অধ্যায় ০৬ : জাহেলিয়াতের আক্রমন

খেলাফতে রাশেদা

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তেইশ বছরের মধ্যে এ সমস্ত কার্য পূর্ণরূপে সম্পাদন করেন। তাঁর পর আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ও ওমর ফারুক(রাঃ) এর ন্যায় দুজন আদর্শ নেতার নেতৃত্বলাভের সৌভাগ্য ইসলামের হয় । তাঁরা রাসুলুল্লাহর ন্যায় এ সর্বব্যাপী কাজের সিলসিলা জারি রাখেন। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) -এর হাতে কর্তৃত্ব আসে এবং প্রথম প্রথম কয়েক বছর রাসূলুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি পূর্ণরূপে জারি থাকে।

জাহেলিয়াতের আক্রমন

কিন্তু একদিকে ইসলামী রাষ্ট্রর দ্রুত বিস্তারের কারণে কাজ প্রতিদিন অধিকতর কঠিন হতে যাচ্ছিল এবং অন্যদিকে হযরত উসমান(রাঃ) যাঁর ওপর এ বিরাট কাজের বোঝা রক্ষিত হয়েছিল, তিনি তাঁর মহান পূর্বসুরীদেরকে প্রদত্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না।৫ (৫)কতিপয় মুফতি সাহেবান এ বাক্যটিকে হযরত উসমানের (রাঃ)প্রতি অমর্যাদাকর বলে চিহ্নিত করেছেন।অথচ আমার বক্তব্য শুধু এতটুকুন যে, হযরত উসমানের (রাঃ)মধ্যে শাসন পরিচালনার এমন কতিপয় গুণাবলী অভাব ছিল,যা হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ)ও হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ছিল। এটি ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় এবং ইতিহাসের ছাত্ররা এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। এটি ফিকাহ ও কালামের বিষয়বস্তু নয় ।কাজেই ফতোয়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ফতোয়ার আকারে এ সম্পর্কে কোনো রায় প্রকাশ করা যেতে পারে না। তাই তাঁর খিলাফত আমলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে জাহেলিয়াত সমাজ ব্যবস্থা অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। হযরত উসমান (রাঃ) নিজের শির দান করে এই বিপদের পথরোধ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা রুদ্ধ হয়নি। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) অগ্রসর হন। তিনি ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে জাহেলিয়াতের পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্যে চরম প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি জীবন দান করেও এই প্রতিবিপ্লবের পথ রোধ করতে পারেন নি। অবশেষে নবুয়্যাতের পদ্ধতির পরিচালিত খিলাফতের জামানা শেষ হয়ে যায়। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র তার স্থান দখল করে।এভাবে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ইসলামের পরিবর্তে আবার জাহেলিয়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর জাহেলিয়াত ক্যানসার ব্যাধির ন্যায় ধীরে ধীরে সমাজদেহে তার বাহু বিস্তার করতে থাকে। কেননা কর্তৃত্বের চাবিকাঠি এখন ইসলামের পরিবর্তে তার হাতে ছিল এবং রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার পর তার প্রভাবের অগ্রগতি রোধ করার ক্ষমতা ইসলামের ছিলনা ।সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এইযে, জাহেলিয়াত উলঙ্গ ও আবরণ মত্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি, বরং মুসলমান-এর রূপ ধারণ করে এসেছিল। প্রকাশ্য নাস্তিক, মুশরিক বা কাফেরের মুখোমুখি হলে হয়তো মোকাবিল করা সহজ হতো। কিন্তু সেখানে প্রথমেই ছিল তৌহিদের স্বীকৃতি,রিসালাতের স্বীকৃতি, নামায ও রোযা সম্পাদন এবং কোরআন ও হাদীস থেকে যুক্তিপ্রমাণ গ্রহণ আর তার পেছনে জাহেলিয়াতের নিজের কাজ করে যাচ্ছিল । একই বন্তুর মধ্যে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সমাবেশ এমন কঠিন জটিলতা সৃষ্টি করে যে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করা হামেশা জাহেলিয়াতের সঙ্গে মোকাবিলা করার চাইতে বেশী কঠিন প্রমানিত হয়েছে। উলঙ্গ জাহেলিয়াতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে লক্ষ লক্ষ মুজাহেদীন মাথায় কাফন বেঁধে সহযোগিতা করতে অগ্রসর হবে এবং কোনো মুসলমান প্রকাশ্যে জাহেলিয়াতকে সমর্থন করতে পারবে না। কিন্তু এই মিশ্রিত জাহেলিয়াতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে শুধু মুনাফিকরাই নয়, অনেক খাঁটি মুসলামনও তার সমর্থনে কোমর বেঁধে অগ্রসর হবে এবং শুধু তাই নয়, বরং ঐ জাহেলিয়াতের সংগে যুদ্ধকারীকে উল্টো দোষারোপ করা হবে। জাহেলী নেতৃত্বের সিংহাসনে এবং জাহেলি রাজনীতির মসনদে মুসলমানের সামসীন হওয়া, জাহেলী শিক্ষায়তনে মুসলমানের শিক্ষকতা করা এবং জাহেলিয়াতের আসনে মুসলমানের মুর্শেদ হিসেবে উপবেশন করা এক বিরাট প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। এবং খুব কম লোক এই প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে।
এই প্রতিবিপ্লবের সবচাইতে ভয়াবহ দিক এই যে, ইসলামের আবরণে তিন ধরনের জাহেলিয়াতই তাদের শিকড় গাড়তে শুরু করে এবং তাদের প্রভাব প্রতিদিন অধিকতর বিস্তার লাভ করতে থাকে। নির্ভেজাল জাহেলিয়াত রাষ্ট্র ও সম্পদ করায়ত্ত করে । নামে খিলাফত কিন্তু আসলে ছিল সেই রাজতন্ত্র যাকে খতম করার জন্যে ইসলামের আগমন হয়েছিল ।

বাদশাহকে ‘ইলাহ’ বলার হিম্মত কারুর ছিল না,তাই ‘আস--সুলতানু যিল্লুল্লাহ’৬-এর তালাশ করা হয়। এই বাহানায় ইলাহ যে আনুগত্য লাভের অধিকারী হন বাদশাহরাও তার অধিকার লাভ করে। এই রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় আমির-ওমরাহ, শাসকবর্গ,গভর্ণরবৃন্দ, সেনাবাহিনী ও সমাজের কর্তৃত্বশালী লোকদের জীবনে কম-বেশী নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের দৃষ্টিভংগী বিস্তার লাভ করে। এই দৃষ্টিভংগী তাদের নৈতিক বৃত্তি ও সামাজিকতাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। অতঃপর সস্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই এই সংগে জাহেলিয়াতের দর্শন , সাহিত্য এবং শিল্পও বিস্তার লাভ করতে থাকে।এবং বিভিন্ন বিদ্যা ও শাস্ত্রও এই পদ্ধতিতে সংকলিত ও রচিত হতে থাকে। কেননা এসব জিনিস অর্থও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল। আর যেখানে অর্থ ও রাষ্ট্র জাহেলিয়াতের আয়ত্তাধীন সেখানে তাদের ওপরও জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব অনিবার্য। কাজেই এ কারণেই গ্রীক অনারব দর্শন বিদ্যা ও সাহিত্য ইসলামের সংগে সংযুক্ত বলে কথিত সমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার পথ খুঁজে পায়।এ সাহিত্যের প্রভাবে মুসলমানদের মধ্যে ‘কালাম’ শাস্ত্রের বিতর্ক শুরু হয়, মোতাজিলা মতবাদের উদ্ভব হয়, নাস্তিকতা ও ধর্ম বিরোধিতা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে এবং ‘আকিদার’ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ নতুন নতুন ‘ফেরকা’ -সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়।এখানেই শেষ নয় বরং যে সমস্ত জাতিকে ইসলাম নৃত্য,গীত ও চিত্রাংকনের ন্যায় নির্ভেজাল জাহেলী শিল্প-সংস্কৃতির হাত থেকে উদ্ধার করেছিল তাদের মধ্যে এগুলো আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।৭

(৬) হাদীসে এ শব্দটির উল্লেখ আছে, এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সম্পর্ণ ভুল অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় সুলতানের আসল অর্থ হলো কর্তৃত্ব। কর্তৃত্বশালীর জন্যে এ শব্দটি নিছক কৃত্রিম অর্থে ব্যবহৃত হয়। নবী(স) এ শব্দটিকে কৃত্রিম অর্থে নয় বরং তার আসল অর্থে ব্যবহার করেছেন। নবী করিমের (স) ইরশাদের অর্থ হলো এই যে, রাষ্ট্র ও কর্তৃত্ব আসলে আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্বের প্রতিচ্ছায়া মাত্র। যে ব্যক্তির ওপর এ প্রতিচ্ছায়া পড়বে, সে যদি তার সম্মান বহাল রাখে অর্থাৎ হক ও ইনসাফ অনুযায়ী রাষ্ট্র চালায় তাহলে আল্লাহতাআলা সম্মান দান করবেন। আর যে ব্যক্তি খোদার এই ছায়াকে অপমান করবে অর্থাৎ জুলুম ও স্বার্থবাদিতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন। নবী করিমের এই জ্ঞানপূর্ণ বাণীকে বিকৃত করে লোকেরা বাদশাহকে খোদার প্রতিচ্ছায়া গণ্য করেছে এবং নবী করিমের (স) উদ্দেশ্যের প্রতিকূলে এটিকে বাদশাহ পূজার বুনায়াদে পরিণত করেছে।

(৭) মাওলানা শিবলী নোমানী ও জাস্টিস আমির আলীর মতো লোকেরা ঐ সব বাদশাহন এহেন কার্যাবলীকে ইসলামী তাহজীব ও তমুদ্দুনের খেদমত বলে গণ্য করেছেন। শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াত জনগণের ওপর হামলা করে তাদেরকে তৌহিদের পথ থেকে সরিয়ে গোমরাহির অসংখ্য পথে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। একমাত্র সুস্পষ্ট মূর্তিপূজা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি,নয়তো এমন কোনো ধরনের শের্ক ছিল না, যা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত হয়নি। পুরাতন জাহেলী মতবাদে বিশ্বাসি জাতিসমূহে যে সমস্ত লোক ইসলামের আওতায় প্রবেশ করে, তারা অনেকে শের্কের ধারণা ও মতবাদ নিজেদের সংগে করে নিয়ে আসে। এখানে তাদেরকে শুধু এতটুকুন কষ্ট করতে হয় যে, পুরাতন মাবুদগণের স্থলে তাদেরকে মুসলীম মনীষীদের মধ্যে থেকে কতিপয় নতুন মাবুদ তালাশ করতে হয় , পুরাতন মঠ -মন্দিরের স্থলে আউলিয়া -দরবেশগণের সমাধির ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হয় এবং ইবাদতের পুরাতান আচার-অনুষ্ঠানের স্থলে নতুন আচার-অনুষ্ঠান উদ্ভাবন করতে হয়। এ কাজে দুনিয়াদার আলেম সমাজ তাদেরকে বিপুলভাবে সাহায্য করে এবং শের্ককে ইসলামের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো তার দূর করে দেয়। তারা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সংগে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণী বিকৃত করে ইসলামে আউলিয়া পূজা ও কবর পূজার জন্যে স্থান সংকুলান করে। শের্কের কাজ করার জন্যে ইসলামের পরিভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করে এই নতুন শরিয়তের জন্যে আচার-অনুষ্ঠানের এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে যে, তা সুস্পষ্ট ও বড় শের্কের আওতায় পড়ে না। এই সূক্ষা শিল্পীসুলভ সাহায্য ছাড়া ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার পথ আবিষ্কার করা শের্কের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হতো না।

বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত ওলামা, মাশায়েখ, সুফী ও পরহেজগার লোকদের ওপর হামলা করে এবং তাদের মধ্যে সেইসব ত্রুটি বিস্তার করতে থাকে, যেগুলোর দিকে আমি ইতিপুর্বে ইশারা করেছি। এই জাহেলিয়াতের প্রভাবে মুসলিম সমাজে প্লেটোবাদী দর্শন , বৈরাগ্যবাদী চারিত্রিক আদর্শ এবং জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভংগী প্রসার লাভ করে। এই জীবন দর্শনটি শুধু সাহিত্য ও জ্ঞান সাধানাকেই প্রভাবিত করেনি বরং প্রকৃতপক্ষে সমাজের সৎ লোকদেরকে মরফিয়া ইনজেকশান দিয়ে স্থবিরত্বে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, রাজতন্ত্রের জাহেলী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে, ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে জড়তা ও সংকীর্ণ চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সমগ্র দ্বীনদারীকে কতিপয় বিশেষ ধর্ম-কর্মের সীমাবদ্ধ করেছে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম