মিলাদ উদযাপনকারীদের ধোঁকাপূর্ণ যুক্তি সম্পর্কে আলোচনা

মীলাদুন্নবী কী,মুসলিমের নিকট এ দিনের গুরুত্ব কত? 


প্রথমত :

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোয় বের করেছেন। তিনি মানুষদের হাত ধরে গোমরাহী থেকে হিদায়াত ও সঠিক পথে নিয়ে এসেছেন।



আশা করছি এ প্রশ্ন ইসলাম সম্পর্কে আপনার গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রথম স্তর এবং এ সম্পর্কে জানা ও পড়া-শোনার প্রথম ধাপ। আপনি কুরআনের অনুবাদ পড়ার চেষ্টা করুন, তাহলে এ দ্বীন সম্পর্কে আরও অধিক জানতে পারবেন। সন্দেহ নেই আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ করে আমাদের দ্বীনি বোন হয়ে যান, তাহলে আমরা অধিক খুশি হবো।



দ্বিতীয়ত : ইসলাম ধর্মে ইবাদাত কিছু মূলনীতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার নীতি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনিত আদর্শের অনুসরণ ব্যতীত কারো ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর নির্দেশিত ইবাদাত ব্যতীত অন্য পন্থায় যে ইবাদাত করবে, আল্লাহ তার ইবাদাত কবুল করবেন না। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। আয়েশা -রাদিআল্লাহু- আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

    

    “আমাদের এ দ্বীনে যে নতুন আবিষ্কার করল, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা পরিত্যক্ত”। [বুখারী : ২৪৯৯]



ঈদ এসব ইবাদাতেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য দু’টি ঈদের অনুমোদন দিয়েছেন, এ ছাড়া আর কোন ঈদ উদযাপন করা বৈধ নয়।



ঈদে মীলাদুন্নবী সম্পর্কে জানা প্রয়োজন যে, এ দিনে ঈদ উদযাপন করার অনুমতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দেননি। তিনি নিজে এ দিনে ঈদ উদযাপন করেননি, অনুরূপ তার সাহাবাগণও নয়। অথচ আমাদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাদের মহব্বত অধিক ছিল। এ জন্য এ দিনে আমরা ঈদ উদযাপন করব না। এতেই রয়েছে আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুসরণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :



    “রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও”। সূরা হাশর : (৭)



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

    

    “তোমরা আমার সুন্নত ও আমার খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত আঁকড়ে থাক এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে তা কামড়ে ধর। খবরদার ! তোমরা নতুন আবিষ্কৃত বস্তু থেকে দূরে থাক, কারণ প্রত্যেক নতুন আবিষ্কৃত বস্তু বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী”। [আবু দাউদ : ৩৯৯১], আল-বানি সহীহ আবু দাউদে : (৩৮৫১) হাদিসটি সহীহ বলেছেন।

    

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত যেসব জিনিস দ্বারা প্রকাশ পায়, তা হচ্ছে তার প্রতিটি আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম দিন  বা মীলাদুন্নবী উদযাপন করা তার নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।



আর যে ব্যক্তি ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে চায়, তার উচিত এর স্বপক্ষে দলিল পেশ করা, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম দিন সোমবার সিয়াম সাধনার ফজিলত রয়েছে, কিন্তু এটা শুধু ঈদে মীলাদুন্নবীর সোমবার নয়, বরং বছরের প্রতিটি সোমবার এ ফজিলতের অন্তর্ভুক্ত।



    আবু কাতাদা আনসারী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবারে সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন : “এ দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমার উপর অহী নাযিল করা হয়েছে”। মুসলিম : (১৯৭৮)



সোমবার দিন বান্দার আমল আসমানে উঠানো হয় এবং তা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়।



মুদ্দাকথা :



ঈদে মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা বা তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদান করেননি, তাই আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুসারে এ দিনে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা বৈধ নয়। দোয়া করছি, আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দান করুন। আল্লাহ ভাল জানেন।

যারা মনে করে যে এই বিদ'আতটি চালু রাখা দরকার, তারা ধোঁয়াটে সব যুক্তি উত্থাপন করে থাকে যা কিনা ওজনে মাকড়সার জালের চেয়েও হালকা। এসমস্ত ত্রুটিপূর্ণ যুক্তির জবাব এভাবে দেয়া যায়:



প্রথম ভ্রান্ত যুক্তি: তারা দাবী করে যে এটা নবীর(সা.) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন:



এর জবাবে বলা যায় যে নবীকে শ্রদ্ধা করার উপায় হচ্ছে তাঁর আনুগত্য করা, তিনি যেমনটি আদেশ করেছেন, তেমনটি করা আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করা; বিদ'আত, কল্পকাহিনী এবং পাপাচারের মাধ্যমে তাঁকে সম্মান করতে বলা হয়নি। মিলাদুন্নবী উদযাপন এরকমই এক দূষণীয় কাজ, কারণ এটা একধরনের পাপাচার। নবীকে(সা.) যারা সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা করেছিলেন, তারা ছিলেন সাহাবীগণ, যেমনটি উরওয়াহ ইবনে মাসউদ কুরাঈশদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন:

“হে লোকসকল! আল্লাহর কসম আমি রাজরাজড়াদের দেখেছি। আমি সিজার, কায়সার এবং নেগাসের দরবারে গিয়েছি, কিন্তু আল্লাহর শপথ, আমি এমন কোন রাজা দেখিনি যার সাথীরা তাকে এতটা সম্মান করে, যতটা গভীরভাবে মুহাম্মাদকে(সা.) তাঁর সাথীরা শ্রদ্ধা করে। আল্লাহর শপথ তাঁর কোন থুথুও মাটিতে পড়ত না, বরং তাঁর সাথীরা হাত দিয়ে ধরে নিতেন এবং তা তাদের চেহারা ও ত্বকে বুলিয়ে নিতেন। যদি তিনি তাদেরকে কোন আদেশ দেন, তবে তারা সেটা পালন করার জন্য দ্রুতগামী হয়। তাঁর ওযুর সময় তারা ওযুর পানি গ্রহণ করার জন্য প্রায় লড়াই করতে উদ্যত হয়। তিনি কথা বললে তাঁর উপস্থিতিতে তারা তাদের কন্ঠস্বরকে নীচু করে ফেলে। এবং তারা গভীর শ্রদ্ধাবোধের কারণে তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়েও থাকে না।” (বুখারী)



তাঁর প্রতি এত শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা [অর্থাৎ সাহাবীরা] কখনও মিলাদুন্নবীর দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করেননি। যদি ইসলামে একে পালন করার উৎসাহ দেয়া হত, তবে তারা কিছুতেই একে অবহেলা করতেন না।



দ্বিতীয় ভ্রান্ত যুক্তি: বহু দেশের বহু লোকেই এটা পালন করে থাকে:



এর জবাবে বলা যায় যে, দলীল-প্রমাণ হিসেবে শুধু সেটাই উপস্থাপন করা যাবে, যা নবীর(সা.) কাছ থেকে আগত বলে প্রমাণিত হবে, আর নবীর(সঃ) কাছ থেকে আগত বলে যা প্রমাণিত, তা হচ্ছে এই যে, সকল বিদ'আতই সাধারণভাবে হারাম, আর এটা নিঃসন্দেহে একটি বিদ'আত। লোকেদের রীতিনীতি যদি দলীল-প্রমাণ বিরোধী হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়, তা যতসংখ্যক লোকই তা পালন করুক না কেন। আল্লাহ বলেন:


“আর আপনি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে...” (সূরা আল আনআম, ৬:১১৬)



এতদসত্ত্বেও আলহামদুলিল্লাহ, প্রতি যুগেই এমনসব মানুষ ছিলেন যারা এই বিদ'আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং স্পষ্টত ঘোষণা দিয়েছেন যে, এটি বাতিল প্রথা। সত্যকে ব্যাখ্যা করার পরও যারা এটি পালন করতে থাকে তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই।



এই উপলকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন: শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া(রহ.), তাঁর ‘ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাক্বিম’ বইতে; ইমাম আল শাতিবী, আল-ই’তিসামে; ইবনুল হাজ্জ, আল মাদাখিল বইতে; শায়খ তাজুদ্দিন আলী ইবন উমার আল লাখামী, যিনি কিনা এই প্রথার বিরুদ্ধে গোটা একটি বই লিখেছেন; শায়খ মুহাম্মাদ বাশীর আল সাহসাওয়ানী আল হিনদী, তাঁর সিয়ানাতুল ইনসান কিতাবে; সাইয়্যেদ মু‏হাম্মাদ রশীদ রিদা এই বিষয়ের ওপর একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখেছেন; শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আল আশ-শায়খ এ বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ লিখেছেন; শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায; এবং অন্যান্যরা; যারা এখনও প্রতিবছরই পত্রিকা এবং সাময়িকীতে এসম্পর্কে লিখে যাচ্ছেন এবং একে প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন, এমন এক সময়ে যখন এ বিদ'আত পালিত হচ্ছে।



তৃতীয় ভ্রান্ত যুক্তি: তারা দাবী করে যে তারা মিলাদ পালনের দ্বারা নবীর(সা.) স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রাখছে:



এর জবাবে বলা যায় যে, মুসলিমরা নবীর(সা.) স্মৃতিকে সর্বদাই উজ্জ্বল করে রাখে, যেমন তাঁর নাম উচ্চারিত হয় আযানে, ইক্বামাতে এবং খুতবায়, ওযুর পর কালেমা শাহাদাৎ পাঠের সময়, সালাতের মধ্যে দু'আয় এবং তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়ার সময় যখন কিনা দরূদ পাঠ করা হয়, এবং যখনই কোন মুসলিম কোন ওয়াজিব অথবা মুস্তাহাব কাজ পালন করে যা কিনা নবী(সা.) কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছে। এই সকল উপায়ে একজন মুসলিম তাঁকে স্মরণ করে এবং সে যে উত্তম কাজটি করে, তার সওয়াব নবীও(সা.) পেয়ে যান । এভাবেই একজন মুসলিম তাঁর স্মৃতিকে সতেজ রাখে এবং জীবনের প্রতিটি দিনে ও রাতেই তাঁর সাথে সংযোগ রক্ষা করে আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থায়, শুধু মিলাদের দিন বিদ'আতী ও সুন্নত বিরোধী প্রক্রিয়ায় নয়; কেননা এর দ্বারা রাসূলের(সা.) সাথে দূরত্ব কেবল বেড়েই যায় এবং রাসূল(সা.) এ কারণে তাকে প্রত্যাখ্যান করবেন।



বিদ'আতপূর্ণ উৎসবের কোন প্রয়োজন রাসূলের(সা.) নেই, কেননা স্বয়ং আল্লাহই তাঁকে শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত করেছেন, যেমনটি তিনি ঘোষণা দেন:



“আর আমি তোমার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।” (সূরা ইনশিরাহ, ৯৪:৪)



আর আযান, ইক্বামত কিংবা খুতবায় এমন কোন সময় আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়না যখনই তার পরপরই রাসূলের(সা.) নাম না উচ্চারিত হয়। শ্রদ্ধা, ভালবাসা প্রদর্শন এবং তাঁর স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এটাই যথেষ্ট, এটাই তাঁকে অনুসরণ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহব্যঞ্জক।



আল্লাহ কুরআনে রাসূলের(সা.) জন্মকাহিনী আলোচনা করেননি, বরং তিনি তাঁর মিশনের কথা উল্লেখ করেছেন:


“যথার্থই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন...” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৬৪)



“তিনিই নিরক্ষর জাতির মধ্য থেকে তাদেরই একজনকে রাসূল বানিয়ে প্রেরণ করেছেন...” (সূরা আল জুমুআহ, ৬২:২)



চতুর্থ ভ্রান্ত যুক্তি: তারা দাবী তুলতে পারে যে মিলাদুন্নবী উদযাপন একজন জ্ঞানী ও ন্যায়বিচারক রাজার দ্বারা প্রচলিত হয়েছে যিনি এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চেয়েছেন।



আমাদের জবাব হচ্ছে বিদ'আত কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, তা সে যে কেউই পালন করুক না কেন। ভাল নিয়্যতের দ্বারা কোন খারাপ কাজ করা জায়েয হয় না, আর যদিও বা একজন লোক জ্ঞানী ও সৎকর্মশীল হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন, তার মানে এই নয় যে তিনি কোন ভুল করতে পারেন না।



পঞ্চম ভ্রান্ত যুক্তি: তারা দাবী করে মিলাদুন্নবী উদযাপন “বিদ'আতে হাসানা” বা উত্তম বিদ'আতের আওতায় পড়ে, কেননা এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীকে(সা.) প্রেরণের জন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।



আমাদের জবাব হচ্ছে: বিদ'আতের মধ্যে উত্তম বলে কিছু নেই। নবী(সা.) বলেছেন:



“যে কেউই আমাদের এই দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা এর কোন অংশ নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” (বুখারী)



এবং তিনি(সঃ) বলেছেন:



“প্রতিটি বিদ'আতই পথভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, তিরমিযী)



বিদাতের ক্ষেত্রে শরীয়াতের বিধান হচ্ছে এই যে, সকল বিদ'আতই পথভ্রষ্টতার নামান্তর, কিন্তু তাদের ভ্রান্ত যুক্তির কারণে তাদের ধারণা এই যে সব বিদ'আতই দূষণীয় নয়, বরং কিছু বিদ'আত আছে যেগুলো উত্তম।



শারহুল আরবাঈন বইতে হাফিয ইবনে রজব

বলেছেন:



“নবীর(সা.) বক্তব্য: ‘প্রতিটি বিদাতই পথভ্রষ্টতা’ একটি সংপ্তি কিন্তু ব্যাপক উক্তি যা সবকিছুকেই আওতাভুক্ত করে; এটি দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এটা তাঁর এই বাণীর মত: ‘যে কেউই আমাদের এই দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা এর কোন অংশ নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ (বুখারী, আল ফাতহ) যে কেউই এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করে ইসলামের সাথে একে সম্পৃক্ত করতে চায়, যার ভিত্তি এই দ্বীনে নেই, তবে সেটা পথভ্রষ্টতা এবং ইসলামের সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই, তা আক্বীদাহ সংক্রান্তই হোক আর বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ কথা ও কাজ সংক্রান্তই হোক না কেন।” (জামি’উল উলুম ওয়াল হাকাম, পৃ: ২৩৩)



“বিদ'আতে হাসানা” বা উত্তম বিদ'আত বলে কোন কিছু আছে - এর সপক্ষে তাদের কাছে কেবল একটি প্রমাণই আছে, আর তা হল তারাবীহ সালাত সংক্রান্ত উমারের(রা.) উক্তি:



“এটা কতই না উত্তম বিদ'আত।” (সহীহ আল বুখারী, আল ফাতহ)



এছাড়া তারা বলে যে, কিছু বিদ'আত রয়েছে যে সম্পর্কে সালাফগণ কোন আপত্তি তোলেন নি, যেমন কুরআনকে একটি খন্ডের মধ্যে সংকলিত করা এবং হাদীস লেখা ও সংকলন। এক্ষেত্রে বলা যায় এগুলোর ভিত্তি দ্বীনেই রয়েছে, তাই এগুলো আদৌ বিদ'আত নয়।



উমার(রাঃ) বলেছিলেন: “কতই না উত্তম বিদাত।” এখানে বিদাত কথাটিকে শাব্দিক অর্থে নিতে হবে, শরীয়াতের পারিভাষিক অর্থে নয়। দ্বীনের মধ্যে যা কিছুরই ভিত্তি রয়েছে, সেটাকে যদি বিদ'আত বা নব্য প্রথা বলে আখ্যায়িত করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে সেটা শাব্দিক অর্থে বিবেচনা করতে হবে, কেননা শরীয়াতের পরিভাষায় বিদ'আত হচ্ছে সেটাই যার কোন ভিত্তি ইসলামে নেই।



কুরআনের সংকলনের ভিত্তি ইসলামে রয়েছে, কেননা নবী(সা.) কুরআন লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় সাহাবীগণ একে একটি খন্ডে সংকলন করে এর রণাবেণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।



তেমনি নবীজী(সা.) কিছুদিন তারাবীর নামাযে ইমামতি করেন, কিন্তু সেটা যেন ওয়াজিব হয়ে না যায়, এজন্য তিনি পরবর্তীতে তা থেকে বিরত হন। নবীর(সা.) জীবদ্দশায় ও তাঁর পরও সাহাবীরা একাকী তারাবীহ পড়তেন, যতক্ষণ না ওমর(রাঃ) তাদেরকে একজন ইমামের পেছনে একত্র করে দেন, যেমনটি তাঁরা প্রাথমিক অবস্থায় নবীর(সা.) পেছনে তারাবী পড়তেন। এটা ধর্মীয় ব্যাপারে মোটেও কোন বিদ'আত নয়।



হাদীস লেখার ভিত্তিও ইসলামে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ(সা.) কিছু হাদীস বিশেষ বিশেষ সাহাবীর জন্য লিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যখন তাঁর কাছে সেই অনুরোধ করা হয়। তবে সাধারণভাবে তাঁর জীবদ্দশায় হাদীস লেখার অনুমতি ছিল না কেননা তা কুরআনের সাথে মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল এবং ভয় ছিল কুরআনের মধ্যে এমন কিছু অনুপ্রবেশের যা কুরআনের অংশ নয়। নবীর(সা.) মৃত্যুর পর সে ভয় আর ছিল না কেননা কুরআন নাযিল হওয়া ইতিমধ্যেই পূর্ণতা লাভ করেছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পূর্বে এর ক্রমিক বিন্যাস নির্ধারিত হয়েছিল। তাই মুসলিমগণ এর পরবর্তীতে সুন্নাহকে সংরক্ষণ করার জন্য এবং হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য সংকলন করেন। ইসলাম ও মুসলিমদের পক্ষ হতে আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন, কেননা তাঁরা তাঁদের প্রভুর কিতাব এবং নবীর(সা.) সুন্নাহকে হারিয়ে যাওয়া ও বিকৃত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।



তাদেরকে আমরা জবাবে এ কথাও বলতে পারি: যদি শুকরিয়া জানানোই উদ্দেশ্য হয়, যেমনটি তারা দাবী করে থাকে, তবে তিনটি শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম, সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণের প্রজন্ম, যারা কিনা নবীকে(সা.) সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন এবং সৎকর্ম ও শুকরিয়া আদায়ে সবচেয়ে বেশী অগ্রগামী ছিলেন, তারা কেন এটি পালন করলেন না? যারা মিলাদুন্নবী পালনের এই বিদ'আত চালু করেছে, তারা কি তাঁদের [প্রথম তিন প্রজন্ম] থেকে অধিক হেদায়েত প্রাপ্ত? তারা কি আল্লাহর প্রতি অধিকতর শোকরগুজার? অবশ্যই নয়!



ষষ্ঠ ভ্রান্ত যুক্তি: তারা হয়ত দাবী করবে যে মিলাদুন্নবী উদযাপন নবীর(সঃ) প্রতি ভালবাসার প্রকাশ, নবীকে ভালবাসা যে কর্তব্য সেটা প্রকাশ করার এটা একটা পন্থা।



এর জবাবে বলা যায়: নিঃসন্দেহে নবীজীকে(সা.) ভালবাসা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক, প্রত্যেকের উচিৎ তাঁকে তার নিজের জীবন, তার সন্তান, তার পিতা এবং সকল মানুষ অপেক্ষা বেশী ভালবাসা - আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত হোন - কিন্তু এর মানে এই নয় যে, একাজের জন্য আমাদের বিদ'আতের জন্ম দিতে হবে, যার আদেশ আমাদেরকে দেয়া হয়নি। তাঁকে(সা.) ভালবাসা মানে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা, কেননা সেটাই ভালবাসার সবচেয়ে বড় পরিচয়, যেমনটি বলা হয়:



“যদি তোমার ভালবাসা খাঁটি হয়, তবে তার আনুগত্য কর; কেননা প্রেমিক তার ভালবাসার মানুষের বাধ্য হয়।”



নবীকে(সা.) ভালবাসার প্রকাশ ঘটে তাঁর সুন্নাতকে জীবন্ত করা, আঁকড়ে ধরা এবং সুন্নাত বিরোধী কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। নিসঃন্দেহে তাঁর সুন্নাত বিরোধী যেকোন কিছুই হচ্ছে তিরস্কারযোগ্য বিদ'আত, এবং তাঁর প্রকাশ্য অবাধ্যতা। মিলাদুন্নবী পালন এবং অন্যান্য বিদ'আত এর আওতাভুক্ত। ভাল নিয়্যত থাকলেই দ্বীনের মধ্যে কোন বিদ'আতের অনুপ্রবেশ ঘটানো জায়েয হয়ে যায় না। ইসলাম দুটি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত: খাঁটি নিয়্যত এবং নবীর(সা.) [সুন্নাতের] অনুসরণ, আল্লাহ বলেন:



“হাঁ, যে কেউই সৎকর্মপরায়ণ হিসেবে তার চেহারাকে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করবে, তার প্রতিদান তার রবের নিকট রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২:১১২)



চেহারাকে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করা অর্থ আল্লাহর প্রতি ইখলাস, আর সৎকর্মপরায়ণতা হচ্ছে নবীর সুন্নাতের বাস্তবায়ন।



সপ্তম ভ্রান্ত যুক্তি: তাদের অপর একটি ভ্রান্ত যুক্তি হচ্ছে এই যে মিলাদ উদযাপন এবং এ উপলক্ষে নবীর(সা.) সীরাত আলোচনার দ্বারা মানুষকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের আহবান জানানোই উদ্দেশ্য।



তাদের প্রতি আমাদের বক্তব্য হচ্ছে: নবীর(সা.) সীরাত অধ্যয়ন করা এবং তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা একজন মুসলিমের সার্বক্ষণিক কর্তব্য, গোটা জীবন ধরে এবং সারা বছরই তাকে তা করতে হবে। এই কাজের জন্য একটি বিশেষ দিনকে বেছে নেয়া, যার পক্ষে কোন দলীল নেই - তা বিদ'আত, আর “প্রতিটি বিদাতই পথভ্রষ্টতা।” (আহমদ, তিরমিযী) বিদাতের ফসল কেবলই মন্দ, আর এর দ্বারা একজন ব্যক্তি নবী(সা.) থেকে দূরে সরে যায়।



উপসংহারে বলা যায়, মিলাদুন্নবী উদযাপন - তা যে পন্থায়ই হোক না কেন, একটি তিরস্কারযোগ্য নব উদ্ভাবন। মুসলিমদের কর্তব্য এটি সহ অন্যান্য সকল বিদ'আতের অবসান ঘটানো এবং সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করা। এই বিদ'আতের রক্ষাকর্তা এবং প্রচারকারীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক নয়, কেননা এই লোকগুলো সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিবর্তে বিদ'আতকে জীবন্ত রাখতেই বেশী আগ্রহী; এদের কেউ কেউ আছে যারা সুন্নাতের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করে না। কেউ যদি এরকম হয়, তবে তার অনুকরণ ও অনুসরণ জায়েয নয়, অধিকাংশ লোক এই প্রকৃতির হলেও নয়। বরং আমাদের ধার্মিক পূর্বপুরুষ এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে তাদের দৃষ্টান্তই আমরা অনুসরণ করব, যারা সুন্নাতের পথে চলেছেন, তাদের সংখ্যা কম হলেও। কোন মতের পক্ষে মানুষের সংখ্যাধিক্য দ্বারা মতের সত্যাসত্য যাচাই হয় না, বরং যা সত্য সেটার আলোকে মানুষকে যাচাই করতে হবে।



নবী(সা.) বলেছেন:



“তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা বহু বিভক্তি দেখতে পাবে। আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি আমার এবং আমার পরবর্তী সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাতের অনুসরণ করার। শক্তভাবে একে আঁকড়ে ধরে থাক। [দ্বীনের মধ্যে] নব উদ্ভাবিত বিষয় সম্পর্কে সাবধান থাক, কেননা প্রতিটি বিদাতই পথভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, তিরমিযী)



সুতরাং নবী(সা.) এই হাদীসে আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে মতভেদের ক্ষেত্রে কি করতে হবে, যেমনটি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, তাঁর সুন্নাত বিরোধী যেকোন কথা বা কাজই বিদ'আত এবং প্রতিটি বিদ'আতই পথভ্রষ্টতা।



যখন আমরা দেখতে পাই যে, মিলাদুন্নবী উদযাপনের কোন ভিত্তি নবীর(সা.) অথবা খুলাফায় রাশিদীনের সুন্নাতে নেই, তার অর্থই হচ্ছে এটা নব উদ্ভাবিত বহু বিদাতের একটি, যা মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। এই মূলনীতিই হাদীস থেকে লব্ধ এবং নিম্নোক্ত আয়াতে নির্দেশিত:



“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, তাঁর রাসূল এবং তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল, তাদের আনুগত্য কর। যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতবিরোধে উপনীত হও, তবে তার সিদ্ধান্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই উত্তম এবং পরিণতিতে সবচেয়ে সুন্দর।” (সূরা আন নিসা, ৪:৫৯)



এই আয়াতে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া অর্থ হচ্ছে কুরআনের ওপর ছেড়ে দেয়া, আর রাসূলের(সা.) দিকে ফিরিয়ে দেয়া অর্থ হচ্ছে তাঁর মৃত্যুর পরে সুন্নাতের ওপর ছেড়ে দেয়া। মতবিরোধের ক্ষেত্রে কুর'আন এবং সুন্নাহই হচ্ছে সত্যাসত্যের মাপকাঠি। কুর'আন বা সুন্নাহতে কোথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইসলাম মিলাদুন্নবী উদযাপনকে উৎসাহিত করে? যারাই মনে করছে যে এটা ভাল কিছু, তাদেরকে অবশ্যই এর জন্য এবং সকল বিদ'আতের জন্য আল্লাহর নিকট তওবা করতে হবে। সত্যের সন্ধানী একজন মুসলিমের জন্য এটাই হচ্ছে সঠিক আচরণ। কিন্তু প্রমাণ পাওয়ার পরও যে উদ্ধত হবে ও গোঁড়ামী করবে, তবে সেক্ষেত্রে তার হিসাব-নিকাশ হবে তার রবের সাথে।



আমরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই তাঁর সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে। কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ(সা.) এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের ওপর।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম