কিছু কথা
টাকার মুল্য আমাদের কাছে সুপিরিয়র কেন? শুধু কি আমাদের জন্য? বরং মানব জাতির একদম প্রথম থেকেই যা কিছুই টাকা হিসেবে ব্যবহার হয়েছে সেটা কড়ি হোক বা অন্য যেকোন কিছু হোক তার মুল্য অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে অধিক ছিল। টাকা কে মুল্য কে দেয় নি, পৃথিবির সকল ধর্ম ও আদর্শ এই টাকাকে সর্বোচ্চ আসন গুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে।
বইতে পড়েছি একসময় একটা কম্পিউটার নাকি একটা বিল্ডিঙ্গেয় সমান বড় ছিল, ব্যবহারের সুবিধার জন্য ছোট হতে হতে আজ আই প্যাডের মত যন্ত্রের আকার ধারন করেছে যা কিনা দিব্যি পকেটে পুরে রাখা যায়। এভাবে সব কিছুই ব্যবহারিক আরাম প্রিয়তার দোহাই দিয়ে আকারে ও ওজনে ছোট থেকে ছোটতর হচ্ছে। বড় পরিতাপের বিষয় যে এর থেকে পোষাক আষাক ও টাকার ব্যপারটাও বাদ যায় নি।
শুধু মাত্র ব্যবহারের আরাম প্রিয়তার দিককে প্রাধান্য দিয়ে সব কিছুর আদল পরিবর্তন করায় যে কল্যান নেই তা আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের হর্তা কর্তা দের আজও বোধগম্য হয় নি।যাই হোক আগডুম বাগডুম না বকে আসল কথায় ফিরে আসি। বেশ কিছুদিন আগে “খিলাফত ও ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে তর্ক করতে প্রচন্ড আগ্রহীদের কাছে একটি আরজ” নামে একটি পোষ্টে পেপার মানি নিয়ে দুই তিনটা বাক্য লিখেছিলাম শুধু মাত্র আসল পরিস্থিতিটা তুলে ধরার জন্য। লেখাটা পড়ে কোন কোন শ্রদ্ধাভাজন ব্লগারের চোখ আটোকে গেছে ঐ দুই তিনিটি লাইনে। তাই তারা অনুরোধ করেছিলেনে এব্যপারে কিছু লেখার জন্য। তাদের সেই অনুরোধ রাখার জন্যই আজকের লিখতে বসা।
যা বলছিলাম, ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় রসুলুল্লাহর (স) এর দেখানো পথে যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তাদের কেউই মুদ্রা হিসেবে গোল্ড দিনার (স্বর্ন মুদ্রা) ও সিলভার কয়েন (রৌপ্য মুদ্রা) ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করেন নি। আর রাসুল (স) এর যুগে যে সকল জিনিস টাকা হিসেবে ব্যবহার করা হতো তার মধ্যেও গোল্ড কয়েন ও সিলভার কয়েন ছিল। কিন্তু হাদীসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে রাসুলুল্লাহর একটি অতি পরিচিত হাদিসে রিবা (সুদ) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে যখন স্বর্নের বিনিময়ে স্বর্ন, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, বার্লির বিনিময়ে বার্লি, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, অথবা লবনের বিনিময়ে লবন একে অপরের সাথে বিনিময় হবে তখন এদের বিনিময়ের পরিমান উভয় পক্ষ থেকে অবশ্যই সমান হতে হবে। অন্যথায় এটা হবে রিবা বা সুদ। এই হাদিসটি একদিকে যেমন কিভাবে সুদ ভিত্তিক লেনদেন হতে পারে তার শিক্ষা দিচ্ছে তেমনি এই হাদিসটি লেনদেনের জন্য উপরিউক্ত জিনিসগুলো ব্যবহার করার আইনি (শারয়ী) বৈধতাও দিচ্ছে। শুধু তাই নয় অতীতে এসবগুলো জিনিস টাকা হিসেবে মদিনার বাজারে ব্যবহৃত হতো।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো উপরে উল্লেখিত যে ছয়টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে তাদের মাঝে প্রথম দুটি হলো নীরেট ধাতব পদার্থ আর বাকি সবগুলো হলো Commodity বা ব্যবহারিক পন্য। কিন্তু এসব জিনিসের মাঝে দুটি মিল আমরা দেখতে পাই, এক নম্বর মিলটা হলো যেটা আমরা আগেই বলছি যে অতীতে এসবগুলো জিনিস টাকা হিসেবে বাজারে ব্যবহৃত হতো। আর অন্যটি হলো এগুলোর সবগুলোর মুল্য এদের নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান আছে যাকে ইকোনোমিক্সের ভষায় বলা হয় Intrinsic ভ্যালু। সোজা কথায় টাকার মুল্যটা টাকার মধ্যেই বিদ্যমান। আরেকটি মিল খুজে পাওয়া যায় যেটা হলো এসব গুলো জিনিসই একটা অপেক্ষাকৃত লম্বা সময় ধরে জমিয়ে রাখা যায় এবং এতে এগুলোর মুল্য প্রায় একই থাকে। বিশেষ করে গোল্ড ও রৌপ্যের মুল্যে বিন্দুমাত্র্ পরিবর্তন হয় না। আর বাকিগুলোর মাঝেও মানের পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। এটাকেই ইমরান নযর হুসাইন ও আহমেদ কামীল মাইদিন মেরার মত স্কলার গন সুন্নাহ মানি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হালাল মুদ্রার শর্ত
এদিকে হযরত আলী রাঃ একটি উটের বিনিময়ে চারটি উটের বিনিময় করেছিলেন। কিন্তু সেটা রিবা হিসেবে গন্য হয় নি, অন্যদিকে হযরত বিলাল রাঃ দুই সা’আ খেজুরের বিনিময়ে এক সা’আ উন্নতমানের খেজুর বিনিময় করলে রাসুল সঃ তাকে বলেছিলেন যে এটা হলো সূদ বা রিবা। প্রশ্ন উঠতে পারে এখানে এরকম পার্থক্য কেন হল? কারন একটাই আর তা হল একটি জিনিসকে মুদ্রা হিসেবে ব্যাবহার করতে যেসকল গুনাবলী ঐ জিনিসের মাঝে থাকা দরকার সেগুলো উটের মাঝে নেই বরং খেজুরের মাঝে আছে। এখানথেকে বুঝা গেল যে, যেকোন কিছু কম বেশী করে বিনিময় করলে তা রিবা বা সূদ হয় না, এবং সব কিছু মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা যায় না, বরং বিনিময় কৃত বস্তুর মাঝে সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট থাকা চাই। যেমনটি গত পর্বে আমরা বলে ছিলাম যে মুদ্রা হিসেবে কোন কিছুকে ব্যবহার করতে হলে সেই বস্তুকে কিছু বৈশিষ্টের অধিকারী হতে হবে, আর সেই শর্ত গুলো হল, সংশ্লিষ্ট জিনিসটির store value থাকতে হবে সেই সাথে ঐ জিনিসটিকে জমিয়ে রাখার কারনে তার মুল্যমানে কোন বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না, আরেকটি শর্ত যেটি আগের পর্বে উল্লেখ করতে ভুলে গেছি সেটা হল unit of account অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বস্তুটিকে ক্ষুদ্র এককে ভাঙ্গার যোগ্য হতে হবে এবং সেটিকে ক্ষুদ্র এককে ভাঙ্গার পরও এর যথাযথ মুল্যমান ঠিক থাকবে। এই গুনটিও হাদীসে উল্লেখিত সবগুলো জিনিসের মধ্যে বিদ্যমান আছে। আর সেগুলো যেহেতু অতীতে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো সেহেতু একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সে সবগুলোরই মুদ্রা হিসেবে গ্রহন যোগ্যতা সমাজে ছিল।
এখন আসুন কাগুজে মুদ্রার সাথে এই তথাকথিত সুন্নাহ মানির মিল গুলো খুজে দেখি। চিন্তা করে দেখুন, আমাদের দেশের ৫০০ টাকার নোট ও একশত টাকার নোট দৈর্ঘে ও প্রস্থে সম্পুর্ন এক, প্রিন্ট কোয়ালিটিও এক, শুধু একশত টাকার স্থলে পাঁচশত টাকার সীল মোহর মারা, আর একটি থেকে অন্যটিকে আলাদা ভাবে চেনার জন্য ভিন্ন ডিজাইনের অলংকরন করা। শুধু মাত্র একটি কাগজে ভিন্ন সংখ্যা উল্যেখ করার কারনেই একই রকম দুইটি কাগজের মুল্য আকাশ পাতাল তফাৎ হয়ে গেল। বিষয়টা কি কিছুটা হলেও হাস্যকর নয়? যাহোক, এই কাগুজে বা পেপার মানিতে (paper money) একটি গুন সম্পুর্নভাবে আমরা দেখতে পাই সেটা হল এই কাগুজে মুদ্রাকে লম্বা সময়ের জন্য জমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু রাসুলুল্লাহর যুগে তথা ইসলামিক স্বর্ন যুগে কাগুজেমুদ্রার কোন ব্যবহারই ছিলনা। এমনকি পবিত্র কোরআনে মুদ্রার কথা বলতে “দিরহাম”, “দিনার” ও “কিনতার” শব্দ গুলোই এসেছে। এখানে কিনতার হলো নির্দিষ্ট পরিমান দিনারের একক মুল্যের নামীয় প্রকাশ। মানে হল এক কিনতার সমান ১২০০ গোল্ড দিনার। এবং সুন্নাহ মানির মত এই কাগুজে মুদ্রার মুল্য কাগুজে মুদ্রাটির মধ্যে নিহিত নেই। তার মানে হল আমরা যে দশটাকা , বিশটাকা বা একশ টাকার নোটগুলো ব্যবহার করি সে নোট গুলো কখনই দশ পয়শার মুল্যমানও বহন করে না।
Store value: সুন্নাহ মানি বলতে আমরা উপরে যে সকল জিনিস উল্যেখ করেছি সেসকল জিনিস store বা গচ্ছিত করে রাখা যায়। শুধু গচ্ছিত করে রাখাই যদি শর্ত হতো তাহলে কোন কথাই ছিল না। বরং এখানে চমৎকার একটি শর্ত আছে যা আপনার এবং আমার অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য সৃষ্টিকর্তার দেয়া এক অনন্য নিয়ামত। আর সেটা হল প্রকৃত মুদ্রার বৈশিষ্ট হবে এমন যে,যে জিনিসটা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হবে তা যেন গচ্ছিত করে বা দীর্ঘদিন জমাকরে রাখার উপযুক্ত হয়, শুধু তাই নয় এই, জমা করে রাখার কারনে যেন ঐ জিনিসটার মুল্যমানে কোন পরিবর্তন না হয়। এতে ব্যাক্তির সম্পদের ন্যায় সঙ্গত মান দিন, কাল ও পাত্র ভেদে ঠিক ও সমান থাকে। যাকে সার্বজনীন মুল্যমান বলতে পারি আমরা। এখন বর্তমান বিশ্বে কোন মুদ্রা খুজে পাওয়া যাবে না যার সার্বজনীন মুল্যমান আছে। সেটা ডলার হোক বা ইউরো হোক অথবা অন্য যে কোন কিছুই হোকনা কেন। কিন্তু সুন্নাহ মানি বলতে আমরা যেই দিনার বা দিরহামের কথা বুঝাচ্ছি সেই দিনার ও দিরিহামের মান আবহমান কাল ধরে বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। লোকে বলে স্বর্নের বা রৌপ্যের দাম বেড়ে গেছে কিন্তু আসলে স্বর্ন বা রৌপ্যের দাম আদৌও বাড়ে নি বরং আমাদের হাতে যে কাগুজে মুদ্রাগুলো আছে সেগুলোর ক্রয় ক্ষমতা purchasing power কমে গেছে অর্থাৎ সেগুলোর মুল্যমান কমে গেছে।
আপনার টাকার নীরব অবমুল্যায়ন ও মানি ক্রিয়েশন
আমরা যদি হাদিসে উল্লেখিত ছয়টি জিনিসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে সেগুলোতে উপরে উল্লেখিত শর্ত গুলো চমৎকার ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু আজকাল আমরা যে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহার করছি তাতে কি শর্ত দুটি বিদ্যমান আছে? আসুন দেখি সেটা আমরা নিজেরা পরিক্ষা করেই জেনে নেই। ধরুন আজকের দিনে আপনি ৫০ টাকা দরে এক কেজি চাল কিনতে পারেন, এবং আপনার কাছে এখন ৫০ টাকা আছে। এই পঞ্চাশ টাকা আপনি ইচ্ছা করলেই বছরের পর বছর বালিশের তলায় রেখে দিতে পারেন। টাকা টি কিছুতেই নষ্ট হবে না। তাহলে চলুন আমরা ঐ ৫০ টাকা টা বালিশের তলায় রেখে দেই। আজ থেকে এক বছর পর আপনি যখন বাজারে যাবেন তখন ঐ ৫০ টাকায় কি এক কেজি চাল কিনতে পারবেন? আমার মনে হয় পারবেন না। আমি ১০০% নিশ্চিত যে আপনি পারবেন না। আপনাকে এক কেজির চেয়ে কম পরিমান চাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তার মানে হল আমাদের অতি প্রিয় কাগুজে মুদ্রার মুল্যমান এক বছর পরেই বদলে যাচ্ছে। যদি সেটা আরও এক বছর রেখে দেয়া হয় তাহলে? তাহলে আপনার ওই পঞ্চাশ টাকায় আরও কম পরিমান চাল আপনাকে কিনতে হবে। এভাবে কাগুজে মুদ্রার মান কমতেই থাকে। এখন প্রশ্ন হলো ঐ টাকা গুলো বালিশের তলায় রেখে দেয়ার পর আমরা তো কোন পাপ করিনি। কিছুইতো করিনি। তাহলে কে এবং কেন ঐ মুদ্রার মুল্যমান কমালো? যারা ইকোনমিক্সের ছাত্র তারা হুট করেই হয়তো বলে বসবেন যে এখানে “ইনফ্ল্যাশনের” ব্যপার আছে, ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের ব্যপার আছে ব্লা ব্লা ব্লা। হুম্ম অর্থনৈতিক তাত্বিক জ্ঞান তাই বলে। কিন্তু আমরা আজ দেখবো বাস্তবিক জিবনে আসলে কিভাবে কি ঘটে। কে কিভাবে আমাদের পকেটের কাগুজে মুদ্রার মুল্যমান কমায় এবং সেটা কতটা আইনি বা বেআইনি সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে পরে ইনশাআল্লাহ।
তবে এখানে জেনে রাখা ভালো যে ইসলাম কাউকেই অন্যের সম্পদ ও মালের অবমুল্যায়ন করাকে জায়েজ করে নি বরং এটা কঠোর ভাবে হারাম করা হয়েছে। এখানে কোরআনের “লা তাবখাসুন্নাসা আশিয়াউহুম…” এই আয়াতটা উল্যেখ্য। এখানে ঠিক তাই করা হচ্ছে, আপনার আমার অজান্তেই আমাদের পকেটের টাকার মানকে দিন দিন অবমুল্যায়িত করা হচ্ছে। এবং এটা সম্ভব হচ্ছে কাগুজে মুদ্রার বদৌলতেই। এই ব্যপারে জলন্ত উদাহরন হতে পারে ইন্দোনেশিয়া ও তুরষ্ক যাদের টাকার বস্তা নিয়ে বাজারে যেতে হয়। ইন্দোনেশিয়ান ইকোনমি ধ্বশের আগে প্রতি ডলারের মুল্য ছিল আট হাজার রুপিয়া যেটি এক রাতের মাঝেই Depreciate করে নামে ২০ হাজার রুপিয়ার বিনিময়ে মাত্র এক ডলারে। অন্যদিকে তুর্কি ১.৫ মিলিয়ন লিরার বিনিময়ে পাওয়া যেত মাত্র এক ডলার! রাতারাতি এই কাগুজে মুদ্রার মুল্য কেন কমলো? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। শুধু তাই নয় এই অবমুলয়্যিত মুদ্রা গুলোর যে অংশ আমাদের চোখের আড়ালেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে সেগুলো জমা হচ্ছে অন্য কারো পকেটে। তারা কারা সেটাও খুজে বার করার চেষ্টা চালাবো আমরা ইনশাল্লাহ।
এভাবেই বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মুল্যমান কমে যাচ্ছে দিন দিন। এখন কেন আমাদেরকে সার্বজনীন মান সম্পন্ন মুদ্রা বা দিনার ও দিরহামের কথা চিন্তা করতে হবে এবং কেন সুন্নাহ মানি তথা দিরহাম ও দিনার ব্যতিত কাগুজে মুদ্রা কে হারাম বলে গন্য করা হবে সেটা জানা দরকার। যে মুদ্রার সার্বজনীন মুল্যমান নিশ্চিত নয় সে মুদ্রা দিয়ে সহজেই প্রতারনার আশ্রয় নেয়া যায়। এতে করে অর্থ-কড়ি, ধন-সম্পদ সমাজের একটি নিদৃষ্ট জনগোষ্ঠীর আওতায় চলে যায় ফলে সমাজের নিরিহ বৃহদাকায় অংশটি সম্পুর্নরুপে বঞ্ছিত হয় পাশাশি সমাজে নব্য ধারার দাস প্রথার উদ্ভব হয়। এর ফলে ধনী আওর ধনবান হয় আর গরীব হয় আরও রিক্ত। আমাদের গোটা মানব সমাজ সেটা হতে পারে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সবাই আজ মানুষের গড়া সিস্টেমের গোলামে পরিনত হয়েছে। কোন কিছুই আজ সিষ্টেমের বাহিরে হয় না। এই সিষ্টেমের গেড়াকলে পড়ে মানবতা হয়েছে সুদুর পরাহত।
অনেকেই মনে করেন যে বিভিন্ন দেশে সরকারই শুধু মুদ্রা ইস্যু করে থাকে, ধারনাটা আসলেই সত্য। সরকার যে টাকাটা ইস্যু করে তা বৈধ মুদ্রা। এর পেছনে কিছু যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া গেলেও সরকারের ইস্যু কৃত ঐমুদ্রা থেকে আবার নতুন করে যে মুদ্রা তৈরী হয় তা অনেকেরই জানা নেই। না এটা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কোন কাহিনী নয়। সরকার ও জনগনের সামনে দিয়েই এই মুদ্রা গুলো তৈরী হচ্ছে কিন্তু সমস্যা হল হয়তো সরকারগুলো এটা জেনেই চুপ আছে নয়তো সাধারন জনগনের মতই সরকারের অর্থনীতি বিদেরা জিনিসটা একেবারেই জানেন না বা বুঝেন না। উপরের যে উদাহরন দিলাম তার বাস্তবিক সত্যতা বুঝানোর জন্য আমাদেরকে এখন মডার্ন মানি ম্যাকানিক্সের দিকে একটু নজর দিতে হবে। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যংক “ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক” মিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে মনিটর করার জন্য এই মডার্ন মানি ম্যাকানিক্স নামে একটি প্রটোকল তৈরি করে। এই প্রটোকল প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ও মানি ক্রিয়েশন নিয়ে সারা বিশ্বের জন্য একটি নীতিমালা প্রনয়ন করে যার নাম ফ্যাডারেল রিজার্ভ ব্যাংকিং সিস্টেম (Fedarel reserve banking system) ঐ নীতিমালার প্রথমেই এর উদ্যেশ্য হিসেবে লেখা হয়েছে “The purpose of this booklet is to describe the basic process of money creation in a fractional reserve banking system.” এখন আমাদের জানা দরকার যে Fractional reserve banking system বলতে কি বুঝায়। আমার ধারনা সবাই এটা জানেন যে সকল ব্যাংককে কেন্দ্রিয় ব্যাংককে তার মোট ডিপোজিটের একটা অংশ (সাধারনত ১০%) জমা দিতে হয়। মুলত এটাই Fractional reserve banking system। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে অসম্ভব ধুর্ততা ও অনৈতিকতা। এই সিষ্টেমের কারনেই মুলত ৯০% ইনফ্লাশনের সৃষ্টি হয় যার কারনে আমাদের পকেটের মুদ্রার মুল্যমান দ্রুত কমে যায়। এখন আসুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে এটা কাজ করে।
ধরুন একটি দেশের সরকার কিছু টাকা বাজারে ছাড়ার সিধ্যান্ত নিল। তখন সে ফেডারেল রিজার্ভ (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক)এর কাছে থেকে দশ বিলিয়ন কাগুজে মুদ্রা চাইলো। তখন কেন্দ্রিয় ব্যাংক বল্ল যে হ্যা আমরা সরকার থেকে দশ বিলিয়ন টাকার সমমুল্যের সরকারি বন্ড (ট্রেজারি বন্ড) কিনবো।অতএব সরকার কিছু অফিসিয়াল অলংকরন সমৃদ্ধ কাগজে দশ বিলয়ন সমমুল্যের টাকার অংক বসিয়ে দিল (যা সিকিউরিটি বা প্রতিশ্রুতি পত্র।এখানে প্রতিস্রুতি হল এই যে সরকার ফেডারেল রিজার্ভ থেকে দশ বিলিয়ন টাকা ধার হিসেবে নিচ্ছে) এবং কেন্দ্রিয় ব্যাংকের কাছে পাঠালো।প্রতিদানে ফেডারেল রিজার্ভ কিছু কাগুজে মুদ্রা ছাপিয়ে (টাকা যা ১০বিলিয়ন সমান) সরকারকে দিলো। এটা হল সরকারের পক্ষথেকে মুদ্রা ইস্যু করা যাকে এমেরিকানরা বলে ফেডারেল রিজার্ভ নোট বা ডলার আর আমাদের দেশে টাকা। এখানে লখ্যনীয় যে সরকার কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে এই ১০ বিলিয়ন টাকা লোন হিসেবে নিয়েছে।এতটুকু মনে রাখুন ভবিষ্যতে কাজে লাগবে ইনশাআল্লাহ।
এইবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া দশ বিলিয়ন কাগুজে মুদ্রা সরকার একটি ব্যাংক একাউন্ট এ জমা রাখলো। এর মাধ্যমে বাজারে দশ বিলিয়ন নতুন টাকার লিগ্যাল অস্তিত্ব ঘটলো। অবশ্য এই উদাহরনটা একটি সার্বিক উদাহরন আদতে এই সম্পুর্ন প্রক্রিয়াটা নিছক কম্পিউটারের ডিজিট পরিবর্তনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
আমি জানি এখানে এসে অনেক প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগবে। এই পর্বটা বেশ বড় হয়ে গেল তাই আজ এ পর্যন্তই, পরবর্তি পর্বের সাথে এই পর্বের কথা গুলো সম্পুর্ন রিলেটেড তাই আগামি পর্বে অনেক কনফিউশনের জবাব মিলবে।
মানি ক্রিয়েশন
প্রতিবার নতুন করে সরকার যে মুদ্রা ইস্যু করে তা আসলে টাকা নয় বরং সরকার কর্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋন সুতরাং আমাদের পকেটের টাকা গুলো আদতে টাকা নয় বরং সেগুলো হল একেকটি ঋন পত্র। শুধু তাই নয় সেগুলো ইকোনমিতে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান মুদ্রার মুল্যমান থেকে মানের অবনতি ঘটিয়েই নিজেদের মানকে নিশ্চিত করে। এভাবেই আমাদের অজান্তেই আমাদের পকেট থেকে অদৃশ্যভাবে টাকা গুলো প্রকৃত অর্থে চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর এটাকেই ইনফ্লাশন বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
আগেই বলেছি অনেকেই মুখস্থ বলেন যে এখানে Inflation (মুল্যস্ফিতি) ব্যপার আছে, তাদেরকে যদি জিজ্ঞেশ করা হয় যে Inflation কি? তারা বলেন যখন অর্থনীতিতে মুদ্রার সাপ্লাই বেড়ে যায় তখন পন্যের বীপরিতে মুদ্রার সংখ্যা বেড়ে যায় ফলে পন্যের মুল্য বেড়ে যায় এবং একেই Inflation বা মুল্যস্ফিতি বলে। হ্যা ওনাদের কথা ঠিক আছে কিন্তু তারা জানেন না যে বাস্তবতা কতটা ভিন্ন। Inflation এর আসলে উৎসটা কোথায়, কে বা কারা এবং কি জন্য বা কিসের ভিত্তিতে মুদ্রার সাপ্লাই বাড়ানো হয় তা অনেক অর্থনীতিবিদের কাছেই অজানা। আমরা এই পর্বে যখন মানি ডেফিনেশন (money definition) নিয়ে আবার কথা বলবো তখন বিষয়টা আরো পরিশকার হবে, যেমনটি আজকে ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যংকিং সিষ্টেম (fractional reserve banking system) নিয়ে কথা বলার পর অনেকটাই ক্লিয়ার হয়ে যাবে। তখন আশাকরি সব কিছু দিবালোকের মত পরিশকার হয়ে যাবে। আসলে আমরা প্রতিটি ট্রানজেকশানের মাধ্যমে আমরা দিন দিন শুধু প্রতারিতই হচ্ছি।
যেমনটি গত পর্বে বলেছিলাম যে fractional reserve banking system অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকে জমা পড়া টাকা (ডিপোজিট) এর দশ শতাংশ কেন্দ্রিয় ব্যাংকে জমা রেখে বাকি টাকা কাষ্টমারকে লোন দিতে পারবে। এই দশ শতাংশ টাকা জমা রাখার উদ্দেশ্য হল যদি দুর্ভাগ্য বশত কোন ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে পড়ে বা অন্য কোন ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসে পতিত হয় তাহলে কেন্দ্রিয় ব্যাংক সেই বিপদ গ্রস্থ ব্যাংক কে সাহায্য করবে। Finally it (Bank) must maintain legally required reserve in the form of vault cash and/ or balances at its Federal Reserve Bank equal to a prescribed percentage of its deposit. এভাবেই মডার্ন মানি ম্যাকানিক্সে ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ সিষ্টেমটি বর্ননা করা আছে। এদিকে এই রিকয়ার্ড রিজার্ভের পরিমান কত হবে তা বর্ননা করা আছে ঠিক এভাব।।Under current regulations, the reserve requirement against most transection accounts is 10 percent, assuming for simplicity.
উপরের কথাগুলো হল সব তাত্বিক কথাবার্তা, বাস্তবে এগুলোর প্রয়োগের কারনে কি ঘটে আসুন তা লক্ষ্য করা যাক। আগের পর্বে দেখিয়েছিলাম যে কিভাবে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার মুদ্রা ইস্যু করে থাকে। আলোচনার সুবিধার জন্য গত পর্বের সেই উদাহরনটা হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে। ধরুন একটি দেশের সরকার কিছু টাকা বাজারে ছাড়ার সিধ্যান্ত নিল। তখন সে ফেডারেল রিজার্ভ (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক)এর কাছে থেকে দশ বিলিয়ন কাগুজে মুদ্রা চাইলো। তখন কেন্দ্রিয় ব্যাংক বল্ল যে হ্যা আমরা সরকার থেকে দশ বিলিয়ন টাকার সমমুল্যের সরকারি বন্ড (ট্রেজারি বন্ড) কিনবো।অতএব সরকার কিছু অফিসিয়াল অলংকরন সমৃদ্ধ কাগজে দশ বিলয়ন সমমুল্যের টাকার অংক বসিয়ে দিল (যা সিকিউরিটি বা প্রতিশ্রুতি পত্র।এখানে প্রতিস্রুতি হল এই যে সরকার ফেডারেল রিজার্ভ থেকে দশ বিলিয়ন টাকা ধার হিসেবে নিচ্ছে) এবং কেন্দ্রিয় ব্যাংকের কাছে পাঠালো।প্রতিদানে ফেডারেল রিজার্ভ (সংক্ষেপে আমরা একে বলব “ফেড”) কিছু কাগুজে মুদ্রা ছাপিয়ে (টাকা যা ১০বিলিয়ন সমান) সরকারকে দিলো। এটা হল সরকারের পক্ষথেকে মুদ্রা ইস্যু করা যাকে এমেরিকানরা বলে ফেডারেল রিজার্ভ নোট বা ডলার আর আমাদের দেশে টাকা।
এই নতুন ধার করা টাকাটা সরকার বাজারে ছাড়বে কিভাবে? অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে। মডার্ন মানি সার্কুলেশনের জন্য ব্যাংক একটি ইণ্টারমিডিয়ারি হিসেবে কাজ করে। তো ধরুন ফেড বা কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে সরকার টাকা নিয়ে কোন কমার্সিয়াল ব্যাংকে জমা রাখলো। এখন ঐ শংশ্লিষ্ট ব্যাংকে এই দশ বিলিয়ন টাকা একটা ডিপোজিট হিসেবে জমা হবে। fractional reserve banking system অনুযায়ি ঐ ব্যাংককে এই দশ বিলিয়ন টাকার দশ শতাংশ কেন্দ্রিয় ব্যাংকে জমা দিয়ে বাকি টাকা লোন আউট বা লোন দিতে পারবে। অর্থাৎ ১০ বিলিয়ন টাকা থেকে এক বিলিয়ন টাকা বাদ দিয়ে বাকি নয় বিলিয়ন টাকা লোন দিতে পারবে। এখন মনে হতে পারে যে এই নয় বিলিয়ন টাকাটা ঐ দশ বিলিয়ন টাকা থেকেই এসেছে। কিন্তু বিষয়টা আসলে উলটো। আসলে এই নয় বিলিয়ন টাকা সিম্পলি হাওয়া থেকে বানানো হয়েছে যার ফলে ইকোনমিতে মানি সাপ্লাই দশ বিলিয়ন নয় বরং ১৯ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার আসুন মডার্ন মানি ম্যাকানিক্স কি বলে তার দিকে তাকাই, Of course, they (Bank) do not really pay out loans from the money they receive as deposits. If they did this, no additional money would be created. What they do when they make loans is to accept promissory notes (loan contract) in exchange for credits (money) to the borrowers’ transection account. যার অর্থ হলো এই নয় বিলিয়ন টাকা কোন ভিত্তি ছাড়াই তৈরি হয়েছে কারন দুটি, একটি হলো Demand of loan বা লোনের চাহিদা অনেক বেশী অন্যটি হল ব্যাংকে দশ বিলিয়ন ডিপোজিট আছে নয় বিলিয়ন টাকা লোন চাহিদা মেটানোর জন্য।
বিষয়টা আরো পরিস্কার ভাবে বুঝতে আসুন মনে করি মিঃ রহিম শংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গেল এবং নতুন নয় বিলিয়ন টাকা ধার করলো, অনেক বড় অঙ্গকের টাকা নিশ্চই কেউ হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরুবে না। তাই মিঃকরিম ঐ টাকা তার একাউন্টে জমা দিল। এই জমা দেয়ার পর ব্যাংক আবার ঐ নয় বিলিয়ন নতুন ডিপোজিট হিসেবে কাউন্ট করে। এবার আবার ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ রিকয়ার্মেন্টের খেলা শুরূ হলো। নয় বিলিয়নের দশ শতাংশ (৯০০০০০০০০০০ টাকা) ফেড রিজার্ভে রেখে বাকী টাকা (৮১০০০০০০০০০০ টাকা) আবারো ব্যাংক লোন দিবে। এবার ধরুন মিঃ করিম এসে এই ৮.১ বিলিয়ন টাকা লোন নিয়ে সেটা তার একাউন্টে জমা দিল। আবারো ব্যাংকে ৮.১ বিলিয়ন টাকা নতুন ডিপোজিট হিসেবে কাউন্ট হবে সেটা আবার দশ শতাংশ সরিয়ে রেখে বাকী অংশ লোন দেয়া হবে এভাবে মাত্র দশ বিলিয়ন থেকে গড়ে নয় গুন টাকা নতুন করে তৈরি হচ্ছে। একে ব্যাংকের বা ফাইন্যান্সের ভাষায় বলা হয় multiple credit creation বা multiple money creation. গানিতিক যে টার্মটা এ ক্ষেত্রে ইউজ করা হয় তা হল Multiplier effect. এইসব টাকার ফিজিক্যাল কোন অস্তিত্ব নেই কিন্তু ব্যাংক গুলোর একাউন্টিং হিসাবের বইতে বা কম্পিউটারে এই টাকা গুলোর এন্ট্রি ঠিকই আছে। এভাবেই হাওয়া থেকে টাকা তৈরী হচ্ছে প্রতিদিন।
এখন এই টাকাগুলো যে তৈরী হচ্ছে সেগুলোর মুল্যমান কোথেকে আসছে? উত্তর হচ্ছে বাজারে যে টাকা গুলো ফিজিক্যালি আছে সেগুলো থেকে। এই নতুন টাকা গুলো আসলে বাজারে বিদ্যমান টাকা গুলো থেকে মুল্যমান চুরি করছে। এভাবেই মানি সাপ্লাই বেড়ে যাচ্ছে আর প্রতি একক টাকার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে যাকে আমরা মুল্যস্ফিতি বলে জানি। আর এই মুল্যস্ফিতিকে হিডেন ট্যাক্সও বলা হয়ে থাকে। এখন যে কথাটা বলতে যাচ্ছি সে কথাটা আগে বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইতেন না। এখন যতটুকু আলোচনা হল তা যদি বুঝে থাকেন তাহলে আশা করি মোটেই অবাক হবেন না এই কথা জেনে যে আমেরিকার ইকোনোমিতে ফিজিক্যাল মানি বা রিয়েল মানির পরিমান মাত্র ৩%! আর বাদ বাকী ৯৭% হলো ভুতুড়ে ডলার যাদের অস্তিত্ব শুধুই হিসাবের পাতায় আছে। আর ফেড সিষ্টেম চালু হবার পর থেকে এই পর্যন্ত ডলারের ডিভ্যালুয়েশন হয়েছে ৯৬% । কোন এক পর্বে মন্তব্যের ঘরে বলেছিলাম যে ডিভ্যালুয়েশনটা চিরতরে হচ্ছে এবার তার প্রমান মিলে গেল মনে হয়।
কাগুজে মুদ্রার মাধ্যমে বিশ্ব প্রতারনা
এখন চলুন সেই ১৭শ শতাব্দির ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড থেকে শুরু করা যাক। ১৭শ শতাব্দির শেষ দিকে এই ব্যাংকটি সর্ব প্রথম পেপার মানি ইস্যু করে যার আদল সম্পুর্ন একটি ব্যাংক চেকের মতই ছিল। যতক্ষন পর্যন্ত এই ফিয়েট মানি বা কাগুজে মুদ্রা টা গোল্ডে ক্যাশ করা যাবে ততক্ষন এটা হালাল মানি হিসেবেই গন্য হবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ইউরোপিয়ান বিজয়ীরা একটি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি কনফারেন্সের আয়োজন করে এবং তাতে সারাবিশ্বকে আমন্ত্রন জানায় । সালটা ছিল ১৯৪৪, এই কনফারেন্সে মুসলমান দেশগুলোও অংশ গ্রহন করেছিল যেমন সৌদিয়ারবও সেখানে ছিল। এই কনফারেন্সকে সবাই ব্রটেন উড নামেই চেনে। যেখানে বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক বৃটেন উড এগ্রিমেন্ট টি সম্পন্ন হয়। সেখানে দুইটি গুরুত্বপুর্ন বিষয়ে সমঝোতা হয়, একটি হলো এই যে, বিশ্বের সকল কারেন্সির মধ্য থেকে একমাত্র ইউ এস ডলারই গোল্ডে ক্যাশ করা যাবে অন্য কারেন্সি গুলো নয়। তখকার রেট টা ছিল ৩৫ ডলারে এক আউন্স গোল্ড। অন্যান্য কারেন্সি কে গোল্ডে ক্যাশ করতে হলে অবশ্যই আগে সেই কারেন্সি গুলোকে ডলারে ভাঙ্গাতে হবে কারন অন্যান্য কারেন্সিগুলো কে আনরিডিমেবল বলে ঘোষনা করা হয়েছে। এই অন্য কারেন্সির তালিকায় আমাদের মুদ্রা ও আছে। মাওলানা ইমরান নযর হুসাইনের মতে সেদিনই অন্যসব কারেন্সিগুলো ৯৯% হারাম হয়ে যায় মাত্র ১% বাকী থাকে হালাল হিসেবে। কারন তখনও কারেনসি গুলোকে গোল্ডে ক্যাশ করার সুযোগ ছিল। এই চরম সেকুলার আমেরিকা সেদিন পুরো বিশ্বকে ভুলিয়েছিল শুধু মাত্র একটি কথা বলে “ইন গড উই বিলিভ” এই কথাতেই পটে গিয়েছিল সারা বিশ্ব।ধর্মনিরপেক্ষতার মন ভুলানো মিষ্টি কথায় কে নাচেনি? কি মুসলমান কি হিন্দু আর কি অন্যান্য ধর্মের অনুসারিরা। সবগুলোই ধর্মনিরপেক্ষতার চটকদার কথা শুনে তা তা ধৈ ধৈ করে নাচতে নাচতে নিজেদের ধর্মিয় বাধ্যবাধকতার কথা বেমালুম ভুলে গেল। কোন প্রকার চিন্তা ভাবনা না করেই তারা এরকম একটা চরম আত্বঘাতি চুক্তিতে রাজি হয়ে এল। একমাত্র মুসলমানরা যদি তাদের ধর্মের বিধিনিষেধ গুলোর কথা মনে রেখে ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বিকৃতি জানাতো তাহলে আমাদেরকে আজকের কৃতদাসের জীবন যাপন করতে হতো না। এই সিরিজে চেষ্টা করবো কিভাবে আমরা নিজেদের অজান্তেই একটি অতি ছোট্ট গ্রুপের (সিক্রেট সোসাইটি, ইলিমুনাতি) কৃতদাশ হয়ে বসে আছি তা দেখাতে।
এই চুক্তির দুই নম্বর এগ্রিমেন্ট ছিল কোন ব্যাক্তি তাদের মানি কে ক্যাশ করার যোগ্যতা রাখবে না। শুধু মাত্র বিভিন্ন দেশের সেন্ট্রাল ব্যংক তা পারবে। এই চুক্তিটি ১৯৭১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে বৃটিশ সরকার আমেরিকার কাছে তাদের কাছে গচ্ছিত তিন বিলিয়ন ইউ এস ডলার কে গোল্ডে ক্যাশ করার জন্য দাবী করে। কারন পুর্বে উল্লেখিত শর্ত দুটি অনুযায়ি প্রতি ৩৫ ডলারে এক আউন্স স্বর্ন যে কোন দেশের সরকার দাবি করা মাত্রই ইউ এস সরকার তা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে তৎকালিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের হর্তা কর্তারা পড়ে যান এক মহা সংকটে। কারন ইউএস সরকার ততদিনে তাদের কাছে গচ্ছিত স্বর্নের চেয়ে অধিক পরিমান ডলার ইস্যু করে বসে আছে। এদিকে বৃটেনকে তাদের দাবী মোতাবেক স্বর্ন দিয়ে দিলে সৌদি আরবও তাদেরকে অনুসরন করতে পারে বলে আশংকছিল। আরবরা তাদের তেলের কল্যানে বৃটেনের অধিক পরিমান ডলারের রিজার্ভেশন করে রেখেছিল তা আমেরিকার অজানা ছিল না। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো আমেরিকা এই পরিমান ডলারকে স্বর্নে রিডিম করার মত স্বর্নের অধিকারি ছিল না। পরদিন আমেরিকা যা ঘোষনা করলো তা সারা বিশ্বের সাথে এক বিশাল নির্লজ্জ প্রতারনা বৈ কিছু নয়। তারা বৃটেনকে ডলারের বিনিময়ে স্বর্ন দিতে অস্বিকৃতি জানালো। এভাবেই ব্রেটেনউডস এগ্রিমেন্ট ভেঙ্গে যায়। এর পর প্রিথিবীর কোন কারেন্সিতে আর কোন অংশেই হালালের ছিটেফোটাও থাকলো না বরং সেটা একশত ভাগ খাটি হারাম কারেন্সিতে পরিনত হলো (মাওলানা ইমরানের মতে)। শুধু তাই নয় এর পরে ৯১৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত আউন্স প্রতি স্বর্নের বিনিময় মুল্য ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো যা ১৯৭৩ তে ৪০ ডলারে পৌছে যায়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরাইল ইস্যুর প্রেক্ষিতে বাদশা ফয়সল আমেরিকার বিরুদ্ধে তৈল বিক্রিতে বয়কট আরোপ করেন যার সাথে অন্যান্য আরব দেশ গুলোও যোগ দেয়। যার ফলে রাতারাতি ইউ এস ডলার ৪০০% ডিপ্রিশিয়েট করে। তখন স্বর্নের বিনিময় মুল্য প্রতি আউন্সে ৪০ থেকে বেড়ে ১৬০তে উঠে যায়। এর পর ইরানের বিপ্লবের পর যখন ইরানিরা তেলের উপর নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয় তখন আবার ১৫ই জানুয়ারি ১৯৮০ সালে একই ঘটনা ঘটে। এবারে আউন্স প্রতি স্বর্নের মুল্য গিয়ে দাঁড়ায় ৮৫০ ডলারে। এখন প্রশ্ন হলো তেলের উপর নিয়ন্ত্রন পরিবর্তনের ফলে ডলারের মান কেন পড়ে গেল? বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির বস্তাপচা ইকোনোমিক্সের থিওরি গুলো এটিকে ব্যাখ্যা করতে পারে নি কারনে এখানে কোন অর্থনোইতিক কারন ছিলনা। বরং এই সব ইকোনোমিক্সের থিওরি গুলো জনগনকে আরও দ্বিধা-দ্বন্দে ফেলে দিয়েছিল, যার কারনে এক এক জন একেক ব্যখ্যা দাড় করাচ্ছিলেন। আর সারা বিশ্বের মানুষ না বুঝেই হুউম হহুম করে মাথা নাড়ছিলো যেন তারা সব কিছু বুঝে ফেলেছে। যেমন অনেকেই বলেন যে যেহেতু স্বর্নের চাহিদা বেড়ে গেছে অন্যদিকে স্বর্নের সাপ্লাই কম সেহেতু ডলার প্রতি স্বর্নের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু এখানে দেখুন চাহিদা কেন বেড়েছে, আমেরিকা ডলারের বিনিময়ে স্বর্ন দেবার প্রতিস্রুতি দিয়ছিল যখন সেটা তারা ভঙ্গ করেছে তখন সকল দেশ তাদের কাছে গচ্ছিত ডলারের বিনিময়ে স্বর্ন দাবী করায় স্বর্নের দাম বেড়েছে। এখন দেখতে হবে সাধারন অর্থে আমরা চাহিদা ও যোগান বলতে যা বুঝাই এখানে কি সেটা হয়েছে? এখানেই অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। আপাদ দৃষ্টিতে এখানে চাহিদা জোগানের বীপরিতে বেড়েছে কিন্তু সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নয় বরং সংকট জনক পরিস্থিতিতে হয়েছে। সোজা কথায় এটা নেচারাল সাপ্লাই এন্ড ডিমান্ড নয়। যারা ইকোনোমিক্সে ল অফ ডিমান্ড এবং ল অফ সাপ্লাই পড়েছেন তারা নিশ্চই একটা জিনিস জানেন যে সেখানে বলা আছে “assuming everything else remain constant” then the natural law of demand and supply will be as so and so. এখানে কি বাকী সব কিছু আগের যায়গায় ঠিক আছে? এখানে পলিসি ব্রেক হয়েছে, প্রমিজ ব্রেক হয়েছে যা ইকোনোমিতে প্রভাব ফেলে। যার কারনে ল অফ ডিমান্ড এখানে মুল্যহীন। কিছু দিন আগে মালয়েশিয়াতে “ওয়ার্ল্ডস ফার্ষ্ট কনফারেন্স অন রিবা” শিরনামে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেখানে বিশ্ব নন্দিত সকল ইসলামি ইকোনোমিষ্টদের সমাগম হয়েছিল। ঐ কনফারেন্সে একজন স্কলার বলেছিলেন পৃথীবিতে দুই ধরনের ইকোনোমিষ্ট আছে এক ধরনের ইকোনোমিষ্ট আছে যারা জানে যে তারা কিছুই জানে না, আরেক ধরনের ইকোনোমিষ্ট যারা জানেই না যে তারা কিছুই জানে না। সে সময় আসলেই ব্যপারটা তাই দাড়িয়েছিল। একই অবস্থা এখনও চলছে। আমেরিকার অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইকোনমি, যেখানে তেলের অবদান মাত্র ৪%। শুধু তাই নয়, আমেরিকা তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভ হিসেবে পর্যাপ্ত তেলের মিজুদ রেখেছে তা সবারই জানা। তারা তাদের দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য যে তেলের প্রয়োজন হয় তা মেটানোর জন্য ওই রিজার্ভ ছিল অতিমাত্রায় যথেষ্ট। তার পরও তারা তাদের রিজার্ভকে অক্ষুন্ন রেখে অন্য দেশ থেকে তেল আমদানী করতো। কারন তাদের কাছে ডলার শুধু প্রিন্টিং প্রেসে লিফলেট ছাপানোর মত একটা মামুলি বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বলা যায় তারা কাগজের বিনিময়ে লক্ষ কোটি ব্যারেল তেল হাতিয়ে নিচ্ছিল প্রতি বছর। তাহলে কেন ডলারের মান পড়ে গেল? এর একটিই কারন আর তা এই যে সম্পুর্ন ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি সিস্টেমটা ছিল প্রতারনায় ভরপুর। তারা জানে একদিন এই মনিটরি সিষ্টেম সম্পুর্ন ভেঙ্গে পড়বে এবং তখন ডলার পুড়িয়ে ভাত রান্না করা ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। আরব বিশ্বের তেল বয়কট ও ইরানের তেলের উপর নিয়ন্ত্রনের সময় তারা ভেবেছিল সেই দিনটি বুঝি এসেই গেছে।
রিলেটেড অন্যান্য চাপ্টারব্লগ
1 comments:
খুব ভাল হয়েছে।কিন্তু আমাদের দেশে কি হবে?