মহাকবি আল্লামা ইকবাল : জীবন ও কাজ

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (জন্ম নভেম্বর ৯, ১৮৭৭; শিয়ালকোট, পাঞ্জাব - মৃত্যু: এপ্রিল ২১, ১৯৩৮) ছিলেন বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের মুসলিম কবি, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ। তাঁর ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইকবাল তাঁর ধর্মীয় ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত চিন্তা দর্শন হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। তাঁর নাম মুহাম্মদ ইকবাল হলেও তিনি আল্লামা ইকবাল হিসেবেই অধিক পরিচিত। আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষাবিদ । তাঁর ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ; তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামে পরিচিত।

আল্লামা ইকবালের ১২৯৪ হিজরী ৩রা যিলকদ মোতাবেক ১৮৭৭ খৃস্টাব্দে ৯ই নভেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লামা ইকবালের পিতার নাম শেখ নূর মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন একজন সূফী-দরবেশ শ্রেণীর লোক। ইলমে তাছাউফের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। নামায, রোযা, তাসবীহ-তাহলীল, মোরাকাবা-মোশাহাদার মাধ্যমে তিনি অতিবাহিত করতেন দিবসের অধিকাংশ সময়। শিখ শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শিখ-মুসলিম দাঙ্গার সময় কাশ্মীর ছেড়ে সিয়ালকোটে বসতি স্থাপন করেন তিনি। আল্লামা ইকবালের মাতা ইমাম বিবিও ছিলেন পিতার মতই একজন ধর্মভীরু পরহেযগার মহিলা।

শিক্ষা জীবন

পাঞ্জাবের বৃটিশ আর্মির কাছে শিখদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টান মিশনারীরা শিয়ালকোটে শিক্ষা প্রচারের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এই সময়েই শিয়ালকোটে স্কটিশ মিশন কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজ লিবারেল আর্টস্ এর কোর্সসমূহের অনেকগুলোতেই আরবি ও ফার্সি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হতো। যদিও এই সময় বেশীর ভাগ স্কুলেই ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এই স্কটিশ মিশন কলেজেই ইকবাল সর্বপ্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রাপ্ত হন।

ইকবাল তাঁর কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি পান তাঁর শিক্ষক সাইয়িদ মীর হাসানের কাছ থেকে। ১৮৯২ সালে ইকবাল স্কটিশ মিশন কলেজ হতে তাঁর পড়াশোন শেষ করেন। একই বৎসরে গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবির সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯১৬ সালে । এই বিয়েতে ইকবালের তিনটি সন্তান ছিল।

১৮৮৫ সালে স্কটিশ মিশন কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইকবাল লাহোরের সরকারী কলেজে ভর্তি হন। দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এখান থেকে তিনি স্বর্ণ পদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন ততদিনে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

মাষ্টার্স ডিগ্রীতে পড়বার সময় ইকবাল স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষাবিদ ইসলাম ও আধুনিক দর্শনে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইকবালের কাছে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছিলেন। স্যার টমাস আর্নল্ডই ইকবালকে ইউরোপে উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।


দাম্পত্য জীবন ঃ
১৮৯৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পারিবারিক প্রথা অনুযায়ি ইকবাল গুজরাটের সিভিল সার্জন খান বাহাদুর আতা মুহাম্মদের কন্যা করিম বিবি কে বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর কন্যা মেরাজ বিবি ও পুত্র আফতাব ইকবালের জন্ম হয়। এ স্ত্রীর সাথে তার মনোমালিন্য হলে তারা আলাদা বাস করতে থাকেন। প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছিন্নতার পর এক কাশ্মিরী পরিবারের সরদার বেগম নামীয় মহিলার সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। এই স্ত্রীকে তিনি বিবাহের চার বছর পর ঘরে তোলেন এবং তার গর্ভেই ১৯২৪ সালে জাবিদ ইকবালের জন্ম হয়। ইকবালের তৃতীয় বিবাহ ১৯১২ সালে লুধিয়ানানিবাসী মোখতার বিবি’র সাথে। সন্তান প্রসবকালে তার মৃত্যু হয়। শেষ জীবনে ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েলে প্রথম স্ত্রী করিম বিবির ধারস্থ হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই স্ত্রীই তাঁকে সঙ্গ দেন।

কর্মময় জীবন :

১৯২৩ সালে বৃটিশ সরকার ইকবালকে নাইট খেতাব দিয়ে সম্মানিত করে। তার এই নাইট প্রাপ্তি ভক্ত অনুরাগীদের মাঝে ভূল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। বিরুদ্ধবাদী কবিরা ব্যাঙ্গাতœক কবিতা লিখে তাঁকে আক্রমণ করে। এমনকি তার বন্ধুরা চিঠি লিখে তার মতামত জানতে চায় এবং আশ্বস্ত হতে চায় ঘটনা যেন কোন ক্রমেই তাঁর স্বাধীন মতামত প্রকাশে কিংবা কওমের প্রতি খেদমতে বাঁধার সৃষ্টি না করে। আল্লামা ইকবাল বাকী জীবন কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করেগেছেন যে, তিনি কখনো দুর্দশাগ্রস্থ মুসমানদের কথা ভুলন নি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালীন সময়ে উপ-মহাদেশের নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থা বিশেষ করে মুসলমানদের দু:খজনক চিত্র তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক েেত্র শক্তিশালী হওয়া ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুসলমানদেও উত্তরণ আর সম্ভব নয়। মুসলমানদের প্রতিটি সমস্যায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখার ল্েয আমৃত্যু রাজনীতির কঠিন ময়দানে বিচরণ করেন তিনি। তিনি ১৯২৬ সালে পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে বৃটিশ সরকার ভবিষ্যৎ ভারতীয় শাসনতন্ত্রের পটভূমি তৈরীর প্রত্যাশায় “সাইমন কমিশন” প্রেরন করলে কংগ্রেস দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে আল্লামা ইকবাল নওয়াব জুলফিকার আলী খান ও মাওলানা মোহাম্মদ আলীর সাথে যৌথভাবে এক বিবৃতি প্রকাশ করে কমিশনকে সহযোগীতার আশ্বাস দেন। তিনি মুসলমানদের ল্য করে বলেন, যদি আমরা কমিশনকে সহায়তা না করি তবে বৃটিশরা মুসলমানদের স্বার্থকেই বিঘিœত করবে। আল্লামা ইকবালের এই ধারণা বৃটিশদের শাসন পরিচালনায় মুসলমানরা হারে হারে টের পেয়েছিল। বৃটিশরা সবসময় মুসলমানদের কাছ থেকে মতা দখল করার কারণে মুসলমানদেরকেই প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করছে। যা তাদের দীর্ঘ দিনের কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে।

মুসলমান শাসনের অবসানের পর কাশ্মীরের মুসলমানরা নানাবিধ নির্যাতন ও লাঞ্চনার শিকার হয়। অসহায় কাশ্মীরী মুসলমান ভাইদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য লাহোরে চলে আসা কাশ্মীরীরা আঞ্জুমান নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর আল্লামা ইকবাল এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যেহেতু তিনিও ছিলেন মুলতঃ কাশ্মীরী। তার পূর্বপুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েই কশ্মীর ছেড়ে চলে আসেন।
১৯৩০ সালের দিকে মুসলমানদের প্রতি যুলুম-নির্যাতন অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। ডোগরা মহারাজার ক্রমবর্ধমান জুলুম, নির্যাতনের প্রতিবাদে লাহোরে সর্বভারতীয় কাশ্মীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কাশ্মীর প্রশাসনের অন্যায় নির্যাতনের সমালোচনা করে প্রস্তাব গৃহিত হয়। আল্লামা ইকবাল এই প্রস্তাবের প্রতি একাত্মতা পোষন করেন। এ সময় তিনি মুসলিম কনফারেন্সের সভাপতি ছিলেন। তিনি কাশ্মীরিদের সার্বিক সমস্যার কথা সরকারের কাছে যথাযথ ভবে তুলে ধরেন। এর প্রেেিত সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কাশ্মীরিদের সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হয়।

১৯৩২ সালে আলোয়ার রাজ্যের মহারাজা কর্তৃক নির্যাতিত মুসলমানগণ ‘খাদেমুল মুসলিমিন’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করালে মহারাজার সরকার এটিকে বেআইনী ঘোষণা করে। এ অন্যায় আদেশের প্রতিবাদে মুসলমানরা বিােভ করলে তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এতে শহীদ হন প্রায় এক শত মুসলমান। এরপর শুরু হয় গণ-গ্রেফতার। বাড়ী ঘরে ছেড়ে পালাতে থাকে মুসলমানগণ। এই অন্যায় আচরণের প্রতিকার চেয়ে আল্লামা ইকবাল ভাইসরয় লর্ড ওয়েলিংটনের নিকট একটি স্মারক লিপি পেশ করেন। পরিণতিতে মুসলমানগণ ফেরারী জীবন ছেড়ে বাড়ী ফেরার সুযোগ পায়।

১৯৩৬ সালে আল্লামা ইকবাল পাঞ্জাব মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ডের সভাপতি নিযুক্ত হন। একই সালে পাঞ্জাব মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের লে অনুষ্ঠিত সভায় সর্ব-সম্মতিক্রমে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ঘোষণা করা হয় তাকে। ১৯৩৮ সালে লাহোরে মসজিদের দখল নিয়ে শিখ-মুসলমান দাঙ্গার সময় আল্লামা ইকবাল মসজিদ পুনরুদ্ধারে শাহাদাত প্রত্যাশি মুসলমান যুবকদের উৎসাহ যোগান। এক কথায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

এরপরও কেউ কেউ আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক কার্যকলাপের সমালোচনা করেন। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতির বিচারে একজন মুসলমানের এরচেয়ে কতটুকু বেশী করার সুযোগ ছিল তা কিন্তু প্রশ্ন সাপে। সার্বিক বিবেচনায় ভারতীয় মুসলমানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে আল্লামা ইকবালের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। তিনিই সর্ব প্রথম মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবী উত্থাপন করেন। এই দাবীই পরবর্তীতে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনের সূচনা করে।

সব চেয়ে বড় কথা হল আল্লামা ইকবাল কেবল মাত্র রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন নি। জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার কাজ তিনি চালিয়ে যান সমান তালে। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়েই ৬টি বক্তৃতা দেন তিনি। এর পরপরই বাঙ্গালুর হায়দারাবাদ এবং আলীগড়ে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান। তার এ সকল বক্তৃতা The Reconstruction of Religious Thought in Islam নামক পুস্তকে প্রকাশিত হয়। যা আল্লামা ইকবালের চিন্তার গভীরতার স্যা বহন করে।

রচনাবলী ঃ
ইকবাল গদ্য-পদ্য উভয় রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। তিনি ছিলেন মুক্তছন্দ কবি ও লেখক। তিনি লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। অর্থনীতির মত জটিল বিষয় থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতার মতো বিমূর্ত বিষয় পর্যন্ত উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। গ্রন্থ রচনা ছাড়াও তিনি বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে তৈরী করতে হয়েছে বিবৃতি, দিতে হয়েছে সাাতকার। ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও পন্ডিতদের সাথে আজীবন চিঠিপত্র বিনিময় করেছেন তিনি। আল্লামা ইকবাল তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রচনা করেন মাত্র ২৪টি কবিতা। তাও এর অধিকাংশই তার বন্ধু “মাখজান” সম্পাদক আব্দুল কাদিরের অনুরোধে। কবি-জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ইকবাল উপর উর্দু কবি “দাগ”-এর প্রভাব ছিল প্রবল। পরবর্তীতে “কবি গালিব” ও “কবি হালী”-এর প্রভাবে গতানুগতিকা ছেড়ে তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ নতুন খাতে প্রবাহিত হয়। আল্লামা ইকবাল সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে লাহোরে “আঞ্জুমানে হিমায়াতে ইসলাম”-এর বার্ষিক সভায় জনসমে কবিতা পাঠ করেন। কবিতার শিরোনাম ছিল “নালায়ে ইয়াতিম” (অনাথের আর্তনাদ)। ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে একই সংগঠনের বার্ষিক সভায় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী খন্ডকাব্য “শিকওয়া” পাঠ করেন। এর প্রভাবে আল্লামা ইকবালের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এরই প্রেেিত তিনি রচনা করেন আরেকটি যুগান্তকারী খন্ডকাব্য “জাওয়াবে শিকওয়া”। এরপর একে রচনা করতে থাকেন অসংখ্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমেই পাওয়া যায় তার চিন্তা-ধারার প্রকৃত পরিচয়। তার রচিত গ্রন্থাবলী হচ্ছে-

(১) ইলমুল ইকতিসাদ ঃ
অর্থনীতির উপর লেখা উর্দুভাষার প্রথম পুস্তক। তিনি এটি লাহোর সরকারী কলেজের সহকারী অধ্যাপক থাকাকালীন সময়ে রচনা করেন।

(২) তারিখ-ই-হিন্দ ঃ
বইটির মূল কপির সন্ধান পাওয়া যায়না এখন। এর একটি সংস্করণ অমৃতসর থেকে প্রকাশিত হয়।

(৩) আসরার-ই-খুদী ঃ
আল্লামা ইকবালের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে এই “আসরার-ই-খুদী”। এটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বই প্রকাশের পর সাড়া পড়ে যায় সর্বত্র। কিন্তু সূফী তরীকার অনুসারীরা এই পুস্তক প্রকাশকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে গ্রহণ করেননি। কেননা ইকবাল এই গ্রন্থে সূফী কবি হাফিজ শিরাজীর তীব্র সমালোচনা করে ৩৫টি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তেজনা এতই চরম আকার ধারণ করেছিল যে, ইকবালের চিন্তাধারার সমালোচনা কওে খান বাহাদুর পীরজাদা মোজাফফর আহমদ ‘ফজলে রাজ-ই-বেখুদী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেন। ইকবাল পরবর্তী সংস্করনে উল্লেখিত ৩৫টি কবিতা বাদ দিয়ে দেন। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ আর,এ, নিকলসন ১৯২০ সালে এর ইংরেজী তরজমা করেন প্রকাশ করেন।

(৪) রমুযে বেখূদী ঃ
প্রকৃতপে আসরার-ই-খূদীরই ক্রম সম্প্রসারিত এই সংকলনটি ১৯১৮ সালে রমুযে বেখুদী নামে প্রকাশিত হয়। আর্থার জন আর্বারী এটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন।

(৫) পায়াম-ই-মাশারিকঃ
এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩। এ সময়ে ইকবাল কবি হিসেবে অর্জন করেছেন সর্বজন স্বীকৃতি। তাঁর কবিতা এগিয়ে চলেছে পূর্ণ-পরিনতির দিকে। তিনি এ কাব্যে পাশ্চাত্য দর্শনের পাশাপাশি প্রাচ্যের কোরআনী চিন্তার ফসলকেও তুলে এনেছেন। এই কাব্যাটি গ্যাটের চিন্তাধারার অনুসরণে রচনা করেন। এতে মোট আশিটি কবিতা সংকলিত হয়েছে।

(৬) বাঙ্গ-ই-দারা ঃ
ইকবালের কবি জীবনের শুরু উর্দু কবিতার হাত ধরে। আর এই কাব্যটি উর্দু কবিতা সংকলন। উর্দুতেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ দেশাতœবোধক এবং জনচিত্তে আগুন ধরানো কবিতাসমূহ। ১৯২৪ সালে তিনি বাঙ্গ-ই-দারা নামে এ সকল উর্দু কবিতার সংকলনটি প্রকাশ করেন। এ কাব্যের কবিতাগুলো দেশাত্ববোধক, প্রকৃতি প্রীতি ও ইসলামী অনুভূতি এই তিনটি অংশে বিভক্ত।

(৭) যবুর-ই-আযম ঃ
ইকবালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফার্সী কবিতা সংকলন যবুর-ই-আযম। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। এর দুটি অংশের প্রথম অংশে ুদ্র কবিতা ও গীত এবং দ্বিতীয় অংশের নাম গুলশান-ই-রাজ-ই-জাদীদ। এখানে ইকবাল তার বিশিষ্ট দার্শনিক ভঙ্গিতে বর্তমান পৃথিবীর সমস্যাবলীর আলোকে কিছু উচ্চাঙ্গের প্রশ্ন সাজিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে জবাব দিয়েছেন। এই কাব্যেই ইকবালের গীতি কবিতাগুলো চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে।

(৮) The Reconstruction of Religious Though in Islam:
১৯২৮ সনের ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ছয়টি বক্তৃতা সংকলন এই বইটি। এই বক্তৃতাগুলোই আল্লামা ইকবালের সংস্কার ও দার্শনিক মনের প্রোজ্জ্বল চিত্র।

(৯) জাভিদনামা ঃ
ইকবালের প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞানের পরিচয়ক এই জাভিদনামা। ইটালির কবি দান্তের ‘ডিভাইন কমোডি’ অনুস্মরণে ইকবাল এটি রচনা করেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে।

(১০) বাল-ই-জিব্রীল ঃ
বাঙ্গ-ই-দারার পর ইকবাল ফার্সী কবিতার দিকে ঝুকে পড়েন। পুনরায় উর্দু কাব্য রচনা শুরু করলে ১৯৩৫ সালে বাল-ই-জিব্রীল উর্দু কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। অনেকের মতে বাল-ই-জিব্রীল ইকবালের শ্রেষ্ঠ উর্দু কবিতা সংকলন।

(১১) মুসাফির ঃ
মুসাফির নামক এই কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। এর পুরো নাম ‘পাস চেহ বায়াদ করদ আয় আকওয়ামে শারক্ মায়া মুসাফির’। ইকবালের প্রতি মাওলানা রূমীর উপদেশের মাধ্যমে এই কাব্যটি শুরু। মাওলানা রূমী ইকবালকে নির্দেশ দিচ্ছেন প্রাচ্যবাসীকে ধর্ম ও রাজনীতির প্রকৃত গুরুত্ব¡ অনুধাবন করাতে। সে প্রেেিতই ইকবাল ‘মুসাফির’ কাব্যটি রচনা করেন। এ কাব্যের দুটি অংশে- এক. হিকমত-ই-কলিমী (মুসার প্রজ্ঞা) এবং দুই. হিকমত-ই-ফিরাউনী (ফিরাউনের প্রজ্ঞা)।

(১২) যবরে কলীম ঃ
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত বইটির একটি উপশিরোনামের দিকে ল করলেই মূল পুস্তকের প্রতিপাদ্য পরিস্ফুটিত হয়ে যায়। যেমন- এলান-ই-জঙ্গ দাউর-ই-হাযর কি খিলাফ (বর্তমান যুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা)।

(১৩) আরমুগান-ই-হিজায ঃ
ইকবালের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ফার্সী ও কয়েকটি উর্দু কবিতার সমন্বিত সংকলন এটি। ফার্সী কবিতার অধিকাংশই ছোট পরিধির। কিন্তু এগুলো একেকটি ইকবালের চিন্তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন। উর্দু কবিতার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইবলিশ-কি মজলিস-ই-শূরা।
এছাড়াও ইকবালের অসংখ্য চিঠিপত্র, বক্তৃতা, ও সাাতকার প্রদান করেছেন। যে সব থেকে ইকবালের নিজস্ব চিন্তা ও দর্শনের বিভিন্ন বিষয় সুস্পষ্ট ভাবে উপলব্দি করা যায়।

অসুস্থতা ও ইন্তিকাল:
আল্লামা ইকবালের স্বাস্থ্য কোন কালেই ভাল ছিলনা। তিনি ইন্তিকালের প্রায় এক দশক পূর্ব থেকে স্বাস্থ্যের মারাত্মত অবনতি হতে থাকে। ১৯৩৪ সালে লাহোরের বাদশাহী মসজিদে ঈদের নামায পড়তে গিয়ে ঠান্ডা লেগে তার গলা বসে যায়। পরবর্তীতে তিনি হৃদ-রোগে আক্রান্ত হন। এক পর্যায়ে দেশে প্রাপ্ত সকল চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়। কেবল মাত্র হাকিম নবীনা যার প্রকৃত নাম হাকিম আব্দুল ওহাব তার তত্ত্বাবধানে সাময়িক উপশম হয়। ১৯৩৬ সালে আল্লামা ইকবাল শারীরিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ বছরই আঞ্জুমানে হিমায়েত-ই-ইসলামের একটি অনুষ্ঠানে সর্বশেষ জনসম্মুে আসেন। ১৯৩৭ সালে ইকবালের সৃষ্টি শক্তি চুড়ান্তভাবে কমে যায়। এ সময় মিয়া মুহাম্মদ শফী নামে একজন তরুণ সাংবাদিক বন্ধু ইকবালকে প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ে শোনাতেন এবং তার নির্দেশনা মোতাবেক চিঠি-পত্রের উত্তর দিতেন। ১৯৩৮ সালের শুরুতে ইকবাল শেষবারের মত ইসলামী জাতিয়তাবাদ ও ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
জরাগ্রস্থ হতাশ জাতির নতুন দিনের আলোকোজ্জল বার্তাবাহী মহামনিষী ডক্টর স্যার আল্লামা ইকবাল ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভোরে ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আল্লামা ইকবালের মৃত্যুতে লাহোর সহ দেশের সর্বত্র গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। বিরাট মিছিল এবং শান শওকতের সাথে লাহোর বাদশাহী মসজিদের পাশে হুযুরীবাগে আল্লামা ইকবালকে দাফন করা হয়। পারস্যের বাদশাহ রেজাশাহ পাহলভী, আফগানিস্তানের বাদশাহ জহীর শাহ, পাঞ্জাবের গভর্নর, মহাত্মাগান্ধী, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জার্মানীর কনসাল জেনারেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ হাজার হাজার বিশিষ্ট লোক আল্লামার মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠান। আল্লামার জানাযায় ল লোকের সমাবেশ হয়েছিল। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের পূর্বে আল্লামা ইকবাল যে কবিতাটি রচনা করেছিলেন তার দু’লাইন
“নেশানে মরদে মোমেন বাতু গোয়াম্
চু নরগে আয়েদ তাবাছ্ছুম বর লবে উছ্তা”
অনুবাদ:
“ধার্মিক জন মুমিন মানুষ তাহার কাহিনি শোন
বলিতেছি শোন তার পরিচয় লিপি,
মরণ যে দিন তাহার দুয়ারে বাজাবে রুদ্রবাঁশী
মুমিন তাহারে হাসিমুখে নিবে বরি।”
আল্লামা ইকবাল ছিলেন মর্দেমুমিন জিন্দাদিল। তাঁর জীবন ছিল সমৃদ্ধশীল, বিকাশমান ও গৌরবদীপ্ত। এজন্যই মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়েছেন “আমি মুসলিম ডরিনা মরণে।”


তথ্য: উইকিপিডিয়াসোনারবাংলাদেশব্লগ

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম