অধ্যায় ১০ : চার ইমাম

দ্বিতীয় উমরের (র) ইন্তেকালের পর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের চারিকাঠি পুনর্বার ইসলাম থেকে জাহেলিয়াতের দিকে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি যে কার্য সম্পাদন করেছিলেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়।কিন্তু তবুও ইসলামী মানসে তিনি যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন এবং যে তত্ত্বগত আন্দোলনের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তার অগ্রগতি রোধ করার শক্তি কারুর ছিলনা। বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসীয়দের বেত্রদণ্ড ও আশরফির থলি এ আন্দোলনের পথরোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের সব জারিজুরি নিস্ফল হয়। এই আন্দোলনের প্রভাবে কোরআন ও হাদীস শাস্ত্রে গবেষণা ইজতিহাদ ও নীতি-নির্দেশ সংকলন ও প্রণয়নের বিরাট কার্য সম্পাদিত হয়। দ্বীনের মূলনীতি থেকে বিস্তারিত ইসলামী আইন প্রণয়ন করা হয় এবং একটি ব্যাপক তমুদ্দুনিক ব্যবস্থাকে ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালিত করার জন্যে যত প্রকার নিয়মাবলী ও কর্ম পদ্ধতির প্রয়োজন খুঁটিনাটি বিষয়সহ তার প্রায় সমস্তই প্রণয়ন করা হয়। দ্বিতীয় শতকের শুরু থেকে প্রায় চতুর্থ শতক পর্যন্ত এ কাজ পূর্ন শক্তিতে চলতে থাকে।

এই যুগের মুজাদ্দিদগনের মধ্যে চারজন ইমামের নামই(১০)উল্লেখযোগ্য। ফিকাহর চারটি মযহাব তাঁদের চারজনের সংগে সম্পর্কিত। তারা ছাড়াও আরো বহু সংখ্যক মুজতাহিদ ছিলেন। কিন্তু যে কারণে তাদের মরতবা মুজতাহিদের পর্যায় থেকে মুজাদ্দিদের পর্যায়ে উন্নীত হয় তা হলো এইঃ- প্রথমতঃ তাঁরা নিজেদের গভীর দৃষ্টিশক্তি ও অস্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে এমন চিন্তাধারার জন্ম দেন, যার বিপুল শক্তি সম্ভার সাত-আট শতাব্দী পর্যন্ত মুজতাহিদ পয়দা করতে থাকে। (১০) ইমাম আবু হানিফা(র) ৮০হিজরীতে (৬৯৯ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ইন্তেকাল করেন ১৫০হিজরীতে (৭৬৭খৃঃ)।ইমাম মালিক(র) জন্মগ্রহণ করেন ৯৫ হিজরীতে (৭১৪খৃঃ) এবং ইন্তেকাল করেন ১৭৯ হিজরীতে (৭৯৮খৃঃ)ইমাম শাফেয়ী (র) জন্মগ্রহণ করেন ১৫০হিজরীতে (৭৬৭খৃঃ) ইন্তেকাল করেন ২৪০হিজরীতে (৮৫৪খৃঃ)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) জন্মগ্রহণ করেন ১৬৪ হিজরীতে (৭৮০খৃঃ) এবং ইন্তেকাল করেন ২১৪ হিজরীতে (৮৮৫খৃঃ) তাঁরা দ্বীনের মূলনীতিসমূহ থেকে খুটিনাটি বিষয়াবলী উদ্ভাবন করার এবং জীবনের বাস্তব বিষয়াবলী শরিয়তের নীতি সমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার এমন সার্বজনীন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন যার ফলে পরবতীকালে তাঁদের ঐ পদ্ধতির ভিত্তিতেই যাবতীয় ইজতিহাদমূলক কার্যাদি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ সম্পর্কিত কোন কার্য তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না।

দ্বিতীয়তঃ রাজসরকারের সাহায্য ব্যতিরেকে তার সবরকম অনুপ্রবেশ মুক্ত হয়ে বরং তার অনুপ্রবেশের তীব্র মোকাবেলা করে তাঁরা এসব কার্য সম্পাদন করেন। এ ব্যাপারে তাঁরা এমন এমন কষ্ট ভোগ করেন যার কল্পনা করতেও শরীর শিহরিয়ে ওঠে । ইমাম আবু হানিফা (র) বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস উভয় আমলেই বেত্রদণ্ড ও কারাদণ্ড ভোগ করেন।এমন কি অবশেষে তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। ইমাম মালিককে (র) আব্বাসী বাদশাহ মনসুরের আমলে ৭০বেত্রদণ্ড দেয়া হয় এবং ভীষণভাবে তাঁকে পিছমোড়া করে বাঁধা হয় যে তাঁর হস্তদ্বয় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ওপর মামুন, মোতাসিম ও ওয়াসিক তিনজনের আমলেই অনবরত নির্যাতন চালানো হয়। তাঁকে এত বেশী মারপিট করা হয় যে সম্ভবতঃ উট ও হাতী সেই মারের পর জীবিত থাকতে পারতো না। অতঃপর মুতাওয়াক্কিলের আমলে তাঁর ওপর এর বেশী রাজকীয় পুরস্কার, সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় যে, তিনি ঘাবড়িয়ে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেনঃ
----------------------
“ঐ মারপিট এবং কারাদন্ডের চাইতেও এগুলো আমার ওপর অধিকতর কঠিন বিপদ”। কিন্তু এসব সত্ত্বেও এ মনীষীগণ দ্বীনি ইলম সংকলন ও প্রণয়নের ব্যাপারে শুধু রাজ-প্রভাব ও অনুপ্রবেশের পথরোধই করেননি বরং এমন পদ্ধতির প্রচলন করে যান, যার ফলে পরবর্তিকালে সমস্ত ইজতিহাদমূলক ও মৌলিক রচনার কাজ পূর্ণরূপে রাজদরবারের প্রভাবমুক্ত থাকে। এরই ফলস্বরুপ আজ ইসলামী আইন এবং কোরআন ও হাদীস শাস্ত্রের যতগুলো নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য বই আমরা লাভ করেছি, তাতে জাহেলিয়াতের সামান্য গন্ধ পর্যন্তও নেই। এ জিনিসগুলো এমনি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন অবয়বে বংশানুক্রমিকভাবে স্থানান্তরিত হয় যে, বাদশাহ ও আমীর-ওমরাহদের কয়েক শতাব্দীকালীন ইন্দ্রিয় লিপ্সা ও বিলাসিতা এবং জনসাধারণের নৈতিক অবনতি এবং আকিদা-বিশ্বাস ও তমুদ্দুনিক বিকৃতির যে সয়লাব প্রবাহিত হয়, তা যেন জ্ঞানের এই স্তুপকে স্পর্শও করতে পারেনি এবং তার কোনো প্রভাব এর ওপর পরিলক্ষিত হয় না।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম