স্মৃতিচারন ও কিছু কথা

প্রথম প্রথম যখন পাকিস্তান আসি তখন এক কাশ্মিরী বড় ভাইকে খুব গর্বভরে বাংলাদেশের গল্প শুনাচ্ছিলাম। বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে অনেক বড় বড় কথা। উনিও খুব মজা নিয়ে শুনছিলেন। একপর্যায়ে উনি জিজ্ঞসা করে বসলেন, ‘তোমরা নিজেদের কি ভাব? প্রথমে বাংলাদেশি পরে মুসলমান নাকি প্রথমে মুসলমান পরে বাংলাদেশি?’ আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘অবশ্যই প্রথমে বাংলাদেশি পরে মুসলমান’।



আজ প্রায় তিন বছর পর উনার প্রশ্ন টা আবার মনে পরে গেল। জীবন অনেক বড় একটা চক্রের মত। ঘুরে ফিরে অনেক কিছুই নতুন করে ফিরে আসে। আমার জীবনের শুরুটা সাধারন একটি মুসলিম পরিবারে। আমি আমার দাদাভাই এর মারাত্তক ভক্ত ছিলাম। উনি আমাকে অনেক গল্প শুনাতেন। উনাকে পছন্দ করার অনেকগুলো কারনের মধ্যে এটি অন্যতম। উনি প্রথম জীবনে ততোটা ধার্মিক ছিলেন না। তবে শেষ জিবনে তার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। এখনো স্পস্ট চোখের সামনে ভাসে ঐ দিনটির কথা। আমি উনার সাথে নামায পরে মসজিদ থেকে বের হয়ে এসেছি। উনি বললেন, ‘দেখ অপু, নামায পরলে মনের মাঝে কত শান্তি আসে’। আমি তখন নামাযের সাথে শান্তির বেপারটা ভালোকরে না বুঝলেও উনার চেহারা দেখে ঠিকই প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। উনি আমাকে অনেক কাহিনি শুনাতেন, তবে বেশিরভাগই নবী রাসুলদের কাহিনি, আরো শুনাতেন বাংলার খাটি উপকথা- রুপভান আর বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনি, আজো স্পস্ট মনে পরে সেই অসহায় মেয়েটির কথা যে নাকি পানিতে নেমে আর উঠতে পারেনি। শিতের রাতে তার আঞ্চলিক ভাষায় গল্প শুনার প্রবল একটা আকর্ষন কাজ করতো আমার মাঝে।



তার ঐ গল্পগুলো আমার শৈশবে অনেক প্রভাব বিস্তার করেছিল আর সেই জন্যই হয়ত যখন আমি ক্যাডেট কলেজের বিশাল লাইব্রেরীটা পেলাম, তখন আর দেরি করি নি। সাহিত্য আর ধর্ম সম্পর্কে যা পেলাম তাই পড়া শুরু করে দিলাম। বাংলা সাহিত্যের আগাগোরা শেষ করে ফেললাম। শুরু বঙ্কিমচন্দ্র দিয়ে আর শেষ হুমায়ুন আহমেদ দিয়ে। ধর্ম সম্পর্কেও কিছুই বাদ দিলাম না। কুরআন এর অর্থসহ তরজমা, সহিহ মুসলিম, সহিহ বুখারি, তিরমিযী, আরো পড়লাম ধর্মের উতপত্তি আর এর বিকাশ ও আরো অনেক বই। ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারনাটা মোটামুটি পরিস্কার তখন। আমি নামায পরা শুরু করলাম, আরো অনেক নফল ইবাদত ও করতাম তখন। ইমাম গাযযালির লেখা কিমিয়ায়ে সাআদাত বইটার কথা এখনো মনে পরে। ওটা পরে কিছুদিন আমার মাথা আউলাইয়া গেছিল। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে ওটা আমার জন্য লেখা না। যাই হোক, আমি তখন আগাগোরা মুসলিম আবার কবিও। বাংলায় কবিতা লেখার একটা অভ্যাস ও তখন গড়ে উঠেছিল। এই আমি একসময় কবিও ছিলাম, ভাবতেই অবাক লাগে এখন। আর আমাদের কলেজের বাংলা ডিপার্টমেন্টের তখন স্বর্নযুগ চলছিল। আমাদের শিক্ষকরা তাদের দ্বায়িত্ত অসাধারনভাবে পালন করেছিলেন। কারন নবম-দশম শ্রেনীর এক বালক হয়েও আমরা স্বকীয়তা, মনুষ্যত্ত, বিবেকবোধ, স্বাধীনতার সত্যিকারের অর্থ ধরতে পেরেছিলাম। আর আমার মধ্যে একটা দ্যৈত স্বত্তা কাজ করতো তখন। আমি মনে করতাম ধর্মও আমাদের এগুলোই শিক্ষা দেয় যদিও তা একটু ভিন্ন আংগিকে।



ইসলামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগির সাথে আমার তখনই পরিচয় হয়- আমারই কলেজের এক বড় ভাই এর মাধ্যমে। সত্যিকথা বলতে কি আমি একটু গোয়ার ধরনের ছোটবেলা থেকেই। তাই যখনি কেউ আমাকে কিছু বলে আমি তা যাচাই করে দেখতে চাই। আল্লাহর কাছে আজ আমি অনেক কৃতজ্ঞ যে উনি আমাক এভাবে তৈরি করেছেন। আর অন্ধভাবে কোন কিছু বিশ্বাস করাকে আমি ঘৃনা করি। তাই যখন দেখলাম যে অই রাজনৈতিক দলটির আসল উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতার লোভ তখন আমি তাদের থেকে দূরে সরে আসি। ঐদিন আমার কলেজের সেই বড় ভাইকেও আমি হতাশ করে দিয়েছিলাম। উনিও মেনে নেন যে আসলে ওদের পথটা সঠিক নয়।



তবে বিপত্তির শুরু এখানে নয়। শুরু একটি মেয়ে কে কেন্দ্র করে। বয়সে আমি তখন তরুন, তারুন্যের ডানা মেলে আকাশে উড়ছি। পাশের বাসার মেয়েটিকে কোন কারন ছাড়াই অনেক বেশি ভাল লাগতে লাগল। মনের মাঝে কি এক বিচিত্র টান অনুভব করা শুরু করলাম তার জন্য। দীর্ঘ চার মাস অপেক্ষায় থাকতাম, কবে তাকে একটু দেখব! গ্রীস্মের ছুটি যেন আর হতে চায় না। ইসলামিক মুল্যবোধ সম্পন্ন কবির মনে দোটানা চলতে লাগলো। আমি তখন ঠিকই জানতাম যে ইসলামে বিয়ের পুর্বে প্রেম হারাম। কিন্তু মন মানে কই? আমি পরাজিত হলাম আমার লাগামহীন ভালবাসার কাছে। ভালোবাসলাম, আল্লাহর কাছে দুআ করতে লাগলাম ভালবাসার মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু, আল্লাহ আমার জন্যে যে আর অনেক ভাল কিছু রেখেছিলেন তা বুঝতে পারলাম না। শয়তান তার পথে আমাকে চলতে প্ররোচিত করে বিপথগামী করল। চিরাচরিত সত্যরূপে আমি ব্যর্থ হলাম। ব্যর্থ প্রেমিকের অসহায় যাতনা অনুভব করতে লাগলাম। আর অনেক বেশি কবিতা বের হতে লাগলো আমার কলম থেকে। ফলাফল- শয়তানের সাফল্য শতভাগ, আর আমি নামায রোযা ছেড়ে ব্যর্থ প্রেমিকের খোলসে আবৃত হলাম।



দ্বাদশ শ্রেনী পাস করে যখন বেরিয়ে আসলাম, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সবাই অস্বাভাবিক এক প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ন হতে চলেছে। সে এক বিশাল যুদ্ধ। আর আমি ব্যর্থ প্রেমের যাতনা বুকে নিয়ে সিগারেট ফুকি আর অন্যদের কোচিং এ আসা যাওয়া দেখি। কতগুলো কোচিং এ নাম লিখিয়ে ক্যাডেট হওয়ার কারনে বিনামুল্যে যে গাইড বই গুলা পেলাম ওগুলোও নীলক্ষেতে বিক্রি করে দিলাম। ভাবলাম এসব আমাকে দিয়ে হবে না। সশস্ত্র বাহিনীতে ভরতির কোচিং এ গিয়েও একটা কাজই করতাম- আড্ডাবাজি।



সশস্ত্র বাহিনীতে যাওয়ার আমার তেমন কোন ইচ্ছা ছিলো না কখনোই। ক্যাডেট কলেজে ডিসিপ্লিনের দিক দিয়ে আমি কখনোই তেমন ভালো ছিলাম না, আর আমার এরকম ডিসিপ্লিন পছন্দও ছিলো না। তবে এ বেপারে আমার বাবা-মার উতসাহে কোন ঘাটতি ছিলো না। যাই হোক আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। তেমন কোন প্রস্ততি ছাড়াই আই এস এস বি তে বিমান বাহিনীতে চান্স পেয়ে গেলাম। যদিও অনেক জোগ্য আর ভাল প্রস্তুতিসম্পন্ন প্রার্থীরা বাদ পড়ল (এই ভরতি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আজো আমার যথেস্ট সন্দেহ বিদ্যমান)।

যাই হোক, যেহেতু পড়াশোনায় আমার আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না, তাই ভাবলাম বেপার না, যাই বিমান বাহিনীতে। যা হবার হবে। বাসায় বাবা-মার হাস্যোজ্জল মুখ দেখে অনেকটা তৃপ্তিও পেলাম। কোনরকম ভর্তি যুদ্ধে আর অবতীর্ন হতে হবে না এটাও আমাকে অনেকটা স্বস্তি দিল। এখনো মনে পরে সেই দিনটির কথা- প্রথম যেদিন ব্যাগ গুছিয়ে এয়ার ফোর্স একাডেমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি!! বেশ সুখিই ছিলাম তখন।



একাডেমির জীবন স্বম্পর্কে তেমন কিছু বলার নাই। কারন এটা ক্যাডেট কলেজেরই আরেকটি ভার্সন। তবে এই সময়টা আমার কাছে অনেক গুরুত্ত্বপুর্ন। কারন তখন আমার জীবন সম্পর্কে ধারনা পালটে যেতে থাকে। আমার কাছে মনে হতে থাকে জীবন তো একটাই। একে এই খাচায় পুরে শেষ করার কি মানে? তখন অনেক স্যারের (সিনিয়র ক্যাডেট) সাথে আমার এই নিয়ে আমার কথা হত। সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আমার কাছে ধোয়াটে মনে হতে থাকে। আমাদের একটা মটো ছিলো- “বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত”। আর একাডেমির মটো ছিলো- “Sky is our limit”। এই মটো টা ইংরেজিতে ছিল। যাই হোক, ট্রেনিং করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পরতাম অথবা একটু অবসর পেতাম, তখনই একটা চিন্তা মাথায় সর্বদাই উকি দিতো- “আমরা যুদ্ধ কেন করব?” কবি মানুষ হওয়ার কুফল আর কি। মানুষ মারতে হবে এটা চিন্তা করেই আমার গা গুলিয়ে আসতো। হাতে যখন অস্ত্র থাকত, অর্থাৎ যখন আমরা ফায়ারিং প্রাকটিস করতাম, তখন কেমন যেন অনুভব করতাম। সারা গায়ে শিহরন খেলে যেত। অস্ত্রটা হাতে নিলেই মনে হত এই দিয়ে আমি অনায়াসে মানুষ খুন করতে পারি। তখন একটা বিচিত্র হিংস্রতা আর জান্তব বোধও কাজ করত মনে। আমার প্রশ্নের উত্তর আমি খুজে বেরাতাম সর্বদাই। কেন এবং কখন যুদ্ধ করাটা ন্যায়? ধরে নেই আমাদের দেশের উপর যখন অন্য কোন দেশ আক্রমন চালাবে তখন যুদ্ধ করাটা ন্যায়। তাহলে অন্য যে দেশটি আমাদের আক্রমন করল তাদের সৈন্যবাহিনিকে আমাদের প্রতিহত করতে হবে যেভাবেই হোক। কিন্তু যে সৈন্যবাহিনি আমাদের আক্রমন করলো তারাও আমাদেরই মত। তারাও ক্যাম্পে খায়, ট্রেনিং করে, যুদ্ধের মহড়া করে, ছুটি পেলে পরম আনন্দে ঘরে যায় আপন স্ত্রী-শিশুর কাছে। অতএব, তাদের হত্যা করাটা কি অন্যায় নয়? ধরে নিলাম ওরা আগ্রাসী ভুমিকা পালন করে আমাদের দেশ দখল করতে এসেছে, তাই এটা ওদের প্রাপ্য। কিন্তু আমার ছয় বছর ক্যাডেট জীবনের শিক্ষা থেকে আমি জানি, ওরা কেউই স্বইচ্ছায় এই ভুমিকা নেয় নি, ওরা শুধু হুকুমের মালিক। তাহলে ওদের মারার চেয়ে ওদের যারা ভাগ্যনিয়ন্তা তাদের মারাটাই কি বেশি যুক্তি সংগত নয়? ওদের আদেশ করার মালিক কিন্তু ওরা নয়। বেসামরিক কিছু স্বার্থপর ক্ষমতালোভী শাসক। সম্পুর্ন সশস্র বাহিনি আসলে একটি অস্ত্র। এখন যদি আমরা যে আমার দিকে অস্ত্র তাক করেছে তাকে বাদ দিয়ে অস্ত্রকে ধংস করার চেস্টা করি তাহলে সেই অস্ত্র উরিয়ে দিলেও আবারো নতুন কোনো অস্ত্র আমাদের কে নিশানা বানাবে। আমরা ভুলে যাই অস্ত্রের পিছনের হাত কে, সেই হাত ধারনকারী মানুষরূপী জন্তুটিকে। আমরা শুধু অস্ত্রটিকেই দেখতে পাই।



ধীরে ধীরে আমার কাছে মনে হতে থাকে দেশের সংগাটাই কেমন যেন স্বার্থপর গোছের। দেশ কি? কতটুকু আমার দেশ? কোথায় তার সীমানা? একবার শিক্ষাসফরে আমাদের রাজশাহী সীমান্তে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের মদ্ধ্যকার ব্যাবধান কে! আমার মনে একটা প্রশ্ন এসেছিলো তখন,-“আচ্ছা যদি এই কাটা তারের এপারে বাংলাদেশ আর ওইপারে ইন্ডিয়া হয় তাহলে এদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই কেন?” এপারে যেমন সবুজ ধানের খেত ওপারেও তাই। ওপারেও আম গাছ দেখা যাচ্ছে। কি বিচিত্র!! তাহলে ধরে নেয়া যায় যে প্রাকৃতিক বৈষম্যে দেশ বিভাজন চলতে পারে না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমরা বিভক্ত? ধরে নেই জাতিগত পার্থক্য। তাহলে ওপারের কলকাতার লোকজন কি দোষ করল? ওরাও ত নিজেদের বাঙ্গালী দাবি করে। আর ওদের ভাষা আর সাংস্কৃতিক অনেক মিলও আমাদের সাথে বিদ্যমান। আচ্ছা আপনি হয়তো বলবেন, ওরা একটু বেশি কৃপন আর আমরা একটু বিলাসী! না রে ভাই, তাহলে ত আমাদের চাপাই নবাবগঞ্জের মানুষদেরও কলকাতায় পাঠাতে হয়! তাহলে? দেশের সংগাটা কোনভাবেই দাড় করানো যাচ্ছে না। যাই হোক, এ নিয়ে আর ভেবে কাজ নেই। আমার কাছে যা মনে হয়েছে তাতে দেশের সংগাটা অনেকটা এরকম দারায়, “দেশ হল একটি স্বার্বভৌম ভুখন্ড যা তার অন্তর্ভুক্ত মানুষের অধিকার সংরক্ষন করে চলে”। তাহলে আপনার আমার সংগায় যে দেশ সুজলা, সুফলা, শশ্য-শ্যামলা তা আর থাকছে না। যে দেশপ্রেম দেশপ্রেম করে আমরা এত বিতর্ক করি তাও থাকছে না। থাকছে শুধু স্বার্বভৌমত্ত রক্ষা আর স্বার্বভৌম ভুখন্ডের অন্তরভুক্ত মানুষের অধিকার আদায়ের বেপারটি। তাহলে এখানে যুদ্ধের বেপারটারো নিস্পত্তি হয়ে যায়। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে আমরা যুদ্ধ করব অন্য দেশের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ও সাধারন মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে। জহির রায়হান এর লেখা একটা ছোট গল্পের কথা মনে পরে গেলো। আমাদের পাঠ্য ছিলো- “সময়ের প্রয়োজনে”। গল্পটার অন্তর্নিহিত অর্থ আমি একাডেমীতে ট্রেনিং এ না আসলে হয়ত কাখনই ধরতে পারতাম না। আসলে সময়ই ঠিক করে দেয় কে কার সাথে লড়বে, আর এই সময়কে নিয়ন্ত্রন করে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ। তাই জহির রায়হান এর ঐ গল্পের একটি লাইন-“আজ আমরা ওদের সাথে লড়ছি, একদিন যারা আমাদের বন্ধু ছিল”।



অতএব, আমি বুঝতে পারলাম যে আসলে দেশপ্রেম বলে কিছু নেই, আছে শুধু মানুষের প্রতি ভালবাসা। তাদের অধিকার সংরক্ষন করা। আর তাদের উপর থেকে অত্তাচারীর কালো হাতকে হটানো। আমি আরো বুঝতে পারলাম যে আসলে যুদ্ধ নিজেই একটা ক্রাইম। কেননা, আমি আগেই বলেছি, সৈন্যবাহিনি হল একটা অস্ত্রের মত। ওদেরকে মেরে কাখনই অপরাধ দমন করা যাবে না। যারা সমস্যার মুল অথবা যে আদর্শবাদ এর মুল তাকে ধংস করলেই সমস্যার সমাধাম সম্ভব।



যাই হোক, অনেকের মনে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, এত সব ভাবার সময় আমি একাডেমীতে পেলাম কি করে? ভাল প্রশ্ন। তবে কলেজে যে হারে ফাকিবাজি (ডজ মেরে) করে কাটিয়েছি সেটা কাউকে বুঝানো যাবে না। তাই এই প্রশ্নের উত্তর মুলতবি থাকলো। পরে কাখনো আড্ডাবাজির সময় বলা যাবে।

অতএব আমি ভাবতে শুরু করলাম যে আমার দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আমি যেকোন সময় যুদ্ধে যেতে পারি, তার জন্য সারা জীবন লেফট-রাইট করার কোন মানে হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ। ভেগে গেলাম একাডেমি থেকে। কিভাবে? কখন? তার বর্ননা পরে কোনদিন শুনাব।





একাডেমী থেকে ভেগে আসার পরে আমার সত্যিকারের জীবন সম্পর্কে ধারনা আরো স্বচ্ছ হল। যথাবিহিত ভেগে আসার কারনে বাসা থেকে বহিস্কৃত হলাম। আর্থিক অনটন কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি সংগাসহ বুঝে গেলাম। ঐ দুর্দিনে আল্লাহ আমার অনেক বন্ধুকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দিলেন। তাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এবং সর্বোপরি মহানুভব, ও মহামহিম আল্লাহর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উনি আমাকে সাহায্য করলেন আরেকজন বড় ভাই ও বন্ধু দাড়া। ঐ ভাইয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাতের গল্পটা না বলে থাকতে পারছি না। তখন আমি আমার এক বন্ধুর সহযোগিতায় তারই অর্থব্যয় এ একটি মেসে ঠাই গুজতে আসলাম। কয়েকদিন পর দেখি যে এক বড়ভাই হাফ প্যান্ট পরে চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। তার চুলের কাট আর হাবভাব দেখে ক্যাডেট মনে হচ্ছিলো। আর আমারো তখনো চুল বড় হয় নি। আমরা যখন একে অপরকে দেখলাম তখন দুই জনই চুপ করে গেলাম। অবশেষে যখন জানতে পারলাম যে উনিও পলাতক- তারপর আর যায় কোথায়। অনেক বড় স্বস্তির একটা নিস্বাস ছাড়লাম। কারন ততদিনে আমি শুধু মানুষের একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই কাহিল-“কেন ছেড়ে আসলা?” যাই হোক, এমন একজনকে অন্তত পাওয়া গেল যাকে ঐ প্রশ্নটির উত্তর দিতে হবে না, আর আমি যা ভাবি তার ভাবনা চিন্তার ধারা এক।

এই মেসে থাকাকালিন অবস্থায় মানুষের প্রতি ভালবাসা তথা মানবতার প্রতি ভালবাসার বেপারটা আরো পরিস্কার হয় আমার কাছে। আমার দারিদ্র আমাকে ফুটপাথে শুয়ে থাকা অসহায় শিশুটির কথা মনে করিয়ে দেয়, আমার দারিদ্র আমাকে মনে করিয়ে দিতো সেই হাজারো গৃহহীন নরনারীর কথা। আমি আর আমার ঐ বড়ভাই আমরা দুজন মিলে অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম পরে কিভাবে মানবতার সেবায় নিজেকে উতসর্গ করা যায়। ভাবতে লাগলাম জীবনের উদ্দেশ্যটা কি? খেয়ে দেয়ে বড় হওয়া, তারপর পরাশুনা করে ভাল ডিগ্রি অর্জন করা, তারপর একটি ভাল চাকুরির জন্যে জুতার তলা ক্ষয় করা, আর ভাল সুন্দরী দেখে একটি মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হওয়া, তারপর নিজের ছেলেমেয়েকে মানুষ করা ও তাদেরকেও ঐ একই পথে চলতে অনুপ্রানিত করা!! হায় রে জীবন! এটাই যদি জীবন হয়ে থাকে তো আমার মনে হতে থাকে এই ধরনের জীবন আমি চাই না। যে জীবন শুধু আমাদের স্বার্থপর হতে শিখায় তা দিয়ে কি লাভ? আমি আরও ভালো ও পুর্নাংগ একটা সংগা খুজে পেতে চাই জীবনের। আমার তখন মনে হতে থাকে মানুষের সেবায়, মনুষত্যের সেবায় জীবন কাটানোটা একটা যুক্তিসংগত ব্যাক্ষা হতে পারে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই আবারও পরাশুনায় ফিরে আসার।



নিজের টিয়্যুশনি করা টাকা জমিয়ে ভরতি হই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয়- ব্যবসায় প্রসাশন। তেমন পরাশুনা করতে হবে না বলেই এই বিষয়ে ভরতি হলাম আর তাতে অনেক সময়ও বেচে যাবে আমার টিয়্যুশনির জন্য।







যাই হোক, ব্যবসায় প্রশাসনে পড়তে এসে মজার অনেক কিছু শিখলাম। যেমন, ব্যবসা করতে আসলে তেমন বুদ্ধির দরকার পরে না, কিছু মানুষের বুদ্ধি কিনে ফেল্লেই হয় (Enterpreneurship) । আবার যেমন, এখানে কিভাবে উপরওয়ালাদের তোয়াজ করতে হয় তা শিখায় (Management)। আবার শিখায় কিভাবে সুদের দর ধরলে লাভ বেশি হবে (Finance)। এটাও শিখায় কিভাবে পন্যকে অন্য পন্যের সাথে মিশিয়ে বেচলে লোকজন বেশি খাবে (Portfolio management)। আবার বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় গাড়ির সাথে এক নারীও যোগ করে দিয়ে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষন করতে শিখায় (Marketing)। যাই হোক, কিছুদিন পরে আমার মনে হল যে আমি ব্যবসা বুঝে ফেলেছি আর যে ব্যবসা শুধু গরিবদের শোষন করতে শিখায় আর ধনীদের আরও ধনী বানায় তা দিয়ে আমার দরকার নাই। আমার মনে হতে থাকে যদি কোনভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং শিখা যেতো তাহলে হয়ত মানব জাতির জন্য কিছু একটা করা যেত। আর সেজন্য দরকার প্রচুর টাকা, কারন আমি ততোদিনে সরকারি সব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির যোগ্যতা হারিয়েছি। একমাত্র পথ খোলা ছিল, আর তা হল স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া। আল্লাহর অসীম কৃপায় আমি বেশ কয়েকটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। তার মধ্যে থেকে পাকিস্তানের ডাক আগে আসায় এখানেই এসে পরি।   



পাকিস্তানে আসার আগে বাসার সবাই ও আমার যতো আত্মীয় আছেন সবাই বলা শুরু করলেন, “পাকিস্তান গিয়ে কি করবি? এর চেয়ে জাপান যা। আর ওখানে এত বোমাবাজি আর যা অবস্থা!” যাই হোক, আমার মতো গোয়ারকে হার মানাতে তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেন।



আবার প্রথম থেকে শুরু করি। পাকিস্তান আসার পুর্বে আমার পাকিস্তান সম্পর্কে যে খুব একটা ভাল ধারনা ছিল তা কিন্তু না। আর দশটা বাংলাদেশিদের যে ধারনা আমারও তাই ছিল। কিন্তু এখানে এসে কিছু বিচিত্র বেপার লক্ষ্য করি। প্রথমত, ইতিহাসের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় এদের স্কুল কলেজগুলোতে ইতিহাসের নামে পাতিহাস শিখানো হয়। ওরা মনে করে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুধু একটি ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্র। আর বাংলাদেশ পাকিস্তান ভাই ভাই ছিল আর ইন্ডিয়া তাদের ভাইকে আলাদা করে দিয়েছে। প্রথম প্রথম ওদের এই ভুল ব্যাক্ষা শুনলে রাগে গা জ্বলে যেত। পরে চিন্তা করে দেখলাম, আমি এম্নিতেই ওদের উপর রাগ করছি। ওদের কে যদি সত্য শিখানো না হয় ওটা তো ওদের দোষ নয়। বরংচ, ওরা অনেক নিরীহ আর সৎ। ওদের সততার একটা গল্প বলি, মাত্র অল্প কয়েকদিন হয়েছে আমি পাকিস্তানে এসেছি। ক্যান্টিনে খেয়ে ৫০০ রুপির নোট দেওয়ায় দোকানি আমাকে ১০০০ রুপির চেঞ্জ দিল। আমি তো দেখি হায় হায় একি অবস্থা। টাকাটা ফেরত দেওয়ার আগে ভাবলাম যে লোকটা হয়ত অনেক খুশি হবে। কিন্তু একি!! আমি যখন বললাম যে ভাই আপনি আমাকে ৫০০ রুপি বেশি দিয়েছেন তখন লোকটা বলল, “তাই নাকি। আচ্ছা ঠিক আছে”। আমি তো অবাক। ব্যাটা একটা ধন্যবাদ তো দে। মনে একটূ রাগও হয়েছিল।



কিন্তু একটা জোক্স মনে পরায় অনেক হেসেছিলাম সেদিন আর ঐ লোকটার প্রতি রাগ দূর হয়ে কেমন যেন একটা ভক্তি এসে পরেছিল। এখন জোক্সটা বলি, “আপনাদের সকলেরই চাপাই নবাবগঞ্জবাসীদের কৃপনতার কথা জানা আছে নিশ্চই!! হাহাহহা। জানা না থাকলেও ক্ষতি নেই। কারন এটা শুধু জোক্সের খাতিরেই বলা। যাই হোক, এক চাপাই বাসী আর অন্য আরেক লোকের সাথে আভিজাত্যের দ্বন্দ হচ্ছে। তো অন্য লোকটা বলছে যে, ‘আমাদের এখানে বিশাল বিশাল অট্টালিকা আছে। তোদের তো কিছুই নাই’। তো চাপাই বসী বলে, ‘আমাদের থাকুক আর নাই থাকুক, তোদের এলাকায় তো গলিতে গলিতে ভিক্ষুক। তুই জানিস আমাদের পাড়ায় একটাও ভিক্ষুক নাই!!’ তো উত্তরে অন্য লোকটি বললো, ‘আরে কিপ্টার দল, তোরা ভিক্ষা দিস যে তোদের এলাকায় ভিক্ষুক থাকবে। ভিক্ষুকদের এত না খাইয়া মরার শখ নাই’।



এখন যা বলতে চাচ্ছিলাম, পাকিস্তানি সাধারন মানুষের সততা। ঐ লোকটি টাকা ফেরত পাওয়ায় বিন্দুমাত্র অবাক হয় নি কারন টাকাটা ফেরত পাওয়াটাই ওর কাছে স্বাভাবিক ছিল। ঢাকায় নগুরে জিবনের ছোয়ায় আর আধুনিক সভ্যতার কারনে আমি ভুলতে বসেছিলাম সততা কি জিনিস। ঐ লোকটি আমাকে তা মনে করিয়ে দিলো। আমাকে মনে করিয়ে দিল সততা দেখিয়ে নিজেকে বড় আর মহানুভব ভাবাটা কতবড় বোকামি।



যতোই দিন যেতে লাগলো আমি বুঝতে পারলাম যে এরা আমাদের গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের মতই নিরীহ আর কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি সৎ আর অতিথিপরায়ন। এখানে এসে আরো একটা জিনিস পরিস্কার হয়ে গেলো। আর তা হল পুজিবাদ অর্থনীতি কি করে সমাজে শ্রেনীবৈষম্য তৈরি করে। পাকিস্তানে পুজিবাদ অর্থনীতি মানুষকে দুইটা শ্রেনীতে বিভক্ত করে ফেলেছে,- শোষক আর শোষিত। আপনারা অবাক হয়ে জাবেন দেখলে যে পাকিস্তানে কোন মধ্যবিত্ত শ্রেনী বলতে কিছু নাই। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখা খুবই কম। আর জেগুলো আছে তাতে কোনভাবেই একজন মধ্যবিত্ত উঠতে পারবে না। আর বাকি সবারই নিজ নিজ গাড়ি আছে।



যাই হোক, আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পরতে পরতে আমি বুঝতে পারলাম যে আসলে আমি যদি কোনভাবে কিছু একটা আবিস্কার করেও ফেলি তাহলেও কোনভাবে তার সুফল সাধারন জনগনের কাছে পৌছাবে না অথবা পৌছাতে এতটাই সময় লেগে যাবে যে দারিদ্রের সংগা পালটে যাবে।



এই বেপারে একটা উদাহরন দেয়া যায়। ধরা যাক পুর্ববর্তি যুগের সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা যখন বিল্ডিং বানানো আবিস্কার করলেন তখন তারা মনে করলেন যে তারা আসলেই মানব জাতির জন্য মহৎ কিছু করে ফেলেছেন। যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখি। বিল্ডিং আবিস্কারের পুর্বে ধনী গরিব সকলে একই গোয়ালের গরু ছিল। কিন্তু বিল্ডিং আবিস্কার ধনী গরিব সকলকে এক অসম প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিল। ধনীরা গরিবকে শোষন করে টাকা জমিয়ে বিল্ডিং বানাতে লাগলো। আর গরিবরা ওদের বিল্ডিং দেখে হা হুতাস করতে লাগলো। মানব জাতি আজো বিল্ডিং বা দালান নামক এই জিনিসটির লোভে অনেক অন্যায় আর অত্যাচার করে থাকে। অতএব, এই আবিস্কার কি আদৌ মানব সভ্যতার কোন উন্নয়ন করতে পেরেছে? হয়তো বা করেছে তবে তা মানব সভ্যতায় নয়, দানবীয় কোন সভ্যতায়।



আবিস্কারের যে নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল তা ছুটে গেল। ভাবতে বসলাম কিভাবে সত্তিকারের সভ্যতা ফিরিয়ে আনা জায়। ইতোমধ্যে, মহান আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। তওবা করে ফিরে এসে দেখি মহান আল্লাহ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর ১৪০০ বছর আগেই বলে দিয়েছেন। মানব সভ্যতাকে যদি সত্তিকারের সভ্যতায় উত্তীর্ন করতে হয় তাহলে একমাত্র আল্লাহ’র আইনই যথেষ্ট। ধনী গরিবের মাঝে ব্যবধান দূর হয়ে যাবে আল্লাহর আইন মানলে, সততা আর উপকথা হয়ে গল্পের বইএ নয় বাস্তবেও শোভা পাবে, আল্লাহর আইন মানলে অকারন হানাহানি আর যুদ্ধ থেকে মুক্তি পাবে সব মানুষ, এতিম আর গরিব দুখিদের জন্য আর আমার মত নালায়েক কাউকে ভেবে ভেবে কাহিল হতে হবে না, ব্যবসা বানিজ্যে সততা আর শুদ্ধতা থাকবে, গাড়ির সাথে কোন নারী আর বেচতে হবে না, লোভ আর লালসার জগত থেকে মুক্তি পাবে সব মানুষ; সর্বোপরি একমাত্র ইসলামই পারে মানুষের মনে প্রকৃত শান্তির হাওয়া বইয়ে দিতে যা মানুষকে ইহকালে ও পরকালে মুক্তি দিতে পারে।



রাইটার : Nazmul Islam

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম