নাম : মো: আইনুল হক
বাবার নাম : মো: হারেস শেখ
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- মহারাজপুর, থানা- মোকসেদপুর, জেলা- গোপালগঞ্জ
পরিবারের মোট সদস্য : ৬ জন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়
সর্বশেষ পড়াশোনা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (এমএসসি, ভূগোল, শেষ বর্ষ)
সাংগঠনিক মান : সাথী (ঢাকা মহানগরী পশ্চিম)
শাহাদাতের তারিখ : ১৫ জানুয়ারি, ১৯৮৮
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আঘাতের ধরন : রাইফেলের বাট, রড, লাঠি
শহীদ আইনুল হক
ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং নিজের স্বৈরাচারী শাসনকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সামরিক শাসক এরশাদ এক ভয়ঙ্কর অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন- সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে গড়ে তুলেছিলেন পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী- 'জাতীয় ছাত্রসমাজ'৷ ওই বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসের কারণে শিক্ষাঙ্গনগুলোর পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হতে থাকে সেই শাসনামলে৷ দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও ওই সন্ত্রাসের বাইরে ছিল না৷ ১৯৮৮ সালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রসমাজের সন্ত্রাসীরা প্রায় একমাস জুড়ে চরমতম সন্ত্রাস চালায়, এ সময় আইনুল হক শাহাদাতবরণ করেন৷
ব্যক্তিগত পরিচিতি ও শিক্ষাজীবন : শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২০তম শহীদ হলেন আইনুল হক৷ শহীদ আইনুল হক ছিলেন গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর থানার মহারাজপুর গ্রামের হারেস মুন্সির ছেলে৷ তিনি তাঁর তিন ভাই ও এক বোনের মাঝে সবার বড়৷ শহীদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি৷ শাহাদাতকালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের এমএসসি শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন৷ ব্যক্তিজীবনে খুবই দক্ষ, সাহসী ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন শহীদ৷
শাহাদাত : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে সরকার ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের শেষার্ধে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ করে দেয়৷ দীর্ঘ ৬০ দিন বন্ধ থাকার পর ১৯৮৮ সালে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেয়৷ সে অনুযায়ী সে বছরের ৭ জানুয়ারি আবাসিক হলগুলো ও ১০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা ছিল৷ কিন্তু সন্ত্রাসী ছাত্রসমাজের কুখ্যাত হামিদ বাহিনী ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সময় ২টি বাস, ১টি মাইক্রোবাস ও ১টি জিপে করে গুলি করতে করতে ক্যাম্পাসে ঢুকে দখলদারি কায়েম করে৷ দখলকৃত ক্যাম্পাসে সশস্ত্র দুবর্ৃত্তরা ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়৷
সে সময় আইনুল হক ও তাঁর বন্ধু হাবিবুর রহমান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে ছিলেন- কঙ্বাজার ও চট্টগ্রাম ঘুরতে ঢাকা থেকে রওয়ানা করে ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম পেঁৗছেছিলেন তাঁরা৷ একদিন চট্টগ্রাম অবস্থান করে পরদিন অর্থাত্ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হন দু'জন৷ এর আগে কখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি তাঁরা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়াদর্ী হলে আইনুল হকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকতেন- হাবীব রেজা৷ বন্ধুর সাথে কথা ছিল- দেখা হবে, সুতরাং যাওয়া৷ কিন্তু তাঁরা ক্যাম্পাসের অবস্থা ঠিকঠিক জানতেন না৷ ক্যাম্পাস যখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দখলে, যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন প্রোভিসি, শিক্ষক সমিতি এবং দশটি সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন সংবাদমাধ্যমে বারবার জানাচ্ছিলেন যে, 'পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক, ছাত্ররা ক্রমশ হলে ফিরে আসছে' ইত্যাদি৷ এসব বানানো গল্পের কারণেই অনেকেই দূরের বাড়ি থেকে এসে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন৷
১৫ তারিখ সকাল এগারোটার দিকে রিকসায় করে ক্যাম্পাসে পেঁৗছেছিলেন দুই বন্ধু৷ টহলরত সন্ত্রাসীদের একদল এসে তাঁদের জোর করে থামায়, সাথে থাকা অর্থ-কড়ি জিনিসপত্র কেড়ে নেয় এবং দু'জনকে আটকে আলাওল হলে নিয়ে যায়৷ তারপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন, রাইফেলের বাট আর রড দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর৷ ৬/৭ জন মিলে তীব্রভাবে মারতে শুরু করে আইনুল হককে, এক পর্যায়ে রক্তাক্ত আইনুল জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান৷ ঘাতকরা তাঁকে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যায়৷ সেই থেকে হাবিব আর তাঁর বন্ধুর হদিস পাননি সামনা-সামনি৷
ওদিকে হাবিবকে আলাওল হলের ২২১ নম্বর কক্ষে একটানা ০৬.০২.১৯৮৮ তারিখ পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে পটিয়ায় নিয়ে গিয়ে ১৭.০২.১৯৮৮ তারিখ পর্যন্ত হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি দিয়ে আটকে রাখে সন্ত্রাসীরা৷ দীর্ঘ ৩৩ দিন পর দুবর্ৃত্তরা হাবিবকে চোখ বন্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম শহরে এনে ছেড়ে দেয়৷ হাবিব ঢাকায় ফিরে আসেন, কিন্তু আইনুলের সন্ধান মেলেনি আর৷ আইনুল হকের জন্য তাঁর পিতা-মাতা, ভাই-বোন হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক তালাশ করেন৷ দুবর্ৃত্তরা যে আইনুল হককে হত্যা করেছে তা নিশ্চিত৷ হাবিব ছাড়া পেয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দেন৷ অবশ্য সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে৷
শাহাদাতের পর পিতা-মাতার অবস্থা : নিশ্চিত ধারণা করা হয় যে, কুখ্যাত হামিদচক্র আইনুল হককে খুন করে লাশ গুম করেছে৷ অকালে পুত্র হারানোর শোকে একদিন শহীদের মা ইন্তেকাল করেন৷ বাবা হারিস মুন্সি এখনও পাগলের মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পীর দরবেশের কাছে ধরনা দেন৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাহাড়ে পাহাড়ে তার সন্তানকে তালাশ করে ফেরেন৷ কিন্তু কেউই আর ফিরিয়ে দিতে পারে না জান্নাতবাসী শহীদ আইনুল হককে৷
0 comments: