উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্বরতা

উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতির জাতীয় আন্দোলন চলছে যার লক্ষ্য একাধিক স্বাধীন জাতীয়-রাষ্ট্র গঠন। রাজনৈতিকভাবে এ সকল আন্দোলন মোকাবেলায় ব্যর্থ ভারত সরকার সামরিক শক্তির জোরে সেখানে ভারতীয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য সমূহে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিপুল উপস্থিতি এবং কার্যত সামরিক শাসন সেখানকার জনজীবনকে করেছে বিপর্যস্ত। সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন প্যারামিলিটারী বাহিনী, পুলিশ বাহিনী প্রভৃতি শুধু যে বলপ্রয়োগই করছে তাই নয়, সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতনও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এ সকল নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বিরোধী কমিটি’ ২০০৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আসাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা রাজ্যে ব্যাপক সফর ও তদন্তের ভিত্তিতে তারা প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন। Accused Indian Army: Women’s Testimonies from Northeast-

শিরোনামের উক্ত বইটির কিছু অংশ সংস্কৃতি-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাষান্তর করেছেন আশরাফ আহমদ সিদ্দিকী।

সালফা

উলফা সংগঠনের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে যারা ভারত সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে; এই সমস্ত আত্মসমর্পণকারীদের ‘সালফা’ (Sulfa – Surrendered ULFA) নামে অভিহিত করা হয়। এ সমস্ত লোকদেরকে ভারত সরকার অস্ত্র, অর্থ ও যানবাহন সরবরাহ করে। উলফা সদস্য এবং তাদের পরিবারবর্গকে ভীতি প্রদর্শন ও হত্যা করার জন্য সালফা-কে ব্যবহার করা হয়। এরা হলো সরকার ও সেনাবাহিনী পরিচালিত গোপন হত্যাকারীদের এক বাহিনী। কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ এই হত্যাকারীদেরকে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার আশ্বাসে আসামের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু গগৈ ক্ষমতা গ্রহণের পরেও এই সমস্ত হত্যাকান্ড কমেনি।

কারবি আংলাং
কারবি আংলাং হচ্ছে আসামের পর্বতসঙ্কুল এবং ঘন বন সমৃদ্ধ এক দূরবর্তী এলাকা। এই এলাকার মূল বসবাসকারী কারবি এবং অন্য জাতিগোষ্ঠী- দামাসাস, খাসিয়া, নাগা, বোড়ো, নেপালী, কুকী। অহমিয়ারা ছাড়াও আছে বিহারী অভিবাসী। কারবিরা হলো একটি সমজাতিক জাতিগোষ্ঠী, তারা ভৌগোলিক দিক দিয়ে একটানাভাবে লাগোয়া অঞ্চলে বসবাস করে। ১৯৯৫ সালে কারবি আংলাং স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিল (kaak-karbi analong council) গঠিত হয়। এর হাতে ৩০টি বিভাগীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। এই জেলা শাসনতন্ত্রের ষষ্ঠ সিডিউল-এর ধারা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত জেলা হিসাবে ঘোষিত হয়। হিন্দিভাষী অভিবাসী এবং দেশজ কারবি ভাষীদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় জমির ব্যবহার ও দখলীকরণ প্রক্রিয়ায়। কারবিরা ব্রহ্মপুত্রের সমতলের অধিবাসীদের জন্য ‘নির্দিষ্ট সিডিউল’ বর্ণিত অধিকারী থেকে বঞ্চিত।
‘রাজ্য স্বায়ত্তশাসন দাবী পরিষদ’ (The Antonomous State Demand Council (ASDC) নামে- ১৯৮৬ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এ দলের মূল স্লোগান হলো- ‘স্বায়ত্তশাসন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নয়’ No Autonomous State, No Rest)। আসাম গণপরিষদ (AGP) এ দাবীর মোকাবেলা করে দমনপীড়নের মাধ্যমে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
UPD (United People’s Democratic Soliderity) একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক দল যারা রাজ্য সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এদের কর্মকান্ডের লক্ষ্য হলোÑ ‘অ-কারবিয়দের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’ বিশেষ করে গাঙ্গেয় উপত্যকার সমতল অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসনকারীদের প্রতিরোধ করা যারা হিমালয়ভুক্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে দখল কায়েম করেছে. যার মধ্যে কারবিয় অধিকারভুক্ত এলাকাসমূহও রয়েছে। বহু UPD সদস্যকে রাজ্য কর্তৃপক্ষ হত্যা করেছে এবং শত শত নিরীহ মানুষকে TADA আইনে অভিযুক্ত করেছে।

বোড়ো আন্দোলন
রাজ্যের সমতল অঞ্চলের বৃহত্তম গোত্র হলো বোড়ো জনগোষ্ঠী। তারা মূলত কৃষিজীবী যদিও একই সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে না। বোড়োদের আছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি, আছে নিজস্ব জীবনধারা ও সনাতন কর্মঐতিহ্য। জবরদস্তিমূলকভাবে তাদেরকে বাধ্য করা হয় হিন্দুধর্মভুক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু তারা তাদের আত্মপরিচয় বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান, যা তারা হারিয়ে যেতে বসেছিলেন ব্রিটিশ ও ভারতীয় শাসন আমলে। এমনকি বোড়ো ভাষা প্রচলনের ন্যায্য দাবি থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছিলেন। সশস্ত্র দমনপীড়নের মাধ্যমে নিবৃত্ত করা হয় সে আন্দোলনকে। ১৯৮০-র দশকে বোড়ো জনগোষ্ঠীর উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো গণতন্ত্রের বিবেককে তাড়া করে ফিরছিল। বোড়োরা চাইছিল তাদের ভাষার জন্য রোমান হরফ ব্যবহার করতে, কিন্তু সরকার চাপিয়ে দিল দেবনাগরী হরফ।
বোড়োরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে প্রধানতঃ কোকরাঝার, দাড়রাং এবং মোনিতপুর জেলাসমূহে। আসামের বোড়ো অধ্যুষিত এলাকায় National Democratic Front of Bodo (NDFB) কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত চুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে শুরু করে তাদের স্বাধীন বোড়োল্যান্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলন সামগ্রিকভাবে বোড়ো জনগণের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলে। ঠিক এই সময়ে ভারত সরকার কিছু কিছু বোড়ো নেতাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে গড়ে তোলে বোড়ো টাইগারস আন্দোলন (Bodo Libration Tigers) যারা রেললাইন উপড়িয়ে ফেলার মত কাজকে তাদের কৃতিত্ব বলে দাবী করে। উলফাও বোড়োল্যান্ডের দাবীকে সমর্থন দেয়।
ব্যাপক জনসমাবেশ, অনশন আন্দোলন, দীর্ঘস্থায়ী বন্ধ কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বাধীন বোড়োল্যান্ড প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ১০১ দিনের লাগাতার বন্ধ পালিত হয়। অহমিয়া ও বোড়োদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে যায়। রাজ্য সরকার কোকরাঝারকে উপদ্রুত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। শত মত মানুষকে TADA আইনে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ বহু নারীকে ধর্ষণ করে। আসাম পুলিশ বাহিনীকে তাদের অঞ্চলে প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীরা সেতু উড়িযে দেয়, রাস্তাঘাট কেটে ফেলে, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয়।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন
নারী ধর্ষণ, গুম করে দেওয়া, গ্রেফতার, বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ভীতি প্রদর্শন শ্লীলতাহানি, লুটপাট, নিরাপত্তা বাহিনী লেলিয়ে ভীতি সঞ্চার প্রভৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিত্যদিনের ঘটনা। গ্রামগুলো পরিণত হয়েছিল বন্দী শিবিরে। আসাম এখনো বিবেচিত হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকা সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ভারতের সর্ববৃহৎ অঞ্চল হিসাবে। এখানে সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ড, পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীসহ বেসামরিক প্রশাসন সবাই মিলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ জারি রেখেছে। আসাম গণপরিষদ সরকার নির্লজ্জভাবে যৌথ কমান্ডের নামে প্রকৃত অর্থে আসামে সামরিক শাসন চালু রেখেছে। এটা হলো সেই সরকার যারা সামরিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছিল। এ অঞ্চলে প্রবর্তিত সামরিক আইনসমূহের মধ্যে রয়েছে আসাম আইন শৃঙ্খলা রক্ষা আইন ১৯৫৩ (Assam Maintenance of Public Order Act 1953), আসাম উপদ্রুত এলাকা আইন ১৯৫৫, সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৫৮ (Armed Forces Special Power Act 1958), নাগাল্যান্ড নিরাপত্তা আইন ১৯৬২ (Nagaland Secourity Act. 1962) ইত্যাদি। এসব আইন এ অঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনী সমূহকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়। সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৫৮ যথোচিত আলোচনা ছাড়াই পাস হয় ভারতীয় পার্লামেন্টে। ১৯৭২ সাল নাগাদ এই আইনের বিস্তার ঘটানো হয় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে। সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। মাছ, ডিম, দুধ, তরিতরকারী ইত্যাদি সাধারণ জনগণের কাছে দুর্লভ হয়ে পড়েছে। ১৯৯০ সাল নাগাদ আসাম পরিণত হয় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও গণতন্ত্র হত্যার এক বিশাল বধ্যভূমিতে।


প্রকৃত ঘটনাবলীর অনুসন্ধান রিপোর্ট
১. তারিখ : ২৪ এপ্রিল ১৯৯৭
ঘটনার প্রকৃতি : ধর্ষণ
নাম : টুলুমণি দেবী (২৮)
স্থান : ঘুমাতিগাঁও, কোপাহারা, মোরেগাঁও জেলা।
উলফার খোঁজে গ্রামে আসে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। সমস্ত গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে তারা। আনুমানিক বেলা ২টার দিকে তাদের জনাতিনেক টুলুমনির বাড়িতে ঢুকে পড়ে। টুলুমনির ছোট দোকান মালিক স্বামী তখন জিনিষপত্র কিনতে বাইরে গিয়েছিল। সৈন্যরা টুলুমনির ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। টুলুমণি দেখতে পায় সৈন্যরা তার ভাইকে প্রহার করছে। ভীতসন্ত্রস্ত টুলুমণি তার নয় মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তাদেরকে অনুসরণ করে। সৈন্যরা হঠাৎ করে তাকে তার কুঁড়েঘরের পেছনে টেনে নিয়ে যায়। একজন তার ভাইটিকে একটি দশ টাকার নোট দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দেয় এবং বাকি দুজন টুলুমনিকে ধর্ষণ করে। এর আগে তারা ওকে বেদমভাবে প্রহার করে। গ্রামবাসীরা পরে ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পারে একাট্টা হয়ে বেরিয়ে এলে সৈন্যরা ধরা পড়ে।
টুলুমণি এক প্রতিবেশীর বাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রতিবেশীরা তাকে তার মায়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। মা তাকে ঘটনাটি কারুর কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করে। টুলুমণি সামরিক বাহিনীর এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে নির্বিচারে ছেড়ে না দেওয়ার দৃঢ় তাগিদ অনুভব করেন। সে তার স্বামী ও কিছু গ্রামবাসীসহ মিকিরভিটা থানায় যায় অভিযোগ নিয়ে।
পুলিশ তাকে নিয়ে যায় মোরেগাঁওয়ে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য। পুলিশ তাকে আশ্বস্ত করে তারা সামরিক বাহিনীর কাছে এই অপরাধ কর্মের জন্য সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আবেদন করবে। কিন্তু টুলুমণি জানায়, সে কোন প্রতিকারই পায়নি। সামরিক বাহিনী কোনোরকম তদন্ত করেনিÑ অপরাধী শনাক্তকরণও করেনি। স্থানীয় পত্রিকাসমূহ ঘটনাটি প্রকাশ করে। বিভিন্ন গণসংগঠন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। এমনকি একজন মন্ত্রী দিগেনবোরা (বর্তমানে প্রয়াত) টুলুমণির বাড়িতে আসেন। সে আদালতের শরণাপন্ন হয়। তাকে সেখানে দুবার তলব করার হয়। মামলাটি এখনো ঝুলে আছে।
সামরিক বাহিনীর লোকেরা যখন তার বাড়িতে এসে তার ছোট ভাইটিকে ধরে নিয়ে যায়, তখন তারা উলফা বা অন্য কোনো কারণই উল্লেখ করেনি। উপরি-উপরি সাক্ষাতে তারা ওর প্রতি সমবেদনা জানালেও অসাক্ষাতে তারা ওকে উপহাসই করেছে ঘটনাটর জন্য। ওর স্বামীর স্বাস্থ্য হঠাৎই ভেঙে পড়েছে। সে তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছেÑ টুলুমণি আমাদেরকে জানায়। আমার স্বামী ঘটনাটি ভুলতে পারে না এবং আমাকেও ভুলে যেতে দেয় না।

২. তারিখ : ২১ এপ্রিল ১৯১৭
ঘটনার প্রকৃতি : ধর্ষণ
নাম : জাপা দেউড়ি (৪২)
স্থান : তাঘরিয়া, জাগিরদ, মোরিগাঁও জেলা।
রাত্রে চারটি গাড়িতে চড়ে গ্রামে আসে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। সংখ্যায় তারা পনেরো থেকে বিশ জন ছিল। তারা বলে, উলফার রাজনৈতিক কর্মীদের সন্ধানে এসেছে। জাপা দেউড়ির দরজায় আঘাত করে তারা। তার স্বামী মিঠান দেউড়িকে বেরিয়ে আসতে বলে। মিঠান পেশায় একজন কাঠুরে। সৈন্যরা তাকে প্রহর করতে করতে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে নিয়ে যায়, যে পরিবারের একজন সদস্য ছিল উলফার কর্মী। আর ওদের কয়েকজন রয়ে যায় জাপা দেউড়ির বাড়িতে। জাপার চারটি মেয়ে, ওরা সবাই গভীর ঘুমে ছিল। সৈন্যরা তাকে উত্যক্ত করতে থাকলে জাপা ভয়ে পালিয়ে গিয়ে একটি ধানক্ষেতে লুকায়। সৈন্যরা তাকে তাড়া করে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে পেয়েও যায়। এরপর দুজন সৈনিক ওর ওপর নির্মম পাশবিক অত্যাচার চালায়। এই ঘটনা তিয়া মহিলা কমিউনিটির গোচরে আসে। তারা তিয়া ছাত্র ইউনিয়ন, AASU ও MASS এর সাথে যৌথভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। জাপা দেউড়িকে অবশেষে মোরেগাঁও হাসপাতালে নেওয়া হয় মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য। একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন, কিন্তু কেউই এ অপরাধের শাস্তি পায়নি।

৩. তারিখ : ১৯ জুন ২০০২
ঘটনার প্রকৃতি : যৌন নিগ্রহ
নাম : রজনী তিমুংপি (১৪)
স্থান : দিখলেম, খেরোনি, কারবি আংলাং জেলা।
রজনী তিমুংপি সকালে যখন মুখ-হাত ধুচ্ছিল সে সময় ওয়াকিটকি হাতে সেনাবাহিনীর এক লোক ওদের আঙ্গিনায় প্রবেশ করলে সে বাড়ির বাইরে চলে আসে। সৈনিকটি তখন ওকে আটক করে ঘর খুলে দিতে বলে এবং সেখানে একটি বাক্সের মধ্যে কী আছে দেখতে বলে। রজনী বাক্সটি খুলে দেখায়, কিছুই ছিল না তার মধ্যে। এরপর সৈন্যটি জানতে চায় সে কেন বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল। মেয়েটি ভয়ে কাঁদতে থাকে। সৈন্যটি ওয়াকিটকি দিয়ে মেয়েটির কাঁধে আঘাত করে। আদেশ করে উপরে হাত তুলতে। সে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়েটির কান্না শুনে তার ভাই এগিয়ে এসে তার বোনকে উদ্ধার করে ও সৈন্যটিকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়।
রজনীর তিন ভাই সৈনিকটিকে অনুসরণ করে। বাড়ির সব মেয়েরা ও মহিলারা ওদেরকে অনুসরণ করে। সৈনিকটি তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে বলে। এলাকার লোকেরা তাকে রাস্তার মাঝখানে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সে চেষ্টা করছিল ওখান থেকে একট সামরিক জিপে চড়ে বসতে। মহিলারা জিপটির গতিরোধ করে দাঁড়িয়ে যায়। ওটা ছিল একটা টাটা সুমো জিপ। জিপের ভেতরে ডজন খানেক সামরিক লোক ছিল। গ্রামবাসীরা তিন দিক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। মহিলাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা হাওয়াপুর রেলস্টেশনের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসতে বাধ্য হয়Ñ কেননা স্টেশন থেকে আর যাওয়ার কোন রাস্তা ছিল না। ইতিমধ্যে মহিলা, শিশু ও অন্যান্য গ্রামবাসীরা খেরোনি পুলিশ স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। জিপটি ফিরে আসছে দেখে তারা আবার রাস্তা অবরোধ করে। তারা সামরিক লোকদেরকে থামতে বলেন এবং অপকর্মকারী সদস্যকে তাদের কাছে হস্তান্তর করতে বলে। মেয়েরা লাঠি দিয়ে সামরিক বাহিনীর লোকদের ওপর করতে থাকে ও পাড়ির গ্লাস ভেঙে ফেলে। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের মহিলাদেরকে সংগঠিত করে তাদের সাথে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য। তারা সামরিক যানটিকে খেরোনি পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত যেতে বাধ্য করে। তারা সামরিক বাহিনীর এসব অপকর্ম সম্পর্কে অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনসমূহকে অবগত করে। বহু গণসংগঠন এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং পুলিশকে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানায়। যথারীতি এ অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি 

উপদ্রুত রাজ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণী : আসাম

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের  ২৩টি জেলা নিয়ে গঠিত সাতটি রাজ্যের মধ্যে আসাম হচ্ছে সর্ববৃহৎ। বাঙলাদেশ ও ভুটানের সঙ্গে রয়েছে আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা। পশ্চিমে পরিবেষ্টিত পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ সীমান্ত দ্বারা। দক্ষিণে মিজোরাম, মেঘালয় ও মনিপুর, পূর্বে নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ আর উত্তরে অরুণাচল প্রদেশ ও ভুটান। আসাম হচ্ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশ দ্বার।

আসামের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে গ্রীষ্ম অঞ্চলীয় চিরসবুজ, ঘন বাঁশঝাড় সমৃদ্ধ উঁচু এলাকা। এখানকার লোকেরা নানাধরনের সুন্দর জিনিস ও বাড়িঘর তৈরী করে বাঁশ দিয়ে। কচি বাঁশের তৈরী নানা ধরনের খাবারও তৈরী করে, যেমন- বাঁশের চাল ও বাঁশের আচার। আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষেরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা আসামের মানুষদের প্রধান খাদ্য চাউল উৎপাদনের ক্ষেত্র। অন্যান্য কৃষিপণ্য হচ্ছে পাট, আখ, তুলা, কমলালেবু ও আলু। রেশমের গুটিপোকার চাষও হয় ব্যাপক অঞ্চলে। আসামের গ্রাম অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বয়নযন্ত্র আছে এবং মহিলারা কাপড় তৈরিতে নিয়োজিত থাকেন। বনসম্পদ ও অপরিশোধিত তেল উত্তোলন আসামের সবচেয়ে মূল্যবান অর্থনৈতিক উৎস হিসাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এ রাজ্যের বৈশিষ্ট্য।

প্রাক-উপনিবেশিক আসামের ইতিহাস

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, শান বংশোদ্ভুত অহমিয়াদের দ্বারা আসাম রাজ্যের পত্তন হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে অহম রাজ্য গঠিত হয়। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী এই প্রথমবারের মতো একক শাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। অহমিয়ারা সবসময় ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে দূরে থাকার নীতি অনুসরণ করেছে। এই কারণে অহম শাসকদের সাথে অধিকাংশ গোত্রের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এটা তাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়তা করেছিল। অহম রাজা প্রায় ৬০০ বছর যাবত তাদের শাসন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

প্রাক উপনিবেশিক আমলে অধিকাংশ গোত্র ছিল মাতৃতান্ত্রিক এবং সে কারণে সম্পত্তির উত্তরাধিকার, পারিবারিক আইন ইত্যাদি প্রশ্নে মেয়েদের অধিকার ছিল যথেষ্ট উচ্চ স্তরে। উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের মতোই মেয়েরাও সর্বস্তরে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু হিন্দুত্ববাদের প্রচলন প্রক্রিয়ায় সামাজিক ও গোত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব কিছু থেকে নারীর ভূমিকাকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ শাসকদের হাত ধরে বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ এবং আসামে ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে বৃটিশরা গাঙ্গেয় উপত্যকার অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় মূল ভূমির ধর্মীয় বর্ণবাদ প্রথার প্রাধান্য আসামেও প্রবর্তন করে।

অহম শাসকদের নেতৃত্ব মুঘল শাসকদের প্রায় ১৭টি আক্রমণ আসামের বিভিন্ন গোত্রের সহায়তায় প্রতিরোধ করে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখে। ১৮২২ সাল থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত বার্মিজরা আসামকে দখল করে রাখে। ১৮২৬ সালে বৃটিশরা বার্মিজদের পরাজিত ও বিতাড়ণ করে কুখ্যাত ইয়ান্দাবু চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আসামকে অবিভক্ত ভারতের শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন করা হয়। অহমীয়রা কিন্তু এই সন্ধি চুক্তির পক্ষে ছিল না। তৎকালীন আসাম শাসকরাও এই চুক্তিকে অনুমোদন দেয়নি। কেবল মাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিযে বৃটিশরা ১৮২৬ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত আসামে সামরিক শাসন জারী রাখে।

১৮৩৮ সালে অহম রাজ পুরান্দার সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করে আসামকে ব্রিটিশরা পুরোপুরি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আওতাভুক্ত করে। বিভেদ এবং শাসন নীতির অনুসরণে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা অহমিয়া এবং বাঙ্গালী অভিবাসীদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টিতে প্ররোচনা দেয়।

প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের উদ্দেশ্যে বৃটিশরা ১৮৪৭ সালে ব্রহ্মপুত্র স্টিমার সার্ভিস চালু করে এবং আসামের চা উৎপাদন অঞ্চল থেকে চা পরিবহনের জন্য রেলওয়ে লাইন স্থাপন করে। বৃটিশরাই প্রথম ডিগবয়ে এশিয়ার প্রথম তেল শোধনাগার স্থাপন করে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক শোষণের একটি সহজতম বাহন হিসাবে ব্যবহার করা হয় রেলওয়েকে এবং শিল্প উৎপাদন হয়ে দাঁড়ায় উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের মাধ্যম।

কৃষকদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চেপে বসায়, আসাম অঞ্চলে বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের উদ্ভব হয়। কৃষকরা বিভিন্ন সুসংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে বৃটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা আসামের বিভিন্ন শহরে ‘রায়ত’ সভা গড়ে তোলে। এইসব সভাগুলো সংগঠিত হয়েছিল শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব, এক একটি শক্ত কৃষক ঘাঁটি হিসাবে। তারা প্রধানত আওয়াজ তোলে ‘বায়ত’দের দাবি-দাওয়া নিয়ে। এই সভাগুলো ১৮৮২ সালে গঠিত আসাম এসোসিয়েশন বীজ পত্তন করে। ১৯২১ সালের আসামে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শাখা প্রতিষ্ঠার আগে, এই আসাম এসোসিয়েশনই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন।

একমাত্র প্লানটেশনের কাজেই বৃটিশরা নারীদেরকে পুরুষের সাথে কাজ করতে উৎসাহিত করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কঠিন দারিদ্র্যের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে গিয়ে সাহসী নারীরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকেন। বহু নারী এইভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন।

স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে মনে হলো গান্ধীসহ ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব, পশ্চাৎপদ জাতিসমূহের দুর্ভোগ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ঠিক এই সময় তারা ১৯৪২ সালে তারা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন যাতে স্বাধীনতার পর রাজ্যগুলিকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন শাসন দেওয়ায় অঙ্গীকার করে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। এই প্রস্তাবে তারা সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেন কোন আঞ্চলিক ইউনিটকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতীয় ইউনিয়নের যোগ দিতে বাধ্য করা হবে না এবং এ ধরনের প্রতিটি ইউনিটের বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সহজেই এই প্রস্তাব থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শাসকরা দূরে সরে গেলেন। যদিও অহমিয়ারা কোনোক্রমেই ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দিতে চায়নি, তথাপি জোরপূর্বক তাদেরকে এই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভূক্তির বিরুদ্ধে অহমিয়াদের প্রধান যুক্তি হচ্ছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৫-১২-১৯৬০ তারিখে গৃহীত প্রস্তাব [প্রস্তাব নং ১৫৪১ {XV}-এর ধারা VI] নীতিমালা অনুযায়ী আসাম এলাকা হচ্ছে ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় শাসন বহির্ভূত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল।

আসাম আন্দোলন

বিদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন : ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০-৫০ লক্ষ লোক আসামে প্রবেশ করে। বৃটিশরা তাদের কুটকৌশল অনুযায়ী অনেক আগে থেকেই আসামে বাইরের লোকদের অভিবাসন ঘটাতে থাকে। এই সব অভিবাসীরা আসামের উর্বর ভূমিগুলি দখল করতে থাকে এবং এই প্রবণতা কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকে। কারণ জনসংখ্যা বাড়লে সরকারের ভোট সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে উত্তেজনার একটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আসাম ছাত্র ইউনিয়ন (All Asam Students’ Union) ১৯৭৯ সালে পুরো আসাম জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের দাবি ছিল, সমস্ত অভিবাসীদের শনাক্তকরণ ও তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো এবং ভোটার লিস্ট থেকেও তাদের নাম কেটে দেয়া। চার বছর ধরে এ আন্দোলন চলতে থাকে। আসামের জনগণ তেল শোধনাগারগুলিতে বন্ধ এবং হরতাল কর্মসূচি পালন করে। এমনকি তারা বুলেট ও লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে তেলের পাইপ লাইন কেটে দেয়ার চেষ্টা করে। এই বিদেশী খেদাও আন্দোলন পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে দমন করা হয়। দুলিয়াজানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপরে পুলিশ, সিআরপিএফ (কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) এবং বিএসএফ প্রায় ৮০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। আসামের যুবশ্রেণী অনুধাবন করল শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় তাদের দাবি পূরণ অসম্ভব। এইভাবে উলফা-র (All Asam Students’ Union) জন্ম হলো। তাদের দাবি হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার। একই বছর পূর্বতন আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ‘আসাম গণপরিষদ’ নামে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৮৩ সালে জনগণের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এমনকি প্রাদেশিক সরকারের অনেক কর্মচারীই এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আসাম গণপরিষদ ক্ষমতায় আসে।

অথনৈতিক লুণ্ঠন

আসামের আছে চা, উন্নতমানের কাঠ ও বনজ সম্পদ, তেল ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর মালিক কেউ নয়। আসামের স্থানীয় পুঁজি বিনিয়োগ অত্যন্ত সীমিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ও বহিরাগতরা পুঁজিপতিরা সকল চা বাগানের মালিক। তাদের বার্ষিক আয় কোটি কোটি রুপি অথচ আসাম তা থেকে পায় অতি সামান্য। শাসনতন্ত্রের সপ্তম তফশিল (Schedule VII) অনুসারে মাটির নিচের সব সম্পদই কেন্দ্রীয় সরকারের। অতএব তেল সম্পদ থেকে যা কিছু আয় হোক না কেন, তার সবটাই যায় কেন্দ্রীয় কোষাগারে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি আসামে লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। বাগান শ্রমিকেরা হচ্ছেন এক শোষিত শ্রেণী। চা শিল্পের প্রায় সকল শ্রমিক বিহার এবং বাংলা থেকে আগত অভিবাসী। আসামে বিশাল কয়লার মজুদ আছে কিন্তু কয়লা নির্ভরশীল কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে নি। কোন শিল্প উন্নয়ন ঘটে নি সেখানে এবং বেকারত্বের হার অনেক বেশী।

ভারতীয় সরকার উপযুক্ত প্রযুক্তি কৌশল প্রয়োগ না করে, তেলকূপগুলি থেকে বেরিয়ে আসা মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাসের ফলপ্রসূ ব্যবহার না করে পুড়িয়ে ফেলে লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করছে। আসামের জনগণ কোন সময়ই তেল সম্পদের আয় থেকে কোনই সুবিধা ভোগ করতে পারে নাই। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়মূলক শোষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।

উলফা (United Liberation Front of Asam)

১৯৭৯ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখে ‘উলফা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয় দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম আসাম প্রতিষ্ঠা করা। ভারতীয় দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সশস্ত্র ছোট ছোট স্কোয়াড গঠন করে উলফা ভারতীয় রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার অর্জনে সচেষ্ট হয়।

সামাজিক কল্যাণমূলক অনেক কাজ করায় তারা যথেষ্ট জনসমর্থন লাভ করে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মদ্যপানবিরোধী, নারীদের উত্যক্ত করা বিরোধী, পতিতাবৃত্তিবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে উলফা। ১৯৬৭ সালের ‘বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইন’ (Unlawful activities [Prevention] act, 1967) প্রয়োগ ১৯৯০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার করে আসাম গণপরিষদ সরকারকে বরখাস্ত করে এবং উলফাকে নিষিদ্ধ করে। একই সাথে উলফাকে ধ্বংস করার জন্য শুরু করে ‘অপারেশন বজরাং’।



-সঙ্কলন : দ্রোহ.নেট

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম