যুদ্ধ

রাইটার :
রেহনুমা বিনত আনিস 


“আপা আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি আপনাকে পাগলের মত খুঁজছি!” পেছন ফিরে গলার অধিকারীকে দেখে চিনতে অনেক বেগ পেতে হোল। শায়লা ভাবী না? এ কি অবস্থা ওনার? বিধ্বস্ত চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, ওনার ট্রেডমার্ক হাসিটাও মিসিং। দুষ্টুমী করে বললাম, “কি ব্যাপার ভাবী? আপনি কি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গেছিলেন নাকি? আপনাকে তো চিনতেই পারছিনা! তা বলুন, আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি?”



শায়লা ভাবীকে আমার খুব ভালো লাগে। বিশাল বড়লোকের বৌ হয়েও ওনার মধ্যে কখনো কোন অহংকারের ছায়া পর্যন্ত দেখিনি, আমাদের চেয়েও সাধারণভাবে চলেন, নিজেই বাচ্চাদের রিক্সায় করে স্কুলে আনা নেয়া করেন। আমার হাত খুবলে ধরে বললেন, “আপা, আমাকে একটু সময় দেন, আমি আপনার বাসায় আসব”। অ্যাঁ! বলে কি? এত বড়লোক মানুষকে আমি কি দিয়ে অপ্যায়ন করব? আমার তো রান্নাঘর পর্যন্ত নেই- নিজেই খাই শ্বাশুড়ী আম্মার দয়ায়! যাই হোক। বললাম, “ভাবী, আমি বাসায় থাকার সুযোগ পাই খুব কম, আজকে তিনটা থেকে চারটা এক ঘন্টা বাসায় থাকব। আপনি আসতে পারেন কিন্তু দেরী করলে আমি সময় দিতে পারবনা”। উনি বললেন, “আমি আসব”। ওনার কথাবার্তা, চেহারায় একধরণের desperation দেখলাম। কিন্তু স্কুল ছুটির সময়, বাচ্চা আর বাবামাদের গিজগিজে ভীড়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না।





ঠিক তিনটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে ভাবী এসে উপস্থিত। আমি তখনও আম্মার বাসায়, ভাত খাচ্ছি। হাতে সময় কম, তাই বাচ্চাকে ওর দাদুর বাসায় রেখে শায়লা ভাবীকে আমার দু’কামরার ফ্ল্যাটে নিয়ে বসলাম। উনি কোন ভনিতা না করেই কথা শুরু করলেন, “আপা, আমি আমার বাবামা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব কারো কাছে না গিয়ে আপনার কাছে এসেছি, আপনি প্লীজ আমাকে ফেরাবেন না। আমি শুনেছি আপনি লোকজনকে পরামর্শ দেন। আমি কোন রাখঢাক না করেই আপনাকে আমার সমস্যার কথা খুলে বলব, প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন”।

বলতে যাচ্ছিলাম, “আমি কবে থেকে পরামর্শদাত্রী হলাম?” কিন্তু উনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলতে শুরু করলেন, “আপনি হয়ত জানেন আমি আর আমার স্বামী দু’জনই খুব সাধারণ পরিবার থেকে এসেছি। প্রথমদিকে আমরা তেমন একটা সচ্ছল ছিলাম না। পরে ও একটা ব্যবসার সন্ধান পায়। ব্যবসা শুরু করার মত পুঁজি ছিলোনা। তখন আমি বাবামা শ্বশুরশ্বাশুড়ী সবার উপদেশ উপেক্ষা করে আমার সমস্ত স্বর্ণ বিক্রি করে সেই টাকা ওর হাতে তুলে দেই। দিনে দিনে আমাদের ব্যবসা জমে উঠতে শুরু করে। সে চাকরী ছেড়ে দেয়, নিজের কোম্পানী খোলে। একসময় আমরা ভালো বাড়ী তৈরী করে, ভালো গাড়ী কিনে এমন এক জীবন গড়ে তুলি যার স্বপ্ন আমরা দু’জনে মিলে দেখেছিলাম। বাচ্চারা প্রাচুর্যের মাঝে বড় হতে থাকে। আমি আমার শেকড়ের কাছাকাছি থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু আমার মনে হতে থাকে কোথায় যেন আমার স্বামী সাদাতের শেকড়টা আলগা হতে শুরু করে। কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছিলাম সে কাজে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে কখনো কখনো সারারাত বাসায় আসেনা। যখন আসে তখন এত ক্লান্ত থাকে যে আমাকে সময় দেয়ার মত মুড থাকেনা। প্রথম প্রথম আমি একে কাজের চাপ মনে করলেও একসময় ওর আচরণে আমার সন্দেহ হতে শুরু করে। পরে একদিন ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে কিরা-কসম কেটে শক্ত করে ধরার পর উনি বলেন, ‘ভাবী, আপনি কি কিছুই বুঝতে পারেন না? যে আগুনে সুন্দরী যুবতি সেক্রেটারীকে আপনার স্বামী সর্বত্র নিয়ে যান, উনি তার প্রেমে পড়েছেন। সাহেব তাকে বিয়ে করতে চান। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। ওনাকে বুঝাতে গেলে চাকরী যাবার ভয় দেখান। আপনাকে বলেছি জানলে কি করবেন কে জানে! ভাবী, উনি ভালো মানুষ। কিন্তু এখন উনি মোহগ্রস্ত। আপনি তাঁকে ফেরান’। আপা, আমার মনে হোল আমার পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেছে, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। একবার ভাবলাম সংসারের মুখে লাথি দিয়ে বাচ্চা দু’টো নিয়ে চলে যাই। কিন্তু আপা, আমার পরিবারের আমাকে দু’বাচ্চাসহ প্রতিপালন করার সামর্থ্য নেই। এতবছর আমি কোন চাকরীবাকরী করিনি, লেখাপড়া থেকেও বিচ্ছিন্ন- বিশ্বাস করুন আমি মনে হয় অ আ পর্যন্ত ভুলে গেছি! আমি বাচ্চা দু’টোকে কিভাবে বড় করব? আমি তাদের আমার মত সাধারণভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। ওরা হয়ত অনেক কষ্ট করতে পারবে। কিন্তু ওদের যে পরিমাণ কষ্ট করতে হবে তা চিন্তা করলে আমার বুক ফেটে যায়। আবার ভাবি, আমার এত বছরের সংসার আমি বিনাযুদ্ধে ছেড়ে দেব?! কিন্তু আপা, আমার যে কোন যোগ্যতাই নেই! যৌবনও যায় যায়। কি দিয়ে লড়ব আমি?”

একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে উনি হঠাৎ তন্ময় হয়ে পড়লেন। আম্মার বুয়া এসে নাস্তা দিয়ে গেল। অপদার্থ বৌদের শ্বাশুড়ীদের অনেক জ্বালা। আমি নাস্তার কথা বলতে ভুলে গেছি বলে তাঁকেই মনে করে পাঠাতে হোল। শায়লা ভাবী নাস্তার দিকে দৃকপাত না করে বললেন, “আপা, আমার নাওয়াখাওয়া উঠে গেছে। আপনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন”। আমি চুপ করে রইলাম। উনি আবার বললেন, “আপা, আমি আপনার সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছি, আপনি আমাকে পরামর্শ দিন”। আমি বললাম, “আপা, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবনা”। ওনার মুখটা অজান্তেই হা হয়ে গেল, “আপা, আপনি আমাকে এভাবে মুখের ওপর না করতে পারেন না!”



আমি উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। বাইরে প্রচন্ড রোদ, আকাশে একখন্ড মেঘ তার মাঝে ছায়া সৃষ্টি করে আছে। সেই ছায়া গিয়ে পড়েছে মাটিতে যেখানে ঘন সবুজ নারকেল বাগানের মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে আমগাছ বা কাঁঠালগাছের মাথা। আহা! আমি যদি ঐ মেঘখন্ডের মত এই সবুজমনা নারীকে ছায়া দিতে পারতাম জীবনের খর বাস্তবতা হতে! ফিরে এলাম ভাবীর সামনে। বললাম, “ভাবী, আমি আসলেই আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবনা। তবে যিনি পারবেন তার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারব। আপনার সমস্যার সমাধান আছে। কিন্তু তার জন্য সময় আর শ্রম দিতে হবে”।

বেচারীর চেহারাটা হঠাৎ আশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। উনি বললেন, “আমি যার কাছে যেতে বলবেন যাব, যা করতে বলবেন করব, শুধু আপনি আমাকে পথ দেখান”। আমি বললাম, “ঠিক তো?”

উনি বললেন, “পাক্কা ওয়াদা। সাদাতের সাথে সংসার করা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু আমি আমার সন্তানদের জন্য যা করতে হয় সব করব”।



শায়লা ভাবীর চোখে চোখ রেখে বললাম, “ভাবী, আপনি আপনার স্বপ্নের পথ ধরে বহুদুর এগিয়েছেন, স্বামীর জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছেন, সন্তানদের জন্য বাকীটাও উজার করে দিতে রাজী আছেন, কিন্তু পথের কোন একখানে আপনি আপনার সের্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর হাত ছেড়ে দিয়েছেন, তার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। আপনাকে সবার আগে সেই সম্পর্ক পুণর্গঠন করে তুলতে হবে কারণ সে ছাড়া আর কেউ আপনাকে উদ্ধার করতে পারবেনা”।

উনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “আপা, আমি তো লোকজনের সাথে যদ্দুর পারি যোগাযোগ রাখি। আপনি কার কথা বলছেন আমি তো বুঝতে পারছিনা!”

আমি হেসে বললাম, “আপনি তার সাথে যোগাযোগ না করতে করতে তার নামও ভুলে গেছেন! ভাবী, দায়িত্বের খাতিরে নয়, আল্লাহকে ভালোবেসে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে নামাজ পড়েছেন কবে মনে আছে? অর্থসহ কুর’আন পড়ে আপনাকে কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বসে পাঁচমিনিট ভাবার চেষ্টা করেছেন কতবছর হোল? কিছু চাইবার জন্য নয়, বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য আল্লাহর সামনে হাত তুলেছেন কবে মনে পড়ে? আপনি যদি তার ডাকে সাড়া না দেন, আপনার বিপদেও সে গড়িমসি করবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? আমি আপনাকে এতদিন পর একঘন্টা সময় দিলাম আর আপনি পাঁচমিনিট আগেই ছুটে এলেন। অথচ যে আপনার কথা শোনার জন্য, আপনাকে দেবার জন্য উপহারের ডালি সাজিয়ে বসে আছে কে জানে কত বছর তার সাথে কথা বলার আপনার ফুরসতই মেলেনা!” ভাবী চোখ নামিয়ে নিলেন।

বললাম, “ভাবী, আমার কথায় কষ্ট পেয়েন না। আপনি পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ রেগুলার করে ফেলুন। সাতদিন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে, কুর’আন পড়ে, আল্লাহর সাথে পরামর্শ করুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানান আপনি কি করতে চান। সংসার করবেন, নাকি চলে যাবেন? আপনি যে পথ বেছে নেবেন সেভাবেই আমি আপনাকে পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ”।



শায়লা ভাবী চলে গেলেন।





সাতদিন পর উনি এসে বললেন, “আপা, আমার মনে কেমন যেন একটা স্বস্তি আর সাহস এসেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা উটকো মহিলা এসে আমার সন্তানদের অধিকার কেড়ে নিয়ে যাবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব তা হবেনা। আমি লড়ব। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। আপনি আমাকে বলুন কিভাবে কি করব”।

বললাম, “ভাবী, আপনাকে কিছু কড়া সত্য কথা বলব, আপনি সহ্য করতে পারবেন তো? নইলে আপনি এখনই চলে যেতে পারেন”। উনি বললেন, “কি যে বলেন আপা! যে মহিলার স্বামী অন্য মহিলা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার কি রাগ ঘেন্না বাকী আছে? আপনি তো আমার ভালোর জন্য ক’টা কড়া কথা হলেও বলছেন, সে তো সেটুকুও আমার জন্য করছেনা!”

উচিত কথা বলা থেকে নিজেকে কখনই বিরত রাখতে পারিনি যদিও বুঝি তা আমার জন্য কতখানি অনুচিত। আজও প্রবৃত্তির কাছে হার মানলাম। ক’খানা কটু কথা বলারই সিদ্ধান্ত নিলাম, “ভাবী। বিয়ের সময় একটা ছেলে আর একটা মেয়ের শিক্ষাগত এবং অন্যান্য যোগ্যতা আনুপাতিক কি’না দেখেই বিয়ে দেয়া হয়। তারপরে কি হয় জানেন? ছেলেটা উত্তরোত্তর উন্নতি করতে থাকে, তার পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে, তার জ্ঞান বাড়তে থাকে। আর মেয়েটা? সে সংসার করতে করতে জীবনের যে মূল লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন করা সেটাই ভুলে যায়। তার পৃথিবী একসময় রান্নাবান্না, ধোয়াপালা, বাচ্চা সামলানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় নতুবা আটকে যায় টেলিভিশনের পর্দায় যা তার মেধার বিকাশে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনা। আমি বলছিনা মহিলাদের চাকরী করতে হবে বা তারা ঘরের কাজ করবেনা। কিন্তু দৈনিক অন্তত একটি ঘন্টা সময় তো নিজের জন্য ব্যায় করা যায়, হোকনা সে দুপুরের ঘুম বাদ দিয়ে বা যেকোন একটি কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ আগামী দিনের জন্য বাকী রেখে। কার্যত দেখা যায় মহিলারা নামাজ পড়ার পর্যন্ত সময় পান না, লেখাপড়া না করতে করতে বাচ্চাদের সামান্য প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও বলেন, ‘আব্বুকে জিজ্ঞেস কর’। সংসারের ব্যাস্ততায় আমাদের মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে সুতরাং ঐদিক দিয়েও ভদ্রলোক কোন সুবিধা করতে পারেন না। এই বৌয়ের সাথে কথা বলে তখন স্বামী আর মজা পাননা, তার মন চলে যায় বাইরে, বন্ধুবান্ধবের আড্ডায়। আমরা বাইরে যাবার সময় সেজেগুজে যাই অথচ বাসায় বুয়ার মত হয়ে থাকি, সুতরাং, স্বামী ভদ্রলোক হলে অসন্তুষ্টির সাথে মেনে নেন আর তাঁর আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব থাকলে দৃষ্টি হয়ে যায় বহির্মুখী। সেই লোক যদি বাইরে এমন কোন মহিলার সন্ধান পান যে এই উভয়প্রকার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম এবং আগ্রহী তখন তাকে বিয়ে নামক সম্পর্কের দলিল দিয়ে আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ভাবী, আমরা মানুষ। তাই খুব সহজেই ভুলে যাই সে সঙ্গীর কথা যে তার জীবন যৌবন আমাদের উন্নতির পেছনে ব্যায় করে নিজে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সবসময় নিজের স্বার্থটাই চিন্তা করি আর স্বার্থ চিন্তায় বর্তমানে কি পাইনি তা ছাড়া অন্য কিছু আমাদের নজরের সামনে আসেনা। যার আল্লাহর ভয় আছে সে নাহয় জবাবদিহিতার ভয়ে নিজের প্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু যার সে চিন্তা নেই সে কি দিয়ে নিজকে আটকাবে বলুন তো? আরেকজনকে সংশোধন করা আমাদের সাধ্যের অতীত। আমরা কেবল নিজেকেই সংশোধন করতে পারি। সুতরাং, চলুন আগে নিজের দিকে যথাসম্ভব উন্নয়নের চেষ্টা করি। ভেবে দেখুন, আপনার কাছে যে গুণগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো সাদাত ভাই নিজের মধ্যে সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে আপন কত খুশী হবেন। একইভাবে চিন্তা করে দেখুন আপনার স্বামীর কাছে কোন জিনিসগুলো আকর্ষণীয় বা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেসব ব্যাপারে আপনার দক্ষতা সৃষ্টির চেষ্টা করুন। আপনি আমার সাথে একদিন বের হবেন। আমি আপনাকে ইংরেজী কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেব। আরেকদিন বের হব আপনার জন্য ভালো জামাকাপড় কিনতে- আপনি বাসায় সবসময় ফিটফাট হয়ে থাকবেন। প্রতিদিন অন্তত একঘন্টা আপনি বিভিন্ন সাধারন জ্ঞানবর্ধক বই পড়বেন এবং বাচ্চাদের সাথে এগুলো শেয়ার করবেন। আজ থেকে হিন্দি সিরিয়াল টাটা বাই বাই। Discovery, History বা National Geographic চ্যানেল দেখবেন। এতে ইংরেজীও শেখা হবে, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা সম্পর্কে জানারও সুযোগ হবে। সবচেয়ে বড় কথা আপনার হাতে প্রচুর পরিমাণ সময় আসবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। কি, রাজী?”



শায়লা ভাবী প্রচন্ড আগ্রহ আর উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে।





কয়েকমাস পর দেখা গেল তিনি বিবিধ বিষয়ে অনর্গল আলাপ করতে পারছেন, ইংরেজীতে কথা বলতে বা বুঝতে তাঁর কোন অসুবিধা হচ্ছেনা বিধায় স্বামী অপর মহিলার সাথে ব্যাবসায়িক আলাপের ভান করে গোপন আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাঁর কথাবার্তা চেহারা পোশাক পরিচ্ছদে রুচি ও শালীনতার বহিঃপ্রকাশ তার স্বামীকে মোহিত করে তুলল, তিনি আগে যে কাজ সারাদিনে করতেন তা এখন কৌশল প্রয়োগ করে কয়েকঘন্টায় করতে পারছেন ফলে বাচ্চাদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তিনি সময় দিতে পারছেন- কিন্ত সবচেয়ে বড় কথা সাদাত ভাই শায়লা ভাবীর আচরণে এমন এক আত্মবিশ্বাস দেখতে পেলেন যে তাঁকে ছেড়ে দেয়ার চিন্তার পরিবর্তে শায়লা ভাবীই তাকে ছেড়ে যাবেন কি’না সেই চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। স্ত্রী এবং সেক্রেটারীর মধ্যে তুলনা করে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দু’জনের মধ্যে কে শ্রেয়। একসময় তিনি নিজেই সেক্রেটারীকে বাদ দিয়ে স্ত্রীর প্রতি ঝুঁকে পড়লেন।



ছ’মাস পর ভাবী একদিন বাসায় দাওয়াত দিলেন। ভদ্রলোকেরা ড্রইং রুমে কথা বলতে বলতে আমরা রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে খাবার বাড়তে বাড়তে গল্প করতে লাগলাম। ভাবীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাবী, এখন কি অবস্থা?”

শায়লা ভাবী হাতে ভাতের চামচের অস্তিত্ব ভুলে গেলেন, তন্ময় হয়ে বলতে লাগলেন, “আপা, একসময় মনে হত আমি সাদাতকে ছাড়া কি করে বাঁচব? আমার বাচ্চাদের কি হবে? এখন বুঝি আমাদের দেখাশোনার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, সাদাত তো কেবল একটা মাধ্যম। সে যখন বুঝতে পারল আমি এখন আর ওর ওপর dependent নই তখন সে আমাকে আর বাচ্চাদের আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরল। ঐ মহিলা বিদায় হয়েছে তিনমাস আগে। সাদাত নিজেই তাকে বিদায় করেছে। এখন তো সে ঘর ছেড়ে এক পাও নড়তে চায়না, আমার পরামর্শ ছাড়া কিছুই করেনা, বাচ্চাদের প্রচুর সময় দেয়- কিন্তু কি জানেন? আমি এখন যুদ্ধক্লান্ত। আল্লাহর অসীম সাহায্যে আমি জিতেছি, এই বোধ ছাড়া আর কোন বোধ এখন আর আমাকে স্পর্শ করেনা …”



তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও হারিয়ে গেলাম সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মেঘমালার মাঝে যা আনন্দে ঝরঝর গেয়ে ওঠা বৃষ্টির বার্তা নিয়ে আসে…

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম