চলুন এখন নামাজের শিক্ষাগুলো পর্যালোচনা করা যাক। মহান আল্লাহ দু’ভাবে নামাজ থেকে শিক্ষা দিয়েছেন বা দিতে চেয়েছেন। যথা
ক. অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা এবং
খ. পঠিত বিষয় থেকে শিক্ষা।
অনুষ্ঠান থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষা আবার দু’ভাগে বিভক্ত। যথা
১. ব্যক্তি জীবনের শিক্ষা এবং
২. সমাজ জীবনের শিক্ষা।
নামাজের পঠিত বিষয় থেকে শিক্ষাগুলোকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়
১. সূরা ফাতেহা পড়া থেকে শিক্ষা,
২. অন্য সূরা পড়া থেকে শিক্ষা,
৩. তাসবীহ পড়া থেকে শিক্ষা এবং
৪. দোয়া থেকে শিক্ষা।
চলুন এখন নামাজ থেকে আল্লাহর দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলো একটু বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা যাক
নামাজের অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা
ব্যক্তিজীবনের জন্যে নামাজের অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা
একজন ব্যক্তি তার জীবনকে ইসলাম অনুযায়ী যাতে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে, সে জন্যে নামাজ তার অনুষ্ঠান থেকে যে শিক্ষাগুলো দেয়, তা হচ্ছে
১. আল্লাহর আদেশ মানার মানসিকতা সৃষ্টি করা
নামাজের মাধ্যমে দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলোর মধ্যে এটিই হচ্ছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুসলমান তার সকল কাজকর্ম ফেলে নামাজ পড়তে চলে যায় বা দাঁড়িয়ে যায়, কারণ এটি আল্লাহর নির্দেশ। এটি না করলে কেউ তাকে মারধর করে না। অর্থাৎ শুধু আল্লাহর ভয়ে সে এটি করছে। প্রতিদিন পাঁচ বার মুসলমানদের অন্তরে এই আল্লাহভীতি জাগিয়ে দিয়ে নামাজ মুসলমানদের অন্তরে আল্লাহভীতি এমনভাবে বদ্ধমূল করে দিতে চায় যে, তারা যেন তাদের জীবনের প্রতিটি কাজ করার সময় এই আল্লাহভীতিকে সামনে রাখে। অর্থাৎ আল্লাহর খুশি হওয়াকে সামনে রাখে। আল্লাহ অখুশি হন এমন কোন কাজ সে করবে না এবং খুশি হন এমন সব কাজই করবে। আর ঐ কাজগুলো যেভাবে করলে আল্লাহ খুশি হন, শুধু সেভাবেই সে তা করবে। প্রতিটি কাজ ঐভাবে সে এ জন্যেই করবে যে ঐভাবে কাজটি করলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে লাভবান হবে এবং কাজটি না করলে বা ঐভাবে না করলে সে কোন মতেই আল্লাহর শাস্তি তথা দুঃখ-কষ্ট থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে রেহাই পাবে না। নামাজের অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষার ব্যাপারে এ কথাটিই আল্লাহ বলেছেন, সূরা বাকারার ১৪৩ নং আয়াতে, যা আগে আলোচনা করা হয়েছে।
২. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ নির্ভুল উৎস তথা আল-কুরআন থেকে জানার মানসিকতা তৈরি করা
নামাজে মহান আল্লাহ শুধু আল-কুরআন পড়তে বলেছেন। হাদীস, ফিকাহ্ গ্রন্থ, ইসলামী সাহিত্য, ডাক্তারী বই, অর্থনীতির বই বা অন্য কোন গ্রন্থ পড়তে বলেননি। এর মাধ্যমে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন ইসলামকে প্রথমে জানতে হবে নির্ভুল উৎস আল-কুরআন থেকে। কারণ কুরআনের সূরা নাহলের ৮৯ নং আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইসলামের সকল মূল তথা সকল প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয় কুরআনে উল্লেখ করে রেখেছেন। আর ঐ বিষয়গুলো হচ্ছে কুরআনের মূল বিষয়। ঐ চিরসত্য মূল বিষয়গুলো না জেনে কেউ যদি শুধু হাদীস, ফিকাহ বা ইসলামী সাহিত্য পড়ে ইসলাম জানতে চায়, তবে সে কখনই সঠিক ইসলাম জানতে পারবে না। আর এর ফলে সে ইসলামের ব্যাপারে নানা রকম ধোঁকায় পড়ে যাবে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ইসলামের নামে কিছু অসতর্ক প্রচারণা, যা কুরআন, সুন্নাহ ও বিবেক বিরুদ্ধ, মুসলমানদের আজ নামাজের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাইতো দেখা যায়, অধিকাংশ নিষ্ঠাবান নামাজীরও আজ কুরআনের জ্ঞান নেই। আর এই অজ্ঞতার দরুন তারা ইসলামের অনেক প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয়ের ব্যাপারেও নানাভাবে শয়তানের ধোঁকায় পড়ছে। এই অসতর্ক প্রচারণায় কয়েকটি হচ্ছে-
ক. কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা ফরজ হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে তার স্থান অন্য অনেক আমলের নিচে।
খ. কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা সকলের জন্যে ফরজ নয়।
গ. ওজু ছাড়া কুরআন পড়া যাবে কিন্তু স্পর্শ করা মহাপাপ।
ঘ. অর্থ ছাড়া বা জ্ঞান অর্জনের ল্য ছাড়া কুরআন পড়লেও প্রতি অরে দশ নেকী।
ঙ. কুরআন বুঝা কঠিন। তাই বুঝতে গেলে গুমরাহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
চ. জ্ঞান অর্জনের চেয়ে আমলের গুরুত্ব বেশি।
ছ. জানার পর পালন না করলে না জানার দরুন পালন না করার চেয়ে বেশি গুনাহ। তাই বেশি জানলে বেশি বিপদ।
বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি, ‘কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী- ‘মুমিনের এক নাম্বার কাজ আর শয়তানের এক নাম্বার কাজ’, ‘ওজু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করলে গুনাহ হবে কি?’, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া গুনাহ না সওয়াব’ নামের পুস্তিকাগুলোতে।
৩. পর্দা করার শিক্ষা
পর্দা করা ইসলামী জীবন বিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ কাজ। নামাজে সতর ঢেকে রাখার বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ প্রতিদিন পাঁচ বার এই ফরজ কাজটির কথা মুসলমান নর-নারীদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আজ মুসলমান মহিলাদের অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যকই ব্যক্তিগত জীবনে নামাজের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটিকে মেনে চলেন। নামাজের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটির কী দারুণ অবহেলা তারা করছেন, তাই না?
৪. সময় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদায় করতে হয়। এই সময় বেঁধে দিয়ে আল্লাহ মুসলমানদের সময়জ্ঞানের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। পুরো মুসলিমবিশ্বে বর্তমানে এই সময়জ্ঞানের দারুণ অভাব। নামাজের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কী দারুণ উপো, তাই না? অথচ মানুষের জীবন পরিচালনার জন্যে এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান বিশ্বে উন্নত জাতিগুলোর মধ্যে এই সময়জ্ঞান বেশ প্রখর।
৫. শরীর সুস্থ ও সবল রাখার শিক্ষা
নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষের শরীর সুস্থ ও সবল রাখার অপূর্ব শিক্ষা দিয়েছেন নিম্নোক্তভাবে
ক. শরীর, পোশাক-পরিচ্ছাদ ও জায়গা তথা পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার শিক্ষা
পূর্বেই (পৃষ্ঠা নং ২২) উল্লেখ করা হয়েছে নামাজের আগে শরীর, কাপড় ও জায়গা পাক তথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার শর্তের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষকে তাদের শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশকে ঘন ঘন ধোয়া-মোছার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। আর এভাবে তিনি তাদের নানা ধরনের রোগের হাত থেকে মুক্ত থাকার এক অপূর্ব ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শরীর, পোশাক ও পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে দিনে পাঁচবার শিক্ষা দেয়ার পরও মুসলমানরা আজ পৃথিবীর অনেক জাতির চেয়ে ঐ ব্যাপারে অনেক অনেক পেছনে পড়ে আছে।
খ. ব্যায়াম করা ও ব্যায়ামে কী কী অঙ্গভঙ্গি (গড়াবসবহঃ) করতে হবে তা শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে রোগমুক্ত রাখার ব্যবস্থা
সিজদা হচ্ছে নামাজের মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে পছন্দের অবস্থান। তাই আল্লাহ তো নামাজের সময় শুধু সিজদায় থেকে দোয়া কালাম পড়ে নামাজ শেষ করতে বলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি হাত উঠিয়ে তাকবীরে তাহরীমা, মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে রুকু ও সিজদা এবং ঘাড় ফিরিয়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ আদায় করতে বলেছেন। এখান থেকে বুঝা যায়, নামাজের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির একটা শিক্ষা হচ্ছে শরীর চর্চার শিক্ষা। আর শরীর চর্চার সময় কী কী অঙ্গভঙ্গির দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা শিক্ষা দিয়েছেন। ডাক্তারী বিদ্যায় এখন এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয় যে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে মানুষের বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি অনেক কম হয়। নামাজ থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষাগুলো নিয়ে বাস্তবে তা নামাজীরা পালন করুক, এটিই তো আল্লাহ চান। মুসলমানরা যদি ব্যায়ামের সময় কী ধরনের অঙ্গভঙ্গি করতে হবে নামাজ থেকে ঐ শিক্ষাগুলো নিয়ে বাস্তবে প্রতিদিন ঐভাবে কিছুণ ব্যায়াম করে তবে তাদের অনেক রোগ-ব্যাধি কম হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ নামাজীই শরীর সুস্থ রাখার ব্যাপারে নামাজের এই অপূর্ব শিক্ষাটি বাস্তবে পালন করেন না।
গ. মেসওয়াক করার মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার শিক্ষা
ওজুর সময় মেসওয়াক করা সুন্নত। রাসূল সা. এটিকে এত গুরুত্ব দিতেন যে, ওফাতের আগে যখন অজ্ঞান অবস্থা থেকে একটু জ্ঞান আসছিল তখনই তিনি মেসওয়াক চাচ্ছিলেন। পাঁচবার ওজুর সময় কেউ যদি নিয়মিত মেসওয়াক বা ব্রাশ করে তবে তার দাঁত ও মুখের রোগ অনেক অনেক কম হবে। তাছাড়া রাসূল সা. বলেছেন, মেসওয়াক করে নামাজ পড়লে নামাজের সওয়াব অনেক গুণ বেড়ে যায়।
এখন প্রশ্ন থাকে যে, কী কারণে আল্লাহ মুসলমানদের নামাজের মাধ্যমে এভাবে শরীর সুস্থ-সবল রাখার শিক্ষা দিলেন। সে কারণটি হচ্ছে, ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গেলে মুসলমানদের জরা-জীর্ণ শরীরের অধিকারী হলে চলবে না। ঐ কাজ করতে তাদের কঠোর প্রতিরোধের মুকাবেলা করতে হবে। সুতরাং তাদের অবশ্যই সুস্থ-সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। তাই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের শরীর-স্বাস্থ্য, সুস্থ-সবল রাখার এই অপূর্ব শিক্ষা দিয়েছেন।
৬. ইসলামের বিধানসমূহ গুরুত্ব অনুযায়ী পালনের শিক্ষা
নামাজের বিধানসমূহকে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব এই চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিয়ম হচ্ছে, ফরজে ভুল হলে নামাজ হবে না। ওয়াজিবে ভুল হলে সহূ সেজদা দ্বারা তা না শোধরালে নামাজ হবে না। সুন্নাতে ভুল হলে নামাজ হবে তবে একটু দুর্বল হবে। আর মুস্তাহাবে ভুল হলে নামাজের কোন তি হবে না।
নামাজের বিধানগুলো গুরুত্ব অনুযায়ী পালনের বিধান থেকে শিক্ষা হচ্ছে, ইসলামী জীবন বিধানেও মৌলিক ও অমৌলিক বিষয় আছে। মৌলিক বিষয়গুলোর কোন একটি বাদ দিয়ে অমৌলিক বিষয়গুলো যতই পালন করা হোক না কেন, তাতে ইসলাম পালন হবে না এবং ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে যেতে হবে। আর মৌলিক বিষয়গুলো পালন করার পর অমৌলিক বিষয় পালনে যদি কিছু দুর্বলতা থাকে, তবে তাতে কিছু দুর্বল হলেও ইসলাম পালন হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে যেতে হবে না। তবে তার বেহেশতের মান () কিছু কমবে।
সমাজ জীবনের জন্যে নামাজের অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা
মানুষ সামাজিক জীব। সুশৃঙ্খল ও সমাজবদ্ধ মানবজীবন আধুনিক সভ্যতার পূর্বশর্ত। তাই মানুষ গড়ার প্রোগ্রামে যদি সুষ্ঠু সমাজবদ্ধ জীবন গড়ার শিক্ষা না থাকে, তবে সেই প্রোগ্রাম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আল্লাহর মানুষ গড়ার প্রোগ্রাম অসম্পূর্ণ থাকতে পারে না। তাই মুসলমানরা কিভাবে তাদের সমাজ জীবন পরিচালনা করবে, তার অপূর্ব শিক্ষা তিনি নামাজের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়েছেন। এ শিক্ষা আল্লাহ ‘জামায়াতে’ নামাজ পড়ার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়েছেন।
জামায়াতে নামাজের গুরুত্বের ব্যাপারে কুরআনের বক্তব্য
জামায়াতে নামাজ পড়াকে কুরআনে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই ইসলামী শরীয়াতে এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পবিত্র কুরআনের দুই স্থানে জামায়াতে নামাজ আদায় করার কথাটি বা আদায় করার গুরুত্ব নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে
সূরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন
وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ.
অর্থ: রুকুকারীগণের সাথে রুকু কর।(অর্থাৎ জামায়াতের সঙ্গে নামাজ আদায় কর)।
জুম্আর নামাজ জামায়াতে আদায় করার ব্যাপারে সূরা-জুমআর ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَوةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُوْنَ.
অর্থ: হে ব্যক্তিগণ যারা ঈমান এনেছ, জুমআর দিনে যখন নামাজের জন্যে ডাকা হয় তখন কেনা-বেচা ত্যাগ করে আল্লাহর স্মরণের (নামাজের) দিকে দ্রুত চলে যাও। এটি তোমাদের জন্যে অধিক উত্তম, যদি তোমরা জানতে।
ব্যাখ্যা: আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা ২৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে।
জামায়াতে নামাজের ব্যাপারে হাদীস
জামায়াতে নামাজ পড়ার গুরুত্ব বর্ণনাকারী অনেক হাদীস আছে। এখানে আমি শুধু বোখারী ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীসের প্রকৃত বক্তব্যটা উপস্থাপন করছি। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমার ঐ সব মুসলমানের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে যারা (বিশেষ ওজর ছাড়া) আযানের পর জামায়াতে নামাজ পড়তে না এসে, ঘরে একা নামাজ পড়ে।
উপরে বর্ণিত কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য থেকে অতি সহজে বুঝা যায় যে, ইসলাম জামায়াতে নামাজ পড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কাজ বন্ধ রেখে জামায়াতে নামাজ পড়তে আসা অনেক উত্তম। এ কথাটি যে কত বড় সত্য তা অতি সহজে বুঝা যাবে, জামায়াতে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ যে শিক্ষাগুলো দিতে চেয়েছেন, সেগুলো জানার পর। তখন আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হব, যে সমাজে ঐ শিক্ষাগুলোর বাস্তব প্রয়োগ নেই, সেখানে মানুষের যতই টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য থাকুক না কেন, সামাজিক শান্তি বলতে কিছুই থাকতে পারে না।
এবার চলুন জামায়াতে নামাজের সামাজিক শিক্ষাগুলো আলোচনা করা যাক। সে অপূর্ব শিক্ষাগুলো হচ্ছে
১. সমাজের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা ইত্যাদি সামাজিক গুণ সৃষ্টি করা
পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতের ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ.
অর্থ ও ব্যাখ্যা: মুমিনরা পরস্পরের ভাই। আল্লাহ এখানে বলছেন, এক ভাইয়ের অন্তরে অন্য ভাইয়ের জন্যে যেমন সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, ভালবাসা ইত্যাদি থাকে, একজন মুমিনের অন্তরেও ঠিক অন্য মুমিনের জন্যে অনুরূপ অনুভূতি থাকবে।
রাসূল সা. বলেছেন, মুসলমানদের সমাজ একটি দেহের মত। দেহের কোথাও কোন ব্যথা বা কষ্ট হলে সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়। আবার দেহের কোথাও সুখ অনুভূত হলে তাও সমস্ত শরীরে অনুভূত হয়। মুসলমানদের সমাজও হতে হবে অনুরূপ। অর্থাৎ তাদের সমাজেরও কোন ব্যক্তির উপর কোন দুঃখ-কষ্ট আসলে সমাজের সকলের উপর তার ছাপ পড়তে হবে এবং সবাইকে সেটি দূর করারও চেষ্টা করতে হবে। আবার সমাজের কারো কোন সুখের কারণ ঘটলেও সমাজের সকলের উপর তার ছাপ পড়তে হবে।
‘মুমিনরা পরস্পরের ভাই’কথাটি বলেই আল্লাহ ছেড়ে দেন নাই। ভাইয়ের অন্তরে ভাইয়ের জন্যে যেমন স্নেহ-শ্রদ্ধা, মমতা, ভালবাসা, সহমর্মিতা ইত্যাদি থাকে তেমন মুসলমানদের সমাজের সদস্যদের পরস্পরের অন্তরেও অনুরূপ গুণাবলী সৃষ্টি করার জন্যে, তিনি ব্যবস্থা দিয়েছেন জামায়াতে নামাজের। আর এটি জামায়াতে নামাজ পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, পারস্পরিক দেখা-সাাৎ, ওঠা-বসা যত বেশি হয়, ততই একজনের প্রতি আর একজনের মায়া-মহব্বত, স্নেহ-মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি বেশি হয়। আর তা না হলে ঐ সবগুলো বিষয়ই ধীরে ধীরে কমে যায় ()। জামায়াতে নামাজ মুসলমানদের সমাজের একজনের সঙ্গে আর একজনের সেই দেখা-সাাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জামায়াতে নামাজ প্রতিদিন পাঁচবার নিজ এলাকার লোকদের সঙ্গে, প্রতি সপ্তাহে একবার (জুমআর নামাজ) আরো একটু বড় এলাকার লোকদের সঙ্গে এবং প্রতি বছর দু’বার (ঈদের নামাজ) আরো একটু বড় এলাকার লোকদের সঙ্গে এবং প্রতি বছর একবার (হজ্জের সময়) সমস্ত পৃথিবীর সচ্ছল মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে দেখা-সাাতের ব্যবস্থা করেছে। কী অপূর্ব ব্যবস্থা! অন্য কোন জীবন ব্যবস্থায় সমাজের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি স্নেহ-মমতা, ভালবাসা তৈরি করার এমন অপূর্ব সুন্দর ব্যবস্থা আছে কি?
২. সামাজিক সাম্য তৈরির শিক্ষা
পবিত্র কুরআনের সূরা হুজরাতের ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন :
يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُواط إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْط
অর্থ: হে মানুষ, আমি তোমাদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সেই সব থেকে বেশি সম্ভ্রান্ত, যার অন্তরে আল্লাহভীতি সব থেকে বেশি।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে বলছেন, তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একজন পুরুষ ও একজন মহিলা থেকে। এরপর তিনি তাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন। তবে এই বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য পরস্পর সম্মান ও মর্যাদা নির্ণয় করা নয় বরং পরস্পরকে সহজে চেনার ব্যবস্থা করা। এরপর আল্লাহ বলেছেন, তাঁর নিকট মানুষের সম্মান-মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে আল্লাহভীতি। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় যার অন্তরে যতি বেশি, আল্লাহর নিকট সে তত বেশি মর্যাদাশীল। আল্লাহর ভয়ই মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে এবং ন্যায় কাজ করতে বাধ্য করে। তাহলে আল্লাহ বলছেন, ন্যায় কাজ করা বা বাস্তবায়ন করা এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকা বা তা প্রতিরোধ করাই হচ্ছে মানুষের মর্যাদাশীল হওয়ার মাপকাঠি। বংশ, জাতি, ধনী-গরীব, কালো-সাদা, মনির-চাকর ইত্যাদি নিয়ে যেন অহংকার সৃষ্টি না হতে পারে, সে জন্যে তিনি কর্মপদ্ধতিও তৈরি করে দিয়েছেন। সেই কর্মপদ্ধতি হচ্ছে ‘জামায়াতে নামাজ’। একজন মুসলমান দিনে পাঁচবার জামায়াতে নামাজের সময় তার বংশ, ভাষা, গায়ের রং, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্য মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে এক লাইনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় মনিবের পাশেই তাঁর ভৃত্য দাঁড়াতে পারে বা মনিবের মাথা যেয়ে লাগতে পারে সামনের কাতারে দাঁড়ানো তাঁর ভৃত্যের পায়ের গোড়ালিতে। এভাবে দিনে পাঁচবার বাস্তব প্রশিণের মাধ্যমে মুসলমানদের অন্তর থেকে বংশ, বর্ণ, ভাষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ভিত্তিক অহংকার সমূলে দূর করার অপূর্ব ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার এমন অপূর্ব প্রশিণের ব্যবস্থা খুঁজে পাবেন কি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থায়?
৩. সামাজিক শৃঙ্খলার শিক্ষা
সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যতীত কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। জামায়াতে নামাজের মাধ্যমে মুসলমানদের সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অপূর্ব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মুসলমানও যদি জামায়াতে দাঁড়ায়, তবুও দেখবেন, সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে, কী সুন্দর শৃঙ্খলার সঙ্গে তারা একটি কাজ করছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, তারা যেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি কাজ সুশৃঙ্খলভাবে করে। এত সুন্দর প্রশিণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সামাজিক শৃঙ্খলার অবস্থা দেখলে সত্যিই দুঃখ হয়।
৪. সমাজ পরিচালনা পদ্ধতির বাস্তব শিক্ষা
মানবসমাজের সুখ, শান্তি, উন্নতি, প্রগতি ইত্যাদি নির্ভর করে সুষ্ঠুভাবে সমাজ পরিচালনার ওপর। সুষ্ঠুভাবে সমাজ পরিচালনা করতে হলে কী কী বিষয় দরকার, জামায়াতে নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ প্রতিদিন পাঁচ বার তা মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেই বিষয়গুলো হচ্ছে-
ক. নেতা নির্বাচন করা
জামায়াতে নামাজের সময়, একের অধিক লোক হলেই একজন ইমাম বা নেতা বানাতে হয়। এখান থেকে আল্লাহ শিক্ষা দিচ্ছেন, কোন সামাজিক কর্মকাণ্ড, যেখানে একের অধিক লোক জড়িত, তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে একজন নেতা অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে।
খ. পুরুষ না মহিলা নেতা
জামায়াত যদি শুধু পুরুষের হয় বা পুরুষ ও মহিলা মিশ্রিত হয়, তাহলে পুরুষ ইমাম হবে। কিন্তু জামায়াত যদি শুধু মহিলাদের হয়, তবে সেখানে মহিলা ইমাম হতে পারবে। এ থেকে আল্লাহ শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, যে সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড পুরুষ ও মহিলা অধ্যুষিত বা শুধু পুরুষ অধ্যুষিত, সেখানে পুরুষই নেতা হবে। আর যে সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড শুধু মহিলা অধ্যুষিত, সেখানে মহিলা নেতা হতে পারবে।
এর কারণ হল, পুরুষ ও মহিলা মিশ্রিত সামাজিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে, একটি বিশেষ দৈহিক, বুদ্ধি-বৃত্তিক ও মানসিক গঠন দরকার। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সব থেকে ভাল জানেন, ঐ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে ঐ তিনটি গুণের প্রয়োজনীয় সমন্বয় কার মধ্যে অপোকৃত ভাল আছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি পুরুষকেই সে দায়িত্ব দিয়েছেন। আর এটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে আল্লাহ বলেছেন, সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে। আয়াতটি হচ্ছে
الرِّجَالُ قَوَّامُوْنَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍط
অর্থ: পুরুষেরা হচ্ছে নারীর পরিচালক। কারণ, আল্লাহ তাদের একজনকে অপরের উপর বিশিষ্টতা দান করেছেন।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, পুরুষ হচ্ছে নারীর পরিচালক। এরপর তিনি এর কারণটি বলেছেন। কারণটি হল পুরুষকে নারীর ওপর বিশিষ্টতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরিচালনা করা বা নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে যে সব দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিশিষ্টতা দরকার, সে ব্যাপারে পুরুষকে নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও সত্য। মানুষেরা যদি এই সৃষ্টির রহস্যভিত্তিক কথা না মানে, তবে ভোগান্তি হবে তাদের, আল্লাহর নয়।
আল্লাহ কথাটি কুরআনে উল্লেখ করেই থেমে থাকেননি, প্রতিদিন পাঁচ বার নামাজের মাধ্যমে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়ে দেয়ারও ব্যবস্থা করেছেন।
গ. নেতা হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ
একটি সমাজের বা দেশের নেতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে, ঐ সমাজ বা দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে। একজন ভাল নেতা যেমন একটি সমাজ বা দেশকে দ্রুত সব দিক থেকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন, ঠিক তেমনি একজন খারাপ নেতা একটি সমাজ বা দেশকে দ্রুত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই যে গুণাবলী থাকলে কোন ব্যক্তি নেতা হতে পারবে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুণগুলো রাসূল সা. সুন্দরভাবে মুসলমানদের জানিয়ে দিয়েছেন, নামাজের ইমাম হওয়ার গুণাবলী বর্ণনাকারী নিম্নের হাদীসগুলোর মাধ্যমে-
তথ্য-১
عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ فَإِنْ كَانُوا فِي الْقِرَاءَةِ سَوَاءً فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ فَإِنْ كَانُوا فِي السُّنَّةِ سَوَاءً فَأَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً فَإِنْ كَانُوا فِيْ الْهِجْرَةِ سَوَاءً فَأَقْدَمُهُمْ سِلْمًا وَلاَ يَؤُمَّنَّ الرَّجُلُ الرَّجُلَ فِي سُلْطَانِهِ وَلا يَقْعُدْ فِي بَيْتِهِ عَلَى تَكْرِمَتِهِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ.رواه مسلم و في رواية لَّهُ وَلاَ يَؤُمَّنَّ الرَّجُلَ فِىْ اَهْلِهِ.
অর্থ: হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : মানুষের ইমামতি করবে সে-ই, যে কুরআন ভাল পড়ে। যদি কুরআন পড়ায় সকলে সমান হয়, তবে যে সুন্নাহ বেশি জানে। যদি সুন্নাহেও সকলে সমান হয়, তবে যে হিজরত করেছে সে। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে বয়সে বেশি। কেউ যেন অপর ব্যক্তির অধিকার ও মতাস্থলে ইমামতি না করে এবং তার বাড়িতে তার সম্মানের স্থলে না বসে অনুমতি ব্যতীত। (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: কুরআন ভাল পড়ার অর্থ হচ্ছে শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা। তাই এ হাদীসটিতে রাসূল সা. ইমাম হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ বা যোগ্যতাগুলো যে ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
খ. সুন্নাহ তথা হাদীসের জ্ঞান থাকা,
গ. হিজরত করা এবং
ঘ. বেশি বয়স।
তথ্য-২
عَنْ أَبِي سَعِيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانُوا ثَلاَثَةً فَلْيَؤُمَّهُمْ أَحَدُهُمْ وَأَحَقُّهُمْ بِالْإمَامَةِ أَقْرَؤُهُمْ. (رواه مسلم) وَ ذَكَرَ حَدِيْثَ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ فِىْ بَابِ بَعْدَ فَضْلٍ الاَذَانِ.
অর্থ: হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যখন তিন ব্যক্তি হবে, তখন যেন তাদের মধ্য হতে একজন ইমামতি করে এবং ইমামতির অধিকার তার, যে কুরআন অধিক ভাল পড়ে। (মুসলিম)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসখানিতে রাসূল সা. বলেছেন, নামাজের ইমাম সেই হবে যে শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান অধিক রাখে।
তথ্য-৩
عَنْ عَمْرِو بْنِ سَلَمَةَ قَالَ كُنَّا بِمَاءٍ مَمَرِّ النَّاسِ وَكَانَ يَمُرُّ بِنَا الرُّكْبَانُ فَنَسْأَلُهُمْ مَا لِلنَّاسِ مَا هَذَا الرَّجُلُ فَيَقُوْلُوْنَ يَزْعُمُ أَنَّ اللهَ أَرْسَلَهُ أَوْحَى إِلَيْهِ كَذَا فَكُنْتُ أَحْفَظُ ذَلِكَ الْكَلاَمَ وَكَأَنَّمَا يُقَرُّ فِي صَدْرِي وَكَانَتِ الْعَرَبُ تَلَوَّمُ بِاِسْلاَمِهِمُ الْفَتْحَ فَيَقُوْلُوْنَ اُتْرُكُوْهُ وَقَوْمَهُ فَإِنَّهُ إِنْ ظَهَرَ عَلَيْهِمْ فَهُوَ نَبِيٌّ صَادِقٌ فَلَمَّا كَانَتْ وَقْعَةُ أَهْلِ الْفَتْحِ بَادَرَ كُلُّ قَوْمٍ بِإِسْلاَمِهِمْ وَبَدَرَ أَبِي قَوْمِي بِإِسْلاَمِهِمْ فَلَمَّا قَدِمَ قَالَ جِئْتُكُمْ وَاللهِ مِنْ عِنْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَقًّا فَقَالَ صَلُّوا صَلَوةَ كَذَا فِي حِيْنِ كَذَا وَصَلُّوا صَلَوةَ كَذَا فِي حِيْنِ كَذَا فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَوةُ فَلْيُؤَذِّنْ أَحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْثَرُكُمْ قُرْآنًا فَنَظَرُوا فَلَمْ يَكُنْ أَحَدٌ أَكْثَرَ قُرْآنًا مِنِّي لِمَا كُنْتُ أَتَلَقَّى مِنَ الرُّكْبَانِ فَقَدَّمُوْنِي بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَأَنَا ابْنُ سِتٍّ أَوْ سَبْعِ سِنِيْنَ.
অর্থ: আমর ইবনে সালেমা রা. বলেন, আমরা লোক চলাচলের পথে একটি কূপের নিকট বাস করতাম, যেখান দিয়ে আরোহীগণ চলাচল করত। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করতাম, মানুষের কী হল? তারা যে লোকটি সম্বন্ধে বলে তিনি কে? তারা উত্তর করত, লোকটি মনে করে তাকে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন এবং তার প্রতি এইরূপ ওহী নাযিল করেছেন। তখন আমি ওহীর বাণীটি এমনভাবে মুখস্থ করে নিতাম যে তা আমার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যেত। আরবগণ যখন ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে মক্কা বিজয়ের অপো করছিল, তখন তারা বলত তাকে (মুহাম্মাদকে) তার গোত্রের সাথে বুঝতে দাও। যদি সে তাদের উপর জয়লাভ করে তখন বুঝা যাবে, সে সত্য নবী। যখন মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটল, তখন সকল গোত্রই ইসলাম গ্রহণে তাড়াহুড়ো করল এবং আমার পিতা গোত্রের অন্য সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি গোত্রে ফিরে এসে বললেন, আল্লাহর কসম আমি তোমাদের নিকট এক সত্য নবীর নিকট থেকে ফিরে এসেছি। তিনি বলে থাকেন, এই নামাজ এই সময় পড়বে এবং ঐ নামাজ ঐ সময় পড়বে। যখন নামাজের সময় উপস্থিত হবে, তখন তোমাদের মধ্য হতে কেউ যেন আযান দেয় এবং তোমাদের মধ্যে ইমামতি যেন সেই ব্যক্তি করে যে অধিক কুরআন জানে। তখন লোকেরা দেখল, আমার অপো অধিক কুরআন জানে এমন কেউ নেই। কেননা আমি পথিকদের নিকট হতে পূর্বেই তা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। তখন তারা আমাকেই তাদের আগে বাড়িয়ে দিল অথচ তখন আমি ছয় কি সাত বছরের বালকমাত্র। ........... (বুখারী)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, নামাজের ইমাম হওয়ার জন্যে কুরআনের জ্ঞান থাকা বয়সের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য-৪
عَنِ بْنِ عُمَرَ قَالَ لَمَّا قَدِمَ الْمُهَاجِرُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ الْمَدِيْنَةَ كَانَ يَؤُمُّهُمْ سَالِمٌ مَوْلَى أَبِي حُذَيْفَةَ وَ فِيْهِمْ عُمَرُ وَ اَبُوْ سَلَمَةَ بْنُ عَبْدِ الأسَدِ. رواه البخارى
অর্থ: ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. এর হিজরতের পূর্বে যখন প্রথম মুহাজির দল মদীনা পৌঁছলেন, তখন আবু হুযায়ফার গোলাম সালেম রা. তাদের ইমামতি করতেন। অথচ তাদের মধ্যে তখন ওমর এবং আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদের ন্যায় লোকও বিদ্যমান ছিলেন। (বুখারী)
ব্যাখ্যা: হযরত সালেহ একদিকে যেমন কুরআনের বড় জ্ঞানী ছিলেন, অপরদিকে তিনি বড় কারীও ছিলেন। রাসূল সা. যে চার ব্যক্তির নিকট থেকে কুরআন শিখতে বলেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।
এ হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, ইমাম হওয়ার যোগ্যতার মধ্যে শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকার গুরুত্ব বংশ, গোত্র, দেশ অথবা মনিব, গোলাম ইত্যাদির চেয়ে ওপরে।
তথ্য-৫
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِسْتَخْلَفَ ابْنَ أُمِّ مَكْتُوْمٍ يَؤُمُّ النَّاسَ وَهُوَ أَعْمَى. رواه ابو داؤد
অর্থ: আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইবনে উম্মে মাকতুমকে নামাজে লোকের ইমামতি করার জন্যে আপন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ। (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা: হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, নামাজের ইমাম হওয়ার যোগ্যতার মধ্যে শারীরিক পূর্ণতা বা সৌন্দর্যের গুরুত্ব অন্য যোগ্যতার গুরুত্বের চেয়ে কম। তাই সে সৌন্দর্য বা পূর্ণতা শরীরের রং, গঠন, পরিপূর্ণতা অথবা পোশাক-পরিচ্ছদের মূল্য বা কাটিং ইত্যাদি যে কিছুর জন্যেই হোক না কেন।
উল্লিখিত ৫টি হাদীসের সরলার্থ থেকে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, নামাজের ইমাম হওয়ার যোগ্যতা বা গুণাগুণগুলোর প্রথম চারটিকে গুরুত্বের ক্রম অনুযায়ী রাসূল সা. যেভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন বা উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে কুরআন পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
খ. হাদীসের জ্ঞান থাকা,
গ. হিজরত করা এবং
ঘ. বয়স।
শরীরের রং, গঠন, পরিপূর্ণতা, বংশ, গোত্র, দেশ, অথবা পোশাক-পরিচ্ছদের মূল্য, কাটিং ইত্যাদি সাধারণত ইমাম হওয়ার কোন গুণ বা যোগ্যতা নয়। তবে যেটি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম তেমনটি কখনো হলে অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তি উপরের চারটি যোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারেই সমান হলে, কে বেশি যোগ্য সেটি নির্ণয়ের জন্যে ঐ বিষয়গুলো বিবেচনায় আসতে পারে।
ইমামের যোগ্যতা নির্ণয়ের ব্যাপারে রসূল সা. কর্তৃক উল্লিখিত প্রথম তিনটি বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন ব্যক্তিকে যথাযথভাবে যাচাই করতে হলে ঐ তিনটি বিষয়কে নিম্নোক্তভাবে আরো একটু বিস্তারিত জানতে হবে
শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা
যে কোন ভাষা শিক্ষার প্রথম স্তর হচ্ছে ঐ ভাষা শুদ্ধ করে পড়া শিখা। পড়া শুদ্ধ না হলে অর্থ পাল্টে যায়। তাই আল-কুরআনসহ সকল গ্রন্থ পড়ার সময় ইমামসহ সকলের পড়া শুদ্ধ হওয়া অবশ্যই দরকার।
কোন ব্যাপক বিষয়ের (ঠধংঃ ঝঁনলবপঃ) সকল দিকের বিস্তারিত জ্ঞান থাকা সকল মানুষের জন্যে সাধারণভাবে সম্ভব নয়। তাই স্বতঃসিদ্ধভাবে কোন ব্যাপক বিষয়ে জ্ঞানী লোকদের নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা হয়
সাধারণ জ্ঞানী যার ঐ ব্যাপক বিষয়ের সকল দিকের (অষষ ংঢ়পরধষরঃু) মৌলিক জ্ঞান আছে।
বিশেষজ্ঞ জ্ঞানী যার সকল দিকের মৌলিক জ্ঞান আছে এবং এক বা একাধিক দিকের (ঝঢ়বপরধষরঃু) বিস্তারিত জ্ঞান আছে। এ স্তরে অবস্থানকারীদের মধ্যে তাকেই বেশি জ্ঞানী বলা হবে, যার বেশি সংখ্যক দিক (ঝঢ়বপরধষরঃু) সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞান আছে।
জ্ঞানী নয় যার এক বা একাধিক দিক (ঝঢ়বপরধষরঃু) সম্বন্ধে মৌলিক জ্ঞানের অভাব আছে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ধরুন, ডাক্তারি বিদ্যা। এখানে এনাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথোলজি, মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, চু, নাক-কান-গলা, অর্থোপেডিক্স ইত্যাদি অনেক বিভাগ (ঝঢ়বপরধষরঃু) আছে। এই সকল বিষয়ে একজন ডাক্তারের পে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা সম্ভব নয় বলে জ্ঞানের পরিব্যাপ্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ডাক্তারদের নিম্নোক্তভাবে ভাগ করে নেয়া হয়েছে
সাধারণ জ্ঞানী অর্থাৎ অবিশেষজ্ঞ (ঘড়হ-ংঢ়বপরধষরংঃ) ডাক্তার এ ডাক্তাররা হচ্ছেন তারা যাদের ডাক্তারি বিদ্যার সকল বিভাগের ( অষষ ঝঢ়বপরধষরঃু) মৌলিক জ্ঞান আছে।
বিশেষজ্ঞ জ্ঞানী অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ (ঝঢ়বপরধষরংঃ) ডাক্তার এ ডাক্তাররা হচ্ছে তারা যাদের ডাক্তারী বিদ্যার সকল বিভাগের মৌলিক জ্ঞান আছে এবং একটি বিভাগের (ঝঢ়বপরধষরঃু) বিস্তারিত জ্ঞান আছে।
জ্ঞানী নয় অর্থাৎ ডাক্তার নয় যার এক বা একাধিক বিভাগের মৌলিক জ্ঞানের অভাব আছে।
এবার চলুন, কোন বিষয়ে জ্ঞানী হওয়া বা না হওয়ার এই স্বতঃসিদ্ধ (ঊঃবৎহধষ ঞৎঁঃয) তথ্যের আলোকে কুরআনের জ্ঞানী হওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাক
পবিত্র কুরআন হচ্ছে মানুষের দুনিয়ার জীবন সুখী, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীলভাবে পরিচালনার মাধ্যমে পরকালে পুরস্কৃত হওয়ার ল্েয আল্লাহপ্রদত্ত গাইডবুক বা হেদায়েত। তাই দুনিয়ায় মানুষের জীবন নির্ভুলভাবে পরিচালনার জন্যে যত বিষয় প্রয়োজন, তার সকল বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই কুরআনে বক্তব্য আছে। সেই বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে
১. তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ), রেসালাত (নবী-রাসূল), আখিরাত,
ফেরেশতা, কিতাব ইত্যাদি।
২. নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি উপাসনাস্বরূপ ইবাদত।
৩. সমাজের একজনের সঙ্গে আর একজনের আচার-ব্যবহার, দায়িত্ব ও
কর্তব্য অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান (ঝড়পরধষ ঝপরবহপব)।
৪. বিবাহ, তালাক।
৫. উত্তরাধিকারদের মধ্যে সম্পদের বণ্টন।
৬. বিচারব্যবস্থা ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি। বিচারক ও সাীর দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি।
৭. শিক্ষাব্যবস্থা।
৮. অর্থনীতি।
৯. ব্যবসা-বাণিজ্য।
১০. বিজ্ঞান।
১১. যুদ্ধবিদ্যা, যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধনীতি ইত্যাদি।
১২. আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি, সন্ধি ইত্যাদি।
১৩. রাষ্ট্রবিজ্ঞান (চড়ষরঃরপধষ ঝপরবহপব)।
তাহলে পূর্বোল্লিখিত কোন বিষয়ের জ্ঞানী হওয়ার স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী কুরআনের জ্ঞান থাকার বিভিন্ন পর্যায় (এৎধফব) হবে নিম্নরূপ
বিশেষজ্ঞ জ্ঞানী যার কুরআনে উল্লেখিত সকল বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান আছে এবং এক বা একাধিক বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান আছে।
এ স্তরে যার কুরআনে উল্লেখ থাকা বেশি সংখ্যক বিষয়ের বিস্তারিত জ্ঞান থাকবে, তাঁকে অধিক জ্ঞানী বলা বা ধরা হবে।
সাধারণ জ্ঞানী যাঁর কুরআনে উল্লেখিত সকল বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান আছে।
জ্ঞানী নয় যার কুরআনে উল্লেখিত এক বা একাধিক বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানের অভাব আছে।
হাদীসের জ্ঞান থাকা
নামাজের ইমামতি তথা সমাজের নেতা হওয়ার দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় বিষয় (জবয়ঁরৎবসবহঃ) হিসেবে রাসূল সা. হাদীসের জ্ঞান থাকাকে উল্লেখ করেছেন। কুরআনের সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা হাদীসে আছে, তাই হাদীস পড়লেই তো ইসলামের সকল বিষয় ব্যাখ্যাসহকারে জানা যায়। কিন্তু রাসূল সা. ইমামতি করার ব্যাপারে কুরআনের জ্ঞান থাকাকে হাদীসের জ্ঞান থাকার আগে তথা হাদীসের জ্ঞান থাকার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বলেছেন। তিনি কি বিনা কারণে এটি বলেছেন? অবশ্যই না। ব্যাপারটি আজ বিশ্ব মুসলমানদের অত্যন্ত ভাল করে বুঝতে হবে। আর তা বুঝতে হলে কুরআন ও হাদীস সম্বন্ধে নিম্নের তথ্যগুলো জানতে হবে
ক. মৌলিক-অমৌলিক আমলের পার্থক্য নির্ণয়ের অসুবিধা
কুরআন-সুন্নাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের বিষয়গুলো প্রধানত মৌলিক ও অমৌলিক এ দু’ভাগে বিভক্ত। মৌলিক বিষয়গুলো আবার প্রথম স্তর ও দ্বিতীয় স্তর, এ দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয়গুলো হচ্ছে সেগুলো, যেগুলোর একটিও ইচ্ছাকৃতভাবে বা ছোটখাট ওজরের কারণে পালন না করলে একজন মানুষকে সরাসরি (উরৎবপঃষু) জাহান্নামে যেতে হবে। দ্বিতীয় স্তরের মৌলিক বিষয়গুলো হচ্ছে প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতির মৌলিক বিষয়। এগুলোর একটি ইচ্ছাকৃতভাবে বা ছোট ছোট ওজরের কারণে পালন না করলেও একজন মুসলমানকে জাহান্নামে যেতে হবে, তবে এ জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে পরো (ওহফরৎবপঃ)। কারণ দ্বিতীয় স্তরের একটি মৌলিক বিষয় পালন না করলে ঐ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রথম স্তরের মৌলিক কাজটি ব্যর্থ হবে আর তাই তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। আর অমৌলিক আমলগুলোর সবটিও যদি কেউ ঘৃণা বা অস্বীকার না করে, কোন গ্রহণযোগ্য কারণের (ওজর) জন্যে পালন না করতে পারে, তবে তার জন্যে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে না। এ জন্য শুধু তার বেহেশতের মান (এৎধফব) কমবে।
সূরা নাহলের ৮৯ নং আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, আল-কুরআনে তিনি ইসলামের সকল প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয় উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় স্তরের মৌলিক বিষয়ের সবগুলো কুরআনে উল্লেখিত নেই। কিছু আছে শুধু সুন্নাহ তথা হাদীসে। আর অমৌলিক আমলের প্রায় সবই আছে শুধু হাদীসে। কিন্তু শুধু হাদীস পড়ে এটি বুঝা অসম্ভব যে, কোন্ আমলগুলো মৌলিক আর কোন্গুলো অমৌলিক। তাই যদি শুধু হাদীস পড়েই ইসলামকে জানার ব্যবস্থা চালু হয়, তবে মুসলমানরা ইসলামের কোন্ বিষয়গুলো মৌলিক আর কোন্ বিষয়গুলো অমৌলিক, তা বুঝতে পারবে না। ফলে ইসলাম পালনের সময় তারা অমৌলিক বিষয়গুলো মৌলিক বিষয়গুলোর থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে থাকবে, যা তারা বর্তমানে করছে। যে কোন জীবনব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার জন্যে এটি একটি অত্যন্ত বড় কারণ। ইসলামের মৌলিক ও অমৌলিক বিষয়ের মহা তিকর এই মিশ্রণ এড়ানোর জন্যে রাসূল সা. মক্কী জীবনে, হাদীস লিপিবদ্ধ করাকে নিষেধ করেছেন। অথচ কুরআন নাযিলের সাথে সাথে তিনি তা লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ করার ব্যবস্থা করেছেন।
খ. কুরআন বানানো বা পরিবর্তন করা অসম্ভব কিন্তু হাদীসের ব্যাপারে তা সম্ভব
ইসলামের শত্র“রা বা ইসলামের অতি ভক্তরা, রাসূল সা. যে সব কথা, কাজ বা সমর্থন করেননি, তেমন বিষয়কেও হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে। কারণ হাদীস বানানো বা পরিবর্তন করা সম্ভব। এরকম অসংখ্য হাদীস বানানো বা পরিবর্তন করা হয়েছে বলেই ইমাম বুখারী রা. ৬ (ছয়) ল হাদীস বাছাই করে দ্বিরুক্তি বাদ দিয়ে মাত্র ২৬০২-২৭৬১টি হাদীসকে বুখারী শরীফে উল্লেখ করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন পেয়েছেন।
পান্তরে কুরআনের একটি ছোট আয়াতও কেয়ামত পর্যন্ত কেউ বানাতে পারবে না। এটি কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন এভাবে
وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ.
অর্থ: এটা নিশ্চিত যে, আমি এ কিতাব সংরণ করব। (আল হিজর : ৯)
গ. মিথ্যা হাদীস শনাক্ত করার উপায়
হাদীসের গ্রন্থসমূহে মিথ্যা হাদীস শনাক্ত করার উপায় হিসাবে হাদীস বর্ণনাকারীদের (রাবী) চরিত্র, মেধা, স্মরণশক্তি, ইসলাম পালন, পরিচিতি, বর্ণনাকারীর সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করা হয়েছে। যে সব হাদীসের বর্ণনাকারী (রাবী) উপরোক্ত গুণাগুণের বিচারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁদের বর্ণনাকৃত হাদীসকে সহীহ হাদীস হিসেবে ধরা হয়েছে। কারণ, এটি ধরে নেয়া হয়েছে যে, উপরোক্ত গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে আছে, তিনি মিথ্যা হাদীস বা বানানো হাদীস বলতে পারেন না। হাদীসের গ্রন্থসমূহে হাদীসের বক্তব্য বিষয়কে (মতন), হাদীসটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে, বিবেচ্য বিষয় (ঈৎরঃবৎরধ) হিসেবে ধরা হয় নাই।
তাই যদি দেখা যায়, কোন হাদীসের বক্তব্য কুরআনের কোন স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী, তবে নির্দ্বিধায় বলতে হবে সে হাদীসটি বানানো বা হাদীসটির ব্যাখ্যা ভুল করা হয়েছে। কারণ কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী কোন কথা, কাজ বা সমর্থন রাসূল সা. অবশ্যই করতে পারেন না। এ বিষয়টি সকল মুসলমানের নিকট অত্যন্ত পরিষ্কার থাকা দরকার। হাদীস সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ‘হাদীসশাস্ত্র অনুযায়ী সহীহ হাদীস বলতে নির্ভুল হাদীস বুঝায় কি?’ নামক বইটিতে।
ঘ. সকল সুন্নাহ হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হওয়া না হওয়া
রাসূল সা. কুরআনের সঙ্গে সুন্নাহের মিশ্রণ এড়ানোর জন্যে মক্কী জীবনে হাদীস লিখতে নিষেধ করেছেন। খুলাফায়ে রাশেদীনগণ হাদীস সংকলনের বিরোধী ছিলেন। তাই প্রকৃতভাবে হাদীস সংকলন করা শুরু হয় তাঁর ইন্তেকালের ১৭৫ বছরেরও পরে। তাছাড়া রাসূল সা. তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে ভুল বা বানানো কথা বলাকে একটি অতি বড় গুনাহের বিষয় বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। তাই জানা থাকলেও নির্ভুলতার ব্যাপারে সামান্য সন্দেহ থাকলে বহু সাহাবী অনেক হাদীস বর্ণনা করেননি। সুতরাং সকল সুন্নাহ হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে এ কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে না বা যায় না।
ঙ. হাদীস গ্রন্থের ভাণ্ডার অনেক বড় হওয়া এবং হাদীস হুবহু মুখস্থ রাখা কঠিন হওয়া
কুরআনের চেয়ে হাদীসের ভাণ্ডার অনেক বড় এবং তা মনে রাখাও কঠিন। তাই তো কুরআনের হাফিজের সংখ্যার তুলনায় হাদীসের হাফিজের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
হিজরত করা
নামাজের ইমাম হওয়ার গুণাবলীর (ছঁধষরঃু) মধ্যে রাসূল সা. তিন নম্বরে উল্লেখ করেছেন হিজরত করাকে। হিজরত ইসলামের একটি আমল বা কাজ । সুতরাং হিজরত করা বলতে রাসূল সা. বুঝিয়েছেন ইসলামের আমল বা কাজ করাকে। হিজরত বর্তমানে সাধারণভাবে চালু নাই। তাই বর্তমান বিশ্ব মুসলমানদের এটি ভাল করে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ-তাহলিল, যিকির-আযকারসহ ইসলামের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকা সত্ত্বেও রাসূল সা. কেন ইমাম হওয়ার তিন নাম্বার গুণ (ছঁধষরঃু) হিসেবে এমন একটি আমলের নাম উল্লেখ করেছেন, যা সাধারণভাবে চালু নেই। ব্যাপারটি বুঝতে হলে হিজরত সম্বন্ধে নিম্নের তথ্যগুলো মনে রাখতে হবে
হিজরতের অর্থ
হিজরত ইসলামের একটি পরিভাষা। এর অর্থ হচ্ছে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিজ জন্মভূমি, আত্মীয়-স্বজন, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে স্থায়ীভাবে অন্য স্থানে চলে যাওয়া।
হিজরতের উদ্দেশ্য
রাসূল সা. এর দুনিয়ায় আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে, মানুষের কল্যাণের জন্যে কুরআনে বর্ণিত সকল ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে, দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে দেয়া। এ কাজটি শুধুমাত্র করা সম্ভব ইসলামকে বিজয়ী তথা শাসন মতায় বসানোর মাধ্যমে।
নবুয়াত প্রাপ্তির পর রাসূল সা. মক্কায় ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কার্যক্রম চালাতে থাকেন। কিন্তু ১৩ বছর অকান্ত পরিশ্রম করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, মক্কাতে ইসলামকে বিজয়ী করা সম্ভব নয়। কারণ সেখানকার অধিকাংশ মানুষ ছিল ইসলামের সক্রিয় বিরোধী। পান্তরে মদিনার অবস্থা ছিল ভিন্ন। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ হয় ইসলামের প,ে না হয় নিষ্ক্রিয় বিরোধী ছিল। অর্থাৎ আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী মক্কায় ইসলাম বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না কিন্তু মদিনায় তা ছিল। তাই তিনি নিজের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি, আত্মীয়-স্বজন ও সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং হিজরত করলেন। মদিনায় পৌঁছে প্রথমেই তিনি ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে ঘোষণা করে একটি ছোট ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন।
‘হিজরত’ সম্বন্ধে উপরোক্ত তথ্য পর্যালোচনার পর এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, হিজরত ইসলামের এমন একটি আমল বা কাজ, যার উদ্দেশ্য ইসলামকে বিজয়ীশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং যেটি করতে অত্যন্ত কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
এখন আশা করি, সবার নিকট পরিষ্কার হবে যে, নামাজের ইমাম হওয়ার জন্যে রাসূল সা. হিজরত নামক আমল বা কাজ দ্বারা ঐ সব কাজকে বুঝাতে চেয়েছেন, যার উদ্দেশ্য হবে ইসলামকে বিজয়ীশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং যা করতে যেয়ে কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাই সহজে বুঝা যায়, ইমাম হওয়ার গুণাগুণের মধ্যে হিজরত করাকে তিন নম্বরে উল্লেখ করার মাধ্যমে রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন ইমাম হওয়ার তিন নম্বর গুণ হবে এক ও দুই নম্বর গুণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল বা কাজ করা। আর আমলগুলোর গুরুত্বের ক্রম অনুযায়ী অবস্থান হবে
১. ঐ সকল মৌলিক কাজ যার উদ্দেশ্য হবে দীনকে বিজয়ী করা এবং যা করতে মাল ও জানের প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করা লাগে।
২. ঐ সকল মৌলিক কাজ যা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের মধ্যে পড়ে।
৩. ঐ সকল মৌলিক কাজ যা মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের মধ্যে পড়ে।
৪. ইসলামের অমৌলিক কাজ।
তাহলে নামাজের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ বা দেশের নেতা তথা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার পরিষদের নেতা হওয়ার জন্যে যে গুণাবলীর প্রয়োজন হবে বলে আল্লাহ ও রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন, গুরুত্বের ক্রম অনুযায়ী সেগুলোর বিন্যাস হচ্ছে
১. শুদ্ধ করে কুরআন পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা। এখানে কুরআনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানীকে সাধারণ জ্ঞানীর চেয়ে বেশি যোগ্য ধরতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞানীদের মধ্যে যার কুরআনের বেশি সংখ্যক বিভাগের (ঝঢ়বপরধষরঃু) বিশেষ জ্ঞান আছে, তাকে বেশি যোগ্য ধরতে হবে।
২. হাদীসের জ্ঞান থাকা।
৩. আমল করা। আর আমল করার ব্যাপারে নিম্নের ক্রম অনুযায়ী যার আমল যত বেশি হবে, তাকে তত বেশি যোগ্য ধরতে হবে
ক. ঐ সকল মৌলিক আমল যার উদ্দেশ্য ইসলামকে বিজয়ী করা তথা শাসন মতায় বসান এবং যা পালন করতে প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করা লাগে।
খ. ঐ সকল মৌলিক আমল যা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের মধ্যে পড়ে।
গ. ঐ সকল মৌলিক আমল যা মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের মধ্যে পড়ে।
ঘ. অমৌলিক আমল।
৪. বয়স।
৫. শারীরিক পরিপূর্ণতা, গায়ের রং, বংশ, গোত্র, দেশ, মনিব, গোলাম, পোশাক-পরিচ্ছদের মূল্য ও তৈরির ধরন ইত্যাদি নেতার যোগ্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ডে তখনই শুধু আসতে পারে, যখন উপরের সকল গুণ একাধিক ব্যক্তির মধ্যে একই মানের হবে, যা একটি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
ঘ. নেতা নির্বাচন পদ্ধতির শিক্ষা
মুসলিমসমাজ বা দেশের নেতা তথা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার পরিষদের নেতা কী পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে সেটি মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন নামাজের ইমাম নির্বাচনের পদ্ধতির মাধ্যমে, যা প্রত্যেক নামাজীকে প্রতিদিন পাঁচবার অনুশীলন করতে হয়। নামাজের ইমাম নির্বাচনের ঐ পদ্ধতি রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন নিম্নের হাদীসগুলোর মাধ্যমে
তথ্য-১
عَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَال قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلاَثَةٌ لاَ يَقْبَلُ اللهُ مِنْهُمْ صَلَوتُهُمْ مَنْ تَقَدَّمَ قَوْمًا وَهُمْ لَهُ كَارِهُوْنَ وَرَجُلٌ أَتَى الصَّلَوةَ دِبَارًا وَالدِّبَارُ أَنْ يَأْتِيَهَا بَعْدَ أَنْ تَفُوتَهُ وَرَجُلٌ اعْتَبَدَ مُحَرَّرَهُ.رواه ابو داؤد و ابن ماجة
অর্থ: ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে নাক. যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার বলে নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং গ. যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।
ব্যাখ্যা: হাদীসটিতে রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ লোকেরা (অথ্যাৎ ঈমানদার জনগণ) তাকে পছন্দ করে না তার নামাজ কবুল হবে না। অর্থাৎ কোন গোত্র বা জাতির ইমামের নামাজ কবুল হতে তাকে অবশ্যই সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদির সমর্থন তথা ‘ভোট’ নিয়েই ইমাম হতে হবে। সুতরাং সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদি যাকে পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণসমূহের ভিত্তিতে অধিক যোগ্য মনে করবে সেই নামাজের ইমাম হবে।
তথ্য-২
وَ عَنْ اَبِىْ اُمَامَةَ (رض) قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلاَثَةٌ لاَ تُجَاوِزُ صَلَوتُهُمْ آذَانَهُمُ الْعَبْدُ الْآبِقُ حَتَّى يَرْجِعَ وَامْرَأَةٌ بَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَلَيْهَا سَاخِطٌ وَإِمَامُ قَوْمٍ وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ. رواه الترمذى وَ قَالَ حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ.
অর্থ: আবু উমামা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের কানের সীমা অতিক্রম করে না (অর্থাৎ কবুল হয় না) ক. পলাতক দাস যতণ না সে ফিরে আসে, খ. যে নারী রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী তার ওপর অসন্তুষ্ট এবং গ. গোত্র বা জাতির ইমাম কিন্তু মানুষ (সঙ্গত কারণে) তাকে পছন্দ করে না। (তিরমিযী, তবে হাদীসটিকে তিরমিযী গরীব বলেছেন)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসটি থেকেও বুঝা যায়, যে ব্যক্তি নামাজের ইমাম হয়েছে কিন্তু মানুষেরা তাকে সঙ্গত কারণে পছন্দ করে না, তার নামাজ কবুল হয় না বা হবে না। অর্থাৎ এ হাদীসটি থেকেও বুঝা যায়, নামাজের ইমাম হতে হবে সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদির সম্মতি তথা ভোটের মাধ্যমে। এ হাদীসখানির মাধ্যমেও তাই রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন নামাজের ইমাম সেই হবে যাকে সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদি পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণের ভিত্তিতে অধিক যোগ্য মনে করবে।
তথ্য-৩
وَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ثَلاَثَةٌ لاَ تَرْتَفِعُ صَلَوتُهُمْ فَوْقَ رُءُوسِهِمْ شِبْرًا رَجُلٌ أَمَّ قَوْمًا وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ. وَامْرَأَةٌ بَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَلَيْهَا سَاخِطٌ وَأَخَوَانِ مُتَصَارِمَانِ. رواه ابن ماجه
অর্থ: ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা (সঙ্গত কারণে) তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসটি থেকেও বুঝা যায়, ইমাম হতে হলে অবশ্যই সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদির সম্মতির (ভোটের) মাধ্যমে হতে হবে।
উল্লিখিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের প্রত্যেকটিতে রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাজের ইমাম হবে কিন্তু অধিকাংশ মুক্তাদি তাকে চায় না তথা পূর্বোল্লিখিত ইমাম হওয়ার গুণাগুণসমূহের ভিত্তিতে যোগ্য মনে করে না, তার নামাজ কবুল হবে না। অর্থাৎ পরকালে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই সকল হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে নামাজের ইমাম নির্বাচনের ব্যাপারে যে বিধি-বিধান বের হয়ে আসে এবং যা প্রতিটি মুসলমান বাস্তব আমলের ভিত্তিতে দিনে পাঁচবার অনুসরণ করছে, তা হচ্ছে
ক. ভোট বা সমর্থনের মাধ্যমে সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদি যাকে পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণসমূহের ভিত্তিতে অধিকতর যোগ্য মনে করবেন তিনি নামাজের ইমাম হবেন। আর এই সমর্থন দিতে হবে সকল রকম অন্যায় প্রভাব মুক্ত হয়ে।
খ. ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করে ইমাম নির্বাচন করা ইসলামের একটি মৌলিক বিধান। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন, ঐ পদ্ধতি অনুসরণ না করে যে ইমাম হবে, তার নামাজ কবুল হবে না। সুতরাং তাকে জাহান্নামে যেতে হবে অর্থাৎ তার সকল কর্মকাণ্ড ব্যর্থ হবে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নামাজের অনুষ্ঠান থেকে আল্লাহ মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আর নামাজের ইমাম নির্বাচনের বিধি-বিধানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, সমাজের নেতা নির্বাচন করার বিধি-বিধান। তাহলে সমাজের নেতা নির্বাচনের সেই বিধি-বিধানগুলো হবে
১. নেতা নির্বাচিত করতে হবে সকল বা অধিকাংশ ঈমানদার মুসলমানের সমর্থন তথা ভোটের মাধ্যমে।
২. সকল বা অধিকাংশ ঈমানদার মুসলমান ঐ ভোটের মাধ্যমে জানাবেন কোন্ ব্যক্তি তাদের মতে নেতা হওয়ার জন্যে পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণের ভিত্তিতে অধিকতর যোগ্য।
৩. ঐ ভোটাভুটি হতে হবে সকল প্রকার অন্যায় প্রভাবমুক্তভাবে।
৪. নেতা নির্বাচনের এই বিধি-বিধান ইসলামের একটি মৌলিক বিধি-বিধান। অর্থাৎ নেতা নির্বাচিত ও পরিবর্তন করার ব্যাপারে ঐ বিধি-বিধানসমূহ ইচ্ছাকৃতভাবে যে অমান্য করবে, পরকালে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
ঙ. নেতার আনুগত্য ও অপসারণ পদ্ধতির শিক্ষা
নামাজের ইমামের আনুগত্য করার পদ্ধতি হচ্ছে
ইমাম যতণ সঠিকভাবে অর্থাৎ কুরআন-সুন্নায় উল্লেখিত নীতিমালা অনুযায়ী নামাজ পরিচালনা করবেন ততণ তাকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে নামাজ হবে না।
ইমাম ভুল করলে, (ভয় না করে) পিছন থেকে লোকমার মাধ্যমে অর্থাৎ গঠনমূলকভাবে তাকে শোধরানোর জন্যে বলতে হবে।
ইমাম শুধরিয়ে নিলে তার আনুগত্য বহাল রাখতে হবে।
কোন মারাত্মক ভুল লোকমার পরও অর্থাৎ গঠনমূলক সমালোচনার পরও যদি ইমাম শুধরিয়ে না নেয়, তবে তাকে বাদ দিয়ে সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদির ভোটের মাধ্যমে নতুন ইমাম নির্বাচন করতে হবে।
অতএব নামাজের ইমামের আনুগত্য ও অপসারণ পদ্ধতি হতে মুসলমান সমাজের নেতার আনুগত্য ও অপসারণ পদ্ধতি হবে
নেতা যতণ কুরআন হাদীসে বর্ণিত সীমারেখার মধ্যে থেকে সমাজ পরিচালনা করবে, ততণ অবশ্যই তার আনুগত্য করতে হবে।
নির্বাচিত নেতা ভুল করলে নির্ভয়ে, ভদ্র ও গঠনমূলকভাবে তার ভুল
ধরিয়ে দিতে হবে।
মারাত্মক ভুল ধরিয়ে দেয়ার পরও নেতা যদি শুধরিয়ে না নেয় তবে তাকে অপসারণ করে ভোটের মাধ্যমে নতুন নেতা নির্বাচন করতে হবে।
সুধী পাঠকবৃন্দ, চিন্তা করে দেখুন, বর্তমান মুসলিম দেশগুলোতে নামাজীরা কোথাও কি নামাজের মাধ্যমে দেয়া শিক্ষা অনুযায়ী তাদের সমাজের নেতা নির্বাচন ও তার আনুগত্য করে? যদি তারা তা করত, তবে কী অপূর্ব শান্তি-শৃঙ্খলাই না তাদের সমাজে বা দেশে স্থাপিত হত।
চ. নেতার সমাজ বা দেশ পরিচালনা পদ্ধতির ব্যাপারে শিক্ষা
নামাজের ইমামের নামাজ পরিচালনার পদ্ধতিসমূহ
ইমামকে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত গণ্ডির মধ্যে থেকে নামাজ পরিচালনা করতে হবে।
নামাজ পরিচালনার সময় ইমামকে মুক্তাদিদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন মুক্তাদিদের মধ্যে কেউ অসুস্থ বা ব্যস্ত থাকতে পারে, তাই দীর্ঘ সূরা পড়ে নামাজ লম্বা করা ঠিক নয়।
সুতরাং নামাজের শিক্ষা অনুযায়ী, মুসলিমসমাজ বা দেশের নেতার, দেশ পরিচালনা পদ্ধতি হবে
দেশ পরিচালনার ব্যাপারে সে স্বাধীন নয়। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আইন-কানুনের গণ্ডির মধ্যে থেকে তাকে দেশ চালাতে হবে।
যুগের দাবি অনুযায়ী নতুন আইন-কানুন বানানোর দরকার হলে ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোর আলোকে শুরা তথা আইন পরিষদের মাধ্যমে তা করতে হবে। মৌলিক বিধানগুলোর বিরোধী কোন আইন অবশ্যই বানানো যাবে না।
দেশ পরিচালনার সময় সাধারণ নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধা তথা কল্যাণের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
ছ. জামায়াতবদ্ধ বা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার শিক্ষা
জামায়াতে নামাজের একটি প্রধান শিক্ষা হচ্ছে জামায়াতবদ্ধ বা দলবদ্ধ হয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ড করা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلاَ تَفَرَّقُواج
অর্থ: তোমরা দলবদ্ধভাবে আল্লাহর রুজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (আল ইমরান : ১০৩)
আল্লাহ এখানে দলবদ্ধভাবে ইসলামের কাজ করার আদেশ দিচ্ছেন অর্থাৎ জামায়াতবদ্ধ হয়ে কাজ করাকে ফরজ করে দিয়েছেন। জামায়াতে নামাজ হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে এই আদেশ পালনের শিক্ষা। ইসলামের সব চেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, আল্লাহর দীনকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে, আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করা। সংঘবদ্ধ বা দলবদ্ধভাবে ছাড়া সে কাজে সফল হওয়া অসম্ভব। হজরত ওমর রা. তাই বলেছেন, জামায়াতবিহীন ইসলাম নেই, নেতাবিহীন জামায়াত নেই।
জামায়াতে নামাজ, আমাদের সেই দলবদ্ধ হিসাবে কাজ করার শিক্ষাই শুধু দেয় না, দলবদ্ধ হিসাবে কাজ করে সফলকাম হতে হলে কী কী মৌলিক বিষয় অনুসরণ করতে হবে, তাও অত্যন্ত সুন্দরভাবে শিক্ষা দেয়, প্রতিদিন পাঁচবার।
নামাজের পঠিত বিষয় থেকে শিক্ষা
নামাজের কিছু নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট কালাম, তাসবীহ ও দোয়া সকল নামাজীকে পড়তে হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দুটি
১. কালাম (কুরআন) পড়ার মাধ্যমে নামাজীকে ইসলামের মূল বা প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয়গুলো জানা ও ভুলে না যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
২. তাসবীহ ও দোয়ার মাধ্যমে তার সামনে দাঁড় করিয়ে নামাজীর মুখ দিয়ে কিছু স্বীকৃতি বা অঙ্গীকার আদায় করে নেয়া যাতে করে বান্দাহ নামাজের বাইরেও ঐ কথা ও স্বীকারোক্তিগুলো অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করে। নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে তাসবীহ ও দোয়ার মাধ্যমে যে কথাগুলো নামাজী বলে বা স্বীকার করে বাস্তব জীবনে যদি সেই কথা বা স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে কাজ না করে, তবে নামাজীর কথা ও কাজে মিল থাকে না। যারা কথা বলে একরকম আর কাজ করে অন্যরকম তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آَمَنُوا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لاَ تَفْعَلُوْنَ.كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لاَ تَفْعَلُوْنَ.
অর্থ: হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা মুখে যা বল কাজে তা কর না কেন? আল্লাহর নিকট এটা অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী বিষয় যে, তোমরা মুখে যা বলবে কাজে তা করবে না।
তাই প্রত্যেক নামাজীর ভাল করে জানা দরকার, নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে সে কী বলছে বা স্বীকার করছে। নামাজের বাইরে যদি তার কাজ সেই অনুযায়ী না হয়, তবে কুরআন বলছে, আল্লাহর অত্যন্ত ক্রোধে তাকে পড়তে হবে।
নামাজে কালাম (কুরআন) পড়া থেকে শিক্ষা
ক. সূরা ফাতেহা পড়া থেকে শিক্ষা
নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহা পড়া ফরজ। একজন মুসলমান ফরজ, ওয়াজেব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ধরে প্রতিদিন ফজরে ৪. বার, জোহরে ১০ বার, আছরে ৪ বার, মাগরিবে ৫ বার, এশায় ৯ বার অর্থাৎ মোট ৩২ বার সূরা ফাতেহা পড়ে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না হলে নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতিদিন ৩২ বার এই সূরাটি পড়ার ব্যবস্থা করতেন না। রাসূল সা. বলেছেন, সূরা ফাতেহা হচ্ছে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা। চলুন এখন দেখা যাক, সূরা ফাতেহাকে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সূরাটিকে এত গুরুত্ব দেয়ার কারণ হচ্ছে, মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত দেখে সাধারণ মুসলমানরা ইসলাম পালনের ব্যাপারে যে ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, বান্দাহ এবং তার মধ্যে কথোপকথনস্বরূপ প্রার্থনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সে দ্বন্দ্বের সমাধান দিয়েছেন এ সূরাটির মধ্যদিয়ে।
নামাজকে বলা হয়েছে আল্লাহর সঙ্গে সাাতের ব্যবস্থা। অর্থাৎ একজন মুসলমান যখন নামাজে দাঁড়ালো, তখন সে যেন আল্লাহর সামনে দাঁড়ালো। আর এই দাঁড়ানোর পর আল্লাহর সঙ্গে সে কথোপকথন হয়, সেটিই হচ্ছে সূরা ফাতেহা।
এ ব্যাপারে সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই-নাসাই শরীফে উল্লেখিত এবং আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত একটি হাদীসের বক্তব্যকে সামনে রেখে সূরাটির বক্তব্যগুলো এবং তা উপস্থাপনের ধরন নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহ ও নামাজীর মধ্যে সেই কথোপকথনটি নিম্নরূপ হবে বলে সহজে বুঝা যায়। সূরাটিতে আল্লাহর কথাগুলোকে উহ্য (ঝরষবহঃ) রাখা হয়েছে, আর বান্দার কথাগুলো লিখা আছে।
নামাজীর কথা
নামাজে দাঁড়িয়ে একজন নামাজী প্রথমে আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে তাঁর প্রশংসা করে তিনটি কথা বলে। যথা
الْحَمْدُ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ. الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ. مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ.
অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যেযিনি মহাবিশ্বের রব। তিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়; বিচার দিনের মালিক।
ব্যাখ্যা: নামাজী বলছে, হে আল্লাহ, আমরা যে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দুনিয়ায় বেঁচে থেকে আমাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছি এর জন্যে সকল প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য শুধু আপনি। কোন নেতা, পীর, বুজুর্গ, ডাক্তার ইত্যাদি নয়। এভাবে নামাজী তিনটি বিষয়ে আল্লাহকে স্বেচ্ছায় স্বীকৃতি দিচ্ছে। যথা
আল্লাহ হচ্ছেন মহাবিশ্বের রব
আরবী ভাষায় রব শব্দটির তিন প্রকার অর্থ হয়। যথা ক. মনিব বা প্রভু। খ. লালন-পালনকারী বা তত্ত্বাবধায়ক। গ. আদেশদাতা, আইনদাতা, শাসক বা বিচারকর্তা। নামাজী এই সকল অর্থেই স্বেচ্ছায় আল্লাহকে স্বীকৃতি দেয়।
আল্লাহ পরম দয়ালু ও করুণাময়
রোগব্যাধি ও অন্য অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে আমরা যে এ দুনিয়ায় বেঁচে আছি, এটি সত্যিই তাঁর দয়া। আর তিনি দয়া না করলে আমরা কেউই পরকালেও শান্তিতে থাকতে পারব না। তিনি মাফ করার জন্যেই বসে আছেন। শাস্তি দেয়ার জন্যে নয়। আমরা যদি কুরআনে বর্ণিত মৌলিক কাজগুলো অন্তত করতে পারি তবে তিনি ছোটখাট সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। এ কথা পবিত্র কুরআনে তিনি অনেকবার উল্লেখ করেছেন। আল্লাহকে দয়ালু ও করুণাময় বলার মাধ্যমে নামাজী এ বাস্তব অবস্থার স্বীকৃতি দেয়।
আল্লাহ বিচার দিনের মালিক
এ কথা বলে নামাজী আল্লাহকে বলছে, শেষ বিচারের দিনে সর্বময় কর্তৃত্ব থাকবে আপনার। ইসলামের মৌলিক কাজগুলো না করে গেলে সেই দিন কোন পীর, বুজুর্গ, শহীদ, এমনকি নবীও কাউকে বাঁচাতে পারবেন না। তাই রাসূল সা. নবুয়াত পেয়ে আল্লাহর নির্দেশে সম্মেলন ডেকে, সর্বপ্রথম যে দিন ইসলামের দাওয়াত দেন, সে দিন তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়ে ফাতেমাকেও রা. সম্বোধন করে বলেছিলেন, হে ফাতেমা, তুমি যদি আল্লাহর আনুগত্য না কর তবে সেই বিচার দিনে, তোমার পিতা আমি মুহাম্মাদও তোমাকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারব না।
আল্লাহ প্রশ্ন
নামাজীর তিনটি কথা শুনে আল্লাহ বলছেন, ‘কে তুই আমার প্রশংসা করছিস? কী তোর পরিচয়?
নামাজীর জবাব
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ.
অর্থ: আমরা তোমারই দাসত্ব করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ নামাজীর পরিচয় জানতে চাওয়াতে নামাজী বলছে, আমি সেই ব্যক্তি যে সারাণ শুধু তোমারই দাসত্ব করি এবং শুধু তোমারই কাছে সাহায্য চাই। দাসত্ব করা মানে হুকুম মানা। যা হুকুম তাই আইন আর যা আইন তাই হুকুম। তাহলে নামাজী আল্লাহকে বলছে আমি সেই ব্যক্তি, যে ২৪ ঘণ্টার জীবনে অন্য কারো নয়, শুধু তোমারই আইন মেনে চলি।
নামাজী আরো বলছে, আমি শুধু তোমার কাছে সাহায্য চাই। কারণ আমি জানি নেতা, পীর, বুজুর্গ কারোরই মতা নেই, তোমার নিকট থেকে জোর করে কিছু আদায় করে দেয়ার। তাই পীর, বুজুর্গ বা অন্য কাউকে নজর-নেয়াজ বা অন্যভাবে ঘুষ দিয়ে খুশি করে তার দ্বারা তোমার নিকট থেকে কিছু আদায় করে নেয়ার মতবাদে আমি বিশ্বাস করি না।
আল্লাহর জিজ্ঞাসা
বেশ জানলাম তোর পরিচয়। এখন বল, তুই কী চাস?
নামাজীর উত্তর
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ.
অর্থ: আমাদের সঠিক পথ দেখাও।
ব্যাখ্যা: আল্লাহর ‘তুই কী চাস’ প্রশ্নের উত্তরে নামাজী একটি জিনিসইমাত্র চেয়েছে, আর তা হচ্ছে, সঠিক পথ। এখানে লণীয় হচ্ছে, যে নামাজী সঠিক পথের সন্ধান আল্লাহর কাছে চেয়েছে, সে কিন্তু নিজের কয়টি কথা বলেছে বা স্বীকার করেছে
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে।
আল্লাহ মহাবিশ্বের রব।
আল্লাহ শেষ বিচার দিনের মালিক।
চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে সে শুধু তাঁরই আইন মেনে চলে।
অর্থাৎ নামাজী কাফের, কমিউনিস্ট বা ধর্মনিরপেতাবাদী নয় বরং সে একজন পাকা ঈমানদার মুসলমান। তাহলে কেন সেই ঈমানদার মুসলমান, যে ইসলামকেই তার জীবন ব্যবস্থা হিসাবে বেছে নিয়েছে, সে আল্লাহ চাইতে বলাতে অন্য কিছু না চেয়ে শুধু সঠিক পথের সন্ধান চাইল? বেশ চিন্তার বিষয়, তাই না? আল্লাহর ও নামাজীর পরবর্তী কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
আল্লাহর জিজ্ঞাসা
নামাজীর সঠিক পথ চাওয়ার উত্তরে আল্লাহ বলেছেন, আচ্ছা বান্দা, এতণের কথাবার্তায় তো বুঝা যায়, তুই ইসলামের সঠিক পথেই আছিস। কিন্তু এরপরও তুই আমার নিকট সঠিক পথের সন্ধান চাচ্ছিাস। এই সঠিক পথ বলতে তুই কী বুঝাতে চাচ্ছিস, খুলে বলতো?
নামাজীর জবাব
صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْنَ.
অর্থ: ঐ সব লোকের পথ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ এবং যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট ছিল না।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ সঠিক পথের ব্যাখ্যা চাওয়াতে নামাজী মুসলমান বলছে, হে আল্লাহ, সঠিক পথ বলতে আমি ঐ পথ বুঝাতে চাচ্ছি, যে পথে চলে পূর্ববর্তীরা সফলকাম হয়েছেন এবং অভিশপ্ত বা পথভ্রষ্ট হন নাই। কারণ, আমি তো ইসলাম পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত দেখছি। যেমন-
অলি-আওলিয়াদের অনুসারী দল,
পীরদের অনুসারী দল,
বুজুর্গদের অনুসারী দল,
তাবলীগের অনুসারী দল,
কংগ্রেসী, আওয়ামী, জাতীয়তাবাদী, ওলামাদের অনুসারী দল,
অধ্যাত্মবাদীদের অনুসারী দল,
ইসলামী রাজনৈতিক দলের অনুসারী দল ইত্যাদি।
উপরের প্রত্যেক দলের অনুসারীদের চেহারা ও বেশ-ভূষায়তো ইসলামের অনুসারী বলে মনে হয়। কাউকে কাউকেতো চেহেরা ও বেশভূষা দেখে বিরাট কামেল লোক মনে হয়। আবার কথাবার্তায় প্রত্যেকে দাবি করেন তারাই সঠিক ইসলামের পথে আছেন। তাই আমি কাদের পথ অনুসরণ করব, এ ব্যাপারে ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেছি। এ জন্যে যে পথে চললে সফলকাম হব এবং তোমার গজবে পড়ব না, সেই পথের সন্ধান আমি তোমার কাছে চাচ্ছি।
নামাজীর সঠিক পথ দেখানোর প্রশ্নের জবাবে আল্লাহর উহ্য থাকা উত্তর
আল্লাহ বলছেন, বান্দাহ, ইসলামের নামে বিভিন্ন ভ্রান্ত দল-উপদলের দ্বারা যে ইসলামের ভীষণ তি হবে, তাতো আমি জানি। আর সাধারণ মুসলমানরা যে সঠিক ইসলাম কোন্টি, তা বুঝতে কঠিন সমস্যায় পড়ে যাবে, তাও আমি জানি। এ সমস্যা থেকে উদ্ধারের উপায় হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা। আর এ জন্যেই আমি নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো করেছি
নামাজে সূরা ফাতেহার পর অন্য কোন সূরার বড় একটি বা ছোট তিনটি আয়াত পড়া বাধ্যতামূলক করেছি। যাতে মুসলমানরা কোন মতেই কুরআন ভুলে যেতে না পারে।
সূরা ফাতেহা পরে নাযিল হওয়ার পরও কুরআনে সূরাগুলো সাজানোর সময় সূরা ফাতেহাকে প্রথমে এনেছি।
মুমিনের সব ফরজের বড় ফরজ যে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা তা কুরআন-সুন্নাহের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি।
ইবলিস শয়তানের এক নম্বর কাজ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় গুনাহের কাজ কুরআনের জ্ঞান থেকে দূরে রাখা তাও আমি কুরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি।
আর সূরা আরাফের ৩ নং আয়াতে আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি
اِتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَط
অর্থ: হে লোকেরা, তোমাদের রবের তরফ থেকে যা নাযিল হয়েছে (কুরআন) শুধু তাই মেনে চল এবং এর পরিবর্তে অন্য কোন আওলিয়াকে অনুসরণ কর না।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে মুসলমানদের ল্য করে বলেছেন, এমন এক সময় আসবে যখন ইসলাম পালন নিয়ে মুসলমানরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা শুধু অনুসরণ করবে সেই দলকে, যাদের জীবনের সকল দিক (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি) কুরআন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
সুধী পাঠক, চিন্তা করে দেখুন নামাজে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতেহার মাধ্যমে প্রতিদিন অন্তত ৩২ বার আল্লাহর সঙ্গে আমাদের কী কথোপকথন হচ্ছে। কী অপূর্ব উপায়ে আল্লাহ আমাদের ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মৌলিক বিষয় এবং ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার সব থেকে মারাত্মক উপায় থেকে বাঁচার পথ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে এটি সোজাসুজি বলে দিতে পারতেন। কিন্তু মানুষরা যাতে সহজে বুঝতে পারে, তাই তিনি প্রশ্ন করে কথোপকথনের মাধ্যমে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন।
খ. সূরা ফাতেহা বাদে কুরআনের অন্য অংশ পড়া থেকে শিক্ষা
নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার পর কুরআনের অন্তত একটি বড় আয়াত বা ৩টি ছোট আয়াত অবশ্যই পড়তে হয়। কেন আল্লাহ এ বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাটি করেছেন, তা আজ বিশ্ব মুসলমানদের আবার ভাল করে বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী তাদের কর্মপদ্ধতি শুধরিয়ে নিতে হবে, যদি তারা আবার দুনিয়ায় বিজয়ী হতে চায় এবং পরকালে শান্তিতে থাকতে চায়। ব্যাপারটি ভালভাবে বুঝতে হলে কুরআনে বর্ণিত মানুষ সৃষ্টির গোড়ার কথা থেকে শুরু করতে হবে।
আল্লাহ আদম আ. কে সৃষ্টি করে ফেরেশতাদের এবং জীন-ইবলিসকে তাকে সেজদা করতে বললেন। সকল ফেরেশতা আদম আ. কে সেজদা করল কিন্তু ইবলিস অহংকার করে সেজদা করল না। এতে আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়ে শয়তান হিসাবে ঘোষণা দিলেন। ইবলিস তখন আল্লাহকে বলল, আল্লাহ, আমিও আদম ও তার বংশধরদের ইসলামের পথ থেকে বিপথে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব। আর এই কাজ করার জন্যে ইবলিস দুটো জিনিস আল্লাহর নিকট দাবি করল
১. কেয়ামত পর্যন্ত আয়ু এবং
২. যে কোন স্থানে যাওয়ার এবং যে কোন রূপ ধারণ করার মতা।
আল্লাহ ইবলিসকে বললেন, ঠিক আছে, তোর দুটো দাবিই আমি পূরণ করব। কিন্তু তুই জোর করে বা বাধ্য করে মানুষকে বিপথে নিতে পারবি না। শুধু ধোঁকা দিয়ে তাদের বিপথে নেয়ার চেষ্টা করতে পারবি। আল্লাহ এই কথার পরিপ্রেেিত ইবলিস তার কর্মকৌশল ঠিক করে নিল। সে ঠিক করল, যেহেতু তাকে শুধু ধোঁকাবাজি বা প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর মতা দেয়া হয়েছে, তাই তাকে কাজ করতে হবে, মানুষের বন্ধু বা কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে।
আল্লাহ আদম আ. ও বিবি হাওয়াকে বেহেশতে থাকতে দিলেন এবং একটি গাছের ফল ছাড়া আর যা কিছু ইচ্ছা খেতে বললেন। ইবলিস তার কাজ শুরু করে দিল। সে বন্ধু সেজে আদম আ. এর কাছে গেল এবং বলল আদম, জানো আল্লাহ কেন তোমাকে ঐ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন? ঐ ফল খেলে তুমি ফেরেশতা ও অমর হয়ে যাবে এবং চিরকাল এই বেহেশতে থাকতে পারবে, তাই আল্লাহ তোমাকে ঐ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। এভাবে ইবলিস কল্যাণের কথা বলে আদম আ. কে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করল এবং আদম আ. ও বিবি হাওয়া কল্যাণের কথা ভেবে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পরই কিছু নিদর্শন দেখে আদম আ. বুঝতে পারলেন অন্যায় কাজ করা হয়ে গেছে। তাই সাথে সাথে তাঁরা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বিনীতভাবে মা প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তাঁদের মা করে দিলেন। কিন্তু জানিয়ে দিলেন, তাঁরা আর বেহেশতে থাকতে পারবে না। কিছু সময়ের জন্যে তাঁদের দুনিয়াতে থাকতে হবে এবং সেখানে শয়তানও তাঁদের সঙ্গে থাকবে। শয়তানও দুনিয়ায় তাঁদের সঙ্গে যাবে শুনে আদম আ. ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ শয়তানের ধোঁকা বুঝা যে কত কঠিন, সে অভিজ্ঞতা তাঁর ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। তাই আদম আ. এটা ভেবে মহাচিন্তায় পড়লেন যে, শয়তান যদি পৃথিবীতে যায় তবে তো সে ধোঁকা খাটিয়ে তাঁর সকল বংশধরকে বিপথে নিয়ে যাবে। আদম আ. এর ঐ দুশ্চিন্তা বুঝতে পেরে আল্লাহ বললেন
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِّنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ.
অর্থ: অতঃপর আমার নিকট থেকে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছান হবে। যারা সেই বিধান অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং তাদের চিন্তিত হওয়ারও কোন কারণ নেই। (বাকারা : ৩৮)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ আদম আ. এর চিন্তা দেখে বললেন, তোমার দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আমি কিতাব আকারে যুগে যুগে জীবন বিধান পাঠাবো। তোমার বংশধরদের মধ্যে যারা সেই জীবন বিধান মেনে চলবে তাদের কোন ভয় নেই।
আল্লাহর এ কথা জেনেই ইবলিস মুসলমানদের ইসলাম থেকে বিপথে নেয়ার জন্যে তার এক নম্বর কাজটি ঠিক করে ফেললো। আর তা হলো, মুসলমানদের বিভিন্নভাবে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান থেকে দূরে রাখা। কারণ এটি করতে পারলে বন্ধু বা কল্যাণকারী সেজে, যেকোন কথা বা কাজকে ইসলামের কথা বা কাজ বলে চালিয়ে দিয়ে, অতি সহজে সে মুসলমানদের ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
আল্লাহও ইবলিসের ঐ এক নম্বর কর্মপন্থাকে বিফল করে দেয়ার জন্যে ব্যবস্থা নিলেন। শেষ নবীর উম্মতের জন্যে আল্লাহর সেই ব্যবস্থা হচ্ছে নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার পর কুরআনের অন্তত একটি বড় আয়াত বা তিনটি ছোট আয়াত বাধ্যতামূলকভাবে পড়া। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ নিম্নোক্তভাবে মুসলমানদের শয়তানের এক নম্বর কর্মপন্থা থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করছেন
১. নামাজের বাইরেও প্রতিদিন কিছু কুরআন তেলাওয়াত করার শিক্ষা দেয়া। এর ফলে মুসলমানরা ইসলামের প্রথম স্তরের সকল মৌলিক বিষয় নির্ভুল তথ্য থেকে সরাসরি জানতে পারবে।
২. নামাজে পুনঃ পুনঃ (জবঢ়বধঃবফষু) পড়ার মাধ্যমে মুসলমানরা যাতে কুরআনের বক্তব্য কোনক্রমেই ভুলে যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।
পবিত্র কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬টি। এর মধ্যে কোন্ আয়াতগুলো সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে আল্লাহ সূরা আল-ইমরানের ৭ নং আয়াতে বলেছেন:
هُوَ الَّذِيْ أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِط
অর্থ: তিনিই (আল্লাহ) তোমার প্রতি এ কিতাব (আল-কুরআন) নাযিল করেছেন। এতে মুহকামাত আয়াত আছে। ঐগুলো হচ্ছে কুরআনের মা।
ব্যাখ্যা: মুহকামাত আয়াত হচ্ছে কুরআনের সেই সব স্পষ্ট আয়াত যার অর্থ বুঝা খুব সহজ বা যার অর্থ বুঝতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামের বুনিয়াদী নীতিসমূহ। যথা : আকায়েদ (বিশ্বাস-প্রত্যয়), ইবাদাত (উপাসনা-আনুগত্য), আখলাক (নৈতিকতা-চরিত্রনীতি), ফারায়েজ (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) এবং আমার ও নাহী (আদেশ ও নিষেধ)। এ জন্যে এই আয়াতগুলোকে আল্লাহ কুরআনের ‘মা’ বলে উল্লেখ করছেন।
কুরআনের সূরা ফাতেহার ৭টি আয়াত বাদ দিলে মোট আয়াত সংখ্যা ৬২২৯টি। আর মুহকামাত আয়াতের সংখ্যা প্রায় ৫শ’টি। প্রতিদিনে ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাসহ ৩২ রাকাত নামাজের ২৫ রাকাতে সূরা ফাতেহার পরে অন্য আয়াত পড়তে হয়। প্রতি রাকাতে ১টি বা ৩টি করে আয়াত পড়লেও প্রতি ৭ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মুহকামাত আয়াতগুলো একবার পড়া হয়ে যায়। আর প্রতি ৮৪ থেকে ২৫০ দিনের মধ্যে পুরো কুরআন পড়া হয়ে যায়। চিন্তা করে দেখুন, ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলো সর্বোচ্চ ৭ থেকে ২০ দিনের মধ্যে নির্ভুল উৎসের থেকে পুনঃ পড়ার (জরারংরড়হ) কী অভূতপূর্ব ব্যবস্থাই না আল্লাহ করেছেন! এর মাধ্যমে আল্লাহ এটিই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, মুসলমানরা যেন তাদের জীবন-বিধানের প্রথম স্তরের মৌলিক বিষয়গুলো কোনক্রমে ভুলে যেতে না পারে। ফলে শয়তান বন্ধু বা কল্যাণকামী বেশে এসেও যেন তাদের অন্তত ঐ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনক্রমেই ধোঁকা দিতে না পারে। আর কুরআন ও সুন্নাহের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইবলিস শয়তানের ১ নং কাজই হচ্ছে মানুষকে কুরআনের জ্ঞান থেকে দূরে রাখা।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মহান আল্লাহর এত সব অপূর্ব ব্যবস্থাকে প্রায় ব্যর্থ করে দিয়ে ইবলিস শয়তান তার এক নম্বর কাজে আজ প্রায় ১০০% সফল। এটি শয়তান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে করে নাই। সে তা করেছে কুরআনের জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে প্রত্য ও পরোভাবে জড়িত নানা রকম ধোঁকাবাজিমূলক কথা মুসলমান সমাজ তথা মানুষের মধ্যে চালু করে দিয়ে। সে সকল ধোঁকাবাজিমূলক কথার কয়েকটি পূর্বেই (৩২পৃষ্ঠা) উল্লেখ করা হয়েছে।
নামাজে পড়া তাসবীহ থেকে শিক্ষা
নামাজে পড়া সকল তাসবীহ ও দোয়া নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বইটির কলেবর ছোট রাখা যাবে না। তাই যে তাসবীহটি আমরা নামাজে সর্বাধিক বার পড়ি, শুধু সেটি নিয়ে কিছু আলোচনা করে পুস্তিকাটি শেষ করতে চাই।
নামাজে সর্বাধিক যে তাসবীহটি পড়তে হয় তা হচ্ছে
سُبْحَانَ رَبِّىَ الْاَعْلَى/سُبْحَانَ رَبِّىَ الْعَظِيْمُ.
প্রতি ২ রাকাত নামাজে নামাজী কমপে ১৯ বার سُبْحَانَ তাসবীহটি বলেন। সানায় ১ বার, রুকুতে ৩ বার এবং ২ সিজদায় ৬ বার। অর্থাৎ প্রতিদিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কমপে ২৯৯ বার এই সুবহানা তাসবীহটি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নামাজীকে পড়তে হয়। আল্লাহ কি বিনা কারণে প্রতিদিন ২৯৯ বার এই কথাটি নামাজীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন? না, তা অবশ্যই নয়। কথাটি মুসলমানদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নামাজে দাঁড় করিয়ে তিনি মুসলমানদের মুখ দিয়ে ২৯৯ বার কথাটি বলিয়ে নিয়েছেন। চলুন এবার দেখা যাক, আল্লাহ সুবহানা শব্দটির দ্বারা নামাজীর মুখ দিয়ে কী স্বীকার করিয়ে নিচ্ছেন।
সুবহানা শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পবিত্র। কুরআনে যত আয়াতে সুবহানা শব্দটি আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়- এই শব্দটি দ্বারা আল্লাহ বুঝাতে চেয়েছেন, তিনি শিরক থেকে পবিত্র। তাই তাসবীহটির মাধ্যমে নামাজী আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, আল্লাহ শিরক থেকে পবিত্র। অর্থাৎ নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি নামাজী দিনে ২৯৯ বার অঙ্গীকার করছে যে, বাস্তব জীবনে সে শিরক করবে না। আল্লাহ জানেন, শিরক দুনিয়া ও আখিরাতের জন্যে অত্যন্ত তিকর একটি বিষয়। তাই তিনি প্রতিদিন ২৯৯ বার কথাটি নামাজীর কাছ থেকে স্বীকার করিয়ে নিয়ে এ তথ্যটিই বলতে চেয়েছেন যে, তারা যেন তাদের বাস্তব জীবনে শিরকের গুনাহ থেকে অবশ্যই মুক্ত থাকে।
তাহলে শিরক কী এবং কী কী কাজ করলে শিরক করা হয়, প্রতিটি মুসলমানের এ ব্যাপারে অত্যন্ত পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। শিরক শব্দের অর্থ হচ্ছে অংশীদারিত্ব। তাই আল্লাহর সাথে শিরক করার অর্থ হচ্ছে, যে সব বিষয় শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত, সে সব বিষয়ে অন্য কারো অংশীদারত্ব আছে এ কথা স্বীকার করা অথবা বাস্তবে এমন কাজ করা যাতে বুঝা যায়, ঐ সব বিষয়ে আল্লাহর সঙ্গে অন্যের অংশীদারত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
চলুন এবার দেখা যাক, শিরক কয় প্রকার এবং বর্তমানকালে মুসলমানরা কোন্ কোন্ শিরক কী পরিমাণে করছে-
অধ্যায় ০৬ : নামাজের শিক্ষার শ্রেণী বিভাগ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: