অধ্যায় ০৬ : অপপ্রচারের মোকাবেলায়

‘শাইখ! শহরে আমাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই অপপ্রচারের মাত্রা এতো বেশি যে, আমাদের পক্ষে ধৈর্যধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’ একজন যুবক বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয় ও ব্যথাভরা কণ্ঠে হাসানুল বান্নাকে একথাগুলো জানান।

‘এখন আপনি অনুমতি দিন আমরা এই অপপ্রচারকারীদের ওপর পুরোপুরি প্রতিশোধ নিবো।’ ঐ যুবকের আরেক সাথী আবেগ আপ্লুতকণ্ঠে শাইখের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে। এসব কথা শুনে হাসানুল বান্নার ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা ঝিলিক দিয়ে যায়। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, এর মাঝেও কল্যাণকর একটি দিক রয়েছে। আল্লাহতা’লা এরশাদ করেছেন, ‘হে মুসলমানগণ! তোমাদের জন্য জীবন ও সম্পদের পরীক্ষা আসবে। আর তোমরা আহলে কিতাব ও মুশরেকদের কাছ থেকে অনেক কষ্টকর ও তিক্ত কথা শুনবে। এ অবস্থায় তোমরা যদি ধৈর্য ও খোদা ভীরুতার পন্থা অবলম্বন করতে পারো তাহলে সেটা হবে তোমাদের জন্য খুবই সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কাজ।’ (আলে ইমরান-১৮৬)।

অতএব আমাদের কখনোই ধৈর্য ও খোদাভীতির পথ পরিহার করা সমীচীন হবে না। এ দাওয়াতের সত্যতা ও এর শক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ এর বিরুদ্ধে মিথ্যা মনগড়া অপপ্রচার চালাবে। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে আন্দোলনের ব্যাপারে কি কি ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। রাসূলে পাকের (সা.) ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পর্যন্ত কাঁদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। অথচ তিনি এই আন্দোলনের দাওয়াত দেয়ার আগ পর্যন্ত তারা তাকে শ্রদ্ধাভরে বিশ্বাসী ও সত্যবাদী নামে অভিহিত করতো। একজন যুবক কথার মাঝখানে বলে উঠে, কিন্তু এগুলো হলো নতুন ধরনের অপবাদ, এসব ব্যাপারে আমরা তো নিশ্চুপ বসে থাকতে পারি না। এটা নেহায়েতই একটা ভয়াবহ অপবাদ এবং এরা এই অপবাদ ছড়ানো অব্যাহত রেখেছে। ঐ সব লোক এসব অপবাদ ছড়াচ্ছে যাদের কাছে মানুষ দ্বীনি শিক্ষা লাভের জন্য ধাবিত হয়।

হাসানুল বান্না যুবকদের প্রশ্ন করেন, কি সেই অপবাদ? অপবাদদাতারা বলে বেড়াচ্ছে যে, আপনি দরসে আল্লাহর ইবাদত ত্যাগ করে আপনার ইবাদত করার জন্য আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। সুতরাং ইখওয়ানুল মুসলেমুন আপনার নির্দেশনা মোতাবেক এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, শাইখ হাসানুল বান্না মানুষ কিংবা নবী অলি নন, বরং তিনি নিজেই একজন খোদা-যিনি উপাসনা বা ইবাদতের যোগ্য।

হাসানুল বান্না জিজ্ঞেস করেন, এই অভিযোগের কারণ বা রহস্য কি? আমরা আপনার কাছে আসার আগে এ অপবাদের উৎপত্তিস্থলের সন্ধান করে এসেছি। যে ব্যক্তি এ অপপ্রচার চালাচ্ছেন তিনি একজন দ্বীনি আলেম এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ধ্বজাধারী। তিনি যা কিছু বলে বেড়াচ্ছেন, মানুষ সেটাকেই সত্য বলে মেনে নিচ্ছে। আমরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনাকে কে এ কথা বলেছে যে, ইখওয়ানের কর্মীরা হাসানুল বান্নাকে উপাস্য হিসেবে স্বীকার করে? তিনি জবাবে বলেন, আমি নিজের কানে তোমাদের উস্তাদ হাসানুল বান্নাকে এ ধরনের কথা বলতে শুনেছি। আমরা তার জবাব শুনে হতবাক হয়ে গেছি। তাকে আমরা বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু তিনি প্রত্যুত্তরে একই কথা বলে যাচ্ছেন, আমি নিজের কানে উস্তাদকে এ কথা বলতে শুনেছি। আমরা তো তার কথা কখনোই বিশ্বাস করতে পারি না। আমরা সত্যিকার কি ঘটেছে তা জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সত্য কথা হলো, এ লোকদের দুঃসাহস দেখে আমরা বিস্ময়বোধ করছি।

ইখওয়ানদের কাছে এসব কথা শুনে হাসানুল বান্না বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। তিনি ভাবতে থাকেন, মানুষ একে অন্যের বিরুদ্ধে কি করে এমন অদ্ভূত ও অকল্পনীয় মিথ্যাচার করতে পারে। তিনি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখলেন, এই মৌলবী সাহেবের সাথে এ বিষয়ে কোন অনুষ্ঠানে তার এ ধরনের কোন কথাবার্তা হয়নি। সুতরাং হাসানুল বান্না সঙ্গীদের নিয়ে ঐ মৌলবী সাহেবের উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি একই সাথে ইখওয়ানের এমন দুইজন আলেমকে ডাকলেন, যাদের সাথে ঐ মৌলবী সাহেবের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এরপর পাঁচজনে মিলে ঐ মৌলবী সাহেবের বাড়িতে পৌঁছান। তাদেরকে দেখে মৌলবী সাহেবের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় এবং তার চোখে মুখে অস্থিরতার ভাব ফুটে ওঠে। মনে হয় লোকটি এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। চেয়ারে বসার পর হাসানুল বান্না তাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, উস্তাদ সাহেব! এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে আমি এইমাত্র জানতে পারলাম যে, আপনি আমার উপর ইবাদত করানোর অপবাদ দিয়েছেন। আর একথাও বলেছেন যে, এটা আপনি নিজের কানে শুনেছেন। তারা যা বলেছেন, সেটা কি ঠিক।

মৌলবী সাহেব জবাব দিলেন, হ্যাঁ, ঠিক। হাসানুল বান্না মৌলবী সাহেবকে বলেন, তাহলে তাদের দুইজনের অবস্থান তো পরিষ্কার হয়ে গেল।

অর্থাৎ তারা যা বলেছেন সত্য কথাই বলেছেন। উস্তাদ সাহেব, আপনি আমার কাছ থেকে এ ধরনের কথা কবে শুনেছেন? মৌলবী সাহেব বলতে শুরু করেন, আমার মনে হয়, প্রায় মাস খানেক আগে আমরা মসজিদে বসা ছিলাম। এ সময় মোহাম্মদ আল-লাইসী নামের একজন শিক্ষক আমাদের সাথে এসে বসেন। এরপর ইখওয়ান কর্মীরা আসতে থাকেন। তারা খুবই আবেগ আপ্লুত হয়ে আপনাকে সালাম করতে থাকে। এটা দেখে মোহাম্মদ আল লাইসী আফেন্দি বলতে থাকেন, মাননীয় উস্তাদ। আপনার প্রতি ইখওয়ান কর্মীদের ভালবাসা পূজা করার সীমানায় চলে গেছে। আপনি উত্তরে বলেছিলেন, এ ভালবাসা যদি নির্ভেজাল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহলে এতে বলার কি আছে।

আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি করে দেন।

হাসানুল বান্না ঐ মৌলবী সাহেবের কথার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হ্যাঁ, এ ঘটনা আমার স্মরণ আছে। মৌলবী সাহেব নিজের প্রচারণার স্বপক্ষে প্রমাণস্বরূপ বলেন, ‘তাহলে এর পরিষ্কার অর্থ এই নয় কি- এসব লোক আপনার পূজা করে। এ ধরনের কথা বলার সাথে সাথেই হাসানুল বান্নার সাথে আগত ব্যক্তিরা এবং তার বন্ধু ও সহকর্মী শিক্ষক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হন এবং তারই বাড়িতে তাকে পিটানোর জন্য তৈরি হয়ে যান। তারা বলেন, উস্তাদ এতটুকুই তোমার বিদ্যার দৌড়? এটাই তোমার জ্ঞানের পরিধি’, তোমার উপলব্ধির অবস্থা এই, এটা তোমার আলোচনার মজলিসের তোমার আমানতদারী, এটাই কি একের কথা অন্যের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তোমার বিশ্বস্ততা? হাসানুল বান্না তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লোকটিকে ধোলাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন।

তিনি মৌলবী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শিক্ষক সাহেব! আপনিতো একথা অন্যের কাছে প্রচার করে ফেলেছেন। এখন আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, আপনি যেভাবে ইচ্ছা এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করুন। কিন্তু আপনি আমার বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার করেছেন, আমি নিজেই ইখওয়ানীদের আমার ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছি। আল্লাহ রক্ষা করুন। আপনি আরো মিথ্যাচার করেছেন যে, একথা আমার কাছ থেকে নিজ কানে শুনেছেন এবং এটাও বলেছেন যে, ইখওয়ানীরা এ ধরনের আকিদা বিশ্বাসই পোষণ করে। আপনি আমার বক্তব্যের ঐ অংশটুকু কাটছাঁট করে ফেলেছেন, যেখানে আমি মোহাম্মদ আল লাইসি আফেন্দিকে এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্যের ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছি। আমি তাকে একথা বলে দিয়েছিলাম যে, আপনি যা বলছেন, তা ইসলামের পরিপন্থি।

উস্তাদ সাহেব! আপনি ঘটনাতো স্মরণ রেখেছেন কিন্তু আমার বক্তব্য ও সতর্কীকরণকে মুছে ফেলেছেন। যা হোক, আমাদের ওপর আপনার এই যে, অনুগ্রহ এটাই যথেষ্ট। এখন সত্য ঘটনা আলোর মত ফুটে উঠেছে। কিন্তু মৌলবী সাহেবের বন্ধু ও সঙ্গী সাথী ইখওয়ানীরা এতটুকু তিরস্কারেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা দাবি করলেন ইখওয়ানের কোন জমায়েতে নিজের দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন, তা না হলে ছোট বেলায় খাওয়া দুধ কিভাবে নাক দিয়ে বের করতে হয় তাদের তা ভালো করেই জানা আছে। সুতরাং মৌলবী সাহেব বন্ধুদের কাছে নতি স্বীকার করে পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশেই নিজের অপরাধের কথা উল্লেখ করে ঘটনার পূর্বাপর বর্ণনা করেন এবং কৃত অপরাধের জন্য ক্ষশা প্রার্থনা করেন।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম