"মধ্যপন্থী মুসলমান"-দের "সহনশীলতা"-র সীমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ?

পৃথীবির ইতিহাসের প্রায় সবটা সময়েই কোন না কোন ভাবে দুটা পরাশক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত থেকে ইতিহাসকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়েছে । 'সভ্যতার সংঘাত' -সেই সংঘাত ছিলো সব ধরনের সংঘাত, সরাসরি অস্ত্র নিয়ে সংঘাত কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত । বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতেও দুটো সভ্যতার প্রকাশ্য সংঘাত চলছে । এক ইসলাম, দুই পশ্চিমা সভ্যতা । পশ্চিমা সভ্যতা বলতে ইসলাম টুকু বাদ রেখে বাকি যা আছে, তার পুরোটাকেই বুঝানো হচ্ছে ! মুসলমান বলে যারা পরিচিত, পশ্চিমা সভ্যতার সংঘাত কিন্তু তাদের সাথে না ! সংঘাত টা ইসলামের সাথে । ইসলামের ওপর আক্রমনে হয়তো কিছু 'মুসলমান' ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কিন্তু মূল লক্ষ্যবস্তু কখনোই তথাকথিত মুসলমানরা নয় ।


এই সংঘাতে ইসলামের বিরুদ্ধ শিবিরের সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী অস্ত্র হল তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন মিডিয়া আর ইসলামের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা চিন্তাশক্তি ও শিক্ষাদীক্ষায় মুসলমানদের কুপমন্ডুক সংকীর্ণতা । এই মিডিয়া এমনই প্রভাবশালী যে মুসলিম বিশ্বে এমনকি ইসলামী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের ছেলেমেয়েরা (যারা নিজেদেরকে অন্য সাধারণদের চেয়ে বেশি মেধাবী বলে নিজেরাই প্রচার করে) পর্যন্ত চরম বিভ্রান্তির বেড়াজালে ঘুরপাক খায় । ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সভ্যতার উষ্কানীতে আত্ম-ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে নিহত জাতীয়তাবাদী কোন কর্মীর মৃত্যুতে ওই মিডিয়াগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ধিক্কার দেয় এরা-ও! মিডিয়ার এমন ই শক্তি! অথচ এরা কিন্তু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী না! মিডিয়া শুধু এদেরকে এটুকু ভুলিয়ে দিয়েছে, যে , জাতীয়তাবাদী এসব আন্দোলনে শুধুমাত্র একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যই পশ্চিমা মিডিয়া সহযোগিতা করে।

এই প্রসঙ্গটায় আমি উদাহরণ হিসেবে এমন কিছু কথা বলতে চাচ্ছি যা সম্ভবত কোন পক্ষের ই পছন্দসই হবেনা! [1971 এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির একটা অংশ হলো এদেশের জনগনের ইসলামপন্থী ও ইসলামী আদর্শবাদী অংশ । তারা একাত্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পরাজিত হলেও দীর্ঘদিন বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি । এমনকি জেলবন্দী অনেক নেতা তখন বিজয়দিবসের উন্নত খাবার বর্জন করতেন বলেও শুনেছি । কিন্তু একটা সময়ে এসে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়, এদেশের নতুন অর্জিত স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় এমনকি ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় মিছিল পর্যন্ত করে!!!! ..............এই ইসলামী আদর্শবাদীরা ৭১ এর পরাজয় ভুলে গিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে, এটা খুবই যৌক্তিক এবং বাস্তব সিদ্ধান্ত... তাই বলে, তারা যদি ইতিহাসকেও ভুলে যেতে চায় বা ইতিহাসের বিকৃতিতে গা ভাসিয়ে দেয়, সেটা হবে তাদেরই অসংখ্য মৃত সহযোদ্ধা ও সম-আদর্শে বিশ্বাসীদের সাথে বেইমানীপূর্ন অবস্তান। ]

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডটার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০ বছরের বৃটিশ জুলুমের শিকার উপমহাদেশের মুসলমানরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিলো ৪৭ এ স্বাধীন নিজস্ব আবাসভূমি পেয়ে । বৃটিশরা উপমহাদেশে যেহেতু মুসলমানদেরকে পরাজিত করেই শাসনভার দখল করেছিলো, সেহেতু পুরো সময়টুকুই ছিলো মুসলমানেদের ওপর নিপীড়নের সময় । এই সময়টায় হিন্দুরা ছিলো সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ।

১৯০ বছর ধরে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের কঠিন কঠিনতম অধ্যায়গুলোর সবগুলো-ই সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করেছে উপমহাদেশের মুসলমান আলেম, মুসলমান সিপাহী ও মুসলমান তরুন মুজাহিদরা। খুব অল্প কয়েকটা আন্দোলনেই হিন্দুরা আংশিকভাবে অংশ নিয়েছে । যেমন ১৮৫৭ এর সিপাহীদের মহাবিদ্রোহে সম্ভবত ঝাঁসির রানী ও আরো দুয়েকজন হিন্দু জমিদার অংশ নিয়েছিলো । বাকি পুরোটাই ছিলো মুসলিম সিপাইদের । ফলে বিদ্রোহের ব্যর্থতার পরে মুসলিম সিপাইদের লাশেই ভারতবর্ষ ছেয়ে গিয়ৈছিলো । শত বছরের ফকির বিদ্রোহ, তীতুমীরের লড়াই - বেরেলভীদের আন্দোলন..... সবই ছিলো উপমহাদেশে বৃটিশ ভিত কাঁপিয়ে দেয়া মুসলমানদের স্বাধীনতাযুদ্ধ।

৪৭ এ পাকিস্তান নামের মুসলিম ভূখন্ড ছিলো জাতীয়তাবাদী মুসলিমলীগ নেতাদের বিচক্ষণ নেতৃত্বের ফসল । কিন্তু মুখে তারা ঠিক-ই কোরআনের আইন বা কোরআনের সংবিধানের কথা প্রচার করেছিলো । আসলে ইসলামী রাষ্ট্রপরিচালনাব্যাবস্থা সম্পর্কে তাদের আগ্রহ থাকলেও জ্ঞান ছিলোনা, সুযোগ-ও ছিলোনা । তবুও স্বাধীন- সার্বভৌম পাকিস্তান ভূখন্ড ছিলো দুই শত বছর ধরে বৃটিশ ও হিন্দুদের হাতে চরমভাবে নির্যাতীত - নিগৃহীত মুসলমানদের জন্য এক বিশাল স্বস্তি - আল্লাহর বিরাট রহমত !

পাকিস্তান কিভাবে সৃষ্টি হলো ? হিন্দুদের সংগঠন কংগ্রেস ও মুসলিম দের সংগঠন মুসলীম লীগের রাজনীতির ফসল হল ভারত ও পাকিস্তান । কংগ্রেসের দাবী ছিলো ভারত উপমহাদেশকে অখন্ড অবস্থায় ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে । ভারতীয়দের একজাতি হিসেবে বিবেচনা করে ভোটে নির্বাচিত নেতারাই ভারতের ভবিষ্যত কর্ণধার হবেন । একজাতি ত্বত্বের এই প্রস্তাবনা মুসলমানদের কিছু সময় বিভ্রান্ত করে রাখলেও কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক জুলুম তাদের চোখ খুলে দেয় । ১৯৩৬ এ কিছু সময়ের জন্য কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ভারতের কিছু রাজ্যে মুসলমানদের যখন কচুকাটা করা হচ্ছিলো, তখন শেরে বাংলা ফজলুল হককে বলতে হয়েছিলো, আর একজন মুসলমানকে হত্যা করলে আমি বাংলার দুইজন হিন্দুকে খতম করে দেবো!

...অবশেষে দ্বিজাতিত্বত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ভারত ও পাকিস্তান । পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য গনভোটের আয়োজন করা হয়েছিলো । কোন কোন এলাকার মানুষ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকতে চায় তা সেই এলাকার জনগনই নির্ধারণ করবে। মুসলিম লীগ নেতাকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পুর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে তৈরী হলো পাকিস্তান রাষ্ট্র । এই গনভোটে পাকিস্তানের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ভোট দিয়ৈছিলো এই পূর্ব বাংলার মানুষেরা (প্রায় ৯৭ পারসেন্ট) । তারপরও কংগ্রেসএর হিন্দু নেতা ও বৃটিশ ভাইসরয়ের যোগসাজসে অনেক এলাকা পাকিস্তানের হাতছাড়া হয়, মুর্শীদাবাদ-বিহার-কলকাতা-তৎকালীন সিলেটের করিমগন্জ এসব এলাকা সীমানা নির্ধারন টীমের কারসাজিতে মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায় । তৈরী হয় কাশ্মীর নিয়ে হিন্দু ভারতের স্থায়ী জুলুমের প্রেক্ষাপট । মুসলীমলীগ নেতারা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের জন্য একটা করিডোর চেয়েও পায়নি কংগ্রেসের উগ্র মানসিকতার কারনে ।

হিন্দু জাতি ও মুসলিম জাতি দুটো আলাদা জাতি । আলাদা কৃষ্টি ও আলাদা সংস্কৃতি - আলাদা জীবনযাপনব্যবস্থা, আলাদা আদর্শ.... এই হলো দ্বিজাতি ত্বত্ব । যে ত্বত্ত্ব মুসলমানদেরকে ১৯০ বছরের জুলুম থেকে স্বাধীনতা দিয়েছিলো ।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা সংঘাতময় পরিবেশ তৈরীর সার্বিক সহযোগী ছিলো পাকিস্তানের আজন্ম শত্রু ভারত। যারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করতে জাল মুদ্রা , সীমান্ত চোরাকারবার আর হিন্দুত্ববাদী ও কম্যুনিজমের লাল বইয়ে এদেশ ছেয়ে ফেলেছিলো....১৯৬৫ এর সম্মুখ যুদ্ধে যারা এই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী সৈন্যদের ই চূড়ান্ত ত্যাগ আর বীরত্বের কারনে অপমানজনক পরাজয় স্বীকার করেছিলো । একাত্তরে যে সংঘাতের শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হলো, তার ফলাফল হলো, পূর্ব পাকিস্তান; বর্তমান বাংলাদেশ বিজয়ী হলো ।.... বিজয়ী হলো বাঙালী বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ । .............এরপর থেকে ইতিহাস নামক অধ্যায়টা অবস্যম্ভাবী ভাবেই বিজয়ীরাই রচনা করলো তাদের সুবিধামত । এটা খুবই স্বাভাবিক । ইতিহাস সবসময়েই বিজয়ীরাই রচনা করে ।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : হিন্দু-মুসলিম দুই জাতি, এই ত্বত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিলো ১৯৫২ এর জাতীয়তাবাদী ভাষা আন্দোলন ছিলো তার ভিত্তিকে দুর্বল করার একটা ষঢ়যন্ত্রমূলক আত্মঘাতী আন্দোলন । যার শুরুটা ভারতের ইন্ধনে সেই ৪৭ এই তমদ্দুন মজলিস গঠনের মাধ্যমে হয়েছিলো । তখন থেকেই ভারত, শত্রু পাকিস্তানকে স্টাডী শুরু করেছে, কি করে একে বিচ্ছিন্ন করা যায়! উর্দু ভাষাকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ভাষা বলে যে প্রচারনা চালানো হয়, তা ছিলো সর্বৈব একটা মিথ্য প্রচারণা । উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান ভাষা ছিলোনা । পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা আলাদা অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠির বসবাসস্থল ছিলো..... বেলুচ-সিন্ধু-পাঠান.... এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা রয়েছে । উর্দু ছিলো সমগ্র পাকিস্তান কে ঐক্যবদ্ধ করার একটা মাধ্যম মাত্র । লক্ষ্য করুন, পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষী হিন্দুরা কিন্তু হিন্দী ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা বলে নিয়েছে ঠিকই । আরো অসংখ্য ভাষাভাষী বিশাল ভারতে ভাষা আন্দোলন কখনোই জোরদার করতে পারেনি । অথচ ২০০ বছরের জুলুমে জরজর একটা নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রএর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো এই বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদী ভাষা আন্দোলন । ভাষা আন্দোলনে অবশ্যই মুসলীমলীগ নেতাদের হঠকারীতার ভূমিকাও কম ছিলোনা । কিন্তু লাভের গুড় পুরোটুকুই গেছে চিড়শত্রু ভারতের পেটে । লীগ নেতাদের আরেকটা যুক্তি ছিলো, তখন বাংলাভাষায় জনগনকে তাদের আদর্শিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করার মত কোন সাহিত্য পর্যন্ত ছিলোনা । বাংলা সাহিত্যে তখন রাজত্ব সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথদের । অন্যদিকে আরবীর পরে উর্দু ছিলো দ্বিতীয় শক্তিশালী ভাষা যা পাকিস্তানের যে আদর্শিক ভিত্তি ছিলো তার মুল্যবোধকে বহন করে ।

ইরানে ভোটে নির্বাচিত ইসলামী মূল্যবোধের সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী কর্মীর মৃত্যুর যে মিডিয়া প্রচারণার সাথে তাল দেয় মুসলমানদের "মেধাবী" নেতাদের সন্তানরা , তারা ভুলে যায় এরকম অসংখ্য ষঢ়যন্ত্রের ইতিহাসকে । অথবা, আসলে তারা জানেইনা এসব ইতিহাস । কেননা ইতিহাসকে বিজয়ীরা বিকৃত করে বিভ্রান্তিতে ঢেকে দিয়ৈছে । আর তাদেরকে পরিয়ে দিয়েছে সবাইকে খুশি রাখার অবমাননাকর আপোষকামী মুখোশ।

পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শোষণের ইতিহাস : একটা প্রচারণা রয়েছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীরা নাকি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শোষিত হয়েছে । এদেশের টাকায় নাকি পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন হয়েছে ! এটা একটা চূড়ান্ত মিথ্যা প্রচারণা । বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজকে পরাজিত করে ২০০ বছর ধরে যে শোষণ ও লুন্ঠনএর শুরু করেছিলো, পশ্চিম পাকিন্তানের রাজ্যগুলোর অবস্থা তার থেকে ভিন্ন ছিলো । পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলো বৃটিশদের করায়ত্ত্ব হয় অনেক পরে । আর বাংলার বানিজ্যের পুরোটাই ছিলো হিন্দুদের দখলে যারা এদেশের সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলো কলকাতা শহরকে। এমনকি মুসলমানরা-ও বিনিয়োগের পুরোটুকু ওই কলকাতাতেই করতো বৃটিশদের সময়ে । ফলে ৪৭ এ যখন কলকাতা পেলোনা পাকিস্তান, তখন বাংলা ছিলো সব রস শুষে নেয়া নিতান্তই ছিঁবড়ে এক ভূখন্ড । আদমজী-ইস্পাহানী প্রমূখ মুহাজির শিল্পপতিদের উদ্যোগেই এই ভূখন্ডের উন্নয়ন শুরু হয় । বাংলাদেশ ভূখন্ডের যে উন্নয়ন হয়েছে, তার ৯০ ভাগের ও বেশি ৪৭ থেকে ৭১ এর পচিশ বছরেই হয়েছে । এদেশে কিছু ছিলোনা । স্রেফ কিছু ছিলোনা । পাটকলগুলো সব ওই সময়ে হয়েছে, ৪৭ এর পূর্বে যা হতো কলকাতাতে । শেরাটন-শাহবাগ হোটেল, এদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো, হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, মিল কারখানা.... প্রায় সব ওই পচিশ বছরের অর্জন । এবং খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এসবের উদোক্তা ছিলো হয় মুহাজির অবাঙালীরা অথবা পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার । ৭১ এ বিজয়ী হবার পরে আমরা এই ইতিহাসকে বিকৃত করে দিয়েছি।


এসব গেলো কিছু উদাহরনের কথা । ইসলাম বা মুসলমানদের উত্থানপতনের ইতিহাসটাই এরকম । চিড়কালীন । কখনোই পরবর্তি প্রজন্ম এসব থেকে শিক্ষা নেয়না । ছাড় দিতে দিতে ইমানকে ছাড় দিতে দ্বিধাবোধ করেনা একসময় । ৬৫ এর সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত ভারত ৭২ এ এসে বলেছিলো আমরা হাজার বছরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছি ! ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সব ইসলামী দল ও ইসলামপন্থী মানুষ পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষ নিয়েছিলো। ৭০ এর নির্বাচনে যারা আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, তারা সবাই ঐকবদ্ধভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো ৭১ এ । আজ রাজাকার বা আলবদর শব্দগুলো মিডিয়া প্রচারণার জোড়ে হিংসাত্মকভাবে ঘৃণার প্রতীকে পরিনত করা হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় বাহিনী যদি সেদিন পরাজিত হতো, পরিস্থিতি হয়তো ঠিক এর বিপরীত হতো । একটা ব্যাপার বাংলাদেশের তরুন প্রজন্ম নিদারুন ভুলভাবে শিখেছে, তা হলো "মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে" । এটা একটা মিথ্যাচার । সত্য হলো মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনীর হাত থেকে একটা জেলাও মুক্ত করতে পারেনাই । ভারতীয় নৌবাহিনী, বিমানবাহীনী আর স্থল বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমন যখন থেকে শুরু হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন থেকেই পরাজয়ের দিন গুনতে থাকে । পাকিস্তানবাহিনী পরাজিত হয়েছে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কিছুই করতে পারেনি নয় মাসের যুদ্ধে । মুক্তিযোদ্ধারা অবাঙালী মুহাজির মুসলমান হত্যা (যারা ৪৭ এর পর ভারত থেকে হিন্দুদের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেচে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলো)আর গ্রামগুলোর রাজাকারদের বিরুদ্ধেই সাফল্যজনক যুদ্ধ চালিয়েছে !!


.................................

ইসলামকে বা মুসলিম সংস্কৃতি ও মুল্যবোধকে পরাজিত করার পরে বিরুদ্ধ শক্তি যেখানে সামান্যতম ছাড় দেয়না, সামান্যতম মানবতা দেখায়না, সেখানে মুসলমানরা বা ইসলাম পন্থীরা বা ইসলামী আদর্শের ধারকদের ছাড় দেবার পরিসীমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তুত ?
.................................

গতকাল একটা পোষ্টে একটা কমেন্ট করেছিলাম । নাস্তিক নামধারী এক কুলাঙ্গারকে নিয়ে ছিলো পোষ্টটা । সব ধরনের ব্লগাররা যখন প্রচন্ড ক্ষিপ্ত এই অমানুষটার বিকৃত আচরণের কারনে, তখন শুনতে হলো তার প্রতি নাকি সহমর্মী হতে হবে! ... আমি ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম, এই সহমর্মীতার মাত্রা কতদূর পর্যন্ত বিস্তুত ?
...................................

ব্লগে দুধরনের নাস্তিক আছে । একটা ধরন হলো আরিফুর রহমান-দূরের পাখি টাইপের বিকৃত মস্তৃষ্ক পশুটাইপের নাস্তিক আর একটা হলো নাস্তিকের ধর্মকথা টাইপের যারা মোটামুটি সভ্যভাবে কথা বলতে শিখেছে । যারা চেষ্টা করে অন্তত যুক্তি ও তথ্যসহ কথা বলতে । লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, স্রষ্টায় বিশ্বাসীরা এই দুধরনের প্রতি কিন্তু একরকম আচরণ করেন না । নাস্তিকের ধর্মকথাকে কেউ গালি দেয়না, তাকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, তার ভুল ধরিয়ে দেয়া হয় অথবা একান্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে এড়িয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু আরিফুর রহমান / নিতাই ভট্টাচার্য হলো একটা উচ্ছৃঙ্খল উষ্কানীদাতা । মেরিটলেস বিকৃত ইতরামী ছাড়া সে কথা বলতে পারেনা । তার প্রতি তাই অন্যদের আচরন ও খুব স্বাভাবিকভাবে আলাদা ।
...................................

বেশ কিছু দিন আগে ফেসবুকে একটা কমেন্ট দেখেছিলাম । খুজে পেলাম ।
...................................

ক্ষমা , ভালো ব্যবহার... এসব তাদের প্রাপ্য যারা না জেনে, না বুঝে ভুল করে । বুঝতে পারলে অনুতপ্ত হয় তারাই যারা অজ্ঞানতার কারনে ভুল পথে চলে । কিন্তু যারা জেনে-বুঝে-হিসেব করে-প্লান পরিকল্পনা করে নিজে ভুল পথে চলে এবং নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে ...আরো অসংখ্য মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়, তাদের প্রতি সফ্ট বিহেইভ বা তাদের দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখা, এগুলো ঠিক মেনে নেবার মত না ।

আবু জেহেল কিংবা মুসা নবীর সময়কার ফিরআউন.. এরা তাওহীদ কে অস্বীকার করতো সব জেনে বুঝে । এরা খুব ভালোমত জানতো যে আল্লাহ আছেন, নবী যে পথের সন্ধান দিয়েছেন সেটাই মুক্তির পথ কিন্তু এরা তা মানতো না কেবল নিজস্ব গোয়ার্তুমী অহঙ্কার আর প্রতিপত্তি হারানোর সম্ভাবনায় । এরাও অনেক ট্যালেন্ট ছিলো.. যেমন ইবলিশ ও কিন্তু প্রচুর টালেনন্ট , বুদ্ধিমান । অনেক অবিশ্বাসী (কাফির-মুশরিক...) কে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন, অসংখ্য পথহারা মানুষকে আল্লাহ সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন... কিন্তু লক্ষ্য করুন, আবু জাহেলদের জন্য সুরা লাহাব কিম্বা ফিরআউন বা ইবলিশদের প্রতি অভিশাপবাণী যুগযুগ ধরে মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন..

....................................

মক্কা বিজয়ের পরে মক্কার সব কাফেরের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করার পরে চিহ্নিত কয়েকজনের ব্যাপারে ঘোষনা ছিলো এদের কোন ক্ষমা নেই এমনি কাবার গেলাফের মধ্যে আশ্রয় নিলেও !!!! যে কুরআন মুসলমান জাতিকে মধ্যপন্থী বলে ঘোষণা করেছে, মানবতার জন্য সর্বকালের সেরা আশির্বাদ যে মহানবী সা. ছিলেন ক্ষমা ও দয়ার সমুদ্র, সে কুরআন ও সে রাসুল কেও অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে । যারা ইমানদার না, যারা ইসলামের আইন-কানুনের কল্যান সম্পর্কে অবগত না, তাদের সাথে হয়তো কুরআন বা রাসুলের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু ইসলামে বিশ্বাসীদের তো এগুলো সরাসরি মেনে নিতে হবে! ..

হ্যাঁ, কথা থেকে যায় যেখানে, তা হলো প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষাপট ভালো মত না জেনে ও যথাযথ দায়িত্বশীল কতৃপক্ষ ছাড়া যার তার এখতিয়ার নেই কোথাও কুরআনের দন্ডবিধি এপ্লাই করার । সেটা করলে সেটা বিশৃঙ্খলাই হবে যা ইসলাম এলাউ করেনা । কিন্তু সর্বজনীণ তেমন কর্তৃপক্ষ তো আর পাওয়া সম্ভব না যার আনুগত্য সবাই করবে । অথচ কুরআনকে আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার জন্য শেষ দিনটি পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে নিদৃষ্ট করে দিয়েছেন । তাহলে উপায় কি ? প্রতিটি মানুষকেই জন্মগতভাবে বিবেক-বুদ্ধি ও ভালোমন্দ যাচাই করার একটা প্রাকৃতিক ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয়েছে । যার মাধ্যমে মানুষ যুক্তি ও তথ্যের সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ।
.....................................

অতি উদারতা-নিষ্পৃহতা ক্ষতিকর - বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত ধরনের একটা অগ্রহণযোগ্য ব্যাপার । মধ্যপন্থার মানে হলো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ যুক্তি ও বাস্তবতার সম্মিলন। মধ্যপন্থা মানে, যে আমার পিঠে ছুড়ি বসিয়ে দিলো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া নয় । তায়েফের ময়দানে আক্রমনকারীদের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা আবার বদরের ময়দানে আক্রমনকারীদের ধ্বংস কামনা... এই হলো মধ্যপন্থীদের অনুসরনযোগ্য একমাত্র আদর্শ ! তায়েফ ও বদরের প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা বুঝলেই আচরনের এই ভিন্নতার কারন স্পষ্ট হয় । তায়েফবাসী না জেনে, না বুঝে অন্যায় করেছিলো এবং সম্ভাবনা ছিলো তারা একসময়ে কল্যানের পথে ফিরে আসবে কিন্তু বদরের মাঠে আক্রমনকারীরা জেনে বুঝে কেবল হিংস্রতার বশবর্তী হয়ে এসেছিলো !

.....................................

অতি উদারতার ভাব এক ধরনের এক্সট্রিমিজম । জাতির ইতিহাস - পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে ঝাঁপসা ভাসা ভাসা জ্ঞান থেকে এই এক্সট্রিমিজমের উৎপত্তি । জাতি ও জাতিস্বত্ত্বার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতাই এধরনের ভুলের মধ্যে কাউকে ধরে রাখতে পারে ।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম