ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসার গল্প

হঠাৎ ধুপ করে একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ ও শুনতে পেলাম, সেই সাথে মহিলাদের বিলাপ, বাচ্চাদের হাউ মাউ কন্না আর যুবকদের আল্লাহ আল্লাহগো, আব্বাগো। একজন মহিলা চিৎকার করছিলেন- সীমান্ত, আমার সীমান্ত কই???  নিজেকে আবিষ্কার করলাম অন্ধকার একটা কুঠুরীতে। হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। মনে পড়ে গেল রাত ১২।১৫ মিনিটে বাসে উঠেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে - ঢাকা যাব বলে।কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টেরই পাই নি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম- রাত ২।৩৫ মিনিট। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলাম। বাসে উঠার সময় ব্যাগ পায়ের কাছে ব্যাগ রেখেছিলাম । খুঁজে বের করলাম। ব্যাগের ভিতরে প্রিয় বন্ধু ল্যাপটপটা ঠিক মত আছে কিনা আল্লাহই জানেন। এক পায়ে জুতা আছে, আর এক পায়ে নেই। চারদিকে কাঁচ ভাঙ্গা।জুতা খুঁজতে লাগলাম- মোবাইলের আলোতে। পাশের সীটের লোক একটা জুতা এগিয়ে দিল- 'দেখেন তো আপনার নাকি?' হ্যাঁ ভাই আমার। দেখলাম পুলিশের লোকজন এসেছে-লাইট মারছে ভিতরে। আমার সবকিছু collection শেষ। so , বের হলাম আস্তে আস্তে সামনের ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড দিয়ে। বের হয়ে দেখি আরো অনেক লোকজন। কারো মাথা ফাটা, কারো মাথায় কাঁচ ঢুকেছে, বেশীরভাগেরই হাত পা থেকে রক্ত পড়ছে। এইদিকে দশ হাত দূরেই রেল ক্রসিং। ঝিক ঝিক করে রেল যাচ্ছে । আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম কয়েকবার। যদি বাসটা এখন রেল লাইনের উপরে থাকত !!! আমার ব্যাগে ২ টা পাঞ্জাবী ছিল। কালো পাঞ্জাবীটা বের করে হাত বাঁধলাম। মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে একটা  responsibility  feel করলাম- যদিও আমার অবস্থাও খারাপ। সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম- আপনাদের ক্ষতস্থানগুলো আগে শক্ত করে বেঁধে ফেলুন- শার্ট , গেঞ্জী , ওড়না যার যা আছে- আগে রক্ত পড়া বন্ধ করেন সবাই। আমার বয়েসী এক যুবক তার শার্টের বোতাম খুলে ভিতরে গেঞ্জী দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল- ভাই এইটাতে হইব না? বললাম- অবশ্যই হবে- তাড়াতাড়ি বাঁধেন- রক্ত পড়া বন্ধ করেন আগে। পুলিশের এক সদস্যকে বললাম- পিক আপে করে তাড়াতাড়ি গুরুতর জখমীদের আশে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যান। শালাদের কোন খবরই নাই। বিভিন্ন যায়গায় phone দিচ্ছি- কেউ receive ও করছে না। এত রাতে কেউ কেউ disturb feel করে মোবাইলই বন্ধ করে দিল। সবার আগে message করল বরিশাল মেডিকেল কলেজের ( এক্স কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ) প্রিয় বন্ধু- ফাহিম। ' sms please.' উত্তর দিলাম- dost mara jacchi- road accident. pls call me. সাথে সাথে ফাহিম ফোন করল- লোকেশান বললাম ওকে- ফতেহপুর রেল ক্রসিং ফেনী। একটু পরে ফেনীর আনোয়ার ভাই ফোন করলেন। ততক্ষনে পুলিশের ভ্যানে করে ফেনী সদর  
হাস্পাতালের দিকে রওয়ানা দিয়েছি। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ডাক্তার, মেডিকেল এসিস্ট্যান্টদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হল আগে। একে একে সবার সেলাই- ড্রেসিং সম্পন্ন করা হল। ফেনীর এক পরিচিত ভাই এসে আমাকে উনাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে rest নিতে নিতে ভাবছিলাম- এভাবে রাতের অন্ধকারে আচমকা হামলায় ফিলিস্তিন কিংবা ইরাকের কোন ঘর যখন ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয় আর সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে যখন কেউ আহত অবস্থায় জীবিত বের হয়ে এসে দেখে তার প্রিয় আব্বাজনের মাথা নাই- আম্মাজানের হাত পা নাই; বোনের প্রিয় মুখখানি ক্ষতবিক্ষত- কেমন লাগে তাদের তখন? কিম্বা ধ্বংসস্তূপের ভিতরেই কেউ যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে- কেমন লাগে তখন? অথবা আমাদের এই শান্তির বাংলাদেশে যেখানে মার্কিন হামলার ভয় নেই- কিন্তু ট্রাফিক অনিয়ম, ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ী চালনা, ঘনঘন ওভারটেকিং এর কারনে প্রায়শই বাস accident এর কবলে পড়ে যারা রাতের অন্ধকারেই মারা যাচ্ছে -শেষ মুহূর্ত গুলো কেমন কাটে তাদের? আজ যদি আমি ও শেষ নিশ্বাস ত্যগ করতাম- বাসের তলায় - কেমন লাগত তখন??!!



বাস ছিল হানিফ এর। 
 
 
- Mohammed Shorfuddin Patowary 

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম