন?
-দু’জনে বসে চুটিয়ে গল্প করবো। কী মজা হবে, তাই না!
-আচ্ছা।
-তো চল।
-আব্বা আর বাবুকে বলে আসি। তা না হলে আবার হাঁক-ডাক শুরু হয়ে যাবে।
-যা। কিন্তু আমার কথা বলিসনে যেন।
-আচ্ছা, বলবো না।
আমি দ্রুত পুকুর পাড়ে গেলাম। আব্বা আর বাবুকে বললাম, আমি একটু আসি।
-কই যাবি? বাবু জিজ্ঞেস করলো।
-এই তো আরকি।
ম্যাভাই বললো, আমি আসবো?
-না দরকার নেই।
-আচ্ছা যা।
আব্বাও আর কিছু বললেন না।
আমি নাসিরের কাছে গেলাম।
আমি আর নাসির।
গল্প করতে করতে আমরা হাঁটছি।
জোছনার মুক্তোকুঁচি যেন আমাদের মাথার ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে। এত জোছনা!
চারপাশ ফকফকা।
উত্তরের দিঘির মাঠ, পুবের দিগদানা, মাঠশে, দক্ষিণের কাহার পাড়া, শুকুর খোলা -সব-সবই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
আর এর মাঝখানের যে দূরত্ব, যে ফসলের ক্ষেত সবই যেন রূপোর টাকার মতো গোল। ঝকমক করছে জোছনার আলোতে।
মগরা পার হয়ে আমরা আরও সামনে এগিয়ে চলেছি।
রাস্তা বেয়ে।
রাস্তার সবুজ ঘাস জোছনায় আরও কোমল, আরও নরোম তুলতুলে হয়ে উঠেছে।
নাসিরের পায়ে স্যান্ডেল।
আমার পা খালি।
সুতরাং ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটার মজা আমিই বেশি পাচ্ছি।
নাসিরকে বললাম, স্যান্ডেল খুলে হাতে নে।
-কেন?
-তাহলে হাঁটার মজাটা বেশি পাবি। দেখছিস না কেমন তুলতুলে ঘাস।
নাসির হাসলো।
আমার কথা মত স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল।
আমরা কবিরাজের খেজুর বাগানের কাছাকাছি।
বললাম, এখানে বসি।
-তা ভালো
আমরা ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। এত নরোম, এত আরাম। এই ঘাসের গালিচার কাছে কাশ্মিরী কিংবা ইরানী গালিচাও যেন ফেল!
নাসির হেসে বসলো, সত্যিই খুব আরাম লাগছে।
-লাগবে না। দেখতে হবে তো জায়গাটা কী!
-তা বটে, তা বটে! এর সাথে কোনো কিছুর তুলনাই চলে না।
-সত্যি বলছিস।
-একদম সত্যি।
আমরা দু’জনে বসে গল্প করছি। কত ধরনের গল্প। একটু আগে, পুকুর পাড়ে বসে যেসব গল্প হয়েছে তাও।
আমাদের গল্পের সাথে যেন যোগ দিয়েছে আকাশের সাদা মেঘ।
জ্বলজ্বলে তারকারাশি।
গাছেল ডালে জাগ্রত পাখিরা।
ঘুগরো, জোনাকি, ব্যাঙ এবং ক্ষেতের পোকামাকড়সহ সবুজ ফসল। তারা যেন মুগ্ধ শ্রোতা।
আমাদের গল্প এগিয়ে চলেছে।
চলেছে তো চলেছেই।
কোনো নির্ধারিত বিষয় নেই। কোনো তর্ক-বিতর্ক নেই। কোনো শেষ সীমাও যেন নেই।
গল্প করছি আর মজা করছি।
হঠাৎ করিবাজের খেজুর বাগান থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো।
শব্দটি স্বাভাবিক নয়।
কিসের শব্দ বুঝতেও পারলাম না।
মুহূর্ত মাত্র!
নাসির আমাকে বললো, তুই এখানে বোস! আমি একটু আসছি।
-কই যাবি?
-আরে বয় না!
বলেই নাসির স্যান্ডেল হাতে কবিরাজের খেজুর বাগানের ভেতর ঢুকলো।
আমি কেবল ওর যাওয়াটা দেখতে পেলাম।
কী দৃপ্ত পদভারে!
কি অসম্ভব শক্তভাবে সে পা ফেলছে!
খেজুর বাগানটি ঘন হওয়ায় এখান থেকে আলো-আঁধারির ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে।
একটু পরই শুনতে পেলাম প্রচণ্ড শব্দ!
তারপর গোঙানি।…
না, সেটা মানুষের শব্দের মত না।
পশুর শব্দের মত না।
একেবারেই অন্য রকম একটি শব্দ।
আমি ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখি খেজুর গাছের বিশাল এক গুঁড়ির মতো একটা কী যেন মাটিতে টান টান হয়ে পড়ে আছে।
তার বুকের ওপর আর একটি বিশাল আম আকারের ভয়ানক কিছু। তার দুই চোখ দিয়ে আগুনের হলকা ঠিকরে বেরিয়ে পড়ছে। আর যেন রাগে গড়গড় করতে করতে কি সব বলছে।
যেটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, তার প্রায় এক হাত লম্বা জিহ্বা বেরিয়ে গেছে। সেটা আগুনের মত টকটকে লাল হওয়ায় আমার বুঝতে সমস্যা হল না।
আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপছি।
উঠে যে বাড়ির দিকে দৌড় দেব, তাও পারছিনে।
আবার সেই শব্দ!
এবারে শব্দটি অতি ভয়ঙ্কর!
সেকি গোঙানি।
তারপর চুপ।
তারপর শীতল নীরবতা।
আমি তখনও ভয়ে কাবু।
দাঁড়াবার চেষ্টা করছি।
ভাবছি দৌড় দেব বাড়ির দিকে।-
এমন সময় ফিরে এল নাসির!-
সেই রকম।
স্থির। স্বাভাবিক।
এসেই আমার হাত ধরে বসালো।
আমার চোখে-মুখে ভীতিকর এক বিস্ময়।
নাসির হেসে বললো, কিরে ভয় পেয়েছিস!
আমি চুপ।
নাসির আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আরে ভাই শান্ত হ। এত ভীতু হলে কি আর চলে!
আমি চুপ।
-কিরে কথা বল!
আমি হা করে নাসিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নাসির আমাকে একটু মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, তোর নাম না বিজয়?
-হ্যাঁ।
-তবে?
-কী?
-সামান্যতেই ভয় পাস কেন?
-কোনটা সামান্য।
-যা দেখেছিস।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে!-
-ও, তাই বল। দিছি পাজিটারে শেষ করে।
-কাকে
-আরে ঐ যে এক পাজি!-
-সে কে।
-তুই ওসব চিনবি না। শোন তোদের মধ্যেও যেমন ভালো এবং মন্দ আছে, জিনদের মধ্যেও তেমনটি আছে।
-হ্যাঁ। -
-হ্যাঁ, তাই। দুষ্টদেরকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে হয়। আর যে তাতেও ঠাণ্ডা হয় না, তাকে…
আমি নাসিরের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছি।
নাসির আমার পড়ে হাত রেখে বললো, ঘাবড়াসনে।
-না, মানে-
আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
নাসির সম্ভবত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো।
বললো, চল উঠি।
নাসির আমার হাত ধরে ওঠালো। তারপর কেমন স্বাভাবিকভাবে গল্প করতে করতে বাড়ির কাছে পর্যন্ত নিয়ে। আমাকে আস্তে করে বললো, আজকের এই কথা যেন কাউকে বালিসনে।
-হু।
-মনে থাকবে তো।
-হু।
-তাহলে এখন চলি।
-খেয়ে যা সবার সাথে।
-না। আর একদিন হবে।
নাসির চলে গেল।
অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তেই।
ততোক্ষণে হাতনের বিছানা জুড়ে খাবারের থালা সাজিয়ে রেখেছে মা। সবাই খেতে বসেছে।
বাবু জোরে ডাক দিল, বি-জ-য়! …
আমি বাবুর পেছন থেকে তার ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, কু-উ!
এক সিরাজের বক্ষ থেকে
লক্ষ সিরাজ জাগবে
কপোতাক্ষের পাড়েই বাঁকড়ার হাট।
হাটের পাশে বাঁকড়া হাইস্কুল।
বিশাল মাঠ। ঈদগাহ আর পুকুরও আছে।
স্কুলের মাঠে বছরে বেশ কয়েকটি বড় বড় সমাবেশ হয়।
নিয়মিত।
তার মধ্যে ২৩ জুন, পলাশী দিবস একটি।
দিনটি সরবে পালিত হয় এখানে। অন্যান্য দিবসের মতো।
এবারও হচ্ছে।
আয়োজনটাও দারুণ।
বিকেল।
অনুষ্ঠানে শুরু হবার আগেই মাঠ প্রায় ভরে গেছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিতিদের মধ্যে স্কুল শিক্ষকগণ আছেন।
শিক্ষার্থীরা আছে।
এলাকার শিক্ষিত গণ্যমান্য লোকেরা আছে।
হাটে আগত দর্শক-শ্রোতারাও আছেন।
আলোচনা শুরু হল।
সভাপতিত্ব করছেন আব্বা। মুকুন্দর সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা।
গোটা ইউনিয়নেই তার সুনাম- সুখ্যাতি আছে।
আছে পাণ্ডিত্যের সৌরভ।
সিরাজ স্যার আলোচনা করছেন।
তিনি ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন সংঘটিত পলাশীর সেই মর্মবেদনার ইতিহাস বর্ণনা করলেন।
শেষে বললেন, ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, এখনও আছে।
মীর জাফর আগেও ছিল, এখনও আছে।
মীর মদন, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, ঘষেটি বেগমরা আগেও ছিল, এখনও আছে। তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে।
তাদেরকে চিনতে হবে।
তাদের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে দেশ।
তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ।
তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি।
এই সোনার দেশকে আমরা বিকিয়ে দিতে দেব, নাকি বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করবো, সেই সিদ্ধান্ত আজ নিতে হবে।
সিরাজ স্যার আরও অনেক কথা বললেন।
পলাশী তথা তখনকার প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটকে তুলনামূলক অলোচনা করলেন।
তার আলোচনায় সবাই খুশি হলো।
উদ্দীপ্ত হলো।
সবার আলোচনা শেষে সভাপতির বক্তব্য রাখার জন্য উঠে দাঁড়ালেন আব্বা।
তিনি বললেন, পলাশীর পাতানো আর সাজানো নাটক- নামক যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হয়েছিলেন।
তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
প্রকৃত অর্থে সিরাজের পতন হয়নি। বরং বিজয়ী সিরাজ।
যে কারণে আজও আমরা তাকে স্মরণ করছি।
আমার বিশ্বাস-‘এক সিরাজের বক্ষ থেকে লক্ষ সিরাজ জাগবে।’ সেটা আজ অথবা আগামীতে।
হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ জাগবে। আমি আশাবাদী। যারা কিশোর, তরুণ, যুবক-তাদের মধ্যে থেকেই জেগে উঠবে একেকজন সিরাজ। এ বিশ্বাস আমি রাখি।
আর তখন মীর জাফরদের পতন অনিবার্য।
এর জন্য চাই সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা এবং সাহস। মনে রাখা জরুরি যে, সত্যকে বুঝতে হলে পরিচ্ছন্ন মাথার প্রয়োজন।
সত্যকে দেখতে হলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বচ্ছ চোখের প্রয়োজন।
আর সত্যকে গ্রহণ করতে হলে একটি বিশাল সাহসী হৃদয়ের প্রয়োজন। …
আব্বার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উচ্চারণই যে এককেটি স্বপ্নের পারদ!
আশা এবং আকাক্সক্ষার পালক! সাহসের স্রোতধারা। জীবন জাগানো বৃষ্টি!
আমিসহ প্রতিটি কিশোর, যুবকই সেই সাহস, সেই পারদ এবং সেই পালক কুড়িয়ে হৃদয়ে ভরছি থরে..
জিজ্ঞেস করলেন, গরু দুটো কার?
-সুরত আলী দাদার।
-বেশ তো! কী ভালো স্বাস্থ্য!
-হ্যাঁ।
-তো তোর কাছে কেন?
- এমনিই। বললো খাওয়াতে। নিয়ে এলাম।
মোজের দাদা আমার পাশে বসলো।
একটা দম ছেড়ে বললো, একেই বলে ভাগ্য!-
-তার মানে!
-এমন একটা সময় ছিল, যখন তোর দাদার গরু চরাতো অন্য রাখালে। গোয়াল ভরা গরু। এই যে ডানে-বামে যত জমি-সব-সবই ছিল তোর দাদার। হায়! কী হতে কী হয়ে গেল। রাজা গেল, রাজ্যও গেল।
এতক্ষণ আমি যে ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম, তা মুহূর্তেই উবে গেল। সেখানে ভর করলো এক আকাশ সমান মেঘাচ্ছন্ন কষ্ট। আমিও একটা দম ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ। আব্বার কাছে সব শুনেছি।
-তোর আব্বা তো একটা নিপাট ভালো মানুষ।
-হু।
-তার কোনো তুলনা হয় না।
-হু ।
-তুই আর কী জানিস! তোর দাদা যখন মারা গেল, তখন বিশাল সহায়-সম্পত্তি। কিন্তু ঐ যে গোচান, সেই তো যত নষ্টের মূল।
-কেন?
-গোছান তো ছিল তোদের আজন্ম শত্রু। তোর দাদার মৃত্যুর পর নানা কৌশলে একে একে সব সম্পত্তি বেহাত করে দিল। তারপর তো তোর বাপ-দাদাকে ভিটেছাড়া পর্যন্ত করলো। তুই তার পোতা জানিস?
-হু।
-হু, বললেই শুধু হবে না। দশ গ্রামের মাথা রহিম বখশের পোতাছেলে তুই। আজ তোর এই দশা! সত্যিই আমার চোখে পানি আসেরে! মোজের দাদা চোখ মুছলো।
তারপর আবার বলা শুরু করলো, যাদের গোলার ধান ফুরাতো না, আজ তাদেরই পেটে ভাত জোটে না!
আমি বললাম, ওসব কথা থাক না দাদা। পুরনো দিনের কথা মনে করে কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী?
-পুরনো দিনের কথা কিরে? এই সেদিনের কথা। আমরাই নিজের চোখে দেখেছি। সেসব কি ভোলা যায়!
-না গেলেও কী করবো, বলো দাদা।
মোজের দাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললো, লেখাপড়া শেখ। মানুষ হ। আজ পরের গরু চরাচ্ছিস, পরের ক্ষেতে দিন-মজুর খাটিস, না খেয়ে থাকিস-কত কষ্ট! এসব তখন কিছু থাকবে না। মানুষ হলে নিজেরাই আবার সব করতে পারবি। ভাগ্য বলে কথা! খোদার ওপর ভরসা রাখ।-বলে মোজের দাদা কোমর থেকে পানের পোটলা বের করলো।
সেই ফাঁকে আমি আমার চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। আমার শিক্ষক সিরাজ স্যারও এই রকম কথা বলেন।
তিনি প্রায়ই আমার মাথায় হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বলেন, দোয়া করি, তুই একদিন মস্ত বড় মানুষ হবি। সেদিন বুঝবি জীবন কারে কয়। আব্রাহাম লিংকনের চেয়ে তোদের জীবনও কম মহৎ হবে না। তিনি বাদাম বিক্রি করতেন। স্কুল ছুটির সময়, লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তোরা দুই ভাই এমন কোনা শ্রমের কাজ নেই, যা করিসনে। তিনি নিজের ক্ষেতে চাষ করতেন। তোরা অন্যের ক্ষেতে দিনমজুর খানা খাটিস। দিনের পর দিন উপোস থাকিস। তারপরও লেখাপড়ার হাল ছাড়িসনি। পরীক্ষায় ভালো করিস। হ্যাঁ। এইভাবে এগিয়ে যা, দেখবি একদিন সময় আসবে। সেদিন যেন আবার আমার কথাগুলো ভুলে যাসনে।
না, ভুলিনি। কিছুই ভুলিনি। সিরাজ স্যারের আদর, সোহাগ, আশাবাদ, দোয়া-সব, সবই মনে আছে।
মনে আছে সেই জোছনা রাতে পুকুরঘাটের কথাগুলোও। তখন ছিল গরমের কাল। মাঠশের হাট থেকে আম-কাঁঠাল কেনার জন্য বাবু, আমাদের একমাত্র ছোট চাচা-যাকে আমরা আদর করে বাবু বলে ডাকি-দুই ভাইকে সাথে করে নিয়ে গেল।
বাবু আমাদের এত আদর করতো যে তুই-তুকারি করতাম তার সাথে। দুই ভাইকে দুই কাঁধে করে পুকুরে নেয়া, গোছল করানো, গল্প গল্প-স্বল্প, হাসি-তামাশায় আমাদেরকে বাবু একেবারে জড়িয়ে রাখতো। আমরাই ছিলাম তার চোখের মণি। তো সেই বাবুর সাথে আমরা মাঠশের হাটে গেছি। অনেক আম-কাঁঠাল কেনা হয়েছে।
দুই ভাইয়ের কাছে আমগুলো ভাগ করে দিয়ে বাবু দুই কাঁধে দুটো ইয়া বড় মস্ত কাঁঠাল তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে।
পুব আকাশেও চাঁদ উঠেছে।
আব্বা বললেন, যাও! পুকুর পাড়ে বিছানা ফেল।
তাই হলো!
মা আম-কাঁঠাল রেডি করে দুটো গামলায় ভরে পাঠিয়ে দিলেন পুকুর পাড়ে।
মাঝখানে আম-কাঁঠালের গামলা।
আর তার চারপাশে আব্বা, বাবু, ম্যাভাইসহ আমরা সকল ভাইবোন। যেন সে এক চাঁদের হাট। জোছনা রাতে।
আমরা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছি আর আব্বা ও বাবুর কথা শুনছি। এক সময় আব্বা ম্যাভাই ও আমার কাছে জানতে চাইলেন, বড় হয়ে তোমরা কী হবে?
ম্যাভাই যেন জবাবটা ঠিক করেই রেখেছিল। চট করে বললো,
-বড় হয়ে আমরা দু’ভাই মাওলানা মুহাম্মদ আলী শওকত আলীর মত হবো।
বাবু একটু চুপসে গেল জবাব শুনে। যাবারই তো কথা! কোথায় ছেলেরা কষ্ট করে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি, এসপি হতে চাইবে, তা না কোথায় ফাঁসিতে মৃত্যুবরণকারী আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মত হবে!
বাবুর মুখটা আশঙ্কায় শুকিয়ে গেল।
কিন্তু আব্বা জোরে হেসে উঠলেন।
বললেন, ঠিক, ঠিকই তো! এই তো আমার সাহসী বাবার মতো কথা। বাবু জিজ্ঞেস করলো, এর মধ্যে তুমি বড় কী দেখলে ম্যাভাই!
-ধুর, ত্ই বুঝিসনে।
-তাহলে বোঝাও।
-শোন।-মাওলানা মুহাম্মদ আলী আর শওকত আলী-দুই ভাই-ই সারা জীবন সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সংগ্রাম করেছেন। জেল খেটেছেন। জেলের ভেতর অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন। অবশেষে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলেছেন। তবু, তবুও তারা মিথ্যার কাছে মাথা করেননি। এ জন্যই তো তারা মহৎ। সত্যের এমনি শক্তি বুঝলি!
আব্বা বলেই চলেছেন। তার কত কিছু পড়া!
কত কিছু জানা।
তিনি বখতিয়ার খিলজি, সিরাজউদদৌলা, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ কত যে সংগ্রামী মানুষের কথা বলে গেলেন!
বাবুর মুখ শুকিয়ে গেল তবুও।
আব্বা সেটা বুঝলেন। বললেন, শোন ঘুষখোর- বাটপাড়ের বাপ-চাচা হওয়ার চেয়ে সত্যের সংগ্রামী বীরের বাপ-চাচা হওয়া কি বেশি মর্যাদার নয়! যারা সত্যের জন্য, দেশের জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রামে করে-তারা যদি শহীদও হয়, তবু কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকা উচিত নয়। বরং যেটা অনেক মহৎ, অনেক গৌরবের। বল, কয়জনের ভাগ্যে সেটা জোটে।
আব্বা জোর দিয়ে বলেন, খোকন যা বলেছে, যা হতে চেয়েছে ওরা দুই ভাই-তাই হোক। বল্ আল্লাহ ওদের কবুল করুন।
বাবুর চোখ পানিতে ভিজে গেল।
দুইভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আব্বা কষে ধমক লাগালেন, হ্যাঁ! কানছিস কেন শুনি! বরং খুশি হ। আল্লার শোকর আদায় কর। ওরা চোর-ডাকাত, বাটপাড় হতে চায়নি, বরং সত্যের সাহসী সৈনিক হতে রেখেছে-এর চেয়ে আনন্দের আর কি আছে!
বাবু স্থির হল।
কিন্তু আমাদের দুই ভায়ের দু’টি মাথা বুক থেকে কিছুতেই নামালে না। আমি বললাম বাবু!-
-হু
-হাত ধোবো।
-তোর হাত আমার মাথায় মোছ।
-মাথায়!-
-হ্যা, কাঁঠালের আঁটা পানিতে যায় না, তেলে যায়। আমার মাথায় তেল আছে। মোছ। আব্বা হেসে বললেন, পাগলের দল!
আব্বার হাসিটা আনন্দের।
প্রশ্রয়ের।
প্রশান্তির
বাবুর কথা শুনে পুকুরঘাটে, জোছনারাতে, সেই পাতানো বিছানাটি হাসির ঠেলায় দুলতে লাগলো।
সম্ভবত সেই সাথে পুকুরও।
পুকুরের মাছও।
এমন সময় আমার কানে একটি শব্দ ভেসে এলো।
আমার নাম ধরে কে যেন আস্তে করে ডাকছে।
কে? কে ডাকে!
বাবুকে বললাম, ছেড়ে দে না একটু!
-কই যাবি?
-একটু আসছি।
বাবু আমার মুখে একটা চিমটি কেটে বললো, যা ভাগ! দুষ্টু কোথাকার! আমি বাবুর বুক থেকে মাথা তুলে সজনে তলার দিকে গেলাম। ডাকটি ওদিক থেকেই ভেসে আসছিল।
হ্যাঁ, তাই।
আমি সজনে তলায় যেতেই দেখি নাসির দাঁড়িয়ে আছে। হেসে বললো, আমার ডাক তুই শুনতে পেয়েছিস?
-হ্যাঁ।
-এত আস্তে, তাও!
-হ্যাঁ। তোর কণ্ঠস্বর তো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। মুখস্থ। যত আস্তেই ডাকিস না কেন, শুনতে পাবো।
-যদি দূর থেকে ডাকি?
-তাও।
-যদি শূন্য থেকে ডাকি!
-তাও।
-নাসির হাসলো।
বললাম, চল পুকুর পাড়ে যাই। ওখানে আজ আমাদের চাঁদের হাট বসেছে।
-না থাক।
-কেনরে।
-এমনিই।
-চল, কিছু আম-কাঁঠাল খাবি।
-না, আজ থাক।
-তবে?
-তবে আর কী! জোছনা রাত। কিছু ভালো লাগছে না। তাই চলে এলাম। তোর কাছে কি খারাপ লাগছে?
-না।
Ñতাহলে চল্।
-কোথায়! -
-পুর্ব মাঠে।
-কেন?
-দু’জনে বসে চুটিয়ে গল্প করবো। কী মজা হবে, তাই না!
-আচ্ছা।
-তো চল।
-আব্বা আর বাবুকে বলে আসি। তা না হলে আবার হাঁক-ডাক শুরু হয়ে যাবে।
-যা। কিন্তু আমার কথা বলিসনে যেন।
-আচ্ছা, বলবো না।
আমি দ্রুত পুকুর পাড়ে গেলাম। আব্বা আর বাবুকে বললাম, আমি একটু আসি।
-কই যাবি? বাবু জিজ্ঞেস করলো।
-এই তো আরকি।
ম্যাভাই বললো, আমি আসবো?
-না দরকার নেই।
-আচ্ছা যা।
আব্বাও আর কিছু বললেন না।
আমি নাসিরের কাছে গেলাম।
আমি আর নাসির।
গল্প করতে করতে আমরা হাঁটছি।
জোছনার মুক্তোকুঁচি যেন আমাদের মাথার ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে। এত জোছনা!
চারপাশ ফকফকা।
উত্তরের দিঘির মাঠ, পুবের দিগদানা, মাঠশে, দক্ষিণের কাহার পাড়া, শুকুর খোলা -সব-সবই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
আর এর মাঝখানের যে দূরত্ব, যে ফসলের ক্ষেত সবই যেন রূপোর টাকার মতো গোল। ঝকমক করছে জোছনার আলোতে।
মগরা পার হয়ে আমরা আরও সামনে এগিয়ে চলেছি।
রাস্তা বেয়ে।
রাস্তার সবুজ ঘাস জোছনায় আরও কোমল, আরও নরোম তুলতুলে হয়ে উঠেছে।
নাসিরের পায়ে স্যান্ডেল।
আমার পা খালি।
সুতরাং ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটার মজা আমিই বেশি পাচ্ছি।
নাসিরকে বললাম, স্যান্ডেল খুলে হাতে নে।
-কেন?
-তাহলে হাঁটার মজাটা বেশি পাবি। দেখছিস না কেমন তুলতুলে ঘাস।
নাসির হাসলো।
আমার কথা মত স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল।
আমরা কবিরাজের খেজুর বাগানের কাছাকাছি।
বললাম, এখানে বসি।
-তা ভালো
আমরা ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। এত নরোম, এত আরাম। এই ঘাসের গালিচার কাছে কাশ্মিরী কিংবা ইরানী গালিচাও যেন ফেল!
নাসির হেসে বসলো, সত্যিই খুব আরাম লাগছে।
-লাগবে না। দেখতে হবে তো জায়গাটা কী!
-তা বটে, তা বটে! এর সাথে কোনো কিছুর তুলনাই চলে না।
-সত্যি বলছিস।
-একদম সত্যি।
আমরা দু’জনে বসে গল্প করছি। কত ধরনের গল্প। একটু আগে, পুকুর পাড়ে বসে যেসব গল্প হয়েছে তাও।
আমাদের গল্পের সাথে যেন যোগ দিয়েছে আকাশের সাদা মেঘ।
জ্বলজ্বলে তারকারাশি।
গাছেল ডালে জাগ্রত পাখিরা।
ঘুগরো, জোনাকি, ব্যাঙ এবং ক্ষেতের পোকামাকড়সহ সবুজ ফসল। তারা যেন মুগ্ধ শ্রোতা।
আমাদের গল্প এগিয়ে চলেছে।
চলেছে তো চলেছেই।
কোনো নির্ধারিত বিষয় নেই। কোনো তর্ক-বিতর্ক নেই। কোনো শেষ সীমাও যেন নেই।
গল্প করছি আর মজা করছি।
হঠাৎ করিবাজের খেজুর বাগান থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো।
শব্দটি স্বাভাবিক নয়।
কিসের শব্দ বুঝতেও পারলাম না।
মুহূর্ত মাত্র!
নাসির আমাকে বললো, তুই এখানে বোস! আমি একটু আসছি।
-কই যাবি?
-আরে বয় না!
বলেই নাসির স্যান্ডেল হাতে কবিরাজের খেজুর বাগানের ভেতর ঢুকলো।
আমি কেবল ওর যাওয়াটা দেখতে পেলাম।
কী দৃপ্ত পদভারে!
কি অসম্ভব শক্তভাবে সে পা ফেলছে!
খেজুর বাগানটি ঘন হওয়ায় এখান থেকে আলো-আঁধারির ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে।
একটু পরই শুনতে পেলাম প্রচণ্ড শব্দ!
তারপর গোঙানি।…
না, সেটা মানুষের শব্দের মত না।
পশুর শব্দের মত না।
একেবারেই অন্য রকম একটি শব্দ।
আমি ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখি খেজুর গাছের বিশাল এক গুঁড়ির মতো একটা কী যেন মাটিতে টান টান হয়ে পড়ে আছে।
তার বুকের ওপর আর একটি বিশাল আম আকারের ভয়ানক কিছু। তার দুই চোখ দিয়ে আগুনের হলকা ঠিকরে বেরিয়ে পড়ছে। আর যেন রাগে গড়গড় করতে করতে কি সব বলছে।
যেটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, তার প্রায় এক হাত লম্বা জিহ্বা বেরিয়ে গেছে। সেটা আগুনের মত টকটকে লাল হওয়ায় আমার বুঝতে সমস্যা হল না।
আমি ভয়ে থর থর করে কাঁপছি।
উঠে যে বাড়ির দিকে দৌড় দেব, তাও পারছিনে।
আবার সেই শব্দ!
এবারে শব্দটি অতি ভয়ঙ্কর!
সেকি গোঙানি।
তারপর চুপ।
তারপর শীতল নীরবতা।
আমি তখনও ভয়ে কাবু।
দাঁড়াবার চেষ্টা করছি।
ভাবছি দৌড় দেব বাড়ির দিকে।-
এমন সময় ফিরে এল নাসির!-
সেই রকম।
স্থির। স্বাভাবিক।
এসেই আমার হাত ধরে বসালো।
আমার চোখে-মুখে ভীতিকর এক বিস্ময়।
নাসির হেসে বললো, কিরে ভয় পেয়েছিস!
আমি চুপ।
নাসির আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আরে ভাই শান্ত হ। এত ভীতু হলে কি আর চলে!
আমি চুপ।
-কিরে কথা বল!
আমি হা করে নাসিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নাসির আমাকে একটু মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, তোর নাম না বিজয়?
-হ্যাঁ।
-তবে?
-কী?
-সামান্যতেই ভয় পাস কেন?
-কোনটা সামান্য।
-যা দেখেছিস।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনে!-
-ও, তাই বল। দিছি পাজিটারে শেষ করে।
-কাকে
-আরে ঐ যে এক পাজি!-
-সে কে।
-তুই ওসব চিনবি না। শোন তোদের মধ্যেও যেমন ভালো এবং মন্দ আছে, জিনদের মধ্যেও তেমনটি আছে।
-হ্যাঁ। -
-হ্যাঁ, তাই। দুষ্টদেরকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে হয়। আর যে তাতেও ঠাণ্ডা হয় না, তাকে…
আমি নাসিরের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছি।
নাসির আমার পড়ে হাত রেখে বললো, ঘাবড়াসনে।
-না, মানে-
আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
নাসির সম্ভবত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলো।
বললো, চল উঠি।
নাসির আমার হাত ধরে ওঠালো। তারপর কেমন স্বাভাবিকভাবে গল্প করতে করতে বাড়ির কাছে পর্যন্ত নিয়ে। আমাকে আস্তে করে বললো, আজকের এই কথা যেন কাউকে বালিসনে।
-হু।
-মনে থাকবে তো।
-হু।
-তাহলে এখন চলি।
-খেয়ে যা সবার সাথে।
-না। আর একদিন হবে।
নাসির চলে গেল।
অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তেই।
ততোক্ষণে হাতনের বিছানা জুড়ে খাবারের থালা সাজিয়ে রেখেছে মা। সবাই খেতে বসেছে।
বাবু জোরে ডাক দিল, বি-জ-য়! …
আমি বাবুর পেছন থেকে তার ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, কু-উ!
এক সিরাজের বক্ষ থেকে
লক্ষ সিরাজ জাগবে
কপোতাক্ষের পাড়েই বাঁকড়ার হাট।
হাটের পাশে বাঁকড়া হাইস্কুল।
বিশাল মাঠ। ঈদগাহ আর পুকুরও আছে।
স্কুলের মাঠে বছরে বেশ কয়েকটি বড় বড় সমাবেশ হয়।
নিয়মিত।
তার মধ্যে ২৩ জুন, পলাশী দিবস একটি।
দিনটি সরবে পালিত হয় এখানে। অন্যান্য দিবসের মতো।
এবারও হচ্ছে।
আয়োজনটাও দারুণ।
বিকেল।
অনুষ্ঠানে শুরু হবার আগেই মাঠ প্রায় ভরে গেছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিতিদের মধ্যে স্কুল শিক্ষকগণ আছেন।
শিক্ষার্থীরা আছে।
এলাকার শিক্ষিত গণ্যমান্য লোকেরা আছে।
হাটে আগত দর্শক-শ্রোতারাও আছেন।
আলোচনা শুরু হল।
সভাপতিত্ব করছেন আব্বা। মুকুন্দর সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা।
গোটা ইউনিয়নেই তার সুনাম- সুখ্যাতি আছে।
আছে পাণ্ডিত্যের সৌরভ।
সিরাজ স্যার আলোচনা করছেন।
তিনি ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন সংঘটিত পলাশীর সেই মর্মবেদনার ইতিহাস বর্ণনা করলেন।
শেষে বললেন, ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, এখনও আছে।
মীর জাফর আগেও ছিল, এখনও আছে।
মীর মদন, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, ঘষেটি বেগমরা আগেও ছিল, এখনও আছে। তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে।
তাদেরকে চিনতে হবে।
তাদের প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে দেশ।
তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ।
তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি।
এই সোনার দেশকে আমরা বিকিয়ে দিতে দেব, নাকি বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করবো, সেই সিদ্ধান্ত আজ নিতে হবে।
সিরাজ স্যার আরও অনেক কথা বললেন।
পলাশী তথা তখনকার প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটকে তুলনামূলক অলোচনা করলেন।
তার আলোচনায় সবাই খুশি হলো।
উদ্দীপ্ত হলো।
সবার আলোচনা শেষে সভাপতির বক্তব্য রাখার জন্য উঠে দাঁড়ালেন আব্বা।
তিনি বললেন, পলাশীর পাতানো আর সাজানো নাটক- নামক যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হয়েছিলেন।
তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
প্রকৃত অর্থে সিরাজের পতন হয়নি। বরং বিজয়ী সিরাজ।
যে কারণে আজও আমরা তাকে স্মরণ করছি।
আমার বিশ্বাস-‘এক সিরাজের বক্ষ থেকে লক্ষ সিরাজ জাগবে।’ সেটা আজ অথবা আগামীতে।
হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ জাগবে। আমি আশাবাদী। যারা কিশোর, তরুণ, যুবক-তাদের মধ্যে থেকেই জেগে উঠবে একেকজন সিরাজ। এ বিশ্বাস আমি রাখি।
আর তখন মীর জাফরদের পতন অনিবার্য।
এর জন্য চাই সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা এবং সাহস। মনে রাখা জরুরি যে, সত্যকে বুঝতে হলে পরিচ্ছন্ন মাথার প্রয়োজন।
সত্যকে দেখতে হলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বচ্ছ চোখের প্রয়োজন।
আর সত্যকে গ্রহণ করতে হলে একটি বিশাল সাহসী হৃদয়ের প্রয়োজন। …
আব্বার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উচ্চারণই যে এককেটি স্বপ্নের পারদ!
আশা এবং আকাক্সক্ষার পালক! সাহসের স্রোতধারা। জীবন জাগানো বৃষ্টি!
আমিসহ প্রতিটি কিশোর, যুবকই সেই সাহস, সেই পারদ এবং সেই পালক কুড়িয়ে হৃদয়ে ভরছি থরে..
0 comments: