ঠকানোর মানে যদি টাকা কম দেওয়া বুঝায়, তাহলে ইসলাম কাকে ঠকালো? পুরুষকে না নারীকে?

সম্পদ বন্টনে সবচেয়ে প্রচলিত যে কথা আছে সমাজে তা হল
“নারীরা পুরুষের অর্ধেক পায়।”
কিন্তু কয়টি ক্ষেত্রে?
মিসরের জাতীয় ফতোয়া বোর্ড কর্তৃক প্রচারিত এক ফতোয়ায় মিরাছের সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে যে বিস্ময়কর তথ্য এসেছে তার মাধ্যমে অনেকের চোখ খুলে যেতে পারে, বিবেক পেতে পারে নতুন খোরাক। ঐ পরিসংখ্যানে নারী কখন পুরুষের অর্ধেক পায়, আর কখন সমান পায়, আর কখন বেশি পায় তার বর্ণনা এসেছে অত্যন্ত পরিস্কারভাবে। লক্ষ্য করুন:


• নারী কেবলমাত্র চার অবস্থায় পুরুষের অর্ধেক পায় :
১. মেয়ে ও নাতনী(ছেলের মেয়ে) ছেলে ও নাতী (ছেলের ছেলে) থাকা অবস্থায়।
২. ছেলে সন্তান ও স্বামী বা স্ত্রী না থাকলে “মা” পিতার অর্ধেক পায় ।
৩. “সহোদরা বোন” সহোদর ভাইয়ের সাথে ওয়ারিস হলে।
৪. “বৈমাত্রেয় বোন” বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সাথে ওয়ারিস হলে।


• ১০ অবস্থায় নারী পুরুষের সমান পায় :

১.পিতা-মাতা সমান অংশ পাবে ছেলের ছেলে থাকলে।
২. বৈপিত্রেয় ভাই-বোন সব সময় সমান অংশ পায়।
৩.বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে সব ধরণের বোনেরা (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবে।
৪.শুধুমাত্র ঔরসজাত মেয়ে ও মৃতের ভাই একসাথে থাকলে উভয়ে সমান অংশ পাবে। (মেয়ে পাবে অর্ধেক আর বাকী অংশ পাবে চাচা)
৫. “নানী” বাবা ও ছেলের ছেলের সাথে সমান অংশ পায়।
৬. মা ও বৈপিত্রেয় দুই বোন স্বামী ও সহোদর ভাই এর সাথে সমান অংশ পায়।
৭. “সহোদর বোন” স্বামীর সাথে ওয়ারিস হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে। অর্থাৎ সহোদর বোনের পরিবর্তে সহোদর ভাই হলে যে অংশ পেত ঠিক সহোদরাও একই অংশ পাবে। অর্থাৎ মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে।
৮. বৈমাত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পায় যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় এক বোন এবং একজন সহোদর ভাই থাকে। এ অবস্থায় স্বামী মূল সম্পদের অর্ধেক, মা এক ষষ্ঠাংশ, বৈপিত্রেয় ভাই এক ষষ্ঠাংশ এবং বাকী এক ষষ্ঠাংশ পাবে সহোদর ভাই।
৯. নির্দিষ্ট অংশধারী ওয়ারিস এবং আসাবা সূত্রে পাওয়ার মত কেউ না থাকলে নিকটতম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়রা সমান অংশ পাবে। যেমন মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া অন্য কোন ওয়ারিস না থাকলে এদের সবাই সমান অংশ পাবে।
১০. তিন প্রকারের মহিলা এবং তিন প্রকারের পুরুষ কখনো সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয় না। এক্ষেত্রেও নারী পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করছে।



• অনেক অবস্থায় নারী পুরুষের চেয়ে বেশী পায়। যেমন,

১. স্বামী থাকা অবস্থায় একমাত্র কন্যা পাবে অর্ধেক আর স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ ।
২. দুই কন্যা স্বামীর সাথে হলে। দুই মেয়ে পাবে দুই তৃতীয়াংশ আর স্বামী এক চতুর্থাংশ।
৩. কন্যা মৃতের একাধিক ভাইয়ের সাথে হলে বেশী পাবে।
৪. যদি মৃত ব্যক্তি স্বামী, বাবা, মা ও দুই কন্যা রেখে যায় তবে দুই মেয়ে দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি মেয়ের পরিবর্তে দুই ছেলে থাকত তবে তারা নিশ্চিত ভাবে দুই মেয়ের তুলনায় কম পেত। কেননা ছেলের অংশ হলো এখানে অন্যান্য ওয়ারিসদেরকে তাদের নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যা বাকী থাকে। সুতরাং স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ, বাবা ও মা উভয়ে পাবে এক ষষ্ঠাংশ করে এবং বাকী অংশ পাবে দুই ছেলে যা দুই তৃতীয়াংশ তো নয়ই বরং অর্ধেকের চেয়েও কম।
৫. ঠিক একই ধরণের আরেকটি অবস্থা দুই সহোদর বোনের ক্ষেত্রে। যদি ওয়ারিসদের মধ্যে স্বামী, দুই সহোদর বোন এবং মা থাকে তখন দুই বোন দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ পায়। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি দুই বোনের জায়গায় দুই ভাই থাকত তখন ঐ দুই ভাই মিলে এক তৃতীয়াংশের বেশি পেত না।
৬. তেমনি ভাবে একই অবস্থায় বৈমাত্রেয় দুই বোন বৈমাত্রেয় দুই ভাইয়ের চেয়ে বেশী পায়।
৭. অনুরূপভাবে যদি ওয়ারিসদের মধ্যে স্বামী, বাবা, মা ও মেয়ে থাকে তবে মেয়ে মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় ছেলে থাকলে পেত তার চেয়ে কম। যেহেতু তার প্রাপ্যাংশ হলো অংশীদারদেরকে দেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ।
৮. ওয়ারিস যদি হয় স্বামী, মা ও এক সহোদর বোন তখন ঐ সহোদর বোন অর্ধেক সম্পদ পাবে যা তার স্থানে সহোদর ভাই হলে পেত না।
৯. ওয়ারিস যদি হয় স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় দুই বোন এবং দুই সহোদর ভাই তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় দুই বোন দুই সহোদরের চেয়ে বেশী পাবে। যেহেতু বৈপিত্রেয় বোনদ্বয় পাবে এক তৃতীয়াংশ, আর দুই সহোদর পাবে অবশিষ্টাংশ যা এক তৃতীয়াংশের চেয়েও কম।
১০. যদি স্বামী, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই থাকে সে ক্ষেত্রে বৈপিত্রেয় বোন এক তৃতীয়াংশ পাবে। অথচ এই দুই সহোদর অবশিষ্টাংশ থেকে যা পাবে তা ঐ বোনের এক চতুর্থাংশেরও কম।
১১. ওয়ারিস যদি হয় বাবা, মা ও স্বামী এ ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস (রা) এর মত অনুসারে মা পাবে এক তৃতীয়াংশ, আর বাবা পাবে এক ষষ্ঠাংশ অর্থাৎ মায়ের অর্ধেক।
১২. স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই ওয়ারিস হলে এক্ষেত্রে ঐ বোন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পাবে।



• অনেক সময় নারী মিরাছ পায় কিন্তু তার সমমানের পুরুষ বঞ্চিত হয় । যেমন,

১. ওয়ারিস যদি হয় স্বামী, বাবা, মা, মেয়ে ও নাতনী (ছেলের মেয়ে) এক্ষেত্রে নাতনী এক ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ একই অবস্থায় যদি নাতনীর পরিবর্তে নাতী (ছেলের ছেলে) থাকত তখন এই নাতী কিছুই পেত না। যেহেতু নির্ধারিত অংশীদারদেরকে দিয়ে অবশিষ্টাংশই তার প্রাপ্য ছিলো। অথচ এ অবস্থায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই তার প্রাপ্তির খাতাও থাকে শূন্য ।
২. স্বামী, সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় বৈমাত্রেয় বোন এক ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ তার স্থানে যদি বৈমাত্রেয় ভাই থাকতো তবে সে কিছুই পেত না, যেহেতু তার জন্য নির্ধারিত অংশ নেই।
৩. অনেক সময় দাদী মিরাছ পায়, কিন্তু দাদা বঞ্চিত হয়।
৪. মৃত ব্যক্তির যদি শুধুমাত্র নানা ও নানীই ওয়ারিস হিসেবে থাকে তখন সব সম্পত্তি পাবে নানী। নানা কোন কিছুই পাবে না।
এরপরও কি বলা হবে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে?

দেখলাম সব ক্ষেত্রেই নারীরা কিছু না কিছু পায়, আর একটি ক্ষেত্রে দেখলাম পুরুষরা সম্পূর্ন বঞ্ছিত হয়।
এই আলোচনা মিশরের এক শিক্ষক দেওয়ার সময় এক ছাত্র বলেই ফেলল , ইসলাম পুরুষদের ঠকিয়েছে!!!
আর একটি ক্ষেত্রে দেখলাম নারীরা অর্ধেক পায়, আর এটিই নিয়েই বহু কথা।


ইসলাম যে পরিবারের কথা বলে ঐখানে পুরুষদের ফরয করে দেওয়া হয়েছে পরিবারের অর্থনৈতিক দ্বায়িত্ব নেয়া। স্ত্রীকে এই দ্বায়িত্ব মোটেই দেয়া হয়নি। স্ত্রী যেখান থেকেই টাকা পাক সেটি একান্ত তারই। ইচ্ছা মত খরচ করার স্বাধীনতা তার আছে ।
খৃষ্টান ধর্মের একটি সেক্ট যারা ওসমানি খেলাফতের সময় বর্তমান তুর্কির উপরের দিকে ছিল তারাও স্ত্রীদের ক্ষেত্রে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করত। কিন্তু সম্পদ বন্টনের বেলায় তারা কিছু দিত না নারীদের। তাদের যুক্তি ছিল, আমাদের সিস্টেমে পুরুষদের সব অর্থনৈতিক দ্বায়িত্ব পালন করতে হয়, নারীদের কোন যুক্তিতে অর্থ দরকার। তাদের যেটা দরকার সেটা তো স্বামীর কাছেই পাবে। তাই তারা কোন ভাগই দিত না সম্পদে। পরে ওসমানি শাসকরা যেটি করে সেটি ইসলাম মোটেই সমর্থন করেনা। তারা ইসলামি আইন তাদের উপর চাপিয়ে দেয় এই ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সম্পদের নারীরা পুরুষের অর্ধেক পাবে। মানতে পারেনি তৎকালীন খৃষ্টান নেতারা। তারা চালাকি করল। মারা যাওয়ার আগে সম্পদের সিংহ ভাগ নানা ভাবে তাদের ছেলেদের দিয়ে দিত। আর কিছু রেখে যেত। আর তা থেকে নারীরা পুরুষের অর্ধেক পেত।


এখন একটু অংক কষি। ধরা যাক এক লোকের মোট ৩ লাখ টাকা সম্পদ। তার এক ছেলে আহমেদ আর এক মেয়ে সালমা। তিনি মারা যাওয়ার পর সম্পদের বন্টন হল (ধরে নিলাম লোকটি আর কোন আত্নীয় নেই)। আহমেদ পেল ২ লাখ আর সালমা পেল ১ লাখ ইসলামি রীতি অনুযায়ী।

সালামার বিয়ে ঠিক হল। মোহরানা হিসেবে সে পেল ধরেন ৫০,০০০ টাকা। এখন সালমার সম্পত্তি দেড় লাখ। আর তার এই সম্পত্তিতে সালমার স্বামীর কোন অধিকার নাই। সালমা একান্ত স্বাধীন এই সম্পদের ব্যাপারে। আর বিবাহের পর সালমার পুরা দ্বায়িত্ব তার স্বামীর উপর। এমনকি সালামার বাপের বাড়ি থেকে কোন মেহমান আসলে তাকেও খাওয়াতে হবে সালমার স্বামীর।

ঐদিকে আহমেদের বিয়েও ঠিক হল কিছু দিন পর। সেও তার স্ত্রীকে মোহরানা হিসেবে একই টাকা দিল ধরেন। ৫০,০০০ টাকা। (আরও বেশি হতে পারত)। এখন তার সম্পত্তি দাড়াল দেড় লাখ টাকা। এখানেই তার শেষ নয় এখন নতুন সংসারের জন্য যা খরচ তার পুরা দ্বায়িত্ব তার উপর। আর তার স্ত্রীর টাকা থাকা সত্বেও তার কোন অধিকার নেই ওই টাকা নিয়ে পরিবারের কাজে লাগান।
এখন ঠকানোর মানে যদি টাকা কম দেওয়া বুঝায়, তাহলে ইসলাম কাকে ঠকালো পুরুষকে না নারীকে?

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম