২৪শে সেপ্টেম্বর সৌদি আরবে ছিল ঈদের দিন। দক্ষিণ দাম্মাম ইসলাম প্রচার অফিস থেকে আসা আমরা ৪৮ জন অবস্থান করছিলাম লোকাল হজ্জ এজেন্সি ‘আল রাজেহী’ এর তাবুতে। যার অবস্থান ছিল ৫২২/৯ মুজদালিফার শুরু এবং মিনার ঠিক শেষে, মিনার আল ওয়াদী হাসপাতালের বিপরীতে। সকাল পৌনে সাতটায় আমার কাফেলা নিয়ে বের হই জামারাতে কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে। ৫২২ নং রোড ধরে জামারাতের অভিমূখে আমরা পায়ে হেঁটে চলতে থাকি। কিছুদুর যাওয়ার পর ৫১১ নং রোডে উঠি। এই সড়কটি দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। ডান পাশের রাস্তাটি গিয়ে জামারাতের একটি প্রধান সড়ক (কিং ফাহাদ রোড) এর সাথে মিশেছে। আর বাম পাশের পথটিও জামারাতের আরেকটি প্রধান সড়কে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে। আমরা এই পথটি ধরেই অগ্রসর হয়েছি। কিছুদূর যাওয়ার পর সিড়ি বেয়ে জামারাতে যাওয়ার অন্যতম প্রধান সড়ক সূক আল আরব মহা সড়কে আমরা উঠি।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, মিনার প্রধান সড়কগুলো হলো যথাক্রমে- কিং আবদুল আজীজ সড়ক, কিং ফয়সাল সড়ক, সূক আল জাওহারাহ সড়ক, সূক আল আরব সড়ক, কিং ফাহাদ সড়ক এবং পদচারীদের জন্য বিশাল টিনসেড সড়ক ও রিং রোড। এরমধ্যে মেট্রো রেল লাইন ঘেঁষে যাওয়া কিং আবদুল আজীজ সড়কটি জামারাতের পাশ দিয়ে মক্কা পর্যন্ত চলে গেছে। আর অপর পাশের রিং রোডটিও জামারাতকে পাশে রেখে মিনার বাহিরে চলে গেছে। আর অবশিষ্ট সকল প্রধান সড়কই গিয়ে জামারাত ব্রীজে (যেখানে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়) গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে।
আমরা জামারাতের যে রোডটি ধরে অগ্রসর হয়েছি সেটা ছিল খুব সম্ভব সূক আল আরব সড়ক। সুবিশাল এই সড়ক তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে জামারাতের দিকে ছুটে চলেছেন। কিছুদুর যাওয়ার পর এই সড়কটি কোন কারণে বন্ধ থাকায় (video link: ইরানী শিয়া মিডিয়া বাদশাপূত্রের গাড়িবহরের এই ভিডিও প্রকাশ করেছে যা আপাতদৃষ্টিতে সত্য বলেই মনে হচ্ছে) দায়িত্বরত নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদেরকে ডান পাশের একটি সরু পথ ধরার নির্দেশ দিলেন। পরিকল্পনা ছিল, সেই ছোট্ট সড়কটি হয়ে কিং ফাহাদ মহাসড়কে উঠার-যেটি জামারাতে গিয়ে মিশেছে। এই রোডটি হলো দু’পাশে সারিবদ্ধ তাবুর মধ্যবর্তী পথ, যা মূলত: তাবুর লোকদের চলাচলের জন্য। স্বভাবত:ই সেই পথটি ফেলে আসা মহা সড়কের চেয়ে অনেক সরু। বিশাল সড়কভর্তি লোকগুলো যখন মহল্লার সরু পথে ডাইভার্ট হলো, তখনই শুরু হলো প্রচন্ড চাপাচাপি ও বর্ণনাতীত ভিড়। এদিকে সে সময়ের তাপমাত্রা ছিল হজ্জের যেকোন দিনের চেয়ে বেশি। ফলে অনেক হাজী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের পথ চলার গতিও শ্লথ হয়ে আসতে লাগলো। এভাবে পথ যতো এগুতে থাকে ভিড় ততই বাড়তে থাকে।
ঘটনাস্থল অর্থাৎ ২০৪নং সড়কে কৃষ্ণবর্ণের সুঠাম দেহী আফ্রিকান ও এরাবিয়ান হাজীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আর হজ্জ বা উমরায় আসা যেকোন লোকই জেনে থাকবেন- নাইজেরিয়ান, কেনিয়ান ও অন্যান্য দেশী কৃষ্ণাঙ্গ হাজীরা সাধারণত: অনেক বেশি হুড়োহুড়ি করে চলতে অভ্যস্ত। দুর্ঘটনাস্থল (২০৪ নং রোডে) তাদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়াটাও ভিড়ের ভয়াবহতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর মৃতদের মধ্যে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়া থেকেও বুঝা যায় যে এই পথে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
এই পথে ইরানী হাজীদের গ্রুপগুলোর আধিক্যও চোখে পড়ার মতো ছিল। পুরো পথে প্রায় শতকরা ৩০ জনই ছিলেন ইরানী হাজী। ইরানী হাজীদের একটি চরিত্র হলো, কখনোই তারা গ্রুপ বিহিন চলাফেরা করেন না। কোন ইরানীকে বিশেষ করে হজ্জ বা উমরার কোন কাজ সম্ভবত: কেউ একা করতে দেখেন নি। তাদের প্রতিটি গ্রুপকে ঘিরে থাকে শক্তিশালী কিছু লোক। যারা অন্যদেরকে ঠেলাঠেলি করে হলেও নিজেদের গ্রুপকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয় না। ফলে স্বাভাবিক পথ চলা অনেক সময় রুদ্ধ হয়ে যায়। মিনা ট্রাজেডির ঘটনাস্থ ২০৪নং রোডেও তাদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং যথারীতি গ্রুপ আকারে। এটিও অতিরিক্ত ভিড় সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
প্রচন্ড ভিড় ও চাপাচাপির মধ্যে আমরা চলতে থাকি। এরই মাঝে কিছু দুর্বল লোক পেছনের চাপ সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে লাগলেন। আর ভয়াবহ এই ভিড়ে দু’একজন পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তাদের আশপাশের লোকেরাও হুমড়ি খেয়ে তাদের উপরে পড়ে সেখানে পতিত মানুষের স্তূপ সৃষ্টি হয়ে যেতো লাগলো। কারণ, পেছনের মহাসড়ক থেকে আসা মানুষের স্রোতের চাপে কেউ পড়ে গেলেই পিছনের লোকেরা শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে তারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে লাগলেন পতিত লোকদের উপর। পড়ে যাওয়া মানুষের কারণে যখন আর সামনে এগুনো যাচ্ছিল না তখন আশপাশের মানুষ সর্বশক্তি দিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। পেছনের চাপে তারাও একের পর এক পড়ে যেতে লাগলেন। এভাবে একজন পড়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে তার উপর আরো বহু লোক পড়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে লাগলো। এদিকে এমন পরিস্থিতে আশপাশের সকল তাবুর গেটগুলো ছিল বন্ধ। আমরা বহু চিৎকার করে গেট খুলে পথের বৃদ্ধ ও নারীদের অন্তত ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিতে বললেও সম্ভবত: হুড়োহুড়ি সৃষ্টি হয়ে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরির ভয়ে তারা গেট খোলে নি। অপরদিকে কর্তব্যরত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এখানে হতাহতের খবর পেয়ে উদ্ধারের জন্য বিপরিত দিক থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করানোর ব্যর্থ চেষ্টা শুরু করলো। যার ফলে সামনের লোকগুলোর বের হওয়ার পথও অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেলো। আর তখনই কয়েক মিনিটের মধ্যে পেছন থেকে আসা মানুষের স্রোত থমকে যাওয়া লোকগুলোর উপর একের পর এক আছড়ে পড়তে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই রচিত হয়ে গেলো ইতিহাসের বিষাদময় ট্রাজেডিক উপাখ্যান। যারা আশপাশের তাবুর গ্রীল বেয়ে উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছেন তারাই কেবল বেঁচে ছিলেন।
আমার গ্রুপে আমি সহ মোট ৪৮ জন ছিলাম। তার মধ্যে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার সাজেদুল ইসলাম নামের দুই সন্তানের জনক এক টেক্সি ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর কুমিল্লার জসিম নামের অপর একজনের এখনো কোন খবর পাওয়া যায় নি। আর বুকের হাড় ভেঙ্গে গুরুত্বর আহত দুই জন এখনো মক্কার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়াও অনেকের হাত বা পা ভেঙ্গেছে। অনেকে বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তারা সবাই ইতিমধ্যে সেই অবস্থায়ই নিজ গন্তব্য দাম্মামে এসে পৌঁছেছেন।
লেখক: আহমাদুল্লাহ
মিনা ট্রাজেডি: নিজের চোখে যা দেখেছি + ভিডিও
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
- শহীদি প্রোফাইল সংকলণ
- তুরস্কে ব্যর্থ ক্যু: শ্বাসরুদ্ধকর একটি কালো রাত!
- বিরোধী জোটের ২০১৫ এর আন্দোলন চলাকালীন পেট্রোল বোমা হামলাকারীদের পরিচয়
- এদের চিনে রাখুন,একদিন এরাই আপনাকে ছিড়ে-খুঁড়ে খাবে
- প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও গাণিতিক বিষয় সম্পর্কিত ব্লগ সঙ্কলণ
- বিয়ে ► করণীয় ও বর্জনীয় ► (যে বিবাহে খরচ কম ও সহজ সে বিবাহই অধিক বরকতপূর্ণ)
- তুর্কি পাবলিক স্পেসে ইসলাম কীভাবে ফিরে আসছে?
- মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে
- জ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত : মানুষের উপর জ্বীনের নিয়ন্ত্রন (আছর)- বিশ্বাসযোগ্যতা, কারণ, প্রতিকার ..ইত্যাদি ইত্যাদি...
- একজন শিবির কর্মীর কথা
- কুরআন তেলাওয়াত ডাউনলোড
- ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট কারা চালায়, কেন চালায়?
- কুরআনে বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক ইঙ্গিতসমূহ
- হেফাজতের ওপর গণহত্যার ভিডিও আর্কাইভ | VDO archive of Genocide on Hefajat
- আজ কুরআন দিবস (১১-মে-১৯৮৫) : কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হবার দিন..
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
- নামায - aamzubair
- কিশোরকন্ঠ সমর্থক প্রতিবেদন ফরম - খালেদ হাসান রাফি
- Re: লিবিয়ার জনগণকে নিয়ে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের বহুমুখি খেলা - খালেদ হাসান রাফি
- Re: মিশরের ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুড: নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় - খালেদ হাসান রাফি
4344868
1 comments:
ইরানী মিডিয়ার নিউজকে শিয়া প্রপাগান্ডা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করতেছে 'সুন্নি' লেভেলধারী্রা! অন্যদিকে 'শিয়া' নামধারীরা প্রমাণসহ কারন বের করে ফেলেছে মিনা ট্রাজেডীর। রাস্তা ব্লকড ছিলো- একথা কেউই অস্বীকার করতেছেনা অথচ অপ্রাসংগিকভাবে বারবার আফ্রিকান আর ইরানী হাজীদের প্রসংগ টেনে আনতেছে। এই সুপার সেন্সেটিভ সময়ে রাস্তা কেন ব্লকড থাকবে, তার কারন বলার সাহস নাই কারো!! বাহ! রাস্তা বন্ধ ছিলো, হঠাৎ করে মূল রাস্তা ছেড়ে পাশের এক গেট খুলে দেয়া হলো - যা স্পষ্টতই হাজীদের খুন করে ফেলার জন্য যথেষ্ট... রাস্তা কেন বন্ধ ছিলো?? বাদশাজাদার গাড়ীবহরকে পথ করে দিতে! সবকিছুর ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত!!