রাইটার : মুহাম্মদ ইবনে হাবীব
আমরা একটি দিনের ২৪ ঘন্টাই আক্রান্ত হচ্ছি বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস, বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে লেখা, অ্যাডভারটাইসমেন্ট দ্বারা, এটা কিনুন, ওটা কিনুন, এটা নিন, ওটা নিন কিন্তু তবুও তাদের মধ্যে অনেকেই হতাশ হয়ে যাচ্ছে এবং আত্মহত্যা করছে। ১৪ বছরের একটি মেয়ে দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে, কেন? কারণ, তার মা তাকে টিভি দেখতে দেয়নি! এটি অ্যাডভারটাইসমেন্ট দুনিয়ার কসসিউমার সোসাইটির একটি অভিশাপ!
(পশ্চিমা দুনিয়াতে) ক্রিসমাস হচ্ছে একটি প্রধান অনুষ্ঠান যখন পরিবারে মানুষগুলো একত্র হয় কিন্তু তারা এমনকি তাদের নিজের মাকে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানায় না, পিতাকেও জানায় না। ক্রিসমাসে তারা তাদের বাবা-মাকে দেখতে পর্যন্ত যায় না এবং আশ্চর্যজনক হচ্ছে অনেকসময় তারা তাদের বাবা-মাকে এমনকি একটা ফোন পর্যন্ত করে না। আপনারা কি জানেন এই বিষয়টি মুসলামান, হিন্দু, শিখদের মধ্যেও ঘটতে শুরু করেছে। এটা এই ইন্ডিয়াতে শুরু হয়েছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা অচিরেই এটি অবলোকন করবেন, যে মানুষগুলো দিনে দিনে আরো অধিক হারে বস্তুবাদী দুনিয়ার দারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।
আমরা আমাদের বাচ্চাদের বড় করছি যে ফিলোসফি বা দর্শন দ্বারা তা হলো, কাজ-কাজ(কাজ কর) , টাকা-টাকা(টাকা উপার্জন কর)। ঠিক আছে আপনি বাচ্চাদের শিখাচ্ছেন কাজ-টাকা সম্পর্কে এখন আপনি কি মনে করেন, সে আপনার বিষয়ে যত্নবান হবে? কেন সে আপনার খোজ-খবর নিবে যখন আপনি বৃদ্ধ হয়ে যাবেন? কেন? আপনি তাকে সব সময় শিখিয়েছেন কাজ-কাজ, টাকা-টাকা আপনি কখনও শেখাননি আম্মি-আব্বু, টাকা-টাকা। সে কেন আপনার বিষয়ে চিন্তা করবে যখন আপনি বৃদ্ধ হয়ে যাবেন কারণ তাদের চিন্তা মননে যা আছে তা হচ্ছে শুধু টাকা, ইনজয়মেন্ট, ফান; আমার জীবনটাকে উপভোগ করতে দাও।
আমরা এটাই প্রতক্ষ্য করছি। কনসিউমার বস্তুবাদী সমাজের এটি একটি সমস্যা এবং আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এটি নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। এটি এমন একটি বিষয় যেটি অবশ্যই ঘটবে, আমি আপনাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ করছি ইতিহাসের বই নিয়ে আসুন, সেগুলো পড়ে দেখুন ইতিহাসের একই ঘটনা বারবার ঘটছে। ইতিহাস সবসময়ই নিজেই একই ধারায় পুনরায় আবর্তিত হয়। ইতিহাসের শিক্ষা প্রায় একই আর আপনারা সবসময়ই এই বিষয়টি লক্ষ্য করে থাকবেন।
যখন একটি সিভিলাইজেশন অনেক শক্তিশালী, অর্থশালী, সম্পদশালী, পার্থিব ও বস্তুবাদী দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় তখন নৈতিকতা অনেক কমে যায়; তখন মানুষ সঠিক না বেঠিক তার দিকে লক্ষ্য করে না বরং তারা সবসময় লক্ষ্য করে কিভাবে জীবনটাকে উপভোগ করা যায়। তখন আপনারা দেখবেন এটি একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র, সময়টি আবার বড় নয় অনেক ছোট আর সেই সময়ের মধ্যে সেই সমাজটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ সমাজ বলতে আমরা কি বুঝি? সমাজ বলতে আমরা বুঝি যেখানে মানুষ একসাথে বসবাস করে, একে অপরকে সহযোগীতা করে, সবাই মিলে কিছু বিষয় অর্জন করার চেষ্টা করে; আমরা সবাই একসাথে কাজ করি ভাল কিছু অর্জনের জন্য। কিন্তু যখন এটি এমন হবে, মানুষ শুধু তার নিজেকেই নিয়েই ব্যাস্ত থাকবে, শুধু নিজের সুবিধার দিকেই লক্ষ্য রাখবে, শুধু নিজে কিভাবে জীবনটাকে উপভোগ করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে তখন কি সমাজের একত্র বসাবাস করার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল সেটি কি এই বিষয়টির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল না? যার ফলস্বরূপ আপনার দেখতে পাচ্ছেন ছেলেমেয়েরা তাদের অভিভাবকের খোজ-খবর নেয় না।
ঐ সকল লোকজন যারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত অর্থাৎ আমি তাদের বুঝাচ্ছি যারা গরীব এবং তারা এই বস্তুবাদী দুনিয়া থেকে কোন সুবিধা পাচ্ছে না ফলে তারা সবসময় পেছনে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কাছেও সেই একই অ্যাডভারটাইসমেন্ট দেখানো হচ্ছে, একই রকম টিভি কমার্শিয়াল অ্যাডভারটাইসমেন্ট দেখানো হচ্ছে, একই রকম ধ্যান-ধারণা তাদেরকেও দেয়া হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে তারা চিন্তা করতে শুরু করেছে আমার টাকা দরকার, আমার সম্পদ দরকার; আমি কিভাবে সুখী হতে পারি যদি আমার এই জিনিসগুলো না থাকে? এখন তারা যদি এই জিনিসগুলো উপার্জনের মাধ্যমে অর্জন করতে না পারে এখন তারা কি করবে বলে আপনারা মনে করেন? হ্যাঁ? তারা চুরি করবে! তারা চুরি করবে এই জিনিসগুলো অর্জন করার জন্য। তারা ডাকাতি করবে এগুলো অর্জন করার জন্য। আর ঠিক এই বিষয়টি ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে ঘটছে। মানুষজন একে অপরকে মেরে ফেলছে মামুলি কতগুলো জিনিস অর্জন করা জন্য এমনি তারা মানুষকে মেরে ফেলছে একটা হাতঘড়ির জন্য। আর বিষয়টি এমন নয় যে এটি ঘটছে শুধু এজন্যে যে সে ড্রাগ এডিকটেট(Drug Addicted), বিষয়টি এমন নয়; যা ঘটছে তা হচ্ছে তার চিন্তা-মননে।
সে ভাবছে আমার যদি এই রকম জুতো থাকে তাহলে এটি আমাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে রুপান্তরিত করবে। কেন? কারণ, ঠিক এই বিষয়টি অ্যাডভারটাইসমেন্টগুলো তাকে শেখাচ্ছে! তারা শেখাচ্ছে Just do it! যদি এই জিনিসগুলো তাদের থাকে তখন তারা ভাবতে শুরু করে হ্যাঁ এখন আমার এই জুতোটি আছে, আমার অমুক জ্যাকেটটি আছে, আমার এই জিনিসগুলো আছে, আমি কিছু একটা হয়ে গেছি, আমি গুরুত্বপূর্ণ একজন।
একটা কাপড়ের টুকরো কথা বিবেচনা করুন যেটা এমন জায়াগায় বানানো হয়েছে যেখানে যারা কাজ করে তারা খুবই অল্প পরিমানে বেতন পায় যা দিয়ে তাদের জীবনই চলে না। এই কাপড়টি হয়তো বানাতে সামান্য কিছু অর্থ খরচ হয়েছে কিন্তু তারা এই কাপড়টি বিক্রি করছে হাজার-হাজার টাকা, পাউন্ড বা ডলারে! কেন এমনটি হচ্ছে কারণ যারা কিনছে তারা ভাবছে হ্যাঁ এই কাপড়টি আমাকে স্পেশাল একজনে রুপান্তরিত করবে, আমাকে গুরুত্বপূর্ণ একজনে পরিণত করবে। যার ফলে সমাজে হিংস্রতা বেড়ে যাচ্ছে, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
এখন আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন মানুষজন এমন বাড়িতে বসবাস করে যেগুলো দেখতে প্রাসাদের মতো! সম্পদশালী ব্যক্তিরা দেয়াল ঘেরা জায়গায় থাকতে শুরু করেছে যেখানো আরো রয়েছে নিরাপত্তা টিভি ক্যামেরা, সিকিউরিটি গার্ড! আর সেখানে কেবলমাত্র ধনী মানুষেরাই যেতে পারে। এই বিষয়টি ঠিক এখন ইন্ডিয়াতে ঘটছে, স্পেশাল জায়গা ধনীদের জন্য। তারা ভায়োলেন্সকে ভয় পাচ্ছে, তারা তটস্থ থাকছে কিনা আবার ঘটে যায়। এটি ইউনাইটেড স্টেটস এ, ইংল্যান্ডে এবং চায়নাতে ঘটছে। কারণ, আমরা সকলেই এই বস্তুবাদী দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। আমরা এই থিওরী বা মতবাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেছি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমরা কখনও সন্তুষ্ট হই না। আমাদের যত আছে আমরা এর চেয়ে আরো অধিক চাই, কামনা করি। আপনারা কি মনে করেন এই বিষয়গুলো আপনাকে সুখী করবে? ঠিক আছে কখন আপনারা সুখী হবেন? আপনার নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে, নিজস্ব গাড়ি রয়েছে কিন্তু আপনি এখন চিন্তা করবেন আমার আরেকটি ফ্ল্যাট দরকার তাহলে আমি সেই ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিতে পারবো আর আমার জীবনি আরো সহজতর হবে। এরপর আরেকটি গাড়ি দরকার আমার স্ত্রীর জন্য, আমার মেয়ের জন্য, ছেলের জন্য, মেয়ের জামায়ের জন্য। এরপর ও আমার একটি বোট দরকার, একটি প্রাইভেট বিমান দরকার! কখন এই আকাঙ্খা শেষ হবে? এটি কখনো শেষ হবে না! এর কোন শেষ নেই! কারণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলেছেন, “দুনিয়ার কিছুই আদম সন্তানের পেটকে পরিপূর্ণ করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এটি কররের মাটি দ্বারা পূর্ণ হবে”। এটি তখনই শেষ হবে যখন আপনি মারা যাবেন, তখন এই জিনিসগুলো পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আপনার শেষ হয়ে যাবে। এই আকাঙ্খা একমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমেই আপনার নিকট থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
আপনারা জানেন, মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা অভিশাপ, কোন আর্শিবাদ নেই, কোন বেনিফিট নেই; এটি অভিশাপ। এটি এমন যা,তোমাকে ক্ষতির কারণ করে দিবে, রোগাক্রান্ত করে দিবে, অসুস্থ করে দিবে, কখনও সন্তুষ্ট করবে না, তোমার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিবে, কখনও সুখী করবে না, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে দিবে, সমগ্র পৃথিবীটিই এরকম শুধুমাত্র ধর্মীয় আলেম ব্যক্তিগণ ব্যাতীত, তারা ব্যতীত যারা ইলম অর্জনের ছাত্র; জিকির, আল্লাহর স্মরণ এবং এই বিষয়গুলো অর্জন করতে আর যা কিছু তোমার প্রয়োজন সেগুলো।”
এই লেখাটি আব্দুর রহীম গ্রীনের একটি লেকাচারের কিছু অংশের অনুবাদ।
বস্তুবাদী কনসিউমার সোসাইটির অ্যাডভারটাইসমেন্টের অভিশাপ
☼→
ব্লগ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: