অধ্যায় ০৯ : উমর ইবেন আবদুল আযীয

ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ হলেন হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) । ৮রাজ পরিবারে তাঁর জন্ম। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে দেখেন পিতা মিসরের ন্যায় বিরাট দেশের গবর্ণর । আরো বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে নিজেও উমাইয়া সরকারের অধীনের গবর্ণন পদে নিযুক্ত হন।বনু উমাইয়া বংশীয় বাদশাহগন যে সমস্ত জায়গীরের সাহায্যে নিজেদের খান্দানকে বিপুল ধনশালী করেন, তাতে তাঁর এবং তাঁর পরিবার পরিজনেরও বিরাট অংশ ছিল। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির আয় ছিল বার্ষিক ৫০ হাজার আশরাফি। বিত্তশালীর ন্যায় শান শওকতের সংগে জীবন যাপন করতেন। পোশাক-পরিচ্ছেদ,খানা পিনা, বাড়িঘর, যান-বাহন স্বভাব-চরিত্র, সবই ছিল শাহজাদার ন্যায়। এই পরিপ্রক্ষিতে পরবর্তিকালে তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন, তার সংগে তাঁর পরিবেশের কোনো দূরতম সম্পর্কও ছিল না । কিন্তু তাঁর মাতা ছিলেন হযরত উমরের (রা) পৌত্রী। (৮)তিনি ৬১হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১০১ হিজরীতে ইন্তাকাল করেন। নবী করীমের (স) ওফাতের ৫০ বছর পর তাঁর জন্ম হয়। তাঁর যুগে অগণিত সাহাবা ও তাবেঈন জীবিত ছিলেন। শুরুতে তিনি হাদীস ও ফিকাহর পূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রথম শ্রেণীর মুজাদ্দিদের মধ্যে গণ্য হতেন এবং ফিকাহ শাস্ত্র ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন্ কাজেই নবী করীম (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে তমুদ্দুনের বুনিয়াদ কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং খেলাফত রাজতন্ত্র পরিবর্তিত হবার পর এ বুনিয়াদ সুমুহে কোন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তত্ত্বগত দিক দিয়ে একথা জানা ও উপলব্ধি করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন ছিলনা।অবশ্য কার্যতঃ যে জিনিসটি তাঁর পথের প্রতিবন্ধক হতে পারতো, তা হলো এই যে, তাঁর নিজেরই খান্দান ছিল এই জাহেলী বিপ্লবের স্রষ্টা। এই বিপ্লব থেকে পূর্ণতঃ ও বিপুলভাবে লাভবান হচ্চিল তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন,তিনি নিজে এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি। তাঁর বংশগত স্বার্থ, ব্যক্তিগত লালসা এবং ভবিষ্যত বংশধরদের পার্থিব মঙ্গলের জন্যে তাকেও নিজের রাজতখতে ফেরাউনের ন্যায় জেঁকে বসা উচিত ছিল। নিজের বিদ্যা-বুদ্ধির, জ্ঞান, ও বিবেককে নিরেট বস্তুগত লাভের মোকাবিলায় কোরবান করে দিয়ে হক, ইনসাফ, নৈতিকতা ও নীতিবাদিতার গোলক ধাঁধাঁয় পদার্পণ না করাই তার জন্যে বেহতের ছিল। কিন্তু৩৭ বছর বয়সে নিহাত ঘটনাক্রমে যখন তিনি রাজতখতের অধিকারী হন এবং অনুভব করতে পারেন যে, কি বিপুল-বিরাট দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তখন আচানক তাঁর জীবনের ধারা পাল্টে যায়। বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃনা করাই তিনি জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় নিজের জন্যে ইসলামের পথ বেছে নেন। যেন এটি তাঁর পূর্বাস্থিরিকৃত সিদ্ধান্ত ছিল।

বংশানুক্রমিক পদ্ধতিতে তিনি রাজতখতের মালিক হন। কিন্তু বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ)গ্রহণ করার সময় জনসমাবেশে তিনি পরিষ্কার বললেনঃ আমি তোমাদেরকে নিজের বাইয়াত থেকে আজাদ করে দিচ্ছি, তোমরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাউকে খলিফা নির্বাচন করতে পারো। অতঃপর জনসাধারণ যখন সর্বসম্মতভাবে এবং সাগ্রহে বললো যে, আমরা আপনাকেই নির্বাচন করছি, তখনই তিনি স্বহস্তে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অতঃপর রাজকীয় জাঁজমক, ফেরাউনের শাসন পদ্ধতি, কাইসার ও কিসরার দারবারী নিয়ম-নীতি সবই বিদায় করে দেন। এবং প্রথম দিনেই রাজযোগ্য সবকিছুই পরিত্যাগ করে মুসলমাদের মধ্যে তাদের খলিফার যোগ্য পদ্ধতি গ্রহণ করেন।

অতঃপর রাজবংশের লোকেরা যেসব বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন, সেদিকে তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তাদেরকে সবদিক দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সমপর্যয়ে নামিয়ে আনের তাঁর নিজের জায়গীর সহ অন্যান্য যেসব জায়গীর রাজবংশের দখলে ছিল সবগুলিই বায়তুলমালে ফিরিয়ে দেন।এ পরিবর্তনের ফলে তাঁর নিজের যে, ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষট যে, তার বার্ষিক আয় পঞ্চাশ হাজারের পরিবর্তে মাত্র দুশো আশরফিতে নেমে আসে। বায়তুলমালের অর্থকে তিনি নিজের এবং নিজের খান্দানের জন্যে হারাম করে দেন। এমনকি খলিফা হিসেবে বেতনও গ্রহণ করেননি। নিজের জীবনের সমগ্র রূপটিই বদলিয়ে দেন। খলিফা হবার আগে রাজোচিত শান-শওকতের সংগে জীবন যাপন আর খলিফা হবার সংগে সংগেই ফকিরি জীবন অবলম্বন ৯,অবশ্যই বিস্ময়ের ব্যাপার।

স্বগৃহ ও পরিজনদের সংশোধনের পর তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নজর দেন। অত্যাচারী গভর্ণরদেকে বরখাস্ত করেন। এবং গভর্ণরদের দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্যে সৎলোকদের অনুসন্ধান করে বের করেন। সরকারের প্রশাসনিক র্কমচারিবৃন্দের নিয়মকানুন মুক্ত হয়ে প্রজাদের জান মাল ,ইজ্জত-আবরুর ওপর অনাধিকার হন্তক্ষেপ করার অধিকারী হয়ে বসেছিল। তিনি তাদেরকে পুনর্বার আইন-শৃংখলার অনুগত করেন এবং আইনের রাজত্ব কায়েম করেন। কর নির্ধারণের সমগ্র নীতি-নিয়মই পরিবর্তিত করেন। এবং আবগারীসহ বনি উমাইয়া বাদশাহগন যে সমস্ত অবৈধ ও অন্যান্য কর বসিয়েছিলেন সেগুলোকে সংগে সংগেই বাতিল করে দেন। জাকাত আদায়ের জন্যে যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা নতুনভাবে সংশোধন করেন এবং বাইতুল মালের অর্থকে পুনর্বার সাধারণ মুসলামনদের কল্যাণের জন্যে ওয়াকফ করে দেন।অমুসলিম প্রজাদের সাথে যেব অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল সংগে সংগেই তার প্রতিকার করেন। তাঁদের যেসব উপাসনালয় অন্যায় ভাবে দখল করা হয়েছিল সেগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। (৯)জীবনীকাররা বলেন যে, খলিফা হবার আগে হাজার দিরহাম মূল্যের পোশাক উমর ইবেন আবদুল আযীযের পছন্দ হতো না, কিন্তু খলিফা হবার পর চাঁর-পাঁচ দিরহামের মূল্যের পোশাকও নিজের জন্যে বড়ই মূল্যবান মনে করতেন। তাদের যেসব জমি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল,তা তাদেরকে ফেরত দেন।শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের প্রাপ্য যাবতীয় অধিকার পুনর্বার তাদেরকে প্রদান করেন। বিচার বিভাগকে সরকরের শাসন বিভাগের অধীনতা মুক্ত করেন। এবং মাণুষের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম ও স্পিরিট উভয়কেই সরকারী ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত করে ইসলামী নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবন লাভ করে।

অতঃপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাহায্যে তিনি অর্ধ শতাব্দীকালের জহেলী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে সমাজ জীবনের চতুর্দিকে বিস্তার লাভকারী জাহেলীয়াতের নিদর্শন সমূহকে জনগণের মানসিক নৈতিক ও সমাজ জীবন থেকে নির্মূল করতে উদ্যেগী হন। বিকৃত আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার বন্ধ করে দেন। ব্যাপকভাবে জনশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। কোরআন, হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষার দিকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দৃষ্টি পুনর্বার আকৃষ্ট করেন এবং এমন একটি তত্ত্বগত আন্দোলন গড়ে তুলেন যার প্রভাবে ইসলামে আবু হানিফা(র) ,মালিস(র), শাফেয়ী(র) ও আহমদ ইবনে হাম্বলের(র) ন্যায় মুজতাহিদগণের আবির্ভাব হয়। শরীয়তের আনুগত্য করার প্রেরণা মানুষের মধ্যে নতুন করে সঞ্জীবিত করেন। রাজতন্ত্রের বদৌলতে সৃষ্ট শরাব পান ,চিত্রাংকন ও বিলাসিতার ব্যাধি নির্মূল করেন। এবং যে সব উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্যে ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, মোটামুটি তিনি সেগুলো পূর্ণ করেন অর্থাৎ

অতি অল্প সময়ের মধ্যে জনজীবন এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর এই সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করে। জনৈক বর্ণনাকারী বলেন, ওলিদের আমলে লোকেরা তাদের আলাপ-আলোচনায় বৈঠকে অট্রালিকা ও উদ্যান সম্পর্কে আলোচনা করতো । সোলায়মান ইবনে আবদুল মালিকের জামানায় ইন্দ্রিয় লিপ্সার দিকে জনগণ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আযীয খলিফা হাবার পর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কোথাও চারজন লোক একত্রিত হলেই সেখানে নামাজ , রোজা ও কোরআন সম্পর্কিত আলোচনা শুরু হয়ে যেতো । অমুসলিম প্রজাদের ওপর এই সরকারের এত বেশী প্রভাব পড়ে যে, এই অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার অমুসলামন ইসলাম গ্রহণ করে এবং জিজিয়ার আয় আচানাক এতটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় যে, তার ফলে রাষ্ট্রিয় কোষাগারও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ইসলামী রাষ্ট্রের চারপাশে যেসব অমুসলিম রাষ্ট্র ছিল হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। তাদের মধ্য থেকে একাধিক রাষ্ট্র ইসলাম গ্রহণ করে। তৎকালে ইসলামী রাষ্ট্রের সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রোম সাম্রাজ্য। প্রায় এক শতাব্দীকাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল । হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়েও তাদের সংগে রাজনৈতিক সংঘর্ষ জারি ছিল । কিন্তু রোম সাম্রাজ্যের ওপর তাঁর বিরাট নৈতিক প্রভাব পড়েছিল। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে রোম সম্রাট যে মন্তব্য করেন তা থেকেই তা আন্দাজ করা যায়ঃ

“ কোনো সংসার বৈরাগী যদি সংসার ত্যাগ করে নিজের দরজা বন্ধ করে নেয় এবং ইবাদতের মশগুল হয়ে যায়, তাহয়ে আমি তাতে মোটেই অবাক হই না। কিন্তু আমি অবাক হই সেই ব্যক্তির ব্যাপারে ,যার পদতলে ছিল দুনিয়ার বিপুল সম্পদ-সম্পত্তি আর সে তা হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়ে ফকিরের ন্যায় জীবনযাপন করে”।

ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ কেবলমাত্র আড়াই বছর কাজ করার সুযোগ পান। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি করেন। কিন্তু বনি উমাইয়ার প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়ায় । ইসলামের জীবনের মধ্যে তাদের মৃত্যু নিহিত ছিল। কাজেই এই সংস্কারমূলক কাজকে তারা কেমন করে রবদাশত করতে পারতো ।অবশেষে তারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে বিষপান করালেন এবং মাত্র ৩৯বছর বয়সে দ্বীন ও মিল্লাতের এই নিঃস্বার্থ খাদিম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। তিনি যে, সংস্কারমূলক কাজের সূচনা করেছিলেন, তা প্রায় পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। আর শুধুমাত্র বংশানুক্রমিক মনোনয়নের পদ্ধতি খতম করে তদস্থলে নির্বাচন ভিত্তিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটুকু বাকী ছিল। এ সংস্কার পরিকল্পনাটি তার সম্মুখে ছিল। তিনি নিজের এ পরিকল্পনাটি প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু সমাজ জীবন থেকে উমাইয়া শাসনের প্রভাব নির্মূল করা এবং সাধারণ মুসলমানদের নৈতিক ও মানসিক অবস্থাকে খিলাফতের বোঝা বহন করার জন্যে তৈরী করা নিতান্ত সহজ ছিল না। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে তা সম্পাদিত হতে পারতো না।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম